ছায়াহীনা

পর্ব ১.

তারপর নারকোল ছোবড়ার দড়ি কেটে সবাই ধরাধরি করে আমার দেহটা মাটিতে নামালো! আদ্দিকালের পুরোনো বিল্ডিং; চুণসুড়কির গাঁথুনী আর কড়িবড়গাওলা বিশাল শোবার ঘর। তিনমানুষ সমান খাড়া কড়িবড়গার নিচে একমানুষ সমান লোহার মোটা রডের সাথে ঝুলছিলো গাবদা চেহারার এক কলের পাখা। আর আমি ঝুলছিলাম সেই পাখার সাথে পেন্ডুলামের মতো- নারকোল ছোবড়ার দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে। পায়ের নিচে কাত হয়ে যাওয়া চেয়ার। আমার পাদুটো অনিয়ন্ত্রিতভাবে কিছুসময় খিঁচুনি দিলো। ঘাড়ের কাছে মট্ করে উঠলো। জিভটাও বোধহয় বেরিয়ে গেলো কিছুটা… তখন দরজায় ধাক্কা টের পেলাম। আমার মনটা আকুলি বিকুলি করে ডাকলো, ওগো, তোমরা এতোক্ষণে টের পেলে! জলদি এসে আমায় উদ্ধার করো।

কিছু একটা দিয়ে কপাটের কব্জা খসিয়ে হুড়মুড় করে ওরা সবাই ঘরে ঢুকলো। আমার জ্ঞাতিভাশুড়ের হাতে একটা খোন্তা। আরও দুচারজন সমর্থ পুরুষের সাথে আমার স্বামীও আছেন। ইশ্ আমার আঁচল খসে গিয়ে পুরো নাভি উন্মুক্ত। এভাবে কোনোদিন ওঁদের সামনে যাবো চিন্তাও করিনি। আজ মরণের পাড়ে এসে কী যাচ্ছেতাই কাণ্ড! আমার স্বামী উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে দৌড়ে এসে আমার পাদুটো নিজের বুকে চেপে ধরলো। হাহাকার করে ফুঁপিয়ে ডাকলো, এ কী করলে মীরা? আমি মিটিমিটি হাসছিলাম। বেশ হয়েছে এখন, বৌ ছাড়া পুরুষমানুষ কতো অসহায়! আমার স্বামীর চোখের জলে আমার পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে। ওগো, আমাকে নামাও সোনা আর কষ্ট দেবোনা তোমায়। এর চেয়ে কষ্ট আর কী দেবে মীরা? আর দেবোনা, এবার দড়ি কাটো! একটু সবুর করো, ওরা মই আনতে গেছে! সেই মই এনে ওরা আমার দেহটা নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। নীলরতন কবিরাজ যতোটা না ডাক্তার, তারচেয়ে বেশি অভিভাবক আমাদের। কালো চামড়ার ব্যাগটা পাশে রেখে একটা মিক্শচার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তিনি আমার স্বামীর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালেন। বিরবির করে বললেন, ঘরের লক্ষ্মীকে অযত্ন করলি রে হারামজাদা!

আমি বেশ মজা পেলাম। আমার স্বামীকে কেউ বকাঝকা করলে ভালো লাগে আমার। তিনি মিক্শচারটা খাওয়ানোর চেষ্টা করলের আমাকে। আক্ষেপে মাথা নাড়লেন। আমি তার হাত আঁকড়ে ধরে বললাম, ডাক্তারকাকা আমি মরিনি!

