কবিতা

আর্জি

রাস্তার কল থেকে পানি খাচ্ছে এক কন্যা পথশিশু।

তার হাতে একতোড়া ন্যাতানো ফুলের গোছা।

ঘটনা বলতে এইটুকুই। 

 

আর কোনো গান নেই, আর কোনো 

অভিযোগ নেই কোনোখানে। 

 

সিগন্যাল পড়ে গেলে কন্যাশিশুটি আবার গিয়ে দাঁড়াবে 

আপনাদের অভিজাত গাড়ির কাঁচঘেরা 

কোমল কামরায়। 

 

মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে 

আপনারা হয়তো ন্যাতানো ফুলের আর্জির বিপরীতে বলবেন, 

‘মাফ করো”!

তিল

ধরো তোমার গলায় একটা তিল-

সেই তিলের পাশে শুয়ে আছে স্বর্ণচাঁপা হার;

বিয়ের উপহার।

প্রেশারকুকার সিটি মারছে, স্বামীর অফিস

বাচ্চাগুলো ঘুমায় অকাতরে

তোমার আছে ইয়োগাক্লাশ, হারমোনিয়াম

সাড়ে চারটায় বাঁধা-

তিলটা কিন্তু ঠিকই জানে 

কার বিরহে তোমার গলা সাধা।

গাছেদের পিএইচডি লাগেনা

যে কোনো গাছের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকি। কী দারুন সরলতা নিয়ে তারা বড় হয়। বড় হয়ে আরও বড় হয়। বড় হতে তাদের মাস্টারমশাই লাগে না। চক ডাস্টার হোয়াইটবোর্ড কিচ্ছু কিচ্ছু না! 

স্কুলে যাবার পথে গাছেদের ইভটিজিংয়ে পড়তে হয়না। গাদাগাদা মুখস্থ করার কোনো রেওয়াজরীতি বৃক্ষমহলে চালু নেই। পরিবর্তে তাদের প্রসারিত শাখা সবসময় পাখীদের বসার জন্য অবারিত রাখতে হয়। যে যতো প্রসারিত শাখা নিয়ে দাঁড়াতে পারে, বৃক্ষসমাজে তার মূল্যায়ন ততো বেশি। পাখী ও পতঙ্গকে আকৃষ্ট করতে গাছেদের তাই কতো আয়োজন! গাছেদের সিলেবাসে বৃষ্টিপাত, সূর্যালোক, বায়ুবেগ আছে। রাষ্ট্রচিন্তা নেই – রাষ্ট্রের ধারণাও নেই। তাই গাছেদের পিএইচডি লাগেনা। 

গাছেদের সিলেবাসে মানুষদের নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ অধ্যায় রয়েছে: ‘ক্ষতিকর প্রানীদের হাত থেকে টিকে থাকার কৌশল’ নামে। শিশুবৃক্ষ প্রথমেই সেটা পড়ে নেয়। গাছেরা ‘কুড়ুল দিবস’ পালন করে। আর ভিন্ন তালিকায় রাখে সেইসব গাছেদের নাম, যারা কুড়ুলের হাতল হবার জন্য ঘষেমেজে নিজেদের চকচকে রেখেছ!

হলুদপাতা

একটি হলুদপাতা পথে পড়ে আছে!

পাতার কিনার জুড়ে সংগ্রামের ঘ্রাণচিহ্ন,

মলিন বিভঙ্গ রেখা, নির্দয় সাধনা,

তবু পাতা গর্বভরে 

নিজেকে ব্যপৃত রাখে সমুন্নত সসীম সমাজে!

 

ওই পাতা সংগ্রাম শিখেছে। ওই পাতা 

সংসারবিবাগী।

বিস্মৃতির গুহাগাত্রে হলুদপাতাটি আজ 

মুহ্যমান নিষাদ সন্যাসী!

চোরকাঁটা

আমার কিন্তু ছিলোনা কেউ, কোনোখানে
ওঁৎ পাতিনি, জানো?
আমার সাথে দেখা হয়নি কারো।
কিংবা দেখা হতেও পারে, মুখ মনে নেই
কার ইশারায়, উপেক্ষাতে
হুহু জ্বরে তপ্ত হলাম
সিঁড়ির 'পড়ে বসে রইলাম সর্বহারা
মানো বা না মানো-
আমি একাই ছিলাম, আছি আগাগোড়া
মাঝেমধ্যে দু' একটা হাইফেন-
দুজন মানুষ  জোড়ার ছলে দ্বন্দ্ব সাজালেন! 

সেসব বহু পুরোনো সুর। ওই সুরে কি 
গান করা যায়? গানও
খুঁজে বেড়ায় নিত্যনতুন ছন্দ-ভাষা
মগ্ন এলোচুল-
শাড়ীর পাড়ে বিঁধে থাকুক চোরকাঁটা তীর 
কাঞ্জিপুরম হাসিতে মশগুল।
২৮ আগস্ট, ২০২১
সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা।

আগস্ট ‘৭৫

তারপর নেকড়ের দল
দেয়াল টপকে ঢুকে গেলো
সাদা বাড়িটার
মনোহর চাতালে। যেখানে সবুজ ঘাস, 
মাধবীলতার আশকারায় 
টুনটুনি সংসার পেতেছে। 
কিছু বুঝে ওঠার আগেই 
ওরা ঝাঝরা করে দিলো 
নিস্তব্ধতা। প্রতিবাদের ব্যুহ 
তৈরি হবার আগেই 
বেয়াড়া বুটের আস্ফালনে 
সারিসারি চন্দ্রমল্লিকা 
নুয়ে পড়লো। 

জান্তব আনন্দে ভারী ভারী বুলডোজার 
পিচরাস্তায় গাঢ় দাগ ফেলে 
ফিরে যাবার পরও
একটি পাখি পড়ে ছিলো 
            সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে 
                        অনেকক্ষণ, 
                               রক্তাক্ত, 
                                     একা! 



