অম্লমধুর

শুকনো আপেল

বয়স পাঁচ বছর ছুঁইছুঁই, সম্ভবত চুহাত্তর সালের দিকে – প্রতি সপ্তাহে আমার উছিলায় শুকনো আপেলের প্যাকেট নিয়ে আসতো মা। সঙ্গে অয়েস্টার মিল্ক গুঁড়োদুধের টিন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে রেড ক্রসসহ বিভিন্ন ক্রিস্চিয়ান অর্গানাইজেশন তখন প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য বাড়তি পুষ্টি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলো।

কী যে স্বাদ ছিলো সেই আপেলকুচিতে তা বলে বোঝানো যাবে না। স্বর্গে গেলে যে প্রথমত ওই আপেলকুচি দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে, সে ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ও আছি! ইউরোপের অাবহাওয়ায় পরিপক্ক, দূষণহীন সেইসব আপেল কেমন করে শুকিয়ে তারা আমাদের নিরানন্দ শৈশবকে চমকিত করেছেন তা ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করি। কয়েক টুকরো মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেয়া যেতো। তারপর পানি খেলে ক্ষিদে গায়েব!

অয়েস্টার মিল্কের কৌটো অনেক ওপরের তাকে তুলে রাখা হতো, আমার নাগালের বাইরে! কিন্তু চেয়ার ঠেলে ঠেলে নিয়ে, তার ওপর জলচৌকি বসিয়ে ননীচুরির বিদ্যা কী আমি শিখিনি তদ্দিনে?.. দুয়েকটা অঘটন তো ঘটতোই- পুরো টিন মাঝপথে হাত ফসকে গেলে কিংবা চেয়ারের পায়া যদি বিট্রে করে, তো সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে ঘুমিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বাড়ির পেছনের জঙ্গলে বা স্বপনদাদের বাসায় রাজনৈতিক আশ্রয় না নিয়ে উপায় কী?

সেই আপেলকুচি আর অয়েস্টার মিল্ক শৈশবের সাথে সাথে বাজার থেকেও নেই হয়ে গেছে! বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর পুরো বিদেশী সাহায্যগুলি রাতারাতি তাদের মিশন গুটিয়ে নিয়েছ বা স্ট্রাট্রেজি পাল্টে ফেলেছে। আমার মুখে লেগে থাকা সেই শুকনো আপেলের স্বাদ আমি কখনো ভুলতে পারিনি! ঢাকার বড়বড় সুপারশপে জিজ্ঞেস করলে তারা কিভাবে যেনো তাকায়। তারপর আপেলের জ্যাম নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে এটায় চলবে কিনা!

দেশের বাইরে সবসময় শুকনো আপেল কেনার বাসনা থাকলেও, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে পাইনি। গতমাসে ভিয়েনার চেইন শপ ‘বিল্লা’ তে ঢুকে মনে হলো, এটাই উপযুক্ত স্থান। অত্যন্ত সুদর্শন এক অস্ট্রিয়ান যুবক সেলসবয় হিসেবে তখন মালামাল সাজিয়ে রাখছিলো থরে থরে। জিজ্ঞেস করতে আমাকে নিয়ে গেলো নির্দিষ্ট জায়গায়। দুনিয়ার হেনো ফল নেই, যা তারা চিপসে রূপান্তরিত করেনি! কিন্তু শুকনো আপেল মাত্র দুই প্যাকেট, তাও ছোট ছোট। দেড় ইউরো দাম। আমার আশাহত চোখ দেখে ছোকড়া কী বুজলো কে জানে। আমাকে অপেক্ষায় রেখে বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো বড়বড় আরও দুটো প্যাকেট নিয়ে। চোখে অপরাধ ফুটিয়ে বললো সেগুলির দাম প্রতিটি পাঁচ ইউরোর বেশি, আমার তাতে চলবে কিনা!… চলবে না মানে? পুরো শৈশব প্যাকেট করে তোমরা হাতে তুলে দিচ্ছো, এত্তো সস্তা ইউরোপের বাজার!