তিনি ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হনহন করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ঘরভর্তি মানুষের সামনে আমার স্বামী দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বুকে তুলে নিলেন। এই, কী শুরু করেছ? আমি মৃদু বকুনী দিলাম। আসলে ওর বুকে আদর খেতে আমার ভালোই লাগছিলো। আর ফাঁস দেয়ার আগে যতো যা-ই অবিশ্বাস অভিমান থাকুক না কেনো, এখনতো আমি জানি, আমার স্বামী কত্তো ভালোমানুষ! ওকে শান্তনা দিতে তাই বললাম, আমি মরিনিগো, কান্না থামাও। অবিশ্বাস নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। সেই চোখ, সেই ঠোঁট। ভ্রূর কাটা দাগটাতে কতো পুরুষালী আমার স্বামী। ভাবতেই শরীরের ভেতর কেমন করে উঠলো! আমি সবার সামনেই ওর বুকে মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললাম, সবাইকে একটু যেতে বলোনাগো, আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে! আমার স্বামী চমকে উঠে বললেন, মীরা, দিনেদুপুরে এসব কী কথা? একটু লাগছে এখন, আসোনাগো, আমি চোখে আমন্ত্রণ নিয়ে বললাম। আমার স্বামী বিরক্ত হলেও অমত করলেন না। আর তাছাড়া একটু আগে ফাঁস নিয়ে মরতে যাওয়া বৌয়ের আবদার কে ফেলতে পারে? আমরা ওটা করলাম। বলা ভালো আমি করলাম। উদ্দাম, উন্মাতাল, লাগামছাড়া! তারপর থেকে আমার স্বামী কেমন যেনো হয়ে গেলেন। চুপচাপ থাকে। অবশ্য আগেও চুপচাপই ছিলো। সারাদিন ব্যাবসায় নিয়ে ব্যস্ত! রাতে শুতে এসে আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে কেমন করে যেনো তাকায়! বড্ড মায়া লাগে আমার। আহা ভালোমানুষটা!

দিনতিনেক পর ছায়া কলঘরে বাসন মাজতে গিয়ে একটা কাণ্ড ঘটালো। ছায়া আমাদের কাজের ঝি। আমার বিয়ের আগে থেকেই এ বাসায় আছে! সন্ধ্যার দিকে একগাদা বাসন মেজে পাকঘরের দিকে আগাতে গিয়ে চিলেকোঠার দিকে তাকিয়ে ও বাবাগো মাগো বলে ঝনঝন করে বাসন ফেলে বারান্দায় এসে মূর্ছা খেয়ে পড়লো। আমার স্বামী দৌড়ে গেলেন। আমিও। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে মুখে ফেনা তুলে ছায়া যা বললো, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। চিলেকোঠায় সে নাকি আমাকে বসে থাকতে দেখেছে! হ্যাঁ, ছাদের ওইখানটায় উঁচু পাঁচিলে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝে আমি বসে রোদে চুল শুকাই। কখনো জোৎস্নারাতে বা অন্ধকারে একা বসে গুনগুন করতে আমার ভালোই লাগে! কিন্তু এখন তো আমি শোবার ঘরে। ছায়া কী করে আমাকে চিলেকোঠায় দেখলো? আমি যতোই বোঝাই, সে মাথা নেড়ে অবিশ্বাসের সুরে চেঁচায়। ও নাকি সত্যিই আমাকে দেখেছে, চুল খোলা, উলঙ্গ!

এ পর্যায়ে আমার মেজাজ চড়ে গেলো! বাড়ির কাজের মেয়ে হয়ে, এসব কী অলক্ষুণে কথা! আমি আমার স্বামীর কাছে নালিশ জানালাম, কতো বড় মুখ হয়েছে মেয়েটার! আমার স্বামী ওকে পরদিন সকালেই টাকাপয়সা দিয়ে বিদায় করে দিলেন! মেয়েটা যেনো বেঁচে গেলো। তারপর কয়েকদিন ধরে আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম, আমি কেনো গলায় ফাঁস দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে পড়লো না। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কেনো মরতে গিয়েছিলাম বলোতো? মৃদুল, মানে আমার স্বামী গম্ভীর মুখ করে বললেন, সুখে!

পর্ব ২.

আমার সৎমা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আপন মায়ের মতো। সত্যি বলতে কি, নিজের মাকে আমার সেভাবে মনেও নেই। তাই মাঝে মাঝে মনে হতো সৎমাই আমার মা। আমাকে স্নান করাতো, খাওয়াতো, চুল বেঁধে দিতো। তারপর যখন ছোট বোনটা হলো, সারারাত ট্যা ট্যা করে জ্বালিয়ে মারতো। ছোট হাতে আমি মাকে সাহায্য করতাম। কাঁথা পাল্টে দিতাম। বোনের জন্য একটু হিংসা হোতো, মায়ের কোলটা দখল করেছে বলে। আবার ভালোও লাগতো। কী কচি কচি হাত পা আঙুল নাড়ছে। সৎমা একদিন আমাকে স্নান করাতে নিয়ে গেলো। আমি খুবই খুশি হলাম। অনেক দিন পর মা সাবান ঘষে আমাকে স্নান করালো। তারপর পুকুর ঘাটের শেষ ধাপে বসে সৎমা আমার মাথাটা পানিতে চুবিয়ে ধরে রইলো বুকের সব বাতাস বের হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত! এরপর নিজেই মড়াকান্না জুড়ে দিলো, ওগো তোমরা কে কোথায় আছো শিগগির এসো, আমাদের মিনি জলে ডুবে যাচ্ছে!

জলেডোবা কাউকে কলস উল্টে তার ওপর উপুড় করে শোয়ানো হয়। আমাকেও সেভাবেই শোয়ানো হলো। মুখ দিয়ে অনেক জল বের হয়ে যাবার পর ক্ষিতিশকাকা আমার দুই পা ধরে উল্টোকরে ঝুলিয়ে বেধড়ক ঝাঁকুনি দিতে আমার শ্বাস ফিরে এলো। বেঁচে গেলাম আমি। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আমার আপন মাকে স্বপ্নে দেখতাম। মা মাথার পাশে বসে হাত বোলাতে বোলাতে আমার কষ্ট দূর করে দিতো।

বাবা ছিলেন ছাত্র-অন্ত প্রাণ শিক্ষক। জগত প্রলয় হলেও তিনি গা করার মানুষ নন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনেপয়সায় ছাত্র পড়িয়ে রাত করে বাড়ি ফিরতেন বাবা। নোংরা নোংরা গালি হজম করে না খেয়ে গুটিশুটি মেরে বিছানার এককোণে শুয়ে পড়তেন। তারপর আরও চাপা আক্রোশ আর হিসহিস অভিশাপ অভিযোগে সৎমায়ের কণ্ঠের খরখরে আক্ষেপ শুনতে পেতাম। তার কিছুটা বুঝতাম, বাকীটা বুঝেও না বুঝে থাকতে চাইতাম। ওই ঘটনার পর থেকে সৎমা আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাতো, কিংবা তাকাতোই না। তার চোখেমুখে আমি অনিশ্চয়তা দেখেছি। কেমন ভয়ে ভয়ে তাকাতো। মিনিট দশেক জলের নিচে ঠেসে ধরার পরেও যে পুঁচকে মেয়েটি বেঁচে যায়, তাকে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক! শুধু সৎমা কেনো? এলাকার অনেকেই আমাকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে কিসব যেনো বলাবলি করতো। পড়ালেখায় ভালো ছিলাম বলে বাবা আমাকে না পড়িয়ে পারলেন না। আমি ইউনিভার্সিটির পড়তে গেলাম। ওইসময় আমাদের পরিবারে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। বছরে একবার আমি বাড়ি যেতাম, মনসা পূজার সময়। আমাদের বাড়িতে মনসা মন্দির ছিলো। খুব ধুমধাম করে পূজা হতো। একবার গেলাম না। চিনি, মানে আমার ছোটবোনটা সেইবার পুকুরে ডুবে মারা গেলো। ও ছিলো ঠিক আমারই বয়সী, যখন আমি জলে ডুবে গিয়েছিলাম। এই ঘটনার পর আমার সৎমা উন্মাদ হয়ে গেলেন। সারাদিন পেটিকোট ব্লাউজ পড়ে পুকুরঘাটে বসে থাকে আর বিরবির করে।

ভার্সিটির গণ্ডী পার হবার আগে আগে মৃদুলের সঙ্গে পরিচয় হলো। তার আগে অনেকেই আমাকে মন দিতে চেয়েছিলো, আমি নেইনি; আবার ফিরিয়েও দেইনি। তাদের অনেকেই বাবার ছাত্র, এবং যোগ্য। নোট দেবার ছুতায়, বাড়ি থেকে পাঠানো এটাসেটা ডেলিভারি দেয়ার উছিলায় তারা ঘন্টার পর ঘন্টা হলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করতো। আমার ইচ্ছে হলে দেখা করতাম, নাহলে করতাম না। ছেলেগুলোর জন্য মায়া হতো অবশ্য। তবু কেনো তাদের কাউকেই আমার মনে ধরলো না, সে এক গভীর রহস্য। কিন্তু সেসব নিয়ে জল্পনা করে কোনো লাভ নেই। মৃদুলকে আমার মনে ধরেছিলো শ্রেফ ওর ভ্রূর কাটা দাগটার জন্য। মৃদুলের সবকিছুই তখন আমার কাছে ভালো লাগতো। ও হাসলে, রাগ করলে, বা মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে থাকলেও আমি নির্বাক ওর দিকে চেয়ে থাকতাম। এমনকি ও ঘুমিয়ে থাকলে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে আমি আবছা আলোয় মৃদুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। বিরবির করে বলতাম কে তুমি? কেনো এসেছ আমার জীবনে? কী চাও?

