টেরাক

লক্কর-ঝক্কর ট্রাকটা এসে ল্যান্ড করলো ঠিক আমাদের দাড়িয়াবান্ধা আর ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্টের উপরেই। শালা আর জায়গা পেলোনা। কিন্তু যাবেই বা কোথায়? পাবলিক স্কুলের পুরো মাঠটাতেই তো একহাঁটু প্যাঁচপেচে কাদা। ওখানে নামার প্রশ্নই আসে না। আমরা ভাবছিলাম হয়তো মাল আনলোড করেই ওটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে যাবে। কিন্তু ট্রাকটা তো খালি! হেলপার চালিয়ে এসেছে- ২/১ জন লেবার যারা ছিলো, নেমে কোথায় যেন গেল আর ফিরে এলো না। এলো না তো এলোই না। যাবার সময় দুয়েকটা কাজের জিনিস যেমন, ইঞ্জিন কী আর জেড আকৃতির ক্রাঙ্ক হ্যান্ডেলটা নিয়ে গেলো। সে আমলে ওটা ট্রাকের সামনে রেডিয়েটরে নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে প্রবল বেগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্র্ট করাতে হতো। আমাদের ঐ বয়সে গার্জেনবিহীন একটা ট্রাক তো মহা কৌতুহলের বস্তু! প্রথমে সদলবলে ওটার পেছনের ক্যরিয়ারে উঠে আমরা দাপাদাপি করলাম। তাতে শান্তি হোলো না। এরপর সাহস করে ওটার ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্ট ধরে টানলাম। আরে, দরজা তো আটকানো নয়। তাহলে তো ট্রাকটা চালানোই যাবে। মুখ দিয়ে ভ্রভ্রভ্ররররররররররর শব্দ করে আর স্টিয়ারিং এলোমেলো ঘুরিয়ে কিছুদিন ট্রাক ড্রাইভার খেলা হলো। সহিদ তার মধ্যে বেশ কায়দা করে তালে তালে বলছে, ‘অকুপাইডস, অকুপাইডস’। শব্দটা তখন আমরা কেবল শুনেছি, কিন্তু মানে জানতাম না। এরপর শুরু হলো অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং! ড্যাশবোর্ডের প্লাস্টিক-মেটাল আউটফিট ভেঙেচুড়ে ওটার নাড়িভূড়ি বের করতে আমাদের বেশিদিন লাগলো না। এরপর সিটের নামকাওয়াস্তে গদি খুটে খুটে সর্র্বনাশ করা হলো। কেউ কেউ ওটার ছাদে উঠে উদ্দাম অঙ্গভঙ্গী করে বেশি মজা পেত। এমনি করে করে ট্রাকটা আমাদের প্রতিদিনের খেলার অপরিহার্র্য উপকরণে পরিনত হলো। ‘পলাপলি’ খেলায় ওটার নীচে মাটির গভীরে বসে যাওয়া ফাঁটা টায়ারের আড়ালে কিংবা ড্যাশবোর্ডের ‘গুহায়’ লুকানোর চমৎকার যায়গা আমরা খুঁজে পেতাম। এবং ততদিনে বুঝতে পেরেছিলাম- ট্রাকটা পরিত্যাক্ত। কেউ কেউ পুকুরে গোসল শেষে ওটার ছাদে লুঙ্গী শুকাতো। দুপুরে ভাত খেয়ে বড়ই আমলকি নিয়ে ট্রাকের ভেতরে বসে খেতে খেতে চমৎকার আড্ডা জমানো যেতো। ততদিনে লক্ষ করেছি ট্রাকের অনেক যন্ত্রাংশ উধাও হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। চাকা আর সামনের টারিট বাদে পেছনের কেরিয়ারটা পুরোটাই লোপাট। ভেতরে স্টিয়ারিং ছাড়া আদতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কিছু ইলেকট্রিক তার কিলবিল করে বেহুদা ঝুলে আছে। মিটারের গর্র্তগুলো খালি পরে আছে… অন্তত মাস ছয়েক চলে যাবার পর- যখন ট্রাকটার উপস্থিতি আমাদের কাছে সয়ে গেছে এবং উদাসীন হয়ে গেছি- তখন একদিন সকালে ট্রাক কিংবা ট্রাকের কঙ্কাল খণ্ড খণ্ড করে খুলে কয়েকটা লোক ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেলো। চলে যাবার পর যায়গাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিল। আমরা তাকিয়ে দেখলাম নীচে লম্বা লম্বা হলুদ ঘাস গজিয়েছে…!

অন্যদের জানিয়ে দিন