অশ্রুভাই

আলী আশরাফ অশ্রু! নামের ভেতরে যার কান্না লুকানো- সেই লোকটি কিন্তু ছিলেন ভীষণ হাসিখুশি। আমাদের চেয়ে ২/৩ বছরের বড় হবে বড়জোড়- কিন্তু চান্স পেলেই আমাদের মতো পিচ্চিদের কাছে যথেষ্ট মুরুব্বীআনা করতেন তিনি। অত্যন্ত সুশ্রী, গৌরবর্র্ণ, উন্নতনাসার অশ্রুভাইকে দেখলে হিংসা হতো! অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পরেও তিনি ছিলেন আমাদের সম্পত্তি- মুক্ত বিহঙ্গ খেলাঘর আসরের। নাটক-শরীরচর্চা-বিজ্ঞান ক্লাব আর মারামারি- সবকিছুতেই তার দক্ষতা মানোত্তীর্র্ণ ছিলো। তাঁর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেন। অনেকদিন বাদে অশ্রুভাইকে আবিষ্কার করতাম- তারুণ্যের নতুন কোন ডাইমেনশন নিয়ে ‘দিগ্বিজয়’ করে ফিরেছেন হয়তো। অত্যন্ত পরিপাটি একটি পরিবারের তিনি বড় ছেলে- কিন্তু সে অনুযায়ী দায়িত্বের বোঝা তাকে কখনো বিচলিত করেছে বলে মনে হতো না। কী এক খেয়াল চাপলো- অশ্রুভাই তখন খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের একনিষ্ঠ কর্র্মী- হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলে পরে জানা গেলো তিনি পশ্চিমবঙ্গে গেছেন নাটক নিয়ে পড়তে। বছর দুতিনেক পরে অশ্রুভাই আবার নতুন খোলসে ফিরে এলেন- এবার আর মুরুব্বীআনা নয়- আমাদের সাথে বয়সের পার্র্থক্য ঘুচিয়ে দিব্বি সিগারেট অফার করছেন- আর রাজ্যের হাসি-তামাশায়-মধ্যমনি হয়ে উঠেছেন। নাটকে অভিনয় আর নির্দেশনা- দুটোতেই অশ্রুভাই আমাদের দিল জিতে নিলেন অল্পতেই। তারপর আবার হঠাৎ করে অশ্রুভাই নেই হয়ে গেলেন…ভেবেছিলাম তিনি আবার যথারীতি তার অন্তর্র্ধানের নিয়মানুযায়ী পুনরায় ফিরে আসবেন। কিন্তু অশ্রুভাই ফিরলেন না। কোনদিনই না। শুনেছি কোলকাতার একটি নামকরা নাট্য-সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। তারপর কারা জানি তাকে মেরে ফেলেছে- কোন এক বড়লোকের কন্যার সাথে (অন্য ধর্মের হয়েও) হৃদয়জ সম্পর্কে জড়ানোর অপরাধে। …এ সবই শোনা শোনা কথা। সত্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তাঁর পরিবার থেকে অনেক চেষ্টা করেও অশ্রুভাইয়ের এমনকি লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানি না অশ্রুভাইয়ের কথা মনে করে আজও সেই নাম না জানা মেয়েটির চোখে অশ্রু ঝরে কিনা!

পিযুষ

মশলা বাটতে বাটতে শিলপাটার ধার একসময় নষ্ট হয়ে যায়- একধরনের পেশাজীবী রয়েছেন, যারা এই পাটা খোটানোর বা ধার করার কাজটা করেন। একটা ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে খুটখুট করে সারা পাটার উপরে নকশার আকারে সুন্দর করে তারা খোদাই করেন। কাজটা দেখতে দারুন লাগতো। কিন্তু খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না- পাথরের শ্র্যাপনেল ছিটকে এসে চোখে লাগতে পারে। ক্লাশ থ্রি তে থাকতে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলি- বড় হয়ে পাটা খোটানোর কাজটাকে পেশা হিসেবে নিতে হবে। পরবর্তী জীবনে অবশ্য এই লক্ষ্য অনেকবার পরিবতন করতে বাধ্য হয়েছি। রাজমিস্ত্রি হতে পারিনি বলে আমার দুঃখ এখনো কিছুটা আছে! আর মুদি দোকানদার না হতে পারাটা জীবনের এক বিরাট লস- বিশেষত, গুঁড়োদুধ যেসকল দোকানে বিক্রি হয়- আমার অবাক লাগতো ভেবে- তারা কিভাবে সবটুকু দুধ খালি খালি খেয়ে নিজেরাই শেষ করে না! ছোটবেলায় শপথ নিয়েছিলাম- চাকরি পেলে পুরো একটা গুঁড়োদুধের টিন কিনে একা একা খাবো। বলতে দ্বিধা নেই- সত্যি সত্যি কিনেছিলামও; কিন্তু ছোটবেলার ঐ স্বাদ আর পাইনি।

আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর নাম পিযুষ। কতো বয়স হবে আমাদের, পাঁচ কিংবা ছয়। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো- ওদের বাড়িতে গুঁড়োদুধের টিন থাকতো-পিযুষ হাতভর্তি দুধ নিয়ে আমার সাথে খেলতে আসতো। বড়দের একটা ম্যানিয়া ছিলো- ছোট বাচ্চাদের ইন্টেলিজেন্স টেস্ট করার জন্য ছড়া বলতে বলতো। আমার খুব লজ্জা লাগতো হুটহাট মুখস্ত ছড়া আবৃত্তি করতে। পিযুষকে জিজ্ঞেস করলে সে চটপট শুরু করে দিতো- কাঠবেড়ালী কাঠবেড়ালী পেয়ারা তুমি খাও, গুড়মুড়ি খাও…তারপরই স্বরচিত পাঞ্চলাইন: …খাবেনা খাবেনা, মাইর দেবো!!!