ছোটবেলায় সাপের খেলা দেখাতে বেদের দল আমাদের পাড়ায় আসতো। রাজ্যের ছেলেপুলেরা দল বেঁধে ওদের পিছু নিতো। আমিও নিতাম। হাঁটুঢাকা ফ্রক পড়ে আমিও সবার সাথে গোল হয়ে বসে ওদের সাপখেলা আর জরিবুটি বিক্রির নকশাবন্দী দেখতাম। শক্তপোক্ত চেহারার এক বেদে চ্যাপ্টা কাঠের বাক্সের ভেতর থেকে নানা জাতের সাপ বের করে গলায় পেঁচিয়ে খেলা দেখাতো। বাচ্চারা মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিতো। একসাথে সাত আটটা সাপ ঘাড়ে গলায় কোমরে পেঁচিয়ে লোকটা মুখের ভেতরে টরটর টরে টরে বলে একধরনের বিদঘুটে শব্দ করতো। মাথার বাবরিচুল চূঁড়ো করে বাঁধা, আর বাহুতে শীবের উল্কী! আমার লোকটাকে সুপারহিরো মনে হতো। কিন্তু লোকটার সাথে সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর তিনচারটা বেদেনী মেয়েদের দেখে হিংসায় আমার বুক জ্বলে যেতো। বিড়ি খেতো ওরা, একজনের মুখেরটা অন্যজন। আর বাংলা উর্দুর মিশেল দেয়া এক ভাষায় কথা বলতো। যার কতকটা বোঝা যেতো। ঠারেঠারে ওই বেদেপুরুষের সাথে অনেক অশ্লীল ভঙ্গী করতো মেয়েগুলি। তাদেরও চুল চূঁড়ো করে বাঁধা আর খাটো ব্লাউজে আটসাঁট আটপৌড়ে ছাপাশাড়ী। আমার খুবই রাগ হতো ওই ন দশ বছর বয়সেই। কেনো হতো, তার ব্যাখ্যা আমার কাছে তখন ছিলো না। এই এতো বছর পর, বিবাহিত সংসারের বেডরুমে গভীররাতে আচমকা জেগে উঠে বিদ্যুচ্চমকের মতো আমার মৃদুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো, আরে, এ তো সেই লোকটা! ঘাড়ে গলায় কোমরে নানাজাতের সাত আটটা সাপ জড়ানো বেদেপুরুষ! অবিকল সেই মুখ, ভ্রূর কাটা দাগটা পর্যন্ত!

আমি স্বামীকে জাগালাম না। কিন্তু সে নিজেই নিঃশব্দে চোখ খুললো। একদম অবাক না হয়ে বললো, এখনো দেখা শেষ হয়নি?

আমি হিসহিস করে বললাম, কে তুমি! বলো, কে তুমি? আমার স্বামী নির্লিপ্ত গলায় বললো, ঘুমোও, একটু পরেই ভোর হবে!

পর্ব ৩.

অশরীরীদের কোনো ছায়া থাকে না! ছোটোবেলায় এমন বদ্ধমূল বিশ্বাসের পেছনে কারণ ছিলো। গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার পাশে শ্যাওড়াগাছ পার হয়ে সন্ধ্যার পর কেউ তেমন চলাফেরা করতো না। প্রয়োজনে দুগ্রাম ঘুরে যেতো। কেননা, অদ্ভুতভাবে প্রতি বছর ওই স্থানটিতে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটবেই। একবার শশধরের (যার ডাকনাম ছিলো শসা!) গাভীন গরুটা মরে গেলো। দিব্বি ছিলো, ঘাস খেতে খেতে শ্যাওড়াগাছের নিচে এগিয়ে গিয়ে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মরে গেলো। শসার আহাজারী দেখে কে? আর একবার গাছের তলায় বাইরের অচেনা একটা লোককে ছুরিমারা অবস্থায় উল্টো হয়ে মরে পড়ে থাকতে দেখেছে গাঁয়ের লোক। পুলিশ এসে নিরাপরাধ শংকরকে ধরে নিয়ে গেলো। পরে পেপারে উঠলো শংকর জালটাকা চক্রের সদস্য ছিলো। এইসব অপঘাত মৃত্যুর পর গাঁয়ে কিছু কানাঘুষা রাষ্ট্র হতো অযথাই। সেসব কথা ডালপালা ছাড়িয়ে শেষমেষ নিরীহ গাছটির ওপর গিয়েই বর্তালো। আর আমরা যারা ছোটো ছিলাম, বড়দের ঠারঠার কথার কারণে অজানা আতঙ্কে অনেককিছু এড়িয়ে চলতাম। যেমন, বাড়িতে অচেনা কোনো লোক বা বয়ষ্ক কোনো ভিখিরী এলে কিংবা একতারা হাতে বাউল এসে গান ধরলে আমরা প্রথমে সন্দেহের চোখে তাকে মাপতাম। চোখ গোল করে দেখতাম মাটিতে তার ছায়া পড়ে কিনা। কারণ তারাতো ওই শ্যাওড়াগাছের সামনের মাটির রাস্তা দিয়েই হেঁটে এসেছে! আর অশরীরীরা তো এভাবেই মানুষের বেশ ধরে আসে! তাদের চেনার সহজ পন্থা হলো, মাটিতে ছায়া পড়ে কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া। ছেলেবেলার সেইসব রহস্যময় দিনগুলি বড় হবার সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়। এখন গ্রাম বদলে গেছে। রাস্তা চওড়া আর পাকা করতে গিয়ে শ্যাওড়াগাছের সেই ছায়াছায়া শান্তি কবেই নেই হয়ে গেছে! নতুন পিচঢালা সেই রাস্তা ধরে গাড়ি হাঁকিয়ে আমি আমার বাবার বাড়িতে এলাম। বিয়ের দশদিনের মাথায় দ্বিরাগমনে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে, আমাকে তাই স্বামীসহ আসতেই হলো। মৃদুল কোনো ত্রুটি রাখেনি। অনেক ধুমধাম আড়ম্বরেই আমি বাড়িতে পা রাখলাম। কখনো ভাবিনি আমার জিবনটা এমন সুখের হবে। আমার যদিও আসার একদমই ইচ্ছা ছিলোনা, কারণ বাড়িতে সৎমা, তা আবার উন্মাদ। কিন্তু মৃদুলের মা, মানে আমার শ্বাশুড়ি জোর করে পাঠালেন।

বর দেখতে পুরো গ্রাম উপচে পড়লো আমাদের বাড়িতে। সবাই ওর খুব প্রশংসা করছিলো। এলাকার ছেলেরা- যার ভেতরে আমার প্রেমপ্রার্থীও দু একজন ছিলো- তাদের চোখে একধরণের সমীহ দেখেছি আমি। মৃদুল আসলে সমীহ করার মতোই একজন মানুষ। মার্জিত, হাসিখুশি, রূচীশীল। নতুন জামাইকে নিয়ে এ যাত্রায় অনেকগুলো ছোটোছোটো অনুষ্ঠানের রেওয়াজ আছে। তার অন্যতম হলো দশপিঠা। দশধরণের পিঠা দশবাড়ির বৌঝিরা বানিয়ে জামাইকে খাওয়ায়। বৃদ্ধা দিদিশ্বাশুড়ীরাও তখন রগড় ঠাট্টা মশকরায় শামিল হন। গ্রামের মেয়ে বৌরা মৃদুলকে জেঁকে ধরলো। বয়ষ্ক বৌদিরা আবার রেখেঢেকে বলতে জানে না। মৃদুল খুবই শান্তভাবে তাদের মশকরা শুনছিলো। হাসিমুখে তাদের ‘পিঠাপিঠির অত্যাচার’ সহ্য করছিলো। কিন্তু মেয়েগুলোর ওকে নিয়ে আদেখলেপনা আমার সহ্য হচ্ছিলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো একটা সিন ক্রিয়েট করি। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করলাম। তবে তারপর থেকে মাসখানেক মৃদুলকে আমার কাছে ঘেঁষতে দিলাম না। এই একমাস আমার নাঁকিকান্না আর ঘ্যানঘ্যান সে সহ্য করলো। পরে আমি ভেবে দেখলাম, কী কারণে এতো রাগ করলাম। কিছুই পেলাম না। মৃদুলকে আমার খুব দুষ্প্রাপ্য কিছু মনে হয়নি এতোদিন। ওর প্রতি কমিটমেন্ট ছিলো, আকর্ষণও ছিলো তীব্র। ব্যাস ওটুকুই। নেকুনেকু প্রেমে গদগদ আমি কখনোই ছিলাম না। কিন্তু গ্রামের মেয়েগুলোর চোখে যে হিংসা আর লোভে চকচক কাড়াকাড়ি আমি দেখেছিলাম- সেটাই আসলে আমার রাগের কারণ। মনে হচ্ছিলো, আমার স্বামী বুঝি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে! তারপর থেকে শুরু হলো রাত জেগে একা একা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা! মৃদুল প্রথম দিকে টের পায়নি। একদিন পেলো। আমার চোখ থেকে একফোঁটা জল ঝরে পড়লো ওর গালের ওপর। মৃদুল ঘুম ভেঙে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। তারপর বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কী হয়েছে, কী হয়েছে মীরা? কিন্তু আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তীব্র আবেগে কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। বাকিরাত মৃদুল আমাকে বুকে নিয়ে জেগে রইলো। শেষরাতে তন্দ্রার ভেতর আমার মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।

আমার শ্বশুরবাড়িটি যৌথ। বনেদিও বটে। চক মেলানো বিশাল বারান্দার নকশাদার সাবেকি বিল্ডিং। আমার দাদাশ্বশুরের নিজহাতে বানানো এই বাড়ী। শুনেছি তিনি ইংরেজদের কন্ট্রাকটর ছিলেন। বাড়ির পেছনের পুকুরটি কেটে সেই মাটিতে ইট পুড়িয়ে বানানো হয়েছে ইমারতটি। আমার শ্বশুরের কোনো আপন ভাইবোন ছিলোনা। ব্যবসা সামাল দিতে জ্ঞাতিগোষ্ঠী এনে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন বাড়িতে। তাদেরই সন্তান সন্ততি মানে আমার স্বামীর কিছু জ্ঞাতি ভাইবোন এখন থাকে বিশাল বাড়িটির নিচতলায়। আর আমরা থাকি দোতলা তিনতলা মিলিয়ে। সবাই মৃদুলকে অত্যন্ত ভালোবাসে, মান্য করে। বয়সে বড় দুই দাদা আছেন, তাঁরাও মৃদুলকে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখেন। আর সবার মুখে মৃদুল ছোটবাবু। শুনেছি বড়বাবু ছিলেন আমার শ্বশুর সাহেব। এমনই চলছিলো এতোদিন। আমি একদিন প্রাইভেসির প্রশ্নে নিচতলার সিড়ির মাঝখানে একটা লোহার গেট লাগালাম। মৃদুল একটু আপত্তি করছিলো। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ির কাছে ভোট না পেয়ে রাজি হয়ে গেলো। এখন আলাদা সিড়ি, আলাদা গেট। দোতলায় কেবল আমি আর আমার শ্বাশুড়ি। আগে নিচতলার ওরা হুটহাট ওপরে চলে আসতো। কিন্তু গেট হবার পর সেসব বন্ধ।

তিনতলাটা আসলে দখল করে আছে মৃদুলের শতশত কবুতর। তাদের গুপ গুপ আওয়াজ ভরদুপুরে অদ্ভুত শোনায়। আমি কবুতরের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করি, ওরা যেনো কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। কিন্তু সেটা ধরতে পারিনা। হঠাৎ একদিন মৃদুলের শার্ট কাচতে গিয়ে একটা মেয়েলি পারফিউমের ঘ্রাণ পাই। এই ঘ্রাণ আমার পরিচিত নয়। মৃদুল কখনোই এসব মাখে না। তাহলে কার? আমি মন খারাপ করে চিলেকোঠার চাতালের পাশের সিঁড়িতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে ভাবি। মৃদুলকে আমার সন্দেহ হয় না। আবার খুবই সন্দেহ লাগে মৃদুলকে। কারণ ওই চোখের আমন্ত্রণের যে যাদু, সেটা আর কেউ না হোক, আমিতো জানি। মৃদুলকে হারাবার একটা অজানা ভয় আমার শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোতের মতো বয়ে যায়!

