পর্ব ২: অব্যক্ত প্রেমের বিলাপ
ঢাকা শহরে যারা প্রেমিকাকে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ভুল করে ফুপুশাশুড়ীকে পাঠাবেন, তাদের জন্য আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে রাখি- ভুলেও লাইটপোস্টের নিচে ফুটপাতে বসবেন না, এমনকি দাঁড়াবেনও না! ভাইরে ভাই! এই বদমাশ কাকগুলো তক্কে তক্কে থাকে, উপযুক্ত ‘গ্রাহকের’ আশায়! গ্রাহক পেলেই তারা টার্গেট করে। খোদার অশেষ মেহেরবানিতে এ যাত্রা বেঁচে গেছি! মাথায় ইয়ে করতে চেয়েছিলো, একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে! ছোটন, তোমাকে আরও সাবধানী হতে হবে! নিজেকে নিজেই বললাম শান্তনার সুরে!
হনহন করে হাঁটার সময় কি হনহন শব্দ হয়? আমি এখন হনহন করেই হাঁটছি। আপদবালাই থেকে যতো দূরে সরে যাওয়া যায়, ততোই মঙ্গল। কিন্তু এই ধরাধামে আপদের কি শেষ আছে? দোকান ঘেঁষে হাঁটছিলাম- এক দোকানের কর্মচারী হুট করে একটা পাপোষ ঝেড়ে দিলো আমার মুখের সামনেই! শইলে কেমনডা লাগে! ডালকুকুরের মতো একটা লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। থাক তোরা তোদের ফুটপাতের দখল নিয়ে! একটু পর রিকশা নিলাম। বলা ভালো, রিকশাই আমাকে নিলো। উদাসী আমাকে দেখে রিকশাচালক নিজেই ডাক দিলেন, মামা কৈ যাইবেন?
একটা জিনিস হয়তো আপনাদের অনেকেরই নজরে পড়েছে, ঢাকা শহরে যতো রিকশাচালক আছেন, তাদের এক তৃতীয়াংশই দার্শনিক! কতো নিবেন, জিজ্ঞেস করলে ভীষণ ধোঁয়াটে উত্তর পাওয়া যায়! যথা, দিয়েন ইনসাফ কইরা, যান না সবসময়? ইত্যাদি। আপনাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়ে তারা আসলে আপনার পার্চেজ ক্যাপাসিটিই পরখ করেন। এই রিকশাওলা অবশ্য তেমন নন, ভীষণ প্রাকটিক্যাল। উনি লোকেশনটা জেনে নিয়ে ডিস্ট্যান্স আর টাইম ক্যালকুলেট করলেন, তার সাথে মার্জিন অব এরর আর সিস্টেম-লস যোগ করে তারপর রেজাল্ট জানালেন- জেনুইন ভাড়া একশো, কিন্তু তিনি আশিতে যেতে রাজি আছেন, কারণ তার রিকশার গ্যারেজ ওদিকেই! তো আমাদের যৌথযাত্রা শুরু হলো।
কোথায় যাচ্ছি, জানতে চান? সুরীটোলায় দিনেশ চন্দ্র বসাক লেনের কানাগলির মাথায় এক ভেঙে পড়োপড়ো বাড়ির পাঁচতলার চিলেকোঠা – সেই চিলেকোঠারও একতলা ওপরে প্লাস্টারছাড়া ওয়ালঘেরা টিনশেড এক গুমটিঘরে থাকে আব্দুল জব্বার! আমার বিশিষ্ট বন্ধু! সে অবশ্য তার নাম পাল্টে মোহিত প্রবারণ রেখেছে! এই নামের অর্থ কী, সেটা জিজ্ঞেস করলে সে প্রশ্নকারীর অজ্ঞানতায় ব্যথিত হয়ে করুণার চোখে গৌতমবুদ্ধের মতো তাকায়, কিন্তু কিছুই বলে না। ইদানিং সে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছে। তাই কাব্যিক নাম দরকার। অবশ্য মার্কেটে তার ‘জব্বারস গাইড’ বেশ চলছে ইদানিং। ‘প্লে-গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল বিষয়ের জন্য বাবামাদের আস্থার নির্ভরযোগ্য গাইড- জব্বারস গাইড!, মিতুল প্রকাশনী, ৩১ বাংলাবাজার, ঢাকা’ – এহেন বয়ানে জব্বারের কপি-পেস্ট নোটবইগুলো বিজ্ঞাপন ছড়ায়! কামাচ্ছে ভালোই, কিন্তু জব্বারের খাসলতের মেলা দোষ আছে। একে তো মহাকিপটা, তার ওপরে বিদঘুটে সব কান্ডকারখানা করার কারণে বেশ কিছু মেসমেটদের দ্বারা অতীতে সে বিভিন্ন সময়ে বিতাড়িত হয়েছে। এখন এই চিলেকোঠার টংয়ের ওপরে একা একা ঘুঘুরগান করে! এইচএসসিতে আমাদের ম্যাথ পড়াতেন ‘অতএব’ স্যার (আসল নাম ভুলে গেছি, প্রতি কথায় অ-তৈ-এ-ব শব্দটা চ্যাপ্টা করে উচ্চারণ করতেন বলে এই উপাধী তিনি অর্জন করেছেন, ছাত্রদের কী দোষ?)। সেই স্যারকে বশ মানিয়ে জব্বার এখন মিতুল প্রকাশনীর মালিক। তবে ওর একটা অসামান্য দিক হলো আমাকে দেখলে নির্ভেজাল খুশি হয়। দুটো কারণে, এক – আমার থেকে টাকা খসাতে পারবে সেই আনন্দে, দুই – বন্ধুদের মাঝে আমাকেই সে একমাত্র বিশ্বাস করে মনের কথা বলে। ও খুব ভালো করেই জানে আমি কাউকে কথা বেচে বেড়াই না। তাই ওর বাড়ীউলি ইলাবৌদির সাথে ঘনিষ্টতার খবরও আমার সাথে সে শেয়ার করেছে।
জব্বারের বিল্ডিংটা আধুনিক স্থাপত্যকলার এক বিরল নিদর্শন। সুলতানী আমল থেকে এ পর্যন্ত সব যুগের স্মৃতিচিহ্ন ও উপকরণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ফ্লোরে পাথরের স্লাব, মোজাইক, বাংলাসিমেন্ট, টাইলস- মোটকথা যখন যেটা পাওয়া গেছে, সেটাই বাছবিচার না করে লাগানো হয়েছে! সিঁড়িটা অবশ্য বেশ প্রশস্ত। এক বারে একজন হেঁটে উঠতে পারবে কোনোক্রমে। দুজন মুখোমুখি হলে কোলাকুলি না করে পার হওয়ার কোনো উপায়ই নাই! সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমি ভাবছিলাম প্রবারণ সাহেব আছেন তো?
আমাকে দেখে জব্বার জব্বর খুশি হলো! রসগোল্লার মতো চোখ গোল করে বললো,
– পোতোন আয় আয়, অনেকদিন বাঁচবি! ইলাবৌদিকে সেদিন তোর কথা বলছিলাম!
আমি রাগ আর প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম। নাম বিকৃত করা ওর হেবিট। আমাকে ডাকে পোতোন চৌধুরী! টেবিল থেকে খাতা তুলে বললো, কাল রাতে কবিতা লিখেছি, তোর জন্য, এই দ্যাখ:
কবিতার নাম: অব্যক্ত প্রেমের বিলাপ
‘রাস্তায় অপলক দেখি মানুষ আর মানুষ।
তুমি কি একটা ফানুস?
চলে যাবে যদি হে সুন্দরী প্রিয়তমা মহিষ
ভালো বাসলে কেনো, জড়ালে একি বন্ধনে
তব নক্ষত্র সহিস….!’
বিশাল কবিতা। শেষই হয়না! আমি একপর্যায়ে ওকে থামালাম। মহিষ নয়, মহিষী! মানে স্ত্রী। জব্বার অপ্রস্তুত না হয়ে চটপট বানানটা ঠিক করে নিলো। ইতোমধ্যে নাস্তা এলো (আমার টাকায়; ওর কাছে ১০০ টাকার খুচরা নেই বলে! কখনোই থাকেনা অবশ্য)। আমার চাকরি কেমন চলছে, দেশের বাড়িতে আম্মা কেমন আছেন, ইত্যাদি আলাপ শেষে সে অবধারিত প্রশ্নটি করলো,
– তারপর? কেমন আছে তোর মায়াবড়ি?
– জব্বাইরা, তোর মাথা ফাটাবো! ফের যদি ওইভাবে ডাকিস।
– তুই যতোদিন আমাকে পরিচয় করিয়ে না দিবি, ততোদিন ডাকবো! আচ্ছা বল, মায়াভাবী কেমন আছে?
ওর মুখে ভাবী শুনে আমি যেনো কেমন হয়ে গেলাম। বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো। মায়াবতী কি বোঝেনা আমার মনের কথা? এটা সত্যি, আমি বিষয়টা ঠিকঠিকভাবে তার সামনে বলতে পারিনি। পারার কথাও নয়। সুন্দরী মেয়েদের সামনে আমি একদমই কম্ফোর্টেবল নই। আমার মফঃস্বলী লাজুক মানসিকতার কারণে তাকে কফিশপে ডেটে নিয়ে যাওয়ার মতো স্মার্ট হয়ে উঠতে পারিনি, এটা সত্যি। কিন্তু জানটা যে কোরবান করে দিয়েছি তা তো মিথ্যা নয়।…
মেসেজ-বিভ্রাটের সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলো জব্বার। আমাকে আকাট মূর্খ বলেও গালি দিলো। তারপর হঠাৎই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-
– তুই এতো ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেনো? এটা বরং ভালোই হয়েছে। তুই মায়াবতীকে মুখ ফুটে বলতে পারিসনি এতোদিন, এখন সেজোখালার কাছ থেকে জেনে যাবে!
– খালা না, ফুপি!
– ওইত্তেরি! তোর কান্ডজ্ঞান হবে কবেরে এ্যা? খালা হোক আর ফুপিই হোক, উনি এখন ভাস্তিকে প্রটেক্ট করতে গিয়ে বিষয়টা পাবলিক করে দেবেন, বিচার বসাবেন! চড়থাপ্পড় কিছু জুটতে পারে, কিন্তু আখেরে লস নেই। ফলাফল কী হবে বুজতে পারছিস? কিরে, গাড়লের মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?
জব্বারের কথা শুনে আমার মেরুদন্ডে হিমস্রোত বয়ে গেলো! কল্পনায় এবার দেখতে পাচ্ছি সেজোফুপি আমার কলার ধরে ধাইধাই করে চড় মারছে আর বলছে, “বদমাশ ছেলে, আর করবি?’
পর্ব ৩: ব্যাঙ্গুট
প্রেমে পড়ার বহিঃপ্রকাশের যতোগুলো ভার্সন সেলুলয়েডে আছে, তার ভেতর সবচে নির্ভরযোগ্য মনে হয় তেলেগু ছবির এক্সপ্রেশনটি। নায়িকা সেখানে আনন্দের ঠেলায় এক লাফে আমগাছে উঠে পড়ে, আর নাচতে নাচতে আপেল খায়! অবশ্য প্রেমপত্র পেয়েই দৌড়ে গিয়ে বালিশে হুমড়ি খেয়ে পড়া কিংবা কাঁখের কলসকে জড়িয়ে ধরে গীত গাওয়ার মধ্যে যে প্রেম অনুপস্থিত, সেটা আমি বলছি না। ওইসব দৃশ্যে মায়াবতীকে কল্পনা করে ভীষণ হাসি পেলো আমার। কিন্তু ঠিক হাসার মতো অবস্থায় নেই আমি এখন! গম্ভীর হয়ে বসে আছি। সামনে আমার টিনএজ ছাত্রী, অন্তি!
রুমে তৃতীয় আরও একজন আছেন, যিনি ভীষণ মুখ গোমড়া করে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। বলা ভালো, নজর করছেন। তিনি জনৈক বেড়াল! হাবভাবে সেজোফুপির মতোই অনেকটা। প্রথমদিন থেকেই দেখছি বেড়ালটার মেজাজ খারাপ। আমার দিকে খুবই তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়। ভাবখানা এমন, হুহু বাবা, সব নজর করছি, একটু ইদিক উদিক দেখলেই এমন খামচি দেবো!… একটা বেড়ালকে পাত্তা দেবার কিছু নাই। কিন্তু না দিয়েও পারছি না। আমি পড়াবার সময় কেউ নজর রাখছে, ব্যাপারটা সুখকর নয়। হোকনা সে বেড়াল। আমি ঘনঘন বেড়ালটার দিকে তাকাচ্ছি বুঝে অন্তি ঠোঁটটিপে হাসলো। এটা ওর রোগ। একটু পরপর ঠোঁট টিপে হাসে। সেই প্রথমদিন ভুলে মায়াবতীদের ফ্লাটে ঢুকে যাবার কান্ডটাই হয়তো মনে করে। আল্লাহ মালুম, ওরা ঘটনাটা নিয়ে নিজেদের ভেতর কী কী আলোচনা করে! কিন্তু যা-ই করুক, সেটা যে আমার ফর-এ আসবে না, সেটুকু আমি বুজতে পারছি। এ ধরণের বিব্রতকর অবস্থায় টিউশনিটা ছেড়েই দিতো অন্য কেউ হলে। কিন্তু আমার ইন্টার্নশীপটা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে আয় হয় না বলে এই বাড়তি ইনকামটা আমাকে চালিয়ে যেতেই হবে, যতোদিন একটা পার্মানেন্ট জব না হচ্ছে! আর পড়াতেও বেশ লাগে। মেয়েটা মেধাবী। একটু বুঝিয়ে দিলেই ধরে ফেলে। আর, এটা না ছাড়ার প্রধান কারণ মায়াবতী। দেখা সাক্ষাত না হোক, তবুও তার কাছাকাছি যেতে পারছি, এটাইবা কম কিসে? কথায় আছেনা, যাকে ভালোলাগে, তার বাড়ির বেড়ালটাকে দেখলেও আপন আপন লাগে! আমি অন্তির চোরা হাসি পাত্তা না দিয়ে পড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মোটা পাওয়ারের চশমার ভেতর থেকে অন্তিও মনযোগী হলো। পড়া দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে একটা চাপা টেনশন কাজ করছিলো- মেসেজটা পেয়ে সেজোফুপির কী প্রতিক্রিয়া হলো সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছি। অন্তির চাপাহাসির পেছনে এটাই কারণ নয়তো? এই বয়সী মেয়েরা সবকিছুতেই থ্রিল খুঁজে পায়। তাহলেতো সাড়ে সব্বোনাশ!