বরিশাল সদর হাসপাতালে প্রায় দিন পনের ভুগলো পিযুষ। শেষদিকে মায়ের সাথে আমিও একদিন দেখতে গিয়েছিলাম পিযুষকে। ঐ প্রথম আয়োডিনের গন্ধভরা পুরাতন বিল্ডিংকে মৃত্যুপূরী মনে হয়েছিলো আমার। পিযুষ শুয়েছিলো ময়লা অফহোয়াইট চাদর বিছানো লোহার খাটে। কোন কথা বলতে পারেনি আমার সাথে- ওর কালো শরীরটা শুকিয়ে গিয়েছিলো নিউমনিয়ায়। তার ২/১ দিন পরে সবাই বলাবলি করছিলো, পিযুষ মরে গেছে। …এতো বছর পর সম্প্রতি পাঁজরের হাড় ভেঙে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে পিযুষের কথা খুব মনে পড়ছিলো!

কুমীরের মাথা

কুমীরের মাথার ভেতর হাত ঢোকানোর যে কী শিহরণ- তা শৈশবেই টের পেয়েছিলাম! এই বক্তব্য কিছুটা প্রক্ষিপ্ত- কারণ আদতে তা ছিলো কুমীরের মাথার কঙ্কাল বা খুলি। এবং শহরবাসী হয়েও আমাদের এমন সুযোগ পাবার কথা নয়। কেননা, আমাদের জন্মের বহু আগেই কীর্তনখোলা নদীর কুমীর লোপাট হয়ে গেছে- ছিলো কতগুলো শুশুক। মামাবাড়ী যাবার সময় নৌকার গলুইয়ে বসে ওদের হুশ করে ভেসে উঠে মিলিয়ে যাওয়া দেখে দেখে গুনতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু কোনদিনই গুনে মেলাতে পারতাম না, কারণ সংখ্যায় ওরা ছিলো প্রচুর। একসাথে তিনচারটা কালো তেলতেলে শরীর নিয়ে লাফিয়ে উঠেই মিলিয়ে যেত। নৌকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে ওরা আসতো। মায়ের যন্ত্রণায় শান্তিমতো উপভোগ করার জো ছিলো না। তিনি নদীর পাড়ের মেয়ে হয়েও নিজে সাঁতার জানতেন না বলে নদীতে ডুবে যাবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে নৌকার ভেতর বসে থাকতেন। আমাদেরকেও আটকে রাখতেন। এহেন নিয়ন্ত্রিত শৈশবে একটি কুমীরের মাথা নিয়ে ‘গবেষণা’ করতে পারার সুযোগ নেহাত কম নয়। খেলাঘরের প্রদর্শনীতে এটা রাখা হয়েছিলো- আর আমার উপর সেটা ডেমনেস্ট্রেট করার ভার পরেছিলো। আমার শৈশব-কৈশোরকালের প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে খেলাঘর!শিশুদের ভেতরে সাংস্কৃতিক বিকাশের সাথে সাথে নিয়ম, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্ব তৈরি করতে এমন সংগঠনের বিপুল ভূমিকা ছিলো। নিয়মিত প্যারেড-পিটি, খেলাধুলা, গানবাজনার পাশাপাশি বছরান্তে একটি সম্মেলনের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। দুই বা তিনদিনব্যাপী লাগাতার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ‘ভাইবোনদের’ হাতের কাজের প্রদর্শনী করা হতো পাবলিক স্কুলের ঘরগুলো পুরোটা ব্যবহার করে। চেষ্টা করা হতো প্রতি বছরেই নতুন কিছু উপকরণ তৈরির। সম্ভবত আশি সালের কথা- সম্মেলনের আগের দিন শেখর দা কোত্থেকে যেন ঐ কুমীরের মাথাটা নিয়ে হাজির। স্থানীয় জালিয়াবাড়ীতে তাঁর বাড়ীর পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে খাল- যেখানে চারপাঁচটা পোষা উদ্বিড়াল সারাক্ষণ ডুবোডুবিতে ব্যস্ত থাকতো! শেখরদা নাকি খালে স্নান করতে নেমে ঐ কঙ্কালটা পেয়েছিলেন। এখন বুঝি, ওটা ছিলো একটা এলিগেটর বা মেছো কুমীর- নাকের ডগাটা অনেক লম্বা। কঙ্কালের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আমরা ওর অবশিষ্ট নড়বড়ে কয়েকটা দাঁত নিয়ে মজা করতাম। ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো ঐ কুমীরের মাথাটা। লোকজন ওটার পাশে ভিড় করে বিভিন্ন সম্ভাবনা ব্যক্ত করতেন। তৎকালীন নারীনেত্রী শ্রদ্ধেয়া মনোরমা বসু মাসীমা তাঁর বক্তৃতার শেষে এজন্য শেখরদাকে একশত টাকা বকশিস দিয়েছিলেন, এটা মনে আছে। কিন্তু এরপর কুমীরের মাথাটা নিয়ে কী করা হয়েছিলো তা আর জানতে পারিনি। খেলাঘরটিও কয়েকবছর পরে আস্তে আস্তে অকার্যকর সংগঠনে পরিনত হয়ে অবশেষে নেই হয়ে যায়। শত খুঁজেও আমরা এখন আর একটা কুমীরের মাথা জোগাড় করতে পারবো না…!