১২ আগস্ট ২০২১

জাতিস্মর

ধরো বুঁচি, তোমার আমার এখনো বিয়েশাদী হয়নি
কিন্তু হবো হবো করছে- রিকশায় হুড তুলে আমরা দুজন ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক সেদিক পার্কে কিংবা রেস্টুরেন্টে- জনগনের চোখের সামনে বরবউয়ের মতো একজন আরএকজনের মুখে তুলে দিচ্ছি আধিখ্যেতার গ্রাস। চুড়ি কিনতে হাত মুঠোয় নিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি হাতে- বুঁচি, আমার মনে হয় আমাদের এই জিবন ভালো। এই জিবন জিবনের চেয়ে মরনোত্তর! তুমি কী বলো বুঁচি, আমরা কি আবার জন্মাবো?

১৭ মার্চ ২০২১ সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা

ট্রোপোসীমার ৭ছন্দ

১.

ট্রোপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে একা স্বপ্ন দেখে নদী

কোদণ্ড সন্তাপের শেষে টাটকিনা মাছ নাচে

গভীর রাতে বুকের মাঝে তেজকটালের চাপ

কোথায় যেনো বাজছে ব্যকুল

স্যাক্সোফোনের স্বর।

                     নিরক্ষীয় সন্ধ্যা বসে

                     জনযুবতীর চুলে –

আগুন নিয়ে করছে খেলা অবাধ্য সব ভূত!

 

২.

বর্ষাবিহীন ক্লান্তিমাখা পত্রপতন গাছে

একাত্তরের সঙ্গী যখন 

বেশ্যা-কবি-ভাঁড়;

ডায়ামিটার বাড়িয়ে দিলাম গণতন্ত্রের মুখে –

যা বলে যান, বলুন; 

এখন

সবাই সর্বভূক।

 

৩.

বাঘের থাবা বাড়িয়ে আছে অসভ্য স্তন।

চান্দ্রমাসে কন্দকাটা

শিব গিয়েছেন জেলে

                   রসিক, এবার স্যাক্সোফোনে

লাম্বাডা সুর তুলে

গিনেস বুকে অনাহারীর ফর্দ তুলে ধরে!

 

৪.

নি-নেপচুনের চামড়া ছিঁড়ে মিথেন-মদির ধোঁয়া

এইযে আমার কোদাল

আমার কাস্তেরা খঞ্জ না।

 

৫.

তুড়ির শব্দে

তুবড়ি তুলে জ্যান্ত ফুজিয়ামা

জলখাবারের কফির কাপে

মেঘ দ্যাখে সন্তরা।

                      ত্রিশের কবি

                      পঞ্চাশে মেঘ

                      নব্বইয়ে হালভাঙা-

ঊষঢ় দিনেই গজায় ক্ষেতে কন্টিকারীর ছানা।

 

৬.

হামাক্ তু ল্যিয়ে যাবিক্

মারমা গাঁয়ের কাছ্যে

সনঝেরাতের মাদল শুন্যে

চিত্রাহরিণ ডাক্যে!

 

৭.

অবশেষে ক্রান্তি যখন

শিরে ও সন্দ্বীপে-

                          ভাসাও তোমার

                           ক্যান্যু জাহাজ

                           তাহিতি কোন্ দিকে?

ওইখানে সব ওয়াহিন মেয়ে

ওইখানে সব সুখ;

ওইখানে এক মারমা যুবক

                            ণৃতত্ত্ব সন্ধানে-

ট্রোপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে এক

ভিনগ্রহে পৌছাঁবে!

 

প্রকাশ: আমিনুল হাসানের রেখা ও কাব্যে কবিত্রয়, ১৯৯৪

বিশ্বরূপ

 

খড়ের পুতুলের ভেতর থেকে 
সেদিন তোমাকে আমি 
টেনে বার করলাম, আর রাতারাতি 
পৃথিবীটা ভীষণরকম 
নতুন ভাসানে ভরে উঠলো! 

মানুষেরা যার যতো দেনাপাওনা ছিলো
সব শোধ করে 
নতুন মানুষ হয়ে গেলো। গাছপালা
অবশিষ্ট পাতায় বল্কলে
দিব্যি গজিয়ে গেলো নতুন মানুষ!
মোড়ে মোড়ে খুলে গেলো ট্রাফিক জ্যাম।

একবিন্দু বৃষ্টিতে 
বিশ্বরূপ দেখে ফিরলেন অবসন্ন চাকুরিজীবী

যেদিন তুমি প্রথম চুমু পাঠাবে!

৯ জুন ২০২১ সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা

খুন

খুন হয়ে যাবার পর আমি তোমার দিকে 
তাকালাম; পিরামিডের পাশে-
ঝিকিঝিকি আগুনের সূর্যটা ম্লান করে 
তোমার নিঃসঙ্গ সৌষ্ঠব 
অহেতুক আস্ফালনে 
আমাকে বাঘের মতো ফালাফালা 
করে দিলো! 

চেয়ে দেখলাম, পুরোনো পৃথিবীটা 
নগন্য তামার পয়সার মতো নিঃশব্দে 
অস্ত যাচ্ছে তোমার পেছনে!



৯ জুন, ২০২১
সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা