বার্ধক্যজনিত কারণে কালীকে বিদায় করতে হলো। ওর যৌবনগত হয়েছে, হাঁটতে, চিবুতে কষ্ট হয়-চোখেও বোধহয় কম দেখে- আমাদের পরিবারের তখন তেমন বিলাসীতা করার সময় নয় যে একটি উপযোগিতাহীন গৃহপালিত প্রাণীকে বৃদ্ধাশ্রমের আয়োজনে বসিয়ে রাখি। বিশেষত, যখন বর্ষা মৌসুমে খড় একদম পাওয়া্ যায় না। শহরে বসে গরু পালনের রেওয়াজ তখন উঠে যাচ্ছে- অন্যান্যরা বেচে দিয়েছে- কেবল আমরা্ দুধের লোভে… বাবা একদিন কোত্থেকে এক উটকো লোককে ধরে আনলো- আর লোকটা দড়ি খুলে কালীকে নিয়ে চলে গেলো! গরু বিক্রিবাটায় একটি রেওয়াজ হলো- বিক্রির পরেও পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য গিয়ে দড়ি ধরলে তাকে টাকা দিয়ে নিবৃত্ত করতে হয়। ভেতরের ঘরের ন্যাড়া চকিটাতে হাফপ্যান্ট খালিগায়ে উপুর হয়ে ঘুমের ভানে পড়ে আছি আমি। মা এসে তাড়া লাগালো আমি যাতে দড়িটা একবার গিয়ে ধরি- তাহলে অন্তত শ’খানেক টাকা সম্মানী পাওয়া যাবে। কিন্তু কালীর জন্য এমন টাকা নিতে আমার বয়ে্ই গেছে! ওর ঘাড়ে যখন একটা চিরস্থায়ী ঘাঁ তৈরি হলো- সেখানে যাতে মাছি না বসে সেজন্য ‘বোরোলিন’ আর তিব্বত পাউডার মেখে দেইনি আমি? ওকে নিয়ে ঘাস খাওয়াতে কতো দূর-দূরান্তে চলে যেতাম, কতো লোকের বকা খেতাম তাদের ক্ষেতে-বাগানে ‘মুখ দিয়েছে’ বলে। মাঝে মাঝে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো-ওকে বলতাম তাড়াতাড়ি চল কালী-আমার ভয় করছে। জন্তুটা খুব্ বিবেচকের ভঙ্গীতে আবছা আদুড়ে একটা ডাক দিয়ে দ্রুত পা চালাতো। ওকে নিয়ে আমার সব স্মৃতিকে একশো টাকায় আমি বিকোতে পারি? ইচ্ছে করছিলো দড়ি ধরে চিরদিনের জন্য ওকে রেখে দেই। কিন্তু আমার সে অনুভূতি যদি সবার চোখে আধিখ্যেতা মনে হয়, সেই ভয়ে লাজুক আমি…। সম্ভবত আটশো টাকায় কালীর সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতি ঘটলো। ও চলে যাবার পর বাবা-মার আক্ষেপ আর আফসোসে বুজলাম যারা কিনেছে- তারা পালার জন্য নেয়নি। আমি ঘুমিয়ে আছি ভেবে বাবা চাপাস্বরে মাকে বললেন- বাজারে নিয়ে যাবে ওকে- ‘কাটবে’!