গোলট্যাক্সি

বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটি পরিচালিত মল-অপসারণের গাড়িগুলির কথা বললে একালে কেউ বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ। আফসোস হচ্ছে- অনেক চেষ্টা করেও অমন একটি গাড়ির ছবি আমি জোগাড় করতে পারিনি। স্থানীয় মেথরবাড়ীতে সেগুলো থাকতো। একটা দশাসই ড্রামের পেটের কাছে মুখ-কাটা, আর আড়ভাবে জুড়ে দেয়া গরুর গাড়ীর সাথে। এর সঙ্গে থাকতো অদ্ভুত আকারের একটা বালতি। আজীবন দেখেছি বালতির উপরের অংশটা নীচের অংশের থেকে চওড়া হয়। ওদের বালতিটা ছিলো উল্টো। নীচে অনেক প্রশস্ত আর উপরের মুখের দিকটা সরু। দেখে মনে হতো উল্টানো। ছোটবেলায় ঐ গাড়ী অনেক দেখেছি। ঢিমে তালে অত্যন্ত মুড নিয়ে (মুডতো নেবেই, গাড়ীভর্তি গু নিয়ে তো আর হাসতে হাসতে চলাফেরা করা যায় না!) মেথরপট্টির পেইড-পরিচ্ছন্নকর্মীরা ওই গাড়ী চালিয়ে আসতো। এসে ধন্য করতো। কারণ, যাদের ‘সেপটিক ট্যাঙ্ক’ ভরে গেছে- তারা জানে কী বিপদে পড়েছে! রাস্তা আপসে আপ খালি হয়ে যেতো। কারণ মেইনট্যানেন্সের অভাবে কিংবা বেখেয়ালে- যে কারণেই হোক- অধিকাংশ ড্রামের মুখের ঢাকনা থাকতো না। লোকজন ওই গাড়ী দেখলেই নাকে রুমাল চেপে দৌড় লাগাতো। অতি উৎস্যুক কেউ কেউ চালককে জিজ্ঞেস করতো- ভরা, না খালি? আর এ প্রশ্নের যে উত্তর পেতো তা আর লেখার যোগ্য নয়। ওরা একটু ভিন্ন ভাষায়-ভিন্ন উচ্চারণে- উর্র্দু-হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলতো। সন্ধ্যা হলে ওরা নিজেদের হাতে বানানো মদ গিলে ব্যপক গানবাজনা করতো। লুকিয়ে লুকিয়ে বহুদিন আমরা ঐসব দেখতে গেছি। বড় হয়ে গেছি শুয়োরের ছবি তুলতে। অনেক শুয়োর পালতো ওরা। সে যা-ই হোক, আমাদেরও একটা আদ্দিকালের ল্যাট্রিন ছিল, চুণ-শুরকির ছাদঢালাই দেয়া। এখনো আছে- পরিত্যক্ত। জিনিসটার উপস্থিতি জমির ম্যাপের ভেতরে নির্দেশিত বলে মা ওটা ভাঙতে চান না। আমরা সম্মান করে বলতাম ‘-মন্দির’। বাবা মাঝে মাঝে পৌরসভায় নির্দিষ্ট ফরম পুরণ করে মেথর আসার আবেদন করে আসতেন। ওরা আসতে গড়িমসি করতো। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছালে তবে আসতো। আহ্ কী ভাব তখন তাদের, হাঁকডাক আর হম্বিতম্বি করতো। ঐদিন আমাদের- ছোটদের, গৃহবন্দী থাকতে হতো- কারণ মায়ের ছিলো ভয়ানক শুচিবাই। তারই ফাঁকফোকড়ে ওদের কর্র্মকাণ্ড দেখতাম লুকিয়ে। খুব সাবলীলভাবে ওরা কাজটা করতো। সেফটি ট্যাঙ্কের ওপরের গোল স্ল্যাবটা উঠিয়ে ওদের একজন ঐ আজগুবি বালতি ভরে তুলে আনতো- আর একজন সেই বালতি ঢেলে দিতো গাড়ীর ড্রামে। ওদের নাক ঢাকতে হতো না। কথা বললে ওদের মুখ থেকে বিকট দুর্র্গন্ধ পেতাম- পান্তা পচিয়ে বানানো দেশি মদের। অন্যসব গন্ধ তার কাছে তুচ্ছ! তো, কাজ শেষ হবার পর খানাপ্রধানকে একটা কাগজে সই করে দিতে হতো পরিমানসহ। নিরক্ষর মেথর-সর্র্দার বাবাকে বললেন, “লিখিয়া দেন ইধারসে ম্যেথর আসিয়া দুইগাড়ী গু ল্যইয়া গেসে”। আমাদের নীতিবান বাবা বললেন, “কই, একগাড়ী এনেছ যে?” সর্দার সংশোধন করে বললেন, “তাইলে লিখিয়া দেন ম্যেথর আসিয়া এক্ক গাড়ী গু ল্যইয়া গেসে”। বাবা চটে উঠলেন- “একগাড়ীওতো হয়নি, যা নিলে…”। সর্দার পুনরায় ঠিক করে বললেন, “তাইলে বাবু খিকখেন, ম্যেথর আসিয়া আধাগাড়ী গু লিয়া গ্যেছে…।

এখন ভাবি, দুইগাড়ী লিখলেই বা কী ক্ষতি ছিল? হীরা-জহরত তো আর নেয়নি, কেবল গু-ই তো!

টেরাক

লক্কর-ঝক্কর ট্রাকটা এসে ল্যান্ড করলো ঠিক আমাদের দাড়িয়াবান্ধা আর ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্টের উপরেই। শালা আর জায়গা পেলোনা। কিন্তু যাবেই বা কোথায়? পাবলিক স্কুলের পুরো মাঠটাতেই তো একহাঁটু প্যাঁচপেচে কাদা। ওখানে নামার প্রশ্নই আসে না। আমরা ভাবছিলাম হয়তো মাল আনলোড করেই ওটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে যাবে। কিন্তু ট্রাকটা তো খালি! হেলপার চালিয়ে এসেছে- ২/১ জন লেবার যারা ছিলো, নেমে কোথায় যেন গেল আর ফিরে এলো না। এলো না তো এলোই না। যাবার সময় দুয়েকটা কাজের জিনিস যেমন, ইঞ্জিন কী আর জেড আকৃতির ক্রাঙ্ক হ্যান্ডেলটা নিয়ে গেলো। সে আমলে ওটা ট্রাকের সামনে রেডিয়েটরে নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে প্রবল বেগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্র্ট করাতে হতো। আমাদের ঐ বয়সে গার্জেনবিহীন একটা ট্রাক তো মহা কৌতুহলের বস্তু! প্রথমে সদলবলে ওটার পেছনের ক্যরিয়ারে উঠে আমরা দাপাদাপি করলাম। তাতে শান্তি হোলো না। এরপর সাহস করে ওটার ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্ট ধরে টানলাম। আরে, দরজা তো আটকানো নয়। তাহলে তো ট্রাকটা চালানোই যাবে। মুখ দিয়ে ভ্রভ্রভ্ররররররররররর শব্দ করে আর স্টিয়ারিং এলোমেলো ঘুরিয়ে কিছুদিন ট্রাক ড্রাইভার খেলা হলো। সহিদ তার মধ্যে বেশ কায়দা করে তালে তালে বলছে, ‘অকুপাইডস, অকুপাইডস’। শব্দটা তখন আমরা কেবল শুনেছি, কিন্তু মানে জানতাম না। এরপর শুরু হলো অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং! ড্যাশবোর্ডের প্লাস্টিক-মেটাল আউটফিট ভেঙেচুড়ে ওটার নাড়িভূড়ি বের করতে আমাদের বেশিদিন লাগলো না। এরপর সিটের নামকাওয়াস্তে গদি খুটে খুটে সর্র্বনাশ করা হলো। কেউ কেউ ওটার ছাদে উঠে উদ্দাম অঙ্গভঙ্গী করে বেশি মজা পেত। এমনি করে করে ট্রাকটা আমাদের প্রতিদিনের খেলার অপরিহার্র্য উপকরণে পরিনত হলো। ‘পলাপলি’ খেলায় ওটার নীচে মাটির গভীরে বসে যাওয়া ফাঁটা টায়ারের আড়ালে কিংবা ড্যাশবোর্ডের ‘গুহায়’ লুকানোর চমৎকার যায়গা আমরা খুঁজে পেতাম। এবং ততদিনে বুঝতে পেরেছিলাম- ট্রাকটা পরিত্যাক্ত। কেউ কেউ পুকুরে গোসল শেষে ওটার ছাদে লুঙ্গী শুকাতো। দুপুরে ভাত খেয়ে বড়ই আমলকি নিয়ে ট্রাকের ভেতরে বসে খেতে খেতে চমৎকার আড্ডা জমানো যেতো। ততদিনে লক্ষ করেছি ট্রাকের অনেক যন্ত্রাংশ উধাও হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। চাকা আর সামনের টারিট বাদে পেছনের কেরিয়ারটা পুরোটাই লোপাট। ভেতরে স্টিয়ারিং ছাড়া আদতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কিছু ইলেকট্রিক তার কিলবিল করে বেহুদা ঝুলে আছে। মিটারের গর্র্তগুলো খালি পরে আছে… অন্তত মাস ছয়েক চলে যাবার পর- যখন ট্রাকটার উপস্থিতি আমাদের কাছে সয়ে গেছে এবং উদাসীন হয়ে গেছি- তখন একদিন সকালে ট্রাক কিংবা ট্রাকের কঙ্কাল খণ্ড খণ্ড করে খুলে কয়েকটা লোক ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেলো। চলে যাবার পর যায়গাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিল। আমরা তাকিয়ে দেখলাম নীচে লম্বা লম্বা হলুদ ঘাস গজিয়েছে…!