কিছুক্ষণ পড়ার ফাঁকে নাস্তা এলো। আমি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পরিবেশ সহজ করার জন্য বললাম, “তোমাদের এই বেড়ালটা কতোদিন থেকে আছে?’ অন্তি খাতা থেকে মুখ না তুলেই বললো, “ও আমাদের বেড়াল নয় স্যার!’
– তাহলে কাদের?
– মায়াআপুদের।
হেইও ভাইসকল! এইসমস্ত কোইন্সিডেন্স কেবল আমার ক্ষেত্রেই ঘটে কেনো বলতে পারেন? বিষম খেতে খেতে আমি হতভম্ভ হয়ে তাকালাম।
– ওদের বেড়াল তোমরা পোষো কেনো?
– পুষি না তো স্যার।
বুদ্ধিমান মেয়ে। কথাটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ডেলিভারী দিলো “ও আগে ‘সুলতান সোলেমান’ দেখার সময় হলেই আসতো আমাদের বাসায়। ওটা বন্ধ হয়ে যাবার পর অনেকদিন আসেনি। এখন আবার আমার প্রাইভেট পড়া শুরু হলে এসে বসে থাকে!’
ঘটনা শুনে মাথাটায় একটা ঘুরান্টি দিলো। মায়াবতীর বেড়াল এটা! আমি যখন পড়াতে আসি, তখন সে এসে বসে থাকে! আমাকে দেখে? হাউ সুইট! আপনারা এর ভেতরে কোনো রোমান্টিক বিষয় হয়তো দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু খবরটা শুনে আমি চায়ে ভেজানো বিস্কুটের মতো গলে গেলাম। এতক্ষণ বেড়ালটাকে দেখে আমার ভিলেন ভিলেন মনে হয়েছিলো, এখন ওর দিকে তাকিয়ে মনটা ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে গেলো!
– বাহ্ তাই নাকি? দা-দারুণ তো, কী নাম রেখেছ ওর?
– পেলো!
– কি বললে?
– স্যার ‘পেলো’। মায়াআপু ওকে খুব আদর করে!
– হ্যাঁ খুব সুন্দর কিউটি নামের বেড়াল তোমাদের…মানে মায়াআপুদের!
আমার মুখে আপু শুনে অন্তি এবার শব্দ করে হাসলো। তারপর এক দৌড়ে ভেতর ঘরে চলে গেলো। আমি নিশ্চিত জানি, সে ভেতরে গিয়ে এখন হাসবে একচোট। খোদা, আর কতো ‘পরীক্শা’ রেখেছ এ জিবনে!
আপনাদের বলা হয়নি, এদিকে আরও একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি আমি। প্রথমদিনের ওই ডিজাস্টারের পর ২/১ দিন সিঁড়িতে মায়াবতীর সাথে দেখা হয়েছে। মুখের ভাব দেখে কিছুই বোঝা যায় না। খুবই উদাসীন ভাব। মনে হয় যেনো কিছুই তার মনে নেই আর। খুব দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে চোখ দিয়ে কেবল দেখে একবার আমাকে। আমি তাতেই কাত। সিঁড়ির রেলিং টপকে নিচে পড়ে যাবার অবস্থা। বাব্বাহ, কী অদ্ভুত মায়াবী চাহনি! একদিন ব্যতিক্রম হলো। বায়োলজী পড়াতে গিয়ে অন্তিকে ব্যাঙের অঙ্গসংস্থান শেখাচ্ছিলাম। সেটাই মনে হয় রঙচঙ চড়িয়ে সে মায়াবতীর কাছে পেশ করেছে। সিঁড়িতে একদিন মায়াবতী আমাকে ধরলো। “এক্সকিউজ মি, আপনি আমার এসাইনমেন্টের খাতা এঁকে দেবেন প্লিজ?’ কথার ভেতরে আদেশ আর অনুরোধের মিশেল। আমি কিছু বলার আগেই সে সম্মতির অপেক্ষা না করে জানিয়ে গেলো, অন্তির কাছে খাতা জমা দেয়া থাকবে, আমি যেনো নিয়ে নেই। আপনাদের বলতে লজ্জা নেই, কার্টুন আমি খুব ভালো আঁকি! মানে যা-ই আঁকি তা দেখেই মানুষজন হাসে। তো বহু কসরৎ করে আমি একটা ব্যাঙ আঁকলাম। উটের মতো দেখাচ্ছিলো অনেকটা। ব্যাঙের গায়ের আঁচিলগুলোর সাইজ একটু বড় হয়ে গেছে, তো মোটমাট ডোরাকাটা উটই হয়েছিলো শেষটায়। আমি নাম দিয়েছি ব্যাঙ্গুট। তো সেই ব্যাঙ্গুটের দিকে মায়াবতী দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে একটা চোরা নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর শুকনো একটা থ্যাঙ্কস দিয়ে বিদায় নিলো! আমি আতঙ্কে তিনদিন ঘুমাইনি।
পেলো বসে বসে ঝিমাচ্ছে, না ঘুমুচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঘুমালেও তার একটা কান রেডারের মতো এদিক থেকে ওদিকে ঘোরাচ্ছে মাঝেমাঝে। আরে, বেড়ালটাতো আসলেই সুন্দর দেখতে। কানের একটা পাশ কালো। চোখে, পেটে আর লেজেও কালো ছোপ। আভিজাত্য আছে চেহারায়। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, বিড়াল সমাজে সে একজন সেলিব্রিটি! না জানি কতো বেড়ালের হার্টথ্রব সে! আমি ওকে আদর করার জন্য উঠে কাছে গেলাম। মাথায় আলতো করে দু আঙুল বুলিয়ে দিতেই সে আরামে বাবু হয়ে গেলো একেবারে। ইশ্ কী নরম নরম লোম। মায়াবতীও ওকে এভাবে আদর করে নিশ্চয়ই! আমি হাত বোলাতে বোলাতে ফিসফিস করে বললাম, “এই শোন্ আমি না তোকে অনেক ভালোবাসি, বুঝেছিস?’ খিলখিল হাসির শব্দে আমি চমকে উঠলাম। অন্তি! বেড়ালটাও শব্দ শুনে একলাফে দরজার নিচ দিয়ে ভাগলো। ঠোঁটটেপা হাসি নিয়ে অন্তি বললো,
– আজ আর পড়বো না স্যার, আজ অনেক মাথা ধরেছে!
আমি জানি এটা বাহানা। পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো আদম সন্তান একটা বেড়ালকে প্রেম নিবেদন করলো; তাও আবার ছাত্রীর সামনে! মাবুদ! অন্তি দরজা খুললো। আমি বের হলাম। আর সাথে সাথেই মায়াবতীর সামনে পড়ে গেলাম! পেলোকে কোলে নিয়ে সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! অবাক হলে মেয়েদের এত্তো সুন্দর লাগে? আমি নিজের ভেতরে চাপা আতঙ্ক টের পেলাম, পেলো কি তাকে আমার প্রেম নিবেদনের কথা মায়াবতীর কাছে চাউর করে দিয়েছে!?
পর্ব ৪: লেডিস ট্রায়ালরুম
পরিবার পরিকল্পনার সকল স্থায়ী-অস্থায়ী পদ্ধতিকে পরাস্থ করে আমি আর মায়াবতী চতুর্থবারের মতো মাবাবা হলাম।
কী বলবো আপনাদের, বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে গত মাসে। সরি এ্যাঁ, আপনাদের দাওয়াত দিতে পারিনি। যা তাড়াহুড়ার মধ্যে বিয়ে করতে হলো! তার ওপর কোর্ট-কাচারি, পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনী – এসব সামলে বিয়ে করা কি মুখের কথা?… এই চারটা সন্তানকে পেলেপুষে বড় করতে জান কয়লা হয়ে গেছে মায়াবতীর। শুধু নামেই না, মানুষ হিসেবেও সে অনেক মায়াবতী বলেই পেরেছে এই অসাধ্য সাধন করতে! ছেলে দুটোর একটা কোলে আর একটা চার বছরের, মাঝে দুটো জমজ! দুটোই মেয়ে। ভাবেন একবার। কী দারুণ কম্বিনেশন! জ্বী, সময়টাকে কাজে লাগিয়েছি আমরা! মেয়ে দুটোকে দেখতে দেখায় ডলপুতুলের মতো! একদম মায়ের চেহারা পেয়েছে। ছেলেদুটো অবশ্য আমার বাবার মতো হয়েছে। মানে দাদার মতো। আব্বাকে আমি জ্ঞান হবার পরে আর দেখিনি। সে যা-ই হোক, চারটা পিচ্চিই তাদের মাকে ছেড়ে একদমই থাকতে পারে না। তাই যেখানেই যাই, চারজনকে সাথে নিয়েই বের হতে হয়। এই যেমন এখন কফি খেতে এসেছি, সেখানেও ফল-ফ্যামিলি – ছয়জন! আমি এপাশে একা বসেছি আর টেবিলের উল্টোদিকে ওরা। মায়াবতীর দুপাশে দুই মেয়ে, নীল ফ্রক আর মাথায় অনেকগুলো নীল ব্যান্ড দিয়ে আধাইঞ্চি পরিমাণ চুলে ঝুঁটি বেঁধেছে। দেখলে মনে হয় রূপকথা! নামও রেখেছি সিরাম: রূপকুমারী আর ফুলকুমারী! দুই মেয়ের মাঝখানে তাদের মাকে লাগছে রাজরাণীর মতো! আমি রাণীসাহেবার দিকে তৃষ্ণার্তের মতো অপলক তাকিয়ে আছি! সুবহানাল্লাহ!!! আমি অস্ফুটে বললাম।
– কী হলো!!!
আমি সম্বিত ফিরে দেখি উম্মে হুজাইফা কুররাতুল আফসানা! এটা মায়াবতীর সার্টিফিকেটের নাম। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, তিন/চারবার সংশোধন না করে জাতীয় পরিচয়পত্র পায়নি সে! এই নাম রেখেছে তার দাদাজান! আমি নেট ঘেঁটে এই নামের যে অর্থ পেলাম, তা ভয়াবহ! হুজাইফা মানে মেষ বা ভেড়া, কুররাতুল= চোখের শান্তনা, আফসানা = রূপসী, আর উম্মে মানে মেয়ে বা মা! কুলমিলাকর ইয়ে সাবিত হো কি: রূপসী ভেড়ার চোখের শান্তনার মেয়ে! প্রভু যীশু, রক্ষা করো!
আমি হাসি চেপে ওর দিকে তাকালাম। কানে একটা মুক্তো বসানো দুল। হালকাভাবে দুলছে। আহ্ এতো সুন্দর লাগছে দেখতে। কানটাও কতো সুন্দর! আমার বুক ঢিপঢিপ করছে! হাসতে চেষ্টা করলাম। কফির কাপ মুখের কাছে নিয়ে একদৃষ্টে আমাকে দেখছে উম্মে হুজাইফা মানে মায়াবতী!
– কী ভাবা হচ্ছে?
– আর একটা বাচ্চা নেবো!
– কী?
– এ্যাঁ? নাহ্ কিছু না। আমি লাজুকভাবে ওর দিকে তাকালাম। তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলাম। পিচ্চিগুলো কই? এইমাত্র না এখানে ছিলো? এক নিমেষে সব হাওয়া। কী হয়েছে বলেন তো আমার? যখনই মায়াবতীর কাছে যাই, তখনই ওর আসেপাশে আমাদের ভবিষ্যত সন্তানদের দেখি! এটাও কি প্রেমের কোনো সিম্পটম? কি জানি বাপু, এই প্রেম বড় ‘ঝাটিল’ (ঝামেলা+জটিল) একটা জিনিস!
– পেলো কেমন আছে?
– সে তো পাগল একেবারে। টিচারের শব্দ পেলেই আর ঘরে থাকতে চায় না!
– তাই নাকি?
আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন, আমরা কেউই একে অন্যকে সম্বোধন করছি না। আপনি আর তুমির মাঝামাঝি স্টেজে আছি এখন। আমি অবশ্য সিনিয়রিটির দিক দিয়ে ওকে তুমি ডাকতে পারি, কিন্তু জিভে জড়িয়ে যাচ্ছে। আবার আপনি ডেকে তাকে দূরের একজন ভাবতেও পারছিনা। ঝাটিল, ঝাটিল!
আজ নিয়ে এটা আমাদের তৃতীয় আউটডোর ডেট! (ইনডোর ডেট নিয়ে ভাবতে গেলে দমবন্ধ হয়ে যায়, আঁই কিত্তাম?) এসেছি একটা শপিংমলে। ভাষার একদম ছ্যাড়াবেড়া অবস্থা। কেনো রে, এতো শানদার স্থাপনাকে মল ডাকার কী প্রয়োজন? বৃহত বিপনিকেন্দ্র বলতে গায়ে ফোস্কা পড়ে? যত্তোসব! এই হীনমন্যতাই আমাদের ভাষাকে শেষ করবে বুজলেন?
– আমার যেতে হবে!
– আর একটু থাকা যায় না। মানে আর পাঁচ মিনিট?
– কফি শেষ করা পর্যন্ত আছি।… কেউ তো কিছু বলছে না, থেকে কী হবে?
মায়াবতীর মুখে অনুযোগের মেঘ জমলো। আমার কষ্ট হলো ওর জন্য। আসলেই আমি কিছু বলতে পারছি না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। উচিত ছিলো বাসা থেকে আগেই স্ক্রিপ্ট লিখে আনা – আমি যা যা বলতে চাই। কী বলতে চাই আমি? বলতে চাই, হে রূপবতী তুমি কি আমার সাথে বাকী পথটুকু হাঁটবে? তোমার সুন্দর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আমি দুর্গম খাইবারপাস পার হতে পারবো। হাত ধরো, মায়াবতী। আমার হৃদয় কেটে স্লাইস করা হলে প্রতিটি টুকরো থেকে তোমার পাসপোর্ট সাইজ ছবি পাওয়া যাবে! আমাকে তোমার পাশাপাশি একটু থাকতে দাও। বিনিময়ে প্রতিদিন আমি তোমাকে ব্যাকপ্যাকে ভরে অফিসে নিয়ে যাবো। অফিসে ব্যাগ খুলে মাঝে মাঝে দেখবো তোমাকে!!! – এসব বললে মায়াবতীর প্রতিক্রিয়া কী হবে? সে কি বুজবে আমি তাকে কতোটা বাসি?
– মন খারাপ কেনো?
– এমনি। বলে আমি চোখ নামালাম। কফির খালি কাপটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। টেবিলের ওপর ওর চুড়ি পড়া একটা হাত আমার দিকে আগানো। বাকি হাতটা গালে ভর দিয়ে আমাকে দেখছে, জানি। আমি সহজ হতে পারছি না। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললাম, চাই!
– ক্কী?
– সবটা!
– মানে?
– মানে একসাথে হাঁটতে চাই!
– যদি না হাঁটি?
– মরে যাবো!
– মিথ্যে!
– নাহ্। জন্মের মতো সত্যি!
এ পর্যায়ে সিনেমার দৃশ্যের মতো ওর লম্বা করা হাতের আঙুলগুলো টেবিলের ওপর দিয়ে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে আমার হাতের পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো! দ্বিধা। ভয়। উত্তেজনা! আমি আমার হাত ওর দিকে খুলে ধরলাম। মাত্র দুটো আঙুল দিয়ে মায়াবতী আমার আঙুল স্পর্শ করলো। ৮৮০ ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেলো! চারটা আঙুল একে অন্যকে আঁকড়ে ধরি ধরি করেও থমকে আছে। বিহ্বল আমি কাতর চোখে তাকিয়ে রইলাম আমাদের দুজনের হাতদুটোর দিকে। যেনো চারদিকের সবকিছু ফ্রিজ হয়ে গেছে। নড়ছে না। এমনকি সময়ও স্থির এখন।
– সেজোফুপি!…
ফুঁপিয়ে ওঠার মতো বললো মায়াবতী! আমরা এক ঝটকায় খাড়া হয়ে গেলাম। কাঁচঘেরা পার্টিশনের ওই দিকে সত্যিই সেজোফুপি! তার সম্প্রতি খতনা করা পুত্রকে নিয়ে মার্কেটের ভেতর ঢুকছেন। আমরা দুজন লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিপদ আমাদের পিছে পিছে ধেয়ে আসছে! ওইতো সামনেই একটা ব্রান্ডশপ। আমি মায়াবতীকে নিয়ে ওটার ভেতরেই ঢুকে পড়লাম।
– গুড ইভনিং স্যার, হাউ কেন আই হেল্প ইউ ম্যাম!
ব্লু স্যুট আর সাদা শার্ট পড়া একজন সেলসগার্ল এগিয়ে এলো! টানটান উত্তল শার্টের ওপর সোনালি নেমট্যাগ লাগানো- তানিয়া। মায়াবতী তাকে ডজ দিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে গেলো। আমি এই সুযোগে দোকানটায় চোখ বোলালাম। মেয়েদের আইটেম সব। আমার পেছনে টর্নেডো ধেয়ে আসছে, মরিয়া হয়ে বাছবিচার না করে আমিও শো রুমের অন্যদিকটায় হানা দিলাম। পেছনদিকে এক চক্কর মেরে আমি ঘুরপথে পোঁছাতে চাই মায়াবতীর কাছে। প্রায় ওর কাছাকাছিই চলে গিয়েছি, এমন সময় দেখি ওর সামনেই সেজোফুপি দাঁড়িয়ে। ধরা পড়ে গেছে সে। আল্লাহ্ রহম করো। কি কি যেনো বলছেন তিনি। একসার হ্যাঙারে ঝোলানো কাপড়ের আড়ালে বলে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু যে কেনো সময় এদিকে ফিরলেই তিনি আমাকে দেখতে পাবেন! দোয়া ইউনুস মনে পড়ছে না কেনো? বুকের ধুকপুক এতো জোরে হচ্ছে যে সেই শব্দতেও সেজোফুপি সজাগ হয়ে যেতে পারেন। আমার দিকে আগাচ্ছেন তিনি। উপায়অন্ত না পেয়ে আমি পিছনে ফিরতেই ছোট একটা কুটুরিঘর দেখে তাতেই সেঁদিয়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকে খট করে দরজা লাগিয়েই বুজলাম জিবনের বড় ভুলটা এইমাত্র করে ফেলেছি। আমি লেডিস ট্রায়ালরুমে বন্দী! হাইহিলের শব্দ টের পেলাম। কে যেনো নক করছে। মেয়েকন্ঠ। সেই স্যুটপড়া মেয়েটা মনে হয় – তানিয়া।
– এক্সকিউজ মি স্যার, এটা লেডিসরুম স্যার, প্লিজ ওপেন দা ডোর!
পুরো ইনিংসে হেরে যাওয়া আমি দরজা মেলে ধরতেই দেখলাম সামনে সেজোফুপিসহ বেশ কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী মহিলা চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে। তাদের দৃষ্টি আমার হাতের দিকে। এই শালার হাত কি করে কোত্থেকে জানি মেয়েদের একটা পোশাক তুলে নিয়ে এসেছে! নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আমি জমে গেলাম। আমার হাতে ৪৮ সাইজের একটা ব্রা!!!
পর্ব ৫: শীতকালীন মহড়া
ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামান তরফদার পিএসসিকে ইউনিফর্ম ছাড়া সাধারণ পোশাকে দেখলে চট করে ঈদ আনন্দমেলার উপস্থাপক বলে মনে হতে পারে। সপ্রতিভ, সদালাপী আর তীক্ষ্ণ ধীশক্তির গুণে তিনি আজ এই অবস্থানে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট পদক ছাড়াও দেশ বিদেশের সামরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও সিমুলেশনে অংশ নিয়ে জয় করেছেন বেশকিছু শিরোপা। তারই ধারাবাহিকতায় তাঁকে দেশের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত আধাসামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চলমান শীতকালীন মহড়া নিয়ে তাঁর বেশকিছু জমকালো আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে। আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র দেশ মালাউই-এর সেনাপ্রধান আসবেন এই মহড়ার সমাপনী ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে। সেনাপ্রধান হলেও তারা দুজনেই আমেরিকার উটাহ -তে একসাথে ছয়মাসের একটি সারভাইভ্যাল কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। (এই কৃষ্ণাঙ্গ সেনাপ্রধান ডক্টর সি. পম্পিডু সাহেবের সাথে আমার একটা সেলফি তোলার ব্যাপার আছে, সেইটা কাহিনীর শেষের দিকে বলবো আপনাদের)। তো বিগ্রেডিয়ার তরফদারের দেশের বাড়ি খুলনা আর বাগেরহাটের মধ্যবর্তীস্থানে হবার কারণে তাঁর ভাষায় কোনো লোকাল টানই জোড়ালো নয়। কেবল কড়িছো, গেইইচো এইরকম দুএকটা দেশি-ভাষা মাঝেমোদ্দে আসি-যায়! সিডা কোনো ব্যাপার না।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বন্ধুকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য তিনি এক অভিনব আইডিয়া ঠিক করেছেন। তিনি ভেবেছেন, এবার তালপাতা আর খেজুরপাতা দিয়ে… ঝনঝন করে ল্যান্ডলাইন টেলিফোন বেজে উঠতে তার চিন্তাটার ইন্টারভেল হয়ে গেলো। নীল সেটটা বাজছে। তারমানে বাসা থেকে। এই ফোন যখনই আসে, তা কোনো আনন্দদায়ক বার্তা বহন করে না। কিন্তু সংবাদ যতোই তেতো হোক, তাঁকে এই মুহূর্তেই কলটা এ্যাটেন্ড করতে হবে। কারণ ফোন করেছে শরাবান তহুরা, তাঁর স্ত্রী। শ্বশুরের দেয়া এই উপহার নিয়ে তিনি বিশাল সক্ষমতার সাথে গত চল্লিশটা বছর পার করেছেন। এবং তহুরা বিষয়ে তার কোনো অনুযোগ নেই। কারণ ‘দেয়ার ইজ নো অবস্টাকেল রিমেইনস অন দিস প্লানেট, এজ লং এ্যাজ ইয়ু নো হাউ টু ফিক্স ইট” – এই নীতিতে বিশ্বাসী তিনি। আর স্ত্রী-ভাগ্য বলে যে একটা জিনিস আছে, সেটা তহুরা তার জীবনে না এলে বুজতেন না। প্রতিটা উন্নতি ধাপে ধাপে তাঁকে শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। সেটা তহুরা পাশে না থাকলে হতো না। কারণ তাঁর কেরিয়ার গড়তে সহায়তা করতে গিয়ে তহুরা তার নিজের কেরিয়ার কোরবানী দিয়েছে! একটা জিনিসে খামতি ছিলো, আল্লাহ সেই পুত্রের সাধও শেষ বয়সে তাঁর পূরণ করেছেন। পুত্র হবার পর থেকে তহুরার গলার স্বর অবশ্য দুই স্টেপ উচ্চ হয়েছে, তবে সিডা কোনো ব্যাপার না।
ফোন ধরার পর পাঁচ মিনিট তিনি ওপাশ থেকে যা যা বলনীয়, তা বলতে দেন কোনো ইন্টারাপশন ছাড়াই। এবারও তাই করার প্লান ছিলো তাঁর, কিন্তু পারলেন না। কারণ, বিষয়টা তার মাজান-কে নিয়ে। মাজান তার মেয়ে নয় ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও বেশি। তিনি ওপাশে তহুরার কাঁদোকাঁদো কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কথাগুলো কান্নার দমকে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যেই শুধু একটা প্রশ্ন করলেন, ছেলেটা কে? তারপর আরও দু তিনটা তথ্য শুনে তিনি স্ত্রীকে শান্ত হবার কথা বলে ফোন রাখলেন। একমিনিট দ্বিধান্বিত হলেন এই চৌকশ কর্মকর্তা, যিনি কর্মক্ষেত্রে দুরূহ সব সমস্যার এক নিমেষে সমাধান দেন, সেই তিনিই কেমন যেনো থমকে গেলেন। কিভাবে এটা হ্যান্ডেল করবেন যেনো বুজতে পারছেন না। তাঁর বিভাগের ইন্টেলিজেন্সকে তিনি এক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে চান না। করা উচিতও নয়। তাহলে কী করা যাবে? পিতার গুরুদায়িত্ব বুঝি একেই বলে, এই প্রথম তিনি টের পেলেন। আগে তো ঘটনার মূলে যে আছে তার সম্পর্কে জানতে হবে। তাছাড়া মাজানের সাথেও তিনি সরাসরি কথা বলতে চান। বাসায় যেতে হবে। বেল বাজিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে একমিনিটে তিনি সিন্ধিকে মোবাইলে ধরলেন, কোর্টে আছো না চেম্বারে?
– হু, কী ব্যাপার? কোথায় আসতে হবে?’ একেই বলে উকিলের বুদ্ধি। ব্যারিস্টার ইফতেখারুজ্জামান সিন্ধি পার্টি পলিটিক্স না করার কারণেই পেশাগতভাবে পিছিয়ে গেছেন। নাহলে এই ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে জাতীয় সংসদ আলোকিত করতে পারতেন এখন। তার সাথে কল কাটার আগে তিনি তহুরার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন:
নাম: ইমতিয়াজ চৌধুরী ছোটন
ঠিকানা: ইনটার্ন, গ্লোবাল এ্যাক্সিস (ইনক্.), বনানী।
মোবাইল নং…
পর্ব ৬: উপসালা
স্থবির ব্যাঙের মতো চিত হয়ে শুয়ে আছি বিছানার প’রে! কিন্তু মরে আছি, না বেঁচে সেটা বুজতে পারছি না। জব্বার আমাকে দেশে ফিরে গিয়ে চাষবাসে মনযোগী হতে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে। আমি নাকি মেগাসিটিতে বসবাসের উপযোগী নই!
ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকে আমি একবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। কলাবাগান থেকে যাবো মীরপুর সাড়ে এগারো। বাস ধর্মঘট চলছে বলে নিরূপায় হয়ে ভাগের সিএনজিতে উঠেছি! শালারা কল্যাণপুর গিয়েই একটা ভোঁতা পিস্তল আমার পেটের পাশে ঠেকালো! আইবাপ, কী তামশা! ভার্সিটি স্টুডেন্ট, তার ওপর হলে থাকি – শুনে গায়ে হাত দেয়নি ওরা। ভদ্রভাবে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ব্যাগটা তমিজসহকারে ফিরিয়ে দিয়েছে। ইনফ্যাক্ট এতো ভদ্র ছিনতাইকারী আপনারা অর্ডার দিয়ে বানালেও পাবেন না। ওদের আদব লেহাজ দেখে আমার রীতিমতো লজ্জা লাগছিলো। বড়ভাই বলে সম্বোধন করছিলো। টেকনিক্যালের মোড়ে এসে ওরা আমাকে তমিজসহকারে নামিয়ে দিলো, তারপর ভোঁ করে গাবতলীর দিকে চলে গেলো। পরম আত্মীয় হারানোর বেদনা নিয়ে আমি সিএনজিটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবটা ঘটে গেলো কয়েক মিনিটের ভেতর, কিন্তু হাঁটতে গিয়ে খেয়াল করলাম, আমার পা দুটো নড়ছে না। একদমই না। হাঁটুদুটো অসাড়। আমি তখন হাঁটুদুটোকে কাউন্সেলিং করতে লাগলাম, “দ্যাখ ওরাতো চলে গেছে, তোরা এখন সেফ। চিন্তা করিস না, চলা শুরু কর্।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? হাঁটুর কাঁপুনী আর থামেনা, কী আপদ!… তো সেই স্টোরি শুনে এই জব্বারই তখন আমাকে বলেছিলো, “হার্টে মাইন্ড নিস না দোস্ত! এমন হয়। ছিনতাইয়ের ভেতর দিয়ে ঢাকা তোকে আপন করে নিয়েছে!’ আর এখন সে বলছে, আমি নাকি ঢাকায় থাকারই যোগ্য নই। বহুদিন পর এখন ছিনতাই হবার পরের সেই অনুভূতিটা নিজের ভেতরে কাজ করছে! প্রেম করতে গিয়ে (বা পড়তে গিয়ে) যে কঠিন প্যাঁচের ভেতর আমি পড়ে গেছি, তার সুরাহা আমার কাছে নেই। কার কাছে আছে, তাও জানিনা।
মায়াবতীর ফোন ওই ট্রায়ালরুম ইন্সিডেন্সের পর থেকে বন্ধ! সোশাল মিডিয়াতেও নেই সে। হয়তো আমার মতো এমন নির্বোধ বেকুবের হাত থেকে নিস্তার পেতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে! ঠিকই করেছে। কেবল বুকভরা ভালোবাসা থাকলেইতো হবে না। কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষকে কে সহ্য করবে? গত এক সপ্তাহ ধরে আমি অন্তিকে পড়াতেও যাইনা। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি দেশে যাবার কথা বলে। হয়তো জব্বারের পরামর্শ নিয়ে আমাকে গ্রামেই ফিরে যেতে হবে। ঝাঁকিজাল দিয়ে হাওড়ে মাছ ধরবো! দৃশ্যটা ভাবতেই মনটা ভেঙে যাচ্ছে আমার। শুধু নিজেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর প্রত্যয় নিয়ে আমি শূন্যহাতে ঢাকা এসেছিলাম। আজ ভাগ্যের কাছে পরাভূত হয়ে ফিরে যাবো?
অফিস থেকে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো, ধরা হয়নি। আজ মন খারাপের জন্মদিন নিয়ে অফিস শুরুর ঘন্টাখানেক আগেই হাজির হলাম। এইসময়ে সাপোর্ট স্টাফ ছাড়াও বিগবস চলে আসেন। জনশূণ্য ওয়র্কস্টেশনগুলোর এককোণে আমার টেবিলে বসে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, আমি এখানে কেনো? সারা শরীরটা অসাড় হয়ে আছে। প্রেমে ব্যর্থতায় কেবল মনই ভাঙে না, শরীরও। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে নিচের ফুটপাতে গার্মেন্টস কর্মীদের দ্রুতপায়ে লাইন দিয়ে হেঁটে যাওয়া বেশকিছু সময় ধরে দেখলাম। আমার জীবনটা কি ওদের চেয়েও অর্থহীন? তুচ্ছ? দীর্ঘশ্বাস চেপে একটা কফি বানিয়ে নিয়ে এসে আমি ল্যাপটপ খুললাম। তিনটা মেইল পপআপ হলো। আমি একে একে পড়তে লাগলাম। তিন নম্বরটা পড়ার আগেই বসের রুমে ডাক পড়লো। কিছু কি পেন্ডিং আছে? মনে করতে পারছি না। না জানি কী আছে কপালে আজ। কাঁচের স্লাইডিং দরজা ঠেলে আমি ঢুকলাম। জেসমিন এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। গুডমর্নিং! কাজ করছিলেন উনি। আমাকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
– আরে ইমতিয়াজ, কংগ্রাচুলেশন! হোয়াট এ ব্রিলিয়ান্ট সাকসেস!’ আমি হতভম্ব আর ভ্যাবাচাকা দুটোই একসাথে হয়ে গেলাম!’
– কী ব্যাপার, মুখচোখ এতো শুকনো কেনো মাই বয়, আই নো আই নো, ইউ হ্যাড টু পাস এ টাফ টাইম!’
কিসের কথা বলছেন বস? মায়াবতীর কারণে টাফটাইম যাচ্ছে, সেটা উনি জানলেন কী করে? অবশেষে স্পষ্ট হলো, তিনি পুরো অফিসকে ফর্মালি মেইল দিয়ে জানাবেন খবরটা, তবে আমার সাথে আগে আলোচনা করে নিচ্ছেন। ব্যাপার হলো, সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটি আমাকে লিডারশিপ মাস্টার্স কোর্সে এক বছরের জন্য ফুল স্কলারশিপে মনোনীত করেছে। “সাচ এ প্রেস্টিজিয়াস অপরচুনিটি!’ বস গর্ব নিয়ে বললেন। কফি খাওয়ালেন আর একবার। টিমের অন্য কলিগরাও দুএকজন এসে উইশ করলো আমাকে। আমার খুবই আনন্দিত হওয়া উচিত। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিনা তেমন। কী হবে এসব দিয়ে, যদি মায়াবতীকেই না পেলাম? বুকের ভেতর তীব্র অভিমান পাক খেয়ে গলার কাছে উঠে আসছে। কোনো সিনক্রিয়েট না হয়ে যায়, সেজন্য নিজেই তড়িঘরি উঠে পড়লাম। পেছন থেকে বস ডাকলেন-
– ইমতিয়াজ, আপনার খোঁজে অফিসে পুলিশ এসেছিলো। হোয়াট হ্যাপেন্ড? ইজ এভরিথিং ওকে?
আমি চমকে উঠলাম। পুলিশ এসেছিলো? কেনো?
– আরে না না। তেমন কিছু না, ডোন্ট ওয়ারি, জাস্ট স্বভাব চরিত্র কেমন, বাড়ির ঠিকানা এইসব জানতে চাচ্ছিলো। আমি অবশ্য পার্সোনাল ইনফো কিছুই ডিসক্লোজ করিনি, এক্সেপ্ট… স্কলারশীপের বিষয়টা জানিয়েছি।… এনিওয়ে, আমাকে জানাবেন কোনো হেল্প লাগলে… শেষের দিকে তিনি মুচকি হাসলেন। কি কারণ কে জানে?
পুলিশের বিষয়টা আমার মাথায় থাকলো না বেশিক্ষণ। বরং একবুক অভিমান নিয়ে আমি ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। চোখ লাল হয়ে আছে নির্ঘুম রাতজাগার কারণে। মায়াবতীর মুখটা মনে করতে চাইলাম, কানের দুলটাই শুধু ভাসছে চোখে। যাবো না, লাগবে না স্কলারশিপ, বিরবির করে বললাম। হাওরে ফিরে গিয়ে মাছই ধরবো! কখনোই আর তোমার সামনে দাঁড়াবো না! ভালো থেকো প্রিয়তমা! বড় বড় ফোঁটায় টপটপ করে বেসিনের ওপর চোখের পানি পড়তে লাগলো! অস্ফুটে বললাম, এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর!…
পর্ব ৭: পার্সোনাল ম্যাটার
আপনারা যারা চ্যাটিংয়ে প্রবল অভ্যস্ত তারা হতবাক হবার এক্সপ্রেশন দিতে একটা জিনিস মাঝেমাঝে ব্যবহার করে থাকেন, তা হলো ওপরদিকে চোখ তুলে তাকানোর ইমোজি! যতো ধরণের ইমোজি আছে, তার ভেতরে সবচে অর্থবহ ও সৃষ্টিশীল মনে হয় এই উপরদিকে তাকানো পুরাই কনফিউজড ভদ্রলোককে। যিনি এটা ড্রইং করেছেন, তাকে পেলে সালাম দিতাম! কেননা, ইলাবৌদির ফোন পেয়ে আমি এখন ঠিক ওই ইমোজির মতোই চোখ চাঁদির ওপর তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি! আদি ঢাকেশ্বরী টানে ইলাবৌদি আমাকে যা জানিয়েছেন, সেটা শুনলে আপনাদেরও অবস্থা এমনই হতো মনে হয়। ঘটনা হলো, জব্বারকে গতকাল সাদাপোশাকে কারা নাকি ধরে গেছে। বৌদির ভাষায়, “চিনতাই কইরা লয়া গেচেগা!’ উনি কাঁদো কাঁদো মুখে জানালেন, “ঠাকুরপো, আপনের বন্দুরে মারেনাইক্কা, তামামটা রাইত খালি হাজতের ভিত্রে মষার আড়তের মইদ্দে বহাইয়া রাকচে!’ (মশা বানানে ষ দিলাম, ভয়ংকরতা বোঝাতে)। আমার ব্রেনের অবস্থা অনেকটা ‘সবকটা লাইন এখন ব্যস্ত আছে- সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না- অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুণ’ -এমন!
কেনো, কিসে, কিভাবে, কী করেছে- ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের জ্যাম লেগে গেছে ‘বেরেন্টের’ ভেতরে। জব্বারের পক্ষে দেশের চলমান আইনের পরিপন্থী কিছু করা দূরুহ, তবে অসম্ভব নয়। আমি ভয়ানক শংকিত হলাম ওকে নিয়ে। কিপটেমি ছাড়া আর কোনো ক্রাইম ও করেছে বলে শুনিনি কখনো। (তবে, প্রাক্তন ইলাবৌদিগন যদি একসাথে ওর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেন – তাহলে আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে জব্বারের জেল জরিমানাসহ সশ্রম-ফাঁসিও হতে পারে! তবে তারা তা করবেন না বলেই মনে হয়, কেননা জব্বারের ভাষায়, ওইসব নাতিদীর্ঘ নাজুক সম্পর্কগুলো নাকি “আপছে-আপোষেই” ঘটে থাকে। কোনো দিক থেকেই কোনো শিকায়েৎ নাই।) যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত কিপটেমিকে সেভাবে আইনের আওতায় আনা হয়নি। তাহলে ওকে ধরে নিয়ে গেলো কেনো? কী করেছে জব্বার? আমি ইলাবৌদির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে উত্তরা মডেল থানায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে যা শুনলাম, তা এক লহমায় শরীরের সব রক্ত শুষে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।
জব্বারকে ধরা হয়েছে ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামান পিএসসির বাসভবনের সামনে থেকে। সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরায় অনেকক্ষণ ধরেই তাকে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছিলো! গতিবিধি সন্দেহজনক বলে কর্তব্যরত সেন্ট্রিরা সিকিউরিটিকে বিষয়টা অবগত করেন। এতো যায়গা থাকতে হতভাগা মায়াবতীদের বাসার সামনে মরতে গেলো কেনো? তার বিরুদ্ধে চার্জটা কী? কর্তব্যরত ইয়াং ডিউটি অফিসার আমার কনফিউশন আরও বাড়িয়ে দিলেন। এ মুহূর্তে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। ওপরের নির্দেশে ধরেছেন, বলছেন। আরও বললেন, আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান দেয়া হবে। আমরা যেনো কোর্ট থেকে তার জামিন নিয়ে নেই! বলে কী? বিনা অভিযোগে কাউকে এভাবে আটকে রাখা যায়? ‘দিস ইজ আনফেয়ার অফিসার, ইউ কেন্নট ডু দিস, সো ফার!”
– অফকোর্স আই ক্যান! লুক মিস্টার…
– ইমতিয়াজ!
– ইয়েস মিস্টার ইমতিয়াজ, ডু য়ু নো হোয়াট হি ডিড? ইয়োর ফ্রেন্ড; হি হ্যাজ থ্রেটেন্ড ব্রিগেডিয়ার’স ফ্যামেলি! সে স্যারের সম্বন্ধীর মেয়ের সাথে দেখাও করতে চাইছিলো?
– ক্কি?
– ইয়েস! আই আম টেলিং ইউ দা ট্রুথ! ইভটিজিং। উনি খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাবেন!
– ওহ্। আপনাদের কোথাও নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে…
– নো। উই হ্যাভ ভিডিও ফুটিজ অন দ্যাট। সে এমনকি বাসায় ঢুকে স্যারের মেয়ের সাথে কথাও বলতে চেয়েছিলো! ভাবতে পারেন?
– স্যারের মেয়ে, না সম্বন্ধীর মেয়ে?
– একই কথা। মেয়ের চেও বেশি।
– কী নাম তাঁর মেয়ের?
– দ্যাট ইজ নান অফ ইয়োর বিজনেস!… তারপরও বলি, স্যারের মেয়ের নাম মায়াবতী! স্যার ডাকেন মাজান, এবার বুজতে পারছেন?
এই তাহলে ব্যাপার! মাথার জটগুলো একটা একটা করে এবার খুলতে শুরু করেছে। প্রচন্ড রাগও হচ্ছে জব্বারের ওপর! আমি ডিউটি অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে জব্বারের সাথে দেখা করলাম। থানা হাজতে নয়, জব্বারকে পেছনের দিকে একটা খালি ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে! এ সমস্ত মডেল থানা এখন কনভেনশনাল প্রাকটিস থেকে বেড়িয়ে এসেছে! আগের মতো আতঙ্কজনক পরিবেশ আর নেই। একজন পুলিশ সদস্য আমাকে ওর রুমটা দেখিয়ে দিলেন। দুহাতের পাতার ওপর কপালের ভর রেখে জব্বার ঝিমাচ্ছিলো চেয়ারে। আমাকে দেখে সোজা হলো। হাসলো অপ্রস্তুতের হাসি। আমি কিছু বলতে যাবার আগেই ও বলে উঠলো,
– তোর ফুপিশাশুড়িকে একদম সাইজ করে দিছি দোস্তো!
– এইটা কী করেছিস হারামী! আমি চাপা গলায় ওকে শাসালাম।
– দোস্তো পাবলিকরে সবসময় চাপে রাখবি বুজলি!
– এইটা কী বলছিস তুই? হিরোগিরি কোথায় করেছিস, বুজতে পারছিস? তোকে তো ওরা ফাঁসাবে। এখন কী হবে?
– কী আর হবে? দোস্তের জন্য রিস্ক তো নিতেই হয়।
– এই পাকনামীটা কেন করতে গেলি, আহাম্মক! রাগে আমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিলো। নিজের না, জব্বারের। ওর কথা শুনে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে বললাম-
– এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার, তোকে নাক গলাতে কে বলেছে? জব্বার হাসলো আমার কথা শুনে।
– আমারও পার্সোনাল ম্যাটার!… মায়াবতী একসাথে দুজনের জিবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। সেটাই বলতে গিয়েছিলাম ওকে!
– মানে? কী বলছিস তুই এসব?
– হ্যাঁ দোস্তো। ম্লান হাসলো জব্বার। তারপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে, যেনো দেয়ালকেই শোনাচ্ছে এভাবে ফিসফিস অনুযোগের সুরে বললো:
– এই মেয়েটার কারণে আমার একমাত্র বন্ধুটা যদি ঢাকা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সেটা কার লস?… আমার অনেক খারাপ গুণ আছে দোস্তো। কেউ আমার সাথে সম্পর্ক রাখেনা, টাকা ধার চাই বলে। কেবল তুইই সেই হল ছাড়ার পর থেকে আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিস। তোকে কি আমি হারাতে পারি, বল?
আমিও ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমাদের দুজনের চোখই এখন আড়াল চাইছে একে অন্যের কাছ থেকে!
পর্ব ৮: ফ্লাঙ্কিং মেনুভার
ছোটোবেলায় আমি ভাবতাম পুঁটিমাছই বড় হয়ে ইলিশমাছ হয়। তো কেউ যদি বলে মাগুরমাছ বড় হয়ে কাইনমাছ হয়, তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না। কেননা দেখতে প্রায় একই রকম, শুধু কাইনমাছের গায়ের রং হয় হলদেটে সাদা। সাধারণ জাল মেরে বা বড়শিঁতে এই মাছ ধরা যায় না, কারণ সে থাকে সুন্দরবনের নোনাজলে, গর্তের ভেতর। স্রেফ হাত দিয়ে মাছ ধরতে অনেক দক্ষ যারা, কেবল তারাই পারে কাইনমাছ ধরতে। ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামানের বাসায় আজ সাড়ে তিনকেজি ওজনের সুস্বাদু একটা কাইনমাছ এসেছে মংলা থেকে। মাছের সাথে এসেছে ছেলেবেলার স্মৃতিও! তারা ছোটবেলায় বহু কৌশল করে ‘শোর’ বা নালার একদিকে জাল পেতে, অন্যদিকে ‘বাইক্লোর’ পাতা ছেঁচে কাইনমাছের গর্তে ঢেলে দিতেন। বাইক্লোর তীব্র কটু গন্ধে এই মাছ সুড়সুড় করে বেড়িয়ে এসে জালে আটকা পড়তো। তবে ঝুঁকি ছিলো তাতে। কাইনের পিঠে দশাসই একটা কাঁটা আছে, যার খোঁচা খেলে তিনদিন জ্বর থাকে…!
তহুরা বিশেষ বিশেষ দিনে কিচেনে ঢুকে দু একটা আইটেম বানায়। সেই বিশেষ দিনগুলি হয় সেদিন- যেদিন সিন্ধি আসেন। তহুরা আজ তার জন্য চুঁইঝাল দিয়ে কাইনের সাথে আরও একটা এক্সক্লুসিভ আইটেম পাকিয়েছেন। তা হলো গাবপাতার পাকোড়া। দেশি গাবগাছের একদম কচিপাতা ঝুড়িকরে কেটে তার সাথে সিক্রেট কিছু অনুপান মিশিয়ে ব্যসন দিয়ে ভেজেছেন। এই জিনিস একটা খেলে বহুদিন তার স্বাদ মুখে থেকে যায়। টেবিলে আরও কিছু পদ রয়েছে আরাফাত আর মায়াবতীর পছন্দের। কিন্তু বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও ভাইবোনের একজনও খেতে আসেনি। আরাফাত কাগজ কেটে কী যেনো একটা প্রজেক্ট বানাচ্ছে তার মিসের নির্দেশে। আর মায়াবতীর নাকি খিদে নেই। বেশ কদিন ধরে মেয়েটার খিদে থাকছে না। এতো উচ্ছল উজ্জ্বল মেয়েটা কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গেছে। সব ওই ছেলেটার কারণে। তিনি ভেতরে ভেতরে অসহায় বোধ করলেন। খেতে খেতে সিন্ধি অনেক প্রশংসা করছে তহুরার। বেহেস্তে নাকি প্রথমেই গাবপাতার পাকোড়া সার্ভ করা হবে, এইসব। তিনি ভেতরে ভেতরে টেনশন বোধ করছেন, তবে সেটা তার মুখ দেখে বোঝে কার সাধ্য। হাসি হাসি সপ্রতিভ মুখ করে তিনি সবই শুনছেন, বা শোনার ভান করছেন। সিন্ধির কাছে কিছু আপডেট আছে। কিন্তু সেটা নিজে থেকে জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে না। ইন হিজ ওপিনিয়ন, ইট হ্যাজ গন টু ফার। এট্রিশন ওয়ারফেয়ার হয়ে গেছে! এতোটা বাড়াবাড়ি না করলেও হয়তো হতো! আর তাছাড়া মেয়ের মন কী চায়, সেটা তিনি একটাদুটো কথাতেই বুঝে গেছেন। না বোঝার কথা নয়, ওকে তিনবছর বয়স থেকে পালছেন তিনি। তহুরার চেয়ে তার কাছেই মেয়েটা থাকতো বেশি। ওর নেপি পাল্টানো, খাওয়ানো, গোসল করানো সবই ছিলো ফুপাইর দায়িত্ব! কেরিয়ারের শুরুর দিকে, যখন তিনি একজন প্রমিজিং সোলজার হিসেবে কঠিন কঠিন সব অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তার ভেতরেও ঠিকই সময় বের করে ফেলতেন মাজানের জন্য। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেলো। দুদিন বাদে বিয়ে দিতে হবে। কোন্ পরিবেশে গিয়ে পড়বে কে জানে? আর্থিক সঙ্গতি, সামাজিক অবস্থান, কঠোর নিরাপত্তা – কোনোকিছুই মেয়েদের ভাগ্য নির্ধারণে কাজে আসেনা আসলে। সঙ্গী মানুষটার ওপরেই অধিকাংশ সময় নির্ভর করে তার সুখী হওয়া না হওয়া। তারা যেভাবে ওকে মানুষ করেছেন, তাতে বৈরী পরিবেশে কতোটা নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে সেটা অনেকটাই অনিশ্চিত। তবে তিনি চান না ডিফেন্সের এই বন্দী পরিবেশে তার মেয়ে জিবন পার করুক। তার মেয়ে! হ্যাঁ, তারই মেয়ে। মাবাবা দুজনকেই হারানো এতিম বাচ্চাটাকে তহুরা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বুকে তুলে নিয়েছিলো। একদিকে ভাই, ভাইয়ের বৌ হারানোর শোক, অন্যদিকে নিঃসন্তান দম্পতির রাতারাতি বাবামা হয়ে ওঠা- দুঃখ আর আনন্দের মিশেল!
খাওয়ার পর তারা তিনজন ড্রইংরুমে বসলেন। একটুপর সিন্ধি উঠে গিয়ে সংলগ্ন ব্যালকনিতে দাঁড়ালেন। টোবাকো পাইপে অগ্নিসংযোগ করায় হালকা মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি দরজার চৌকাঠে ঠেস দিয়ে ওদের দিকে ফিরলেন।
– বুজলেন বৌঠান – সিন্ধি শুরু করলেন। ‘ছেলেটা কিন্তু অনেক ভদ্র, আর চুপচাপ।
– কার কথা বলছেন ভাই? তহুরা অবাক হয়ে তাকালেন। যে ছেলেটা আমাদের বাসার সামনে…
– উহু উহু, সিন্ধি আবার ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর ধোঁয়ার ভেতর থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ওর বন্ধুটা। যে তার জামিনের জন্য এসেছিলো।
– আপনি কী করে জানলেন?
– সে আমার চেম্বারে এসেছিলো।… শুধু ভদ্রই নয়। বুদ্ধিমানও।
– কী বলছেন?
– হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। ফালতু নয়, ভালো পরিবারের সন্তান মনে হয়েছে। শাইন করবে…।
হাসানুজ্জামান চুপচাপ তাদের দুজনের কথপোকথন শুনছেন। তাঁর নিজের কাছেও কিছু বাড়তি ইনফরমেশন আছে, যা এঁরা কেউ জানে না। তিনি এখনই সেসব জানাবেন না ঠিক করেছেন। তাঁর অফিসের ড্রয়ারে টেলিস্কোপিক লেন্সে দূর থেকে – সম্ভবত অন্য কোনো বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে – তোলা ছেলেটার কিছু ছবির লার্জপ্রিন্ট রয়েছে। সিন্ধির কথা মিথ্যে নয়। চেহারায় মায়া আছে। কফিরঙের চোখের মনিদুটোয় বুদ্ধিদীপ্ত শার্প চাহনী। এই ছেলে বেকুবের মতো কাণ্ড করে কেনো? অবশ্য এ বয়সে তিনিও কম বেকুবি করেননি। তহুরার বোন, মানে তাঁর শালীদের হাতে কম হেনস্থা হননি। নির্ভেজাল প্রেমে পড়ে গেলে কেউ কেউ এমন হয়ে যায়। বিয়ের পরপর প্রথমদিকের ঘটনা, তহুরার এক মামাতো বোন ছিলো একটু ডানপিটে ধরনের। দুপুরে খাবার পর তিনি পেপারটা হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় বসেছেন। এমন সময় সে এসে বললো, “দুলাভাই, পান খাবেন, মিষ্টি পান।’ এসবে তাঁর অভ্যাস নেই। তারপরও শালীর মন জোগাতে বললেন “খাবো, নিয়ে আসো’। শরীরের পেছনে লুকানো হাত সামনে এনে সে পানটা বাড়িয়ে ধরলো, “উহু, আমার হাতে খেতে হবে, হাঁ করুন’। হাসানুজ্জামান পরম আবেগে শালীর হাতে বানানো পান মুখ হাঁ করে নিয়ে কামড় বসালেন, আর তারপরই – শুধুু তাঁর জ্ঞানচক্ষুই নয়, জ্ঞানকর্ণও সাথে সাথে খুলে গেলো! কাঁচামরিচ দেয়া সেই পান তাকে পুরোটা চিবিয়ে খেতে হয়েছে। ভাগ্যিস সারভাইভ্যাল ট্রেনিংগুলো করা ছিলো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব ভেতরে ভেতরে হাসছেন যদিও, কিন্তু বাইরে নিঃস্পৃহ মুখভঙ্গী করে তিনি তাকিয়ে আছেন। মনে মনে একটা পরিকল্পনা তিনি করে ফেলেছেন। ডিফেন্সের ভাষায় একে বলে আনঅর্থোডক্স ডিটেরেন্স- দৃশ্যমান কোনো নিরাপত্তাবলয় না স্থাপন করেও যখন নিরাপদ থাকা যায়। সিন্ধির সাথে আলাপ করতে হবে, কিন্তু তার আগে তহুরার মতামত জানা দরকার। তিনি আলগোছে একটা নির্দোষ মন্তব্য করলেন।
– কোন বিবাহযোগ্য পাত্রী থাকলে দেখতে পারো সিন্ধি!
শব্দ করে হাসলেন তহুরা। ‘নিজের পাত্রীই জোটাতে পারলেন না, আবার অন্যের…’
হাসানুজ্জামান স্ত্রীর দিকে অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকালেন। কিছু বললেন না। সিন্ধি নিশ্চয়ই মাইন্ড করবে। কিন্তু দেখলেন, সিন্ধি আজ শরীফ মেজাজে আছে।
– না না বৌঠান, আর একজন মানুষের দায়িত্ব নেয়ার যোগ্যতা আমার ছিলো না কোনোকালে।তাছাড়া চারদিকে এতো এতো সেপারেশন কেস দেখেছি একসময়, বিয়ে করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে তাতে!
– বুড়ো বয়সে বুজবেন!
– সয়ে গেছে। সামলে নেবো।’ সংক্ষিপ্তভাবে বললেন সিন্ধি৷ হাসানুজ্জামান উসখুস করলেন, “ইয়ে, ওই ছেলেটার কী অবস্থা এখন?’
– কোন ছেলেটা? দ্যা কুল গাই?
– উহু, দ্যা এ্যারোগেন্ট ওয়ান!
– জামিন হয়ে গেছে! হি হ্যাজ এ পয়েন্ট দো…
– হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ওকে একটু ডেকো তো তোমার চেম্বারে।
– কেনো?
ব্রিগেডিয়ার হাসানুজ্জামান পিএসসি এবার দুজনের সাথেই তাঁর নতুন আর একটি স্ট্রাটেজি নিচুস্বরে আলোচনা শুরু করলেন। ডিফেন্সের ভাষায় একে বলে ফ্লাঙ্কিং মেনুভার: যখন শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে ছোট একটি দলকে আলাদা করে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়!…
পর্ব ৯: কোরামিন
আবার ইলাবৌদির ফোন: “ঠাকুরপো, আপনের বোন্দুতো গত তিনদিন ধইরা বাইত আইতাছেনা! বাংলাবাজারে ভি যায় নাইক্কা। হের মুবাইলে তো কল ডুকতাছেনা- এক ছেরি খালি আবার চেষ্টা করনের বুদ্দি দিতাছে। এলা জবর চিন্তা হইতাছে।… ‘ আমি এবার আর ভড়কালাম না। জব্বারের ধরন এমনই, ধূমকেতুর মতো, কিংবা তিমিমাছ। হঠাৎ করে ডুব দেয়, তারপর নিজেই মন চাইলে ভেসে ওঠে। ওর সবচে যেটা বাজে তা হলো, যারা তাকে ভালোবাসে তাদের থেকেই সে পালিয়ে বেড়ায়। এই ইলাবৌদি ওর জন্য অনেক করেন। ভদ্রমহিলা জাঁদরেল, কিন্তু তাকে ভালোমতোই বশ করেছে জব্বার। মাসিক ভাড়া তো সে দেয়ই না, উল্টো তার কাছ থেকে ধার করে। তারপরও হাসিমুখে ছোট বাটিতে করে মাঝেমাঝে বাসায় রান্না করা মাছ তরকারি জব্বারের জন্য নিয়ে আসেন তিনি।
জামিন নেয়ার পর ওর সাথে সপ্তাখানেক হলো যোগাযোগ করিনি আমি, কিছুটা অপরাধবোধের কারণেই। আমার জন্য বেচারার এমন একটা ফ্যাসাদে জড়াতে হয়েছে। আসলে কারো সাথেই আমার যোগাযোগ নেই তেমন। ইন্টার্নশীপে ঢোকার পর থেকে আরও ব্যস্ত ছিলাম। আর এখনতো মায়াবতীর কারণে একে একে সবকিছুই ছেড়ে দিচ্ছি। অন্তির আব্বুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি, টিউশনিটা কন্টিনিউ করছি না আমি আর। উনি অবশ্য একমাসের পেমেন্ট নিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি যাইনি। পরে অন্তি মেসেঞ্জারে লিখেছিলো, ‘স্যার, আমাদের কী দোষ?’ সাথে পেলোর একটা ছবিও পাঠিয়েছে। লিখেছে, উই মিস ইউ! পেলোকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠলো। ইশ্ কতোদিন দেখিনা ওকে। সত্যিই পেলো হয়তো আমাকে মিস করে। কিন্তু কোনোদিন আর মায়াবতীর মুখোমুখি হতে চাই না এ জিবনে। কাউকে নিরঙ্কুশভাবে ভালোবাসা এক ধরণের অপরাধ। আমি সেই অপরাধে অপরাধী। কিছুই এখন আর টানেনা আমাকে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে ছোটন, নিজেকে বললাম।
বিভিন্ন ধরণের মানুষ দেখা আমার এক ধরনের শখ ছিলো এককালে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাস্তার সাধারণ লোকজনদের হাঁটাচলা, আচরণ, কথা বলার ভঙ্গী, এইসব গভীর মনযোগ দিয়ে খেয়াল করতাম। বেশ লাগতো। এখন কিছুই খেয়াল করিনা আর। আমি কি একধরণের বিকারগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছি? ইদানিং আর একটা বিষয়ও ঘটছে। মায়াবতীকে মাঝে মাঝেই পথেঘাটে দেখতে পাই! দেখে থমকে দাঁড়াই। পা চলতে চায় না। পরে ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি অন্য মানুষ। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার এমন একটা অনুভূতি হয়, সেটা ঠিক বলে বোঝানোর নয়। এমন ঘোর পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হয়েইকি মানুষ সুইসাইড করে? আমি কি সুইসাইডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? কিন্তু কেনো মায়াবতীকে এভাবে দেখতে পাই আমি? কেনো? হয়তো আমার অবচেতন মন যা দেখতে চায়, সেটাই দেখি! বিকেল হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা না বলে টেবিল ক্লিন করে অফিস ছাড়লাম আমি। লিফটে অনেক ভীড় থাকে এইসময়। লাইন দিয়ে নিচে বের হয়ে এসে রিসেপশনের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। আবার মায়াবতীকে দেখছি আমি! রিসেপশনের এককোনের সোফায় বসে আছে। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে সোজা। পরণে মিষ্টি কালারের সুতীর কামিজ সাদা টাইটসের সাথে পড়েছে, চুলগুলো দুপাশে ক্লিপ করা, খোলা। এবার আর আমি পাত্তা দিলাম না ওকে। জানি, একটু পরেই তাকালে দেখবো অন্য কোনো মেয়ে বসে আছে। হিহ্। আমি ওর সামনে থেকে গটগট করে হেঁটে দরজার দিকে আগাচ্ছি। কার্ড পাঞ্চ করার জন্য ওয়ালেট বের করে দরজার সামনে গেলাম, পেছন থেকে রিসেপশনের মেয়েটা আমাকে ডাকলো, ‘স্যার, ইউ হ্যাভ এ ভিজিটর…।’
– কে?
– উনি। বলে কোণের সোফার দিকে ফিরলো। সেদিকে তাকিয়ে আমি জমে গেলাম। মায়াবতী! সত্যিই মায়াবতী!! চোখ বড় হয়ে গেছে আমার, কারণ সে আমার দিকেই এগিয়ে এলো।
– তুমি এখানে? কার কাছে এসেছ?
– আপনার কাছে!
– ওপরে যাওনি কেনো? বলে আমি রিসেপশনের দিকে ঘুরলাম। কিছু বলার আগেই মেয়েটা ব্যাখ্যা দিলো, স্যার আমি প্রথমেই আপনাকে ইনফর্ম করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ম্যাম নিষেধ করেছেন… সরি স্যার…!
মায়াবতী মাথা ঝাঁকালো, ‘ হ্যাঁ, আমিই বারণ করেছি। আপনার কাজে ডিস্টার্ব করতে চাইনি!’
সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। আমার কাছে এসেছে কিন্তু আমাকেই না জানিয়ে বসে ছিলো।
– কতক্ষণ ওয়েট করেছ?
– একঘন্টার ওপরে। রিসেপশনের মেয়েটা বললো। তো এই পয়েন্টে আর কী বলা যায়? আমি আলগা স্মার্টনেস চড়িয়ে- যেনো কিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে – এমন ভাব নিয়ে গড়গড়িয়ে বললাম:
– আমার অফিস শেষ, কি করবে এখন?
– আমি… মানে একটা কথা ছিলো… চলুন… বলে বাইরের দিকটা ইশারা করলো মায়াবতী। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজা মেলে ধরে প্রথমে ওকে বের হতে দিলাম। তারপর নিজে বের হয়ে বললাম,
– আমার অফিস চিনলে কী করে?
– চিনতাম না তো।… খুঁজে খুঁজে বের করেছি। শুধু অফিসের নামটা শুনেছিলাম অন্তির কাছে! মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বললো সে।
– তাই?
– হ্যাঁ। পুরো কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ওই মাথা থেকে প্রতিটা বিল্ডিংয়ে হানা দিতে হয়েছে। অবশেষে খুঁজে পেলাম।
– মানে? কী বলছো এসব? গুগল সার্চ দিলেই তো পেতে।
– তা পেতাম, কিন্তু আমার মোবাইলটা ভেঙে ফেলেছি গত মাসে। তাই দেখতে পারিনি। অন্তিও তোমার ঠিকানা বলতে পারলো না।
আমি ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অফিস বিল্ডিংয়ের সামনের পোর্চে চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম।
– তুমি সত্যি সত্যি প্রতিটা বিল্ডিংয়ে ঢুকে আমাকে খুঁজেছ?
– হ্যাঁ।
– কতক্ষণ লেগেছে?
– সাড়ে তিন ঘন্টা!
– বলো কী?
– এতো অবাক হবার কী আছে? মানুষ কি মানুষকে খুঁজবে না? বলে এমন একটা চাহনী দিলো মায়াবতী, যে আমার সকল স্নায়ু ঝনঝন করে ঘন্টি বাজিয়ে দিলো। আমি মায়াবতীর চোখে সরাসরি চোখ রাখলাম! এই প্রথম! গভীর দৃষ্টিতে যেনো ভেতরের সব স্ক্যান করে ফেলবো। আহত চড়াইয়ের মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে- যেনো তার গোপনীয় সব আমি জেনে ফেলেছি, এখন জিবন মরণ সব আমার হাতে – এমন অসহায় ভাব নিয়ে তাকালো সে। দূরারোগ্য রোগীরা যেভাবে তাকায়। নাকের ওপর বিন্দুবিন্দু ঘাম, অনেক ক্লান্তও দেখাচ্ছে। মায়া হলো, চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম আমি। আর এক মিলিসেকেন্ড ওভাবে থাকলেই হয়তো সে, না হয় আমিই কেঁদে ফেলতাম। মায়াবতীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম ভালো করে। চোখের নীচে কালি। শুকিয়েছে। আবার আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে! কোথাও কিছু একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এসি কারেন্টে চলছিলো সব এতদিন, হঠাৎ ডিসি কারেন্ট শুরু হয়েছে। আমার বুকটার ভেতর কুয়াকুয়া করছে এখন। এমন কেনো লাগছে আমার? কী বলে এই অনুভূতিকে? আমাদের পাশ দিয়ে অন্য অফিসের লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। আমাদেরকে ফিরে দেখছে কেউ কেউ। ওনাদের নিশ্চয়ই এমন অনুভূতি হচ্ছে না?
– কেনো খুঁজেছ আমাকে? আমি কে? আমি তো একটা ফালতু ছেলে! (অভিমানের সুযোগ পেলে ছেলেরা সাধারণত ছাড়ে না)
– আচ্ছা, ঝগড়াটা আমরা কোথাও বসে তারপর করি, প্লিজ! আমার পা ব্যাথা করছে, অনেকক্ষণ হেঁটেছি! (যুগে যুগে প্রেমিকারা এভাবেই জিতেছে!)
– কোথায় যেতে চাও?
– খাবো কিছু একটা। আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, দুপুরে খাইনি!…
আমি এবার আর ওকে ক্ষমা করলাম না। খপ করে ওর ডান হাতটা ধরে – যেনো কতোদিনের সম্পর্ক আমাদের- এভাবে গোঁয়াড়ের মতো টেনে নিয়ে রাস্তা পার করলাম। উল্টোদিকের দুটো বাড়ি পরেই একটা কোজি রেস্টুরেন্ট আছে। পা ছড়িয়ে, পা তুলে যেমন খুশি সোফায় আরাম করে বসে খাওয়া যায় ওখানে। আমরা দুজন হাতধরাধরি অবস্থায় সিঁড়িতে উঠতে উঠতে মায়াবতী হাসলো।
– আমার হাতটা কেউ কিনে রেখেছিলো নাকি?
– হাতসহ পুরো মানুষটা! বলে আরও জোরে চেপে ধরলাম হাত। নরম পেলব হাতটা লাল হয়ে গেলো চাপ খেয়ে। ছাড়বো না, যা থাকে কপালে! আপনারাই বলুন, আমি কি কোনে অন্যায় করছি? ভাবছেন বিটিভি কীকরে এক নিমেষে এমটিভি হলো, তাইতো? ম্যাজিক, স্যার। প্রেম এক আশ্চর্য ম্যাজিক! সব বদলে দেয়। যাকেতাকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করিয়ে নেয়। প্রেম এক মহাশক্তির নাম। এই মেয়েটার জন্য আমি সব হারাতে বসেছিলাম। এখন কোরামিন দেয়ার মতো নিজেকে নিয়ে আমার মৃত্যুসজ্জায় হাজির হয়েছে! সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে আমি দুহাতে ওর ফর্সা হাতটা আঁকড়ে ধরলাম। তারপর আপনাদের চোখের সামনেই দুঃসাহসে মায়াবতীর হাতে চুমু খেলাম একটা! এটুকু শাস্তিতো তাকে দিতেই পারি আমি, তাইনা?
পর্ব ১০: চিলের ছোঁ
রিকশা একটি রোমান্টিক বাহন। তামাম দুনিয়ায় এর মতো সহনশীল যান আর একটাও নেই। আমার আর মায়াবতীর মত সদ্য প্রেমিক-প্রেমিকা যারা, তাদের কাছে এর কার্যকারিতা অতুলনীয়। প্রেম করেছে কিন্তু একসাথে রিকশায় ওঠেনি, এমন কাপলদের জন্য আমার দুঃখ হয়, করুণা লাগে। রিকশার বিবিধ উপকারিতাগুলো নিম্নরূপ:
১) ভালোবাসার মানুষটি সত্যিই আপনাকে ভালো বাসে কিনা, তা বোঝার উপায় একসাথে রিকশায় ওঠা। যাচাই করার এর চেয়ে কার্যকরী মাধ্যম আর দ্বিতীয়টি নেই। ছেলেটি বা মেয়েটি তার সঙ্গীর প্রতি কতোটা কেয়ারিং কতোটা একাগ্র ও রূচিশীল সেটা বোঝা যায় তার ঘনিষ্ট হয়ে বসার ভঙ্গীমাতে।
২) প্রেমিক-প্রেমিকা সবসময় একে অন্যের মুখদর্শন করতে পারে। ভেতরে ক্রিম লাগানো জোড়া বিস্কুটের মতো পাশাপাশি (বা তারচেও কাছাকাছি) ছুঁয়ে থাকা যায়। প্রেমিকার শাড়ির আঁচল, ওড়না, চুলের ঝাপটা এসব ফ্রি, এর জন্য আলাদা করে পে করতে হয় না।
৩) হাত ধরা যায়! (লাখ টাকার সুবিধা এটাই। খুনসুটির বিভিন্ন স্টেজে দিনে দুপুরে ডাকাতি করার অপরাধে এই হাতকে মাঝে মাঝে অবশ্য জেলেও যেতে হয়!)
৪) ঝগড়া করতে সুবিধা। আর ঝগড়ায় তৃতীয় ব্যক্তিকে স্বাক্ষীও রাখা যায়। তাছাড়া, আপনারা দুজন যখন কোনো বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করছেন, তখন তৃতীয় ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ মতামতও পেতে পারেন। যথা, ঠিকোই কইছেন মামা, হয় হয়, আমারও সেইটাই মনে হয়, ইত্যাদি। (অনেক সময় দেখা যায়, এই তৃতীয় ব্যক্তি তার নিজের কাহিনী বলার ব্যাপারে এতোই আগ্রহী, যে আপনাদের প্রেমালাপ গৌন হয়ে গেছে!)
৫) একমাত্র রিকশাতেই আপনি ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পেতে পারেন। যে উচ্চতায় রিকশাতে বসতে হয়, সেটা কোনোকিছু দেখার জন্য খুবই আরামদায়ক। চলন্ত রিকশায় চারপাশের দৃশ্য অনেকটা সিনেমার মতো প্যান করে দেখতে পারেন। আর এসব পাচ্ছেন একদম ফ্রি ফ্রি!!
৬) সেলফি তোলার জন্য রিকসা একটি আদর্শ স্থান। খেয়াল করে দেখবেন, সেলফিতে দুজনের পেছনে রিকশার হুডের কারণে দারুন একটা ফ্রেমিং হয়ে যায়, যা আপনার ছবিকে দেয় বিশ্বমানের মর্যাদা।
৭) বৃষ্টির সময় পর্দাঘেরা রিকশার উপকারিতা বিষয়ে কিছু ভাঙিয়ে বলতে হবে, না বুঝে নেবেন?
রিকশা নিয়ে আমার আরও অনেক গবেষণা আছে, আর একদিন বিস্তারিত বলবো আপনাদের।
আজ আমাদের তৃতীয় আউটডোর ডেটিং (আগেই বলেছি, ইনডোর ডেটিংয়ের কথা ভাবলেই দমবন্ধ লাগে! আমার হার্ট আবার খুবই নিরীহ)। কোথায় যাবো, ঠিক করিনি কিছু। তবে আর যা-ই করি, কোনো বৃহত বিপনীকেন্দ্রে মরে গেলেও ঢুকবো না। ইউনিভার্সিটির দিকেই যেতে বললাম রিকশাকে। মায়াবতীর সাথে শেষ যেদিন দেখা হলো, তার পর থেকে দিনের অধিকাংশ সময় আমরা অনলাইনে ছিলাম। বহু কথার মান অভিমানে পোক্ত করেছি বোঝাপড়াটা। কিন্তু মন তবুও মানে না। একে অন্যের কাছে যেতে চায়। অনেক খুশিখুশি লাগছে মনটা আজ। মনে হচ্ছে কোনো ঝরণার পাশে বসে আছি। ঝিরিঝিরি শব্দ পাচ্ছি জলপতনের। ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে একদম। আমার পাশে যে ভদ্রমহিলা লাগাতার কথা বলে যাচ্ছেন, তার নাম উম্মে হুজাইফা!
ভ্যানিলা আইসক্রিমের সাথে কাঁচাহলুদ আর চন্দন মেশালে যে রং পাওয়া যায়, ওর তেমনি। এতো রূপের দিকে সোজাসুজি তাকানো যায় না, তাকাতে হয় আড়চোখে। আমি সেভাবেই দেখছি এখন। সবকিছু এখনো আমার বিশ্বাসও হচ্ছে না; মনে হচ্ছে সিনেমা দেখছি। ভয় হয়, যদি সিনেমাটা এখনি শেষ হয়ে যায়? রিকশায় ওঠা অব্দি তাই ওর হাতটা ছাড়িনি আমি। আল্লারি আল্লা, আমাকে বলার এতো কথা জমা ছিলো ওর পেটে! অথচ বাসায় নাকি সে কথাই বলেনা! আলোচনার টপিকগুলোও ইউনিক! পেলো-পর্ব চলছে এখন।
পেলোর নাকি আরও চারপাঁচটা ভাইবেরাদার ছিলো, ফেলো মেলো বেলো আরও কিকিসব নাম বলছিলো! রাস্তার পাশে ফুল প্যানেলে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিলো ওরা। কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা ওদের বস্তাভরে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তার ফুপাই কী করে বীরদর্পে তাদেরকে রেসকিউ করে নিয়ে আসেন তারই সবিস্তৃত বর্ণনা চলছে! পয়েন্ট টু বি নোটেড ইয়োর অর্নার, এসব আলোচনা কিন্তু আমাদের প্রেমালাপেরই অংশ!! এবং আমি যে একজন মনযোগী শ্রোতা, সেটা বোঝানোর জন্য নিয়মিত ইন্টারভেলে হু দিয়ে যাচ্ছি! কিন্তু তাকাচ্ছি না ওর দিকে। তাকালে সহ্য হবে না, সেটাই কারণ। আমি বরং লক্ষ রাখছি ওর দিকে কারা কারা তাকায় সেটার প্রতি। ভীষণ রাগ লাগে এই পুরুষজাতটার প্রতি! কেনরে কাকু, পরওয়ারদেগার তোদের আন্ধা বানাতে পারলো না? খোদার দুনিয়ায় এই একটিই রূপবতী নারী, আর কাউকে চোক্ষে দেখিস না? অবশ্য কিছুকিছু মেয়েরাও তাকাচ্ছে ওর দিকে। সেটা নির্ঘাত হিংসায়! হুজাইফাকে সেটা বলতেই খিলখিল করে হাসলো সে।
– দেখুক। তুমি অমনযোগী বলেই সবাই এমন করে তাকাচ্ছে।
– কে বললো আমি অমনযোগী?
– আচ্ছা তাহলে বলোতো একটু আগে কী বলেছি আমি?
– পেলোর ভাইবোনদের কথা…
– আরে নাহ, বলছিলাম, পেলোর একটা এ্যাফেয়ার ছিলো পাশের বাসার একটা বেড়ালের সাথে। সেজোফুপি সেটায় পর্যন্ত বাগড়া দিয়েছেন! শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। উহ্ ভদ্রমহিলার হাতে দুনিয়ার কোনো প্রেমই নিরাপদ নয়। অথচ নিজে ঠিকই মেজরসাহেবকে (তৎকালীন) জ্যাভলিন মেরে ঘায়েল করেছেন। বিএল কলেজের ছাত্রী ছিলেন সেজোফুপি। উইমেন স্পোর্টসে কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। শর্টপুট, ডিসকাস আর জ্যাভলিন চালাতে গিয়ে ছুটিতে বাড়িতে আসা মেজরসাহেবকে নক আউট করে দিলেন একেবারে! তার আগে এলাকার বখাটে, মাস্তানদের বেশ কয়েকটাকে ঠেঙিয়েছেন। তার ভয়ে নাকি ওরা টটস্থ থাকতো। সেই সেজোফুপির কথা শুনলেই আমার হাঁটুদুটো নিয়ন্ত্রণ হারাবে স্বাভাবিক। পায়ে বল থাকেনা। মনে হয় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি! এটা মায়াবতীকে বললে সে চোখ পাকিয়ে বকুনি দিলো।
– তোমাকে কিন্তু তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে একদিন। পারবে না?
– অবশ্যই পারবো!… কিন্তু যে ভয়ভয় লাগে!
– কী বলো, কেনো? সেজোফুপি রাগী, তাই বলে কী তোমাকে খেয়ে ফেলবেন? আমার জন্য, তাঁর কাছে আমার হাত চাইতে পারবে না তুমি?
এমন করে বললো কথাটা, আমি ক্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়েই রইলাম। কী সুন্দর ওর মায়াভরা চোখদুটো! নিরীহ গোরুর মতো ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেই এখন ভালো লাগছে আমার! মায়াবতীও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি জানি কি ভাবছে, কাপুরুষ ভাবছে কিনা। আর তখন, তখন, তখন একটা দৈবঘটনা ঘটে গেলো! স্থান কাল পাত্র- কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে ঝট করে মায়াবতী তার ডানহাত দিয়ে আমার চিবুক ধরে ওর দিকে টানলো আমার মুখ। আর তারপর চিলের ছোঁ মারার মতো চকিতে আমার ঠোঁটের ওপর তার পেলব কোমল ঠোঁট নামিয়ে আনলো! শরীরের ভেতর থেকে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুত চলে গেলো!
– ভয় ভাঙিয়ে দিলাম! আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চাপাস্বরে কিন্তু স্পষ্ট করে বললো সে! আর আমি তাকিয়ে দেখলাম, পৃথিবীটার বয়স অনেক কমে গেছে! চারদিকে নতুন পাতার সমাহার। রিকসাওলার চেইন পড়ে গেলো তখন! পড়ারই কথা!!!
পর্ব ১১: মহাশোল
সেজোফুপি যদি টর্নেডো হন, আমার আম্মা সেই তুলনায় সুপার সাইক্লোন! আর এদের দুজনের যদি সংঘর্ষ বাঁধে, তাহলে কী দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে পারে মায়াটোনের জিবনে তাই ভেবে এখন শংকিত হচ্ছি! মায়াটোনের বিষয়টা বোধহয় পাঠক-পাঠিকা ঠিক ঠিক বুঝিলেন না। বিষয় হলো, অধুনা ক্রেজ হচ্ছে সেলিব্রিটি কাপলদের নাম সন্ধি করে একত্রে ডাকা। সেই অনুযায়ী আমরাও নিজেদের নাম এভাবে গ্রাফটিং করে নিয়েছি। অবশ্য আপনারা চাইলে ছোটোবতীও ডাকতে পারেন। তবে দয়া করে আমাদের সার্টিফিকেট নাম নিয়ে ওইসব এক্সপেরিমেন্ট না করাই ভালো। কী দরকার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দাঁতগুলোকে মাঢ়িছাড়া করার?
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি এয়ারপোর্টের সামনে। সিলেটের পরপর দুটো ফ্লাইট নেমেছে। যাত্রীদের বের হওয়া দেখছি, হঠাৎ আম্মার দিকে চোখ পড়লো। হুইল চেয়ারে বসে আছেন। সোনালি ফ্রেমের চশমা আর সোনালি চিকন পাড়ের কাঞ্চিভরম শাড়িতে আম্মাকে অন্যরকম লাগছে। আম্মার পেছনেই হুইলচেয়ারের হ্যান্ডেল ধরে আছে শিবশংকর -আমাদের শিবদা! তার সাজপোষাক দেখে না তাকিয়ে উপায় নেই। সাদা ফিনফিনে ধুতি আর পাঞ্জাবি-শার্টের সাথে বুটজুতো আর গায়ে চড়িয়েছে নীল রঙের ব্লেজার। মাথায় পাগড়ি। পান খাওয়া ঠোঁট আর পাকানো গোঁফ, সেইসাথে চোখের চাহনী দেখলে রক্ত হিম হয়ে যায়। ছোটবেলায় তাকে দেখে ভয় পেতাম। আম্মার সার্বক্ষণিক বডিগার্ড কাম এসিস্টান্ট। শিবদার পেছনে একান থেকে ওকান পর্যন্ত দাঁত বের করা পটলমার্কা হাসি নিয়ে মুখ দেখালো জব্বার! ইশ কী খুশী! হাতে একটা লম্বা প্যাকেট (পরে শুনেছি ওটার ভেতরে ছিলো হাওড়ের সিগনেচার আইটেম- মহাশোল। দশকেজি ওজনের।) তিনজনের দলটা গেট পেরিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জের কাছে আসতেই আমি এগিয়ে গেলাম। আম্মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।
– কিলা আছোগো আম্মা। আফনার শরীর ভালা আছেনি?
– অয়রে পুত, আল্লায় রাখছইন। কমরোর বিষে লরতে পারি না।’ উনি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। এরপরই পড়ে গেলাম শিবদার খপ্পড়ে। আমাকে জাপটে ধরে দেড় মিনিট বুকের ভেতর পিষলেন। এর ভেতরে যা যা শুনলাম, তা হলো, ‘কিতাবা, তুমি তো হুকাইয়া কাটি হইয়া গেছো।’ মানে আমি শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছি, গায়ের রং কালো হয়ে গেছে, আমি নিজের যত্ন নেই না, এতো পড়ালেখা করলে শরীর টেকে না। সবশেষে, নালিশের সুরে আম্মাকে বললেন, “জেঠিমা, দাদাভাইরে এব্লা বিয়া করানি লাগে!’
ঘটনা দেখে আপনারাও নিশ্চয়ই আমার মতোই চমকে গেছেন? সেটাই স্বাভাবিক। আমিও মাত্র ঘন্টা দুয়েক আগে জেনেছি। সুদুর সুনামগঞ্জের হাওর পেরিয়ে সেই সাল্লা থেকে এরা প্রথমে সিলেট এসেছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমাকে কল দিয়েছে জব্বার। আমি অফিস থেকে তড়িঘড়ি এখানে পৌঁছেছি। আজই বিকেলের ফ্লাইটেই তারা ফিরে যাবেন সিলেট। এতো তাড়াহুড়া করে আসার কারণ, জব্বার তাদেরকে বুঝিয়েছে, মায়াবতীর কারণে আমি নাকি যে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারি। সেটা অবশ্য সত্য। কিন্তু হারামীটা করেছে কী? কার বুদ্ধিতে সে আমার বাড়ি গেলো? ঠিকানাই বা পেলো কোথায়? এসব জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম না কারণ, সরকারী ফ্লাগ লাগানো একটা গাড়ী এসে লাউঞ্জের সামনে থেমেছে। দিরাই সাল্লা আসনের এমপি সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন আম্মার জন্য। পাঠাবারই কথা! গোটা দশেক জলমহালসহ পুরো সাড়ে পাঁচশো একর ভূসম্পত্তির মালিক চৌধুরাণী, মানে আমার আম্মা। তিনি শিলংয়ের মেয়ে। দেশভাগের আগে সিলেট শিলং সব একই ছিলো। আমার দাদার ছিলো পাথরের কারবার। সেই সূত্রেই আত্মীয়তা। শুনেছি গৌহাটির মহারাজাদের সাথে আমার নানার সখ্যতা ছিলো। নিয়মিত আসাযাওয়া ছিলো দুই পরিবারে। সেই বনেদিয়ানা এখন আর নেই, তবে আমাদের এলাকায় এখনো চৌধুরাণীর কথাই শাসন। কে কোথায় নির্বাচনে পাশ করবেন না করবেন সেটা চৌধুরীবাড়ির সমর্থনের ওপর নির্ভর করে।… এসব কথা লিখতে সংকোচ হচ্ছে। আমি কখনো এসব কাউকেই বলি না। বন্ধুদেরতো নয়ই। আম্মা হুইলচেয়ার ছেড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে কাছে ডাকলেন। “ফুরি আমার বালা লাগছে। তোমার দাদীর লাখান চেহারা।’
– কিতা কওগো আম্মা, আপনে তো না দেক্কিয়া পছন্দো কইরালাইছুইন…
গাড়ির দরজা খুলে শিবদা সসম্মানে সরে দাঁড়ালেন। আম্মা গাড়ীতে উঠে জানালার কাঁচ নামিয়ে বললেন, “তুমি চিন্তা খরিওনা, বৃগেডিওর সাবরে আমি বুজাইয়া সবতা ঠিক করমুনে…।’
গাড়ি চলা শুরু করতে জব্বার পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো। – দোস্তো!
– কিরে তুই গেলিনা?
– কোথায়?
– ওদের সাথে, তোর মাঐ আম্মার সাথে দেখা করতে?
– আবার! আমারে কি কামড়া পাগলায় কুত্তাইছে? আমার দায়িত্ব শেষ। এখন তারা তারা বুঝুক!’ তারপর হঠাৎই ওর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলো, ‘এই ফাজিল, তোরা যে এত্তো ধনী, এতোদিন বলিসনি কেনো? কী বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ী তোদের, ইশ্ আগে জানলে…
– আগে জানলে কী করতি?
– কত্তো টাকা ধার চাওয়া যেতো!
আমি হাসলাম। “বলার কী আছে বল্? এসব সহায় সম্পদ অর্জনে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই। সবই বাপদাদার অর্জন, সেসব নিয়ে গর্ব করার কী আছে?’
জ্ঞানীর মতো মাথা নাড়লো জব্বার। হুম, ঠিক বলেছ পোতোন চৌধুরী। তারপর নিষ্ঠুর চেহারা করে বললো, ‘জেঠিমা চাইলে – শিবদার অনুকরণে সেও একই সম্বোধন করে আম্মাকে- ওরকম পাঁচজন ব্রিগেডিয়ার বডিগার্ড রাখতে পারেন! বাপরে কী দাপট! তুই জানিস, শিবদার কোমরে সবসময় পিস্তল থাকে!’
– জানবো না কেনো, আমাদের দোনলা বন্দুকও আছে লাইসেন্স করা।
– একটা জিনিস দেখলাম দোস্তো, এলাকার কেউ ওর দিকে মুখ তুলে কথা বলেনা!
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শিবদার কুখ্যাতির শেষ নেই। এবং তার অধিকাংশই সত্যও। জলমহাল ইজারা নিতে অনেক পাওয়ার গেমিং চলে।
– বাদ দে এসব। ওদের ডেকে এনে ভালো করিসনি তুই। কী অঘটন ঘটে কে জানে?
– আরে আমি কি যেতে চেয়েছি নাকি?… বলতে গিয়ে মাঝপথে কাছিমের গলা ঢোকানোর মতো কথাটা মুখ থেকে আবার পেটে চালান করে দিলো।
– মানে?
– সেসব তোকে বলা যাবে না পোতোন, সিন্ধি আঙ্কেলের নিষেধ আছে।
– সিন্ধি আঙ্কেল মানে সেই প্রসিকিউটর?
– বললামতো, নিষেধ আছে।জব্বার আমার কাঁধে হাত রাখলো। কথা ঘোরাতে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ননস্টপ বলতে লাগলো এতোদিন সাল্লাতে কিকি খেয়েছে, দেখেছে, সেইসব। শেষে যোগ করলো-
– পোতোন, মেরে ভাই, আমরা না একমায়ের পেটের দোস্তো, তোমাকে একটা রিকু করি সোনা?
– করো, ওর ঢংয়ে আমিও হেসে সায় দিলাম।
– মায়াবড়ি, সরি মায়াবতীকে নিয়ে দয়া করে আর কোনো কেলেঙ্কারী ঘটিও না।
– আমি কী করেছি?
– না না তুই কিছুই করিসনি, শুধু জঙ্গলে ঢুকে বাঘিনীর সামনে থেকে তার বাচ্চা কোলে নিয়েছিস শুধু!’ দৃশ্যটা হাত নেড়ে অভিনয় করে দেখালো সে। তারপর জ্ঞানীর মতো বললো-
– দেখ দোস্তো, বাঘসিংহ মাংশাসী প্রাণী, গরুছাগল হলো ঘাসাসী প্রাণী আর হাঁসমুরগি ধানাসী প্রাণী, মানে আমরা। তো বাঘসিংহ ঝগড়া কাজিয়া করে করুক। আমরা বেনিফিশিয়ারি হিসেবে তার সুফল ভোগ করি, কেমন?
পর্ব ১২: দমবন্ধ লাগে!
মায়াবতীর সাথে আমার প্রেমটা শেষমেষ টিকলো না, জানেন! টিকবে কী করে, প্রেমে পড়তে না পড়তেই বিয়ের আয়োজন করলে কি আর প্রেম থাকে? সেটা তখন হয়ে যায় ‘ব্রেম’! এই ব্রেমও বহু ক্যাঁচাইল্লা জিনিস; একদিকে শাড়ি-আংটি-হলুদের তত্ত্ব, অন্যদিকে ফুচকা-ঝালমুড়ি-রিকশা! গরমভাতে পানি ঢেলে দেবার মতো মায়াবতীর ফুপাই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আমার আম্মার কাছে। আর তাই শুনে আম্মাও ঢাকায় আসতে দেরি করেননি।
যা ভাবা হয়েছিলো, সেসব কিছুই হলো না। দেখা গেলো, সেজোফুপীর সাথে চৌধুরাণীর এক নিমেষে ভাব হয়ে গেলো। বিশেষত আম্মার কাঞ্চিভরম শাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। এক্সক্লুসিভ জিনিস। দু বেয়ানের ভাব দেখে ব্রিগেডিয়ার সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। ডিফেন্সের ভাষায় এই অবস্থাকে কী বলে সেটা এখন তিনি মনে করতে পারছেন না। তার ওপরে বাঁধ সেধেছে ভাষা। সাবটাইটেল না থাকার কারণে ওই পক্ষের কোনো কথাই ঠিক ঠিক বুজতে পারছেন না। ফলে ঘটনা তার বিপক্ষে না পক্ষে যাচ্ছে বোঝা দুঃষ্কর। শত্রুপক্ষের গতিবিধি না জানলে যুদ্ধ-কৌশল ঠিক করা যায়? সিন্ধি থাকায় তবু যা রক্ষা। কিন্তু ব্যাটা এখন ওই পক্ষের উকিল হয়ে বসে আছে। সিন্ধির আব্বা সত্তরের নির্বাচনে সাল্লা থেকে টিকেট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। চৌধুরীদের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোই জানাশোনা আছে তাঁর। আহলাদে গলে পড়ছে একেবারে। গল্প তাঁরাই করছে, তিনি কেবল শুনছেন। উকিল কখনো বন্ধু হয়না, ভাবলেন তিনি। অবশ্য মহাশোলের সাইজ দেখে ওদের বনেদিয়ানা তিনিও কিছুটা আঁচ করতে পারছেন।
অবশেষে মুখমিষ্টি পর্বের পর, উম্মে নুজাইফাকে সামনে আনা হলো। চৌধুরাণী ডেকে তাকে কাছে বসালেন। শিবশঙ্কর তার জেঠিমার পেছনেই দাঁড়ানো (জেঠিমার সামনে তার বসার রেওয়াজ নেই)। নুজাইফার কাঁধে স্নেহের হাত রেখে ব্যাগ খুলে প্রথমেই আম্মা রুবী সেট করা একটা মহার্ঘ স্বর্ণের নেকলেস পড়িয়ে দিলেন ওর গলায়। প্রায় কোমর পর্যন্ত লম্বা। আস্তে করে বললেন, আমার হড়ির (শ্বাশুরি) গয়না, এখন তাকি তোমার! তারপর শিবদার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চৌধুরাণী যেনো তার মতামত নিচ্ছেন সেইভাবে মন্তব্য করলেন,
– এই ফুরি কিতা পারবানি দশগু জলমহালের ইজারা ঠিকবাবে বন্দোবস্তো করতে, শিবশঙ্কর?
– আইজ্ঞা জেঠিমা, তাইন পারবা!
– তাইলে তুই আগামি ম্যাগোর কালো বিয়াচূড়ার বন্দোবস্ত কর্।
– আইজ্ঞা জেঠিমা নিয়ালাইছি।
এরা সব মেঘের কথা কী বলছে, হাসানুজ্জামান বুজতে পারছেন না। সিন্ধির দিকে তাকাতে তর্জমা এলো: আগামি বর্ষায় বিয়ে, মানে একবছর পর! কেনো? না, আমার স্কলারশিপ এখানে মূখ্য কারণ নয়। বিষয় হচ্ছে, হাওড়ে বর্ষাকাল ছাড়া উৎসব জমে না। চৌধুরাণীর এক কথা “ম্যাগোর দিন ছাড়া আমার ফুয়ার হেঙ্গা হইতো না।’ ধামাইল, মানে গীতবাদ্য ছাড়া বিয়ার রেওয়াজ নাই তাঁদের খানদানে ! আর সেটা বর্ষাকাল ছাড়া হাওড়ে সম্ভব?
হাসানুজ্জামান যুক্তি শুনে মুখ হা করে ফেললেন। তহুরাও ঘনঘন মাথা নেড়ে বুঝুক না বুঝুক সিন্ধির মতোই সায় দিচ্ছে! তিনি খুবই অসহায় বোধ করলেন। পরে অবশ্য এই নিয়ে তিনি তহুরার কাছে একটা চরম মুখঝামটা খেয়েছেন, ‘মেয়েটাকে ঘরের বার করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ? কী এমন হবে; একটা বছর তো কাছে পাবো ওকে, সেটা সহ্য হয় না?” তারপর স্বামীস্ত্রী দুজন মিলে কাঁদলেন। মেয়ে হারানোর কান্না।
কাঁদলো মায়াবতীও। তবে সেটা ভিন্ন কারণে। এই একটা বছর সে কেমন করে আমাকে ছেড়ে একা থাকবে, এটা ভেবেই বেচারা কাহিল একদম। কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে। সেই লালচোখ নিয়েই সে বললো,
– আমাকে দূরে ফেলে রেখোনা মী, যতো তাড়াতাড়ি পারো আমাকে তোমার সন্তানের মা হতে দাও!
বিশ্বাস করেন, এটা সত্যি সত্যি বলেছে সে। না না আমি কিছু করি নাই। ইনডোর ডেটিং হলেও আমরা এক মিনিটের জন্য একা হতে পারিনি। জব্বারের টংয়ে এসেছি দুজন। হিসেব মতে আমরা স্বামী-স্ত্রী হইনি যদিও, তবে বাগদান তো হয়ে গেছে। কাবিন হবে আমি সুইডেন থেকে ফিরে আসার পর। কিন্তু এই বেটাকে সেটা বোঝাবে কে? কট্টর মাওলানা একটা। রাতারাতি মায়াবতীর বড় ভাই সেজে বসে আছে। খবর শুনে ইলাবৌদি হাজির। আমার কাছ থেকে একরকম ছিনতাই করে সে, আহো ভইন, আম্গো বাইত আহো, বলে মায়াবতীতে হাত ধরে টেনে নিচে নিয়ে গেলো। ঘন্টাখানেক পর একটা পুরাণঢাকার মেয়ে ঢুকলো ঘরে। মেয়েটা মায়াবতীর মতোই। কিন্তু পড়ে আছে লাল রঙের ঢোলা আফগানী সালওয়ার আর হাঁটুপর্যন্ত হলুদ টাইটফিট কামিজ (মাগোহ্!) দুইবেনী করা চুল দুদিকে হলুদ ফিতে দিয়ে বড় করে রিং বেঁধে ঝোলানো। মেয়েটার ঠোঁটে গাঢ় লিপিস্টিক আর গালে চড়া রুজ লাগানো। মডেলের ভঙ্গীতে দরজায় ঠেস দিয়ে সে দাঁড়ালো। চোখে লাস্য নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আঙুলে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে সে বললো, এলায় কী দেখতাছেন চোদুরিসাব? টাসকি খায়া গেলেন কেলা?’
– তুমি!!!’ ভুত দেখার মতো আমি চমকে উঠলাম। মায়াবতীকে পুরানঢাকার কুট্টিদের সাজে সাজিয়ে দিয়েছেন ইলা বৌদি! কথার উত্তর না দিয়ে সে নিজের পেছনে ঘরের দুটো কপাট আটকে দিলো। আমি কেলেঙ্কারীর আশংকায় জব্বারের যে কোনো সময় এসে পড়ার কথা তুললাম। বুড়ো আঙুল বাঁকা করে মায়াবতী ইশারায় নিচের তলা দেখালো, ‘ইলাবৌদি আটকেছে!’ তারপর ক্রাশকরা উড়োজাহাজের মতো একদৌড়ে উড়ে এসে আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়লো!…. আমি এই কারণেই বলছিলাম, দমবন্ধ লাগে!
তারপর আর কী?
আমাকে সিঅফ করতে একপ্লাটুন সামরিক বেসামরিক লোকজন এয়ারপোর্টে হাজির। এদের ভাবগতিক দেখে নিজেকে ভিভিআইপি মনে হচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব, মানে আমার হোনেওলা শ্বশুরসাহেব দামাতের ইমিগ্রেশনের ঝামেলা লাঘব করতে তাঁর কানেকশনে এয়ারপোর্টের সকল অফিসারদের টটস্থ করে ফেলেছেন একদম। ওয়াকিটকি হাতে একটু পরপর তারা এসে ঠকাস করে সেল্যুট মেরে আপডেট দিচ্ছেন। এর ফলে, মায়াবতীর সাথে একটু যে নিভৃতে কথা বলবো তার জো নেই। আরাফাত আর অন্তি তাকে ঘিরে বসে আছে দেখে আমি কাছে যেতেই অন্তি উঠে দাঁড়ালো। চাপা গলায় চোখ নাচিয়ে কাছে এসে বললো, ‘দুলাভাই, আমার গিফট না পেলে আপুর কাছেই ঘেঁষতে দেবো না!’
– কিসের গিফট্?
– মায়াআপুকে আমিই বুদ্ধি দিয়েছিলাম ফেক একাউন্ট খুলে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে!
– কোনটা ফেক একাউন্ট?
– ফুপিআন্টিরটা। ওই যেটাতে আপনি লিখেছিলেন, “মায়া, আপনার চোখের দিকে তাকালে দমবন্ধ হয়ে যায়” হিহিহি করে খিলখিলিয়ে হাসলো শয়তানটা। আপনারা যারা টিউশনি পড়াচ্ছেন, খেয়াল রাখবেন, ছাত্রী যেনো শালী হবার কোনো সুযোগ না পায়!
নিজেকে অনেকটা মেরেধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্লেনে তুললাম। নিজের সিটে বসতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পাশের সিটের যাত্রী তার জ্যাকেট ফেলে রেখেছে! লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে দুবাইগামী নির্মাণশ্রমিক। আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম। সে ভাবজমানো গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলো
– বদ্দা, ওই বেডিউগ্গারে দেক্খিলাম যে কান্দের, ইবা অনঅর কী লাগে? (মহাশয়, যে নন্দিনীকে দেখিলাম কাঁদিতেছে, সে আপোনার কী হন?)
আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। কী বলছে? এর কাছে বিতং দিতে ইচ্ছা করছে না এখন। এই এক সমস্যা বাঙালিদের। দেশিভাই পেলেই হলো! আরে বাপ, তোর ভাষা আমি জানি কিনা, সেটা জিজ্ঞেস কর আগে! আমি মাথা নাড়লাম শুধু। ওভারহেড বাঙ্কে হ্যান্ডলাগেজ রেখে সিটে বসলাম।
– বেডিত্তুন মনে অয় তোঁয়ারলাই পরাণ পুড়ে। পাইল্লে ইবারে বিয়া গরি ফেলন! (এই মহিলার আপনার প্রতি অনেক মায়া আছে বোঝা যায়, সুযোগ থাকলে একে বিয়ে করে ফেলেন।) নাহ, এ ব্যাটা তো পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু তার কথার ঢংয়ে হেসে ফেললাম। – তাই?
– জ্বে বদ্দা, দুনিয়াৎ নরম ফরানোর মায়ামানুষ কম। আই ন বুজিয়েরে কম বয়সৎ বিয়া গরি ফেলাই।
দমাস করে হেসে ফেললাম এবার। এই মালটা দুবাই পর্যন্ত জ্বালাবে আমায়। ওহ্ যীশু! প্লেন টেকঅফ করার পর দেশিভাই আমাকে নসিয়ত করলো,
– বদ্দা ঠ্যাং তুলি গম গরি বইয়োন। এতিক্কিন টেয়া দিয়েরে পেলেনোর টিকিট কিন্নোদে ননা?
ঠিকই তো। এতো দামের টিকিট, পা না তুলে বসলে পোষায়? আমি হাসি চেপে মোবাইল খুললাম। মায়াবতীর সাথে আমার ছবিগুলো দেখে সময়টা কাটিয়ে দেবো। কিন্তু পাশের মালটার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে আমার মোবাইলের ছবি দেখার ব্যাপারে তার আগ্রহ অসীম। মত পাল্টে আমি মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তারচে মায়াবতীর কথা ভাববো পাঁচঘন্টার পুরোটা পথ। অমন সুন্দর মুখটা কল্পনা করে পাঁচঘন্টা কেনো, পাঁচহাজার বছরও নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারি আমি!
পরিশিষ্ট:
একবছর পরে আমাদের বিয়ে হয়। আপনারা নিশ্চয়ই একমত হবেন- যেমনটা শুরুর দিকে বলেছিলাম- কোর্টকাচারি, পুলিশ, সেনাবাহিনী- সব সামলে আমাকে এই যুদ্ধে জিততে হয়েছে। হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলাম জানেন? আপনাদের আন্দাজেরও বাইরে। মালাউই! সম্ভবত এই প্রথম কোনো নববিবাহিত দম্পতি এশিয়া থেকে আফ্রিকায় হানিমুনে গেলো! ফুপাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাঁর সেনাপ্রধান বন্ধুর কারণে অনেক সমাদর আর আতিথেয়তা পেয়েছি সর্বত্র! ডক্টর সি পম্পিডুর সাথে স্থানীয় পোশাকে (!) একখান সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি আমরা তিনজন। সেটা প্রায় ভাইরাল হবার পথে। ওখানকার খনি এলাকা, কাসাভা ফিল্ড, এসব ঘুরে ঘুরে দেখেছি আমরা দু সপ্তাহ। হানিমুনে গিয়ে কেবল সুইমিংপুলে জলকেলি আর দোলনায় দোল খেতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই কিন্তু। মালাউইর কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে ব্যাপক দখল এসে গেছে আমার! মালউইয়ান একটা রোমান্টিক গানও শিখে ফেলেছি ইতোমধ্যে। চরম রোমান্টিক গান। মায়াবতীকে মাঝেমাঝে গানটা গেয়ে শোনাই। কথাগুলো ভারী মিষ্টি, হোক্কাডো হোক্কাডো, প্যানাপ্যানা… হোক্কাডো হোক্কাডো… আপনারা নেটে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন। আমার গানের কথা শুনে মায়াবতী আঁচল-চাপা দিয়ে হাসে, বলে, এ তো প্রেমের নামে পুরাই কেলেঙ্কারী! (সমাপ্ত)
======================
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য। আপনার মূল্যবান মতামত আমার প্রত্যাশা। নিজের অজ্ঞাতে ও অজ্ঞতায় যদি কারো মনকষ্টের কারণ হয়ে থাকি, সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। সবাই ভালো থাকবেন। মহান শহীদ দিবসের মর্যাদা অমলিন থাকুক এই কামনায়-
তুহিন সমদ্দার