গল্প

দধিমঙ্গল

সুরুজ মিয়া ভাবতেই পারেনি, উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট সাত সকালে এসে তার বাড়িতে হাজির হবে। বাড়ি না বলে এটাকে অবশ্য ডেঁরা বলাই সমীচীন। ভেঙে পড়োপড়ো একটা এক কামরার চালাবেড়ার আস্তানা! তাহার নিচে ডাঁই করে রাখা তার মহামূল্যবান সম্পদ। এর ভেতরে কোনক্রমে সে মাথা গুঁজিয়া ঘুমায় আরকি। সাইরেন বাজাইয়া, দলবল নিয়া, এলাকা তটস্থ করিয়া নয়- প্রেসিডেন্ট সাহেব এসেছেন রিকশাভ্যানে পা দুলিয়ে হালকা শিস্ দিতে দিতে- কালচারাল এ্যাটাশেকে বগলদাবা করে!
এ কেমন আসারে বাবা? এভাবে কোনো প্রেসিডেন্ট আসে নাকি- ছাতা হাতে ছাপোষা উটকো প্রতিবেশীর মতো? কিন্তু কথা এ-ও ঠিক, সুরুজ মিয়াকে বুঝতে হলে- বলা ভালো, ‘সুরুজ মিয়া’ বিষয়টাকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে এভাবেই আসা দরকার। বিচক্ষণ প্রেসিডেন্ট সাহেব তাই করেছেন! না এসে উপায়ইবা কী? পাথর পোষে এমন লোক দুনিয়াতে আছেইবা কটা? তাও যদি একটা দুটো হতো, না হয় মানা যেতো। গুনে গুনে একুশ হাজার দুইশত উনচল্লিশটা পাথরের খামার! খামার বলার কারণ আছে, সুরুজমিয়ার পাথরগুলো সব জীবন্ত। তাদের তদারকিতেই দিন যায় তার। বাইরের লোক ভাববে, কী আর এমন তদারকী? পাথরইতো? খানাখাদ্য, হাগামোতার ব্যাপার তো নাই। থম্ ধরে এক যায়গায় পড়ে থাকা! সুরুজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করো, রাজ্যের কাজের ফিরিস্তি দেবে। পাথরকে নাকি নিয়মিত রোদ খাওয়াতে হয়। অসুখ বিসুখে মাথায় জলপট্টি পর্যন্ত! তা মাথার ইসক্রুপ ঢিলা থাকলে কতো কিছুইনা মানুষ করতে পারে! সেসব কাজের লিস্টি শোনার সময় দধিমঙ্গল গ্রামের লোকদের আছে নাকি? এখন পেঁয়াজ বোনার সময়। শীর্ণকায় পেঁয়াজের অপুষ্ট চারাগুলো মিহিধুল মাটিতে বিঘতখানেক কেবল পুঁতে দিলেই হবে না। তাদের রোদ খাওয়াও রে, ছায়া দাও রে, সেচ দাও রে, আগাছা মারো রে! যেনো ল্যাদাবাচ্চার ঘনঘন কাঁথা পাল্টানোর অবস্থা! মুনিশজন ক্ষেতের সেইসব তত্ত্বতালাফি করতে করতেই সুরুজ মিয়ার খবরাখবর নিজেদের মধ্যে চালাচালি করে। খবরাখবর আর কী, প্যাঁচালের চৌদ্দ আনাই গিবত।

– চুদির বেটার রোয়াবি দেখিছিস? পাথর পুষে কেমন দুনিয়া লয় করে ফেললো গো!

– অক লিয়ে আরও কতো কেচ্ছা হয় দেখে লিস খবিরুল! তোক্ বুইলে দিলাম, ওই পাথরই ওর মহা সব্বোনাশটা করবে!

লোকটা কোনো কাজকর্ম করে না, পাথর ঘষে জীবন পার করে দিলো, খায় দায় মহা ফূর্তিতে আছে, এসব সহ্য করার দায় আছে কারও? কিন্তু সুরুজমিয়াকে আজ পর্যন্ত কেউ কিছু খেতে দেখেনি। চুলো জ্বালার তো প্রশ্নই আসে না। চুলো থাকলে তো জ্বলবে। কারো কারো বিশ্বাস, এই পাথরগুলোর ভেতরে জান আছে। তারা নাকি মিহিসুরে কথা কয়। ভাঙা চালাবেড়ার আড়ে পাতন দিয়ে কেউ কেউ শুনেছে, সুরুজ মিয়া রাতবিরাতে পাথরের সাথে আলিঝালি কথা কয়। তাদেরকে ধমকায়, আদর সোহাগ করে। এসব কিসের আলামত? জ্বিনের নয়তো? আর সেটা ভালো না মন্দ, গ্রামবাসী সেটা ঠিক ঠিক গুছ করতে পারে না। শুরুর দিকে এসব সুরুজের পাগলামীই মনে করে গায়ে পড়ে তার অনিষ্ট করতে গেছিলো, কিন্তু ফল পেয়েছে উল্টো। সুরুজ মিয়ার পাথরে হাত দিয়েছ কি, তোমার কিছু একটা ক্ষতি হবেই। সুইধন বেওয়ার নাতি, যেটা বইছামা হাইস্কুলে আট ক্লাশে পড়তো, সাইকেলে ব্রেকফেল করে ডোবায় পড়ে কী মারাত্মক দুর্ঘটনাই না ঘটালো। তার আগের দিন সে চুরি করেছিলো সুরুজ মিয়ার সবচে প্রিয় পাথর কালাচানকে। পাথরের আবার নাম হয়? আরে বাবা, তোমাদের ওসব নামটাম না হলেও চলে। কিন্তু পাথর যে পোষে, তার কাছে নাম একটা ফ্যাক্টর। কেনো বাপু, তোমরা তো শুনেছি সাইক্লোনেরও নাম দাও। তা সুরুজ মিয়া পাথরে নাম দিলে অসুবিধা কী?

নাতির ওই মরোমরো অবস্থা দেখে সুইধন বেওয়া নিজে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফেরত দিয়ে আসে কালাচানকে। তাকে ফিরে পেয়ে পোষা বেড়ালের মতো কোলে তুলে আদর করতে করতে মিহিস্বরে সুরুজ মিয়া পাথরটাকে শান্তনার সুরে বলে, ভাইঙে দ্যায়েছিছ? মামুর বেটাক একদম খায়ে দিবার পারলু না? এই কথা রাষ্ট্র হবার পর, তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে এমন সাহসী লোক দধিমঙ্গল গ্রামে কটা আছে? অবশ্য একজন আছে, যার সাহসের তুলনা সে নিজে। মীরের হাটের পাতা বিশ্বাস।

তুলারাশির জাতক বলে পাতাখেলার বাজিতে তাকে চাইই চাই। মেসবাউল নামটা তার চাপা পড়ে গেছে পাতা খেলার মূল কারিগরির তলায়। ধান ভুট্টা উঠে যাবার পর লোকজনের বিনুদন ধরো কিছুটা নারীসঙ্গমে আর চায়ের দোকানে পলিটিক্সের আলাপসালাপ মারাতে খরচা হয়। সেটাতো গেলো শরীরের উপর দিয়ে। কিন্তু পকেটে যে বাড়তি টাকা এসেছে, দাদন শোধ করার পরেও বাকিটার সদ্গতি করতে পাতা খেলার আয়োজন করা ছাড়া উপায় কী? খেলা আয়োজনের পারমিশন নিতে হয় উপজেলা পরিষদ থেকে; লিখিত। শাল্টিবাজারের পাশের বিশাল পাগাড়ে লোকজন গায়ে গা ঘেঁষে জড়ো হয়। দূরদূরান্ত থেকে দল ভাড়া করে নিয়ে আসে লোকে। পাতার বাজি জেতার উত্তেজনায় রক্ত টগবগ করে সবার। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে পাতাকে আবিষ্ট করে নিজেদের কোর্টে টানতে পারলেই সেই দল জিতবে। মন্ত্রতন্ত্রের তুকতাক আর কেরিকেচার সাধ্যমত সব দলই করে, কিন্তু পাতা বিশ্বাসকে বশ করা কি এতোই সোজা? একসাথে যে তিন নারীতে উপগত হতে পারে, তাকে ঠান্ডা করার ফিকির কজনইবা জানে? মীরের হাটের নিষিদ্ধ পাড়ার মেয়ে বসিলা, মীনুরানী আর নবিতুন সাক্ষ্য দেয়, পাতা বিশ্বাস আসলেই একটা চিজ! চিকনা মানুষটার গায়ে মোষের শক্তি কিভাবে আসে, যে তিন তিনটা যুবতী মেয়েমানুষকে বিছানায় কব্জা করে ফেলে? কেউ কেউ বলে পাতা বিশ্বাস পাহাড়ি লতাপাতা খেয়ে এহেন যৌনশক্তি সংগ্রহ করেছে। তবে অধিকাংশর ভিন্নমত হলো সুুরুজমিয়ার পাথরের সাথে এর কোনো সংযোগ থেকে থাকতে পারে। বলাটা অমুলক নয়। সুরুজের সাথে একমাত্র পাতারই সামাজিক সম্পর্ক আছে। সাহস করে সে-ই রাত বিরাতে সুরুজের ডেঁড়ায় হানা দেয়। বলে ছাচা, আইজ মীরের হাটের বাজারেত কী হএচে শুইনচেইন? ইয়াব্বড় এক বাঘাইড় মাছ উইটলো, তো কাস্টমার নাই। শেষে হামি ওইঠা কিনা নিলাম হাপনার পাথরের জৈন্ন! এরপর সারারাত তারা চাচাভাতিজা কী করে, কেউ জানে না। তবে সুরুজ মিয়ার ডেঁরা থেকে দুপুররাতে বাঘাড় মাছের সম্ভার দেয়ার সুঘ্রাণে দধিমঙ্গলের বাতাস মইমই করে!

প্রেসিডেন্টের লটবহর এসে পৌঁছালো ঘন্টা খানেক পরে। পোড়ামাটি রঙের লিমুজিনে। মোট আটজন, চারজন সাদা পোশাক আর চারজন কালোয় মোড়া। সাদাদের চারজনের একজন দোভাষী বেশ কায়দা করে স্থানীয়ভাষা প্রেসিডেন্টের জন্য তর্জমা করছেন। তার সোনালী চুল মেয়েদের মতো ঝুঁটি করে পেছনে বাঁধা। প্যাকাটির মতো, শুকনো পাছা দেখলে বোঝা যায় দিনের খুব কম সময়ই ওটা কেদারার স্পর্শ পায়। বকের মতো তুলে তুলে কদম ফেলে সে সবার আগে ঘরে ঢুকলো। রক কাল্টিভেটর সুরুজ মিয়ার ইন্টারভিউ শুরু হলো তারপর। কথা যা বলার দোভাষীই বলছেন। প্রেসিডেন্ট কেবল মিটিমিটি হাসছেন, সম্মতির হাসি। ডিভিক্যামের সামনে অপ্রস্তুত সুরুজ মিয়াকে জেঁকে ধরলো ওরা।

– আপুনি কেমুন কড়িয়া পাতর পালন শিক্কা করিলেন, আমাদিগকে বলুন!

তারপর নিজেই সেটা স্বভাষায় মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অনুবাদ করলেন: Comment as-tu appris à conserver les pierres, raconte-nous! সুরুজ মিয়া যে কী বলে, সেটা সুরুজের নিজের কানেই ঠিকঠাক পৌঁছায় না। পুরো দধিমঙ্গল আজ ভেঙে পড়েছে তার ঘরে। প্রেসিডেন্টের অভিলাষে পুলিশ প্রহরা শিথিল থাকায় কাউকেই ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিরবির করে সুরুজ যা বলে সেটাই বহুগুণ তর্জমা হয়ে ফিরে যায় প্রেসিডেন্টের কাছে। সুরুজ দেখলো, প্রেসিডেন্ট সাহেব তার অতিপ্রিয় সোনাভানকে আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। সে এগিয়ে গেলো। পিছে পিছে দোভাষী। সুরুজমিয়া কুণ্ঠিত হয়ে বল্লে, এই আমার সোনাভান, ও পাঁচমাসের পোয়াতী! শুনিয়া দোভাষীর চোয়াল ঝুলিয়া পড়িলো।

– পাথর পোয়াতী হয়?

– হয়না আবার? কদিন আগে ও ভেগে গিয়েছিলো বসন্ত রক্ষিতের সাথে! দিন দশেক কাটিয়ে এই হাল নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।

– আর বসন্ত রক্ষিত, তাহার কী হইলো?

– ওকে আমি মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলেছি!

– হাসিহাসি মুখ করে প্রেসিডেন্ট তর্জমা শুনলেন। তারপর উচ্ছসিত হয়ে বললেন, J’ai atteint le niveau de fou? এ হামি কোন্ প্রকারের পাগলের পাল্লায় আসিয়া পড়িলাম?

– উপস্থিত দর্শকমন্ডলীর তাহা বোঝার কথা নহে। তাহারা ততোধিক উচ্ছসিত হইলো। রা রা রবে বাতাস প্রকম্পিত করিয়া তারা শুনিয়া যাইতে লাগিলো, সুরুজমিয়া বলিতেছে,

– মানুষ মরিয়া গেলে কেহ হয় ধূলা; কেহ যায় মাটি হয়ে, কেউ হয় শিলা!

– খাঁটি কথা বলিয়াছেন মসিঁউ সুরাজ, অতি খাঁটি কথা!

ওদিকে সুরুজমিয়ার দেহতত্ত্ব বর্ণনা চলছেই: পাথরেরও জান আছে। তারা ভালোমন্দ সৎঅসৎ বোঝে! ওদের হামি সন্তানের মতো পালন করিনু। এই দুনিয়ায় মায়া কাটানো মানুষের জন্য অতি মুশকিল। যারা সেই মায়ায় আটকায় তাদের দিল পাথর হয়ে পড়ে থাকে!

এ কথা শোনার পর প্রেসিডেন্ট সাহেব শোকে মূহ্যমান হয়ে জানতে চাইলেন, তার আটানব্বই বয়সী মায়া কাটানো দাদীআম্মার আত্মা পাথর হয়েছে কিনা। সুরুজ মিয়া তখন নজর তিরচি করে চোখ উল্টে কিছুক্ষণ ভাবলেন। হ্যাঁ, উরুগুয়ের কিছু আত্মার পাথর তার নিকট আছে বটে, তবে খুঁজতে হবে। এই বলে সে তার পাথরের গাদায় হাত ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ বাছাবাছি করার পর ঈষৎ কালচে রঙের চ্যাপ্টা একখানি পাথর টানিয়া আনিয়া প্রেসিডেন্ট সাহেবের সামনে উপস্থিত করিলো। তা দেখিয়া তিনি শোকাকুল হইলেন। আরে, এটা তো সত্যিই দেখিতে তাঁর দাদীআম্মার মতোন! পারিষদবৃন্দও এ কথায় একমত হইলেন, হুবহু দাদীআম্মা! Exactement grand-mère ! বিশেষত গায়ের রঙটা। শুনিয়া প্রেসিডেন্ট কুওইল দিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তার দেখাদেখি পারিষদবৃন্দও যার যার অশ্রু মোচন করিলেন। তাহাদের কান্না হেঁসকি সহযোগে এতোই প্রবল পরাক্রমে চলিতেছিলো, যাহা দেখিলে ইবনে মিজান সাহেব পর্যন্ত বলিতেন, নাটক বেশী হয়ে যাচ্ছে লেদু, কাট্ কর্! অবশেষে সেই প্রস্তরীভূত দাদীআম্মার আত্মাকে বগলদাবা করিয়া প্রেসিডেন্ট সাহেব সত্তর দধিমঙ্গল ত্যাগ করিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রিবিউন আর পোঁ-দেঁ এক্সপ্রেসে এই সংবাদ বেশ ফলাও করিয়া সুরুজ মিয়ার ছবিসহ ছাপা হইলো: Des imbéciles dans la maison des imbéciles!

তার কিছুদিন বাদে পাতা বিশ্বাস নিখোঁজ হইলো। কেহ বলে সে দূরদেশে যাইয়া আর একটি নিকাহ্ করিয়াছে, কিন্তু গ্রামবাসীর অনেকেরই সেটা বিশ্বাস হয় না। বিশেষত বসিলা, মীনুরাণী আর নবীতুনের কাছে এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল সুরুজ মিয়া মাঝরাতে চিৎকার করে শাসায়, আহ্ পাতা, জ্বালাতন করিছ না তো, এ্যানা রাত্তিরে তোর জৈন্ন হামি বাঘাইড় মাছ পাবো কোটে?

তার পাথরশালায় সম্প্রতি সবুজ রঙের নতুন একটা পাথর যুক্ত হয়েছে!

ছায়াহীনা

পর্ব ১.

তারপর নারকোল ছোবড়ার দড়ি কেটে সবাই ধরাধরি করে আমার দেহটা মাটিতে নামালো! আদ্দিকালের পুরোনো বিল্ডিং; চুণসুড়কির গাঁথুনী আর কড়িবড়গাওলা বিশাল শোবার ঘর। তিনমানুষ সমান খাড়া কড়িবড়গার নিচে একমানুষ সমান লোহার মোটা রডের সাথে ঝুলছিলো গাবদা চেহারার এক কলের পাখা। আর আমি ঝুলছিলাম সেই পাখার সাথে পেন্ডুলামের মতো- নারকোল ছোবড়ার দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে। পায়ের নিচে কাত হয়ে যাওয়া চেয়ার। আমার পাদুটো অনিয়ন্ত্রিতভাবে কিছুসময় খিঁচুনি দিলো। ঘাড়ের কাছে মট্ করে উঠলো। জিভটাও বোধহয় বেরিয়ে গেলো কিছুটা… তখন দরজায় ধাক্কা টের পেলাম। আমার মনটা আকুলি বিকুলি করে ডাকলো, ওগো, তোমরা এতোক্ষণে টের পেলে! জলদি এসে আমায় উদ্ধার করো।

কিছু একটা দিয়ে কপাটের কব্জা খসিয়ে হুড়মুড় করে ওরা সবাই ঘরে ঢুকলো। আমার জ্ঞাতিভাশুড়ের হাতে একটা খোন্তা। আরও দুচারজন সমর্থ পুরুষের সাথে আমার স্বামীও আছেন। ইশ্ আমার আঁচল খসে গিয়ে পুরো নাভি উন্মুক্ত। এভাবে কোনোদিন ওঁদের সামনে যাবো চিন্তাও করিনি। আজ মরণের পাড়ে এসে কী যাচ্ছেতাই কাণ্ড! আমার স্বামী উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে দৌড়ে এসে আমার পাদুটো নিজের বুকে চেপে ধরলো। হাহাকার করে ফুঁপিয়ে ডাকলো, এ কী করলে মীরা? আমি মিটিমিটি হাসছিলাম। বেশ হয়েছে এখন, বৌ ছাড়া পুরুষমানুষ কতো অসহায়! আমার স্বামীর চোখের জলে আমার পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে। ওগো, আমাকে নামাও সোনা আর কষ্ট দেবোনা তোমায়। এর চেয়ে কষ্ট আর কী দেবে মীরা? আর দেবোনা, এবার দড়ি কাটো! একটু সবুর করো, ওরা মই আনতে গেছে! সেই মই এনে ওরা আমার দেহটা নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। নীলরতন কবিরাজ যতোটা না ডাক্তার, তারচেয়ে বেশি অভিভাবক আমাদের। কালো চামড়ার ব্যাগটা পাশে রেখে একটা মিক্শচার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তিনি আমার স্বামীর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালেন। বিরবির করে বললেন, ঘরের লক্ষ্মীকে অযত্ন করলি রে হারামজাদা!

আমি বেশ মজা পেলাম। আমার স্বামীকে কেউ বকাঝকা করলে ভালো লাগে আমার। তিনি মিক্শচারটা খাওয়ানোর চেষ্টা করলের আমাকে। আক্ষেপে মাথা নাড়লেন। আমি তার হাত আঁকড়ে ধরে বললাম, ডাক্তারকাকা আমি মরিনি!

তিনি ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হনহন করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ঘরভর্তি মানুষের সামনে আমার স্বামী দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বুকে তুলে নিলেন। এই, কী শুরু করেছ? আমি মৃদু বকুনী দিলাম। আসলে ওর বুকে আদর খেতে আমার ভালোই লাগছিলো। আর ফাঁস দেয়ার আগে যতো যা-ই অবিশ্বাস অভিমান থাকুক না কেনো, এখনতো আমি জানি, আমার স্বামী কত্তো ভালোমানুষ! ওকে শান্তনা দিতে তাই বললাম, আমি মরিনিগো, কান্না থামাও। অবিশ্বাস নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। সেই চোখ, সেই ঠোঁট। ভ্রূর কাটা দাগটাতে কতো পুরুষালী আমার স্বামী। ভাবতেই শরীরের ভেতর কেমন করে উঠলো! আমি সবার সামনেই ওর বুকে মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললাম, সবাইকে একটু যেতে বলোনাগো, আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে! আমার স্বামী চমকে উঠে বললেন, মীরা, দিনেদুপুরে এসব কী কথা? একটু লাগছে এখন, আসোনাগো, আমি চোখে আমন্ত্রণ নিয়ে বললাম। আমার স্বামী বিরক্ত হলেও অমত করলেন না। আর তাছাড়া একটু আগে ফাঁস নিয়ে মরতে যাওয়া বৌয়ের আবদার কে ফেলতে পারে? আমরা ওটা করলাম। বলা ভালো আমি করলাম। উদ্দাম, উন্মাতাল, লাগামছাড়া! তারপর থেকে আমার স্বামী কেমন যেনো হয়ে গেলেন। চুপচাপ থাকে। অবশ্য আগেও চুপচাপই ছিলো। সারাদিন ব্যাবসায় নিয়ে ব্যস্ত! রাতে শুতে এসে আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে কেমন করে যেনো তাকায়! বড্ড মায়া লাগে আমার। আহা ভালোমানুষটা!

দিনতিনেক পর ছায়া কলঘরে বাসন মাজতে গিয়ে একটা কাণ্ড ঘটালো। ছায়া আমাদের কাজের ঝি। আমার বিয়ের আগে থেকেই এ বাসায় আছে! সন্ধ্যার দিকে একগাদা বাসন মেজে পাকঘরের দিকে আগাতে গিয়ে চিলেকোঠার দিকে তাকিয়ে ও বাবাগো মাগো বলে ঝনঝন করে বাসন ফেলে বারান্দায় এসে মূর্ছা খেয়ে পড়লো। আমার স্বামী দৌড়ে গেলেন। আমিও। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে মুখে ফেনা তুলে ছায়া যা বললো, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। চিলেকোঠায় সে নাকি আমাকে বসে থাকতে দেখেছে! হ্যাঁ, ছাদের ওইখানটায় উঁচু পাঁচিলে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝে আমি বসে রোদে চুল শুকাই। কখনো জোৎস্নারাতে বা অন্ধকারে একা বসে গুনগুন করতে আমার ভালোই লাগে! কিন্তু এখন তো আমি শোবার ঘরে। ছায়া কী করে আমাকে চিলেকোঠায় দেখলো? আমি যতোই বোঝাই, সে মাথা নেড়ে অবিশ্বাসের সুরে চেঁচায়। ও নাকি সত্যিই আমাকে দেখেছে, চুল খোলা, উলঙ্গ!

এ পর্যায়ে আমার মেজাজ চড়ে গেলো! বাড়ির কাজের মেয়ে হয়ে, এসব কী অলক্ষুণে কথা! আমি আমার স্বামীর কাছে নালিশ জানালাম, কতো বড় মুখ হয়েছে মেয়েটার! আমার স্বামী ওকে পরদিন সকালেই টাকাপয়সা দিয়ে বিদায় করে দিলেন! মেয়েটা যেনো বেঁচে গেলো। তারপর কয়েকদিন ধরে আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম, আমি কেনো গলায় ফাঁস দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে পড়লো না। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কেনো মরতে গিয়েছিলাম বলোতো? মৃদুল, মানে আমার স্বামী গম্ভীর মুখ করে বললেন, সুখে!

পর্ব ২.

আমার সৎমা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আপন মায়ের মতো। সত্যি বলতে কি, নিজের মাকে আমার সেভাবে মনেও নেই। তাই মাঝে মাঝে মনে হতো সৎমাই আমার মা। আমাকে স্নান করাতো, খাওয়াতো, চুল বেঁধে দিতো। তারপর যখন ছোট বোনটা হলো, সারারাত ট্যা ট্যা করে জ্বালিয়ে মারতো। ছোট হাতে আমি মাকে সাহায্য করতাম। কাঁথা পাল্টে দিতাম। বোনের জন্য একটু হিংসা হোতো, মায়ের কোলটা দখল করেছে বলে। আবার ভালোও লাগতো। কী কচি কচি হাত পা আঙুল নাড়ছে। সৎমা একদিন আমাকে স্নান করাতে নিয়ে গেলো। আমি খুবই খুশি হলাম। অনেক দিন পর মা সাবান ঘষে আমাকে স্নান করালো। তারপর পুকুর ঘাটের শেষ ধাপে বসে সৎমা আমার মাথাটা পানিতে চুবিয়ে ধরে রইলো বুকের সব বাতাস বের হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত! এরপর নিজেই মড়াকান্না জুড়ে দিলো, ওগো তোমরা কে কোথায় আছো শিগগির এসো, আমাদের মিনি জলে ডুবে যাচ্ছে!

জলেডোবা কাউকে কলস উল্টে তার ওপর উপুড় করে শোয়ানো হয়। আমাকেও সেভাবেই শোয়ানো হলো। মুখ দিয়ে অনেক জল বের হয়ে যাবার পর ক্ষিতিশকাকা আমার দুই পা ধরে উল্টোকরে ঝুলিয়ে বেধড়ক ঝাঁকুনি দিতে আমার শ্বাস ফিরে এলো। বেঁচে গেলাম আমি। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আমার আপন মাকে স্বপ্নে দেখতাম। মা মাথার পাশে বসে হাত বোলাতে বোলাতে আমার কষ্ট দূর করে দিতো।

বাবা ছিলেন ছাত্র-অন্ত প্রাণ শিক্ষক। জগত প্রলয় হলেও তিনি গা করার মানুষ নন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনেপয়সায় ছাত্র পড়িয়ে রাত করে বাড়ি ফিরতেন বাবা। নোংরা নোংরা গালি হজম করে না খেয়ে গুটিশুটি মেরে বিছানার এককোণে শুয়ে পড়তেন। তারপর আরও চাপা আক্রোশ আর হিসহিস অভিশাপ অভিযোগে সৎমায়ের কণ্ঠের খরখরে আক্ষেপ শুনতে পেতাম। তার কিছুটা বুঝতাম, বাকীটা বুঝেও না বুঝে থাকতে চাইতাম। ওই ঘটনার পর থেকে সৎমা আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাতো, কিংবা তাকাতোই না। তার চোখেমুখে আমি অনিশ্চয়তা দেখেছি। কেমন ভয়ে ভয়ে তাকাতো। মিনিট দশেক জলের নিচে ঠেসে ধরার পরেও যে পুঁচকে মেয়েটি বেঁচে যায়, তাকে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক! শুধু সৎমা কেনো? এলাকার অনেকেই আমাকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে কিসব যেনো বলাবলি করতো। পড়ালেখায় ভালো ছিলাম বলে বাবা আমাকে না পড়িয়ে পারলেন না। আমি ইউনিভার্সিটির পড়তে গেলাম। ওইসময় আমাদের পরিবারে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। বছরে একবার আমি বাড়ি যেতাম, মনসা পূজার সময়। আমাদের বাড়িতে মনসা মন্দির ছিলো। খুব ধুমধাম করে পূজা হতো। একবার গেলাম না। চিনি, মানে আমার ছোটবোনটা সেইবার পুকুরে ডুবে মারা গেলো। ও ছিলো ঠিক আমারই বয়সী, যখন আমি জলে ডুবে গিয়েছিলাম। এই ঘটনার পর আমার সৎমা উন্মাদ হয়ে গেলেন। সারাদিন পেটিকোট ব্লাউজ পড়ে পুকুরঘাটে বসে থাকে আর বিরবির করে।

ভার্সিটির গণ্ডী পার হবার আগে আগে মৃদুলের সঙ্গে পরিচয় হলো। তার আগে অনেকেই আমাকে মন দিতে চেয়েছিলো, আমি নেইনি; আবার ফিরিয়েও দেইনি। তাদের অনেকেই বাবার ছাত্র, এবং যোগ্য। নোট দেবার ছুতায়, বাড়ি থেকে পাঠানো এটাসেটা ডেলিভারি দেয়ার উছিলায় তারা ঘন্টার পর ঘন্টা হলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করতো। আমার ইচ্ছে হলে দেখা করতাম, নাহলে করতাম না। ছেলেগুলোর জন্য মায়া হতো অবশ্য। তবু কেনো তাদের কাউকেই আমার মনে ধরলো না, সে এক গভীর রহস্য। কিন্তু সেসব নিয়ে জল্পনা করে কোনো লাভ নেই। মৃদুলকে আমার মনে ধরেছিলো শ্রেফ ওর ভ্রূর কাটা দাগটার জন্য। মৃদুলের সবকিছুই তখন আমার কাছে ভালো লাগতো। ও হাসলে, রাগ করলে, বা মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে থাকলেও আমি নির্বাক ওর দিকে চেয়ে থাকতাম। এমনকি ও ঘুমিয়ে থাকলে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে আমি আবছা আলোয় মৃদুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। বিরবির করে বলতাম কে তুমি? কেনো এসেছ আমার জীবনে? কী চাও?

ছোটবেলায় সাপের খেলা দেখাতে বেদের দল আমাদের পাড়ায় আসতো। রাজ্যের ছেলেপুলেরা দল বেঁধে ওদের পিছু নিতো। আমিও নিতাম। হাঁটুঢাকা ফ্রক পড়ে আমিও সবার সাথে গোল হয়ে বসে ওদের সাপখেলা আর জরিবুটি বিক্রির নকশাবন্দী দেখতাম। শক্তপোক্ত চেহারার এক বেদে চ্যাপ্টা কাঠের বাক্সের ভেতর থেকে নানা জাতের সাপ বের করে গলায় পেঁচিয়ে খেলা দেখাতো। বাচ্চারা মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিতো। একসাথে সাত আটটা সাপ ঘাড়ে গলায় কোমরে পেঁচিয়ে লোকটা মুখের ভেতরে টরটর টরে টরে বলে একধরনের বিদঘুটে শব্দ করতো। মাথার বাবরিচুল চূঁড়ো করে বাঁধা, আর বাহুতে শীবের উল্কী! আমার লোকটাকে সুপারহিরো মনে হতো। কিন্তু লোকটার সাথে সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর তিনচারটা বেদেনী মেয়েদের দেখে হিংসায় আমার বুক জ্বলে যেতো। বিড়ি খেতো ওরা, একজনের মুখেরটা অন্যজন। আর বাংলা উর্দুর মিশেল দেয়া এক ভাষায় কথা বলতো। যার কতকটা বোঝা যেতো। ঠারেঠারে ওই বেদেপুরুষের সাথে অনেক অশ্লীল ভঙ্গী করতো মেয়েগুলি। তাদেরও চুল চূঁড়ো করে বাঁধা আর খাটো ব্লাউজে আটসাঁট আটপৌড়ে ছাপাশাড়ী। আমার খুবই রাগ হতো ওই ন দশ বছর বয়সেই। কেনো হতো, তার ব্যাখ্যা আমার কাছে তখন ছিলো না। এই এতো বছর পর, বিবাহিত সংসারের বেডরুমে গভীররাতে আচমকা জেগে উঠে বিদ্যুচ্চমকের মতো আমার মৃদুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো, আরে, এ তো সেই লোকটা! ঘাড়ে গলায় কোমরে নানাজাতের সাত আটটা সাপ জড়ানো বেদেপুরুষ! অবিকল সেই মুখ, ভ্রূর কাটা দাগটা পর্যন্ত!

আমি স্বামীকে জাগালাম না। কিন্তু সে নিজেই নিঃশব্দে চোখ খুললো। একদম অবাক না হয়ে বললো, এখনো দেখা শেষ হয়নি?

আমি হিসহিস করে বললাম, কে তুমি! বলো, কে তুমি? আমার স্বামী নির্লিপ্ত গলায় বললো, ঘুমোও, একটু পরেই ভোর হবে!

পর্ব ৩.

অশরীরীদের কোনো ছায়া থাকে না! ছোটোবেলায় এমন বদ্ধমূল বিশ্বাসের পেছনে কারণ ছিলো। গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার পাশে শ্যাওড়াগাছ পার হয়ে সন্ধ্যার পর কেউ তেমন চলাফেরা করতো না। প্রয়োজনে দুগ্রাম ঘুরে যেতো। কেননা, অদ্ভুতভাবে প্রতি বছর ওই স্থানটিতে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটবেই। একবার শশধরের (যার ডাকনাম ছিলো শসা!) গাভীন গরুটা মরে গেলো। দিব্বি ছিলো, ঘাস খেতে খেতে শ্যাওড়াগাছের নিচে এগিয়ে গিয়ে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মরে গেলো। শসার আহাজারী দেখে কে? আর একবার গাছের তলায় বাইরের অচেনা একটা লোককে ছুরিমারা অবস্থায় উল্টো হয়ে মরে পড়ে থাকতে দেখেছে গাঁয়ের লোক। পুলিশ এসে নিরাপরাধ শংকরকে ধরে নিয়ে গেলো। পরে পেপারে উঠলো শংকর জালটাকা চক্রের সদস্য ছিলো। এইসব অপঘাত মৃত্যুর পর গাঁয়ে কিছু কানাঘুষা রাষ্ট্র হতো অযথাই। সেসব কথা ডালপালা ছাড়িয়ে শেষমেষ নিরীহ গাছটির ওপর গিয়েই বর্তালো। আর আমরা যারা ছোটো ছিলাম, বড়দের ঠারঠার কথার কারণে অজানা আতঙ্কে অনেককিছু এড়িয়ে চলতাম। যেমন, বাড়িতে অচেনা কোনো লোক বা বয়ষ্ক কোনো ভিখিরী এলে কিংবা একতারা হাতে বাউল এসে গান ধরলে আমরা প্রথমে সন্দেহের চোখে তাকে মাপতাম। চোখ গোল করে দেখতাম মাটিতে তার ছায়া পড়ে কিনা। কারণ তারাতো ওই শ্যাওড়াগাছের সামনের মাটির রাস্তা দিয়েই হেঁটে এসেছে! আর অশরীরীরা তো এভাবেই মানুষের বেশ ধরে আসে! তাদের চেনার সহজ পন্থা হলো, মাটিতে ছায়া পড়ে কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া। ছেলেবেলার সেইসব রহস্যময় দিনগুলি বড় হবার সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়। এখন গ্রাম বদলে গেছে। রাস্তা চওড়া আর পাকা করতে গিয়ে শ্যাওড়াগাছের সেই ছায়াছায়া শান্তি কবেই নেই হয়ে গেছে! নতুন পিচঢালা সেই রাস্তা ধরে গাড়ি হাঁকিয়ে আমি আমার বাবার বাড়িতে এলাম। বিয়ের দশদিনের মাথায় দ্বিরাগমনে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে, আমাকে তাই স্বামীসহ আসতেই হলো। মৃদুল কোনো ত্রুটি রাখেনি। অনেক ধুমধাম আড়ম্বরেই আমি বাড়িতে পা রাখলাম। কখনো ভাবিনি আমার জিবনটা এমন সুখের হবে। আমার যদিও আসার একদমই ইচ্ছা ছিলোনা, কারণ বাড়িতে সৎমা, তা আবার উন্মাদ। কিন্তু মৃদুলের মা, মানে আমার শ্বাশুড়ি জোর করে পাঠালেন।

বর দেখতে পুরো গ্রাম উপচে পড়লো আমাদের বাড়িতে। সবাই ওর খুব প্রশংসা করছিলো। এলাকার ছেলেরা- যার ভেতরে আমার প্রেমপ্রার্থীও দু একজন ছিলো- তাদের চোখে একধরণের সমীহ দেখেছি আমি। মৃদুল আসলে সমীহ করার মতোই একজন মানুষ। মার্জিত, হাসিখুশি, রূচীশীল। নতুন জামাইকে নিয়ে এ যাত্রায় অনেকগুলো ছোটোছোটো অনুষ্ঠানের রেওয়াজ আছে। তার অন্যতম হলো দশপিঠা। দশধরণের পিঠা দশবাড়ির বৌঝিরা বানিয়ে জামাইকে খাওয়ায়। বৃদ্ধা দিদিশ্বাশুড়ীরাও তখন রগড় ঠাট্টা মশকরায় শামিল হন। গ্রামের মেয়ে বৌরা মৃদুলকে জেঁকে ধরলো। বয়ষ্ক বৌদিরা আবার রেখেঢেকে বলতে জানে না। মৃদুল খুবই শান্তভাবে তাদের মশকরা শুনছিলো। হাসিমুখে তাদের ‘পিঠাপিঠির অত্যাচার’ সহ্য করছিলো। কিন্তু মেয়েগুলোর ওকে নিয়ে আদেখলেপনা আমার সহ্য হচ্ছিলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো একটা সিন ক্রিয়েট করি। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করলাম। তবে তারপর থেকে মাসখানেক মৃদুলকে আমার কাছে ঘেঁষতে দিলাম না। এই একমাস আমার নাঁকিকান্না আর ঘ্যানঘ্যান সে সহ্য করলো। পরে আমি ভেবে দেখলাম, কী কারণে এতো রাগ করলাম। কিছুই পেলাম না। মৃদুলকে আমার খুব দুষ্প্রাপ্য কিছু মনে হয়নি এতোদিন। ওর প্রতি কমিটমেন্ট ছিলো, আকর্ষণও ছিলো তীব্র। ব্যাস ওটুকুই। নেকুনেকু প্রেমে গদগদ আমি কখনোই ছিলাম না। কিন্তু গ্রামের মেয়েগুলোর চোখে যে হিংসা আর লোভে চকচক কাড়াকাড়ি আমি দেখেছিলাম- সেটাই আসলে আমার রাগের কারণ। মনে হচ্ছিলো, আমার স্বামী বুঝি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে! তারপর থেকে শুরু হলো রাত জেগে একা একা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা! মৃদুল প্রথম দিকে টের পায়নি। একদিন পেলো। আমার চোখ থেকে একফোঁটা জল ঝরে পড়লো ওর গালের ওপর। মৃদুল ঘুম ভেঙে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। তারপর বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কী হয়েছে, কী হয়েছে মীরা? কিন্তু আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তীব্র আবেগে কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। বাকিরাত মৃদুল আমাকে বুকে নিয়ে জেগে রইলো। শেষরাতে তন্দ্রার ভেতর আমার মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।

আমার শ্বশুরবাড়িটি যৌথ। বনেদিও বটে। চক মেলানো বিশাল বারান্দার নকশাদার সাবেকি বিল্ডিং। আমার দাদাশ্বশুরের নিজহাতে বানানো এই বাড়ী। শুনেছি তিনি ইংরেজদের কন্ট্রাকটর ছিলেন। বাড়ির পেছনের পুকুরটি কেটে সেই মাটিতে ইট পুড়িয়ে বানানো হয়েছে ইমারতটি। আমার শ্বশুরের কোনো আপন ভাইবোন ছিলোনা। ব্যবসা সামাল দিতে জ্ঞাতিগোষ্ঠী এনে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন বাড়িতে। তাদেরই সন্তান সন্ততি মানে আমার স্বামীর কিছু জ্ঞাতি ভাইবোন এখন থাকে বিশাল বাড়িটির নিচতলায়। আর আমরা থাকি দোতলা তিনতলা মিলিয়ে। সবাই মৃদুলকে অত্যন্ত ভালোবাসে, মান্য করে। বয়সে বড় দুই দাদা আছেন, তাঁরাও মৃদুলকে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখেন। আর সবার মুখে মৃদুল ছোটবাবু। শুনেছি বড়বাবু ছিলেন আমার শ্বশুর সাহেব। এমনই চলছিলো এতোদিন। আমি একদিন প্রাইভেসির প্রশ্নে নিচতলার সিড়ির মাঝখানে একটা লোহার গেট লাগালাম। মৃদুল একটু আপত্তি করছিলো। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ির কাছে ভোট না পেয়ে রাজি হয়ে গেলো। এখন আলাদা সিড়ি, আলাদা গেট। দোতলায় কেবল আমি আর আমার শ্বাশুড়ি। আগে নিচতলার ওরা হুটহাট ওপরে চলে আসতো। কিন্তু গেট হবার পর সেসব বন্ধ।

তিনতলাটা আসলে দখল করে আছে মৃদুলের শতশত কবুতর। তাদের গুপ গুপ আওয়াজ ভরদুপুরে অদ্ভুত শোনায়। আমি কবুতরের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করি, ওরা যেনো কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। কিন্তু সেটা ধরতে পারিনা। হঠাৎ একদিন মৃদুলের শার্ট কাচতে গিয়ে একটা মেয়েলি পারফিউমের ঘ্রাণ পাই। এই ঘ্রাণ আমার পরিচিত নয়। মৃদুল কখনোই এসব মাখে না। তাহলে কার? আমি মন খারাপ করে চিলেকোঠার চাতালের পাশের সিঁড়িতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে ভাবি। মৃদুলকে আমার সন্দেহ হয় না। আবার খুবই সন্দেহ লাগে মৃদুলকে। কারণ ওই চোখের আমন্ত্রণের যে যাদু, সেটা আর কেউ না হোক, আমিতো জানি। মৃদুলকে হারাবার একটা অজানা ভয় আমার শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোতের মতো বয়ে যায়!

পর্ব ৪

আমি অনেক দেরিতে কথা বলা শুরু করি। মায়ের এজন্য চিন্তার শেষ ছিলোনা। শুকনো সরু সরু হাত পা আর বড় বড় দুটো চোখ মেলে আমি কেবল ড্যাবড্যাব করে সবকিছু নির্বাক তাকিয়ে দেখতাম। আমার তখন তিনবছর বয়স। সবাই ভেবেই নিয়েছে আমি আর কথা বলবো না। আমার প্রিয় খাবার ছিলো ডাব নারকেল। একদিন গাছ থেকে অনেক ডাব পাড়া হয়েছে কিন্তু কাটা হচ্ছে না। আমি ড্যাবড্যাব চোখে ব্যাপারটা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করলাম। তারপর অধৈর্য হয়ে মুখ ফুটে বললাম, ডাব খাবো! একসাথে দুটো শব্দ!!

আমার মা রান্নাঘরে হেলেঞ্চা শাক বাছছিলো, কথা শুনে বটি কাত করে দৌড়ে এলো, আরে আমার মিনি দেখি কথা বলে! তারপর কী আদর কী আদর। কথা ফুটে যাবার পর শুরু হলো আর এক যন্ত্রণা। আমি সারাদিন বকবক করতে লাগলাম। এমনকি ঘুমের ভেতরেও। আমার বকর বকরে লোকজন অতীষ্ট হয়ে যেতো। এতো কথা বলতে পারে পুঁচকে মেয়েটা। আশেপাশের প্রতিবেশীদের বাড়িতে আমার ছিলো অবাধ যাতায়াত। বয়ষ্ক মহিলারা ছিলো আমার সই। তাদের সাথে পান খেতাম আর পাকা পাকা কথা বলতাম। সকালের দিকে পাড়া বেড়াতে নামতাম, দুপুর হলে বলতাম সই, ভাত খেয়ে আবার আসছি! কাণ্ড দেখে সবাই হাসাহাসি করতো আমাকে নিয়ে। মা যখন ভাই আনার জন্য হাসপাতালে গেলো, আমার রুক্ষু চুল তেল দিয়ে আঁচড়ে বেনী করে দিয়ে গেলো। বললো আমি কালই এসে পড়বো, তুমি কাকীর কাছে লক্ষী হয়ে থেকো। তা আমি তো এমনিতে খুবই লক্ষী! কাঁসার বাটিতে খেজুরগুড়ে মুড়ি মেখে দিলে কব্জি ডুবিয়ে হাপুস হুপুস খাই, আর বেড়ালের লেজ ধরে টানি! মা পাশের বাসার কাকীকে বলে গেলেন আমাকে যেনো রাতে ঘুম থেকে তোলা হয়, না হলে তো বিছানা ভাসাবো! কাকী মাকে আস্বস্ত করলেন, একটা রাতেরইতো ব্যাপার, তুমি চিন্তা কোরোনা বড়দি। মা ফিরে এলো একদিন বাদে। আমি সইয়ের সাথে গল্প করছিলাম। মা এসেছে শুনে দৌড়ে গেলাম খালপাড়ে। মা কোথায়? হোগলা দিয়ে মোড়ানো মাকে দুতিনজন নৌকা থেকে তুলে আনলো! তারপর বাঁশের খাটিয়ায় তুলে বোল হরি, হরি বোল বলে তারা চলে গেলো শ্মশানঘাটের দিকে। আমার বকরবকর বন্ধ হয়ে গেলো, সাথে খাওয়াদাওয়াও। ড্যাবড্যাব চোখে কেবল নির্বাক তাকিয়ে থাকতাম। চোখ দিয়ে জল ঝরতো খালি, কোনো শব্দ হতো না!

মাসখানেক পর, আমার অবস্থা দেখে প্রতিবেশিরা বাবাকে পরামর্শ দিলেন বাড়িতে লোক আনার। সংসার কে সামলাবে? পুরুষমানুষ ঘরের লোক ছাড়া কিভাবে থাকে? তাছাড়া মেয়েটাকে তো বাঁচাতে হবে, ওর যত্ন করার কে আছে বাড়িতে। বাবা মৌন থেকে সম্মতি দিলেন। কাঁচাপাকা চুলে টোপর পড়ে সৎমাকে ঘরে তুললেন। আমার সইদিদিরা চোখে আঁচলচাপা দিয়ে নিহার নিহার বলে কাঁদলেন! নিহার আমার মায়ের নাম। আমি কাঁদলাম না। পাশের বাসার কাকী হিসহিস করে চাপাস্বরে বললেন, একবৌকে খেয়েছে, এখন আবার আর একটা! আমি অতোটা বুঝলাম না। তবে আমার মা যে বিনা চিকিৎসায় মরেছে সেটা বুজলাম। কিন্তু বিয়ের পরেও বাবার খাসলতে কোনো পরিবর্তন এলো না। সেই ছাত্র পড়ানো, সেই সমাজসেবা, সেই রাত করে টর্চহাতে বাড়ি ফেরা। সাথে যোগ হলো নতুনমায়ের চিল চিৎকার। আমি ভয়ে জড়োসরো হয়ে কাঁথায় মুখ ঢেকে থাকতাম।

*****

বিয়ের বছর ঘুরে যাচ্ছে কিন্তু কোনো নতুন সংবাদ না শুনতে পেয়ে এলাকাবাসী আছে বেজায় দুঃশ্চিন্তায়। আমার শ্বাশুড়ি তার ছেলেকে বৌ নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার পরামর্শ দেন। কিন্তু মৃদুলের তখন ব্যবসার ভীষণ চাপ। নতুন একটা প্লাস্টিক ইমালশন বাজারে ছাড়া হয়েছে। অনেকটাকা লগ্নী করা হয়েছে এ্যাডভার্টাইজিং আর প্রোমোশনের জন্য। এ অবস্থায় ছুটি নেয়া অসম্ভব। মৃদুল তার ভেতরেও সময় বের করে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। চারদিকে চা বাগান আর মাঝখানে টিলার ওপর ছোট্টো কটেজে প্রথম দুটো দিন আমাদের আনন্দ নির্জনতা আর অন্তরঙ্গতায় কেটে যায়। খুব বেশী ঘোরাঘুরি হয়না আমাদের। যে উদ্দেশ্যে এসেছি, সেটাতে পূর্ণ মনযোগ দেই। আমাকে ইমপ্রেস করতে মৃদুল যথাসাধ্য চেষ্টা করে। তৃতীয়দিন রাতের খাবার শেষে লাল শাটিনের রাতপোশাকে আমাকে দেখে মৃদুলের চোখে ফের ঘোর লাগে। তাড়া দেয় ঘুমুতে যাবার। আমি জানি, ঘুম নয়, তার প্রত্যাশা অন্যকিছু। আমারও। কিন্তু একটা বিষয় মনের ভেতর খচখচ করছে। মৃদুল আমাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে ঘাড়ে গলায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। অস্ফুটে বলে, আমার লাল কবুতর! আমি একহাতে ওর চুলগুলো খামচে ধরতে গিয়ে টের পাই মৃদুলের হাত আমার নাইটির ভেতরে। দমবন্ধ অবস্থার ভেতরেও আমি নিজেকে ভেসে যাওয়া ঠেকাই। মেয়েটা কে, মী? মৃদুলের হাত থেমে যায়, কোন্ মেয়েটা? আমি একপাক ঘুরে ওর মুখোমুখি হই, মিষ্টি করে হেসে বলি, মী, তুমি জানো কার কথা বলছি। মৃদুল হাসে, ওহ্ সেই পারফিউমওয়ালী! আরে ও তো প্রোডাক্ট বেচতে অফিসে এসেছিলো! আমি না-বুঝ বালিকার মতো হাসি। এতো ঝটপট উত্তর তখনই দেয়া সম্ভব, যখন সেটা আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়। আহ্, মৃদুল যদি আর কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র দেরি করতো উত্তরটা দিতে, কিংবা না বুঝতে পারার অভিনয় করে জানতে চাইতো, আমি কার কথা বলছি! মিথ্যে বলা একটা আর্ট, সবাই পারেনা। মৃদুল কেনো মিথ্যেটা গুছিয়ে বলতে পারলো না, এই দুঃখে আমার মনটা কুঁকড়ে গেলো। মৃদুল আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, কী কাণ্ড বলো, এক ডজন পারফিউম গছিয়ে দিয়ে গেলো মেয়েটা। আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট। লতিফকে বলেছি শোরুমে রাখতে, যদি কেউ কেনায় আগ্রহী হয়! আমি তীর্যক চোখে মৃদুলকে দেখলাম। একদম নিখুঁত। এতোটা কোনো পাকা অভিনেতাও পারবে না। কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, তোমার জামা থেকে ভুরভুর করে ঘ্রাণ আসছিলো তো! মৃদুল মাথা নাড়লো, হ্যা, মেয়েটা বলেছে ধুয়ে ফেলার পরেও নাকি ঘ্রাণ থেকে যায় কাপড়ে। তাই টেস্ট করলাম! এ কথা শুনে বুক থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেলো যেনো! ইশ্ আমার স্বামীটা নেহাৎই ইনোসেন্ট, আর তাকে নিয়ে আমি কিনা সন্দেহ করি! অনুশোচনায় মুহুর্তেই আমার শরীর সাড়া দিয়ে উঠলো! আমার স্বামীর হাতদুটো আবার সচল হলো। আমি দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম ওকে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো আমরা খুলে নিলাম একে অন্যের বসন। আর আদিম মানব মানবীর মতো বিশুদ্ধ শরীরী প্রেমে সিক্ত করলাম দুজন দুজনকে। চরম পুলকের মূর্ছনায় আমাদের বিছানাটা একটা উড়োজাহাজের মতো টেক অফ করলো শেষ মুহূর্তে!

পর্ব ৫

হানিমুন থেকে ফিরে আসার পর আমার শ্বাশুড়ি আমাকে আশির্বাদস্বরূপ একটা রূপোর টাকা দিলেন। যাকে বলে চাঁদি! পাকিস্তান আমলের।আমি যত্ম করে সেটা সিঁদুরের কৌটায় উঠিয়ে রাখলাম। মৃদুল অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার ব্যবসার কাজে। রাত করে বাড়ি ফেরে, কোনো কোনো দিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। আমার কেমন ভয়ভয় করে। কিন্তু ভয়টা যে কিসের, সেটাই বুঝিনা। ইদানিং তিনতলায় একা একা সময় কাটাই। একদম একা নই অবশ্য, শ খানেক কবুতরের সাথে। ওদের দেখাশোনা করার আলাদা লোক আছে। কবুতরগুলো মহানন্দে ছাদময় ঘুরে বেড়ায়, কট কট করে ভূট্টা খায় আর গুপগুপ করে ডাকে! আমার পায়ের শব্দ পেলে ওদের গুপগুপ বেড়ে যায়। আমি কানখাড়া করে বুঝতে চেষ্টা করি ওরা কী বলছে, কিন্তু ধরতে পারিনা। কিছু একটা যে বলছে, এবং সেটা বলছে যে আমাকেই, এটা আমি বেশ বুঝতে পারি। মৃদুলকে বিষয়টা জানাবো ভাবছিলাম। কিন্তু সে এটা শুনে হাসবে ভেবে আর বলিনা! খাবার টেবিলে আচমকা একদিন প্রসঙ্গটা তুলি। সুজাতার স্বামীর হার্টে পাঁচটা ব্লক ধরা পড়েছে শুনেছ? আমার স্বামী খুব বড় রকমের চমকে যায়। কোন্ সুজাতা? সে খেই ধরতে জানতে চায়। যে তোমাদের বাড়িতে থেকে এইচএসসি দিয়েছিলো। তোমার ফুলপিসির ননদের মেয়ে না জানি কী। ওহ্, তা তুমি কার কাছে শুনলে? ছায়া বলেছে। আমি অকপটে স্বীকার করি। কিন্তু বাকিটা বলিনা। মৃদুল চোখ সরু করে তাকায়। ছায়া বলেছে? আর কী বললো? বলেনি, ওর সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো? হা বলেছে তা ও; তবে আমি সেটা বিশ্বাস করিনি! বললাম ঠিকই, কিন্তু মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো।

রাতের আলো নিভিয়ে দেবার পর মৃদুল আমাকে আদর করতে করতে অহেতুক সুজাতার প্রসঙ্গ তুললো। জানো, মেয়েটা চায়নি এখানে বিয়ে হোক, আরও পড়তে চেয়েছিলো। ওর পরিবার জোর করে চাপিয়ে দিলো। কিন্তু কোনো লাভ হলোনা। অল্প বয়সে বিধবা হলো। শুনে আমি বরফ হয়ে যাই। আমি কখনো বলিনি সুজাতার স্বামী মারা গেছে! মৃদুল কি করে জানলো? আমার মাথাটা ঘুরছে। মৃদুলকে সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুতে চাইলাম। কিন্তু যে পর্যায়ে সে আছে, সেটাকে বলে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। ওখান থেকে ফিরে যাওয়া যায়না। অগত্যা নিজের অনিচ্ছায় ওর ভোগের সামগ্রী হিসেবে নিজেকে সঁপে দিতে হলো। সে রাতে মৃদুল খুব জান্তবভাবে আমাকে নিলো। আঁচড় কামড়ের একপর্যায়ে কি সুজাতা বলেও ডাকলো আমাকে? আমি নিশ্চিত নই। হয়তো মনের ভুল, হয়তো নয়। পরদিন সকালে বিধ্বস্ত আমাকে বারবার সরি বললো মৃদুল। জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। আমি ক্ষমা করে দিলাম। মাকে হারানোর পর থেকে আমার মাথার ওপর ছায়া দেবার মতো কেউ ছিলো না। বাবা স্বার্থপরের মতো তাঁর নিজেরটা দেখেছেন। সারাটা জিবন আমার গেলো ছায়া খুঁজতে খুঁজতে। অনেক আশায় আর তীব্র ভালোবাসায় মৃদুলকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ফুলশয্যার রাতে তাকে বলেছিলাম, তুমি শুধু আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে থেকো! কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, আমার সেই ছায়া ক্রমশ সরে যাচ্ছে। কিংবা আমি একটা বড় চক্রান্তের শিকার। কাউকে কিছু বলার নেই, কিছু বোঝাবার নেই। তাহলে এখানে আমি থাকবো কেনো? এ সংসারে আমি কে? সারাদিন বিছানায় শুয়ে মাকে মনে করে কাঁদলাম। সন্ধ্যায় আমার জন্য একটা চমৎকার শাড়ী নিয়ে এলো মৃদুল। পরদিন সেই শাড়ী পড়ে আমি নারকেল ছোবড়ার দড়ি দিয়ে ফাঁস নিলাম!

কিন্তু কী কারণে আমি ফাঁস নিয়েছিলাম, সেটা একদমই মনে পড়ছে না আমার। ছায়া না থাকায় কাকেইবা জিজ্ঞেস করি? আর মৃদুল ওই ঘটনার পর কেমন যেনো চুপসে গেছে। কথা একদম বলেই না। খাওয়া দাওয়াতেও ভীষণ অনিয়ম। আমি কথা বললে চুপ করে মাথা নিচু করে থাকে, উত্তর দেয়না। মনে হয় সে নিজেকে দোষী ভাবছে।আমি দিনের অধিকাংশ সময় তিনতলার চিলেকোঠার সামনের ছাদে বসে কাটাই। দুপুরবেলা সেদিন সিঁড়িতে শব্দ শুনে বুঝলাম কেউ ছাদের দিকে আসছে। আমি একটু আড়ালে চলে গেলাম। মৃদুল মোবাইলে কথা বলতে বলতে উঠে এলো। কবুতরের দানা হাতে নিয়ে ছাদময় ছড়িয়ে দিলো। সব কবুতর কার্নিশ থেকে লাফিয়ে নেমে গুপগুপ করে দানা খাচ্ছে। হঠাৎ সে অবাক হয়ে গেলো, মোবাইলে বললো, একটু হোল্ড করো। তারপর নতুন একটা কবুতরের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাল কবুতর। এটা তার ঝাঁকের কবুতর নয়। কিভাবে এলো? মৃদুল তড়িঘড়ি নিচে নেমে গেলো। আমি ওর কাণ্ড দেখে হাসলাম। নিজের কবুতর চিনতে পারছে না।

মাসখানেক পর আমার শ্বাশুড়ির ঘরে মৃদুলকে কথা বলতে শুনলাম। প্রসঙ্গটা যে কী নিয়ে সেটা বুঝতে পারছি না। তবে মা ছেলের দ্বন্দ্বটা পরিষ্কার। মৃদুল বলছে, হলে এখানেই হবে, না হলে নাই। তার মা বলছে, সে এ বাড়ীর যোগ্য নয়। মৃদুল পাল্টা উত্তর দিলো, একবার তো তোমাদের সম্মানরক্ষা করলাম, লাভ হলো কিছু? কার কথা বলছে বুঝতে পারছি না। তবে আমার শ্বাশুড়িকে এভাবে দ্বিমত করতে দেখিনি কখনো। বিয়ের পর বৌভাতের দিন উনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি এই বংশের সম্মান রেখেছ; আশির্বাদ করি সুখী হও! এখন মনে হচ্ছে ওই কথাটার ভেতরে একটা রহস্য ছিলো, যেটা আমি তখন বুঝিনি। ওই ঘটনার কিছুদিন পর বাড়ীতে একটা সাজসাজ রব পড়ে গেলো। হলুদ দেয়ালে চূনকাম পড়লো। আশপাশে সাফ সুতরো করা হলো, জানালায় লাগলো নতুন পর্দা! মৃদুল অনেকরাত করে বাসায় ফেরে আজকাল, তার গা থেকে ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে নাক ডাকে। আমি ওর বুকের ওপর একটা হাত রেখে সন্তর্পনে শুই, যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখি ওর ঘুমন্ত মুখটা।

একদিন খুব ভোরবেলা মৃদুল উঠে পাঞ্জাবী পড়ে বের হয়ে যায়। অনেক লোকজন নিচতলায় জড়ো হয়েছে। তিনচারটা গাড়ি করে ওরা চলে যায়। আমি তিনতলার চিলেকোঠায় কবুতরদের গুপগুপ দানা খাওয়া দেখি। হঠাৎ একটা কবুতর বলে ওঠে। বরকনে এলো বলে, বরকনে এলো বলে! আমি স্পষ্ট শুনলাম। ওরা এটা কেনো বলছে? একটা কবুতর এসে আমার মাথায় ঠোকর মারলো। আমি ভয় পেয়ে দোতলায় নেমে আসলাম। হঠাৎ দেখি বাড়ীভর্তি অনেক লোকের হইচই। শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে কাদের যেনো ওপরের ঘরে আনা হচ্ছে। এতো লোকের কথার কারণে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ভীড়ের ভেতরে উঁকি দিতে দেখলাম মৃদুল। মাথায় টোপর পড়া, বরবেশ। পাশে কনেবেশে সুজাতাকে চিনলাম। যদিও কখনো দেখিনি, তবু আমি এখন জানি এ সুজাতা। নিশ্চিত জানি। কারণ আমি কবুতরের সব কথা বুঝতে পারি!

বরকনে আমাদের বেডরুমের দিকে যাচ্ছে। আমার আর সহ্য হলো না। তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে এসে ওদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম। মৃদুল, কোথায় যাচ্ছো? তোমার পাশে এ কে? আমাদের বেডরুমে কী চায়? মৃদুল আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ঘরে ঢুকলো। আমি প্রাণপণে পেছন থেকে ওদেরকে আটকাতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। মৃদুল ঘরে ঢুকে সুজাতাকে সহ দেয়ালের দিকে গেলো। আমার হাসিহাসি মুখের বড় একটা ছবি টাঙানো দেয়ালে। কাঁচের ওপর চন্দন দিয়ে সাজানো। একটা শুকনো মালা পড়নো ফটোফ্রেমে। আরে, এ ছবিটা এতোদিন চোখে পড়েনি কেনো? আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার হাতের ছোঁয়ায় সিঁদুরের কৌটাটা পড়ে গিয়ে রূপোর টাকাটা ঝনঝন শব্দ তুললো। সবাই চমকে ফিরে সেদিকে তাকালো। কে একজন এসে আমার ফটোটা খুলে নিচ্ছে। আমি দৌড়ে বারান্দার নেমে এসে আমার শ্বাশুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ঝংকার তুলে বললাম, এসব কী হচ্ছে মা, আপনার ছেলে কাকে নিয়ে এসেছে? আমার শ্বাশুড়ি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ফটোটার দিকে তাকিয়ে কাকে যেনো বললেন ঠাকুরঘরে নিয়ে রাখতে। সবাই চুপ করে আমার কান্না দেখছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিকেলের রোদ আমার গায়ে পড়েছে, কিন্তু কোনো ছায়া পড়েনি মেঝেতে! কে যেনো বললো, এই নতুন লাল কবুতরটাকে তাড়া তো, ঘর নষ্ট করবে! (সমাপ্ত)

বাহিরউদ্দিনের বেগুনক্ষেতে এলিয়েন

ফ্লাইং সসারটা নামার আর জায়গা পেলো না? নামবি তো নাম একদম বাহিরউদ্দিনের বেগুনক্ষেতে! ফাজিল একটা! আগামি হপ্তায় কুঁকড়ির হাটে বেগুন বেচার কথা। ফড়িয়ারা আগাম কিছু টাকাও দিয়ে গেছে। বেগুন এবার বাম্পার ফলেছে। বেগুন বেচে একটা নয়া ‘সমার্ট’ ফোন কেনার ইচ্ছা ছিলো, তা বোধহয় আর হলো না। গরু তাড়ানোর পাঁচৈনটা বাগিয়ে বাহিরউদ্দিন সসারটার দিকে তেড়ে গেলো।

– এই, এই হারামজাদারা, তোদের আক্কেলজ্ঞান নাই? আমার জমিতে নামলি কেন্? এটা কি তোদের বাপদাদার সম্পত্তি মনে করছিস?

ডুরালুমিনে তৈরি হালকা নভোযানটার গায়ে রাগের চোটে পাঁচৈনের এক বারি বসিয়ে দিলো বাহিরউদ্দিন। ব্যঙঙঙ করে শব্দ হলো। সসারের সাইডে ছোট গোলাকার জানালার মতো কাঁচঘেরা একটা হ্যাচ। সেটা খুলে বাটকু মানুষের মতো দুজন এলিয়েন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে লাফিয়ে নামলো। 

– সরি সরি সরি, বাহিরভাই। আন্তরিক দুঃখিত! আমরা এখানে নামতে চাইনি। সসার ক্রাশ করেছে। প্লিজ আমাদের ভুল বুঝবেন না!

– ভুল! আমার বিশ হাজার টাকার ফসল তোদের ফাজলামির কারণে বরবাদ হলো, আবার বলছিস ভুল? বলে ওদের পাশেই সসারের ডানার ওপর পাঁচৈনের আর একটা ঘা বসিয়ে দিলো! ক্ষতিপূরণ দে, অক্ষণ দিবি…

– দিচ্ছি দিচ্ছি উত্তেজিত হবেন না।… আর দয়া করে আমাদের এতো মূল্যবান সসারটার এগারোটা বাজাবেন না। (তাদের ঘড়িতে ১২টা নেই, তাই সেটা বাজে না)

বাহিরউদ্দিনের তখন খেয়াল হলো। পাঁচৈনের বারি লেগে সসারের গায়ে লম্বা দাগ পড়ে গেছে! এমনিতে দেখতে আহামরি কিছু না। মনে হয় জিঞ্জিরার বাতিল জিনিস। পুরো বডি জং ধরে চলটা উঠে গেছে। অনেক আঁকিবুকিতে পুরোনো রংটাও বোঝা যাচ্ছে না। চাকু দিয়ে কারা যেনো নিজের নাম লেখার চেষ্টা করেছে সসারের গায়ে। একজায়গায় লেখা কমি+গন্। এরা কারা? প্রেমিক প্রেমিকা মনে হয়। নামদুটোর ওপরে হার্টের সিম্বল! তাহলে এলিয়েনরাও প্রেম করে! 

কিন্তু বাহিরউদ্দিনের এখন প্রেমপিরিতি নিয়ে ভাবার সময় নেই। সে তাচ্ছিল্য নিয়ে বাটকু মানুষদুটোর দিকে তাকালো। খুবই করুণ বেশভূশা ওদের। না আছে স্পেসস্যুট, না অত্যাধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস। মানুষের সাথে একটাই শুধু পার্থক্য, লোকদুটো লম্বায় মাত্র চারফিট। এমন কেনো? বাহিরউদ্দিনের ঢ্যাঙা শরীরের পাশে ওদেরকে খুবই বেমানান লাগছে। সে একটু দয়া বোধ করলো, পাঁচৈনের বারি মারা উচিত হয়নি। বেচারা এলিয়েন হলেও মানুষ তো! আরি, ওরা কি মানুষ আসলে, না অন্যকিছু?

– এই তোমরা কি মানুষ? তুই থেকে তুমিতে উঠলো বাহিরউদ্দিন। বাটকুদুটো হাসলো। খ্যানখ্যান করে। 

– ইয়েস, উই আর মানুশ, বাট নট হিউম্যান বিয়িং। উই আর এলিয়েনবিয়িং। আর আমরা মানুশ লিখি তালব্য শ দিয়ে। রেস্ট অব অল, সেইম টু সেইম! আমাদেরও গেস্টিক হয়, আমরাও সিডএ্যান্টা খাই…

শুনে বাহিরউদ্দিনের মেজাজ কিছুটা ঢিলা হলো। সসারটার সামনের দিকে আঁকাবাঁকা করে বাজে হাতের লেখায় সস্তা রং দিয়ে লেখা- ‘এলিয়েন ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস, পুরারাম টু ঘাটসদর, ভায়া বাগশাহ’। নিচে ছোট করে লেখা- ‘ব্যবহারে ধংশের পরিচয়’! এদের বানান ভুলটা আর শোধরালো না। 

– কী আশ্চর্য! তোমাদের গ্রহেও রামপুরা সদরঘাট, এসব আছে?

– থাকবে না কেনো? আপনাদের যাযা আছে, আমাদেরও তাই তাই আছে! বলে ক্রেডিট নেয়ার ভঙ্গী করলো এলিয়েনদুটো। তারপর বললো, 

– আমাদের গ্রহ ঠিক আপনাদের মতোই। তবে উল্টা এবং কম কম। বেঁচে থাকতে আমাদের বেশি কিছু লাগেনা। এই যেমন ধরেন আমাদের গ্রহে ঠিক আপনার মতো একজন মানুশ আছে, তার নাম ভেতরউদ্দিন। তিনি নগুবে চাষ করেন!

– তাই? বলেন কী!!! বাহিরউদ্দিনের চোখ কপাল ছাড়িয়ে চাঁদিতে ওঠার জোগাড়। সেইসাথে তুমি থেকে আপনিতে সে নিজেই উঠে গেলো।

– তা নগুবের কেজি কতো?

– জিকে! মানুশরা সংশোধন করলো। আমাদের নগুবে আমরা গোরুকে খাওয়াই- মানে রুগোকে খাওয়াই! আপনাদের বেগুনের মতো অতো টেশ না। মুখ চাটলো এক নম্বর মানুশ। 

এই কথার পর বাহিরউদ্দিনের মাথাটা কেমন ঘুরান্টি দিলো। শালা কোনো গ্রহেই শান্তি নাই দেখছি! তার নিজের ক্ষেতেও বাঁধাকপি টমেটো বা মূলার অতিরিক্ত ফলন হলে বা ইন্ডিয়ার আমদানি বাড়ার কারণে বাজারে দাম কমে গেলে, তারা তখন গোরু ছাগলকে খাওয়ায় ঠিকই- কিন্তু এরা তো দেখছি এমনিতেই খাওয়ায়। নাকি তাদের গ্রহে ইন্ডিয়া নেই? জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলবে য়ান্ডিই আছে। বাহিরউদ্দিনের তাই প্রশ্নটা করার সাহস হলোনা। হঠাৎ তার মনে হলো, আরি এরা সব বাঙলায় কথাবার্তা বলছে কেনো? ইংরেজি কি বাদ হয়ে গেলো? আজিবন দেখে আসছে (সিনেমায়) এলিয়েনরা ইংরেজিতে কথা বলে, দাঁত মাজে! সেটা কি মিথ্যা তাহলে? জানা গেলো, এই পৃথিবীর সকল ভাষার মধ্যে নাকি একমাত্র বাংলাটাই ওদের মনে ধরেছে। শুনে বাহিরউদ্দিনের ছাতি চওড়া হয়ে গেলো। সসারটা তার বেগুনক্ষেত নষ্ট করেছে, সেই দুঃখ কিছুটা হলেও কমলো তাতে। পাঁচৈন বগলে চেপে সে লুঙ্গিটা জুৎমতো কাছা দিলো। তাই দেখে দ্বিতীয় মানুশ বললো-

– বাহিরভাই, এই জিনিশটা আমাদেরও পরতে মন্চায় – গিলুং, কিন্তু বেল্ট ছাড়া কোমরে আটকাবো কিভাবে সেটা নিয়ে কনফিউচ!

– না না এইটা পড়ার চেষ্টা না করাই ভালো, ডেঞ্জারাস পোশাক! একটা দুর্ঘটনা- সারাজিবনের কান্না!তাই শুনে মানুশ দুজন খ্যাং খ্যাং করে হাসলো।

– জব্বর হাসাইলেন বাহিরভাই, আমাদের গ্রহের ভিতরউদ্দিনও আপনার মতো রসিক মানুশ! একদিন কী হয়েছে জানেন, ভিতরভাই ‘মঝি’ মেরে, মানে ঝিম্ মেরে বসে আছে, আমরা তাকে জিগাইলাম- ভিতরভাই, কী ভাবেন? সে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, আমি ভাবি…আমি ভাবি… যে আমি কী ভাবি!!! হাহাহা, মজা না?

এর মধ্যে মজা কোথায় বাহিরউদ্দিন ভেবে পেলো না। এই শালার তাড়ছেঁড়াগুলোর সাথে বাহাস করতে গেলে বেলা পড়ে যাবে।

– বাহিরভাই, ঠিকই ধরেছেন, আমার নাম তারছেঁড়া আর ওর নাম তারজোড়া।বাহিরউদ্দিনের পেটের মধ্যে কলজেটা একটা গোত্তা খেয়ে স্থির হয়ে গেলো! এরা তার মনের কথা টের পেলো কিভাবে? 

– এই তোমরা মানুষের মনের কথা টের পাও?

– তা একটু আধটু পাই। শুধু মনের কথাই না, আমরা তোমাদের পেটের কথাও টের পাই

– ক্কিহ?

– জ্যা! এইজন্যইতো তোমাদের প্লানেটে আসা। কথা কিনতে এসেছি আমরা, মানুষের পেটে আর মাথায় দিস্তা দিস্তা কথার আড়ত। আমাদের গ্রহে কথার খুব দাম। ১৭০০ টাকা জিকে!

– স-তে-র-শো? বলো কী?… সরি বলেন কী? বাহিরউদ্দিন আর ভাবতে পারছে না। অথচ তার বেগুন বিকোয় মাত্র সতের টাকা কেজি! 

-ঠিকই বলেছি। তাই সবাই ওজন করে বা মেপে কথা বলে। সবাই সবার কথাও রাখে!

বাহিরউদ্দিনের এবার বিষম খাবার জোগাড়। সামান্য কথার এতো দাম। তাও আবার বিক্রি হয় কেজি দরে? এ কেমন দুনিয়া? সে তাঁরছেড়াকে জিজ্ঞেস করলো,

– তা তোমাদের গ্রহের নাম কী?

– পৃথিবী। তবে আমরা উল্টো করে ডাকি বীথিপি!!! 

 

(চলবে।… তবে না ও চলতে পারে; বীথিপির মানুশদের কথা নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না) 

#অবৈজ্ঞানিক_কল্পকাহিনী

হাত ধরো, মায়াবতী

হাত ধরো
পর্ব ১: শুভ-ইভেন্ট
 
মায়াবতীকে প্রোপোজ করে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ভুলে ওর সেজোফুপিকে পাঠিয়ে দিয়েছি! 
 
এখন আমার মাথা আউলাঝাউলা। 
প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে আমি এখন লাইটপোস্টের নিচে বসে আছি। ইচ্ছা ছিলো কোনো গাছের নিচে ল্যাটকা দিয়ে বসার, কিন্তু ঢাকা শহরে তেমন গাছ কৈ? তাই ফুটপাতে লাইটপোস্টের নিচে বসেই আপাতত কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। এবং আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভাসছে সামনে কী কী ঘটবে, সেইসব ভয়াবহ দৃশ্য! উহ্ কী মারাত্মক! মায়াবতীর সেজোফুপি, মানে আমার ‘না-হোনেওলা বুয়া-সাঁশুমা’ – যাকে দেখলে আমার কুড়ুলের কথা কেনো যেনো মনে হয় – তিনি এই মেসেজ পড়ার পর কী করবেন তা কেবল কল্পনাই করতে পারি আমি, কিন্তু বাস্তব সেই কল্পনাকেও নির্ঘাৎ হার মানাবে! 
 
তিনি এতোই আনপ্রেডিক্টেবল যে, রেগে গিয়ে পুলিশ ডাকতে গিয়ে পুরো ক্যান্টনমেন্টও ডেকে নিয়ে আসতে পারেন! অথবা এলাকার সাঙ্গোপাঙ্গো ভাইবেরাদার নিয়ে আমার বাসায় রাতদুপুরে রেইড দেয়াও তাঁর জন্য অসম্ভব নয়। তাঁর অতীতের রেকর্ড ঘাঁটলে বেশকিছু মারামারি হৈহেনস্থার ঘটনা এলাকাবাসী এখনো স্মরণ করতে পারেন। সেই হেনস্থার কবলে ডাকসাইটে কিছু ব্যাক্তিও পড়েছেন যেহেতু – আমার মতো আনুবীক্ষণিক প্রাণীর টেনশন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এই অপরাধে আমাকে ‘নরম-কদু’র মতো তিনি যে কেবল নখ বসিয়ে খান্ত হবেন, তা নয়। বরং মারের চোটে ব্লাডগ্রুপ চেঞ্জ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। আর আল্লাহর কী মাজেজা, এই ধরনের শ্বাপদশংকুল পরিবেশের ভেতরেই দুনিয়ার সবচে সুন্দরী মেয়েদের বসবাস! 
 
মায়াবতীর চোখদুটোর দিকে তাকালে আমি শ্রেফ ক্যাবলা হয়ে যাই। গত পাঁচ বছর ধরে ওর সাথে আমার ফিফটি পার্সেন্ট প্রেম চলছে। মানে হলো, এই প্রেমে আমি রাজি পুরোটাই, কিন্তু সে মোটেও না! এবং কাহিনীতে আর একটা বিষয়ও আছে- মায়াবতী এই ফিফটি পার্সেন্টের ব্যাপারেও তেমন অবগত না! জানবে কী করে বলুন, ওকে দেখলেই তো আমার বুকের মধ্যে কেমন জানি কুয়াকুয়া করে! পরিস্থিতির বারোটা বেজে যায়, যখন কথা বলতে যাই। বিশ্বাস করেন, গলা দিয়ে আল্লার উনত্রিশটা দিন কথা বলতে কোনো সমস্যাই হয়না। কিন্তু যেই তার সামনে যাই, শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধর্মঘট ডেকে বসে থাকে! আর কী বলবো, শরমের কথা – কেবল হিসু পায়!! 
 
আপনারা ভাবছেন এতো ভীতু মানুষের প্রেম করার দরকার কী, তাইতো? আরে আমি কি ইচ্ছে করে প্রেমে পড়েছি নাকি? বরং প্রেমটাই মায়াবতীসুদ্দ আমার ওপরে এসে পড়েছে! টিউশনির প্রথমদিন ভুল বাসায় কলিংবেল বাজিয়ে আমি ফেঁসে গেছি! আমার চেহারাছবি একদম খারাপ না। কিন্তু তাই বলে আমাকে আইপিএসের লোক ভাবার কোনো কারণ আছে? আরি! আমার হাতে টুলবক্স নাই কিছুনা, আমাকে এভাবে আন্ডার এস্টিমেট করার মানেটা কি এ্যাঁ? তা কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথে যে রূপবতী দরজা খুললো, সে মায়াবতী না হয়ে যায়না। সালামের উত্তরে মিষ্টি করে হাসলো, ড্রইংরুমে বসালো। ওই মোমেন্ট পর্যন্ত আমি কিছু সন্দেহ করি নাই। শান্তশিষ্ট ভাবে দেখছিলাম পরিপাটি রুমের সাদা দেয়ালে কাঠের তিনটা বক – লাইন দিয়ে উড়ছে! তার কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে এলো মিষ্টি আর চা নিয়ে। নিজেই বললো, “নিন, খেয়ে নিন প্লিজ, কাজ শুরু করলে তো হাত ময়লা হয়ে যাবে!’ (এই পর্যায়ে সন্দেহ করা উচিত ছিলো, পড়াতে গেলে হাত ময়লা হবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই, কিন্তু মায়াবতীর রূপে আমি তখন এমনই আউলাঝাউলা, দুনিয়ার বেবাক যুক্তি তখন আমার মাথার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে!) তো খেয়াল করলাম, মেয়েটা গড়গড়িয়ে কথা বলে। নিজেই ব্যাখ্যা দিলো। “আজ আমাদের বাসায় একটা শুভ-ইভেন্ট আছে, সেজন্যই…।’ (শুভ-ইভেন্ট কী জিনিস, সেটা বুঝেছি আরও পরে! না জানলেই ভালো হোতো! কবি জীবনানন্দ দাশ বোধহয় আমার এই সিচুয়েশনকে ভেবেই লিখেছিলেন: মাটি পৃথিবীর টানে কখন এসেছি,/ না এলেই ভালো হতো এইটুকু জেনে/এসে যে গভীরতর লাভ হলো/ সেটুকু জেনেছি/)। তা কিছুক্ষণ পরে আমি জানতে পারলাম, তার সেজোফুপির ছেলের খতনা! আহহারে শুভ-ইভেন্ট! যার যায়, সে-ই বোঝে! 
 
তো যা-ই হোক। এমনিতেই বাইরে কোথাও খেতে গেলে আমার সঙ্কোচ লাগে, তার ওপর অচেনা বাসায় প্রথম গেছি। আমি কোনোমতে মাথা নুইয়ে চা টা খেলাম। এর মধ্যেই সেজোফুপি এলেন। তিনি না এসে একটা টর্নেডো এলেই খুশি হতাম। মোটামুটি ‘হালকা হুমকির’ স্বরে তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন, পানি ভরতে এতো দেরিতে আসি কেনো! ব্যাঙের ওপর বজ্রপাত হতে দেখেছেন কেউ? আমার অবস্থা প্রায় তার কাছাকাছি! আর এহেন পরিস্থিতিতে আমি সাধারণত তোতলাই! তোললাতে তোতলাতে কিকি জানি বলার চেষ্টা করছিলাম! জব্বর হিসুও পেয়েছিলো তখন। তো ঘটনার এই পর্যায়ে অন্তির বাবা ফোন করলেন। অন্তি আমার সম্ভাব্য ছাত্রী – যাকে পড়াতে এসেছি। তিন মিনিটে ক্লিয়ার হলো আমি ফ্লাট ফাইভ-ডি’র পরিবর্তে ফাইভ-বি তে ঢুকে গেছি! ইন্নালিল্লাহ! এরা কিভাবে যে ফ্লাটের নম্বরগুলো রাখে! অন্তির বাবা পুনরায় উচ্চারণ করলেন, ফাইভ-ডি, ডি ফর ডাঙ্কি!! সে আর নতুন কী? ছোটোবেলা থেকেই তো শব্দটির সাথে পরিচিত! 
 
হুলুস্থুল অবস্থার ভেতরেই খটাস করে উল্টোদিকের দরজা খুলে গেলো। অন্তির বাবা বেরিয়ে এসে বললেন, “আসুন স্যার’। ভ্যাবাচ্যাকা আমি ল্যাটামাছের মতো ল্যাংচা মেরে অন্তিদের বাসায় ঢোকার মুখে দেখতে পেলাম, সিঁড়ি দিয়ে গোবেচারা মুখে টুলবক্স হাতে এক লোক মায়াবতীদের ফ্লাটে ঢুকছে। 
আমি মনে মনে তার জন্য দোয়া ইউনুস পড়লাম।
হাত ধরো

পর্ব ২: অব্যক্ত প্রেমের বিলাপ

ঢাকা শহরে যারা প্রেমিকাকে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ভুল করে ফুপুশাশুড়ীকে পাঠাবেন, তাদের জন্য আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে রাখি- ভুলেও লাইটপোস্টের নিচে ফুটপাতে বসবেন না, এমনকি দাঁড়াবেনও না! ভাইরে ভাই! এই বদমাশ কাকগুলো তক্কে তক্কে থাকে, উপযুক্ত ‘গ্রাহকের’ আশায়! গ্রাহক পেলেই তারা টার্গেট করে। খোদার অশেষ মেহেরবানিতে এ যাত্রা বেঁচে গেছি! মাথায় ইয়ে করতে চেয়েছিলো, একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে! ছোটন, তোমাকে আরও সাবধানী হতে হবে! নিজেকে নিজেই বললাম শান্তনার সুরে!

হনহন করে হাঁটার সময় কি হনহন শব্দ হয়? আমি এখন হনহন করেই হাঁটছি। আপদবালাই থেকে যতো দূরে সরে যাওয়া যায়, ততোই মঙ্গল। কিন্তু এই ধরাধামে আপদের কি শেষ আছে? দোকান ঘেঁষে হাঁটছিলাম- এক দোকানের কর্মচারী হুট করে একটা পাপোষ ঝেড়ে দিলো আমার মুখের সামনেই! শইলে কেমনডা লাগে! ডালকুকুরের মতো একটা লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। থাক তোরা তোদের ফুটপাতের দখল নিয়ে! একটু পর রিকশা নিলাম। বলা ভালো, রিকশাই আমাকে নিলো। উদাসী আমাকে দেখে রিকশাচালক নিজেই ডাক দিলেন, মামা কৈ যাইবেন?

একটা জিনিস হয়তো আপনাদের অনেকেরই নজরে পড়েছে, ঢাকা শহরে যতো রিকশাচালক আছেন, তাদের এক তৃতীয়াংশই দার্শনিক! কতো নিবেন, জিজ্ঞেস করলে ভীষণ ধোঁয়াটে উত্তর পাওয়া যায়! যথা, দিয়েন ইনসাফ কইরা, যান না সবসময়? ইত্যাদি। আপনাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়ে তারা আসলে আপনার পার্চেজ ক্যাপাসিটিই পরখ করেন। এই রিকশাওলা অবশ্য তেমন নন, ভীষণ প্রাকটিক্যাল। উনি লোকেশনটা জেনে নিয়ে ডিস্ট্যান্স আর টাইম ক্যালকুলেট করলেন, তার সাথে মার্জিন অব এরর আর সিস্টেম-লস যোগ করে তারপর রেজাল্ট জানালেন- জেনুইন ভাড়া একশো, কিন্তু তিনি আশিতে যেতে রাজি আছেন, কারণ তার রিকশার গ্যারেজ ওদিকেই! তো আমাদের যৌথযাত্রা শুরু হলো।

কোথায় যাচ্ছি, জানতে চান? সুরীটোলায় দিনেশ চন্দ্র বসাক লেনের কানাগলির মাথায় এক ভেঙে পড়োপড়ো বাড়ির পাঁচতলার চিলেকোঠা – সেই চিলেকোঠারও একতলা ওপরে প্লাস্টারছাড়া ওয়ালঘেরা টিনশেড এক গুমটিঘরে থাকে আব্দুল জব্বার! আমার বিশিষ্ট বন্ধু! সে অবশ্য তার নাম পাল্টে মোহিত প্রবারণ রেখেছে! এই নামের অর্থ কী, সেটা জিজ্ঞেস করলে সে প্রশ্নকারীর অজ্ঞানতায় ব্যথিত হয়ে করুণার চোখে গৌতমবুদ্ধের মতো তাকায়, কিন্তু কিছুই বলে না। ইদানিং সে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছে। তাই কাব্যিক নাম দরকার। অবশ্য মার্কেটে তার ‘জব্বারস গাইড’ বেশ চলছে ইদানিং। ‘প্লে-গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল বিষয়ের জন্য বাবামাদের আস্থার নির্ভরযোগ্য গাইড- জব্বারস গাইড!, মিতুল প্রকাশনী, ৩১ বাংলাবাজার, ঢাকা’ – এহেন বয়ানে জব্বারের কপি-পেস্ট নোটবইগুলো বিজ্ঞাপন ছড়ায়! কামাচ্ছে ভালোই, কিন্তু জব্বারের খাসলতের মেলা দোষ আছে। একে তো মহাকিপটা, তার ওপরে বিদঘুটে সব কান্ডকারখানা করার কারণে বেশ কিছু মেসমেটদের দ্বারা অতীতে সে বিভিন্ন সময়ে বিতাড়িত হয়েছে। এখন এই চিলেকোঠার টংয়ের ওপরে একা একা ঘুঘুরগান করে! এইচএসসিতে আমাদের ম্যাথ পড়াতেন ‘অতএব’ স্যার (আসল নাম ভুলে গেছি, প্রতি কথায় অ-তৈ-এ-ব শব্দটা চ্যাপ্টা করে উচ্চারণ করতেন বলে এই উপাধী তিনি অর্জন করেছেন, ছাত্রদের কী দোষ?)। সেই স্যারকে বশ মানিয়ে জব্বার এখন মিতুল প্রকাশনীর মালিক। তবে ওর একটা অসামান্য দিক হলো আমাকে দেখলে নির্ভেজাল খুশি হয়। দুটো কারণে, এক – আমার থেকে টাকা খসাতে পারবে সেই আনন্দে, দুই – বন্ধুদের মাঝে আমাকেই সে একমাত্র বিশ্বাস করে মনের কথা বলে। ও খুব ভালো করেই জানে আমি কাউকে কথা বেচে বেড়াই না। তাই ওর বাড়ীউলি ইলাবৌদির সাথে ঘনিষ্টতার খবরও আমার সাথে সে শেয়ার করেছে।

জব্বারের বিল্ডিংটা আধুনিক স্থাপত্যকলার এক বিরল নিদর্শন। সুলতানী আমল থেকে এ পর্যন্ত সব যুগের স্মৃতিচিহ্ন ও উপকরণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ফ্লোরে পাথরের স্লাব, মোজাইক, বাংলাসিমেন্ট, টাইলস- মোটকথা যখন যেটা পাওয়া গেছে, সেটাই বাছবিচার না করে লাগানো হয়েছে! সিঁড়িটা অবশ্য বেশ প্রশস্ত। এক বারে একজন হেঁটে উঠতে পারবে কোনোক্রমে। দুজন মুখোমুখি হলে কোলাকুলি না করে পার হওয়ার কোনো উপায়ই নাই! সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমি ভাবছিলাম প্রবারণ সাহেব আছেন তো?

আমাকে দেখে জব্বার জব্বর খুশি হলো! রসগোল্লার মতো চোখ গোল করে বললো,
– পোতোন আয় আয়, অনেকদিন বাঁচবি! ইলাবৌদিকে সেদিন তোর কথা বলছিলাম!
আমি রাগ আর প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম। নাম বিকৃত করা ওর হেবিট। আমাকে ডাকে পোতোন চৌধুরী! টেবিল থেকে খাতা তুলে বললো, কাল রাতে কবিতা লিখেছি, তোর জন্য, এই দ্যাখ:

কবিতার নাম: অব্যক্ত প্রেমের বিলাপ
‘রাস্তায় অপলক দেখি মানুষ আর মানুষ।
তুমি কি একটা ফানুস?
চলে যাবে যদি হে সুন্দরী প্রিয়তমা মহিষ
ভালো বাসলে কেনো, জড়ালে একি বন্ধনে
তব নক্ষত্র সহিস….!’

বিশাল কবিতা। শেষই হয়না! আমি একপর্যায়ে ওকে থামালাম। মহিষ নয়, মহিষী! মানে স্ত্রী। জব্বার অপ্রস্তুত না হয়ে চটপট বানানটা ঠিক করে নিলো। ইতোমধ্যে নাস্তা এলো (আমার টাকায়; ওর কাছে ১০০ টাকার খুচরা নেই বলে! কখনোই থাকেনা অবশ্য)। আমার চাকরি কেমন চলছে, দেশের বাড়িতে আম্মা কেমন আছেন, ইত্যাদি আলাপ শেষে সে অবধারিত প্রশ্নটি করলো,
– তারপর? কেমন আছে তোর মায়াবড়ি?
– জব্বাইরা, তোর মাথা ফাটাবো! ফের যদি ওইভাবে ডাকিস।
– তুই যতোদিন আমাকে পরিচয় করিয়ে না দিবি, ততোদিন ডাকবো! আচ্ছা বল, মায়াভাবী কেমন আছে?

ওর মুখে ভাবী শুনে আমি যেনো কেমন হয়ে গেলাম। বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো। মায়াবতী কি বোঝেনা আমার মনের কথা? এটা সত্যি, আমি বিষয়টা ঠিকঠিকভাবে তার সামনে বলতে পারিনি। পারার কথাও নয়। সুন্দরী মেয়েদের সামনে আমি একদমই কম্ফোর্টেবল নই। আমার মফঃস্বলী লাজুক মানসিকতার কারণে তাকে কফিশপে ডেটে নিয়ে যাওয়ার মতো স্মার্ট হয়ে উঠতে পারিনি, এটা সত্যি। কিন্তু জানটা যে কোরবান করে দিয়েছি তা তো মিথ্যা নয়।…

মেসেজ-বিভ্রাটের সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলো জব্বার। আমাকে আকাট মূর্খ বলেও গালি দিলো। তারপর হঠাৎই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-
– তুই এতো ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেনো? এটা বরং ভালোই হয়েছে। তুই মায়াবতীকে মুখ ফুটে বলতে পারিসনি এতোদিন, এখন সেজোখালার কাছ থেকে জেনে যাবে!
– খালা না, ফুপি!
– ওইত্তেরি! তোর কান্ডজ্ঞান হবে কবেরে এ্যা? খালা হোক আর ফুপিই হোক, উনি এখন ভাস্তিকে প্রটেক্ট করতে গিয়ে বিষয়টা পাবলিক করে দেবেন, বিচার বসাবেন! চড়থাপ্পড় কিছু জুটতে পারে, কিন্তু আখেরে লস নেই। ফলাফল কী হবে বুজতে পারছিস? কিরে, গাড়লের মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?

জব্বারের কথা শুনে আমার মেরুদন্ডে হিমস্রোত বয়ে গেলো! কল্পনায় এবার দেখতে পাচ্ছি সেজোফুপি আমার কলার ধরে ধাইধাই করে চড় মারছে আর বলছে, “বদমাশ ছেলে, আর করবি?’

হাত ধরো

পর্ব ৩: ব্যাঙ্গুট

প্রেমে পড়ার বহিঃপ্রকাশের যতোগুলো ভার্সন সেলুলয়েডে আছে, তার ভেতর সবচে নির্ভরযোগ্য মনে হয় তেলেগু ছবির এক্সপ্রেশনটি। নায়িকা সেখানে আনন্দের ঠেলায় এক লাফে আমগাছে উঠে পড়ে, আর নাচতে নাচতে আপেল খায়! অবশ্য প্রেমপত্র পেয়েই দৌড়ে গিয়ে বালিশে হুমড়ি খেয়ে পড়া কিংবা কাঁখের কলসকে জড়িয়ে ধরে গীত গাওয়ার মধ্যে যে প্রেম অনুপস্থিত, সেটা আমি বলছি না। ওইসব দৃশ্যে মায়াবতীকে কল্পনা করে ভীষণ হাসি পেলো আমার। কিন্তু ঠিক হাসার মতো অবস্থায় নেই আমি এখন! গম্ভীর হয়ে বসে আছি। সামনে আমার টিনএজ ছাত্রী, অন্তি! 

রুমে তৃতীয় আরও একজন আছেন, যিনি ভীষণ মুখ গোমড়া করে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। বলা ভালো, নজর করছেন। তিনি জনৈক বেড়াল! হাবভাবে সেজোফুপির মতোই অনেকটা। প্রথমদিন থেকেই দেখছি বেড়ালটার মেজাজ খারাপ। আমার দিকে খুবই তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়। ভাবখানা এমন, হুহু বাবা, সব নজর করছি, একটু ইদিক উদিক দেখলেই এমন খামচি দেবো!… একটা বেড়ালকে পাত্তা দেবার কিছু নাই। কিন্তু না দিয়েও পারছি না। আমি পড়াবার সময় কেউ নজর রাখছে, ব্যাপারটা সুখকর নয়। হোকনা সে বেড়াল। আমি ঘনঘন বেড়ালটার দিকে তাকাচ্ছি বুঝে অন্তি ঠোঁটটিপে হাসলো। এটা ওর রোগ। একটু পরপর ঠোঁট টিপে হাসে। সেই প্রথমদিন ভুলে মায়াবতীদের ফ্লাটে ঢুকে যাবার কান্ডটাই হয়তো মনে করে। আল্লাহ মালুম, ওরা ঘটনাটা নিয়ে নিজেদের ভেতর কী কী আলোচনা করে! কিন্তু যা-ই করুক, সেটা যে আমার ফর-এ আসবে না, সেটুকু আমি বুজতে পারছি। এ ধরণের বিব্রতকর অবস্থায় টিউশনিটা ছেড়েই দিতো অন্য কেউ হলে। কিন্তু আমার ইন্টার্নশীপটা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে আয় হয় না বলে এই বাড়তি ইনকামটা আমাকে চালিয়ে যেতেই হবে, যতোদিন একটা পার্মানেন্ট জব না হচ্ছে! আর পড়াতেও বেশ লাগে। মেয়েটা মেধাবী। একটু বুঝিয়ে দিলেই ধরে ফেলে। আর, এটা না ছাড়ার প্রধান কারণ মায়াবতী। দেখা সাক্ষাত না হোক, তবুও তার কাছাকাছি যেতে পারছি, এটাইবা কম কিসে? কথায় আছেনা, যাকে ভালোলাগে, তার বাড়ির বেড়ালটাকে দেখলেও আপন আপন লাগে! আমি অন্তির চোরা হাসি পাত্তা না দিয়ে পড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মোটা পাওয়ারের চশমার ভেতর থেকে অন্তিও মনযোগী হলো। পড়া দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে একটা চাপা টেনশন কাজ করছিলো- মেসেজটা পেয়ে সেজোফুপির কী প্রতিক্রিয়া হলো সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছি। অন্তির চাপাহাসির পেছনে এটাই কারণ নয়তো? এই বয়সী মেয়েরা সবকিছুতেই থ্রিল খুঁজে পায়। তাহলেতো সাড়ে সব্বোনাশ! 

কিছুক্ষণ পড়ার ফাঁকে নাস্তা এলো। আমি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পরিবেশ সহজ করার জন্য বললাম, “তোমাদের এই বেড়ালটা কতোদিন থেকে আছে?’ অন্তি খাতা থেকে মুখ না তুলেই বললো, “ও আমাদের বেড়াল নয় স্যার!’

– তাহলে কাদের?

– মায়াআপুদের। 

হেইও ভাইসকল! এইসমস্ত কোইন্সিডেন্স কেবল আমার ক্ষেত্রেই ঘটে কেনো বলতে পারেন? বিষম খেতে খেতে আমি হতভম্ভ হয়ে তাকালাম।

– ওদের বেড়াল তোমরা পোষো কেনো?

– পুষি না তো স্যার।

বুদ্ধিমান মেয়ে। কথাটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ডেলিভারী দিলো “ও আগে ‘সুলতান সোলেমান’ দেখার সময় হলেই আসতো আমাদের বাসায়। ওটা বন্ধ হয়ে যাবার পর অনেকদিন আসেনি। এখন আবার আমার প্রাইভেট পড়া শুরু হলে এসে বসে থাকে!’ 

ঘটনা শুনে মাথাটায় একটা ঘুরান্টি দিলো। মায়াবতীর বেড়াল এটা! আমি যখন পড়াতে আসি, তখন সে এসে বসে থাকে! আমাকে দেখে? হাউ সুইট! আপনারা এর ভেতরে কোনো রোমান্টিক বিষয় হয়তো দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু খবরটা শুনে আমি চায়ে ভেজানো বিস্কুটের মতো গলে গেলাম। এতক্ষণ বেড়ালটাকে দেখে আমার ভিলেন ভিলেন মনে হয়েছিলো, এখন ওর দিকে তাকিয়ে মনটা ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে গেলো!

– বাহ্ তাই নাকি? দা-দারুণ তো, কী নাম রেখেছ ওর?

– পেলো!

– কি বললে?

– স্যার ‘পেলো’। মায়াআপু ওকে খুব আদর করে!

– হ্যাঁ খুব সুন্দর কিউটি নামের বেড়াল তোমাদের…মানে মায়াআপুদের!

আমার মুখে আপু শুনে অন্তি এবার শব্দ করে হাসলো। তারপর এক দৌড়ে ভেতর ঘরে চলে গেলো। আমি নিশ্চিত জানি, সে ভেতরে গিয়ে এখন হাসবে একচোট। খোদা, আর কতো ‘পরীক্শা’ রেখেছ এ জিবনে!

আপনাদের বলা হয়নি, এদিকে আরও একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি আমি। প্রথমদিনের ওই ডিজাস্টারের পর ২/১ দিন সিঁড়িতে মায়াবতীর সাথে দেখা হয়েছে। মুখের ভাব দেখে কিছুই বোঝা যায় না। খুবই উদাসীন ভাব। মনে হয় যেনো কিছুই তার মনে নেই আর। খুব দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে চোখ দিয়ে কেবল দেখে একবার আমাকে। আমি তাতেই কাত। সিঁড়ির রেলিং টপকে নিচে পড়ে যাবার অবস্থা। বাব্বাহ, কী অদ্ভুত মায়াবী চাহনি! একদিন ব্যতিক্রম হলো। বায়োলজী পড়াতে গিয়ে অন্তিকে ব্যাঙের অঙ্গসংস্থান শেখাচ্ছিলাম। সেটাই মনে হয় রঙচঙ চড়িয়ে সে মায়াবতীর কাছে পেশ করেছে। সিঁড়িতে একদিন মায়াবতী আমাকে ধরলো। “এক্সকিউজ মি, আপনি আমার এসাইনমেন্টের খাতা এঁকে দেবেন প্লিজ?’ কথার ভেতরে আদেশ আর অনুরোধের মিশেল। আমি কিছু বলার আগেই সে সম্মতির অপেক্ষা না করে জানিয়ে গেলো, অন্তির কাছে খাতা জমা দেয়া থাকবে, আমি যেনো নিয়ে নেই। আপনাদের বলতে লজ্জা নেই, কার্টুন আমি খুব ভালো আঁকি! মানে যা-ই আঁকি তা দেখেই মানুষজন হাসে। তো বহু কসরৎ করে আমি একটা ব্যাঙ আঁকলাম। উটের মতো দেখাচ্ছিলো অনেকটা। ব্যাঙের গায়ের আঁচিলগুলোর সাইজ একটু বড় হয়ে গেছে,  তো মোটমাট ডোরাকাটা উটই হয়েছিলো শেষটায়। আমি নাম দিয়েছি ব্যাঙ্গুট। তো সেই ব্যাঙ্গুটের দিকে মায়াবতী দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে একটা চোরা নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর শুকনো একটা থ্যাঙ্কস দিয়ে বিদায় নিলো! আমি আতঙ্কে তিনদিন ঘুমাইনি। 

পেলো বসে বসে ঝিমাচ্ছে, না ঘুমুচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঘুমালেও তার একটা কান রেডারের মতো এদিক থেকে ওদিকে ঘোরাচ্ছে মাঝেমাঝে। আরে, বেড়ালটাতো আসলেই সুন্দর দেখতে। কানের একটা পাশ কালো। চোখে, পেটে আর লেজেও কালো ছোপ। আভিজাত্য আছে চেহারায়। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, বিড়াল সমাজে সে একজন সেলিব্রিটি! না জানি কতো বেড়ালের হার্টথ্রব সে! আমি ওকে আদর করার জন্য উঠে কাছে গেলাম। মাথায় আলতো করে দু আঙুল বুলিয়ে দিতেই সে আরামে বাবু হয়ে গেলো একেবারে। ইশ্ কী নরম নরম লোম। মায়াবতীও ওকে এভাবে আদর করে নিশ্চয়ই! আমি হাত বোলাতে বোলাতে ফিসফিস করে বললাম, “এই শোন্ আমি না তোকে অনেক ভালোবাসি, বুঝেছিস?’ খিলখিল হাসির শব্দে আমি চমকে উঠলাম। অন্তি! বেড়ালটাও শব্দ শুনে একলাফে দরজার নিচ দিয়ে ভাগলো। ঠোঁটটেপা হাসি নিয়ে অন্তি বললো, 

– আজ আর পড়বো না স্যার, আজ অনেক মাথা ধরেছে! 

আমি জানি এটা বাহানা। পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো আদম সন্তান একটা বেড়ালকে প্রেম নিবেদন করলো; তাও আবার ছাত্রীর সামনে! মাবুদ! অন্তি দরজা খুললো। আমি বের হলাম। আর সাথে সাথেই মায়াবতীর সামনে পড়ে গেলাম! পেলোকে কোলে নিয়ে সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! অবাক হলে মেয়েদের এত্তো সুন্দর লাগে? আমি নিজের ভেতরে চাপা আতঙ্ক টের পেলাম, পেলো কি তাকে আমার প্রেম নিবেদনের কথা মায়াবতীর কাছে চাউর করে দিয়েছে!?

হাত ধরো

পর্ব ৪:  লেডিস ট্রায়ালরুম

পরিবার পরিকল্পনার সকল স্থায়ী-অস্থায়ী পদ্ধতিকে পরাস্থ করে আমি আর মায়াবতী চতুর্থবারের মতো মাবাবা হলাম।

কী বলবো আপনাদের, বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে গত মাসে। সরি এ্যাঁ, আপনাদের দাওয়াত দিতে পারিনি। যা তাড়াহুড়ার মধ্যে বিয়ে করতে হলো! তার ওপর কোর্ট-কাচারি, পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনী – এসব সামলে বিয়ে করা কি মুখের কথা?… এই চারটা সন্তানকে পেলেপুষে বড় করতে জান কয়লা হয়ে গেছে মায়াবতীর। শুধু নামেই না, মানুষ হিসেবেও সে অনেক মায়াবতী বলেই পেরেছে এই অসাধ্য সাধন করতে! ছেলে দুটোর একটা কোলে আর একটা চার বছরের, মাঝে দুটো জমজ! দুটোই মেয়ে। ভাবেন একবার। কী দারুণ কম্বিনেশন! জ্বী, সময়টাকে কাজে লাগিয়েছি আমরা! মেয়ে দুটোকে দেখতে দেখায় ডলপুতুলের মতো! একদম মায়ের চেহারা পেয়েছে। ছেলেদুটো অবশ্য আমার বাবার মতো হয়েছে। মানে দাদার মতো। আব্বাকে আমি জ্ঞান হবার পরে আর দেখিনি। সে যা-ই হোক, চারটা পিচ্চিই তাদের মাকে ছেড়ে একদমই থাকতে পারে না। তাই যেখানেই যাই, চারজনকে সাথে নিয়েই বের হতে হয়। এই যেমন এখন কফি খেতে এসেছি, সেখানেও ফল-ফ্যামিলি – ছয়জন! আমি এপাশে একা বসেছি আর টেবিলের উল্টোদিকে ওরা। মায়াবতীর দুপাশে দুই মেয়ে, নীল ফ্রক আর মাথায় অনেকগুলো নীল ব্যান্ড দিয়ে আধাইঞ্চি পরিমাণ চুলে ঝুঁটি বেঁধেছে। দেখলে মনে হয় রূপকথা! নামও রেখেছি সিরাম: রূপকুমারী আর ফুলকুমারী! দুই মেয়ের মাঝখানে তাদের মাকে লাগছে রাজরাণীর মতো! আমি রাণীসাহেবার দিকে তৃষ্ণার্তের মতো অপলক তাকিয়ে আছি! সুবহানাল্লাহ!!! আমি অস্ফুটে বললাম।

– কী হলো!!!

আমি সম্বিত ফিরে দেখি উম্মে হুজাইফা কুররাতুল আফসানা! এটা মায়াবতীর সার্টিফিকেটের নাম। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, তিন/চারবার সংশোধন না করে জাতীয় পরিচয়পত্র পায়নি সে! এই নাম রেখেছে তার দাদাজান! আমি নেট ঘেঁটে এই নামের যে অর্থ পেলাম, তা ভয়াবহ! হুজাইফা মানে মেষ বা ভেড়া, কুররাতুল= চোখের শান্তনা, আফসানা = রূপসী, আর উম্মে মানে মেয়ে বা মা! কুলমিলাকর ইয়ে সাবিত হো কি: রূপসী ভেড়ার চোখের শান্তনার মেয়ে! প্রভু যীশু, রক্ষা করো!

আমি হাসি চেপে ওর দিকে তাকালাম। কানে একটা মুক্তো বসানো দুল। হালকাভাবে দুলছে। আহ্ এতো সুন্দর লাগছে দেখতে। কানটাও কতো সুন্দর! আমার বুক ঢিপঢিপ করছে! হাসতে চেষ্টা করলাম। কফির কাপ মুখের কাছে নিয়ে একদৃষ্টে আমাকে দেখছে উম্মে হুজাইফা মানে মায়াবতী!

– কী ভাবা হচ্ছে?

– আর একটা বাচ্চা নেবো!

– কী?

– এ্যাঁ? নাহ্ কিছু না। আমি লাজুকভাবে ওর দিকে তাকালাম। তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলাম। পিচ্চিগুলো কই? এইমাত্র না এখানে ছিলো? এক নিমেষে সব হাওয়া। কী হয়েছে বলেন তো আমার? যখনই মায়াবতীর কাছে যাই, তখনই ওর আসেপাশে আমাদের ভবিষ্যত সন্তানদের দেখি! এটাও কি প্রেমের কোনো সিম্পটম? কি জানি বাপু, এই প্রেম বড় ‘ঝাটিল’ (ঝামেলা+জটিল) একটা জিনিস!

– পেলো কেমন আছে?

– সে তো পাগল একেবারে। টিচারের শব্দ পেলেই আর ঘরে থাকতে চায় না!

– তাই নাকি?

আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন, আমরা কেউই একে অন্যকে সম্বোধন করছি না। আপনি আর তুমির মাঝামাঝি স্টেজে আছি এখন। আমি অবশ্য সিনিয়রিটির দিক দিয়ে ওকে তুমি ডাকতে পারি, কিন্তু জিভে জড়িয়ে যাচ্ছে। আবার আপনি ডেকে তাকে দূরের একজন ভাবতেও পারছিনা। ঝাটিল, ঝাটিল!

আজ নিয়ে এটা আমাদের তৃতীয় আউটডোর ডেট! (ইনডোর ডেট নিয়ে ভাবতে গেলে দমবন্ধ হয়ে যায়, আঁই কিত্তাম?) এসেছি একটা শপিংমলে। ভাষার একদম ছ্যাড়াবেড়া অবস্থা। কেনো রে, এতো শানদার স্থাপনাকে মল ডাকার কী প্রয়োজন? বৃহত বিপনিকেন্দ্র বলতে গায়ে ফোস্কা পড়ে? যত্তোসব! এই হীনমন্যতাই আমাদের ভাষাকে শেষ করবে বুজলেন?

– আমার যেতে হবে!

– আর একটু থাকা যায় না। মানে আর পাঁচ মিনিট?

– কফি শেষ করা পর্যন্ত আছি।… কেউ তো কিছু বলছে না, থেকে কী হবে?

মায়াবতীর মুখে অনুযোগের মেঘ জমলো। আমার কষ্ট হলো ওর জন্য। আসলেই আমি কিছু বলতে পারছি না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। উচিত ছিলো বাসা থেকে আগেই স্ক্রিপ্ট লিখে আনা – আমি যা যা বলতে চাই। কী বলতে চাই আমি? বলতে চাই, হে রূপবতী তুমি কি আমার সাথে বাকী পথটুকু হাঁটবে? তোমার সুন্দর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আমি দুর্গম খাইবারপাস পার হতে পারবো। হাত ধরো, মায়াবতী। আমার হৃদয় কেটে স্লাইস করা হলে প্রতিটি টুকরো থেকে তোমার পাসপোর্ট সাইজ ছবি পাওয়া যাবে! আমাকে তোমার পাশাপাশি একটু থাকতে দাও। বিনিময়ে প্রতিদিন আমি তোমাকে ব্যাকপ্যাকে ভরে অফিসে নিয়ে যাবো। অফিসে ব্যাগ খুলে মাঝে মাঝে দেখবো তোমাকে!!! – এসব বললে মায়াবতীর প্রতিক্রিয়া কী হবে? সে কি বুজবে আমি তাকে কতোটা বাসি?

– মন খারাপ কেনো?

– এমনি। বলে আমি চোখ নামালাম। কফির খালি কাপটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। টেবিলের ওপর ওর চুড়ি পড়া একটা হাত আমার দিকে আগানো। বাকি হাতটা গালে ভর দিয়ে আমাকে দেখছে, জানি। আমি সহজ হতে পারছি না। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললাম, চাই!

– ক্কী?

– সবটা!

– মানে?

– মানে একসাথে হাঁটতে চাই!

– যদি না হাঁটি?

– মরে যাবো!

– মিথ্যে!

– নাহ্। জন্মের মতো সত্যি!

এ পর্যায়ে সিনেমার দৃশ্যের মতো ওর লম্বা করা হাতের আঙুলগুলো টেবিলের ওপর দিয়ে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে আমার হাতের পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো! দ্বিধা। ভয়। উত্তেজনা! আমি আমার হাত ওর দিকে খুলে ধরলাম। মাত্র দুটো আঙুল দিয়ে মায়াবতী আমার আঙুল স্পর্শ করলো। ৮৮০ ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেলো! চারটা আঙুল একে অন্যকে আঁকড়ে ধরি ধরি করেও থমকে আছে। বিহ্বল আমি কাতর চোখে তাকিয়ে রইলাম আমাদের দুজনের হাতদুটোর দিকে। যেনো চারদিকের সবকিছু ফ্রিজ হয়ে গেছে। নড়ছে না। এমনকি সময়ও স্থির এখন।

– সেজোফুপি!…

ফুঁপিয়ে ওঠার মতো বললো মায়াবতী! আমরা এক ঝটকায় খাড়া হয়ে গেলাম। কাঁচঘেরা পার্টিশনের ওই দিকে সত্যিই সেজোফুপি! তার সম্প্রতি খতনা করা পুত্রকে নিয়ে মার্কেটের ভেতর ঢুকছেন। আমরা দুজন লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিপদ আমাদের পিছে পিছে ধেয়ে আসছে! ওইতো সামনেই একটা ব্রান্ডশপ। আমি মায়াবতীকে নিয়ে ওটার ভেতরেই ঢুকে পড়লাম।

– গুড ইভনিং স্যার, হাউ কেন আই হেল্প ইউ ম্যাম!

ব্লু স্যুট আর সাদা শার্ট পড়া একজন সেলসগার্ল এগিয়ে এলো! টানটান উত্তল শার্টের ওপর সোনালি নেমট্যাগ লাগানো- তানিয়া। মায়াবতী তাকে ডজ দিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে গেলো। আমি এই সুযোগে দোকানটায় চোখ বোলালাম। মেয়েদের আইটেম সব। আমার পেছনে টর্নেডো ধেয়ে আসছে, মরিয়া হয়ে বাছবিচার না করে আমিও শো রুমের অন্যদিকটায় হানা দিলাম। পেছনদিকে এক চক্কর মেরে আমি ঘুরপথে পোঁছাতে চাই মায়াবতীর কাছে। প্রায় ওর কাছাকাছিই চলে গিয়েছি, এমন সময় দেখি ওর সামনেই সেজোফুপি দাঁড়িয়ে। ধরা পড়ে গেছে সে। আল্লাহ্ রহম করো। কি কি যেনো বলছেন তিনি। একসার হ্যাঙারে ঝোলানো কাপড়ের আড়ালে বলে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু যে কেনো সময় এদিকে ফিরলেই তিনি আমাকে দেখতে পাবেন! দোয়া ইউনুস মনে পড়ছে না কেনো? বুকের ধুকপুক এতো জোরে হচ্ছে যে সেই শব্দতেও সেজোফুপি সজাগ হয়ে যেতে পারেন। আমার দিকে আগাচ্ছেন তিনি। উপায়অন্ত না পেয়ে আমি পিছনে ফিরতেই ছোট একটা কুটুরিঘর দেখে তাতেই সেঁদিয়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকে খট করে দরজা লাগিয়েই বুজলাম জিবনের বড় ভুলটা এইমাত্র করে ফেলেছি। আমি লেডিস ট্রায়ালরুমে বন্দী! হাইহিলের শব্দ টের পেলাম। কে যেনো নক করছে। মেয়েকন্ঠ। সেই স্যুটপড়া মেয়েটা মনে হয় – তানিয়া।

– এক্সকিউজ মি স্যার, এটা লেডিসরুম স্যার, প্লিজ ওপেন দা ডোর!

পুরো ইনিংসে হেরে যাওয়া আমি দরজা মেলে ধরতেই দেখলাম সামনে সেজোফুপিসহ বেশ কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী মহিলা চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে। তাদের দৃষ্টি আমার হাতের দিকে। এই শালার হাত কি করে কোত্থেকে জানি মেয়েদের একটা পোশাক তুলে নিয়ে এসেছে! নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আমি জমে গেলাম। আমার হাতে ৪৮ সাইজের একটা ব্রা!!!

হাত ধরো

পর্ব ৫: শীতকালীন মহড়া

ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামান তরফদার পিএসসিকে ইউনিফর্ম ছাড়া সাধারণ পোশাকে দেখলে চট করে ঈদ আনন্দমেলার উপস্থাপক বলে মনে হতে পারে। সপ্রতিভ, সদালাপী আর তীক্ষ্ণ ধীশক্তির গুণে তিনি আজ এই অবস্থানে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট পদক ছাড়াও দেশ বিদেশের সামরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও সিমুলেশনে অংশ নিয়ে জয় করেছেন বেশকিছু শিরোপা। তারই ধারাবাহিকতায় তাঁকে দেশের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত আধাসামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চলমান শীতকালীন মহড়া নিয়ে তাঁর বেশকিছু জমকালো আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে। আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র দেশ মালাউই-এর সেনাপ্রধান আসবেন এই মহড়ার সমাপনী ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে। সেনাপ্রধান হলেও তারা দুজনেই আমেরিকার উটাহ -তে একসাথে ছয়মাসের একটি সারভাইভ্যাল কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। (এই কৃষ্ণাঙ্গ সেনাপ্রধান ডক্টর সি. পম্পিডু সাহেবের সাথে আমার একটা সেলফি তোলার ব্যাপার আছে, সেইটা কাহিনীর শেষের দিকে বলবো আপনাদের)। তো বিগ্রেডিয়ার তরফদারের দেশের বাড়ি খুলনা আর বাগেরহাটের মধ্যবর্তীস্থানে হবার কারণে তাঁর ভাষায় কোনো লোকাল টানই জোড়ালো নয়। কেবল কড়িছো, গেইইচো এইরকম দুএকটা দেশি-ভাষা মাঝেমোদ্দে আসি-যায়! সিডা কোনো ব্যাপার না।

সমাপনী অনুষ্ঠানে বন্ধুকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য তিনি এক অভিনব আইডিয়া ঠিক করেছেন। তিনি ভেবেছেন, এবার তালপাতা আর খেজুরপাতা দিয়ে… ঝনঝন করে ল্যান্ডলাইন টেলিফোন বেজে উঠতে তার চিন্তাটার ইন্টারভেল হয়ে গেলো। নীল সেটটা বাজছে। তারমানে বাসা থেকে। এই ফোন যখনই আসে, তা কোনো আনন্দদায়ক বার্তা বহন করে না। কিন্তু সংবাদ যতোই তেতো হোক, তাঁকে এই মুহূর্তেই কলটা এ্যাটেন্ড করতে হবে। কারণ ফোন করেছে শরাবান তহুরা, তাঁর স্ত্রী। শ্বশুরের দেয়া এই উপহার নিয়ে তিনি বিশাল সক্ষমতার সাথে গত চল্লিশটা বছর পার করেছেন। এবং তহুরা বিষয়ে তার কোনো অনুযোগ নেই। কারণ ‘দেয়ার ইজ নো অবস্টাকেল রিমেইনস অন দিস প্লানেট, এজ লং এ্যাজ ইয়ু নো হাউ টু ফিক্স ইট” – এই নীতিতে বিশ্বাসী তিনি। আর স্ত্রী-ভাগ্য বলে যে একটা জিনিস আছে, সেটা তহুরা তার জীবনে না এলে বুজতেন না। প্রতিটা উন্নতি ধাপে ধাপে তাঁকে শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। সেটা তহুরা পাশে না থাকলে হতো না। কারণ তাঁর কেরিয়ার গড়তে সহায়তা করতে গিয়ে তহুরা তার নিজের কেরিয়ার কোরবানী দিয়েছে! একটা জিনিসে খামতি ছিলো, আল্লাহ সেই পুত্রের সাধও শেষ বয়সে তাঁর পূরণ করেছেন। পুত্র হবার পর থেকে তহুরার গলার স্বর অবশ্য দুই স্টেপ উচ্চ হয়েছে, তবে সিডা কোনো ব্যাপার না।

ফোন ধরার পর পাঁচ মিনিট তিনি ওপাশ থেকে যা যা বলনীয়, তা বলতে দেন কোনো ইন্টারাপশন ছাড়াই। এবারও তাই করার প্লান ছিলো তাঁর, কিন্তু পারলেন না। কারণ, বিষয়টা তার মাজান-কে নিয়ে। মাজান তার মেয়ে নয় ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও বেশি। তিনি ওপাশে তহুরার কাঁদোকাঁদো কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কথাগুলো কান্নার দমকে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যেই শুধু একটা প্রশ্ন করলেন, ছেলেটা কে? তারপর আরও দু তিনটা তথ্য শুনে তিনি স্ত্রীকে শান্ত হবার কথা বলে ফোন রাখলেন। একমিনিট দ্বিধান্বিত হলেন এই চৌকশ কর্মকর্তা, যিনি কর্মক্ষেত্রে দুরূহ সব সমস্যার এক নিমেষে সমাধান দেন, সেই তিনিই কেমন যেনো থমকে গেলেন। কিভাবে এটা হ্যান্ডেল করবেন যেনো বুজতে পারছেন না। তাঁর বিভাগের ইন্টেলিজেন্সকে তিনি এক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে চান না। করা উচিতও নয়। তাহলে কী করা যাবে? পিতার গুরুদায়িত্ব বুঝি একেই বলে, এই প্রথম তিনি টের পেলেন। আগে তো ঘটনার মূলে যে আছে তার সম্পর্কে জানতে হবে। তাছাড়া মাজানের সাথেও তিনি সরাসরি কথা বলতে চান। বাসায় যেতে হবে। বেল বাজিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে একমিনিটে তিনি সিন্ধিকে মোবাইলে ধরলেন, কোর্টে আছো না চেম্বারে?
– হু, কী ব্যাপার? কোথায় আসতে হবে?’ একেই বলে উকিলের বুদ্ধি। ব্যারিস্টার ইফতেখারুজ্জামান সিন্ধি পার্টি পলিটিক্স না করার কারণেই পেশাগতভাবে পিছিয়ে গেছেন। নাহলে এই ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে জাতীয় সংসদ আলোকিত করতে পারতেন এখন। তার সাথে কল কাটার আগে তিনি তহুরার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন:
নাম: ইমতিয়াজ চৌধুরী ছোটন
ঠিকানা: ইনটার্ন, গ্লোবাল এ্যাক্সিস (ইনক্.), বনানী।
মোবাইল নং…

হাত ধরো

পর্ব ৬: উপসালা

স্থবির ব্যাঙের মতো চিত হয়ে শুয়ে আছি বিছানার প’রে! কিন্তু মরে আছি, না বেঁচে সেটা বুজতে পারছি না। জব্বার আমাকে দেশে ফিরে গিয়ে চাষবাসে মনযোগী হতে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে। আমি নাকি মেগাসিটিতে বসবাসের উপযোগী নই!

ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকে আমি একবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। কলাবাগান থেকে যাবো মীরপুর সাড়ে এগারো। বাস ধর্মঘট চলছে বলে নিরূপায় হয়ে ভাগের সিএনজিতে উঠেছি! শালারা কল্যাণপুর গিয়েই একটা ভোঁতা পিস্তল আমার পেটের পাশে ঠেকালো! আইবাপ, কী তামশা! ভার্সিটি স্টুডেন্ট, তার ওপর হলে থাকি – শুনে গায়ে হাত দেয়নি ওরা। ভদ্রভাবে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ব্যাগটা তমিজসহকারে ফিরিয়ে দিয়েছে। ইনফ্যাক্ট এতো ভদ্র ছিনতাইকারী আপনারা অর্ডার দিয়ে বানালেও পাবেন না। ওদের আদব লেহাজ দেখে আমার রীতিমতো লজ্জা লাগছিলো। বড়ভাই বলে সম্বোধন করছিলো। টেকনিক্যালের মোড়ে এসে ওরা আমাকে তমিজসহকারে নামিয়ে দিলো, তারপর ভোঁ করে গাবতলীর দিকে চলে গেলো। পরম আত্মীয় হারানোর বেদনা নিয়ে আমি সিএনজিটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবটা ঘটে গেলো কয়েক মিনিটের ভেতর, কিন্তু হাঁটতে গিয়ে খেয়াল করলাম, আমার পা দুটো নড়ছে না। একদমই না। হাঁটুদুটো অসাড়। আমি তখন হাঁটুদুটোকে কাউন্সেলিং করতে লাগলাম, “দ্যাখ ওরাতো চলে গেছে, তোরা এখন সেফ। চিন্তা করিস না, চলা শুরু কর্।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? হাঁটুর কাঁপুনী আর থামেনা, কী আপদ!… তো সেই স্টোরি শুনে এই জব্বারই তখন আমাকে বলেছিলো, “হার্টে মাইন্ড নিস না দোস্ত! এমন হয়। ছিনতাইয়ের ভেতর দিয়ে ঢাকা তোকে আপন করে নিয়েছে!’ আর এখন সে বলছে, আমি নাকি ঢাকায় থাকারই যোগ্য নই। বহুদিন পর এখন ছিনতাই হবার পরের সেই অনুভূতিটা নিজের ভেতরে কাজ করছে! প্রেম করতে গিয়ে (বা পড়তে গিয়ে) যে কঠিন প্যাঁচের ভেতর আমি পড়ে গেছি, তার সুরাহা আমার কাছে নেই। কার কাছে আছে, তাও জানিনা।

মায়াবতীর ফোন ওই ট্রায়ালরুম ইন্সিডেন্সের পর থেকে বন্ধ! সোশাল মিডিয়াতেও নেই সে। হয়তো আমার মতো এমন নির্বোধ বেকুবের হাত থেকে নিস্তার পেতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে! ঠিকই করেছে। কেবল বুকভরা ভালোবাসা থাকলেইতো হবে না। কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষকে কে সহ্য করবে? গত এক সপ্তাহ ধরে আমি অন্তিকে পড়াতেও যাইনা। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি দেশে যাবার কথা বলে। হয়তো জব্বারের পরামর্শ নিয়ে আমাকে গ্রামেই ফিরে যেতে হবে। ঝাঁকিজাল দিয়ে হাওড়ে মাছ ধরবো! দৃশ্যটা ভাবতেই মনটা ভেঙে যাচ্ছে আমার। শুধু নিজেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর প্রত্যয় নিয়ে আমি শূন্যহাতে ঢাকা এসেছিলাম। আজ ভাগ্যের কাছে পরাভূত হয়ে ফিরে যাবো?

অফিস থেকে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো, ধরা হয়নি। আজ মন খারাপের জন্মদিন নিয়ে অফিস শুরুর ঘন্টাখানেক আগেই হাজির হলাম। এইসময়ে সাপোর্ট স্টাফ ছাড়াও বিগবস চলে আসেন। জনশূণ্য ওয়র্কস্টেশনগুলোর এককোণে আমার টেবিলে বসে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, আমি এখানে কেনো? সারা শরীরটা অসাড় হয়ে আছে। প্রেমে ব্যর্থতায় কেবল মনই ভাঙে না, শরীরও। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে নিচের ফুটপাতে গার্মেন্টস কর্মীদের দ্রুতপায়ে লাইন দিয়ে হেঁটে যাওয়া বেশকিছু সময় ধরে দেখলাম। আমার জীবনটা কি ওদের চেয়েও অর্থহীন? তুচ্ছ? দীর্ঘশ্বাস চেপে একটা কফি বানিয়ে নিয়ে এসে আমি ল্যাপটপ খুললাম। তিনটা মেইল পপআপ হলো। আমি একে একে পড়তে লাগলাম। তিন নম্বরটা পড়ার আগেই বসের রুমে ডাক পড়লো। কিছু কি পেন্ডিং আছে? মনে করতে পারছি না। না জানি কী আছে কপালে আজ। কাঁচের স্লাইডিং দরজা ঠেলে আমি ঢুকলাম। জেসমিন এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। গুডমর্নিং! কাজ করছিলেন উনি। আমাকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
– আরে ইমতিয়াজ, কংগ্রাচুলেশন! হোয়াট এ ব্রিলিয়ান্ট সাকসেস!’ আমি হতভম্ব আর ভ্যাবাচাকা দুটোই একসাথে হয়ে গেলাম!’
– কী ব্যাপার, মুখচোখ এতো শুকনো কেনো মাই বয়, আই নো আই নো, ইউ হ্যাড টু পাস এ টাফ টাইম!’
কিসের কথা বলছেন বস? মায়াবতীর কারণে টাফটাইম যাচ্ছে, সেটা উনি জানলেন কী করে? অবশেষে স্পষ্ট হলো, তিনি পুরো অফিসকে ফর্মালি মেইল দিয়ে জানাবেন খবরটা, তবে আমার সাথে আগে আলোচনা করে নিচ্ছেন। ব্যাপার হলো, সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটি আমাকে লিডারশিপ মাস্টার্স কোর্সে এক বছরের জন্য ফুল স্কলারশিপে মনোনীত করেছে। “সাচ এ প্রেস্টিজিয়াস অপরচুনিটি!’ বস গর্ব নিয়ে বললেন। কফি খাওয়ালেন আর একবার। টিমের অন্য কলিগরাও দুএকজন এসে উইশ করলো আমাকে। আমার খুবই আনন্দিত হওয়া উচিত। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিনা তেমন। কী হবে এসব দিয়ে, যদি মায়াবতীকেই না পেলাম? বুকের ভেতর তীব্র অভিমান পাক খেয়ে গলার কাছে উঠে আসছে। কোনো সিনক্রিয়েট না হয়ে যায়, সেজন্য নিজেই তড়িঘরি উঠে পড়লাম। পেছন থেকে বস ডাকলেন-
– ইমতিয়াজ, আপনার খোঁজে অফিসে পুলিশ এসেছিলো। হোয়াট হ্যাপেন্ড? ইজ এভরিথিং ওকে?
আমি চমকে উঠলাম। পুলিশ এসেছিলো? কেনো?

– আরে না না। তেমন কিছু না, ডোন্ট ওয়ারি, জাস্ট স্বভাব চরিত্র কেমন, বাড়ির ঠিকানা এইসব জানতে চাচ্ছিলো। আমি অবশ্য পার্সোনাল ইনফো কিছুই ডিসক্লোজ করিনি, এক্সেপ্ট… স্কলারশীপের বিষয়টা জানিয়েছি।… এনিওয়ে, আমাকে জানাবেন কোনো হেল্প লাগলে… শেষের দিকে তিনি মুচকি হাসলেন। কি কারণ কে জানে?
পুলিশের বিষয়টা আমার মাথায় থাকলো না বেশিক্ষণ। বরং একবুক অভিমান নিয়ে আমি ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। চোখ লাল হয়ে আছে নির্ঘুম রাতজাগার কারণে। মায়াবতীর মুখটা মনে করতে চাইলাম, কানের দুলটাই শুধু ভাসছে চোখে। যাবো না, লাগবে না স্কলারশিপ, বিরবির করে বললাম। হাওরে ফিরে গিয়ে মাছই ধরবো! কখনোই আর তোমার সামনে দাঁড়াবো না! ভালো থেকো প্রিয়তমা! বড় বড় ফোঁটায় টপটপ করে বেসিনের ওপর চোখের পানি পড়তে লাগলো! অস্ফুটে বললাম, এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর!…

হাত ধরো

পর্ব ৭: পার্সোনাল ম্যাটার

আপনারা যারা চ্যাটিংয়ে প্রবল অভ্যস্ত তারা হতবাক হবার এক্সপ্রেশন দিতে একটা জিনিস মাঝেমাঝে ব্যবহার করে থাকেন, তা হলো ওপরদিকে চোখ তুলে তাকানোর ইমোজি! যতো ধরণের ইমোজি আছে, তার ভেতরে সবচে অর্থবহ ও সৃষ্টিশীল মনে হয় এই উপরদিকে তাকানো পুরাই কনফিউজড ভদ্রলোককে। যিনি এটা ড্রইং করেছেন, তাকে পেলে সালাম দিতাম! কেননা, ইলাবৌদির ফোন পেয়ে আমি এখন ঠিক ওই ইমোজির মতোই চোখ চাঁদির ওপর তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি! আদি ঢাকেশ্বরী টানে ইলাবৌদি আমাকে যা জানিয়েছেন, সেটা শুনলে আপনাদেরও অবস্থা এমনই হতো মনে হয়। ঘটনা হলো, জব্বারকে গতকাল সাদাপোশাকে কারা নাকি ধরে গেছে। বৌদির ভাষায়, “চিনতাই কইরা লয়া গেচেগা!’ উনি কাঁদো কাঁদো মুখে জানালেন, “ঠাকুরপো, আপনের বন্দুরে মারেনাইক্কা, তামামটা রাইত খালি হাজতের ভিত্রে মষার আড়তের মইদ্দে বহাইয়া রাকচে!’ (মশা বানানে ষ দিলাম, ভয়ংকরতা বোঝাতে)। আমার ব্রেনের অবস্থা অনেকটা ‘সবকটা লাইন এখন ব্যস্ত আছে- সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না- অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুণ’ -এমন!

কেনো, কিসে, কিভাবে, কী করেছে- ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের জ্যাম লেগে গেছে ‘বেরেন্টের’ ভেতরে। জব্বারের পক্ষে দেশের চলমান আইনের পরিপন্থী কিছু করা দূরুহ, তবে অসম্ভব নয়। আমি ভয়ানক শংকিত হলাম ওকে নিয়ে। কিপটেমি ছাড়া আর কোনো ক্রাইম ও করেছে বলে শুনিনি কখনো। (তবে, প্রাক্তন ইলাবৌদিগন যদি একসাথে ওর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেন – তাহলে আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে জব্বারের জেল জরিমানাসহ সশ্রম-ফাঁসিও হতে পারে! তবে তারা তা করবেন না বলেই মনে হয়, কেননা জব্বারের ভাষায়, ওইসব নাতিদীর্ঘ নাজুক সম্পর্কগুলো নাকি “আপছে-আপোষেই” ঘটে থাকে। কোনো দিক থেকেই কোনো শিকায়েৎ নাই।) যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত কিপটেমিকে সেভাবে আইনের আওতায় আনা হয়নি। তাহলে ওকে ধরে নিয়ে গেলো কেনো? কী করেছে জব্বার? আমি ইলাবৌদির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে উত্তরা মডেল থানায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে যা শুনলাম, তা এক লহমায় শরীরের সব রক্ত শুষে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।

জব্বারকে ধরা হয়েছে ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামান পিএসসির বাসভবনের সামনে থেকে। সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরায় অনেকক্ষণ ধরেই তাকে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছিলো! গতিবিধি সন্দেহজনক বলে কর্তব্যরত সেন্ট্রিরা সিকিউরিটিকে বিষয়টা অবগত করেন। এতো যায়গা থাকতে হতভাগা মায়াবতীদের বাসার সামনে মরতে গেলো কেনো? তার বিরুদ্ধে চার্জটা কী? কর্তব্যরত ইয়াং ডিউটি অফিসার আমার কনফিউশন আরও বাড়িয়ে দিলেন। এ মুহূর্তে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। ওপরের নির্দেশে ধরেছেন, বলছেন। আরও বললেন, আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান দেয়া হবে। আমরা যেনো কোর্ট থেকে তার জামিন নিয়ে নেই! বলে কী? বিনা অভিযোগে কাউকে এভাবে আটকে রাখা যায়? ‘দিস ইজ আনফেয়ার অফিসার, ইউ কেন্নট ডু দিস, সো ফার!”
– অফকোর্স আই ক্যান! লুক মিস্টার…
– ইমতিয়াজ!
– ইয়েস মিস্টার ইমতিয়াজ, ডু য়ু নো হোয়াট হি ডিড? ইয়োর ফ্রেন্ড; হি হ্যাজ থ্রেটেন্ড ব্রিগেডিয়ার’স ফ্যামেলি! সে স্যারের সম্বন্ধীর মেয়ের সাথে দেখাও করতে চাইছিলো?
– ক্কি?
– ইয়েস! আই আম টেলিং ইউ দা ট্রুথ! ইভটিজিং। উনি খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাবেন!
– ওহ্। আপনাদের কোথাও নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে…
– নো। উই হ্যাভ ভিডিও ফুটিজ অন দ্যাট। সে এমনকি বাসায় ঢুকে স্যারের মেয়ের সাথে কথাও বলতে চেয়েছিলো! ভাবতে পারেন?
– স্যারের মেয়ে, না সম্বন্ধীর মেয়ে?
– একই কথা। মেয়ের চেও বেশি।
– কী নাম তাঁর মেয়ের?
– দ্যাট ইজ নান অফ ইয়োর বিজনেস!… তারপরও বলি, স্যারের মেয়ের নাম মায়াবতী! স্যার ডাকেন মাজান, এবার বুজতে পারছেন?

এই তাহলে ব্যাপার! মাথার জটগুলো একটা একটা করে এবার খুলতে শুরু করেছে। প্রচন্ড রাগও হচ্ছে জব্বারের ওপর! আমি ডিউটি অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে জব্বারের সাথে দেখা করলাম। থানা হাজতে নয়, জব্বারকে পেছনের দিকে একটা খালি ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে! এ সমস্ত মডেল থানা এখন কনভেনশনাল প্রাকটিস থেকে বেড়িয়ে এসেছে! আগের মতো আতঙ্কজনক পরিবেশ আর নেই। একজন পুলিশ সদস্য আমাকে ওর রুমটা দেখিয়ে দিলেন। দুহাতের পাতার ওপর কপালের ভর রেখে জব্বার ঝিমাচ্ছিলো চেয়ারে। আমাকে দেখে সোজা হলো। হাসলো অপ্রস্তুতের হাসি। আমি কিছু বলতে যাবার আগেই ও বলে উঠলো,
– তোর ফুপিশাশুড়িকে একদম সাইজ করে দিছি দোস্তো!
– এইটা কী করেছিস হারামী! আমি চাপা গলায় ওকে শাসালাম।
– দোস্তো পাবলিকরে সবসময় চাপে রাখবি বুজলি!
– এইটা কী বলছিস তুই? হিরোগিরি কোথায় করেছিস, বুজতে পারছিস? তোকে তো ওরা ফাঁসাবে। এখন কী হবে?
– কী আর হবে? দোস্তের জন্য রিস্ক তো নিতেই হয়।
– এই পাকনামীটা কেন করতে গেলি, আহাম্মক! রাগে আমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিলো। নিজের না, জব্বারের। ওর কথা শুনে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে বললাম-
– এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার, তোকে নাক গলাতে কে বলেছে? জব্বার হাসলো আমার কথা শুনে।
– আমারও পার্সোনাল ম্যাটার!… মায়াবতী একসাথে দুজনের জিবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। সেটাই বলতে গিয়েছিলাম ওকে!
– মানে? কী বলছিস তুই এসব?
– হ্যাঁ দোস্তো। ম্লান হাসলো জব্বার। তারপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে, যেনো দেয়ালকেই শোনাচ্ছে এভাবে ফিসফিস অনুযোগের সুরে বললো:
– এই মেয়েটার কারণে আমার একমাত্র বন্ধুটা যদি ঢাকা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সেটা কার লস?… আমার অনেক খারাপ গুণ আছে দোস্তো। কেউ আমার সাথে সম্পর্ক রাখেনা, টাকা ধার চাই বলে। কেবল তুইই সেই হল ছাড়ার পর থেকে আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিস। তোকে কি আমি হারাতে পারি, বল?

আমিও ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমাদের দুজনের চোখই এখন আড়াল চাইছে একে অন্যের কাছ থেকে!

হাত ধরো

পর্ব ৮: ফ্লাঙ্কিং মেনুভার

ছোটোবেলায় আমি ভাবতাম পুঁটিমাছই বড় হয়ে ইলিশমাছ হয়। তো কেউ যদি বলে মাগুরমাছ বড় হয়ে কাইনমাছ হয়, তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না। কেননা দেখতে প্রায় একই রকম, শুধু কাইনমাছের গায়ের রং হয় হলদেটে সাদা। সাধারণ জাল মেরে বা বড়শিঁতে এই মাছ ধরা যায় না, কারণ সে থাকে সুন্দরবনের নোনাজলে, গর্তের ভেতর। স্রেফ হাত দিয়ে মাছ ধরতে অনেক দক্ষ যারা, কেবল তারাই পারে কাইনমাছ ধরতে। ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামানের বাসায় আজ সাড়ে তিনকেজি ওজনের সুস্বাদু একটা কাইনমাছ এসেছে মংলা থেকে। মাছের সাথে এসেছে ছেলেবেলার স্মৃতিও! তারা ছোটবেলায় বহু কৌশল করে ‘শোর’ বা নালার একদিকে জাল পেতে, অন্যদিকে ‘বাইক্লোর’ পাতা ছেঁচে কাইনমাছের গর্তে ঢেলে দিতেন। বাইক্লোর তীব্র কটু গন্ধে এই মাছ সুড়সুড় করে বেড়িয়ে এসে জালে আটকা পড়তো। তবে ঝুঁকি ছিলো তাতে। কাইনের পিঠে দশাসই একটা কাঁটা আছে, যার খোঁচা খেলে তিনদিন জ্বর থাকে…!

তহুরা বিশেষ বিশেষ দিনে কিচেনে ঢুকে দু একটা আইটেম বানায়। সেই বিশেষ দিনগুলি হয় সেদিন- যেদিন সিন্ধি আসেন। তহুরা আজ তার জন্য চুঁইঝাল দিয়ে কাইনের সাথে আরও একটা এক্সক্লুসিভ আইটেম পাকিয়েছেন। তা হলো গাবপাতার পাকোড়া। দেশি গাবগাছের একদম কচিপাতা ঝুড়িকরে কেটে তার সাথে সিক্রেট কিছু অনুপান মিশিয়ে ব্যসন দিয়ে ভেজেছেন। এই জিনিস একটা খেলে বহুদিন তার স্বাদ মুখে থেকে যায়। টেবিলে আরও কিছু পদ রয়েছে আরাফাত আর মায়াবতীর পছন্দের। কিন্তু বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও ভাইবোনের একজনও খেতে আসেনি। আরাফাত কাগজ কেটে কী যেনো একটা প্রজেক্ট বানাচ্ছে তার মিসের নির্দেশে। আর মায়াবতীর নাকি খিদে নেই। বেশ কদিন ধরে মেয়েটার খিদে থাকছে না। এতো উচ্ছল উজ্জ্বল মেয়েটা কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গেছে। সব ওই ছেলেটার কারণে। তিনি ভেতরে ভেতরে অসহায় বোধ করলেন। খেতে খেতে সিন্ধি অনেক প্রশংসা করছে তহুরার। বেহেস্তে নাকি প্রথমেই গাবপাতার পাকোড়া সার্ভ করা হবে, এইসব। তিনি ভেতরে ভেতরে টেনশন বোধ করছেন, তবে সেটা তার মুখ দেখে বোঝে কার সাধ্য। হাসি হাসি সপ্রতিভ মুখ করে তিনি সবই শুনছেন, বা শোনার ভান করছেন। সিন্ধির কাছে কিছু আপডেট আছে। কিন্তু সেটা নিজে থেকে জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে না। ইন হিজ ওপিনিয়ন, ইট হ্যাজ গন টু ফার। এট্রিশন ওয়ারফেয়ার হয়ে গেছে! এতোটা বাড়াবাড়ি না করলেও হয়তো হতো! আর তাছাড়া মেয়ের মন কী চায়, সেটা তিনি একটাদুটো কথাতেই বুঝে গেছেন। না বোঝার কথা নয়, ওকে তিনবছর বয়স থেকে পালছেন তিনি। তহুরার চেয়ে তার কাছেই মেয়েটা থাকতো বেশি। ওর নেপি পাল্টানো, খাওয়ানো, গোসল করানো সবই ছিলো ফুপাইর দায়িত্ব! কেরিয়ারের শুরুর দিকে, যখন তিনি একজন প্রমিজিং সোলজার হিসেবে কঠিন কঠিন সব অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তার ভেতরেও ঠিকই সময় বের করে ফেলতেন মাজানের জন্য। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেলো। দুদিন বাদে বিয়ে দিতে হবে। কোন্ পরিবেশে গিয়ে পড়বে কে জানে? আর্থিক সঙ্গতি, সামাজিক অবস্থান, কঠোর নিরাপত্তা – কোনোকিছুই মেয়েদের ভাগ্য নির্ধারণে কাজে আসেনা আসলে। সঙ্গী মানুষটার ওপরেই অধিকাংশ সময় নির্ভর করে তার সুখী হওয়া না হওয়া। তারা যেভাবে ওকে মানুষ করেছেন, তাতে বৈরী পরিবেশে কতোটা নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে সেটা অনেকটাই অনিশ্চিত। তবে তিনি চান না ডিফেন্সের এই বন্দী পরিবেশে তার মেয়ে জিবন পার করুক। তার মেয়ে! হ্যাঁ, তারই মেয়ে। মাবাবা দুজনকেই হারানো এতিম বাচ্চাটাকে তহুরা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বুকে তুলে নিয়েছিলো। একদিকে ভাই, ভাইয়ের বৌ হারানোর শোক, অন্যদিকে নিঃসন্তান দম্পতির রাতারাতি বাবামা হয়ে ওঠা- দুঃখ আর আনন্দের মিশেল!

খাওয়ার পর তারা তিনজন ড্রইংরুমে বসলেন। একটুপর সিন্ধি উঠে গিয়ে সংলগ্ন ব্যালকনিতে দাঁড়ালেন। টোবাকো পাইপে অগ্নিসংযোগ করায় হালকা মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি দরজার চৌকাঠে ঠেস দিয়ে ওদের দিকে ফিরলেন।
– বুজলেন বৌঠান – সিন্ধি শুরু করলেন। ‘ছেলেটা কিন্তু অনেক ভদ্র, আর চুপচাপ।
– কার কথা বলছেন ভাই? তহুরা অবাক হয়ে তাকালেন। যে ছেলেটা আমাদের বাসার সামনে…
– উহু উহু, সিন্ধি আবার ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর ধোঁয়ার ভেতর থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ওর বন্ধুটা। যে তার জামিনের জন্য এসেছিলো।
– আপনি কী করে জানলেন?
– সে আমার চেম্বারে এসেছিলো।… শুধু ভদ্রই নয়। বুদ্ধিমানও।
– কী বলছেন?
– হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। ফালতু নয়, ভালো পরিবারের সন্তান মনে হয়েছে। শাইন করবে…।

হাসানুজ্জামান চুপচাপ তাদের দুজনের কথপোকথন শুনছেন। তাঁর নিজের কাছেও কিছু বাড়তি ইনফরমেশন আছে, যা এঁরা কেউ জানে না। তিনি এখনই সেসব জানাবেন না ঠিক করেছেন। তাঁর অফিসের ড্রয়ারে টেলিস্কোপিক লেন্সে দূর থেকে – সম্ভবত অন্য কোনো বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে – তোলা ছেলেটার কিছু ছবির লার্জপ্রিন্ট রয়েছে। সিন্ধির কথা মিথ্যে নয়। চেহারায় মায়া আছে। কফিরঙের চোখের মনিদুটোয় বুদ্ধিদীপ্ত শার্প চাহনী। এই ছেলে বেকুবের মতো কাণ্ড করে কেনো? অবশ্য এ বয়সে তিনিও কম বেকুবি করেননি। তহুরার বোন, মানে তাঁর শালীদের হাতে কম হেনস্থা হননি। নির্ভেজাল প্রেমে পড়ে গেলে কেউ কেউ এমন হয়ে যায়। বিয়ের পরপর প্রথমদিকের ঘটনা, তহুরার এক মামাতো বোন ছিলো একটু ডানপিটে ধরনের। দুপুরে খাবার পর তিনি পেপারটা হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় বসেছেন। এমন সময় সে এসে বললো, “দুলাভাই, পান খাবেন, মিষ্টি পান।’ এসবে তাঁর অভ্যাস নেই। তারপরও শালীর মন জোগাতে বললেন “খাবো, নিয়ে আসো’। শরীরের পেছনে লুকানো হাত সামনে এনে সে পানটা বাড়িয়ে ধরলো, “উহু, আমার হাতে খেতে হবে, হাঁ করুন’। হাসানুজ্জামান পরম আবেগে শালীর হাতে বানানো পান মুখ হাঁ করে নিয়ে কামড় বসালেন, আর তারপরই – শুধুু তাঁর জ্ঞানচক্ষুই নয়, জ্ঞানকর্ণও সাথে সাথে খুলে গেলো! কাঁচামরিচ দেয়া সেই পান তাকে পুরোটা চিবিয়ে খেতে হয়েছে। ভাগ্যিস সারভাইভ্যাল ট্রেনিংগুলো করা ছিলো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব ভেতরে ভেতরে হাসছেন যদিও, কিন্তু বাইরে নিঃস্পৃহ মুখভঙ্গী করে তিনি তাকিয়ে আছেন। মনে মনে একটা পরিকল্পনা তিনি করে ফেলেছেন। ডিফেন্সের ভাষায় একে বলে আনঅর্থোডক্স ডিটেরেন্স- দৃশ্যমান কোনো নিরাপত্তাবলয় না স্থাপন করেও যখন নিরাপদ থাকা যায়। সিন্ধির সাথে আলাপ করতে হবে, কিন্তু তার আগে তহুরার মতামত জানা দরকার। তিনি আলগোছে একটা নির্দোষ মন্তব্য করলেন।

– কোন বিবাহযোগ্য পাত্রী থাকলে দেখতে পারো সিন্ধি!
শব্দ করে হাসলেন তহুরা। ‘নিজের পাত্রীই জোটাতে পারলেন না, আবার অন্যের…’
হাসানুজ্জামান স্ত্রীর দিকে অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকালেন। কিছু বললেন না। সিন্ধি নিশ্চয়ই মাইন্ড করবে। কিন্তু দেখলেন, সিন্ধি আজ শরীফ মেজাজে আছে।
– না না বৌঠান, আর একজন মানুষের দায়িত্ব নেয়ার যোগ্যতা আমার ছিলো না কোনোকালে।তাছাড়া চারদিকে এতো এতো সেপারেশন কেস দেখেছি একসময়, বিয়ে করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে তাতে!
– বুড়ো বয়সে বুজবেন!
– সয়ে গেছে। সামলে নেবো।’ সংক্ষিপ্তভাবে বললেন সিন্ধি৷ হাসানুজ্জামান উসখুস করলেন, “ইয়ে, ওই ছেলেটার কী অবস্থা এখন?’
– কোন ছেলেটা? দ্যা কুল গাই?
– উহু, দ্যা এ্যারোগেন্ট ওয়ান!
– জামিন হয়ে গেছে! হি হ্যাজ এ পয়েন্ট দো…
– হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ওকে একটু ডেকো তো তোমার চেম্বারে।
– কেনো?

ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামান পিএসসি এবার দুজনের সাথেই তাঁর নতুন আর একটি স্ট্রাটেজি নিচুস্বরে আলোচনা শুরু করলেন। ডিফেন্সের ভাষায় একে বলে ফ্লাঙ্কিং মেনুভার: যখন শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে ছোট একটি দলকে আলাদা করে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়!…

হাত ধরো

পর্ব ৯: কোরামিন

আবার ইলাবৌদির ফোন: “ঠাকুরপো, আপনের বোন্দুতো গত তিনদিন ধইরা বাইত আইতাছেনা! বাংলাবাজারে ভি যায় নাইক্কা। হের মুবাইলে তো কল ডুকতাছেনা- এক ছেরি খালি আবার চেষ্টা করনের বুদ্দি দিতাছে। এলা জবর চিন্তা হইতাছে।… ‘ আমি এবার আর ভড়কালাম না। জব্বারের ধরন এমনই, ধূমকেতুর মতো, কিংবা তিমিমাছ। হঠাৎ করে ডুব দেয়, তারপর নিজেই মন চাইলে ভেসে ওঠে। ওর সবচে যেটা বাজে তা হলো, যারা তাকে ভালোবাসে তাদের থেকেই সে পালিয়ে বেড়ায়। এই ইলাবৌদি ওর জন্য অনেক করেন। ভদ্রমহিলা জাঁদরেল, কিন্তু তাকে ভালোমতোই বশ করেছে জব্বার। মাসিক ভাড়া তো সে দেয়ই না, উল্টো তার কাছ থেকে ধার করে। তারপরও হাসিমুখে ছোট বাটিতে করে মাঝেমাঝে বাসায় রান্না করা মাছ তরকারি জব্বারের জন্য নিয়ে আসেন তিনি।

জামিন নেয়ার পর ওর সাথে সপ্তাখানেক হলো যোগাযোগ করিনি আমি, কিছুটা অপরাধবোধের কারণেই। আমার জন্য বেচারার এমন একটা ফ্যাসাদে জড়াতে হয়েছে। আসলে কারো সাথেই আমার যোগাযোগ নেই তেমন। ইন্টার্নশীপে ঢোকার পর থেকে আরও ব্যস্ত ছিলাম। আর এখনতো মায়াবতীর কারণে একে একে সবকিছুই ছেড়ে দিচ্ছি। অন্তির আব্বুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি, টিউশনিটা কন্টিনিউ করছি না আমি আর। উনি অবশ্য একমাসের পেমেন্ট নিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি যাইনি। পরে অন্তি মেসেঞ্জারে লিখেছিলো, ‘স্যার, আমাদের কী দোষ?’ সাথে পেলোর একটা ছবিও পাঠিয়েছে। লিখেছে, উই মিস ইউ! পেলোকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠলো। ইশ্ কতোদিন দেখিনা ওকে। সত্যিই পেলো হয়তো আমাকে মিস করে। কিন্তু কোনোদিন আর মায়াবতীর মুখোমুখি হতে চাই না এ জিবনে। কাউকে নিরঙ্কুশভাবে ভালোবাসা এক ধরণের অপরাধ। আমি সেই অপরাধে অপরাধী। কিছুই এখন আর টানেনা আমাকে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে ছোটন, নিজেকে বললাম।

বিভিন্ন ধরণের মানুষ দেখা আমার এক ধরনের শখ ছিলো এককালে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাস্তার সাধারণ লোকজনদের হাঁটাচলা, আচরণ, কথা বলার ভঙ্গী, এইসব গভীর মনযোগ দিয়ে খেয়াল করতাম। বেশ লাগতো। এখন কিছুই খেয়াল করিনা আর। আমি কি একধরণের বিকারগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছি? ইদানিং আর একটা বিষয়ও ঘটছে। মায়াবতীকে মাঝে মাঝেই পথেঘাটে দেখতে পাই! দেখে থমকে দাঁড়াই। পা চলতে চায় না। পরে ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি অন্য মানুষ। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার এমন একটা অনুভূতি হয়, সেটা ঠিক বলে বোঝানোর নয়। এমন ঘোর পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হয়েইকি মানুষ সুইসাইড করে? আমি কি সুইসাইডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? কিন্তু কেনো মায়াবতীকে এভাবে দেখতে পাই আমি? কেনো? হয়তো আমার অবচেতন মন যা দেখতে চায়, সেটাই দেখি! বিকেল হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা না বলে টেবিল ক্লিন করে অফিস ছাড়লাম আমি। লিফটে অনেক ভীড় থাকে এইসময়। লাইন দিয়ে নিচে বের হয়ে এসে রিসেপশনের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। আবার মায়াবতীকে দেখছি আমি! রিসেপশনের এককোনের সোফায় বসে আছে। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে সোজা। পরণে মিষ্টি কালারের সুতীর কামিজ সাদা টাইটসের সাথে পড়েছে, চুলগুলো দুপাশে ক্লিপ করা, খোলা। এবার আর আমি পাত্তা দিলাম না ওকে। জানি, একটু পরেই তাকালে দেখবো অন্য কোনো মেয়ে বসে আছে। হিহ্। আমি ওর সামনে থেকে গটগট করে হেঁটে দরজার দিকে আগাচ্ছি। কার্ড পাঞ্চ করার জন্য ওয়ালেট বের করে দরজার সামনে গেলাম, পেছন থেকে রিসেপশনের মেয়েটা আমাকে ডাকলো, ‘স্যার, ইউ হ্যাভ এ ভিজিটর…।’
– কে?
– উনি। বলে কোণের সোফার দিকে ফিরলো। সেদিকে তাকিয়ে আমি জমে গেলাম। মায়াবতী! সত্যিই মায়াবতী!! চোখ বড় হয়ে গেছে আমার, কারণ সে আমার দিকেই এগিয়ে এলো।
– তুমি এখানে? কার কাছে এসেছ?
– আপনার কাছে!
– ওপরে যাওনি কেনো? বলে আমি রিসেপশনের দিকে ঘুরলাম। কিছু বলার আগেই মেয়েটা ব্যাখ্যা দিলো, স্যার আমি প্রথমেই আপনাকে ইনফর্ম করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ম্যাম নিষেধ করেছেন… সরি স্যার…!
মায়াবতী মাথা ঝাঁকালো, ‘ হ্যাঁ, আমিই বারণ করেছি। আপনার কাজে ডিস্টার্ব করতে চাইনি!’
সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। আমার কাছে এসেছে কিন্তু আমাকেই না জানিয়ে বসে ছিলো।
– কতক্ষণ ওয়েট করেছ?
– একঘন্টার ওপরে। রিসেপশনের মেয়েটা বললো। তো এই পয়েন্টে আর কী বলা যায়? আমি আলগা স্মার্টনেস চড়িয়ে- যেনো কিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে – এমন ভাব নিয়ে গড়গড়িয়ে বললাম:
– আমার অফিস শেষ, কি করবে এখন?
– আমি… মানে একটা কথা ছিলো… চলুন… বলে বাইরের দিকটা ইশারা করলো মায়াবতী। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজা মেলে ধরে প্রথমে ওকে বের হতে দিলাম। তারপর নিজে বের হয়ে বললাম,
– আমার অফিস চিনলে কী করে?
– চিনতাম না তো।… খুঁজে খুঁজে বের করেছি। শুধু অফিসের নামটা শুনেছিলাম অন্তির কাছে! মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বললো সে।
– তাই?
– হ্যাঁ। পুরো কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ওই মাথা থেকে প্রতিটা বিল্ডিংয়ে হানা দিতে হয়েছে। অবশেষে খুঁজে পেলাম।
– মানে? কী বলছো এসব? গুগল সার্চ দিলেই তো পেতে।
– তা পেতাম, কিন্তু আমার মোবাইলটা ভেঙে ফেলেছি গত মাসে। তাই দেখতে পারিনি। অন্তিও তোমার ঠিকানা বলতে পারলো না।
আমি ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অফিস বিল্ডিংয়ের সামনের পোর্চে চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম।
– তুমি সত্যি সত্যি প্রতিটা বিল্ডিংয়ে ঢুকে আমাকে খুঁজেছ?
– হ্যাঁ।
– কতক্ষণ লেগেছে?
– সাড়ে তিন ঘন্টা!
– বলো কী?
– এতো অবাক হবার কী আছে? মানুষ কি মানুষকে খুঁজবে না? বলে এমন একটা চাহনী দিলো মায়াবতী, যে আমার সকল স্নায়ু ঝনঝন করে ঘন্টি বাজিয়ে দিলো। আমি মায়াবতীর চোখে সরাসরি চোখ রাখলাম! এই প্রথম! গভীর দৃষ্টিতে যেনো ভেতরের সব স্ক্যান করে ফেলবো। আহত চড়াইয়ের মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে- যেনো তার গোপনীয় সব আমি জেনে ফেলেছি, এখন জিবন মরণ সব আমার হাতে – এমন অসহায় ভাব নিয়ে তাকালো সে। দূরারোগ্য রোগীরা যেভাবে তাকায়। নাকের ওপর বিন্দুবিন্দু ঘাম, অনেক ক্লান্তও দেখাচ্ছে। মায়া হলো, চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম আমি। আর এক মিলিসেকেন্ড ওভাবে থাকলেই হয়তো সে, না হয় আমিই কেঁদে ফেলতাম। মায়াবতীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম ভালো করে। চোখের নীচে কালি। শুকিয়েছে। আবার আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে! কোথাও কিছু একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এসি কারেন্টে চলছিলো সব এতদিন, হঠাৎ ডিসি কারেন্ট শুরু হয়েছে। আমার বুকটার ভেতর কুয়াকুয়া করছে এখন। এমন কেনো লাগছে আমার? কী বলে এই অনুভূতিকে? আমাদের পাশ দিয়ে অন্য অফিসের লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। আমাদেরকে ফিরে দেখছে কেউ কেউ। ওনাদের নিশ্চয়ই এমন অনুভূতি হচ্ছে না?
– কেনো খুঁজেছ আমাকে? আমি কে? আমি তো একটা ফালতু ছেলে! (অভিমানের সুযোগ পেলে ছেলেরা সাধারণত ছাড়ে না)
– আচ্ছা, ঝগড়াটা আমরা কোথাও বসে তারপর করি, প্লিজ! আমার পা ব্যাথা করছে, অনেকক্ষণ হেঁটেছি! (যুগে যুগে প্রেমিকারা এভাবেই জিতেছে!)
– কোথায় যেতে চাও?
– খাবো কিছু একটা। আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, দুপুরে খাইনি!…
আমি এবার আর ওকে ক্ষমা করলাম না। খপ করে ওর ডান হাতটা ধরে – যেনো কতোদিনের সম্পর্ক আমাদের- এভাবে গোঁয়াড়ের মতো টেনে নিয়ে রাস্তা পার করলাম। উল্টোদিকের দুটো বাড়ি পরেই একটা কোজি রেস্টুরেন্ট আছে। পা ছড়িয়ে, পা তুলে যেমন খুশি সোফায় আরাম করে বসে খাওয়া যায় ওখানে। আমরা দুজন হাতধরাধরি অবস্থায় সিঁড়িতে উঠতে উঠতে মায়াবতী হাসলো।
– আমার হাতটা কেউ কিনে রেখেছিলো নাকি?
– হাতসহ পুরো মানুষটা! বলে আরও জোরে চেপে ধরলাম হাত। নরম পেলব হাতটা লাল হয়ে গেলো চাপ খেয়ে। ছাড়বো না, যা থাকে কপালে! আপনারাই বলুন, আমি কি কোনে অন্যায় করছি? ভাবছেন বিটিভি কীকরে এক নিমেষে এমটিভি হলো, তাইতো? ম্যাজিক, স্যার। প্রেম এক আশ্চর্য ম্যাজিক! সব বদলে দেয়। যাকেতাকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করিয়ে নেয়। প্রেম এক মহাশক্তির নাম। এই মেয়েটার জন্য আমি সব হারাতে বসেছিলাম। এখন কোরামিন দেয়ার মতো নিজেকে নিয়ে আমার মৃত্যুসজ্জায় হাজির হয়েছে! সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে আমি দুহাতে ওর ফর্সা হাতটা আঁকড়ে ধরলাম। তারপর আপনাদের চোখের সামনেই দুঃসাহসে মায়াবতীর হাতে চুমু খেলাম একটা! এটুকু শাস্তিতো তাকে দিতেই পারি আমি, তাইনা?

হাত ধরো

পর্ব ১০: চিলের ছোঁ

রিকশা একটি রোমান্টিক বাহন। তামাম দুনিয়ায় এর মতো সহনশীল যান আর একটাও নেই। আমার আর মায়াবতীর মত সদ্য প্রেমিক-প্রেমিকা যারা, তাদের কাছে এর কার্যকারিতা অতুলনীয়। প্রেম করেছে কিন্তু একসাথে রিকশায় ওঠেনি, এমন কাপলদের জন্য আমার দুঃখ হয়, করুণা লাগে। রিকশার বিবিধ উপকারিতাগুলো নিম্নরূপ:
১) ভালোবাসার মানুষটি সত্যিই আপনাকে ভালো বাসে কিনা, তা বোঝার উপায় একসাথে রিকশায় ওঠা। যাচাই করার এর চেয়ে কার্যকরী মাধ্যম আর দ্বিতীয়টি নেই। ছেলেটি বা মেয়েটি তার সঙ্গীর প্রতি কতোটা কেয়ারিং কতোটা একাগ্র ও রূচিশীল সেটা বোঝা যায় তার ঘনিষ্ট হয়ে বসার ভঙ্গীমাতে।
২) প্রেমিক-প্রেমিকা সবসময় একে অন্যের মুখদর্শন করতে পারে। ভেতরে ক্রিম লাগানো জোড়া বিস্কুটের মতো পাশাপাশি (বা তারচেও কাছাকাছি) ছুঁয়ে থাকা যায়। প্রেমিকার শাড়ির আঁচল, ওড়না, চুলের ঝাপটা এসব ফ্রি, এর জন্য আলাদা করে পে করতে হয় না।
৩) হাত ধরা যায়! (লাখ টাকার সুবিধা এটাই। খুনসুটির বিভিন্ন স্টেজে দিনে দুপুরে ডাকাতি করার অপরাধে এই হাতকে মাঝে মাঝে অবশ্য জেলেও যেতে হয়!)
৪) ঝগড়া করতে সুবিধা। আর ঝগড়ায় তৃতীয় ব্যক্তিকে স্বাক্ষীও রাখা যায়। তাছাড়া, আপনারা দুজন যখন কোনো বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করছেন, তখন তৃতীয় ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ মতামতও পেতে পারেন। যথা, ঠিকোই কইছেন মামা, হয় হয়, আমারও সেইটাই মনে হয়, ইত্যাদি। (অনেক সময় দেখা যায়, এই তৃতীয় ব্যক্তি তার নিজের কাহিনী বলার ব্যাপারে এতোই আগ্রহী, যে আপনাদের প্রেমালাপ গৌন হয়ে গেছে!)
৫) একমাত্র রিকশাতেই আপনি ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পেতে পারেন। যে উচ্চতায় রিকশাতে বসতে হয়, সেটা কোনোকিছু দেখার জন্য খুবই আরামদায়ক। চলন্ত রিকশায় চারপাশের দৃশ্য অনেকটা সিনেমার মতো প্যান করে দেখতে পারেন। আর এসব পাচ্ছেন একদম ফ্রি ফ্রি!!
৬) সেলফি তোলার জন্য রিকসা একটি আদর্শ স্থান। খেয়াল করে দেখবেন, সেলফিতে দুজনের পেছনে রিকশার হুডের কারণে দারুন একটা ফ্রেমিং হয়ে যায়, যা আপনার ছবিকে দেয় বিশ্বমানের মর্যাদা।
৭) বৃষ্টির সময় পর্দাঘেরা রিকশার উপকারিতা বিষয়ে কিছু ভাঙিয়ে বলতে হবে, না বুঝে নেবেন?
রিকশা নিয়ে আমার আরও অনেক গবেষণা আছে, আর একদিন বিস্তারিত বলবো আপনাদের।
আজ আমাদের তৃতীয় আউটডোর ডেটিং (আগেই বলেছি, ইনডোর ডেটিংয়ের কথা ভাবলেই দমবন্ধ লাগে! আমার হার্ট আবার খুবই নিরীহ)। কোথায় যাবো, ঠিক করিনি কিছু। তবে আর যা-ই করি, কোনো বৃহত বিপনীকেন্দ্রে মরে গেলেও ঢুকবো না। ইউনিভার্সিটির দিকেই যেতে বললাম রিকশাকে। মায়াবতীর সাথে শেষ যেদিন দেখা হলো, তার পর থেকে দিনের অধিকাংশ সময় আমরা অনলাইনে ছিলাম। বহু কথার মান অভিমানে পোক্ত করেছি বোঝাপড়াটা। কিন্তু মন তবুও মানে না। একে অন্যের কাছে যেতে চায়। অনেক খুশিখুশি লাগছে মনটা আজ। মনে হচ্ছে কোনো ঝরণার পাশে বসে আছি। ঝিরিঝিরি শব্দ পাচ্ছি জলপতনের। ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে একদম। আমার পাশে যে ভদ্রমহিলা লাগাতার কথা বলে যাচ্ছেন, তার নাম উম্মে হুজাইফা!

ভ্যানিলা আইসক্রিমের সাথে কাঁচাহলুদ আর চন্দন মেশালে যে রং পাওয়া যায়, ওর তেমনি। এতো রূপের দিকে সোজাসুজি তাকানো যায় না, তাকাতে হয় আড়চোখে। আমি সেভাবেই দেখছি এখন। সবকিছু এখনো আমার বিশ্বাসও হচ্ছে না; মনে হচ্ছে সিনেমা দেখছি। ভয় হয়, যদি সিনেমাটা এখনি শেষ হয়ে যায়? রিকশায় ওঠা অব্দি তাই ওর হাতটা ছাড়িনি আমি। আল্লারি আল্লা, আমাকে বলার এতো কথা জমা ছিলো ওর পেটে! অথচ বাসায় নাকি সে কথাই বলেনা! আলোচনার টপিকগুলোও ইউনিক! পেলো-পর্ব চলছে এখন।

পেলোর নাকি আরও চারপাঁচটা ভাইবেরাদার ছিলো, ফেলো মেলো বেলো আরও কিকিসব নাম বলছিলো! রাস্তার পাশে ফুল প্যানেলে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিলো ওরা। কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা ওদের বস্তাভরে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তার ফুপাই কী করে বীরদর্পে তাদেরকে রেসকিউ করে নিয়ে আসেন তারই সবিস্তৃত বর্ণনা চলছে! পয়েন্ট টু বি নোটেড ইয়োর অর্নার, এসব আলোচনা কিন্তু আমাদের প্রেমালাপেরই অংশ!! এবং আমি যে একজন মনযোগী শ্রোতা, সেটা বোঝানোর জন্য নিয়মিত ইন্টারভেলে হু দিয়ে যাচ্ছি! কিন্তু তাকাচ্ছি না ওর দিকে। তাকালে সহ্য হবে না, সেটাই কারণ। আমি বরং লক্ষ রাখছি ওর দিকে কারা কারা তাকায় সেটার প্রতি। ভীষণ রাগ লাগে এই পুরুষজাতটার প্রতি! কেনরে কাকু, পরওয়ারদেগার তোদের আন্ধা বানাতে পারলো না? খোদার দুনিয়ায় এই একটিই রূপবতী নারী, আর কাউকে চোক্ষে দেখিস না? অবশ্য কিছুকিছু মেয়েরাও তাকাচ্ছে ওর দিকে। সেটা নির্ঘাত হিংসায়! হুজাইফাকে সেটা বলতেই খিলখিল করে হাসলো সে।
– দেখুক। তুমি অমনযোগী বলেই সবাই এমন করে তাকাচ্ছে।
– কে বললো আমি অমনযোগী?
– আচ্ছা তাহলে বলোতো একটু আগে কী বলেছি আমি?
– পেলোর ভাইবোনদের কথা…
– আরে নাহ, বলছিলাম, পেলোর একটা এ্যাফেয়ার ছিলো পাশের বাসার একটা বেড়ালের সাথে। সেজোফুপি সেটায় পর্যন্ত বাগড়া দিয়েছেন! শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। উহ্ ভদ্রমহিলার হাতে দুনিয়ার কোনো প্রেমই নিরাপদ নয়। অথচ নিজে ঠিকই মেজরসাহেবকে (তৎকালীন) জ্যাভলিন মেরে ঘায়েল করেছেন। বিএল কলেজের ছাত্রী ছিলেন সেজোফুপি। উইমেন স্পোর্টসে কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। শর্টপুট, ডিসকাস আর জ্যাভলিন চালাতে গিয়ে ছুটিতে বাড়িতে আসা মেজরসাহেবকে নক আউট করে দিলেন একেবারে! তার আগে এলাকার বখাটে, মাস্তানদের বেশ কয়েকটাকে ঠেঙিয়েছেন। তার ভয়ে নাকি ওরা টটস্থ থাকতো। সেই সেজোফুপির কথা শুনলেই আমার হাঁটুদুটো নিয়ন্ত্রণ হারাবে স্বাভাবিক। পায়ে বল থাকেনা। মনে হয় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি! এটা মায়াবতীকে বললে সে চোখ পাকিয়ে বকুনি দিলো।
– তোমাকে কিন্তু তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে একদিন। পারবে না?
– অবশ্যই পারবো!… কিন্তু যে ভয়ভয় লাগে!
– কী বলো, কেনো? সেজোফুপি রাগী, তাই বলে কী তোমাকে খেয়ে ফেলবেন? আমার জন্য, তাঁর কাছে আমার হাত চাইতে পারবে না তুমি?

এমন করে বললো কথাটা, আমি ক্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়েই রইলাম। কী সুন্দর ওর মায়াভরা চোখদুটো! নিরীহ গোরুর মতো ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেই এখন ভালো লাগছে আমার! মায়াবতীও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি জানি কি ভাবছে, কাপুরুষ ভাবছে কিনা। আর তখন, তখন, তখন একটা দৈবঘটনা ঘটে গেলো! স্থান কাল পাত্র- কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে ঝট করে মায়াবতী তার ডানহাত দিয়ে আমার চিবুক ধরে ওর দিকে টানলো আমার মুখ। আর তারপর চিলের ছোঁ মারার মতো চকিতে আমার ঠোঁটের ওপর তার পেলব কোমল ঠোঁট নামিয়ে আনলো! শরীরের ভেতর থেকে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুত চলে গেলো!

– ভয় ভাঙিয়ে দিলাম! আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চাপাস্বরে কিন্তু স্পষ্ট করে বললো সে! আর আমি তাকিয়ে দেখলাম, পৃথিবীটার বয়স অনেক কমে গেছে! চারদিকে নতুন পাতার সমাহার। রিকসাওলার চেইন পড়ে গেলো তখন! পড়ারই কথা!!!

হাত ধরো

পর্ব ১১: মহাশোল

সেজোফুপি যদি টর্নেডো হন, আমার আম্মা সেই তুলনায় সুপার সাইক্লোন! আর এদের দুজনের যদি সংঘর্ষ বাঁধে, তাহলে কী দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে পারে মায়াটোনের জিবনে তাই ভেবে এখন শংকিত হচ্ছি! মায়াটোনের বিষয়টা বোধহয় পাঠক-পাঠিকা ঠিক ঠিক বুঝিলেন না। বিষয় হলো, অধুনা ক্রেজ হচ্ছে সেলিব্রিটি কাপলদের নাম সন্ধি করে একত্রে ডাকা। সেই অনুযায়ী আমরাও নিজেদের নাম এভাবে গ্রাফটিং করে নিয়েছি। অবশ্য আপনারা চাইলে ছোটোবতীও ডাকতে পারেন। তবে দয়া করে আমাদের সার্টিফিকেট নাম নিয়ে ওইসব এক্সপেরিমেন্ট না করাই ভালো। কী দরকার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দাঁতগুলোকে মাঢ়িছাড়া করার?

আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি এয়ারপোর্টের সামনে। সিলেটের পরপর দুটো ফ্লাইট নেমেছে। যাত্রীদের বের হওয়া দেখছি, হঠাৎ আম্মার দিকে চোখ পড়লো। হুইল চেয়ারে বসে আছেন। সোনালি ফ্রেমের চশমা আর সোনালি চিকন পাড়ের কাঞ্চিভরম শাড়িতে আম্মাকে অন্যরকম লাগছে। আম্মার পেছনেই হুইলচেয়ারের হ্যান্ডেল ধরে আছে শিবশংকর -আমাদের শিবদা! তার সাজপোষাক দেখে না তাকিয়ে উপায় নেই। সাদা ফিনফিনে ধুতি আর পাঞ্জাবি-শার্টের সাথে বুটজুতো আর গায়ে চড়িয়েছে নীল রঙের ব্লেজার। মাথায় পাগড়ি। পান খাওয়া ঠোঁট আর পাকানো গোঁফ, সেইসাথে চোখের চাহনী দেখলে রক্ত হিম হয়ে যায়। ছোটবেলায় তাকে দেখে ভয় পেতাম। আম্মার সার্বক্ষণিক বডিগার্ড কাম এসিস্টান্ট। শিবদার পেছনে একান থেকে ওকান পর্যন্ত দাঁত বের করা পটলমার্কা হাসি নিয়ে মুখ দেখালো জব্বার! ইশ কী খুশী! হাতে একটা লম্বা প্যাকেট (পরে শুনেছি ওটার ভেতরে ছিলো হাওড়ের সিগনেচার আইটেম- মহাশোল। দশকেজি ওজনের।) তিনজনের দলটা গেট পেরিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জের কাছে আসতেই আমি এগিয়ে গেলাম। আম্মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।
– কিলা আছোগো আম্মা। আফনার শরীর ভালা আছেনি?
– অয়রে পুত, আল্লায় রাখছইন। কমরোর বিষে লরতে পারি না।’ উনি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। এরপরই পড়ে গেলাম শিবদার খপ্পড়ে। আমাকে জাপটে ধরে দেড় মিনিট বুকের ভেতর পিষলেন। এর ভেতরে যা যা শুনলাম, তা হলো, ‘কিতাবা, তুমি তো হুকাইয়া কাটি হইয়া গেছো।’ মানে আমি শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছি, গায়ের রং কালো হয়ে গেছে, আমি নিজের যত্ন নেই না, এতো পড়ালেখা করলে শরীর টেকে না। সবশেষে, নালিশের সুরে আম্মাকে বললেন, “জেঠিমা, দাদাভাইরে এব্লা বিয়া করানি লাগে!’

ঘটনা দেখে আপনারাও নিশ্চয়ই আমার মতোই চমকে গেছেন? সেটাই স্বাভাবিক। আমিও মাত্র ঘন্টা দুয়েক আগে জেনেছি। সুদুর সুনামগঞ্জের হাওর পেরিয়ে সেই সাল্লা থেকে এরা প্রথমে সিলেট এসেছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমাকে কল দিয়েছে জব্বার। আমি অফিস থেকে তড়িঘড়ি এখানে পৌঁছেছি। আজই বিকেলের ফ্লাইটেই তারা ফিরে যাবেন সিলেট। এতো তাড়াহুড়া করে আসার কারণ, জব্বার তাদেরকে বুঝিয়েছে, মায়াবতীর কারণে আমি নাকি যে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারি। সেটা অবশ্য সত্য। কিন্তু হারামীটা করেছে কী? কার বুদ্ধিতে সে আমার বাড়ি গেলো? ঠিকানাই বা পেলো কোথায়? এসব জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম না কারণ, সরকারী ফ্লাগ লাগানো একটা গাড়ী এসে লাউঞ্জের সামনে থেমেছে। দিরাই সাল্লা আসনের এমপি সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন আম্মার জন্য। পাঠাবারই কথা! গোটা দশেক জলমহালসহ পুরো সাড়ে পাঁচশো একর ভূসম্পত্তির মালিক চৌধুরাণী, মানে আমার আম্মা। তিনি শিলংয়ের মেয়ে। দেশভাগের আগে সিলেট শিলং সব একই ছিলো। আমার দাদার ছিলো পাথরের কারবার। সেই সূত্রেই আত্মীয়তা। শুনেছি গৌহাটির মহারাজাদের সাথে আমার নানার সখ্যতা ছিলো। নিয়মিত আসাযাওয়া ছিলো দুই পরিবারে। সেই বনেদিয়ানা এখন আর নেই, তবে আমাদের এলাকায় এখনো চৌধুরাণীর কথাই শাসন। কে কোথায় নির্বাচনে পাশ করবেন না করবেন সেটা চৌধুরীবাড়ির সমর্থনের ওপর নির্ভর করে।… এসব কথা লিখতে সংকোচ হচ্ছে। আমি কখনো এসব কাউকেই বলি না। বন্ধুদেরতো নয়ই। আম্মা হুইলচেয়ার ছেড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে কাছে ডাকলেন। “ফুরি আমার বালা লাগছে। তোমার দাদীর লাখান চেহারা।’
– কিতা কওগো আম্মা, আপনে তো না দেক্কিয়া পছন্দো কইরালাইছুইন…
গাড়ির দরজা খুলে শিবদা সসম্মানে সরে দাঁড়ালেন। আম্মা গাড়ীতে উঠে জানালার কাঁচ নামিয়ে বললেন, “তুমি চিন্তা খরিওনা, বৃগেডিওর সাবরে আমি বুজাইয়া সবতা ঠিক করমুনে…।’

গাড়ি চলা শুরু করতে জব্বার পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো। – দোস্তো!
– কিরে তুই গেলিনা?
– কোথায়?
– ওদের সাথে, তোর মাঐ আম্মার সাথে দেখা করতে?
– আবার! আমারে কি কামড়া পাগলায় কুত্তাইছে? আমার দায়িত্ব শেষ। এখন তারা তারা বুঝুক!’ তারপর হঠাৎই ওর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলো, ‘এই ফাজিল, তোরা যে এত্তো ধনী, এতোদিন বলিসনি কেনো? কী বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ী তোদের, ইশ্ আগে জানলে…
– আগে জানলে কী করতি?
– কত্তো টাকা ধার চাওয়া যেতো!
আমি হাসলাম। “বলার কী আছে বল্? এসব সহায় সম্পদ অর্জনে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই। সবই বাপদাদার অর্জন, সেসব নিয়ে গর্ব করার কী আছে?’
জ্ঞানীর মতো মাথা নাড়লো জব্বার। হুম, ঠিক বলেছ পোতোন চৌধুরী। তারপর নিষ্ঠুর চেহারা করে বললো, ‘জেঠিমা চাইলে – শিবদার অনুকরণে সেও একই সম্বোধন করে আম্মাকে- ওরকম পাঁচজন ব্রিগেডিয়ার বডিগার্ড রাখতে পারেন! বাপরে কী দাপট! তুই জানিস, শিবদার কোমরে সবসময় পিস্তল থাকে!’
– জানবো না কেনো, আমাদের দোনলা বন্দুকও আছে লাইসেন্স করা।
– একটা জিনিস দেখলাম দোস্তো, এলাকার কেউ ওর দিকে মুখ তুলে কথা বলেনা!
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শিবদার কুখ্যাতির শেষ নেই। এবং তার অধিকাংশই সত্যও। জলমহাল ইজারা নিতে অনেক পাওয়ার গেমিং চলে।
– বাদ দে এসব। ওদের ডেকে এনে ভালো করিসনি তুই। কী অঘটন ঘটে কে জানে?
– আরে আমি কি যেতে চেয়েছি নাকি?… বলতে গিয়ে মাঝপথে কাছিমের গলা ঢোকানোর মতো কথাটা মুখ থেকে আবার পেটে চালান করে দিলো।
– মানে?
– সেসব তোকে বলা যাবে না পোতোন, সিন্ধি আঙ্কেলের নিষেধ আছে।
– সিন্ধি আঙ্কেল মানে সেই প্রসিকিউটর?
– বললামতো, নিষেধ আছে।জব্বার আমার কাঁধে হাত রাখলো। কথা ঘোরাতে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ননস্টপ বলতে লাগলো এতোদিন সাল্লাতে কিকি খেয়েছে, দেখেছে, সেইসব। শেষে যোগ করলো-
– পোতোন, মেরে ভাই, আমরা না একমায়ের পেটের দোস্তো, তোমাকে একটা রিকু করি সোনা?
– করো, ওর ঢংয়ে আমিও হেসে সায় দিলাম।
– মায়াবড়ি, সরি মায়াবতীকে নিয়ে দয়া করে আর কোনো কেলেঙ্কারী ঘটিও না।
– আমি কী করেছি?
– না না তুই কিছুই করিসনি, শুধু জঙ্গলে ঢুকে বাঘিনীর সামনে থেকে তার বাচ্চা কোলে নিয়েছিস শুধু!’ দৃশ্যটা হাত নেড়ে অভিনয় করে দেখালো সে। তারপর জ্ঞানীর মতো বললো-
– দেখ দোস্তো, বাঘসিংহ মাংশাসী প্রাণী, গরুছাগল হলো ঘাসাসী প্রাণী আর হাঁসমুরগি ধানাসী প্রাণী, মানে আমরা। তো বাঘসিংহ ঝগড়া কাজিয়া করে করুক। আমরা বেনিফিশিয়ারি হিসেবে তার সুফল ভোগ করি, কেমন?

হাত ধরো

পর্ব ১২: দমবন্ধ লাগে!

মায়াবতীর সাথে আমার প্রেমটা শেষমেষ টিকলো না, জানেন! টিকবে কী করে, প্রেমে পড়তে না পড়তেই বিয়ের আয়োজন করলে কি আর প্রেম থাকে? সেটা তখন হয়ে যায় ‘ব্রেম’! এই ব্রেমও বহু ক্যাঁচাইল্লা জিনিস; একদিকে শাড়ি-আংটি-হলুদের তত্ত্ব, অন্যদিকে ফুচকা-ঝালমুড়ি-রিকশা! গরমভাতে পানি ঢেলে দেবার মতো মায়াবতীর ফুপাই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আমার আম্মার কাছে। আর তাই শুনে আম্মাও ঢাকায় আসতে দেরি করেননি।

যা ভাবা হয়েছিলো, সেসব কিছুই হলো না। দেখা গেলো, সেজোফুপীর সাথে চৌধুরাণীর এক নিমেষে ভাব হয়ে গেলো। বিশেষত আম্মার কাঞ্চিভরম শাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। এক্সক্লুসিভ জিনিস। দু বেয়ানের ভাব দেখে ব্রিগেডিয়ার সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। ডিফেন্সের ভাষায় এই অবস্থাকে কী বলে সেটা এখন তিনি মনে করতে পারছেন না। তার ওপরে বাঁধ সেধেছে ভাষা। সাবটাইটেল না থাকার কারণে ওই পক্ষের কোনো কথাই ঠিক ঠিক বুজতে পারছেন না। ফলে ঘটনা তার বিপক্ষে না পক্ষে যাচ্ছে বোঝা দুঃষ্কর। শত্রুপক্ষের গতিবিধি না জানলে যুদ্ধ-কৌশল ঠিক করা যায়? সিন্ধি থাকায় তবু যা রক্ষা। কিন্তু ব্যাটা এখন ওই পক্ষের উকিল হয়ে বসে আছে। সিন্ধির আব্বা সত্তরের নির্বাচনে সাল্লা থেকে টিকেট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। চৌধুরীদের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোই জানাশোনা আছে তাঁর। আহলাদে গলে পড়ছে একেবারে। গল্প তাঁরাই করছে, তিনি কেবল শুনছেন। উকিল কখনো বন্ধু হয়না, ভাবলেন তিনি। অবশ্য মহাশোলের সাইজ দেখে ওদের বনেদিয়ানা তিনিও কিছুটা আঁচ করতে পারছেন।

অবশেষে মুখমিষ্টি পর্বের পর, উম্মে নুজাইফাকে সামনে আনা হলো। চৌধুরাণী ডেকে তাকে কাছে বসালেন। শিবশঙ্কর তার জেঠিমার পেছনেই দাঁড়ানো (জেঠিমার সামনে তার বসার রেওয়াজ নেই)। নুজাইফার কাঁধে স্নেহের হাত রেখে ব্যাগ খুলে প্রথমেই আম্মা রুবী সেট করা একটা মহার্ঘ স্বর্ণের নেকলেস পড়িয়ে দিলেন ওর গলায়। প্রায় কোমর পর্যন্ত লম্বা। আস্তে করে বললেন, আমার হড়ির (শ্বাশুরি) গয়না, এখন তাকি তোমার! তারপর শিবদার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চৌধুরাণী যেনো তার মতামত নিচ্ছেন সেইভাবে মন্তব্য করলেন,
– এই ফুরি কিতা পারবানি দশগু জলমহালের ইজারা ঠিকবাবে বন্দোবস্তো করতে, শিবশঙ্কর?
– আইজ্ঞা জেঠিমা, তাইন পারবা!
– তাইলে তুই আগামি ম্যাগোর কালো বিয়াচূড়ার বন্দোবস্ত কর্।
– আইজ্ঞা জেঠিমা নিয়ালাইছি।
এরা সব মেঘের কথা কী বলছে, হাসানুজ্জামান বুজতে পারছেন না। সিন্ধির দিকে তাকাতে তর্জমা এলো: আগামি বর্ষায় বিয়ে, মানে একবছর পর! কেনো? না, আমার স্কলারশিপ এখানে মূখ্য কারণ নয়। বিষয় হচ্ছে, হাওড়ে বর্ষাকাল ছাড়া উৎসব জমে না। চৌধুরাণীর এক কথা “ম্যাগোর দিন ছাড়া আমার ফুয়ার হেঙ্গা হইতো না।’ ধামাইল, মানে গীতবাদ্য ছাড়া বিয়ার রেওয়াজ নাই তাঁদের খানদানে ! আর সেটা বর্ষাকাল ছাড়া হাওড়ে সম্ভব?

হাসানুজ্জামান যুক্তি শুনে মুখ হা করে ফেললেন। তহুরাও ঘনঘন মাথা নেড়ে বুঝুক না বুঝুক সিন্ধির মতোই সায় দিচ্ছে! তিনি খুবই অসহায় বোধ করলেন। পরে অবশ্য এই নিয়ে তিনি তহুরার কাছে একটা চরম মুখঝামটা খেয়েছেন, ‘মেয়েটাকে ঘরের বার করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ? কী এমন হবে; একটা বছর তো কাছে পাবো ওকে, সেটা সহ্য হয় না?” তারপর স্বামীস্ত্রী দুজন মিলে কাঁদলেন। মেয়ে হারানোর কান্না।

কাঁদলো মায়াবতীও। তবে সেটা ভিন্ন কারণে। এই একটা বছর সে কেমন করে আমাকে ছেড়ে একা থাকবে, এটা ভেবেই বেচারা কাহিল একদম। কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে। সেই লালচোখ নিয়েই সে বললো,
– আমাকে দূরে ফেলে রেখোনা মী, যতো তাড়াতাড়ি পারো আমাকে তোমার সন্তানের মা হতে দাও!

বিশ্বাস করেন, এটা সত্যি সত্যি বলেছে সে। না না আমি কিছু করি নাই। ইনডোর ডেটিং হলেও আমরা এক মিনিটের জন্য একা হতে পারিনি। জব্বারের টংয়ে এসেছি দুজন। হিসেব মতে আমরা স্বামী-স্ত্রী হইনি যদিও, তবে বাগদান তো হয়ে গেছে। কাবিন হবে আমি সুইডেন থেকে ফিরে আসার পর। কিন্তু এই বেটাকে সেটা বোঝাবে কে? কট্টর মাওলানা একটা। রাতারাতি মায়াবতীর বড় ভাই সেজে বসে আছে। খবর শুনে ইলাবৌদি হাজির। আমার কাছ থেকে একরকম ছিনতাই করে সে, আহো ভইন, আম্গো বাইত আহো, বলে মায়াবতীতে হাত ধরে টেনে নিচে নিয়ে গেলো। ঘন্টাখানেক পর একটা পুরাণঢাকার মেয়ে ঢুকলো ঘরে। মেয়েটা মায়াবতীর মতোই। কিন্তু পড়ে আছে লাল রঙের ঢোলা আফগানী সালওয়ার আর হাঁটুপর্যন্ত হলুদ টাইটফিট কামিজ (মাগোহ্!) দুইবেনী করা চুল দুদিকে হলুদ ফিতে দিয়ে বড় করে রিং বেঁধে ঝোলানো। মেয়েটার ঠোঁটে গাঢ় লিপিস্টিক আর গালে চড়া রুজ লাগানো। মডেলের ভঙ্গীতে দরজায় ঠেস দিয়ে সে দাঁড়ালো। চোখে লাস্য নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আঙুলে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে সে বললো, এলায় কী দেখতাছেন চোদুরিসাব? টাসকি খায়া গেলেন কেলা?’
– তুমি!!!’ ভুত দেখার মতো আমি চমকে উঠলাম। মায়াবতীকে পুরানঢাকার কুট্টিদের সাজে সাজিয়ে দিয়েছেন ইলা বৌদি! কথার উত্তর না দিয়ে সে নিজের পেছনে ঘরের দুটো কপাট আটকে দিলো। আমি কেলেঙ্কারীর আশংকায় জব্বারের যে কোনো সময় এসে পড়ার কথা তুললাম। বুড়ো আঙুল বাঁকা করে মায়াবতী ইশারায় নিচের তলা দেখালো, ‘ইলাবৌদি আটকেছে!’ তারপর ক্রাশকরা উড়োজাহাজের মতো একদৌড়ে উড়ে এসে আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়লো!…. আমি এই কারণেই বলছিলাম, দমবন্ধ লাগে!

তারপর আর কী?
আমাকে সিঅফ করতে একপ্লাটুন সামরিক বেসামরিক লোকজন এয়ারপোর্টে হাজির। এদের ভাবগতিক দেখে নিজেকে ভিভিআইপি মনে হচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব, মানে আমার হোনেওলা শ্বশুরসাহেব দামাতের ইমিগ্রেশনের ঝামেলা লাঘব করতে তাঁর কানেকশনে এয়ারপোর্টের সকল অফিসারদের টটস্থ করে ফেলেছেন একদম। ওয়াকিটকি হাতে একটু পরপর তারা এসে ঠকাস করে সেল্যুট মেরে আপডেট দিচ্ছেন। এর ফলে, মায়াবতীর সাথে একটু যে নিভৃতে কথা বলবো তার জো নেই। আরাফাত আর অন্তি তাকে ঘিরে বসে আছে দেখে আমি কাছে যেতেই অন্তি উঠে দাঁড়ালো। চাপা গলায় চোখ নাচিয়ে কাছে এসে বললো, ‘দুলাভাই, আমার গিফট না পেলে আপুর কাছেই ঘেঁষতে দেবো না!’
– কিসের গিফট্?
– মায়াআপুকে আমিই বুদ্ধি দিয়েছিলাম ফেক একাউন্ট খুলে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে!
– কোনটা ফেক একাউন্ট?
– ফুপিআন্টিরটা। ওই যেটাতে আপনি লিখেছিলেন, “মায়া, আপনার চোখের দিকে তাকালে দমবন্ধ হয়ে যায়” হিহিহি করে খিলখিলিয়ে হাসলো শয়তানটা। আপনারা যারা টিউশনি পড়াচ্ছেন, খেয়াল রাখবেন, ছাত্রী যেনো শালী হবার কোনো সুযোগ না পায়!

নিজেকে অনেকটা মেরেধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্লেনে তুললাম। নিজের সিটে বসতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পাশের সিটের যাত্রী তার জ্যাকেট ফেলে রেখেছে! লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে দুবাইগামী নির্মাণশ্রমিক। আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম। সে ভাবজমানো গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলো
– বদ্দা, ওই বেডিউগ্গারে দেক্খিলাম যে কান্দের, ইবা অনঅর কী লাগে? (মহাশয়, যে নন্দিনীকে দেখিলাম কাঁদিতেছে, সে আপোনার কী হন?)

আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। কী বলছে? এর কাছে বিতং দিতে ইচ্ছা করছে না এখন। এই এক সমস্যা বাঙালিদের। দেশিভাই পেলেই হলো! আরে বাপ, তোর ভাষা আমি জানি কিনা, সেটা জিজ্ঞেস কর আগে! আমি মাথা নাড়লাম শুধু। ওভারহেড বাঙ্কে হ্যান্ডলাগেজ রেখে সিটে বসলাম।
– বেডিত্তুন মনে অয় তোঁয়ারলাই পরাণ পুড়ে। পাইল্লে ইবারে বিয়া গরি ফেলন! (এই মহিলার আপনার প্রতি অনেক মায়া আছে বোঝা যায়, সুযোগ থাকলে একে বিয়ে করে ফেলেন।) নাহ, এ ব্যাটা তো পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু তার কথার ঢংয়ে হেসে ফেললাম। – তাই?
– জ্বে বদ্দা, দুনিয়াৎ নরম ফরানোর মায়ামানুষ কম। আই ন বুজিয়েরে কম বয়সৎ বিয়া গরি ফেলাই।
দমাস করে হেসে ফেললাম এবার। এই মালটা দুবাই পর্যন্ত জ্বালাবে আমায়। ওহ্ যীশু! প্লেন টেকঅফ করার পর দেশিভাই আমাকে নসিয়ত করলো,
– বদ্দা ঠ্যাং তুলি গম গরি বইয়োন। এতিক্কিন টেয়া দিয়েরে পেলেনোর টিকিট কিন্নোদে ননা?
ঠিকই তো। এতো দামের টিকিট, পা না তুলে বসলে পোষায়? আমি হাসি চেপে মোবাইল খুললাম। মায়াবতীর সাথে আমার ছবিগুলো দেখে সময়টা কাটিয়ে দেবো। কিন্তু পাশের মালটার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে আমার মোবাইলের ছবি দেখার ব্যাপারে তার আগ্রহ অসীম। মত পাল্টে আমি মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তারচে মায়াবতীর কথা ভাববো পাঁচঘন্টার পুরোটা পথ। অমন সুন্দর মুখটা কল্পনা করে পাঁচঘন্টা কেনো, পাঁচহাজার বছরও নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারি আমি!

হাত ধরো

পরিশিষ্ট:

একবছর পরে আমাদের বিয়ে হয়। আপনারা নিশ্চয়ই একমত হবেন- যেমনটা শুরুর দিকে বলেছিলাম- কোর্টকাচারি, পুলিশ, সেনাবাহিনী- সব সামলে আমাকে এই যুদ্ধে জিততে হয়েছে। হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলাম জানেন? আপনাদের আন্দাজেরও বাইরে। মালাউই! সম্ভবত এই প্রথম কোনো নববিবাহিত দম্পতি এশিয়া থেকে আফ্রিকায় হানিমুনে গেলো! ফুপাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাঁর সেনাপ্রধান বন্ধুর কারণে অনেক সমাদর আর আতিথেয়তা পেয়েছি সর্বত্র! ডক্টর সি পম্পিডুর সাথে স্থানীয় পোশাকে (!) একখান সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি আমরা তিনজন। সেটা প্রায় ভাইরাল হবার পথে। ওখানকার খনি এলাকা, কাসাভা ফিল্ড, এসব ঘুরে ঘুরে দেখেছি আমরা দু সপ্তাহ। হানিমুনে গিয়ে কেবল সুইমিংপুলে জলকেলি আর দোলনায় দোল খেতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই কিন্তু। মালাউইর কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে ব্যাপক দখল এসে গেছে আমার! মালউইয়ান একটা রোমান্টিক গানও শিখে ফেলেছি ইতোমধ্যে। চরম রোমান্টিক গান। মায়াবতীকে মাঝেমাঝে গানটা গেয়ে শোনাই। কথাগুলো ভারী মিষ্টি, হোক্কাডো হোক্কাডো, প্যানাপ্যানা… হোক্কাডো হোক্কাডো… আপনারা নেটে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন। আমার গানের কথা শুনে মায়াবতী আঁচল-চাপা দিয়ে হাসে, বলে, এ তো প্রেমের নামে পুরাই কেলেঙ্কারী! (সমাপ্ত)

 


======================
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য।  আপনার মূল্যবান মতামত আমার প্রত্যাশা। নিজের অজ্ঞাতে ও অজ্ঞতায় যদি কারো মনকষ্টের কারণ হয়ে থাকি, সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। সবাই ভালো থাকবেন। মহান শহীদ দিবসের মর্যাদা অমলিন থাকুক এই কামনায়-

তুহিন সমদ্দার

ডিম

ডিমের খবরটা এষাই আমাকে প্রথম দেয়। বাথরুমের ঘুলঘুলিতে কিসের যেন একটা ডিম! টিকটিকির নয়তো? এষা উদ্বিগ্ন চোখে জানতে চায়। আমি পেপার থেকে চোখ তুলে কথাটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি। কনসিভ করার পর থেকে এষা দিনের অধিকাংশ সময় বাথরুমেই কাটায়। তলপেটে সর্বক্ষণই একটা চিনচিনে ব্যাথার কথা বলে এষা। তার ধারণা মেটাবলিক সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করলে ব্যাথাটা চলে যাবে। আর এসময় এই ধরনের বাতিক মেয়েদের একটু চড়ে যায় হয়তো। এষা তাই বাথরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা তার আসন্ন মাতৃত্বের পরিচর্যা করে।

প্রথম যেদিন খবরটা সে আমাকে জানালো তখন তার মুখ ছিল অনিশ্চয়তা আর অনিচ্ছায় নীল। সে যেন ভেবেই পাচ্ছিলোনা মাত্র আটমাসের বিবাহিত জীবনে কী করে একটি সন্তান তার পেটে এসে যায়। বিয়ের পর থেকেই সে বলে আসছে একটা চাকরি পেয়ে সংসারটা একটু গুছিয়ে তারপর সন্তান নেবে। কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রি-কশন্ কিছুই সে ঠিক করেনি। নারী পুরুষের দেহগত জটিল বিষয়গুলিতে সে খুবই অনভিজ্ঞ। একটি মেয়ের জন্মগতভাবে এ বিষয়ে যেটুকু জ্ঞান থাকা উচিত, এষার তাও নেই। আমি অনেক সময়ই এ ব্যাপারে খোলাখুলি আলাপ করতে চেয়েছি, কিন্তু পুরো বিষয়টি তার কাছে খুবই নোংরা মনে হয়েছে। ফলাফল যা হবার তাই। এখন সারাক্ষণ গা গুলানো ভাব আর তলপেটে ব্যাথা নিয়ে সে নির্জীব সাপের মত স্তিমিত হয়ে থাকে আর কোঁকায়।

বাথরুমের প্যানের উঁচু ফ্লোরের উপর দাঁড়িয়ে অনেকটা ঘাড় উঁচু করে ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে ডিমটা খুঁজে পেলাম। কিছুই না। শুধু একটা ডিম। প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত আমার ডানহাত সেদিকে এগিয়ে যায়। ডিমটা ধরে। না। টিকটিকির সবচেয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজাতিটির পক্ষেও সম্ভব নয় এতোবড় ডিম পাড়া। তবে নিশ্চয়ই কোন পাখীর ডিম হয়ে থাকবে। ঘুলঘুলির স্লাইডিং কপাটটি আধখোলা থাকে নির্মল বাতাসের প্রত্যাশায়। সেই ফাঁকা দিয়েই সম্ভবত ডিমের গর্ভধারিনীর আগমন ঘটেছিল। ঘুলঘুলিটি খালি নেই। একটা অর্ধেক খালি হওয়া হারপিকের বোতল, এককৌটো গুড়ো সাবান, দুটি পরিত্যক্ত টুথব্রাশ আর গোটা দুয়েক কাঠিসহ একটা নকল মোরগমার্কা ম্যাচবাক্স সেখানে সহাবস্থান করছে। বাথরুমে আগুনের কী ব্যবহার, এটা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে – আগে যখন আমার প্রচণ্ড সিগারেটের অভ্যাস ছিল, তখন ইমার্জেন্সী হিসেবে এখানে একটা ম্যাচ রেখে দিয়েছিলাম। বিয়ের পরপর কোন এক নাজুক মুহূর্তে আমি সম্মত হয়েছিলাম সিগারেট ছেড়ে দিতে। কিন্তু তা ছিল শুধু কথার কথা। পরে এ নিয়ে ঝগড়া হয়েছে, এষা আমার সিগারেট ভেঙেছে, টাকা আটকে রেখেছে, দিব্যি দিয়েছে; তবু আমি ছাড়িনি। সে কূটগন্ধ পছন্দ করেনা বলে আমি পরবর্তীকালে বাথরুমে ঢুকে খেতাম। কনসিভ করার পর থেকে অবশ্য সিগারেট নিজেই বন্ধ করে দিয়েছি। ডিমটা পেড়েছে সেই ম্যাচবাক্সের পাশেই। আমার হাসি পেয়ে যায় এই ভেবে যে এ তল্লাটে – যদি সত্যিই পাখী হয়ে থাকে – তবে সে আমার এই ছোট বাসার সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য জায়গাটিই পছন্দ করে নিতে পেরেছে। এষা বাড়ীর সব জায়গায়ই পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে। কিন্তু শুধু বাথরুম পরিষ্কারের ব্যাপারে তার এলার্জি আছে।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ওর সাথে আমার প্রেম হয়। তখন আমরা হলের সামনের মাঠে বসে প্রতি সন্ধ্যায় প্রেম করতাম। এই এষাকে তখন মনে হয়েছিল দুর্দান্ত স্মার্ট একটি মেয়ে! হয়তো ওরও আমাকে। কিন্তু বিয়ের পর আমরা দুজনেই অন্যভাবে নিজেদের আবিষ্কার করি। যুক্তিবাদী হিসেবে কলেজ জীবনে নিজের একটি পাকাপাকি পরিচিতি ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি একটু আধটু ভাগ্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। এরপর গোমেদে ব্যবসা, মুক্তায় যশ, নীলায় শান্তি, ইত্যাদি বিষয়গুলি আমাকে অনেকটাই অধিগ্রহণ করে ফেলে। ওদিকে এষা একটা চাকরি, একটা চাকরি বলে কীযে করেনা! আমার মনে হয় পৃথিবীতে মেয়েরা সবসময় একটা খোলস চায়। যে খোলসে তারা নিজেদের ডিমের মতো আটকে রাখবে। ঝগড়াঝাটির উত্তপ্ত মুহূর্তে আমরা নিজেদের ভাগ্যকে শাপশাপান্তকরি। তবু তার মাঝে, তার মাঝেই – একদিন সে তার গেস্টেশনের কথা জানায়। আমি উথাল-পাথাল স্বপ্নসাগরে নিজেকে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখে দায়িত্বপ্রবণ স্বামীর মতো তাড়াতাড়ি তাকে গাইনোকলোজিস্টের কাছে নিয়ে যাই। মনের মধ্যে একটা চিনচিনে আনন্দ, একটা কষ্ট কিংবা একটা দুরাশা নিয়ে আমি চেম্বারের বাইরে অপেক্ষাঘরে বসে থাকি।

চিকিৎসার সাথে একুরিয়ামের কী সম্পর্ক সেটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। প্রতিটি ডাক্তারখানাতেই এ জিনিষটি দেখা যায়। কিম্ভুত কদাকার অচেনা মাছগুলো পান চিবোচ্ছে। তেনারা সকলেই অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ও জাগতিক বিষয়ে উদাসীন বলে আমার মনে হলো। এখন একটা গজালমাছ বা ব্যারাকুডা এর মধ্যে ছেড়ে দিলে কাণ্ডটা দেখা যেত! আচ্ছা, মানুষ এ্যাকুরিয়ামে চ্যাং মাছ পোষে না কেনো? সেগুলোতো অনেক সুন্দর এগুলোর চেয়ে। ঐযে পেট ফুলিয়ে বেশ রঙচঙ ধারণ করে যে মাছটা ঢং করে সাঁতরাচ্ছে, ও শালাকে দেখলেই ঘুষখোর অফিসারের কথা মনে হয়। এটাকে একমাত্র মানায় ইনকাম ট্যাক্স অফিসে। এমন যদি হতো – স্থান অনুযায়ী মাছ রাখা হবে, তাহলে? যেমন সচিবালয়ের একুরিয়ামে থাকবে রাঘব বোয়াল টাইপের মাছ, বিমান অফিসে থাকবে ফ্লাইং ফিস, পুলিশ অফিসে দাঁড়কানা মাছ, আর আর… আমি ভাবনার খেই খুঁজি… সরকারী অফিসে… নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় এমন কোন মাছ আছে কী? ধাত্রীবিদ মহিলা চিকিৎসক এষার প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছিলেন- ‘ট্রাই টু কনটিনিউ দ্য প্রেগনেন্সী’! কিভাবে তিনি বুঝতে পারলেন-এষা মা হতে চায়না? তিনি আমাকেও ভেতরে ডেকে পাঠান। তিনজন প্যারামেডিক বা ঐ জাতীয় আধা-চিকিৎসক মহিলার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এষা প্রধান ডাক্তারের সামনে অনেকটা জুবুথুবু হয়ে বসে ছিল। আমি ডাক্তারনী ভদ্রমহিলার দিকে তাকাই। এককালে তিনি যে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন তা বোঝা যায়। প্রথমেই ভদ্রমহিলা একটা সহজকঠিন প্রশ্ন করেন।

–  বাচ্চাটা রাখতে চাচ্ছেন না কেন?

–  আপনি নিশ্চিত ও কনসিভ করেছে?

–  না নিশ্চিত নই। তবে সত্যিকারেই যদি বাচ্চা এসে থাকে, তবে তা রাখতে হবে। এটা প্রথম ইস্যু। একে কোনভাবেই নষ্ট করা যাবেনা। যদি এবরশান করাতে গিয়ে টিউবে ইনফেক্শন হয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে আর সন্তান না-ও হতে পারে!

এষা এ সময় তার আসন্ন বিসিএস পরীক্ষার কথা বলে। ডাক্তার বলেন- আপনার মত হাজার হাজার মেয়ে এ অবস্থায় পরীক্ষা দিচ্ছেন। ভদ্রমহিলাকে তখন খুব স্নেহময়ী মনে হয়। কখনো কখনো মানুষের অভিভাবকের প্রয়োজন হয়। এষাকে অনেক অনুনয় করেও আমি যে যুক্তি দেখাতে পারিনি, সেই এষা ভদ্রমহিলার এই কথায় একদম মিইয়ে যায়। আমার ভেতরে একধরণের নিশ্চিন্তির ভাব খেলা করে। তিনি কয়েকটা টেস্ট ও অষুধের নাম লিখে দেন। এরপর থেকে এষা কেবলই বাথরুমে আর বাথরুমে অসংখ্যবার জলের ঝাপটা আর ঈষৎ বমি বমি ভাব নিয়ে পাতার পর পাতা ফলিক এসিড আর আয়রণ ট্যাবলেট গিলে ফেলতে থাকে।

অজানা ডিমটা হাতে নিয়ে আমি প্রথমে নেড়েচেড়ে সন্তর্পনে দেখি। এরপর নিশ্চিত হবার জন্য আলোর সামনে একচোখ বন্ধ করে ভেতরে কোন ভ্রূণ আছে কিনা খুঁজি। আমার বন্ধ চোখের ভেতরে কালো অন্ধকার গিসগিস করে, আর খোলা চোখের সামনে ডিমের সাদাটে একঘেয়ে শূন্যতা কোন সূত্রই দাঁড় করাতে পারেনা। এষাকে ভরসা দেবার জন্য তাচ্ছিল্য নিয়ে জানাই – এটা কোন পাখীর ডিম হবে।

–  কোন্ পাখী?

–  পায়রাই হবে।

–  তুমি পায়রার ডিম চেনো? তা কি এতো ছোট হয়?

আমি অসহায় অস্থিরতার সাথে ভাবতে থাকি পাখীর ডিম বিষয়ক তথ্যমূলক কোন বই আছে কিনা। কিন্তু স্মৃতিতে টান পড়ে। সলিম আলী পাখীর ডিম নিয়ে কি কোন রিসার্চ করেছেন? সম্ভবত না। কিন্তু তাই বলে ডিমটাতো আর ফেলে দেয়া যায়না। কিন্তু ডিমটা নিয়ে এখন আমরা কী করবো? একধরণের অচলতা, অমীমাংসা নিয়ে আমি আদালত মুলতুবী করার মত বিচারকের কণ্ঠে – কাল সকালে দেখা যাবে এই সিদ্ধান্ত দিয়ে ডিমটাকে পুনরায় তার আঁতুরঘরে রেখে দেই। হ্যাঁ, ভালো শব্দ পাওয়া গেছে ‘আঁতুরঘর’।

অফিসে আমার প্রজেক্টের অবস্থা অনেকটা অনিশ্চয়তার। নতুন ফান্ড আসবে কি আসবে না এ ব্যাপারে কেউই কিছু ঠিক করে বলতে পারছেনা। দাতাসংস্থা শুধুমাত্র হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ও রিসোর্স বাবদ আগামী তিনবছর পর্যন্ত ফান্ড করতে রাজি। কিন্তু স্টাফ স্যালারী কিভাবে আসবে? এ বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনা। মাঝারি মাপের চাকুরী করি বলে উপরমহল বা একদম নীচের মহল, কোন দিকেই আমার তেমন পাত্তা নেই। এটা একধরণের অক্ষমতা। অনেকে খুব সুন্দরভাবে অফিসের সবাইকে ম্যানেজ করে। ড্রাইভার থেকে ডিরেক্টর পর্যন্ত সবার সাথেই থাকে তাদের সহজ সম্পর্ক। যেমন আমাদের অফিসের এখলাস সাহেব। তিনি না চাইতেই অধঃস্তন কর্মীদের কাছ থেকে সালাম টালাম ও বিভিন্ন সুবিধাদি পেয়ে যান। আবার উপরের সকলেই তাকে বেশ পছন্দ করে। অথচ ভদ্রলোক কাজ করার চেয়ে যে জিনিসটায় আগ্রহী তা হচ্ছে টেলিফোন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অন্যের সাথে আলাপ। আবার তিনিই অফিসের ভেতরের সবচেয়ে আপটুডেট খবরটি রাখেন। আমাদের রুমে এসে রসিয়ে রসিয়ে তা মাঝে মাঝে বয়ান করেন। আমরা যখনই এসব তথ্যের যথার্থতা খুঁজতে তার সোর্স জিজ্ঞেস করি তখনই তিনি একদম ঠাণ্ডা মেরে যান। তারপরে এখলাস সাহেবকে আবার অনেকদিনের জন্য খুঁজে পাওয়া যায়না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের খবরও তিনি হয়তো আমাদের চেয়ে বেশী রাখেন। এটা ভাবলেই একধরণের ঈর্ষা আমাকে জেঁকে ধরে। আমাকে কি সবাই অবিশ্বাস করে? তাহলে কেন কিছু জানায় না? একটা খোলসের মধ্যে যেন আটকে রাখা হয়েছে সবকিছু। একটা খোলস; আমি ভাবতে শিখেছি, একটা খোলস। প্রতিটি মানুষ নিজেকে ডিমের ভেতর গুটিয়ে রাখে!

পরদিন তাড়াহুড়োয় বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ঝট্পটি শব্দে আমি দেখতে পাই ঘুলঘুলিতে একটি খেচর-সদৃশ্য প্রাণীর দ্রুত পলায়ন। পাখীটিকে আমি শনাক্ত করতে পারিনা। তড়িঘড়ি সকালের স্নান সেরে অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই লেট হচ্ছে আজকাল। কোন কোনদিন তাই চা না খেয়ে শুধু বিস্কিট, আবার কখনো হয়তো প্যান্টের বেল্ট লাগাতে লাগাতে আমি হিসেব করি আজিমপুর থেকে শংকর পর্যন্ত রিকসায় সর্বনিম্ম কতো মিনিটে পৌঁছানো সম্ভব! ভোরবেলাটায় তাই তাড়া থাকে। সেই ব্যস্ততার মাঝেও ডিমটার প্রতি কেমন করে জানি আকর্ষণ চলে আসে। সেটা তেমনই আছে। একটু কি স্থান পরিবর্তন করেছে? আমি দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের মাঝে শাওয়ার ছাড়ি। অবিরত পানির ফোয়ারায় নিজেকে অবগাহন করে ডিমটার দিকে তাকিয়ে থাকি। ঈষৎ লালচে একটা বড়সড় মার্বেলের আকারের ডিমাকৃতি ডিমটির পাশে একটি দুটি গাছের শুকনো চিকন ডালপালা হয়তো তার গর্ভধারিণী পাখীটিই এনে রেখেছে। পরক্ষণে মনে হয়, পক্ষীকূলে নারী পুরুষের সমঅংশীদারিত্ব বিদ্যমান। তাদের একজন ডিম পাড়ে, তো অন্যজন বাসা বানায়; একজন তা দেয়, তো অন্যজন খাবার খুঁটে আনে। এখানে নিশ্চয়ই তেমন ভারসাম্যমূলক বোঝাপড়া রয়েছে। অফিসে দুএকজন কলিগকে ডিমের বিষয়টি আরও মনোগ্রাহী করতে রং টং চড়িয়ে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু কেউ তেমন আগ্রহ বোধ করেনা। বাথরুমের জানালায় একটা কবুতর ডিম পেড়েছে এটা ওদের কাছে কোন ঘটনাই না। একজনতো বলেই বসে- তা ডিমটা খেয়েছেন না আছে? আমি নিজের মেরুদণ্ডে একটা ঠাণ্ডা স্রোত টের পাই। বলে কী?

বাসায় ফিরতেই এষা নতুন খবর জানায়- হারামজাদা পাখীটা তার বাথরুমের সুখ কেড়ে নিয়েছে। রাজ্যের ডালপালা এনে জড়ো করছে ঘুলঘুলিতে বাসা বানাবে বলে! সেসব ডালপালা জানালার খোপ থেকে নিচে পড়ে প্যানে ও তার আসেপাশে নোংরা করে রেখেছে। এষার আবার পরিষ্কারের বাতিক। ডাক্তার বলেছেন- ভারী জিনিস তুলবেন না, রেস্টে থাকুন। সেই শরীর নিয়ে সে অন্তত দশ বালতি পানি ঢেলেছে সারাদিনে। বাড়ীওলা দুবারের বেশী পানি ছাড়েনা। ফলাফল- রাতের পানি আসার আগে হাতমুখ ধোয়া বন্ধ। আমি ঔৎসূক্য নিয়ে বাথরুমে যাই। একফোঁটা পানি নেই। এন্তার ডালপালা কোত্থেকে এলো এতো? ডিমটা আগের মতোই আছে। এখন যদি ঘুলঘুলির কবাটটা আমি আটকে দেই, তবেই ওদের এই ফ্লাট তৈরীতে বাঁধা পড়ে যাবে। পাখী দম্পতিটি কি তবে বিদ্রোহ করে অন্য পাখীদের ডেকে আনবে? হিচ্ককের ছবির সেই পাখীদের মত আমার বাড়ী বা এ তল্লাটের সবার ঘরবাড়ী ধ্বংস করে দেবে হাজার হাজার পাখী? আমি মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডাস্রোত নিয়ে ডিমটাকে আবার হাতে তুলে নেই। আগের মতোই আছে। কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। সেটা আগের স্থানে রাখার পর মনে পড়ে- এষা তার পেটের অনাগত সন্তানকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। বাচ্চা এলে তার কেরিয়ার ধ্বংস হবে। সে চাকরী করতে পারবেনা। চাকুরী না হলে মেয়েরা মানুষের মত মর্যাদায় বাঁচতে পারেনা ইত্যাদি কথাগুলো এখনো মাঝে মাঝে শোনায়। মনে হয় যেন এখন কনসিভ না করলেই ভালো হতো। আমিই তার অমীত সম্ভাবনার পথে কুড়াল দিলাম। খাওয়া-দাওয়া, সবকিছু এ কারণে তাকে বারবার সেধে করাতে হয়। শুধু নিয়মিত অষুধগুলো খাচ্ছে। এরমধ্যে একদিন খুব যখন আদর আদর ভালোবাসা- তখন বলছিল:

–  ওর হাত পা হয়েছে এখন?

–  নাহ্ , কিযে বলো, সবে তো তিনমাস।

–  তাহলে কি কেবল মাথা হয়েছে?

আমি হাহা করে একথায় হেসে উঠি একটা বাজে গল্প মনে পড়েছে বলে। এষা অপ্রতিভ হয়ে উঠলে বলি:

–  সবই হয়েছে তবে এখনও খুবই ছোট আর অসম্পূর্ণ।

–  উহ্ যন্ত্রণা আর সহ্য হয়না।

–  একটু সহ্য করো সোনা, আরতো মাত্র কটা দিন-

এমনি সব ফালতু কথার ট্রাডিশনাল বুলি দিয়ে তাকে ভুলিয়ে দিতে চাই গা ব্যাথা, মাথাধরা, শরীর গুলানো ভাব। কিন্তু তাতে সমস্যা যায়না। মাঝে মাঝে খুব যখন কষ্ট হয়, তখন সে বাচ্চাটাকে গালি দেয়। গভীর রাতে ক্ষিদের চোটে ঘুম ভেঙে গেলে সে হরলিক্স বানাতে বানাতে শাসায়- ‘রাক্ষসটা খাবে আমাকে। ওর খাই চেপেছে।’

পরদিন বাড়ী থেকে ওর প্রেগনেন্সীর খবর শুনে আমার শ্বাশুড়ী আসেন বেড়াতে। এষা জলের সংকট, বাড়ীভাড়া, শব্দদূষণ, ঢাকার আবহাওয়া, চাকুরীর বাজার ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পরপরই চলে আসে ডিম প্রসঙ্গে। নাস্তার টেবিলে শ্বাশুড়ি আমাকে ধরেন-

– বাবা একটা কথা বলি, ক্ষণগণ এখন একটু মেনে চলবা।’ তার ভাষা প্রয়োগে দক্ষিণাঞ্চলীয় টান উঠে আসে। বড় আপন মনে হয় আমার!

– কেনো মা, তা বলছেন কেনো?

– শুনলাম তোমাদের বাথরুমে কিসে নাকি ডিম পাড়ছে?

– হ্যাঁ, ওইতো পায়রাগুলো ভীষণ জ্বালাচ্ছে আজকাল। ও কিছু না, নেক্সট শুক্রবার আমি সব পরিষ্কার করবো।

– না না বাবা, এটা করতে যাইও না। এসব ভালোমন্দ দেখে হয়। তিনি জামাইয়ের সাথে শুদ্ধ বলার চেষ্টা করেন। বেনুর এখন তিনমাস চলছে। এ অবস্থায় অন্যের ডিম তোমরা ভাঙবা না।

এষা চোখ গোল করে আমাদের দিকে তাকায়। সে দৃষ্টিতে ভয় আর জিজ্ঞাসার মিশ্রণ। ঘাড় বাঁকিয়ে অবুঝ বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞেস করে-

– কেনো,তাহলে কি হবে মা?

– তুই বুঝবিনা এসব। মায়ের মনে দুকখো দিবিনা। ডিম ভাঙলে মায়ের মনে দুকখো পাইবে। এরপর থেকে এষার পাখী ও তার ডিমের প্রতি যত্ন বেড়ে যায়। পারলে সে ডিমটার জন্য একটা জাজিম বানিয়ে দেয়! পাখীটাকে সাবান দিয়ে গোসলও করিয়ে দিতো, যদি ধরতে পারতো। প্রশ্রয় পেয়ে পাখীটাও বেশ জাঁকিয়ে বসেছে তার ডালপালার ভেতরে। এষা প্রতিদিন আমাকে ফলোআপ নিউজ দেয়।

– জানো, আজ না পাখীটা দুঘন্টা তা দিয়েছিল, আজ না পাখীটার একটা পালক পড়ে গেছে। আচ্ছা বাবু হলে আমারও কি ওইরকম চুল উঠে যাবে?

শুনে আমি ক্যাবলার মতো হাসি। রাতে শয়নপূর্ব আলাপচারিতার অনেকটা জুড়ে ডিমটা বিরাজ করে। আমার তখন নিজেকে সুখী সুখী মনে হয়। এখন এমনকি এষার অসুস্থতাও আমার কাছে মহৎ শিল্পের মতো লাগে। ওর মাতৃত্ব একটু একটু করে প্রকাশিত হতে থাকে। বাথরুমে এখন এষা গুনগুন করে গান গায়। বোধহয় ডিমটাকে শোনায়। একদিন জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা বলোতো পায়রার কতোদিনে ডিম ফোটে? আমি পাখী বিশেষজ্ঞের মত বলি- একুশ দিনে। এষা দিন গোনে। ক্যালেন্ডারে তার সম্ভাব্য প্রস্ফুটনের তারিখে কাউন্ট ডাউন করার মতো দাগ কেটে চলে। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন পাখীটা আর আসেনা। এষা হু হু করে কাঁদে। এই না আসার কারণের ব্যাখ্যা করতে পুরাতন যুক্তিবাদী সত্ত্বাটি আমার মধ্যে নড়েচড়ে ওঠে। পাখীরা খুবই স্পর্শ্বকাতর। ডিমটি ধরার কারণে ওটার গায়ে নিশ্চয়ই আমাদের হাতের ঘ্রাণ লেগেছিল। তারপর থেকে মা পাখী এটার প্রতি তার আগ্রহ হারিয়েছে। আমি যুক্তি খাড়া করতে চাই। এমনই হয়। পাখীটি তার ডিমকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেছে বলে বাসা বানাতে আর উৎসাহী নয়। অসমাপ্ত ডালপালার মধ্যে ডিমটি পড়ে আছে। আমিও আর ওটাকে ফেলে দিতে বা জিনিষটাকে হাতে নিয়ে দেখতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি।

ডিমটি সেখানেই আছে। কোন পরিবর্তন ছাড়াই। এদিকে এষা বা বেনুর পেট উঁচু হতে হতে অনেক বড় হয়ে উঠেছে। প্রতিমাসে একবার করে ডাক্তার চেকআপ চলছে। এই ডাক্তারের প্রশংসা শুনি সর্বত্র। এখনও তিনি আল্ট্রাসনো করানোর পক্ষপাতী নন্। এষার মাতৃত্বজনিত উপসর্গগুলি তিনি হেসেই উড়িয়ে দেন। মা হওয়া কি এতোই সোজা? তিনি বক্তৃতার ঢঙে বলেন, কিন্তু এষার সমস্যা কাটে না। ইতোমধ্যে সে বিসিএসের প্রিলিতে অংশ নিয়েছে। যদিও পাশ করতে পারেনি। তবু তার চাকরী দরকার, একটা চাকরী না হলে …।

বিছানায় এখন আর আগের মত এষা হাঁসফাঁস করেনা। কেবল বড় পেট নিয়ে চিৎ হয়ে স্থবির হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে স্খলিত কণ্ঠে হয়তো অনুযোগই করে। দিন ঘনিয়ে আসে। আমি আগেই একটি ক্লিনিকে সবকিছু রেডি করে রেখেছি। ক্লিনিকটি মহিলা ডাক্তারের আশীর্বাদপুষ্ট। নিয়ম মেনে চেক আপ চলছে। এষা এখন আর তেমন চলাফেরা করেনা। ডাক্তার পূর্ণ রেস্টে থাকতে বলেছেন। পাখীটি আর এলোনা। এখন ওদের মিলনের মাস। এক সিজনে পায়রাতো একটি ডিম পাড়েনা। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও ডেড়া বেঁধেছে। অবিভাবকহীন ডিমটি পড়ে আছে সেই থেকে। একদিন শেষ রাতের আধো ঘুম জাগরণে অসুস্থ শরীর নিয়ে এষা আমাকে জাগায়:

– ওর জন্য ওর কোন ক্ষতি হবেনাতো?

– কার কথা বলছো?

– বাবুর কথা।

– কেনো ক্ষতি হবে, কি বলছো তুমি?

– না মানে ডিমটার জন্য ওর যদি কোন অমঙ্গল হয়?

– কেনো হবে, ও তো কিছু করেনি!

– বাবামায়ের অপরাধ নাকি সন্তানের উপর গিয়ে লাগে?

– কি হয়েছে তোমার এষা, এসব বলছো কেনো, আমরা কী দোষ করেছি?

এষা আমতা আমতা করতে থাকে। প্রথমে তো সত্যিই সে চায়নি মা হতে। তাছাড়া পাখীটা হঠাৎ করে না আসার পেছনে সে নিজেদেরই দায়ী করছে। একদিন বলছিল-

– তুমি কি ডিমটা নিয়ে কিছু করেছিলে?

– কই নাতো।

– তা হলে পাখীটাকে কখনো ধাওয়া দিয়েছিলে?

– আমি পাখীটাকে মারতে যাবো কেনো?

– তাহলে ও আসছেনা কেনো, বলো, আসছে না কেনো?

শেষের দিকে এষার স্বর হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে। আমারও বুক দুরদুর করে। সত্যি যদি কোন অমঙ্গল হয়ে থাকে? যদি এজন্য অনাগত সন্তানের কোন ক্ষতি হয়ে যায়? যদি সে আর না আসে?…

ওর খাওয়া দাওয়া আগের চেয়ে কমে গেছে। যা খায় তাইই বমি হয়ে যায়। এটাই নাকি হয় এ সময়। তিনগুন খাওয়া উচিত, অথচ…। এষার হীনমন্যতা আমাতেও সঞ্চারিত হয়। সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা বিষয় খচখচ করে। আমরা কি কোন পাপ করেছি? ডিমটার অ-প্রস্ফুটনে আমার কি কোন ভূমিকা আছে? ওরাতো খুবই সেনসিটিভ, হয়তো আমাদের কোন ব্যবহার ওদের পছন্দ হয়নি। পাখীদের প্রজনন বিষয়ক বেশ কয়েকটা বই ঘেঁটে দেখেছি। কোন কোন পাখী ডিম পেড়েই খালাস। এক ধরনের ফ্লাইক্যাচার আছে, যারা একটি প্রজনন ঋতুতে একধিক পুরুষসঙ্গীর সাথে মিলিত হয় এবং তাদের প্রত্যেকের ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন বাসায় ডিম পাড়ে। হয়তো দ্বিতীয় বার আর সেসব বাসায় যায়ও না। অবশ্য হলুদগলা-ফিঞ্জদের কথা আলাদা। তারা জীবনে একবারই পুরুষসঙ্গী নির্বাচন করে আর তার সাথেই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেয়। ঠিক আমি আর এষা যেমন। আমার ভাবতে ভালো লাগে। বাইরে থেকে ফিরে যখন ওকে পিচ্চিপিচ্চি কাঁথা সেলাই করতে দেখি আমার তখন নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। আমার মা, যাকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে আর দেখিনি, তিনিও কি এভাবে  আমাকে পেটে নিয়ে কাঁথা বুনতেন?

এমনি করে দিন ঘনিয়ে আসে। এষাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার ওকে ড্রিপ দিচ্ছেন। তাতেও না হলে হয়তো সিজার করবেন। দোকান থেকে ফলমূল কিনে কেবিনটাকে একদম বাড়ী বানিয়ে ফেলেছি আমি। আমার শ্বাশুড়ী রাতে থাকেন ওর সাথে। আমি বাসায় ঘুমাই। ইদানিং ঘুম বেড়েছে আমার। সত্যিকারার্থে এষার হাঁসফাঁসের কারণে ঘুমে ব্যাঘাত হতো। এখন স্থির অনুভূতিহীন গাঢ় আচ্ছন্নতা। গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি স্বপ্নের ঘোরে। একটা ডিমের মধ্যে যেন আমি আটকা পড়ে গেছি। চারদিকে নিঃস্প্রাণ সাদা শক্ত খোলস। বাথরুমে গিয়ে নাকে মুখে পানি দেই। ফ্রিজ খুলে পানি খাই। ঘরে একটা বাচ্চার ছবি টাঙিয়েছিলাম। ওটায় মাকড়সা জাল বুনতে শুরু করেছে। এষা থাকলে এসব গুছিয়ে রাখতো। এই সময় ফোনটা বেজে ওঠে। হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো বাজে। ফোনটা মুমূর্ষু রোগীর মত কঁকিয়ে চলেছে। এতো রাতে কে ফোন করেলো। আমি যন্ত্রচালিতের মত রিসিভার তুলতে যাই। কে ফোন করলো? কে? কোত্থেকে? ক্লিনিক থেকে নয়তো? রিসিভার তুলতে ওপাশ থেকে কোন শব্দ আসেনা!

পরদিন ঘুম থেকে জেগে পুরোটাই স্বপ্ন মনে হয়। নিয়ম মত ক্লিনিকে যাই। আজ এষার ডেলিভারী হবে। ওকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যাওয়ার আগে সে রোজকার মত জিজ্ঞেস করেছিলো – পাখীটা এসেছে কিনা। আমি হ্যাঁ বলেছি। আসলে পাখীটা আসেনি। আসেনি এষাও। অনন্তঅনন্তকালের অপেক্ষার পর নার্স কাপড়ের পুটুলীতে পেঁচিয়ে একটা জ্যান্তডিমের মত মানবশিশু আমার কাছে হাজির করে। আমি সেই শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনের-বিশ্বাসের-বাস্তবের বর্ণহীন বিবমিষা প্রত্যক্ষ করি। আর চারদিকে অসংখ্য পাখীর পালকে যেন ছেয়ে যায়। অসংখ্য পালক।  করিডোরে রাস্তায়, যত্রতত্র ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো। শুধু পাখীহীন পাখীর পালক আর তার ডিম! পাখীটি আর কখনো আসবেনা।

রচনাকাল: ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০০০

দেবাংশী

ঝড়ের দিনে প্রতিবারই একটা দুটো ডাল ভেঙে পড়া রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ঢ্যাঙ্গা, ভঙ্গুর গাছটির এহেন আচরণ রীতিবিরুদ্ধ বলেই অনেকে গাছটিকে প্রেত বসবাসের সম্ভাবনা বলে ঠাওড়াতো। সন্ধ্যার পর ঐ গাছের নিচ দিয়ে যে শর্টকাট মাটির রাস্তাটি- যেটি শুধুমাত্র শীতকাল ব্যতিরেকে কেবল তৃণভোজীদের চলাচলসাধ্য- পারতে-সাধ্যে কেউ সেটা খুব একটা ব্যবহার করতো না। 

ঘরের বাইরে, এমনকি ঘরের ভেতর থেকেও তার গলার স্বর শোনা গেছে- এমন দাবী এলাকাবাসীর কেউ কখনো করতে পারেনি লোকটা সম্পর্কে। স্বাধীনতার পর শহর ছেড়ে ঝুনাহারের খাল পেরিয়ে বড় শালার বাড়িতে আত্মগোপন করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকটা, লুট করা সোনাদানা সব সেখানেই নিয়ে গিয়েছিলো- এমন কথা চালু আছে এলাকায়। কিন্তু বাহাত্তরের পর যখন পাতিল একটু একটু করে ঠাণ্ডা হচ্ছে, তখন আবার ফিরে আসে সে। ফিরে আসে যেন তার প্রেত। নিঃশব্দে চলে। কথা প্রায় বলেই না। আর রাস্তাঘাটে একদম মাটির দিকে মুখ করে হাঁটে। দ্রুত, জড়তামুক্ত, কিন্তু অপরাধক্লিষ্ট লোকটি সেই থেকেই এলাকাবাসীর কাছে একটা বিশেষ কিছুতে পরিণত হয়ে আছে। তাকে কেউ ডাকে না। সেও কারো সাথে তেমন মেশে না। কেবল কাঁচাবাজারে তাকে হাসিমুখে আহবান করে মাছওয়ালা, সব্জিবিক্রেতা। পৌরসভায় কী একটা চাকরি যেনো সে করতো। আর প্রতিদিন ভোরে তার একহাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে কুমড়ো, লাউ কিংবা তরমুজ- হিন্দু মেয়েরা যেমন করে পূজা-উপাচার একহাতের তালুতে নেয়- সেভাবে নিয়ে,হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখা যেতো। এই দৃশ্য প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো সবার কাছে। রিকশা বা কোনো যানবাহনের তোয়াক্কা সে করতো না। ফাজিল ছেলে ছোকড়ারা তাকে দেখে সিটি দিতো। দূর থেকে নাম ধরে ডেকে উঠতো- তা-আ-রা-আ-মি-য়া! লোকটা ফিরেও তাকাতো না। যেনো সে একাধারে দৃষ্টিশ্রবণ প্রতিবন্ধী।

তার সাথের একজন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢোকার পর বস্তার মধ্যে ভরে এলাকায় নিয়ে আসে। খুব কষ্ট দিয়ে মারা হয় তাকে। প্রতিটি নিরীহ মানুষকে আর্মিদের হাতে ধরিয়ে দেবার অপরাধে একটি করে আঙুল হাতুড়ি দিয়ে ছেঁচে গুঁড়ো করা হয়। শোনা যায় এসবের পর নাকি মোটে সবমিলিয়ে তিনটা আঙুল তার অবশিষ্ট ছিলো। রাইফেলের বাঁট দিয়ে সামনের সবকটি দাঁত ভেঙে দিয়ে অবশেষে বেয়নেট চার্জ করা হয়। সবশেষে গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেবার আগে যে গুলিটা করা হয়েছিলো- সেটা মাইলখানেক দূরের এক লাইটপোস্ট ফুটো করে ভিতরে আটকে থাকে। মহল্লায় যুদ্ধের স্থায়ী স্মৃতি শুধু এটুকুই। মাঝবয়সী অনেকে এখনো সেই সন্ধ্যায় গুলিটা লাইটপোস্ট ঠং করে ফুটো করার শব্দটির কথা স্মরণ করতে পারে। আর তার অনুভূতি এমন, যে মনে হয় লাইটপোস্ট নয়- গুলিটা নিজের করোটিকে ফুটো করেছে আর সেই থেকে এখনো দশগ্রাম খাঁটি তামায় মোড়া সীসার টুকরোটি মাথার মধ্যে নির্জীব পড়ে আছে; আছে বলেই মাথাটা ভার ভার লাগে! এলাকার লাইট্টা-বান্দর পোলাপানে ঐ লাইটপোস্টের ফুটোটাকে সই করে ইট মারা প্রাকটিস করতো। তারা একে নাম দিয়েছিলো গুল্লি-মারা! লোকটি তার সঙ্গীর এহেন পরিনতিতেই হয়তো কোনো উচ্চবাচ্য থেকে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছিলো। তার ছেলেমেয়েরা কিন্তু তেমন নয়। তারা সবার সাথে মিশতো। অন্তত সমবয়সী অনেকের সাথে। এলাকায় যে যুব-তরুণ-শিশু সংগঠনটি ছিলো- তাতেও তারা নিয়মিত অংশ নিতো। বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধলে একদিন তাদের একজন তারামিয়ার মেজো ছেলেকে গাল দিলো- রাজাকারের বাচ্চা! শান্ত সুবোধ ছেলেটি তখন ক্ষেপে গিয়ে একটা ইট দিয়ে ঐ ছেলেটির মাথা ফাটিয়ে দেয়। এলাকাবাসী থ।

‘দেখছো নাহি কারবার, হালার রাজাকারের বাচ্চায় ঠিক রাজাকারই হইছে। খানকির পোরে কেউন্নাইয়া দাড়া ভাইঙ্গা দেলে হ্যাসে ঠিক অয়।’ এলাকাবাসীর এই রায় অবশ্য কার্যকর হয় না। লোকটা এলাকার মাথা ফ্রিডম ফাইটার তোফাভাইয়ের আব্বার কাছে গিয়ে পা ধরে পড়ে। মিনমিনে খোনা গলায় বলে- ‘ভাইজান, পোলায় আমার জাউর‌্যার পয়দা, আপনে অরে মাফ হইর‌্যা দ্যান’। তোফা ভাইয়ের আব্বা, মানে হাজীচাচার দয়ার শরীর। গজগজ করতে করতে তিনি শাসানি আর ভর্ৎসনা করেন ‘পোলাগুলিরে মানুষ র্ক তারা। ওইগুলা জানি তোর রহম বেহাংরা না অয়- আর কিছু কইলাম না- যা।’ এই বাক্যালাপ বিভিন্ন অনুষঙ্গে এলাকায় চাউড় হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে। কেউ বলে, শালা রাজাকার থাকলে কি হইবে, পোলামাইয়ারে শাসন করে খুব। কেউ বলে, তোফাভাইর আব্বার উচিত আছিলো গন্ডোগোলের সোমায়র জিদটা তুইল্লা লওয়া’। কে না জানে, এলাকায় ‘মুক্তি’ আছে কিনা- প্রশ্নের জবাবে তারামিয়া পাক আর্মীদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তোফাভাইয়ের বাসায়। হাজীচাচা ক্রমাগত চোস্ত উর্দূতে বাতচিৎ করতে পারার কারণেই সেদিন ওদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। আর অশিক্ষিত চামচা তারামিয়াকে ওদের মেজর না ক্যাপ্টেন র‌্যাঙ্কের এক অফিসার ভারীবুটের এমন এক লাত্থি মেরেছিলো যে- সে আর খাডাল থেকে উঠতে পারেনি। অনেকে বলে তারামিয়ার মাটির দিকে নুয়ে হাঁটার রহস্য নাকি সেই দশাসই বুটের লাথি। কিন্তু কোমরে ব্যথা নিয়ে লোকটা এতো দ্রুত হাঁটে কী করে সেটা আর এক বিস্ময়!

কিন্তু আরও এক বিস্ময় সামনে অপেক্ষা করছিলো হয়তো। কেননা তারামিয়া যখন পথের দিকে নুয়ে হাঁটা বাদ না দিলেও, লুঙ্গি ছেড়ে পাজামা পাঞ্জাবী পড়তে শুরু করে, শুক্রবার শুক্রবারে জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতো- তখন কালচারাল দু একটি ফ্যামিলি বাদে অনেকেই তাকে একটু একটু সমীহ করা শুরু করে। কেউ কেউ এমনও বলে যে গণ্ডগোলের সময় লোকটার মতিগতি একটু ঘূণে ধরেছিলো হয়তো… আর তাছাড়া তখন যে সব ফ্যামিলি এফেক্টেড হয়েছিলো- তারা তো এখন আর এলাকায় নেই- বাড়ি টারি বিক্রি করে রাতের আঁধারে কবেই ইন্ডিয়া চলে গেছে- আর লোকটাতো কোনো হিন্দুদের বাড়িও দখল করেনি কিংবা শত্রু-সম্পত্তি হিসেবে রিকুইজিশনড বাড়িও মামলা চালিয়ে ভোগ করছে না, অতএব… তাদের এই ক্ষমাপূর্ণ উদারনীতির বদৌলতে লোকটার কোমর সোজা হয় না বটে, কিন্তু বেশভূষা আর দেহভঙ্গীতে, ব্যক্তিত্বে এক ধরনের জেল্লা ধরে। এক কোরবানীর সময় হালকা পাতলা মানুষটি বিশাল এক ষাঁড় কিনে এনে ফকির-মিশকিনদের প্রচুর গোস্ত বিলিয়ে আর চামড়াটি স্থানীয় মসজিদে দান করলে এলাকাবাসী কেউ কেউ এতোদিন তারাভাইয়ের উপর অবিচার করা হয়েছে- একটি সামান্য ভুলের এমন শাস্তির কেনো মানেই হয় না- এমন কথা বলতেও সঙ্কোচ করে না। কেউ কেউ তখন যুদ্ধ-পরবতীঁ তারামিয়ার দোসরের শাস্তি ও মৃত্যু বিষয়ক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় অনুযোগ না ক্ষোভ না অনাস্থা না অবিচার- কী সূচিত করতে চায়, ঠিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। দেখা যায় কেউ কেউ এমন বক্তব্যের সাথে একপ্রকার মিনমিনে সমর্থন বা একাত্মতাও ঘোষণা করে যেনো। অবশেষে তারামিয়াকে স্থানীয় যুব-কিশোর-শিশু সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদটি দেবার আহবান জানানো হলেও একগুঁয়ে লোকটি মিনমিন করে তার অনিচ্ছা প্রকাশ করে। যে ছেলেরা এই প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলো তারা যেনো বেশ খুশি মনেই ফিরে আসে। এমন আচরণই তারা তারামিয়ার কাছ থেকে আশা করেছিলো হয়তো। ফলত, তারামিয়া সেই নিন্মমুখী, দ্রুতগমনশীল, প্রাত্যহিক বাজারকারী- দৃশ্যটি থেকে তেমন খুব একটা পৃথক হয়ে ধরা পড়ে না। কেবল তার কপালে অত্যাধিক সেজদাজনিত একটি লালচে-কালো কড়া ফুটে ওঠে। আর তার বদৌলতে চট করে তারামিয়ার মুখশ্রীতে কেমন একটি সৌম্য সৌম্য ভাব ফোটে। সরকার আসে সরকার যায়- তারামিয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারাতেও কেউ কোনো আলোড়ন দেখতে পায় না। খুবই হৃদয়বান কেউ কেউ এমনও বলে যে একাত্তরে অনেকেই তো অনেক কিছু করছে- আরে কতো দ্যাখলাম, মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়া হিন্দুগো মাইয়ারে জোর কইর‌্যা মোছলমান বানাইতে, আর তারমিয়া যা-ই হউক মাইয়া মাইনসের অপমান করছে এমোন কতা কেউ কইতে পারবে না।

এহেন অনুসন্ধানী রিপোর্ট সমগ্র এলাকায় তারামিয়ার সম্মান ও প্রতিপত্তিকে স্থায়ী করে তুলেছিলো। আর তার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যখন পড়ালেখায় স্কুল ডিঙিয়ে কলেজের সীমায় ঢুকে পড়ে- তখন তারামিয়াকে আর পায় কে? দেখতে দেখতে তার বাড়ির টিনের চাল উঠে গিয়ে দালান হলো- তারপর সেই দালান একতলা দোতলা হয়ে শেষে বৃদ্ধ কড়ই গাছের মাথা ডিঙিয়ে অনেক দূর থেকে কাঁচকলা দেখায়। কড়ই গাছটি তার বাড়ির সীমানাতেই। ঝড়ের দিনে প্রতিবারই একটা দুটো ডাল ভেঙে পড়া রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ঢ্যাঙ্গা, ভঙ্গুর গাছটির এহেন আচরণ রীতিবিরুদ্ধ বলেই অনেকে গাছটিকে প্রেত বসবাসের সম্ভাবনা বলে ঠাওড়াতো। সন্ধ্যার পর ঐ গাছের নিচ দিয়ে যে শর্টকাট মাটির রাস্তাটি- যেটি শুধুমাত্র শীতকাল ব্যতিরেকে কেবল তৃণভোজীদের চলাচলসাধ্য- পারতে-সাধ্যে কেউ সেটা খুব একটা ব্যবহার করতো না। এই রাস্তাটি থানা কাউন্সিলের আওতায়, কিন্তু এর লিংক রোড দুটি পৌরসভার নিয়ন্ত্রনে বলে বহু বছর ধরে টেন্ডার হলেও থানা কাউন্সিল রাস্তাটিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না করায় এর সংস্কার হয়নি। কবে কারা এককালে সুরকি ফেলেছিলো। এখন প্যাঁচপেঁচে কাদা, কড়ই গাছের পাকনা বীজ আর পাকা পাতায় থকথকে পথটি চলাচলের অযোগ্য। কিন্তু একদিন ভোরে গাছ কাটার শব্দে সবাই চমকে তাকিয়ে দেখলো বিরল পত্রের ঢ্যাঙ্গা কড়ই গাছটির মগডালে কালো কালো পেটানো শরীরের কয়েকটা লোক দড়িদড়া আর হাত-করাত, কুড়োল নিয়ে গাছটিকে খণ্ড খণ্ড করে ভূপাতিত করছে। ‘তারার গাছ তারা কাডে, কার বাপের বাড়া চাডে?’ ছ্যাড়ারা ছড়া বানায়। কেউ বিষয়টাকে তেমন করে পাত্তাও দেয় না। কিন্তু তাদের এই অনুৎসাহ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ব্যাপার হলো, তারামিয়ার বাড়ির পাশের ঐ পথ বা রাস্তাটি থানা কাউন্সিল অবশেষে পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করেছে। তারামিয়া পৌরসভায় চাকরি করতো বলে আগেভাগে খবর পেয়ে গাছটি প্রথমে কেটে ফেলে। কারণ ওটা তার সীমানার মাঝামাঝি। এককালে তার জমিতে গাছটির শেকড় পুরোটাই থাকলেও প্রতি বর্ষার সিজনে বাঙালির সীমানা বাড়ানোর আবহমান রীতি অনুসরণ করে তারামিয়া সেটাকে ঠেলে দিয়েছিলো এতিম রাস্তাটির দিকে। এখন মাপজোখ শুরু হলে সেটাই যাতে বুমেরাং না হয়ে ওঠে এজন্য এহেন পূর্ব প্রস্তুতিতে সে অনেকের নৈব্যক্ত বাহবা কুড়োয়। কিন্তু গাছ কেটে ফেলার পরদিনই যখন রাজমিস্ত্রিরা তারামিয়ার সীমানা বরাবর দশইঞ্চি দেয়াল গাঁথতে শুরু করে- তখন কারো কারো টনক নড়ে। ‘মাজাভাঙ্গার পোয় শুরুডা হরলে কি? রাস্তাডা পাকা হইবে হেয়া সৈজ্জো অয়না এ্যাঁ?’ ইত্যাকার বাক্য তারামিয়ার কানতক পৌঁছায় কিনা সন্দেহ। এলাকার যুবক ছেলেরা একজোট হয়। মুরুব্বীরা জোহরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফেরার পথে জিজ্ঞেস করেথ- ‘ও মেয়া, এইডা হল্লেন কি? রাস্তাডা হওনের পর ওয়াল দেতে পারতেন না?’

তারামিয়া সেই মিনমিনে কণ্ঠে কি যেনো বলে। তার চোখ, তার গলার স্বর আগের মতোই অনিচ্ছা আর বিরক্তিতে কাঁপে। যেনো সে কোনো কৈফিয়ত দিতে প্রস্তুত নয়। দিনকাল খারাপ। মুরুব্বীরা তেমন কোনো সদুত্তর না পেয়ে অপমানেই সরে পড়ে। তার পরদিন যুবকরা যখন অনেকে মিলে দেয়াল তুলতে নিষেধ করার আর্জি নিয়ে তার কাছে যায় তখনও সে তাদের দিকে ভালোকরে তাকায় না পর্যন্ত। কেবল সদ্য কেটে ফেলা কড়ই গাছের এন্তার ডালপালার স্তুপের ভেতর থেকে একটি কালচে-সবুজ আরজিনা সড়াৎ করে বেড়িয়ে এসে লকলকে জিভ বের করে নির্ণীমেষ তাকিয়ে চকিতে উধাও হয়ে গেলে তাদের মধ্যে সদ্য-যুবা কেউ কেউ ভয় পেয়ে নিজের বুকে থুৎকুড়ি ছিটায়। এর দুদিন পর পৌরসভা থেকে লোকজন এসে রাস্তার জন্য জমি মাপ দিয়ে দেখে দুপাশে ড্রেনের জন্য এলাকাবাসীর প্রত্যেকের আড়াই ফিট করে যে জমি সরকারের হুকুমদখলের কথা ছিলো, তা তো নেই-ই, উপরন্তু তারামিয়ার গাইডওয়ালের ভেতরে হাতখানেক রাস্তা গায়েব হয়ে গেছে। ফলে ঐ অংশটা সরু হয়ে গেছে। অপরদিকে আবিয়াতো মেয়েমানুষের অবৈধ পেট ওঠার মতো তারামিয়ার গাইডওয়ালটি ঐখানে বিচ্ছিরিরকম ভাবে ফুলে আছে।

পৌর কর্তৃপক্ষ এলাকার গন্যমান্যদের জানায়। তারামিয়াকে জমি ছেড়ে দিতে বলে। এমনকি এর জায়ে সরকারী কিছু টাকা পাইয়ে দেয়ার আহবানও জানানো হয়। কিন্তু তারামিয়া মিনমিনে খোনা গলায় তার দেয়াল ভাঙতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং তার দেয়ালে সাদা চূণকাম লাগার পর নানা অশ্লীল অক্ষর ও আঁকিবুকিতে ভরে ওঠে। তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য শব্দবন্ধটি হলো- ‘তারারে চুদি’। এই সাদাসিদে আকাঙ্খার কথাটি কে দেয়ালে লিখতে পারে, এ নিয়ে এলাকায় তারামিয়ার ছেলেরা- যারা এখন বেশ নামিদামি মাস্তান- খুঁজে বের করতে গিয়ে দু দফায় তিনজনকে মারধর করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সবাই যখন একজোট হয়ে দেয়াল ভাঙার উদ্যোগ নেয়, তখন এলাকায় স্থায়ী-বেকার ফ্রিডম ফাইটার তোফা ভাই এতে নেতৃত্ব দেন। দলটি দেয়ালের দিকে অগ্রসর হয় এবং শাবলের আঘাতে তার একাংশের কিছু ইট দমাদম খসিয়ে ফেলে। তারার মেজো ছেলে তখন ঘরের ভেতর দিয়ে সড়াৎ করে পিস্তল হাতে বেড়িয়ে এসে তোফাভাইকে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলি করে। তিনি মাথায় গুলি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়। তারামিয়ার দু দুটি পাতানো কেস-এ পুলিশ এলাকার বাড়িঘর চষে ফেলে, সকল যুবক ছেলেদেরই থানায় ধরে নিয়ে যায়। যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়… এমনিভাবে… এমনিভাবে ঘটনার পর ঘটনা ঘটতে থাকলে পুরো ঘটনাটাই একটা নিছক ঘটনায় পরিণত হয়। রাস্তাটাও একদিন পৌরসভা টেন্ডার দিয়ে পাকা করে ফেলে। বলা বাহুল্য, ঐ একহাত জমি ছাড়াই। আর তার পরের কয়েক বছরে তারামিয়ার বিল্ডিং আরও কয়েক তলা উঁচু হয়। ভাড়াটের সংখ্যা বাড়ে। তার বাজার করে বাসায় ফেরার প্রাত্যহিক ভঙ্গীমায় কোনো পরিবর্তন আসে না। দূর থেকে আগে যেখানে দেবাংশী কড়ই গাছটির মাথা নজরে পড়তো- সেখানে এখন তারামিয়ার টু-ইউনিট ফ্ল্যাটবাড়ির নীলপর্দা বাতাসে ওড়ে!

১৫ জুন ২০০১

একটি ধারালো গল্প

গাছকাটা দায়ের ধার পরীক্ষা করতে গিয়ে মহামতি জিল্লুরের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা খ্যাঁচ করে কেটে একদম আলাদা হয়ে দুপুরের ফ্যাসলা রোদের উঠোনে তিড়িক মেরে টিকটিকির লেজের মতো তড়পাতে লাগলো!…

ছরবেছর রক্তের ফুসলানিতে লবেজান জিল্লুর তখন ডাকচিক্কুর না খামিশ খেয়ে থাকবে, তা বিষম বুজতে না পেরে ধুলোর ওপর শাদালুঙ্গীর মায়া ত্যাগ করে বসে পড়লো। গলা দিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজে কৌতুহলী তার এইটে পড়া ছেলেসন্তান মোরসালিন ব্যাপার দেখে ভীরমি খাবার জোগাড়। হাতে টাচমোবাইল নিয়ে সে এতো এতো রক্ত দেখে কিংকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে হেঁচকি তুলে ফেললো। কোরবানীর পশুর কণ্ঠনালী ছাড়া এতো রক্তের পিচকারী সে কোথাও দেখেনি আর। মহামতি জিল্লুর মহাবিরক্তি নিয়ে তাকে বললো পানি আনতে। তারপর সেই পানিতে রক্ত ধুয়ে ধূলোর ভেতর নিজেই নিজের থিরথির কাঁপতে থাকা খন্ডিত আঙুলটা কুড়িয়ে এনে কাটা যায়গায় চেপে বসালো। আর এই ঘটনা পুরোটাই বন্দী হয়ে গেলো  মোরসালিনের সাড়েতিন মেগাপিক্সেল মোবাইল ক্যামেরায়। 

খেজুরগাছ কাটার জন্য স্প্রিংপাতি জুৎমতো পাইন দিয়ে মহার্ঘ দাখানা বানিয়ে দিয়েছিলো ললিত কর্মকার সেই কবে। বালিতে শান দিলে শালী এমন ধারিয়ে ওঠে যে আস্তমানুষও এককোপে দুপিস করা যায়! জিল্লুর তাকে স্ত্রীবাচক মনে করে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনো ঘটনা থেকে থাকবে। কিন্তু ঘটনা হলো, জিল্লুরের সেই কর্তিত আঙুল – যা হোক সময় হলে একটু বাঁকাভাবে জোড়া লেগে গিয়েছিলো; কিন্তু তারচেও বড় খবর হলো, কাঁপা হাতে ভিডিও করা মোরসালিনের সেই ফুটেজ টিকটকে তিনদিনে বারো লক্ষ ভিউড হয়েছে। মোরসালিন রাতারাতি স্টার। সাথে জিল্লুর রহমানও। এখন তাকে এই স্টারার্কি (স্টার+ইয়ার্কি) চালিয়ে যেতে হবে ছাড়া উপায় নেই। তো জিল্লুর এখন কী করবে? নিজের বিশটা আঙুল কি সে নিয়মিত ইন্টারভেলে একে একে কেটে ফেলবে টিকটকবাসীদের প্রভুত বিনুদোন প্রশমনের জন্য? সেটা সম্ভব নয়। জিল্লুর তাই অন্য উপায় খোঁজে। পাবলিকের মনস্তত্ত্ব মেপে সে নানারকম কায়দা কেরিকেচার করে। চ্যানেলে লোক জমাতে সে একটানে ব্রয়লারের মাথা ছিঁড়ে ফেলে, বেড়াল বস্তায় ভরে পিটিয়ে মেরে ফেলে আর ঘুমন্ত পাখির ছানাকে ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়। কিন্তু ভিউয়ার্সের সংখ্যা তাতে ওই হারে বাড়ে না। বেজায় মনোগ্লানি নিয়ে জিল্লুর রহমান আর মোরসালিন তখন ভাবতে থাকে, কী করিলে সোশাল মিডিয়ার ভিউয়ার্স বাড়ানো যায়? 

ভাবিতে ভাবিতে শীত গড়িয়ে বর্ষা আসে। তারা আশা ছাড়ে না। তাদের গবেষণাও চলতে থাকে। সেধে বোলতার কামড় খেয়ে, গরুর গুঁতায় আহত হয়ে আর গাড়ির নিচে মরতে মরতে চাপা পড়ে সেসব ফুটেজ পাবলিককে খাওয়ানোর কম চেষ্টা করেনি জিল্লুর -মোরসালিন জুটি। কিন্তু কাটা আঙুল জোড়া লাগার মতো টিআরপি আর কিছুতেই আসেনি। আর টিআরপি বা লাইক, যে নামেই ডাকো – জীবনের অর্থ কী, সোশাল মিডিয়া ছাড়া? ভাত খেলাম – তো ছবি দিলাম, বেড়াতে গেলাম – তো ভিডিও দিলাম, গাছে উঠলাম কি দড়ি পাকলাম – লাইভ তো করতেই হবে, নাকি? এর পাশাপাশি আছে বিভিন্ন পারফমেন্স বিষয়ক ব্যারাম। গান গাইলে ছাদে, ছাদবাগানে কুমড়াফুলের ছবি – শেয়ার না দিলে কি মান থাকে? নাচতে জানলে পোয়াবারো, নাচতে না জানলেও সমস্যা নেই, আছে আলোচনা সভা আর সাহিত্য আসর। বাদ যাবে না একটি শিশুও। কিছু না কিছু করে আলোচনার কেন্দ্রে তোমাকে থাকতে হবে। আর সেজন্য যাহাই করা দরকার, করো। টিআরটি পড়তে দিও না। ধরে রাখো, উচ্চ করো শির, হে গম্ভীর, হে গম্ভীর!

তো এহেন টিআরপি সংকটের মাঝে তারা দেখতে পায় বাজ পড়ে ঢ্যাঙ্গা নারকোল গাছটার দফা শেষ। আইডিয়া তখন তড়াক করে মাথায় উঠে আসে। আরে তাইতো, জীবন্ত প্রাণীর ওপর বাজ পড়লে তো দারুণ হবে! এনজিওর ঋণে কেনা ‘লাইভিহুড মিন্স’ যে ব্লাকবেঙ্গলখানা তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী মাস চারেক আগে উপহার পেয়েছে, জিল্লুর রহমান তাকে খোলামাঠের মাঝে টাইট করে বেঁধে রাখে। ধরো এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পেছনেও কিছু পারশিয়ালিটি আছে। একটা অবলা নারকেলগাছ খানখান হয়ে গেলো, অথচ ধুমবৃষ্টিতে একটানা তিনদিন বেঁধে রাখার পরেও ছাগলটার কিছুই হলো না। ম্যঁ ম্যঁ করে ডাকতে ডাকতে ফাজিলটা বজ্রের মন জয় করে নিলো। অথচ এ তল্লাটে অন্তত জনাবিশেক লোক ফিবছর বাজপড়ে ছাই হয়ে যায়। এবং তাদের ডেডবডি গোরস্থানে মাটি হবার আগেই উধাও হয়ে যায়, কখন তা কেউই ঠিক করে বলতে পারে না। তা বাজপড়া ডেডবডি যদি এতোই মূল্যবান হবে মিস্টার, তো তাদের গ্রামের সবার বাড়ি আজ সাততলা দালান ওঠার কথা! আর ওদিকে শালা ছাগলটা তিনদিনের বৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চারদিনের দিন ছেউড় হয়ে মরলো। তার শোকে আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর নাকিকান্না দেখে কে? জিল্লুর যে কী করে এখন! অদিকে টিকটকে তার জনপ্রিয়তার পপুলারিটির যাচ্ছেতাই অবস্থা একেবারে। একে রুখতে না পারলে আর জীবনের অর্থ কী? যে করেই হোক সোশাল মিডিয়াকে তো আর হেলা করা যায় না। বর্তমান যুগ, বিজ্ঞানের যুগ বলে কথা। আর এটাই সায়েন্স! তা সায়েন্স বলো আর বিজ্ঞানই বলো, একটা পোস্ট দেবার পর যদি বানের পানির মতো লাইকের বন্যা না ছোটে, পরিবর্তে বৃদ্ধ বয়সে বহুমুত্র রোগীর কায়ক্লেশে ফোঁটা ফোঁটা মুত্র বিসর্জনের মতো একটা দুটো রিএ্যাকশন জোট- তো সে জীবন থাকা আর না থাকা সমান কথা নয়কি হে মিস্টার? এদিকে টিকটকে ভিডিও বুস্ট হবার পর তাকে সবাই মহামতি ডাকতে শুরু করেছে। শব্দটা আসলে ভুলবশত তৈরি। তারা তাকে ডাকতে চেয়েছিলো মরারগতি! লোকমুখে জিহ্বার প্রোরচনায় বা আহলাদে সেটাই মহামতি হয়ে গেছে। তো বন্দরের বাজারে বা এলাকার হাটে তাকে লোকজন আস্তে আস্তে বিশেষভাবে চিনে গেলো মহামতি জিল্লুর হিসেবে। তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া অন্তত আরও গোটা পঞ্চাশেক ভিডিও ট্রল নেটদুনিয়ায় চালু। তার স্টিল ছবি দিয়ে প্রাঙ্ক হচ্ছে অহরহ। জিল্লুর এখন নিজেই নিজেকে ভিডিওর শুরুতে মহামতি বলে পরিচয় দেয়। আর বলে, ছলুন ধর্শোক, দেখতে থাকুন আমাদের স্টারার্কি!… তার ঢং নকল করে ভুল বাংলায়, অশুদ্ধ উচ্চারণে আরও কতো রেডিও জকি রাতারাতি সুপারহিট! 

হলে কী হবে? কাটা আঙুল জোড়া লাগার মতো চমক আর কিছুতেই নেই বলে জিল্লুর একদিন পুকুর ঘাটলায় বসে একা একা ভীষণ গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসে। ভেবে ভেবে এই কিনারায় পৌঁছায় যে শরীরের অঙ্গহানি না করিলে এই শালার টিআরপি আর উপরমুই হলো নাহয়। তো কীভাবে হবে সেই অঙ্গহানি? একটা হাত যদি কেটে ফেলা যায়… ধুৎ, বাঁহাত কতো কাজে লাগে!… সবকিছু বাদ দাও, ল্যাট্রিনে বাঁহাত রাজা, তো সেটা তুমি কেটে ফেলতে চাও কোন্ আক্কেলে মিস্টার? তারচে একটা চোখ যদি…! হ্যাঁ ইয়েস, বাকী চোখে দুনিয়া দেখা চলে! কতো ভালো ভালো শিকখিৎ লোকইতো একচোখে দুনিয়া দেখছে, দুনিয়া মাপছে! কৈ, তাদেরতো কোনো সমস্যা হচ্ছে না? এমনকি দুনিয়াটাও একচোখা দুনিয়াতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বেশ! …তা দেবে নাকি খেজুরকাটা দিয়ে নিজের একটা চোখের দফারফা করে? কোন্ চোখ? ডানটা না বামটা? দুনিয়া এখন ডানবাম কোন্ চোখের নেতৃত্বে যে চলছে, তা মহামতি জিল্লুরের পক্ষে বোঝা কঠিন! এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের খেলার মাঝে জিল্লুরের হুট করে আরও একটা অপশনের কথা এক ঝলকে মনে পড়লো! আর তারপর সেটা তার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোতের পরশ বুলিয়ে সাঁৎ করে নেমে গেলো নিচে! কী সর্বনাশ! জিল্লুর ওটা পুরোপুরি কেটে ফেলার কথা ভাবে কী করে? স্ত্রী যদিও অন্তঃসত্ত্বা তবুও কতো কাম বাকী আছে এখনো!! ছিছিছির দোলাচালে খাবি খেতে খেতে তৎসময়ের জন্য তার এই গা জোয়ারী ভাবনাটা মুলতুবী রাখে, রাখতে বাধ্য হয়। ইসব কথা চিন্তাতে আসাও উচিত লা হোইসে মিষ্ঠার!

কিন্তু খোসপাঁচড়ার চুলকানির মতো একটু পরেই আবার ভাবনাটা তার মাথায় উঠে কুটকুট করতে থাকে। আর এসবের মধ্যেই মহীসোপানের মতো একটা দানবীয় অসুরিক আইডিয়া তার মূর্খ মাথাটিকে একদম আয়ত্ব করে ফেলে! ভাবনার আগাপাশতলা কিছুই সে মাপতে না পারলেও এটুকু বুজতে পারে যে, ওই আইডিয়াটা সফল হলে তার টিকটক পোস্ট দুনিয়ার তাবৎ লাইকের সীমাসংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে! আর মহামতি জিল্লুরের জন্য আপাতত সেটুকু আকর্ষণই যথেষ্ট! নয়কি? ভাবনাকে পাকার সুযোগ না দিয়ে জায়মান চিন্তাটা নিয়ে সে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। বিকেলের রোদ পড়িপড়ি করছে। এই সময়টায় লাইভ করতে পারলে খুবই ভালো হবে। লোকজন দুপুরের ভাতঘুম সেরে কেবল মোবাইলটা হাতে নিয়েছে। এখন জিল্লুরের ছলবলানি দেখতে তাদের ভালো না লাগার কথা নয়। সে গাছকাটা দাখানা জুৎমতো ধার দিয়ে রেখেছিলো আগেই। সেটা হাতে নিয়ে আজ আর ধার পরীক্ষার চেষ্টা করলো না। কেবল মোরসালিনকে টাচমোবাইলটা নিয়ে পুকুর পাড়ের কলাগাছের ঝাড়ের দিকে আসতে বললো। আর ছেলেটাও হয়েছে সৎবাপের ন্যাওটা। কথা একটা মুখ থেকে বলেছ কি, মোরসালিন হাজির। প্রথমে সে একটা মাঝারি সাইজের কলাগাছকে এককোপে নামিয়ে দিলো! বাহ্, শালী তো দারুণ ধারিয়ে আছে! কিন্তু একহাতে দা নিয়ে অন্য হাতে লাইভ করা মুশকিল। সে মোরসালিনকে সেলফিমুডে ক্যামেরার সামনে আসতে বললো। এতোদিনে ছেলেটাও বেশ চৌকশ হয়ে উঠেছে। হালকা গোঁফের রেখার সাথে হালকা সাহসও বেড়েছে। সৎবাপের নির্দেশ মোতাবেক সে টিকটকে লাইভ অপশন চালু করে দিলো। ফ্রেমের এককোণে সে নিজেকে রেখে মূল ফোকাসে আনলো দা হাতে জিল্লুরকে। তারপর ইশারা পেয়ে গড়গড় করে বলতে লাগলো: হামার বাপো, হাজ আপোনাদের দেখাবেনজ্বে, কিয়ের পান্হে চোখোৎ ওরচু ঝরে, কেনু হাপন মানুশ পর হঅয়ে যাছে, ছামাইন্নো ছার্থের খারনে হাপন লোকের গলাৎ ছুরি চাল্হাই দিতে কুনো হায়াশরমের তোয়াক্কা না লিছে, বন্দুগণ রেডি থাকিয়েন জ্বে!… শেষের অংশটা একটা ট্যাগলাইন, হাত নেড়েনেড়ে, কায়দা করে মোরসালিন তার সৎবাপের স্টাইলকে আর একটু মেলোড্রামায় সাজিয়ে দিতে, তার আগের বাপের এলাকার ডায়ালেক্টের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক কিম্ভুত ভাষাসংস্থান ফুটিয়ে তোলে! পাবলিক সেটা দারুণভাবে এনজয়ও করে এসেছে এতোকাল। তো ছলুন ধর্শোক, দেখতে থাকুন বলে জিল্লুর তার স্বভাবসুলভ জাদুকরী ভঙ্গীর বদলে আজ দু কদম সামনে বেড়ে ক্যামেরার সামনে ধারালো দাটা নিয়ে এসে পরখ করালো যেনো। আর তারপরই কোনো এক অসুরিক শক্তিতে আবিষ্ট হয়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো দাখানা সে সাঁৎ করে নামিয়ে আনলো মোরসালিনের অপুষ্ট ঘাড়ে! বিদ্ঘুটে একটা ভোঁতা আওয়াজ উঠলো শুধু।

ছরবেছর রক্তের ধারায় যতোক্ষণ মোবাইলটা ধরা ছিলো,  লাখ লাখ ধর্শোকরা দেখেছেন ধারালো গল্পটা তিড়িক মেরে ধুলোকাদায় লাল টিআরপিতে দিগ্বিদিক ভেসে যাচ্ছে! 

আগস্ট ২০২১, সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা।

 

দুর্ঘটনা

কি ঘটেছিলো এই বাসায়? খুন বা ধর্ষণ কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে কেউ আত্মহত্যা করেছিলো? স্ত্রীকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলেছিলো? কিংবা আচমকা দরজা ভেঙে ঢুকে কেউ পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলিতে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলো লোকটিকে?

দেবব্রত অবশেষে বাসা খুঁজে পেলো। বাসা খোঁজার উপরে কোনো ডিপ্লোমার ব্যবস্থা থাকলে তা তার প্রাপ্য। স্ত্রী অরুন্ধতি নতুন সংসার পাতার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পুরো ঘর, মানে দুই রুম আর একফালি বারান্দা আর মানানসই কিচেন বাথরুম একপাক ঘুরে এসে তৃপ্তির আমেজ মাখা মমতা নিয়ে বলে “বেশ কিন্তু বাসাটা, তাইনাগো?’ দেবব্রত বোঝে সুখ মানে এই এক টুকরো কথার মধ্যে ঠাসবুনোট দেয়া আবেগ। এবং এভাবেই তারা সুখী হবার জন্য প্রথমত তাদের প্রথম সংসার শুরু করে দিলো। কিন্তু প্রথম থেকেই জামার নীচে যেখানে হৃদপিণ্ডটা ক্রমাগত ধুকপুক করছে, ভয়টা সেখানে খামচি মেরে ধরার পর থেকে সেই সুখ অস্থায়ী ভাড়াটের মতো আচরণ শুরু করে দেয়। কিন্তু এমন এক অদৃশ্য কার্যকারণহীন সেই ভয়- যাকে ভয় করা তো হয়ই না, উপরন্তু দেবব্রত এবং পরিশেষে অরুন্ধতিও ক্রমাগত আবিষ্ট হতে শুরু করে। তাদের সুখ অসুখ মিলিয়ে বাসাটাও একটা সত্ত্বা হয়ে বিচরণ করে যেনো। কান পাতলে সেই সত্ত্বার সাথে কথোপকথোন কিংবা তার নিঃশ্বাসের স্বরও শুনতে পাওয়া যেতো!

বাড়িওলা সজ্জন। ছুটির দিন বলে তিনি সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। নিজ হাতে খুলে দেখালেন দুইরুম ফ্ল্যাটটি। ছিমছাম। নতুন ডিস্টেম্পারে চকচকে হাইজিনিক ওয়াশ মাখা দেয়াল দেবব্রতকে ডাকে। সে মোহে পড়ে। নিজের ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার দ্রুত হিসেব করে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়- এখানে হবে। হতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই অবশ্য। আজ মাসের ১৪ তারিখ। এরপর আর কেনো টু লেট ঝুলবে না আসেপাশে। তার অফিসেও মোটামুটি অল্প ভাড়াতেই পৌঁছে যাওয়া যাবে এখান থেকে। কিন্তু এই লোকটাকে তা বুঝতে দেয়া যাবে না- সে মনে মনে ভাবে। উপরে নির্লিপ্তি অথচ ভিতরে দ্রুত যোগবিয়োগপূরণভাগ একদম ব্যস্ত রাখে মাথাটাকে। ফলে বাড়িওলার বাড়ি বিষয়ক সেল্ফ প্রোপাগাণ্ডা তার চেতনা স্পর্শ করে না। কিন্তু ওর চোখের ভাষা, পোড় খাওয়া বর্ষীয়ান ব্যক্তিটি অনায়াশে আনকোড করে ফেলতে পারেন। ঈষৎ হেসে বলেন “দেখুন, এর চেয়ে ভালো বাসা হয়তো পাবেন, কিন্তু এমন ভালোবাসা আর পাবেন না।’ বলেই নিজের রসিকতায় হোহো করে হাসেন। লোকটার এতো গরজ কিসের ? এই এরিয়ায় বাসা পাওয়া বেশ কঠিন। অফিসপাড়া থেকে কাছে হয় বলে খালি পাওয়া যায় না একদমই। চিন্তিত হয়ে ভাবে দেবব্রত। কিন্তু নিজেকে আর নেগেটিভলি উসকে দেবে না বলে শাসায় মনে মনে – আর কয়েকটা স্টিল পিকচারের মতো ভাসে অরুন্ধতি চান করে ভিজে চুলে টাওয়েল জড়িয়ে বেরুচ্ছে বাথরুম থেকে, কিচেনে রান্না করছে, অফিস থেকে ফিরতে চাবি ছুঁড়ে দিচ্ছে নিচে গেট খুলতে… দৃশ্যগুলি এমনই জমজমাট যে চিনির সিরায় ডুবে যাওয়া মাছির মতো আবেশে সে জুবড়ে যায় একেবারে।

অবশেষে তারা একটা রফায় আসতে দেরি করে না। বাড়িওলা ওদের ডেকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসিয়ে ফিরনি জাতীয় একটা কিছুতে আপ্যায়নের সাথে সাথে জানান, কয়েকটা জানালায় কাঁচ ভাঙা আছে, তিনি লাগিয়ে দেবেন। পর্দা টাঙানোর রানারেও কিছু সমস্যার কথা নিজ থেকেই তিনি বলেন। লোকটাকে এতো সরল মনে হয় না। তবুও সে সজ্জনের মতোই জিজ্ঞেস করে দেবব্রতর চাকরিটা কোন্ ধাঁচের। বিদেশি এনজিও শুনে তিনি হাঁফ ছাড়েন। এমনকি বরিশাল বা গফরগাঁওয়ের লোকদের তিনি পছন্দ করতেন না কারণ গফরগাঁও তার নিজ শ্বশুরবাড়ি আর দেবব্রত বরিশালের শুনে তিনি এভাবে কথাটার নিষ্পত্তি করেন যে – একটা এলাকার সব লোক খারাপ হয় না হেঃ হেঃ। দেবব্রত লোকটার ভেতরে এই সময় ঘাপটি মেরে থাকা সচিবালয়ের মিড লেভেল অফিসারসুলভ চামচা অভিব্যক্তি খুঁজে পায়। কিন্তু তারপরও বাড়িওলার সাথে তেমন আশনাই হবে না- ওরা নিজেদের মতোন থাকবে- এই আকাঙ্খা নিয়ে সে এডভান্সের টাকাটা তুলে দেয়। অরু অন্তত বুঝুক সেও বাসা নিতে জানা পুরুষ! অর্থাৎ ‘পুরুষমানুষ’!

এই ঘটনার পর আরও বহু বহুবারের মতো এবারও সে নিজের সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাসাটার একটাই সমস্যা। তা হলো রোদ পড়ে না। কিন্তু ট্যানারি এলাকা বলে মশা মাছি তেমন নেই। অভিজ্ঞ ভাড়াটে বন্ধুদের সাথে সে বাসা খোঁজা ও বাসা পাওয়া নিয়ে অঢেল গুলতানি করে। কেউ বলে ঐ এলাকায় ভাড়াতো কম হবেই- তিনমাসে ধাতব যন্ত্রপাতি সব আলগা ঝুরঝুরা হয়ে যায়। আরে ভাই আমার একখান সাইকেল আছিলো। একদম লজ্ঝর হয়ে গেছে- ট্যানারি ক্যামিকেলের কী ঝাঁঝ! আর একজন তার অল্পবয়সে টাক পড়ে যাওয়ার জন্য ঐখানের সাপ্লাইয়ের পানিকে দোষী করে।… কিন্তু দেবব্রতর ভেতরে তখন অরুন্ধতিকে নিয়ে টানা মিছিল চলছে। মানতে হবে মেনে নাও, দিতে হবে দিয়ে দাও-র মতো বৈবাহিক চাহিদাগুলি আস্ফালন করছে একাদিক্রমে। বিয়ের পরের দুই বছর তারা দুই ভূবনে দুই বাসিন্দা হয়ে আছে। আর কাঁহাতক সহ্য হয়? এবার থাক না বেতন কেটে ডিপিএস চালানোর হিসেব। না হয় মাসের সবটাই শেষ হয়ে যাক। আর ঢাকায় এসে অরুন্ধতিও নিশ্চয়ই একটা কিছু জুটিয়ে নিতে পারবে- এই আশাও তাকে বাসা নিতে সাহস জোগায়- অতএব নতুন বাসায় তারা শীগগীর উঠে গেলো। প্রথম সংসার যেভাবে শুরু হয় – একটা পুরোদস্তর খাট, কিছু বইটই, বিয়েতে পাওয়া কিছু অপ্রয়োজনীয় উপহার সামগ্রী আর অরুন্ধতির কিছু গহনাপত্র ও কাপড় চোপড়ের স্যুটকেস এক ঠ্যালাগাড়িতেও উপচে পড়ে না। প্রথম দিনের মেনু আলুসেদ্ধ- ডিমভাজা আর বাড়িওলার স্ত্রীর পাঠানো ফিরনী অমৃত মনে হয়। ভদ্রমহিলা সম্ভবত ঐ একটা রান্নাই পারেন।
কিন্তু বাসা অর্জন করা যতো কঠিন, তাকে টিকিয়ে রাখাও তারচে কম কঠিন নয়। প্রথম সাতদিনে ধোয়ামোছা পরিপাটি আর এন্তার কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। জুতোর আলমারি কেনাও যে কী ঝকমারি তা ওরা উপলব্ধি করে। আর এরই ফাঁকে ভয়টা চিনচিন করে বাড়তে থাকে। ওদের পাশের বিল্ডিংটায় কনস্ট্রাকশন চলছে। সারাদিনে গর্ত খোঁড়ার মেশিন চলছে একদিকে আর সারা রাতভর ট্র্যাকে করে ইট বালু সুড়কির পরিবহনে ঘুমের বারোটা বেজে যেতে বসেছে। সেন্টারিংয়ের জন্য মিস্ত্রিরা সারারাত কাঠ পেটায়। আচ্ছা দেবব্রত যখন অফিসে থাকে – বিশাল ঐ বিল্ডিংটা থেকে লেবাররা যদি কোনো কুমতলবে এই বিল্ডিংয়ে চলে আসে? ওদের বেডরুমে এখনো পর্দা লাগানো হয়নি। অর্ডার দেবার পরও ঘোরাচ্ছে। অরুন্ধতি একা আছে বুঝে কেউ যদি কোনো ভেক ধরে দরজায় নক করে? আজকাল ডিশের লোক, টেলিফোনের লোক বলে কতো কিছুইতো ঘটছে পেপারে দেখা যায়। অরুন্ধতিকে এসব ভয়ের কথা বলতে দেবব্রতর বাঁধো বাঁধো ঠেকে। কিন্তু অফিসে বসেও এক ধরনের অস্বস্তিতে সে চিড়বিড় করতে থাকে। কি করা যায় মনে মনে ভাবে। বাথরুমের একটা কল থেকে পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়েই চলেছে। বাড়িওলাকে বলবে ভাবছিলো। এখন মনে হয় সেই সাথে দরজায় আর একটা দশাসই ছিটকিনি লাগানোর কথাটাও তুলতে হবে। কিন্তু বাসায় ফিরে সে তাজ্জব হয়ে যায়। অরু জানায়, আজ বাড়িওলা অয়েল্ডিং ফ্যাক্টরির লোকসহ এসে প্রতিটা জানালার মাপ নিয়ে গেছে। একটা গ্রিল থাকা সত্ত্বেও ভেতর দিকে অন্য একটা ঘন তারের গ্রীল তিনি সেট করে দিতে চান সিকিউরিটির জন্য। না না এজন্য দেবব্রতকে কোনো পে করতে হবে না। তোমরা নতুন সংসার পেতেছ- আহলাদে আটখানা হয়ে তিনি অরুন্ধতিকে তুমি সম্বোধন করে বসেন- খোদা না চান যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় এজন্য আগাম ব্যবস্থা… সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু ঐ দুর্ঘটনা শব্দটা দেবব্রতর মাথার ঠিক পেছন দিকের যে চিন্তাশয় – সেখানে হাতুড়ির বাড়ি মারে। দুর্ঘটনা মানে কি? কিসের দুর্ঘটনা? কাদের দুর্ঘটনা? গ্রীল আর দুর্ঘটনা। গ্রীলের ঘন তারের খাঁচা আর দুর্ঘটনা… ওর মাথা বিনবিন করে ওঠে। ”কি হলো তোমার, অসুস্থ লাগছে নাকি?” অরুন্ধতি বলতে বলতে থেমে গিয়ে তীক্ষ্ম চোখে তাকায়। খুবই দূরপরিচিতা মহিলার মতো ফর্মাল শোনায় ওর কণ্ঠস্বর। দেবব্রতর মনে হয় ওর পাশে এই শহরে কেউ যেনো চেনাজানা নেই। সবাই খুব দূরের অনাত্মীয়। আর এই ঘটনার পর থেকেই তার ঘুম পাতলা হতে শুরু করে।

কিছুদিনের মধ্যেই মোড়ের সিগ্রেটওলা আর মুদির দোকানদারের কাছে ওর মুখটা পরিচিত হয়ে ওঠে। তারা সাপ্তাহিক বাজারের ফর্দ মিলিয়ে সওদার প্যাকেট বাঁধতে বাঁধতে চা আনায়। সে শুনেছে এরকম নাকি হয়। নতুন ভাড়াটেদের সাথে এভাবে খাতির জমিয়ে দুদিন পড়েই তার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা ধার চায় এরা। তারপর স্বমূর্তি ধারণ করে। দেব এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক হলেও চা তো আর ফিরিয়ে দেয়া চলে না। গম্ভীর হয়ে সে চুমুক দেয় কাপে। গলির মাথার যে পানের দোকান থেকে সিগারেট কেনে রোজ – সেদিন রাতে লোকটা তার দিকে বেশ মারফতি ঢঙে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে! পাঁচশো টাকার নোটের ভাঙতি সে আঁতিপাতি মিলিয়ে জোগার করে। আর তার ফাঁকে কথোপকথনের টুকরো টাকরা ভাসে-

– ভাইজান কি ঐ বেগুনি রংগের বাড়িতে উঠছেন?

– হ্যাঁ।

– এসপি সাবের বাড়ির পি্ছনে?

– তাতো বলতে পারবো না ভাই…

– হয় হয় ঠিকোই কইছি, যেই বাড়িতে কিছুদিন আগে একটা দুর্ঘটনা হইছিলো…বলেই লোকটা কাছিমের খোলে গলা ঢোকানোর মতো কথার বাকি অংশ গুটিয়ে ফেলে।

– কি দুর্ঘটনা? দেবব্রতর কল্জেটা দুম করে একটা লাফ মারে!

– না মাইনি, কই আরকি, বিল্ডিং উঠতাছে, কতো বিপদ আপদইতো মান্ষের হয়…

লোকটা যে চেপে যাচ্ছে তা বোঝা যায় বেশ। এর পেট থেকে এখন আর কিছু বের করা যাবে না মনে হচ্ছে। দেব বাসায় ফিরেও গুম হয়ে থাকে। শিকেয় ওঠে অরুন্ধতির সাথে নিষিদ্ধ দুষ্টুমির ইচ্ছেগুলি। শুক্রবারের সকালবেলা যখন আমেজ মাখা, দুধের সরের মতোন ঘুম জমে চোখের পাতায় – যাবতীয় ফেরিওলা আর সব্জি বিক্রেতারা যেনো কাকভোরে তরকারি বেচতে এসে নিজেদের ঘুম হারামের আক্রোশ মেটায় চিৎকারে পাল্লা দিয়ে। এই মাছ, এই মাছ ডাকতে ডাকতে একজন চলে গেলো তো আর একজন পেপে পুঁইশাক লেমু থানকুনিপাতা জানান দিতে দিতে এগিয়ে আসে। তার ফাঁকে খুচরো মিউজিক হিসেবে বাজে তালা সাড়ানোর ঝনৎকার আর আল্লাহুমা সাল্লে­য়ালা… আচ্ছা এতো ভোরে চোর ছাড়া ভালো কোনো মানুষের প্রয়োজন হয় তালার চাবি কাটানোর? শব্জিওয়ালা ইতোমধ্যে বাঁক নিয়েছে। হয়তো অন্য কাউকে ফ্লোর দিচ্ছে আর অরুন্ধতির আলুথালু শাড়ির আঁচলের নিচে নিজের কব্জি পর্যন্ত চালান করে দিয়ে জলভরা বেলুনের মতো তুলতুলে জিনিস দুটোতে আলতো করে পরশ নিতে থাকার রসভঙ্গ করতে ডেকে ওঠে কয়েকটি কাক। আর অরুন্ধতি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে – হেই ডাকোতো ।

– কি হলো ? ঘুমজড়ানো চোখের অভিনয়ে পূর্ণ সজাগ দেবব্রতর অনুযোগ।

– পুঁইশাক পুঁইশাক। ইশ্ কদ্দিন খাই না। গুঁড়ো মাছ দিয়ে চচ্চরি, ধুশ ওঠোতো। সে হাতের ধাক্কায় তাড়া লাগায় স্বামীকে।

– কতো করে কেজি? উত্তর না দিয়ে ছোকড়া চেঁচায়- ছার হাজিডা এট্টু ধরেন…

– আরে তোর শাকের দাম আগে বলবিতো-

– ওস্তাদী ঢংয়ে ছেলেটা বলে, দাম লাগতোনা। আহ্মে দিয়েন আগের সাবেরা যেই রহম দিতো।

– আগের সাব মানে?

– ওই যে আছিলো, পরে চইলা গেলো দুঃখ পাইয়া।

– অরুন্ধতিও এসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় বলে দুঃখটা আর শোনা হয় না। তবে দিনের প্রথম ধরানো সিগারেট টানতে টানতে তাকে কড়া নজর রাখতে হয় সব্জির মাপের দিকে। টাকা গুনে ভাংতি দিতে দিতে ছোকড়া বলে-

– আগের সাবে খুব ভালা আল্হে। কোনোদিন মাপ-উপ্ দেহেনাই। ভাবীসাবরে আমি ডেলি সব্জি দিয়া যাইতাম। দুর্ঘটনা ঘইট্টা গিয়া সব বরবাদ হইয়া গেলো!

– কি হয়েছিলো? দেবব্রত নিজেই চমকে যায় নিজের গলার স্বরে। কী এক নির্ঘুম নেশার ঘোর তার রাতপার করা সকালের মুখমণ্ডলে। ছোকড়া একটু ভয় পেয়েই তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে। 

সারাদিন এরপর আর কোনো কিছুতেই মন বসে না। কি হয়েছিলো এ বাড়িতে? এ ফ্লাটে আগে এমন কিছু ঘটেছিলো, যা সবার মনে দাগ কেটে আছে। কি সেই দুর্ঘটনা ? কোনো খুন কিংবা আত্মহত্যা? এখনো অন্যান্য ফ্লাটের ভাড়াটেদের সাথে ওদের আলাপ পরিচয় হয়নি। কিন্তু আলাপ হলেই যে তারা তাকে সব বলবে এমন আশা করা উচিত নয়। বাড়িওলার মনে হলো সব ভাড়াটেদের প্রতিই দারুণ আস্থা। সকলেই নাকি বহু বছর ধরে আছে। অতএব তারাও বাড়িওলার অনুগত হবেন – এটাই ভেবে নেয়া যায়। তাহলে কিভাবে এই রহস্য ভেদ করা যাবে? ভাবতে ভাবতে দেবব্রত খুবই অসহায় বোধ করে। অরুকে এসব বললে – যা ভিতু মেয়ে, নির্ঘাৎ বাড়ি ছেড়ে পালাবে। এখন এই সবেমাত্র একটি বাসায় উঠেই আবার চেঞ্জ করা আর এক ঝক্কি। এক কথায় অসম্ভবই বলা চলে। এতো সাবধানতার পরও এই বাড়িতে মালপত্র উঠতে গিয়ে ওর সাধের পাইরেক্স মগের একটা ভেঙেছে। সুটকেসের চাবি নতুন করে কাটাতে হয়েছে। বাসা বদলের ঝক্কি অনেক। একা মানুষ কতোইবা পারে সে? দেবব্রত ভাবতে ভাবতে অসহায় বোধ করে। বাসা নেয়ার থ্রিল আর আনন্দ সেই বোধের ভেতরে মিইয়ে যায় একেবারে।

এরপর তার ভেতরে কাজ করে বিদঘুটে সব চিন্তা। কিছু যদি ঘটেই থাকে তবে নিশ্চয়ই তার ছাপ পাওয়া যাবে। কোনো ক্লু কি নেই বাসার ভেতরে? কী সেই ক্লু? মুহূর্তে তার মাথায় কলেজ লাইফ পর্যন্ত পড়া ফেলুদা থেকে মাসুদ রানারা একে একে বাসার প্রতিটি ইঞ্চিতে নজর বোলায়। বাথরুমে স্নান করতে করতে সে আয়নার ডানদিকে একটি স্খলিতবসনা নায়িকার ছোট্ট ছবি দেখতে পায়। সম্ভবত কোনো ম্যাগাজিন কেটে লাগানো হয়েছে। কে লাগিয়েছে এটা? অরুকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ওর আবার এসব খুবই পছন্দ। কোনো ভালো রান্নার রেসিপি, কোনো সেলাইয়ের ডিজাইন কিংবা কোনো নায়িকা বা মডেলের সুন্দর সাজপোষাকের ছবি পেলে সে ম্যাগাজিনের ভবিষ্যত তোয়াক্কা না করে ধ্যাড়ধ্যাড় করে কেটে ফেলে। এসব জমিয়ে কি আনন্দ পায় কে জানে? হয়তো তারই কোনো নিদর্শন ওই টু পিস বিকিনি পরিহিতা। ফেটে পড়া স্তনের লোভাতুর আহবান ছড়িয়ে সে লজ্জানত সৈকতে এলোমেলো হয়ে আছে। কিন্তু তবুও দেবব্রত ভেতর থেকে কোনো সাড়া পায় না। কি হতে পারে ঘটনাটা? কি ঘটেছিলো এই বাসায়? খুন বা ধর্ষণ কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে কেউ আত্মহত্যা করেছিলো? স্ত্রীকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলেছিলো? কিংবা আচমকা দরজা ভেঙে ঢুকে কেউ পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলিতে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলো লোকটিকে? কতো কিছুইতো ঘটা সম্ভব। সে অনুমান করতে পারে ওদেরই মতো এক কাপল থাকতো এই ফ্ল্যাটে। পার্থক্য শুধু তাদের দুজনই ছিলো চাকুরিজীবী। তাদের কি ওদের মতো প্রথম সংসার ছিলো এখানে? হ্যাঁ ছিলো। প্রমাণ? প্রমাণ সারা দেয়ালের এখানে ওখানে অসংখ্য পেরেক পোঁতা আর ড্রিল মেশিনের কারুকাজ। নতুন সংসারি যারা, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই দেয়াল ফুটো করতে শুরু করে। অবশ্য অনেকের আবার এটা হ্যাবিটও। দেবব্রত এটা খুব অপছন্দ করে। তাছাড়া নতুন করে পেরেক গাঁথার কোনো প্রয়োজন এখনো তাদের হয়নি।

গোছানো জিনিস আবার গোছানোর বাতিক আছে অরুর। ছুটির দিন পেয়ে দেবও সেদিন হাত লাগিয়েছে তার সাথে। মালপত্রের বোঝা সব একাকার হয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। তার মধ্যে কাঁচের জিনিস গুরুত্বপূর্ণ আসবাব বা নতুন বার্নিশ করা ফার্নিচারে যেনো কোনো দাগ না পড়ে সে জন্য সতর্কভাবে কাজ করছিলো তারা। তাদের নিজেদের বাসা নিজেদের সংসার ইত্যাকার আনন্দে দেবব্রত তখন ডিম পাড়া মোরগের মতো ফুলছিলো! তার পাশে ছেনাল মুরগীর মতো অরুন্ধতিও বাক বাকুম করে এমন চুড়িহাট্টা জাগিয়ে তুলেছিলো যে স্থানকালপাত্র ভুলে দেবব্রত কী করলো অরুন্ধতিকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে সাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দুজনে ভিজতে লাগলো। তার কতোদিনের ইচ্ছা একত্রে বৃষ্টিতে ভিজবে! আজ, আজি সেই শুভক্ষণে আষাঢ় গগনে… মসৃণ শরীরের এখানে ওখানে বেয়াড়া আঙুলের না-বাড়ন তাদের আরও তপ্ত করে ফেলে। এ অবস্থায় ভাবনাটা এখন কেবল একটি আকাঙ্খায় এসে ঠেকে। অরুন্ধতি ফিসফিস ভাঙা কন্ঠস্বর ক্রমাগত কঁকানিতে রূপ নিলে দেবব্রতর কানে আর এক রিরংসা জন্ম লাভ করে। পরক্ষণেই বোঝে এ চিৎকারের অন্য মানে আছে। চট করে সে সামনের আয়নায় নিজের মাথার পেছনে – যেদিকে তাকিয়ে অরুন্ধতি গোঙাচ্ছে – সেদিকে লক্ষ করে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একটা বিজাতিয় আরশোলার মতো বড় পোকা কোত্থেকে এসে তাদের দিকে নির্লজ্জের মতো সবকিছু দেখছে। সে দেখায় না আছে কোনো লজ্জা, না আছে ভদ্রতার কোনো অনুশোচনা। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো পোকাটি ওদের ক্রিয়াকাণ্ড দেখে দেখে যেনো বিকৃত সুখ চেটে নিচ্ছিলো। জরাগ্রস্থ যযাতির মতো তার মাথার ওপর সার্চলাইটের মতো চোখদুটিতে এক ধরনের অক্ষমতার আগুন ঠিকড়ে বেরুচ্ছে। অরুন্ধতিকে চট করে কাছে টেনে নিয়ে দেব ফিরে তাকায় পোকাটার মুখোমুখি। আকারে প্রায় তেলাপোকার দ্বিগুন। মেটে-সবুজ রঙের পাখার কারণে মনে হয় যেনো কোনো গর্ত থেকে শীতনিদ্রা শেষে উঠে এসেছে সে। অরুন্ধতি নিজেকে সামলে নিতে নিতে বাথরুম থেকে বেরোয়। দেবব্রত ইতোমধ্যে একটা ঝাড়ু দিয়ে পোকাটার সর্বনাশ করে ছাড়ছে। থেতলানো মৃতদেহটা প্যানের মধ্যে উগড়ে দিয়ে সে বীরদর্পে বেড়িয়ে আসে। এসে দেখে অরুন্ধতী বেসিনে উপুর হয়ে বমিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে যা খেয়েছে সব। সে ক্রমাগত হাঁফাতে থাকে। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। কে এলো? কে আসতে পারে এখানে? কেউতো তাদের এই নতুন ঠিকানা জানেনা এখনো। প্রথমে কী হোলে চোখ রেখে দেব দেখে একটা অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে। 

– স্লামালেকুম। আম্মা আপনাদের আজ দুুপুরে আমাদের বাসায় দাওয়াত দিয়েছেন। 

– কি কারণ? 

– কিছু না এমনি। 

– না না এসবের দরকার কী… 

কিন্তু মেয়েটি সেসব শোনার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। ফিরে এসে দেখে অরু এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বার বার জিজ্ঞেস করছে কে এসেছিলো। তারপর ধাতস্থ হয়ে দেবব্রতর দিকে চোখ রেখে বলে পোকাটা কী নির্লজ্জের মতো দেখছিলো আমাদের। ওটা কোনো অশরীরী আত্মা নয়তো? রুমে এখনো ফ্যান লাগানো হয়নি। অবশ্য তাড়া নেই। জাঁকিয়ে শীত পড়বে কদিন পরেই। টিউবও লাগাতে হবে। ইত্যাকার অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। বাড়িওলা প্রতিদিনকার কোটনা কুটা সব নিয়ে যাবার লোকটাকে ঠিক করে দিয়েছে। দেব অফিসে গেলে সেদিনের পর থেকে অরুন্ধতি ভেতর থেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে থাকে। গতকাল বিকেলে ডিশের লোক ডিশের লোক বলে অনেকক্ষণ চিল্লি­য়ে গেছে গুন্ডামতো এক লোক। অরু ভয়ে দরজা খোলেনি। দেব আসার পর অনেক সময় নিয়ে সে গল্পটা বলেছে। বাড়িওলাকে যে লোকটা দুধ দেয় সে এসেও নাকি জিজ্ঞেস করেছিলো দুধরোজ করবে কিনা। এদিকে বলা নেই কওয়া নেই গতকাল ভোরবেলা দেখা যায় দরজার নিচ থেকে একটা পেপার উঁকি দিচ্ছে। আরে, সবকিছু এতো অটোম্যাটিক হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? অরু যেহেতু একা থাকে তাই বাইরের কোনো লোকের সাথে এখনই কোনো ধরনের লেনদেন না করাই মঙ্গল। এটা অবশ্য দেবব্রতর অতি সতর্কতা কিংবা স্ত্রী শাসন। কিন্তু সত্যিকারার্থে নতুন যায়গায় এখনই খুব বেশি লোকের আনাগোনা সে ভয় পায়। কিছুদিন গেলে তারপর এসব নিয়ে ভাবা যাবে। অরু সেদিনের তেলাপোকা দেখার পর থেকে বেশ সিঁটিয়ে আছে। তার উপরে সেদিন হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করেছে দেয়ালের কোথায় নাকি গোটা অক্ষরে পেন্সিল দিয়ে কে লিখে রেখেছে ‘শোধ নেবো’। কে লিখতে পারে এই কথা দেয়ালে ? দেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। বাড়িউলি- যখন সে থাকে না- তখন মাঝে মাঝে এসে ওর সাথে গল্প করে যায়। মহিলা আসলে তার বাড়িটা ওরা কিভাবে ব্যবহার করছে সে ব্যাপারে স্পাইগিরি করতে আসেন। তাকে মুখ ফুটে ভয়ের কথা বলতে অরুর সংকোচ লাগে। অবশ্য তার সাথে আলাপচারিতায় বোঝা গেছে আগের ভাড়াটেদের প্রতি তাদের মিশ্র অনুভূতি রয়েছে। সে সম্পর্কে খুলে কিছুই তিনি বলেন না। আবার মাঝে মাঝেই ওদের সাথে পূর্বতন দম্পতির তুলনা করতে গিয়ে কেমন যেনো চুপসে যান। সব মিলিয়ে বিষয়টি এমন এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করে দেব আর অরুর মনে যে নতুন বাসায় সুখের মাঝেও বিষের কাঁটা খচ্খচ্ করে। সবচেয়ে যন্ত্রণা হয় অফিসে। একা একা অরুন্ধতির কোনো বিপদ হয় কিনা- এটা ভেবে কিছুতেই সে কাজে মন লাগাতে পারে না। মাঝে মাঝে নিজেকে সে অটো-সাজেশন দেয়: এসব শ্রেফ নতুন বিবাহিত দম্পতির প্রথম সংসার পাতার ফালতু টেনশন ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর আশংকার ছোটো ছোটো কিউ তাদের অনাস্থা বাড়িয়ে তোলে। এমনি করে একটি মাস নিরানন্দ আর দ্বন্দ্বের দোলাচালে কেটে যাওয়ার আগেই তাদের কাছে অনর্থক অপয়া হয়ে পড়ে বাসাটি। নির্ধারিত তারিখের আগেই ভাড়া দিতে বাড়িওলার ফ্ল্যাটে নক করে দেবব্রত।

– আরে এসো এসো, কেমন চলছে তোমাদের নতুন সংসার? ইত্যাদি আন্তরিক সংলাপ দেবব্রতর ভেতর কোনো আনন্দকে উসকে দিতে পারে না। সে ধপ করে সোফায় বসে প্রথমে কোনো ভূমিকা ছাড়াই ভাড়ার টাকাটা নিঃশব্দে এগিয়ে দেয়। প্রবীণ ব্যক্তিটি ওর দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক তাকান।

– কোনো সমস্যা?

– জ্বি

– কি হয়েছে ?

– আমাদের আগে এ বাসায় যারা থাকতো তাদের কী হয়েছিলো?

ভদ্রলোক তাকিয়েই থাকেন দেবব্রতর দিকে। তারপর একটা চোরা দীর্ঘশ্বাসকে গোপন না করেই পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়েন- 

– তুমি কি ভাগ্য বিশ্বাস করো?

– না, কোনো?

– তাহলে যা-ই ঘটে থাকুক, এজন্য তোমাদের আপসেট হওয়া ঠিক নয়।

– আমি জানতে চাচ্ছি, এ্যাকচুয়াল ইন্সিডেন্টটা কী ঘটেছিলো?

বাড়িওলা হাসেন। বহু বেদনায় দীর্ণ সে হাসি। ভাড়াটে হারানোর চেয়ে বেশি কিছু অর্থময়। এই সময়টুকুর মধ্যেই দেব ঘামতে থাকে। কী শুনতে হবে তাকে? কী ঘটেছিলো? লোকটা যেনো প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিংবা গুছিয়ে নিচ্ছে – ঠিক কতটুকু বলবে, বলা উচিত হবে- এইসব। দেবব্রতর ইচ্ছা করছে লোকটাকে চেপে ধরে খুনে গলায় চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করতে – কী ঘটেছিলো? তার চোখ সরু আর শ্বাস প্রশ্বাস চরম কিছুর জন্য নিষ্পলক হয়ে আছে। বাড়িওলা নিস্তব্ধতা ভাঙ্গেন-

– আমার এই বাসাতেই ওদের বাসর হয়েছিলো। ইউনিভার্সিটিতে পড়তো দুজন। ছেলেটা বিসিএস পাশ করে দুজন বিয়ে করে। কাজী অফিস থেকেই বাসা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। মেয়েটাও জবে ঢুকেছিলো মাস তিনেক পর একটা মার্কেট রিসার্চ কোম্পানিতে কিন্তু…

ক্কি হয়েছিলো? দেব এতো জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে যে, ভেতরঘর থেকে বাড়িওলার পর্দানশীন স্ত্রী পর্যন্ত পর্দা সরিয়ে তাকায়।

– কি হবে বলো?

– কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিলো?

– হ্যাঁ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করেন ভদ্রলোক। এরপর দেবব্রতর মুখে আর প্রশ্ন আসতে চায় না। তাহলে তারা যা সন্দেহ করেছিলো তাই-ই? একটা অপয়া বাড়িতে অরুন্ধতিকে নিয়ে উঠেছে সে! উহ ! এতোদিনে তাদেরও ভাগ্যে কিছু একটা ঘটে যেতে পারতো, উহ্ ভগবান! ঠেকায় পড়ে ভেতর থেকে ঈশ্বরকে মনে পড়লো তার। বাড়িওলা কাশলেন- 

– বছর না ঘুরতেই বাড়ি ছেড়ে দিলো ওরা।

– কারা? আপনি না বললেন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো? তারা কি বেঁচে ছিলো তারপরও?

বাঁচবে না কেনো? দুজনই ভিন্ন ভিন্ন বাসায় গিয়ে উঠেছে শেষে…

মানে? আক্রমণের শেষ চুঁড়োয় যেনো এক বলে একরান নিতে হবে এমন মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করলো দেব। বাড়িওলা নিস্তেজ ম্লান কণ্ঠে বললেন-

– ওরা ডিভোর্স নিয়েছিলো। সেপারেশন হয়ে গিয়েছিলো ওদের !

 

 

রচনাকাল: ৮ নভেম্বর ২০০২

আলোহা

নাহ ! ঠিক এভাবে যে নয়নার সাথে সম্পর্কটার স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এমনটা ভাবেনি উদিতাংশু। সাত বছর পরে এসে তারা যে সমাধানটার কথা ভাবলো, সেটা আগে কেনো ভাবেনি- তাই ভেবে তার নিজেরই একরকম জিদ চেপে গিয়েছিলো। অনেকটা জোর করেই তাই নায়নাকে নিয়ে জমপুর আসা। এমন বিস্তীর্ণ গ্রামে নয়নাকে নিয়ে এই অবস্থায় আসার কোনো মানেই হয়না। তাকে নিয়ে বরং সরকারী কোনো হিসেব সংরক্ষণাগারে হানিমুনে যাওয়া উচিত। যেখানে না থাকবে কোকিল না থাকবে একটা ধানগাছের ছায়া। এই ছায়াঢাকা-পাখীডাকা গ্রাম তার জন্য এখন বিষ। বিষ! উদিতাংশু তাই এক ধরনের বেকুবই ভাবে নিজেকে। তবু, গ্রামের গল্প তার ভেতরে দীর্ঘদিন দানা বেঁধে মিছরি জমে আছে- তাকে না দেখে থাকার কষ্টের চেয়ে এখন দিনরাত্তির নয়নার ঘ্যানঘ্যানানি শোনাও তেমন লোকসানের নয়। হাজার হোক, মেয়েতো একটা! রক্তমাংসের সেক্সডলওতো কতো মানুষ কামনা করে… না,না, উদিতাংশু নিজেকে শাসায়- কেবল খারাপ দিকগুলো ভাবলে চলবে না। নয়নার কিছু ভালো দিকওতো আছে, না-কি?

তবু কেনো যে মেজাজের মুূহূর্তে সেসব মনে আসে না তার? আর নয়নাও তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই একদম সপ্তমে চড়ে বসে। কখনো কখনো চিল চিৎকার আর দাঁত-নখ একত্রে চালায় সে। সাত বছরের বিবাহিত জীবনটা তখন তাকে কলা দেখায়। নাহ্! এভাবে হবে না। হবে না। ভাবতে ভাবতে উদিতাংশু আরও মুষড়ে পড়ে ভেতরে ভেতরে। তার গান কম্পোজ মাথায় ওঠে। এই বাজারে একবার প্রতিষ্ঠার দরজায় পিঠটান দিয়ে কবে আর কে তা ফিরে পেয়েছে ? এ জন্যই তার গান লেখার প্রতি আগ্রহটা চরম ও মরীয়া। গানের নেশা তাকে এক ধরনের ভাবালুতার মধ্যে নিয়ে যায়। তার কেবল ফিরে পেতে ইচ্ছে করে ইউনিভার্সিটির হলের সামনের চত্তরে রাত জেগে বন্ধুদের মাঝে গান গাওয়ার হল্লা। কতো দূর থেকে বন্ধুরা আসতো তার গান শুনতে। নিজের লেখা সুর করা একটার পর একটা চালিয়ে যেতো উদিতাংশু। ওরা তাকে উৎসাহও দিতো প্রচুর। বেশ কিছু স্টেজ প্রোগ্রামও করেছিলো সে। তেমনই এক শো শেষে নয়নার সাথে তার প্রথম পরিচয়! শীতের সন্ধ্যা ছিলো তখন। গাঢ় নীল জিনস্, হলুদ ফিতের স্যান্ডাল আর গ্রেটকোটের মতো ঢোলা কালো সোয়েটারের ভেতর উৎফুল্ল স্তনের অধিকারীণী- চোখে ঝিলিক দিয়ে তার দিকে প্রশ্নাত্বক আকাঙ্খা ছুঁড়ে বলেছিলো- আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন ?….

এদিকের রাস্তা ঘাট এখনো আটশট্টি হাজার গ্রামের মতোই। রিকসায় আসতে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে একত্র হবার দশা। তবু তাদের ভালো লাগছিলো। তার ভালো লাগছিলো। নায়না সূর্যের তেরছা রোদ্দুরের কেরামতি সহ্য না করতে পেরে হ্যান্ডব্যাগটা দিয়ে মাথা ঘাড় ঢেকে- চারপাশের এই এত্তো এত্তো সবুজ-সুষমা না দেখে শুনেই তৃপ্ত ছিলো। যেনো এতে তার কিছুই যায় আসে না। কেবল নলিয়া বাজার আসার পর বলছিলো -জল খাবো। সেই জল জোগাড় করতে গিয়েই তারা প্রথমে শুনলো ’সিন্নি গাছের’ কথা। ডাবওয়ালা নিখুঁত কোপে ডাবটাকে ফালি করতে গিয়ে বলছিলো

-লেওয়া স্যার সিন্নি গাছের ফলের মতোন মিষ্টি!

-কিসের মতো ?

-সিন্নি ফলের মতো। ঐ তো কোপ্তাডাঙ্গায় দেহেন গিয়া…

– কোথায় সেটা ?

– কেন্ আফনেরা জানেন না ? ঢাহা দিয়া আইছেন ?

– হ্যাঁ, কি সেখানে ?

– তাজ্জব এক গাছ আছে এই গ্রামের ঠোডায়। খেজুরের মতোন ফল দেয়, খাইতে দুধের তিন্নাও মিডা লাগে।

উদিতাংশুর মনে হয়েছিলো- এই সেই গাছ, এই সেই গাছ যার কথা সে বিভিন্ন সময় শুনেছে, পড়েছে। পারসীরা তাদের অগ্নীপূজার প্রারম্ভে যে রিকিতের উপাসনা করতো –এটি বুঝি তাদেরই মতোন কোনো দেবাংশী! কিন্তু তার ভাবনাটা- নায়না রোদ্দুরটাকে একটা বিচ্ছিরি গাল দিয়ে রিকসার দিকে এগিয়ে যেতে- আর বাড়তে পারলো না। আশ্চর্য! এমন মোলায়েম পরিবেশের মাঝেও মেজাজ খারাপ করতে পারে কেউ ?

জমপুর রেস্টহাউসটা আহামরি হবে না এ কথা তারা আগেই অনুমান করেছিলো। নামই যার যমপুর… এখানের নামগুলি যেনো কেমন- নলিয়া, কোপ্তাডাঙা, বরিষা, মোস্তফার চর, গুনটিয়া একটার সাথে অন্যটার মিল নেই। নামেরও নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। যেমন জমপুর বা যমপুর যেটাই হোক- তার কোনো ইতিহাস না থেকেই যায় না। ছোট্ট জনপদটির দোকানের সাইনবোর্ডগুলোতে দু ধরনের বানানই সে দেখছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হিন্দু দোকানগুলো লিখেছে ’য’ দিয়ে আর মুসলিম দোকানগুলোয় ’জ’ দিয়ে। যেমন, যমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, নিউ যমপুর লেডিস টেইলার্স, শ্রী মা হেয়ার ড্রেসার এন্ড সেলুন, নীচে ’যমপুর’ লেখা হয়েছে। আর তার ঠিক পাশাপাশি জমপুর ইসলামিয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। হয়তো ’জমজম’ শব্দটির সাথে স্থানের একটি সম্পর্কসূত্র দাঁড় করানোই এর লক্ষ্য। কিন্তু ব্যাপার যা-ই হোক না কেনো, বর্ডার এলাকা দিয়ে এখানে ইদানিং ব্যাপকহারে ফেন্সিডিল আসছে- এটাই এ অঞ্চলের এখন প্রধান অলোচনা। দ্বিতীয় বিষয়টা আর্সেনিক। কেউ কেউ বলছে ফেন্সির বোতলে ভারত থেকে নাকি আর্সেনিক পাচার করছে আবার কেউবা বলছে আর্সেনিক রোগটা বাড়ে ফেন্সিডিল খাবার কারণে। কিন্তু ভজনবালার আশি বছর বয়ষ্ক মোতাহারের মায়ের যখন বিনা কারণে হাত পায়ের তালু ফেটে যেতে লাগলো, তখন এলাকাবাসী আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। তাজ্জব ব্যাপার। প্রথমে জানা ছিলো উঠতি ছ্যামড়ারাই এসব খেয়ে ঝিম মেরে পড়ে থাকে আর দুধ চিনি কড়া চা খেতে শ্যামলের দোকানে ভীড় জমায়। অথচ এখন ?

রাতের বেলা খাবার শেষে আগ্রহটা নায়নাই দেখায় বেশি। উদিতাংশু তখন ভাবছিলো একটা নতুন কম্পোজিশন। আকাশ ভেঙে অত্যুজ্জ্বল আলোকরাশি পৃথিবী ভরিয়ে দেবে- এই মনোভাবাপন্ন একটি গান তার লেখার ইচ্ছে বহুদিনের। এমন গান, যা মানুষকে না প্রেম, না বিপ্লবী, না তত্ত্ব, শুধু গভীর ও উৎফুল্ল আবেশে তরঙ্গায়িত করবে- তাকে জীবন ও জিজ্ঞাসার মুখোমুখি না করে, উত্তরের আকাঙ্খী করবে। এমন গান, এমন গান কি সে লিখতে পারবে না কখনো ? তরুণদের মাঝে সে মোটামুটি পরিচিত একজন গীতিকার। কিন্তু সেই গান কেবলই তাকে অতৃপ্তির মাঝে নিয়ে যায়। সেই অত্যুজ্জ্বল আলোকরাশি- যা সূর্যের চেয়েও মেধাবী, সে কি পারবে না কখনো লিখতে ? …নায়না তার ভাবালুতার মাঝে জট পাকায়।

-কী ভাবছো ?

-উম্ ?

-চলো শুতে চলো।

উদিতাংশু আবছা অন্ধকারেও নায়নার চোখে রতিতপ্ত মানুষীর ঝিলিমিলি দেখতে পায়। সাত বছরতো কম সময় নয়, এতোদিনে সে এই দেহজ ভালোবাসার সবসূত্র জেনে ফেলেছে। চলমান চিত্রের মতো বলে দিতে পারে সে এরপর আস্তে আস্তে নায়না কীভাবে এগুবে। তার প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি পর্ব তার চেনা। উদিতাংশু সেই একান্ত উৎসবে হোমের আয়োজনে নিজেকে ব্রতী করতে, নিজেকে প্রস্তুত করতে মনে মনে প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু নায়না তার ধার দিয়েও যায় না। আজ যেনো সে অন্য নারী। অচেনা। কি যেনো চিবোচ্ছে সে। সম্ভবত মৌরী। এই এক অভ্যাস। যেখানেই যাক, ব্যাগে তার মুখশুদ্ধি কিছু না কিছু থাকবেই। এলাচ দানা, আদাকুচি, গুয়াশুপারি, খোর্মাকুচি, নিদেনপক্ষে দারুচিনি এক টুকরো ওর খাবার পরে চাই-ই চাই। তাকে মানায়ও বেশ। এমনিতে সাজে না। কিন্তু যত্নহীন যত্নের আলগা শ্রী সবসময় ওর গায়ে লেপ্টে থাকে যেনো। মনে হয় এই মেয়েটাকে জয় করি, ভাঙি। তার ভেতরের আমিত্বটুকু পান করে নিঃশেষিত করে দেই। এরই নাম বোধহয় ঘোর। যে ঘোরের কারণে মাত্র সাত দিনের পরিচয়ে, আর একদিনের নিরাপদ নিভৃতির সুযোগে চার চারবার যৌন অংশগ্রহণের পর উদিতাংশু সাবসিডিয়ারী পরীক্ষা না দিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বিয়ে করার। কিন্তু আজ তাদের জীবনে সবটাই যেনো এক ভুল বাসে উঠে পড়ার মতো ভুল। সেটা আদৌ ভুল কিনা- এটুকু; শুধু এটুকু জানার জন্যই উদিতাংশু জমপুর নিয়ে এসেছে নায়নাকে। ‘চলো না কাল আমরা কোপ্তাবাড়ি যাই আজব গাছটা দেখতে!’ নায়নার কথায় চমক ভাঙে তার।

‘তুমি কি কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পেলে ?’ পরদিন দুপুরে ভেজা চুল রৌদ্রে মেলে নায়না প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তার দিকে। বারান্দার টালীর নীচে এ্যাকোস্টিক গিটার নিয়ে উদিতাংশু তখন একটা সুরের নোটেশন দেখছিলো। কোপ্তাবাড়ি থেকে ফেরার পথে আচমকাই একটা সাঁকো পেরুতে পেরুতে তার মনে গুনগুনিয়ে উঠেছিলো লাইনটা। কিন্তু সেটা এখন ঠিক ঠিক দোলা দিচ্ছে না। তৃতীয় তারটিতে এসে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছে সে। নায়নার প্রশ্নটা তাই তার কাছে গুরুত্বহীন মনে হয়। সে কোনো জবাবের চাহিদাও বোধ করে না। মাথা ঝুঁকিয়ে সুরটা খুঁজতে থাকে। নায়না বোধহয় ক্ষেপে যায় এতে। তার নিচু গলা ক্রমে দ্রুতলয়ে বেজে ওঠে। ‘ছোটলোক, আমাকে এই গণ্ডগাঁয়ে নিয়ে এসে হানিমুন শেখাচ্ছে। ছোটলোক, মিনমিনে শয়তান আবার তানসেন হতে চায়’ …উদিতাংশুর সুর কেটে যায়! এই নচ্ছার মেয়েলোকটিকে তার একহাত দেখে নিতে ইচ্ছে করে। গান নিয়ে তাকে কেউ কিছু বললে সে মোটেই সহ্য করতে পারে না। নায়না তা জানে। জেনেই সে বলেছে। অন্ধ রাগে সে টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারে। নায়না উহ্ মাগো বলে পার পাবার আগেই সে এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে এক চড় কষায়…! অথচ একটু আগেই আজ দুপুরে তারা কোপ্তাবাড়ি গিয়ে সেই গাছটা দেখে এসেছিলো। ওদের যিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- সে খুব রোমান্টিক স্টাইলে বর্ণনা করছিলো গাছটির জন্ম ইতিহাস। তাই বলে নায়না অনায়াসে ছেড়ে দেবে না স্বামীকে। মুখ দিয়ে নয়- এবার সে অন্য পন্থা ধরলো। অস্ত্র হিসেবে সেটিও বেশ মোক্ষম। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে জানালো, এমন হবে জানলে সে তাকে বিয়েই করতো না। এরকম তাদের মাঝে মাঝেই হয়। ভালোবাসাবাসির সময় যেমন মাত্রাছাড়া তেমনি ঝগড়ার সময়ও কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না ওদের। এমনও হয়েছে শরীরের টানে তারা সাপের মত শঙ্খলেগে পড়েছিলো সারারাত সারাদিন একটানা একে অপরকে আঁচড়ে-কামড়ে লালা আর লালসায় খুবলে খেয়েছে। আর শরীরের সুখ যখন বিস্বাদ হয়ে গেছে শরীরে- তখন তুচ্ছ কারণে মেতে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ঝগড়ায়। কেউ কাউকে ছাড় দেয়নি। ছাড় পেতেও চায়নি কেউ। ঝগড়া করে জিততে চেয়েছে। অপরের সামান্য ব্যর্থতাও আড়াল থাকেনি তাদের। ফলে দুজনই হেরে গেছে দুজনের কাছে। উভয়েই দেখেছে নিজেদের চরম পরাজয় অন্যের কাছে।

অন্তত আড়াইশো বছরের পুরোনো এই গাছ। কবে কে লাগিয়েছিলো তার কোনো হদিস জানা যায় না। জনশ্র“তি আছে এক কামেল পীরের আগমন ঘটেছিলো জলাভূমি অধিভূক্ত এই অঞ্চলে। তার হাতের আশার লাঠিটি তিনি অনুসারীদের সামনেই মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন, আর, সে থেকেই সিন্নি গাছের উৎপত্তি। কিন্তু পীরসাহেবকে পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তিনি কোনো মাজার- যা পীরদের স্বভাবজাত- স্থাপন করেন নি। হিন্দুরা মনে করে কোনো সাধুপুরুষ নিজেই গাছ হয়ে গিয়েছিলেন ধ্যান করতে করতে। নায়না এসব নোট নেয়। তার একটি সখ আছে, মাঝে মাঝে পত্রিকায় ফিচার লিখে পাঠানো। সে গাছটির ছবি তুলতে গেলে যে লোকটি ওদের গাইডের মতো সঙ্গ দিচ্ছিলো, সে হা হা করে পড়ে।

-ছবি তুইলেন না কোলোম।

-কেনো ?

-ওডবে না।

-এ্যাঁ ?

– ছবি ওডবে না। এর আগে একফির এক সাইবে চেষ্টা হরছেলে ছবি তোলোনের। তিনদিন বাদে রক্তবমি হইয়া মরছে।

একদম বাজে কথা। নায়না দমে যায়। এই জন্য নয় যে, তাদের কথা সে বিশ্বাস করেছে কিন্তু এখানে এর প্রতিবাদ করা ঠিক হবে না সেটা সে বুঝতে পারছে। উদিতাংশু ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আলতো ইশারায় সেও নিষেধ করে নায়নাকে। কী লাভ এদের বিশ্বাসে আঘাত করে। ওরা গাছটিকে দেখে। বেশ বড়সড় একটা বটগাছের আকার নিয়ে গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। চিরিচিরি পাতা খুব ঘন হয়ে আছে। সেই পাতার ফাঁকে ফাকে লালচে ও ঘিয়ে রঙের খেজুরাকৃতি ফল ফলে আছে। অসংখ্য। গাছের কাণ্ডে যারা ইট বেঁধে দিয়ে মানত পূর্ণ করতে এসেছে তারা সযত্নে ফলগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে। মোটা কাণ্ডের গায়ে সিঁদুরও লাগানো কোথাও কোথাও। সব ধর্মের লোকেরাই এটাকে মানে। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই দেখতে আসে। কিন্তু গাছটার মধ্যে ভক্তি করার মতো কোনো গাম্ভীর্য উদিতাংশু খুঁজে পেলো না। এমনকি রিকিতের মীথটিও এখন তার মনে পড়ছে না। সে তাকিয়ে দেখলো গাছের ডালের ফাঁকে বেশ কিছু বাদুর ঝুলে আছে। উদ্ভিদজগতের কোনো বিরল বৈশিষ্ট্যই হবে হয়তো গাছটা। বাদুড়গুলো লাল চোখে নীচের মানুষগুলো দেখছে। একটাও নড়ছে না একটুও। স্থির হয়ে আছে। নায়নার ডাকে সে ফিরে তাকালো। ওরা দেখতে দেখতে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলো। নায়না একটা ফল তার দিকে এগিয়ে দিলো। সে নিজেও চিবুচ্ছে একটা। উদিতাংশু বিরক্তি ও নিঃস্পৃহভাবে কাঁচা ফলটাতে কামড় দিলো। আরে অদ্ভুত তো ! ঘন দুধের মতো স্বাদ আর মিষ্টি। ও একটু ধান্দায় পড়ে গেলো। এতোটা সে ভাবেনি। মনে করেছিলো কইস্টা হবে। নাহ্ এটা সত্যিই বিরল বৃক্ষ ! এরপর নায়নার উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে। সে স্থানীয় লোকজনকে গাছটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে বিভিন্ন কথা। সারা বছরই নাকি গাছটার ফল ধরে। একদিকে ফল পাকে, তো অন্যদিকে নতুন কুঁড়ি ফুটে ওঠে। কিন্তু আশ্চর্য, এই বীজ লাগালে নতুন গাছ হয় না। উদিতাংশুর এসব কিছুই ভালো লাগছে না। তার ভেতরের একটা বোধ কেবলই কেটে কেটে যাচ্ছে। এই নিশ্চুপ গাঁয়ে এসেও যদি সে এতোটা অস্থিরতায় ভোগে তাহলে…। মনে মনে সে নায়নাকে এ প্রসঙ্গে দোষী করে। এই মেয়েটা তার সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে, তাকে স্থির হতে দিচ্ছে না। বিস্বাদ আর অস্বস্তি নিয়ে সে বিরবির করে। পরক্ষণে বুঝতে পারে অজানা কিছু শব্দ সে মনে মনে আওড়াচ্ছে। শব্দগুলো এরপর সঙ্গীতের রূপ নেয়। সে বুঝতে পারে কী যেনো একটা ভাঙাগড়া শুরু হয়ে গেছে ভেতরে

মনে করো এই রোদ তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাত
ছেড়ে যাবে- ঝিম ধরা স্বপ্ন খুঁজেছি একসাথে-
জীবন পাবেনা দেখাÑ মন তাকে বলে অকষ্মাৎ
চাঁদের ছায়ার নীচে চোরাবালি ইশারায় ডাকে!

আকুল হয়ে কাঁদে নায়না। তার পিঠ ফুলে ফুলে ওঠে। উদিতাংশু বিমূঢ় তাকিয়ে থাকে। বারান্দায় অন্ধকার- জোৎস্না ভেঙে ঘন হয়ে আছে। রাত হয়ে গেছে অনেকটা গাঁও-গ্রামে, এই প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের বিনোদন এখন শুধুই ঘুম। দিনের বেলায় যে কথাগুলো তাকে নাড়াচ্ছিলো প্রবলভাবে এখন মনে হয় যেনো ইচ্ছে করলেই তাকে সুর দিতে পারে সে। নায়নার কান্নার সুরের সাথে কোথায় যেনো একটা মিল আছে সেই সুরের। তার মাথার ভেতর কল্পনার সেই আলোকমালা ঝর্না হয়ে ঝরে! শহর ছেড়ে এই যে তারা এতোদূর চলে এসেছে, তার উদ্দেশ্যটি এখন ভিন্ন মাত্রায় মনে টোকা দিয়ে যায়। নায়নার এই কান্না শুধু তাদের- তার- ভিন্ন জীবন যাপনের সমঝোতা স্মারকের কারণেই নয়- মনে হয় যেনো আর কোনো গূঢ় অর্থ বহনকারী।

– তুমি আর চাওনা আমাকে? নায়না জলভরা চোখ- হয়তো লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে- অন্ধকারে ভাবে উদিতাংশু। তার দিকে মুখ ফিরিয়ে কমনীয় কণ্ঠস্বরে শান্ততায় জিজ্ঞেস করে।

– নাহ। এভাবে দুটো জীবন অযথা জোর করে জোড়া বেধে দুজনই কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে নেই আর।

– কাল ভোরে যাচ্ছি আমরা ? ততোধিক শান্ত স্বরে সিদ্ধান্ত শুনতে চায় নায়না।

– হ্যাঁ।

– আজ কি শোবে একসাথে ?

– হ্যাঁ, কেনো নয়?

কিন্তু শুতে গিয়ে সে টের পায় নায়না গভীর ঘুমে নিহত চড়ুইয়ের মতো মৃদু শ্বাস টানছে ঘুমের ভেতর। ’জীবন পাবেনা দেখা- মন তাকে বলে অকস্মাৎ!’ নায়না কী করে এতো নিঃস্পৃহ থাকে- আশ্চর্য- এতোসব কিছুর পরও? আজ কী তাদের শেষ দিন নয়? শেষ রাত নয় তাদের ? সারাদিন উদিতাংশু ভেবেছে সম্পর্কটির স্থায়ীত্ব নিয়ে। নয়নার মনের মতো হয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হবে না কখনো। নয়নাও সেই স্বপ্ন-কল্পনা থেকে বিচ্যুত হতে পারবে না, যা সে ছোটোবেলা থেকে মনে মনে ভেবে এসেছে হয়তো- ভাবে উদিতাংশু। এখন এই শরীর-মনে দূরের হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে হয়তো ম্যাজিক দেখিয়ে, কিংবা পুরুষের মোহময় আচ্ছন্নতা দিয়ে কিছুদিন বশ করে রাখা সম্ভব- কিন্তু তা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। নায়নার প্রতি যে চোরা আবেগ ও কর্তব্যবোধ ছিলো তার, সেটাকে জোর করে বিদায় করতে হবে হয়তো; কিন্তু তাও ভালো। প্রতিদিন এই অহেতুক ঝগড়া-যন্ত্রণার চেয়ে- মনকে প্রবোধ দেয় সে- দূরে চলে যাওয়া ভালো। ’চাঁদের ছায়ার নীচে চোরাবালি ইশারায় ডাকে’। ভাবতে ভাবতে উদিতাংশু ঘুমের চোরাবালিতে ডুবে যায়।

খুব করে সেজেছে আজ আলোহার মা। মানে নায়না। বিয়ের পর পর যখন রোমান্স তাদের শরীর-মনে রোমাঞ্চের বন্যা ডেকে আনছে। ভেবেছিলো মেয়ে হলো ’আলোহা’ ডাকবে তাকে। কেনো এই নাম ? খুব একটা ভাবেনি তা নিয়ে। কোথাও হয়তো শুনে থাকবে। পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। কখনো সখনো নায়নাকে দুষ্টুমী করে খেপানো যেতো ’আলোহার মা’ বলে। আজ সাত বছর পরে- যখন তারা ভিন্ন জীবন নিয়ে ভাবছে তখন- এই নামের কী-ইবা তাৎপর্য আছে এমন ? কেয়ারটেকার খুব যত্ন নিয়ে ওদের সবকিছু রেডি করে দেয়। নিজের হাতে ব্রেকফাস্টে গরম পরোটা ভেজে দিয়েছিলো ভোরে উঠে। রিকসায় যেতে হবে অনেকটা পথ। গতরাতে একজনকে আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। ভোরবেলা ঠিক ঠিক সে হাজির হয়েছে রিকসা নিয়ে। এখন রোদ চড়ার আগে আগেই বেরুতে পারলে বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই ফিরতে পারবে তারা। তারপর, কোথায় যাবে ওরা ? পুনরায় সেই একই ঠিকানায় ? একই বিছানায় ? অসম্ভব। তাহলে আর কষ্ট করে এতোদূরে আসা কেনো ? তাঁতের একটা পারমুটিট ডিজাইনের শাড়ি- শাড়ি খুব একটা পড়ে না নয়না- প্লিট করে পড়েছে সে। চুল ছেড়ে দেয়ায় সেই ইউনিভার্সিটি হল বলেই মনে হচ্ছে এখন। বয়স বাড়েনি নয়নার। কেবল চাকরি তাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে- এর বেশি কিছু নয়। ‘চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে’ বলে খুব সাধারণ ডাকে নয়না বারান্দায় নামে। কী যেনো বলতে গিয়েও বলা হয়না উদিতাংশুর। সেটা কি, নয়নাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে- শুধু এই উক্তিটুকু? সে মনে মনে গুনগুন করে- ‘মনে করো এই রোদ- তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাত।’ নাহ্ সুরটা ঠিক ঠিক এসে দোল দিচ্ছে না, ছাড়া ছাড়া মনে হচ্ছে। কোথায় যেনো কেটে যাচ্ছে খেই। কথার সাথে প্রবাহিত না হলে সুরের মুক্তি আসেনা বলে তার ধারণা।

নয়না উঠে গেছে রিকসায়। কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটা পরিপাটি হয়ে কোলের উপর রেখেছে। মনে হচ্ছে বাচ্চা কোলে নিয়েছে! গীটারটা নিয়ে বারান্দা ছেড়ে সামনের হেরিংবোন ছড়ানো ইটের উপরে নামলো। খবরটা আসে তখন। রেস্ট হাউসের দাড়োয়ান জানালো ওদের। প্রথমে নয়নাকে। উদিতাংশু শোনে- সিন্নি গাছের নাকি একটা চারা পাওয়া গেছে আধমাইল দূরের এক গ্রামে। গ্রামবাসীরা অবাক বিস্ময়ের ভেতরে হু হু করে ছুটছে সেদিকে। এ একরকম অকল্পনীয় ব্যাপার। কেউ ভাবেনি বুড়োকালে গাছটার এমন ভীমরতি ধরবে। নয়না শোনে, নিঃস্পৃহভাবে। উদিতাংশু নাক গলায় ওদের কথায়- ‘যাবে নাকি দেখতে ? গেলে হয় একবার- আর কী আসা হবে এখানে এভাবে ?’ নয়না সায় দেয়না। ফিরতে চায় এখান থেকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব; পৃথক হয়ে চায় সে। উদিতাংশু অগত্যা রিকসায় উঠে বসে। রিকসা বড় রাস্তায় উঠে এলে দেখা যায়- লোকজন অস্থিরভাবে লাইন ধরে ছুটছে রোদের উচ্ছাসের ভেতর। ‘মনে করো এই রোদ…’ উদিতাংশু গুনগুন করে। ‘কেমন হবে কম্পোজিশনটা বলো দেখি ?’ অনেকদিন পর এই প্রথম সে নায়নার মতামত নেয় সঙ্গীত বিষয়ে। একদিন সে তো তার গানের পাগল ছিলো। নায়না ফিক করে হাসে।

– নতুন লিখলে ?

– হ্যাঁ।

– সুন্দর হয়েছে। খুব।

তারপর আর কিছু নয়। চুপচাপ কেবল নারকোল পাতার ঝিরঝির শব্দ শোনা। অনেকক্ষণ। যেনো সাত বছর কেটে গেলো এরই মধ্যে। সাত বছর ?

– কী অদ্ভুত তাই না ? …এতো বছর পর গাছটা… উদিতাংশু ছাড়া ছাড়া ভাবে বলে।

– নাহ্ , এটাতো অস্বাভাবিক নয়। হতেই পারে।

– হতেই পারে ?

– কেনো নয় ?

– ও। বলে উদিতাংশু ঠোঁট কামড়ায়। -তাই বুঝি দেখতে যেতে চাইলে না ?

– সে জন্য নয়। কী হবে শুধু একটা চারাগাছ দেখে ?

– তা অবশ্য। তবুও ভাবো। -এতোবছর পর…

– আর তাছাড়া… নায়নার কথা শেষ হয়নি। কথায় বাধা পড়ে উদিতাংশুরও। সে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে-

– তাছাড়া কী ?

– ওকে নিয়ে আমি যেতে চাইনা অতদূর।

– ক্কী ?

– ওর কথা বলছি। আলোহা! এসে গেছে ! বলে কোলের ব্যাগটা সামলে অবিচল আস্থা নিয়ে সামনের সবুজের দিকে তাকিয়ে বলে নয়না। তারপর যোগ করে হতচকিত উদিতাংশুর দিকে না তাকিয়েই:

– আমরা কিন্তু আর একসাথে থাকছি না। গতরাতে সিদ্ধান্তের কথা মনে আছে তো তোমার ?

উদিতাংশু ঝিম ধরা মাথার মধ্যে সেই নোটেশনটা এবার স্পষ্ট টের পায়। সুরটা ঠিক ঠিক মিলছে এবার! দ্রুতলয়ে বাজছে ক্রমাগত- ‘মনে করো এই রোদ- মনে করো…!’

রচনাকাল: ২৭/০৩/২০০৪

সোমপ্রকাশ বাড়িতে নেই

জনশ্রুতি আছে, রাজা মন্ত্রহারীর আমলে জলদস্যুতা কিছুটা লোপ পেয়েছিল। তিনি ছিলেন রায়মঙ্গল নদীর মতোই বদমেজাজী। বন্দী ডাকাতদের চোখ ধারালো কিরিচ দিয়ে শ্রেফ গেঁথে নিয়ে উপড়ে ফেলা হতো রাজার সম্মুখে। সেই উৎপাটিত চোখ তার সখের চিতা-শাবক দিয়ে তিনি ভক্ষণ করাতেন !

 

নিকষ অন্ধকার ভেঙে যখন কেবল ভোরের অপার্থিব ম্লানিমা চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে- সোমপ্রকাশের একচোখ তখন জেগে উঠলো। যেহেতু তার চোখ একটিই এবং ঐ চোখ তাকে ভালোমন্দ সকাল সন্ধ্যা ইত্যাদি বুঝতে কেবল সাহায্য করে মাত্র। সোম অন্তত এর বাইরে চোখটাকে অন্য কোন কাজেই লাগায় না। বাকী চোখটা না থেকেও আছে। অক্ষিগোলকের মাধুরীমা নিয়ে, পল্লবের চকিত পলক নিয়ে মধ্যবিত্তের স্বপ্নের মতো, না থেকেও বেঁচে আছে। কেবল কর্ণিয়া; যা দৃষ্টিক্ষমতার জন্য অতি দরকারী-বলে থাকেন বিশেষজ্ঞগণ- তাতে একপ্রকার অভেদ্য স্তর জমেছে। জমছে ক্রমাগত। বাইশ বছর বয়সে যখন তার পৃথিবীটাকে রঙিন করে দেখার সময়, তখন একদল লোক ইট দিয়ে তার ডানচোখটা ছেঁচে দিয়েছিল ! আজ উনচল্লিশে এসে সে বাকী চোখটা পিটপিট্ করে মানুষের-বিশ্বাসের-বিচ্ছেদের নব নব প্রতিচ্ছবি থেকে চোখ ফেরাবে বলে ক্যাক্টাসের চাষ করে যাচ্ছে। এই কাঁটাগুল্মের ভেতরে ফুলেল সৌন্দর্য দেখার জন্য নয়, আরো এক বিস্ময়ের অপেক্ষায় সে প্রহর গোনে যেন।

প্রায় সাড়ে চার একর ঊষর বালিময় অঞ্চলে একা একা একটি ভেঙে পড়ো পড়ো কুঁড়েঘরের মতো ইটের দেয়াল দেয়া পুরোনো বাড়ির ভিতরে সোম প্রতিদিন যেভাবে জাগে, আজও সেভাবেই জেগে উঠলো। প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো এখনো সে বেঁচে আছে- এই অবাক বিস্ময় তাকে প্রতিদিনই বিরক্তিকর একটি দিনের প্রস্তুতি নিতে আহবান জানালে সে একবার জীবন ও আর একবার প্রাত্যহিকতার দিকে নিরুদ্দিষ্ট পক্ষপাত শেষে উদাসীন বৈদগ্ধ্য নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। তবু প্রতিটি দিনেই তার মনে হয়, আজ নতুন কিছু ফুটবে; নতুন কিছু ঘটবেই। কিন্তু তার বিদির্ণ ঊষর বাগানে কেবল একটা দুটো ক্যাক্টাসের নতুন পাতা বা কাঁটা গজানো ছাড়া বিশেষ কিছুই ঘটেনা। আজও সে নিশ্চিত, এছাড়া কিছুই ঘটবে না। এশিয়ান নার্সারী ও ক্যাক্টাস হেভেন নামে দুটো প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত লোক এসে তার বাগান থেকে গাছ নিয়ে যায়। আসে ওরা পিকআপ নিয়ে। ছোট ছোট চারা পলিথিন ব্যাগে ভর্তি করে সাপ্লাই দেয় বিভিন্ন জেলায়। সোমের এসব ব্যবসা-ট্যাবসা ভালো লাগেনা। কিছু করতে হবে, তাই করে। এমনকি ক্যাক্টাসের প্রতিও তার কোন দর্বলতা নেই। নেই সখ। নিরস, সম্ভাবনাহীন এই উদ্ভিদের বংশবিস্তার ও পালন করে কি সুখ সে পায় কে জানে। টিউবয়েল থেকে একটা পুরনো জং ধরা ফুটো হয়ে যাওয়া বালতিতে জল তুলে হাতমুখ ধুয়ে ফেললো সোম। অকেজো ডান চোখটা দিয়ে যে অপ্রয়োজনীয় পানি নিয়ত নি:সৃত হয়, তাকে ভূগর্ভস্থ পানিতে বিলীন করে দিতে সে জলের ঝাপটা মারলো। এই টিউবয়েলে বিষ। অনেক আগেই পল্লী স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে কিছু জ্ঞানী অথচ পোড়খাওয়া সিড়িঙ্গে লোকজন এসে এটার পানি টেস্ট করে আর্সেনিকের অস্তিত্ত্ব খুজে পেয়েছে। লাল খড়ি দিয়ে দাগ কেটে দিয়ে যাবার পরেও সে ক্রমাগত সেই জলই ব্যবহার করে যাচ্ছে। নিজের প্রতি কোন মায়া বোধ করেনা সে। কেনো করবে?একা একা র্বির্বি করতে করতে ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে রাখা ভাত নিঙড়ে নিঙড়ে শুকনো তরকারী দিয়ে খেতে খেতে প্রতিদিনের মতো ভাবলো, সেই গাছটার কথা-যাকে অনেকদিন থেকে সোম ভাবছে কেটে ফেলবে কিনা। কিন্তু মন তাতে কেন যেন সায় দিচ্ছে না। ওটার ভাবগতিক অন্য গাছের মতো নয়। প্রায় হাজার খানেক ক্যাক্টাসের আবাদ করছে সে এই জমিতে। ক্রশ ব্রিডিং করেও প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ধরণ তৈরী করেছে নিজেই। ঐ ক্যাক্টাসটা সেরকম কিছু নয়। বলিভিয়া থেকে এক সাহেব তাকে উপহার হিসেবে ডজন খানেক ক্যাক্টাসের চারা দিয়েছিল। বিন্যাসে তারা নতুন হলেও দেশীয় ক্যাক্টাসেরই জাতভাই। তার মধ্যেই ছিল হয়তো এই বিরল গাছটি। এটাও একজাতীয় ক্যাক্টাস বলেই সোমের ধারণা। কাঁটায়, পত্রকে আর শেকড়ে-ব্যাপ্তিতে তাই-ই মনে হয় যদিও, কিন্তু কোথায় যেন একটা অমিলও আছে- যা ধরা যায়না। সোম আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে ফেলবে ফেলবে করেও অবশেষে কেটে ফেলতে পারেনি। লাল ডগডগে পুরু পাতায় ক্যাক্টাসটি তেড়ে ফুঁড়ে উঠছে যেন। লাল রঙের পাতা কোন গাছের হয় তা সে আগে দেখেনি। তাই ফেলাও হয়নি। বলিভিয়ার সেই ভদ্রলোক মিঃ জুয়ান মিগুয়েল আরিস্তাইদ এদেশে এসেছিলেন প্লায়স্টোসিন যুগের পলিভূমিতে ক্যাক্টাসের বিবর্তন নিরীক্ষা করতে। এই জলবায়ুতে আর ভিন্ন ইকোসিস্টেমে উদ্ভিদগুলো কিভাবে এডাপ্ট করে, এইসবের ওপর তিনি ঢাউস একখানা বই লিখবার পাঁয়তারা কষছেন। ভারী খুশী হয়েছেন তিনি সোমের এতোবড়ো ক্যাক্টাসের কালেকশন দেখে। নিজের উদ্ভাবিত কয়েকটি জাত তাকে দিয়েছে সোমপ্রকাশও। যাবার সময় বারবার ‘মেনি থ্যাঙ্কস মেনি থ্যাঙ্কস সোমোপ্রোকাস, দিস ইজ মাই ই-মেইল এড্রেস, মাই সেলুলার নাম্বার ইজ….’ বলে আহলাদে আটখানা একেবারে। কিন্তু সোমপ্রকাশতো তার মতো উদ্ভিদপ্রেমী নয়, অবশ্য পত্র পত্রিকায় ইদানিং তার নামে এইসব বিশেষণ জুড়ে দিয়েই ফিচার করছে শিক্ষানবীশ সাংবাদিকেরা। তাদের কৌতুহল অনেক সময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
: আচ্ছা আপনার যে কেসটা চলছিল, সেটা এখন কোন পর্যায়ে?
: ওই মেয়েটাকে কি আপনি সত্যি সত্যি ভালোবাসতেন?
তারা হিউম্যান স্টোরী চায়,বোঝে সোম। কিন্তু কাউকেই তার কিছু বলতে ইচ্ছে করেনা। এসবের উর্ধ্বে সে এখন। চোখ হারানোই তার একমাত্র বেদনা নয়। হয়তো এই জীবনটাই ছিল তার পরিনতি। সোম সেটাই মেনে নিয়েছে। কেউ তাকে বাধ্য করেনি। অথচ সে হঠাৎই সিদ্ধান্ত নেয় বন্ধ্যা জমিটুকুতে আর কিছু যখন ফলেই না, তখন ক্যাক্টাসের চাষ করলে কেমন হয়? এই করে করে মাঝখানে পনেরটা বছর কেটে গেছে…

আজগের কথাতো নয়। সোমের বাপঠাকুরদার পূর্বপুরুষরা ছিলেন নবাবী আমলের সামন্ত জমিদার। এ অঞ্চলটা তখন ছিল নিচু নাবাল। তাঁদের মহল ছিল এখান থেকে দশমাইল উত্তরে। সেখানে এখন জেলা পরিষদের নতুন ভবন খুলেছে সরকার। ওসবে তার মন নেই। এই সাড়ে চার একর চড়াই- উৎরাই ভূমির শক্ত পাথুরে নিঃষ্প্রাণ মাটিতে নিঃষ্প্রাণ ক্যাক্টাসই তাকে জীবন থেকে ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু ভুলতে চাইলেও সবকিছু ভোলা হয়তো এই জীবনে সম্ভব হবেনা। ফ্রকপড়া ইথিকার ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য লাফানো উদোম হাঁটু আর কল্কল্ হাসি- যে হাসি, যে ইথিকার দৌলতে তার একখানা চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেলো, তাকে ভোলা সোমের হয়ে ওঠেনা।

বাড় বাড়ন্ত শহরের ক্রমাগত আগ্রাসনে বিলীন হওয়ার মাঝেও ইথিকাদের বাড়ির সামনের চাতালটি তখনও অক্ষত। সদ্য কিশোরী ইথিকার অস্ফুট স্তনের মোহে নিশপিশ মোহ নিয়ে সোম দোতলার চিলেকোঠায় তার সংক্ষিপ্ত প্রকোষ্ঠের জলছাদহীন ভ্যাপসা গরমে প্রতিরাতে ঘুমের ঘোরে কেবল ইথিকার প্রত্যাখানকেই স্বপ্ন দেখতো। ইথিকার সাথে তার সেঅর্থে কোন মিলন হয়নি। না স্বপ্নে না বাস্তবে। শুধু তার নির্লোম হাঁটু যখন ব্যাডমিন্টনের স্ম্যাশ্ শটের বিপরীতে ঝাঁঝালো আকাঙ্খা তৈরী করতো,তখন টিউশনি করে কলেজে পড়াশুনার জন্য শহরে এসে এহেন কষ্ট করাকে তার ঢের মন্দ মনে হতো ক্যাক্টাসের চেয়ে যদি না ইথিকা থাকতো। কিন্তু ইথিকা থাকলো না।

ভোররাতে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে সূর্যকে স্বাগত জানানো সোমের তখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সেদিনও সে দেখছিল ইথিকার অপুষ্ট স্তনের মতো নিটোল সূর্যটা কেবল উঠে আসছে আকাশে। নীচতলায় তখন ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ- আর দুমদুম পা ফেলে কারা যেন উঠে আসছে ছাদে। ভোরবেলা মাথাটা ঠিক চট্ করে কাজ করতে চায়না। সোম তাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলো গালাগালি করতে করতে ইথিকার বাড়ীওলা বাপ আর মামা তাকে চেপে ধরলো। ইথিকার দজ্জাল মা তখন সমানে বয়ান করছে কিভাবে ফুসলিয়ে সোম তাদের মেয়ের সর্বনাশ করেছে। একমুখ পেস্টের ফেনায় তার কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হুঙ্কার ছেড়ে সবাই মিলে তাকে ছাদের মেঝেতে পেড়ে ফেলে। নীচের তলায় অনেক মানুষের ভীড় তখন চেয়ে চেয়ে দেখছিল গলায় ফাঁস পড়া মৃতদেহটির ফ্রকে ঢাকা উদোম হাঁটু। তাদের কেউ কেউ আক্ষেপ, কেউ উস্কানি আবার কেউ মারমুখী হয়ে ছাদেও ভীড় করেছিল। আর আক্ষেপ ও আশাভঙ্গের আতিশয্যে একটা পরিপূর্ণ থানইট দিয়ে কে যেন তার মাথায়, মুখে, চোখের ওপর অনবরত বাড়ি মারছে, বাড়ি মারছে,সাদা পেস্টের ফেনার সাথে লাল রক্তের মিশ্রণে মেরুণ সূর্যটা জ্বলে ওঠার আগে তখনও সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখে নিচ্ছিল…।

মা মারা যাবার পর সোমপ্রকাশ একদম একা হয়ে গেলে একবার ভেবেছিল বিষ খাবে কিনা। কিন্তু চোখের যন্ত্রণা তখন এতো বেড়ে গিয়েছিল যে সে অপেক্ষা করছিল মৃত্যুটা বুঝি গুটি গুটি পায়ে নিজেই এগিয়ে আসবে। কিন্তু আসেনি। বিদেশী কোন্ একটা বিশেষজ্ঞ টীম এসে তার চোখটা ভালো করে দেখে-টেখে বললো হুম্ এরতো কর্নিয়া গ্রাফটিং করতে হবে। কিন্তু কর্নিয়াতো আর খোলাবাজারে বিক্রি হয় না। দাদারা সব দেশ ত্যাগ করে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। আত্মীয়-স্বজন যারাও বা আছে তারা খুনের দায়ে দীর্ঘদিন থানা হাজত দৌড়াদৌড়ি করা সোমকে পরিচয়ই দিতে চাইতোনা। তাই চিকিৎসকরা তার নিরন্তর মাথাব্যাথার উপসর্গটা সাড়িয়ে তুললো বটে, কিন্তু তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিলো এই অনবরত জলপড়া। ভাগ্য অবশেষে তার প্রতি এতোটাই সুপ্রসণ্ন হয়ে উঠেছিল যে অনেক জায়গাজমি বিক্রি করে ইথিকা হত্যা মামলা চালাতে গিয়ে সর্বশ্বান্ত সোমপ্রকাশ হঠাৎ একদিন শুনলো মৃত ইথিকার সদ্য পরলোকগত পিতার জবানীতে ঐ মৃত্যু বা হত্যা বা আÍহত্যার রহস্যের সমাধানসূচক ইথিকার একটি ডায়রী পুলিশ উদ্ধার করতে পারায় বিজ্ঞ আদালত তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে।

কিন্তু আজও সে জানে না ইথিকা তার পেটের অবঞ্ছিত ভ্রণটির উৎসপুরুষের কথা সেই ডায়রীতে লিখে গেছে কিনা। সেটা জানায় কিছু এসে যায়না বলেই আগ্রহটাও নেই। সে কি ইথিকাকে ভালোবেসে ছিল? উনচল্লিশের সোমপ্রকাশের কাছে সেটা মোটেই গ্রহণযোগ্য উত্তর নয় বটে, তবে বাইশের সোম পুরোটাই মজে গিয়েছিল হয়তো। যার প্রায়শ্চিত্ত কিংবা হতে পারে প্রতিদানই তাকে দিয়ে এখন এইসব ছাইপাশ করিয়ে নিচ্ছে। একটা ভুলের ক্ষতিপুরণ দিতে আর একটা ভুল; একটা কষ্টের প্রলেপ দিতে আর একটা দুঃখের বীজ সে নিয়তই বপণ করে চলছে। নিজেকে এখন সে ভুল মানুষ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না।

সূর্যের তেজ বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে। ছ্যান্দাও হাতে নিয়ে সোমের এবার কাজে নামার পালা। ভুল মানুষের ভুল জীবনে ত্রুটিপূর্ণ দিনগুলির রোজনামচা এখন গতবাঁধা। এই নিন্মাঞ্চলটি একসময় ছিল ঠগী দস্যুদের অভয়ারণ্য। ইংরেজরা তখনও এদেশে আসেনি। পর্তুগীজ,মগ জলদস্যুরা তখন ফ্লাইং ডাচম্যানের মতো জলযান নিয়ে এ অঞ্চলে লুটতরাজ করে বেড়াতো। তাদের বীর্যের ছাপ এখনো দ্বীপাঞ্চলের কোথাও সরুচোখী অধিবাসীদের মধ্যে পরম্পরায় স্মৃতি রক্ষা করে চলছে। ঐ সময় তারা ছড়িয়ে পড়েছিল টাইডাল সুন্দরবন থেকে গোয়া-দমন-দিউ পর্যন্ত। জনশ্রুতি আছে, রাজা মন্ত্রহারীর আমলে জলদস্যুতা কিছুটা লোপ পেয়েছিল। তিনি ছিলেন রায়মঙ্গল নদীর মতোই বদমেজাজী। বন্দী ডাকাতদের চোখ ধারালো কিরিচ দিয়ে শ্রেফ গেঁথে নিয়ে উপড়ে ফেলা হতো রাজার সম্মুখে। সেই উৎপাটিত চোখ তার সখের চিতা-শাবক দিয়ে তিনি ভক্ষণ করাতেন। ঠগীদের নরহত্যার বিদ্ঘুটে পদ্ধতির মতোই- তাদের ধনসম্পদ ও সোনাদানা লুকিয়ে রাখার নিয়মটিও ছিল বেশ ভিন্নতর। ওদের ধর্মের যক্ষ বা অজং-এর আসন ছিল বেগুনী তারকা খচিত মখমল। তাই দস্যুরা তাদের লুণ্ঠিত ধনসম্পদ কোন অনুচ্চ টিলার শীর্ষে মাটিচাপা দিয়ে রাখতো, আর প্রতীকচিহ্ন হিসেবে সেখানে একটি বেগুনী পাথরের চাঁই পুঁতে রাখা হতো। মšহারীর প্রতাপে তারা অবশেষে অতিষ্ট হয়ে যখন নারিকেল জিঞ্জিরা হয়ে ভারত মহাসাগরে তরী ভাসালো তখন পথিমধ্যে অধিকাংশেরই মহামারীর আকারে দেখা দিয়েছিল স্কার্ভি। দিল্লীর তখ্তে তাউসের তৎকালীন সভাসদ, ঐতিহাসিক সাজিদ জাফরীর গ্রন্থ ‘সাজিদ-ই-আন্ধারী’ তে এই কাহিনীর কিয়দংশ উল্লেখ রয়েছে। এর বাইরে আর তেমন কিছুই জানা যায় না। সোমপ্রকাশ কোনদিন জানতে চেষ্টাও করেনি।

যারা চেষ্টা করেছিল তাদের মধ্যে তার সেজো কাকা অন্যতম। ইয়া পুরু গোঁফ ছিল সেজো কাকার। ব্রিটিশ আর্মীতে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, কোলকাতায় যখন বোমা পড়লো -কাকার তখন কি দাপট! ছোটবেলায় সোম দেখেছে ভোরবেলা উঠেই তার প্রথম কাজ ছিল নিজের চক্চকে বুটখানা আরও পালিশ দিয়ে চক্চকে করে নিয়ে পড়ে ফেলা। এর সঙ্গে থাকতো ক্রশবেল্ট লাগানো ক্যানভাসের খাকি প্যান্ট। যুদ্ধ-টুদ্ধ কবে শেষ হয়ে গেছে তবু সেজো কাকার ভাবখানা ছিল- এইতো সবে ময়দানে গোরাদের সাথে ঘোড়া দৌড়ে তবে এলাম- টাইপের। সোম ভয়ে তার কাছটিতে ভীড়তো না। সারাক্ষণ হল্লাঘরে বসে সে ছবির বই দেখতো। এই হল্লাঘর নামটিও দিয়েছিলেন সেজোকাকা। বাচ্চারা একটি নির্দিষ্ট ঘরে বসে যাবতীয় দুষ্টুমী করবে। তারা বাইরে যেতে পারবে না এই ছিল তার আদেশ। অনেকেই তার আদেশ মানতো না। ফুল্কুদা, ছুঁচুদা তো নয়ই, এমনকি সেও মাঝে মাঝে। তার কেবল ইচ্ছে করতো বাড়ীর পেছনের বিল পেরুলেই যে উঁচু টিলামতো যায়গায় অসংখ্য কাঁটাগাছে আর লজ্জাবতীর বুনোফুলে ছেয়ে আছে- সেখানে একা একা গিয়ে গাছেরা নিজেদের ভাষায় কী কথা বলাবলি করে তা কান পেতে শোনে। একদিন তন্ময় হয়ে সে মিঠে বাতাসের মধ্যে ছোট ছোট গুল্ম আর উদ্ভিদের কানাকানি শুনছিল। ধিঙ্গি আশশেওড়া লজ্জাবতীকে বলছে ‘আ মলো যা, মাগীর ঢং দেখে আর বাঁচিনা। এখনো মাটির সাথে কথা কইছে অথচ দ্যাখোনা রাজ্যের ফুল ফুটিয়ে ছেনালী করছে।’ ওদিক থেকে কণ্টিকারী বাতাসে দুলতে দুলতে গলা বাড়িয়ে বললো ‘ আর বোলোনা দিদি, সারা গায়ে বিষের কাঁটা গজিয়ে রেখেছি তবুও ঢ্যামনা ছাগলগুলোর হাত থেকে রেহাই নেই। আর এ মাগীর গায়ে একফোঁটা শিশির পর্যন্ত পড়েছে কি অমনি পাতা বুজিয়ে, ডালপালা নেড়ে গেলাম গেলাম….মরণ আর কি!’ শুনে সোম এগিয়ে যায় শতমলীর দিকে। আষ্টেপিষ্টে লতায় জড়িয়ে রাখা কাঁটানটে হাফ ছেড়ে বলছে ‘ও ভাই শতমূলী, আর কতো, ছাড়নারে ভাই, তোর জন্য একটু যে নড়েচড়ে হাওয়া খাবো কিংবা হাত পা ছেড়ে একটু আর মোড় ভাঙবো তারও জো নেই…..’। হঠাৎ তখন সে খিল্খিল্ হাসির শব্দ টের পায়। সোম চমকে ওঠে,আরে গাছেরা হাসতেও জানে নাকি? সে লক্ষ্যস্থির করার জন্য একটু ডানদিকের ঘনঝোপের দিকে এগিয়ে গেলে চাপা গোঙানী আর ফিসফিস শুনতে পায়। সোমের বুক ঢিপঢিপ করে। তারই মধ্যে তার কিশোর কৌতুহলী চোখ দেখে, ঝোপ নয়- ঝোপের মধ্যে ছেদ্রে শুয়ে আছে অতসীদি। আর তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ব্লাউজ খুলে চুষে চলেছে ফুল্কুদা। এমা, ফুল্কুদা এতো বড় হয়েও দুদু খায়? কিন্তু ওর কোমরটা ওভাবে ওঠানামা করছে কেনো? ….কেনো? কেনো? … ভাবতে ভাবতেই কি এক রহস্য উন্মোচন আর ভীতির আন্দোলনে সোম দৌড় দৌড় দৌড়, হাঁফাতে হাঁফাতে হল্লাঘরে! জানিস ভুতু আমি না একটা জিনিস দেখেছি আমি না হি হি এমা, ফুল্কুদা কি অসভ্য জানিস ভুতু অতসীদি না, তখন কোঁকাচ্ছিল…..।

সেজো কাকা বাড়ীর পুরোনো দস্তাবেজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন কি নিয়ে যেন খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন- তা সোমের মতো ছোটরা তখন বুঝতে পারেনি। কেবল মনে আছে বিলের পরে যে টিলা-সেখানের ঝোপঝাঁড় সব কেটে সাফ করার জন্য জনাদশেক বিশ্বস্ত কামলা তখন রাতদিন কাজ করতে শুরু করলো। মা পই পই করে বারণ করছিলেন। সেজো ঠাকুরপো, ওইখানে আমাদের বংশে পয় নেই। ওটা খুঁড়ো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দিনরাত মাটি খোড়া চলতো। রাতেও পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে রাখা হতো কেনো কে জানে? তবু তার মধ্যে একদিন শেষরাতে অমাবস্যায় শিবুদাস চিৎকার করতে করতে আর দৌড়াতে দৌড়াতে টিলা থেকে নেমে এলো।

তার ভাষা কেবল জড়িয়ে যাচ্ছিল। বোবা চিৎকার করতে করতে সে সাপে কাটা বুনো শুয়োরের মতো দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিল যেন। শিবুদাসের সাথে সোমদের বহুদিন ধরে শরিকী গোলমাল চলছিল। মোকদ্দমায় ওরা নি:স্ব হয়ে গিয়েছিল একেবারে। গুপ্তধনের লোভে সে চুরী করতে গিয়েছিল খুঁড়ে রাখা ঢিবিটার ভেতরে। কিন্তু তার মুখ থেকে কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। সেজো কাকার দোনলা বন্দুককে উপেক্ষা করে লোকটা মাথামোটা বাইসনের মতো বিশাল দেহটি নিয়ে অপার্থিব চিৎকার করতে করতে উঠোনের মাঝখানের পুরোনো কাঁঠাল গাছের মোটা কাণ্ডের সাথে দড়াম করে বারি খেয়ে উঠোনেই আছড়ে পড়লো। শেষরাতের সেই কাঁপা কাঁপা লণ্ঠনের আলোয় শিবুদাসের মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেড়িয়ে উঠোনের একটা অংশ ভিজিয়ে দিতে দেখলো সোম। সেজো কাকা গম্ভীর হয়ে দোনলা ছেড়ে গরম জলে-টিংচার আয়োডিনে যখন ওর মাথার ক্ষতটায় শুশ্রূষা করছিলেন ততক্ষণে শিবুদাসের পোক্ত শরীরটা স্তিমিত আর বেগুনী হতে শুরু করেছে। এবং কি আশ্চর্য, ঐ অবস্থাতেও শেষবারের মতো শিবুদাস স্বপ্ন দেখে নিদ্রাভঙ্গের মতো উঠে বসে অজানা আতঙ্ক আর ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো ঐ ঢিবিটার দিকে মাত্র একবার তার বেগুনী হয়ে যাওয়া জলভরা চোখদুটো মেলে কিছু একটা তথ্য জানিয়ে যেতে চেয়েছিল- কিন্তু পারেনি। শিবুদাসের অপঘাতে মৃত্যুর পর সেজো কাকা সন্যাস নিয়ে সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন তারপর অনেক বছর কেউ আর সেই টিলা- যেখানে এখন সোম তার বাগান করেছে- সেদিকে পা পর্যন্ত মাড়ায়নি। একাত্তরে এখানে নাকি একবার মুক্তিযোদ্ধারা অস্থায়ী ক্যাম্প করেছিল। খবর পেয়ে আসেপাশের দশগ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক আর্মীরা। ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবার পথে ঐ টিলার ঝোপেই বেশকিছু মেয়েকে-যারা বেশী বাধা দিচ্ছিল -পালাক্রমে ধর্ষণ শেষে গাবগাছে তাদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল।

সোমের মনটা আজ কেনো যে পুরোনো দিনগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে তা সে টের পেলো – যখন হাত দেড়েক লম্বা ধারালো ছ্যানদাওয়ের কাঠের হাতল, তার হাতের মুঠোয় ঘামে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে উঠলো। কে সে? কিসের প্রলোভনে সে এসব করছে? প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে চনমনাচ্ছে। চট্ করে তার মনে পড়ে গেলো রাতে দেখা স্বপ্ন বা দু:স্বপ্নটির কথা। স্বপ্নটি এতো সুন্দর অথচ তার কাছে ভয়ঙ্কর কেনো মনে হচ্ছে? বলিভিয়ার সেই গবেষক তাকে বলেছিল কীংবদন্তীটি। এক জাতের ক্যাক্টাসে নাকি খুবই চমৎকার বেগুনী ফুল ফোটে। প্রমাণ সাইজের থালার আকৃতি পুরু পাপড়িগুলো খুবই রসালো। এই কাঁটাগাছের বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাকাল্যান্সিয়া ফ্লোরেটা। রেড ইন্ডিয়ান আদীবাসীরা একমাত্র ওদের জাতশত্রু ভিনগোত্রীয়দের সাথে যুদ্ধেই একে ব্যবহার করতো। তারা তাকে বলতো ‘মাওমেতু’ যার অর্থ ‘স্বর্গীয় বিষ’। এই মাওমেতু ফুলের নির্যাস বা ‘লামুর’-এর ঘন দ্রবণে, যুদ্ধের ঠিক পূর্বক্ষণে তারা চুবিয়ে নিতো তাদের তূণভর্তি তীরের চক্চকে ফলাগুলি। বিষাক্ত লামুর একটি সমর্থ বুনোমোষকেও নাকি দশ সেকেণ্ড সময় দেয় না! শুধুমাত্র বলিভিয়ার গিরিকন্দরের পাথুরে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে মাওমেতু জন্মায় বলে এটা এখন বিলুপ্তপ্রায় ও মূল্যবান। আদিবাসী ওঝারা অবশ্য একেই ব্যবহার করতো অর্শ্বরোগের চিকিৎসায়। প্যারামাউন্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি বহুজাতিক কোম্পানী এই বিরল প্রজাতির কণ্টক-উদ্ভিদের পেটেন্ট নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাধ সেঁধেছে আমেরিকার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ। ডেমোক্রেটদের মধ্যে ইহুদী ব্লকের কিছু পরিবেশবাদী ধূয়া তুলেছে এই বলে যে, প্যারামাউন্ট কেমিক্যাল কোম্পানী এই ফাইলো-ক্যাক্টাসের এরোমেটিক সিনথেসিস্ করলে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে যে ভিনাইল আইসো-সায়ানাইড প্রকৃতিতে অবমুক্ত হবে, তা ওজোনস্তরের ক্ষয়কারী। এবং নর্থ- ডাকোটার ইগুয়ানা ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক জানিয়েছেন ঐ ক্ষয়ের মাত্রা সি এফ সি ক্ষয়ের ব্যস্তানুপাতিক! ফলে একমাত্র জাপান সাগরে যে বিশালাকায় ‘অটার ফিশ’ পাওয়া যেত, ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের লেজের রং বাদামী থেকে ক্রমশ: বেগুনী আকার ধারণ করতে পারে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘ফিউচার’ অবশ্য এই মতকে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে। চ্যানেল ফোরের ডেভিড হ্যাডলী তার লেটনাইট টকশো তে বরাবরের মতো এবারও ইহুদীদের একহাত দেখে নেবার সুযোগকে হাতছাড়া করেননি। তিনি ব্যঙ্গ করে তাদেরকে “বুড়ো থুত্থুরে ফজলী আম” বলে গালি দিয়ে দর্শক হাসিয়েছেন। যদিও ডেভিড হ্যাডলীর মা ছিলেন ইহুদী এবং গেস্টাপোরা বিশ্বযুদ্ধের সময় কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে তার মতো অসংখ্য ইহুদী নারীর জরায়ুতে ল্যাকাল্যান্সিয়া ফ্লোরেটার কৃতিত্ব দেখার জন্য ইন্জেক্ট করেছিল……! সোমের চোখটা থেকে আজ কেনো যেন বেশীমাত্রায় জল কাটছে। সে কি কাঁদছে? কেনো কাঁদবে? কাঁদার জন্য অন্তত দুটো চোখতো চাই। একচোখে কান্না কি মানায়? এ সব ভাবতে ভাবতে সে চোখ মোছে আর তেরছা রোদ্দুরকে উপেক্ষা করতে মাথার গামছাটা ঘাড় পর্যন্ত বিছিয়ে নিয়ে একটানা আগাছা পরিষ্কার করে যেতে থাকে।

এতোবড় বাগান তার, অথচ সবটাই আগাছা। এই ক্যাক্টাসগুলোতো আগাছাই একরকম। বাগান অথচ ফুল ফোটে না। তাকে কি কেউ বাগান বলবে? তাই সে কোন কেয়ারটেকার রাখেনি। আগাছায় আগাছায় ভরে গেলে সে নিজেই তার পরিচর্যা করে। ইচ্ছে করেই ফুলবতী গাছ লাগানো থেকে সে নিজেকে বিরত রেখেছে। ফুল মানেই আকর্ষণ। ফুল মানেই লোকজনের আনাগোনা, ভালোলাগা, কথাবার্তা, উহ্! ভালোলাগে না। লোকজন দেখতে তার একদম ভালোলাগে না। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো তার চোখে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে মানুষের উপস্থিতি। একা একা তাই সে ভুতের মতো এই বিস্তির্ণ কাঁটাঝোপের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। আসেপাশের গ্রামের লোকজন কেউ এদিকে আসে না। একবার একদল শহুরে পিকনিক পার্টিকে সোম ছ্যান্দাও নিয়ে তাড়া করেছিল। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন গল্পের অনুষঙ্গ নিয়ে। লোকে বলাবলি করে সোম উন্মাদ হয়ে গেছে। এটাই বেশী বলে লোকজন। কেউ কেউ বলে সোম পূর্বপুরুষদের ভিটেতে যখ্ পেয়েছে, তাই কাঁটা দিয়ে তাকে আগলে রাখে। একজন অবশ্য প্রায় নিয়মিতই তার কাছে আসেন। দুঃখী লোক। ‘রুমা হোমিও ফার্মেসী’র কুমুদবাবু । মাঝে মাঝে তিনি গল্প করার চেষ্টা করেন সোমের সাথে। এই একজনের কাছেই সোম নিজেকে একটু মেলে ধরে। তাকে চা বানিয়ে খাওয়ায়। এমনকি ঠাট্টা করে পর্যন্ত। তবে তা শুধু একটি বিষয় নিয়েই।
: আচ্ছা কুমুদবাবু আপনার দোকানের নাম রুমা হোমিও কেনো?
উত্তরটা জানা আছে দুজনেরই। তবুও শান্তিপ্রিয় চিরকুমার লোকটি নির্দ্বিধায় প্রশ্নটির উত্তর পুনরাবৃত্তি করেন। নড়বড়ে চশমার ডাঁটিটি সন্তর্পনে একহাতে ধরে, পাঞ্জাবীর খুঁট দিয়ে তার কাঁচ মুছতে মুছতে কুমুদবাবু স্মৃতি হাতড়ানো স্বরে বলেন-
: সোমবাবু, কি জানেন তিনটে আইবুড়ো বোনকে বিয়ে দিতে দিতে নিজের বিয়ের সময় কখন যে পেরিয়ে গেলো তা বুঝতেই পারিনি। যে বাড়ীতে লজিং থাকতাম, সেই বাড়ীর গবেট অথচ সুন্দরী মেয়েটির নাম ছিল র€মা। মনে সাধ ছিল একদিন নিশ্চয় ওর অভিভাবকরা আমার কাছে তাদের কন্যাদায়ের কথাটা পাড়বে। কিন্তু কি জানেন মানুষের ভাগ্যতো আর কাঁঠাল নয় যে সময়মতো পাকবে। ওরা একদিন ইন্ডিয়া চলে গেলো। এর পর থেকেই কি জানেন …মনে একটা ইয়ে ধরে আছে সোমবাবু…। কুমুদবাবুর দীর্ঘশ্বাসমূলক আকুতি সোমের মনে কোনরকম প্রতিক্রিয়া ছড়ায় কিনা আবছা আলোতে তা মোটেই বোঝা যায় না। কেবল একটি উদোম হাঁটুর ছায়াচিত্র দেয়ালে কিম্ভুত ছায়া ফেলে কাঁপে। আর ভরদুপুরে সেইসব ভাবতে ভাবতে আর উদ্বৃত্ত বাকী চোখটার নিয়ত নি:সৃত পানি এক হাতে মুছতে মুছতে সোম দ্র€ত অবাঞ্ছিত ঘাস কেটে চলে।

উঁচু উঁচু টিলা সদৃশ এই মরুজমিতে রোদটা বেশ তেজ ছড়ায়। তার পিঠে ঘামের ফোঁটা ফোঁটা দানা জমে উঠলে সোম বুঝতে পারে দুপুর গড়িয়ে গেলো। এখন তাকে থামতে হবে। পেটে কিছু দিতে হবে। কিন্তু দাঁড়িয়ে যেতেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে। যতদূর সে চলে এসেছে তার কুঁড়ে থেকে, এই রোদে ততোটা দরত্বকেই খুব বেশী মনে হয় সোমের। এটুকু পথ গিয়ে শান্তি খুঁজতে ইচ্ছে করেনা। অনেক আগাছা জড়ো হয়েছে। এগুলোকে এরপর নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে ডোবার মধ্যে। যে গোল্ডেন রিংটাকে সোম সবচেয়ে বেশী যত্ন করে আজ তার কাছেও যাওয়া হয়নি। সত্যিকারার্থেই এটা একটা দামী গাছ। বিশেষত, সৌখিন বড়লোকদের ড্রইংরুমে এহেন একটি স্বর্ণালী গোলক সদৃশ্য কাঁটাগাছ তাদের আভিজাত্যের পথকে আরো সুসংহত ও কণ্টকমুুক্ত করতো হয়তো। কিন্তু চারদিকে এই কাঁটা আর নিরস উদ্ভিদের মাঝে নিজেকে এখন তার খুবই নি:স্ব মনে হতে থাকে। মনে হয় একা। সেতো একাই। তবে কেনো ভিন্নভাবে আরো বেশী একাকীত্ব? তার আর কী চাওয়ার আছে জীবন থেকে? আর কী সর্বনাশ সে আশা করতে পারে? ভাবতে ভাবতে সে শুনতে পায় ইট ভাঙার শব্দ। কোথায় যেন ইট দিয়ে ছেঁচে দেয়া হচ্ছে কিছু। নরম মাংসের ওপর সংঘর্ষটা হচ্ছে থ্যাচ্ থ্যাচ্! সোমের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। তার এখন একটু ছায়া দরকার। কিন্তু চারদিকে অসংখ্য অনতিদীর্ঘ কাঁটাগাছ। সে হাতের ছ্যান্দাওটি আর বইতে পারে না যেন। মাথার ভেতর অহরহ থ্যাচ্ থ্যাচ্ শব্দের কারণে সবকিছু উলট্-পালট্ হয়ে যাচ্ছে। ওহ্! সোম এগুতে গিয়ে বাধা পায়। কাঁটার খোঁচা লেগে তার হাত পা ছড়ে যাচ্ছে, যাক। এখন একটু ছায়া দরকার। একটি মানুষ শুধু একটু ছায়া চায় শুধু। সোম এগুতে থাকে। কাঁটাগাছে তার পরিধেয় টান পড়ে। কিন্তু সোমতো এই কাঁটা থেকে বের€তে চায়, সে সর্বশক্তি একত্রিত করে। ইথিকার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? কে? সে-ইতো? সে কেনো বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না মেয়েটাকে? চোখটা দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। কিন্তু বাকী চোখটা? মানে যে চোখটা এতোদিন খালি পড়ে ছিল সেটা দিয়ে কি সে দেখতে পাচ্ছে? আর যা যা দেখছে তা কি সত্যি? সোম নিজের শরীরে এক অপার্থিব অনুভূতির অস্তিত্ত্ব টের পায় যেন। এখন সে দুচোখেই দেখতে পাচ্ছে কিছু? তার সামনে রক্তাক্ত একটি উদ্ভিদ। এতো বিশাল, এতো দীর্ঘ, এতো ঘন হয় উদ্ভিদের রং? গাছটির শীর্ষে কড়া বেগুনী আভায় তার চারদিক যেন আরো রৌদ্রকরোজ্জ্বল! সোমপ্রকাশ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো এগুতে থাকে। তার মাথায় থ্যাচ্ থ্যাচ্ শব্দটা ছাপিয়ে উঠেছে তার গতির শব্দ। কাঁটাঝোপ উপড়ে মুচড়ে সোমপ্রকাশ এগিয়ে যায় বেগুনী আভার দিকে। তার জলভর্তি বাঁ চোখ আর শুষ্ক অথচ ক্রিয়াশীল ডানচোখের রহস্যও এখন তাকে ধাতস্থ হতে দিচ্ছেনা। মনে হচ্ছে চতুর্দিকে বেগুনী অন্ধকার নেমে এসেছে। সূর্যটাও ডুবে গেছে সেই অন্ধকারে। আর সোমের বুভুক্ষু হাতদুটি ক্রমাগত এগিয়ে গিয়ে সেই বেগুনী ফুলটির সংলগ্ন হতে চায়। কি এক অপার্থিব থ্যাচ্ থ্যাচ্ ছেঁচে দেবার শব্দ ছাপিয়ে উঠছে চারদিকে। সোম জান্তব উল্লাস আর বৈনাশিক প্রেরণা নিয়ে এক লহমায় ফুলটিকে বৃন্তচ্যত করে! রসালো পাপড়ি নিঙড়ে পানসে রস ঢেলে দেয় নিজোর গলাতে। তার চারদিকে অবশেষে বেগুনী অন্ধকার ঘন হয়ে আসার আগে সে বুঝতে পারে মাওমেতুর শাব্দিক অর্থের মহিমা! নিখোঁজ হয়ে যেতে যেতে সে পৃথিবীর কাছে একটি উদোম হাঁটুর বিনিময়ে একটি চোখ কিংবা একটি চোখের বিনিময়ে উদোম হাঁটু- এর কোনটিরই ঔচিত্য বোধ করেনা। বরং তার নির্ভেজাল ডান চোখের গর্তে সহসাই একটি বেগুনী পাথর ঘৃণার প্রতিকল্প হয়ে জ্বলে ওঠে!

পরিশিষ্ট:
ইথিকার সারাটা পথ আসতে বেশ ঝক্কি গেছে। বাব্বাহ্। এ কি কম ঝামেলা। ফিচার করতে গেলে এই হলো সমস্যা। তার পাতার এডিটর ফুল লেন্থ হিস্টোরী ছাপাতে আগ্রহী। নাড়ি নক্ষত্রের খবর সব তাই জানতে হয়। এই পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে সে আসতো না যদি না চ্যালেঞ্জটা থাকতো। কোন্ এক পত্রিকাতে যেন লিখেছে লোকটার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতার কথা। ইথিকা তাই নিজেই যেচে এই এসাইনমেন্টটা নিয়েছে। আগামী সংখ্যাতেই কাভার স্টোরী হবে ‘ক্যাক্টাসপ্রেমী এক যুবকের ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে।

সোমপ্রকাশের ক্যাক্টাসের বাগানে ঢুকে সে দেখলো জনমনিষ্যি নেই। তার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। সানগ্লাসটা কপালে তুলে দিয়ে সে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলো। কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ চারদিকে। অদূরে টিলামতো যায়গায় কী ওটা? এপিটাফ নাকি? আরে এতো গাঢ় রঙের পাথর হয় কখনো? ইথিকা চিন্তিতভাবে এগুতে গিয়ে থেমে পড়লো। আগে ইন্টারভিউ নেয়া যাক, তারপর এলাকাটা ঘুরে দেখা যাবে। অবশ্য দেখার আছেইবা কি? চারদিকে এতো গাছ উপড়ে ফেলেছে কে? কে কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে? কেউ কি মারা গেছে? একটু খুঁজতেই সে কুঁড়েঘরটি দেখতে পেলো। দেখে মনে হচ্ছে একটা প্রাগৈতিহাসির গুহা। এটাই তাহলে লোকটার ঘর? কি যেন নাম লোকটার? নোটপ্যাড আর ক্যামেরা প্রস্তুত করতে গিয়ে ইথিকা বুঝতে পারলো লোকটা; মানে সোমপ্রকাশ বাড়িতে নেই!

রচনাকাল: ০৯/০৬/২০০০