ফাদার রিকবি

ফাদার রিকবি প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমাদের পাড়ায় আসতেন গল্প করতে- তাঁর আঠাশ ইঞ্চি ফনিক্স সাইকেলে চেপে। মাঠে দাঁড়িয়াবান্ধা আর ফুটবল খেলতে থাকা ছেলেমেয়েরা তাকে দেখতে পেলেই হইহই করে সাইকেলের পেছনে জড়ো হতো। কেউ কেউ আরও বিরক্ত করতো- ক্যারিয়ার টেনে ধরতো পেছন থেকে, সাইকেলে উঠতে চাইতো। ফাদার কোনমতে তাদের ম্যানেজ করতেন। নেমে পড়ে সাইকেল ধরে হেঁটে হেঁটে এগোতেন। পাড়ার ২/১টা বাড়ীতে তার গতায়ত ছিলো বেশি। কিন্তু এর বাইরে মিশতেন সকল পিচ্চি-পোলাপানদের সাথে। ধবধবে সাদা পাদ্রিদের ঢোলা পোশাক আর কোমরে বাধা মোটা উলের কালো কর্ড আর কালো টুপিতে তাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাতো। আগোছালো শব্দচয়নে পরিষ্কার বাংলা বলার চেষ্টা করতেন উনি। আমরা তাঁর আরষ্ঠ উচ্চারণ শুনে হ্য হ্য করে হাসতাম, হেসে গড়িয়ে পড়তাম। ফাদার অপ্রতিভ হতেন- মাইন্ড করতেন না। এমনকি পেছন থেকে অনেক বখে যাওয়া ছেলে-ছোকড়ারা তাকে ‘শাদা-বান্দর’ বলার পরেও- ফাদার যে বুজতেন না, তা নয়।

এলাকার দুটি তরুণের সাথে ছিলো তাঁর প্রকৃত ফ্রেন্ডশিপ। আমার বড়দা ( পরলোকগত ডাঃ দেবাশীষ সমদ্দার) আর তোতাভাইয়ের (Enayet Karim) সাথে। কারণ, এঁদের দুজনের মাথাতেই তিনি ডাকটিকেট সংগ্রহের পোকাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বিশাল সংগ্রহ ছিলো তাদের ডাকটিকেট, ভিউকার্ড, কয়েন আর ফার্স্টডে কভারের। ফাদার নিয়মিত আমাদের বাসায় আসতেন। বাঙালী খাবার পছন্দ করতেন খুব। খেলা থেকে বাসায় ফিরে মাঝে মাঝেই দেখতাম ফাদার মুড়ির মোয়া খাচ্ছেন কিংবা পুঁইশাকের ডাঁটা চিবুচ্ছেন সন্তর্পনে। আমাকে কেনো যে ডাকতেন ‘ধাঁধাল’ বলে- সেটা আজও রহস্য। কারণ, প্রাইমারী লেভেলের ঐ বয়সটা ঠিক ধান্ধালী করার বয়স নয়। সম্ভবত দুষ্টু, চালাক, চঞ্চল ইত্যাদি শব্দের পরিপূরক হিসেবে তিনি ওটা কারো কাছ থেকে শিখে থাকবেন।হঠাৎ করেই ফাদারের আসা বন্ধ হয়ে গেলো। তিনি থাকতেন অক্সফোর্ড মিশন এর ভেতরে। একরাতে কারা যেনো তাকে মেরে ফেললো। দিনদুয়েক পরে পার্শ্ববর্তী একটি পুকুর থেকে তাকে উদ্ধার করা হলো। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার পর কম্বল পেঁচানো তাঁর লাশ সাইকেলের সাথে বেঁধে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো!এতোবছর পর আজও ফাদারের জন্য দুঃখ ও গ্লানি বোধ করি। পরপারে ভালো আছেন নিশ্চয়ই ফাদার!

(ফাদার রিকবির মৃত্যুর কিছুদিন পর বরিশালের কোন এক স্মরণিকায় এই ছবিটি বড় করে ছাপা হয়েছিলো।)

 

কালী

বার্ধক্যজনিত কারণে কালীকে বিদায় করতে হলো। ওর যৌবনগত হয়েছে, হাঁটতে, চিবুতে কষ্ট হয়-চোখেও বোধহয় কম দেখে- আমাদের পরিবারের তখন তেমন বিলাসীতা করার সময় নয় যে একটি উপযোগিতাহীন গৃহপালিত প্রাণীকে বৃদ্ধাশ্রমের আয়োজনে বসিয়ে রাখি। বিশেষত, যখন বর্ষা মৌসুমে খড় একদম পাওয়া্ যায় না। শহরে বসে গরু পালনের রেওয়াজ তখন উঠে যাচ্ছে- অন্যান্যরা বেচে দিয়েছে- কেবল আমরা্ দুধের লোভে… বাবা একদিন কোত্থেকে এক উটকো লোককে ধরে আনলো- আর লোকটা দড়ি খুলে কালীকে নিয়ে চলে গেলো! গরু বিক্রিবাটায় একটি রেওয়াজ হলো- বিক্রির পরেও পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য গিয়ে দড়ি ধরলে তাকে টাকা দিয়ে নিবৃত্ত করতে হয়। ভেতরের ঘরের ন্যাড়া চকিটাতে হাফপ্যান্ট খালিগায়ে উপুর হয়ে ঘুমের ভানে পড়ে আছি আমি। মা এসে তাড়া লাগালো আমি যাতে দড়িটা একবার গিয়ে ধরি- তাহলে অন্তত শ’খানেক টাকা সম্মানী পাওয়া যাবে। কিন্তু কালীর জন্য এমন টাকা নিতে আমার বয়ে্ই গেছে! ওর ঘাড়ে যখন একটা চিরস্থায়ী ঘাঁ তৈরি হলো- সেখানে যাতে মাছি না বসে সেজন্য ‘বোরোলিন’ আর তিব্বত পাউডার মেখে দেইনি আমি? ওকে নিয়ে ঘাস খাওয়াতে কতো দূর-দূরান্তে চলে যেতাম, কতো লোকের বকা খেতাম তাদের ক্ষেতে-বাগানে ‘মুখ দিয়েছে’ বলে। মাঝে মাঝে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো-ওকে বলতাম তাড়াতাড়ি চল কালী-আমার ভয় করছে। জন্তুটা খুব্ বিবেচকের ভঙ্গীতে আবছা আদুড়ে একটা ডাক দিয়ে দ্রুত পা চালাতো। ওকে নিয়ে আমার সব স্মৃতিকে একশো টাকায় আমি বিকোতে পারি? ইচ্ছে করছিলো দড়ি ধরে চিরদিনের জন্য ওকে রেখে দেই। কিন্তু আমার সে অনুভূতি যদি সবার চোখে আধিখ্যেতা মনে হয়, সেই ভয়ে লাজুক আমি…। সম্ভবত আটশো টাকায় কালীর সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতি ঘটলো। ও চলে যাবার পর বাবা-মার আক্ষেপ আর আফসোসে বুজলাম যারা কিনেছে- তারা পালার জন্য নেয়নি। আমি ঘুমিয়ে আছি ভেবে বাবা চাপাস্বরে মাকে বললেন- বাজারে নিয়ে যাবে ওকে- ‘কাটবে’!

পাঙ্গাসকাকু

গায়ে ঘাম। খেলার মাঠ থেকে ফিরেছি ধুলোবালি একাকার করে। কাদামাখা খালি পা। ঝরের বেগে ঘরে ঢুকেছি, উদ্দেশ্য মাটির কলসের ঠান্ডা জল খাবো। কিন্তু ঘরের ভেতর ন্যাড়াচৌকিতে পা তুলে যে লোকটি বসে আছেন হাফহাতা গেঞ্জি লুঙ্গি পড়ে, হাতপাখায় বাতাস খাচ্ছেন, তাকে দেখে কুন্ঠিত হলাম। মা রাগত স্বরে কিকি যেনো বলছেন, সেসবের তোয়াক্কা না করে লোকটির পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। তিনি হাহা করে উঠে ধরে কাছে টানলেন। পেন্নাম করোন লাগবে না, বাবাজি কোথায় আছেলা? মা এখন তাঁর কাছেই নালিশ জানালেন, দেহো পাঙ্গাস, পড়াশুনার নাম নাই, হারাদিন আঁদাড়েপাদাড়ে…!

হ্যাঁ, পাঙ্গাসকাকু। বাবার আপন ভাই নন। এমনকি তুতোভাইও নন। একই গ্রামে বসবাসকারী, কিন্তু কাকু বলতে তাকেই বুঝতাম আমরা, যেহেতু বাবার কোনো আপন ভাই নেই! এই বিদঘুটে নামের সঠিক কার্যকারণ রয়েছে। পাঙ্গাসকাকু চোখে পড়ার মতন ফরসা ছিলেন, আর ঠোঁটদুটি অস্বাভাবিক পুরু প্রশস্ত আর লাল! হয়তো সেকারনেই এমন নাম। এমনি আরও অনেক কাকুর আনাগোনা লেগেই থাকতো আমাদের বাসায়। মোনাকাকু, ধলুকাকু, মোহনকাকু….সব কাকুদেরই বরিশালে আমাদের বাড়িতে লাগাতার পদার্পন ছিলো বিভিন্ন কারণে। তার ভেতর একটা প্রধান কারণ ছিলো ডাক্তার দেখানো। বড়দা তখন ইন্টার্নি করছে শেবাচিমহা তে। তাতে কী, গ্রামের মানুষের কাছে সেটাই বড়-ডাক্তার! সমস্যা কী কাকু? বড়দা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতো রোগের উপসর্গ। তারা তাতেই অর্ধেক ভালো হয়ে যেতেন। মাকে বলতেন, বৌদি, খোকন যে কয়ডা “ফরমুলা” জিগাইলে, মোগো গেরামের ডাক্তারেতো হেকয়ডা জিগাইলেনা!”

কাকুদের আরও একটা কারণে টাউনে আসতে হতো। কেসের তারিখ পড়লে বা জমি “লাগানোর” টাকা দিতে। কেস মানে জমিসংক্রান্ত মামলা, জানতাম, কিন্তু জমি লাগানোর ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না (এখনো বুঝি না :)।  জমি কি চারাগাছ, যে লাগাতে হবে? তবে এর সাথে টাকাপয়সা জড়িত, সেটা বুজতাম, মায়ের অসন্তুষ্টিতে! বাবাকে প্রেশার দিতেন, “এইবার এতো কম টাকা দেছে কেন্? আমাগো জমিতে ধান কি কম ওডে? কতগুলা গাছ! পুষ্কনির মাছতো সব ওরাই খায়!” বাবা চেপে যেতেন, বাদ দাও, গরীর মানুষ!… তা শুনে মা আরও চটে যেতো!… আমরা কি জমিদার? শ্বশুড়ে জমি করছে হালুডি কইররা। তুমি সব বিলাইতে আছো!”
” আহ্ থামো তো, শুনবে!” বাবা চাপাস্বরে বলতেন। কাকুরা বারান্দার চৌকিতে শুয়ে সবই শুনতেন, না শোনার মত। বাবা কখনো মায়ের প্ররোচনায় তাদের কিছু বলতেন না। একটু বড় হবার পর, বাবার ওপর বেশ রাগ হতো এজন্য। বাবা বছরে একবার বাড়ি যেতেন, চেঁচরি, তেলিখালি, কৈখালি, মইষপুরা, বোত্লা  এইসব নাম শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। যাওয়া হয়নি কখনো। বিভিন্ন অঞ্চলে জমি ছিলো আমাদের। মা মাঝেমাঝে তাল দিতো, এইবার তুকুরে নিয়া যাও, ওর পরীক্ষা শেষ, বাড়ি যাউক তোমার লগে। বাবা রাজি হতেন না। কারণগুলো পরে জেনেছি। দেশে আমাদের বাড়িঘর ছিলো না। অন্যের বাড়িতে নিজে যেভাবে থাকেন, ছেলেকে সেখানে নিতে চাননি। বাবার এই বাবাসুলভ অনুভুতিটার খবর মা কোনদিনই তলিয়ে দেখেননি। অগত্যা ক্যাম্বিসের চামড়ার ব্যাগে দু একটা লুঙ্গি গামছা চশমা, দু ব্যাটারির টর্চলাইট আর ক্ষৌরি করার যন্ত্রপাতি ভরে ছাতাসমেত বাবা একতলা কাঠবডি চরদোয়ানির লঞ্চে চড়ে বসতেন। নামতেন হুলারহাট বা ভান্ডারিয়া। আঠালো কাদায় গদগদে কাঁচা রাস্তায় মাইল দশেক যাবার পর সন্ধ্যাসন্ধ্যি গ্রামে ঢুকলে কাকীরা শঙ্খে ফুঁ বা তুলশীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে বাবাকে দেখে একহাত ঘোমটা টেনে “দাদা, আইছেন?” বলে মাটিতে গড়প্রণাম করতেন!

সপ্তাখানেক পর রুক্ষু চেহারা নিয়ে বাবা ফিরতেন একব্যাগ সুপারি, কলার মোচা, সেরদুয়েক রাই সরিষা, হাতেভাজা মুড়ি, খইয়ের ধান আর কিছু টাকা নিয়ে। মায়ের জেরা শুরু হতো তখন। বাবা দশ কথার একটা হয়তো উত্তর দিতেন। মা গজগজ করেই যেতেন, যে কম টাকায় বন্দোবস্ত নেয়ার কথা বলে গেছেন কাকুরা, দিয়েছেন তারও অর্ধেক। “তুমি কিছু কইতে পারলা না?”

– কি বলবো? বাবা কাঁধ ঝাঁকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে শ্রাগ করতেন। দেশের মানুষের হাতে টাকা নাই তো! মোনার পোলাপানগুলি ইস্কুলে যায়…!

আমার এমন বোকাবাবাকে আমার মা, আমরা কেউই কোনদিন বুঝিনি।