পর্ব ৪

আমি অনেক দেরিতে কথা বলা শুরু করি। মায়ের এজন্য চিন্তার শেষ ছিলোনা। শুকনো সরু সরু হাত পা আর বড় বড় দুটো চোখ মেলে আমি কেবল ড্যাবড্যাব করে সবকিছু নির্বাক তাকিয়ে দেখতাম। আমার তখন তিনবছর বয়স। সবাই ভেবেই নিয়েছে আমি আর কথা বলবো না। আমার প্রিয় খাবার ছিলো ডাব নারকেল। একদিন গাছ থেকে অনেক ডাব পাড়া হয়েছে কিন্তু কাটা হচ্ছে না। আমি ড্যাবড্যাব চোখে ব্যাপারটা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করলাম। তারপর অধৈর্য হয়ে মুখ ফুটে বললাম, ডাব খাবো! একসাথে দুটো শব্দ!!

আমার মা রান্নাঘরে হেলেঞ্চা শাক বাছছিলো, কথা শুনে বটি কাত করে দৌড়ে এলো, আরে আমার মিনি দেখি কথা বলে! তারপর কী আদর কী আদর। কথা ফুটে যাবার পর শুরু হলো আর এক যন্ত্রণা। আমি সারাদিন বকবক করতে লাগলাম। এমনকি ঘুমের ভেতরেও। আমার বকর বকরে লোকজন অতীষ্ট হয়ে যেতো। এতো কথা বলতে পারে পুঁচকে মেয়েটা। আশেপাশের প্রতিবেশীদের বাড়িতে আমার ছিলো অবাধ যাতায়াত। বয়ষ্ক মহিলারা ছিলো আমার সই। তাদের সাথে পান খেতাম আর পাকা পাকা কথা বলতাম। সকালের দিকে পাড়া বেড়াতে নামতাম, দুপুর হলে বলতাম সই, ভাত খেয়ে আবার আসছি! কাণ্ড দেখে সবাই হাসাহাসি করতো আমাকে নিয়ে। মা যখন ভাই আনার জন্য হাসপাতালে গেলো, আমার রুক্ষু চুল তেল দিয়ে আঁচড়ে বেনী করে দিয়ে গেলো। বললো আমি কালই এসে পড়বো, তুমি কাকীর কাছে লক্ষী হয়ে থেকো। তা আমি তো এমনিতে খুবই লক্ষী! কাঁসার বাটিতে খেজুরগুড়ে মুড়ি মেখে দিলে কব্জি ডুবিয়ে হাপুস হুপুস খাই, আর বেড়ালের লেজ ধরে টানি! মা পাশের বাসার কাকীকে বলে গেলেন আমাকে যেনো রাতে ঘুম থেকে তোলা হয়, না হলে তো বিছানা ভাসাবো! কাকী মাকে আস্বস্ত করলেন, একটা রাতেরইতো ব্যাপার, তুমি চিন্তা কোরোনা বড়দি। মা ফিরে এলো একদিন বাদে। আমি সইয়ের সাথে গল্প করছিলাম। মা এসেছে শুনে দৌড়ে গেলাম খালপাড়ে। মা কোথায়? হোগলা দিয়ে মোড়ানো মাকে দুতিনজন নৌকা থেকে তুলে আনলো! তারপর বাঁশের খাটিয়ায় তুলে বোল হরি, হরি বোল বলে তারা চলে গেলো শ্মশানঘাটের দিকে। আমার বকরবকর বন্ধ হয়ে গেলো, সাথে খাওয়াদাওয়াও। ড্যাবড্যাব চোখে কেবল নির্বাক তাকিয়ে থাকতাম। চোখ দিয়ে জল ঝরতো খালি, কোনো শব্দ হতো না!

মাসখানেক পর, আমার অবস্থা দেখে প্রতিবেশিরা বাবাকে পরামর্শ দিলেন বাড়িতে লোক আনার। সংসার কে সামলাবে? পুরুষমানুষ ঘরের লোক ছাড়া কিভাবে থাকে? তাছাড়া মেয়েটাকে তো বাঁচাতে হবে, ওর যত্ন করার কে আছে বাড়িতে। বাবা মৌন থেকে সম্মতি দিলেন। কাঁচাপাকা চুলে টোপর পড়ে সৎমাকে ঘরে তুললেন। আমার সইদিদিরা চোখে আঁচলচাপা দিয়ে নিহার নিহার বলে কাঁদলেন! নিহার আমার মায়ের নাম। আমি কাঁদলাম না। পাশের বাসার কাকী হিসহিস করে চাপাস্বরে বললেন, একবৌকে খেয়েছে, এখন আবার আর একটা! আমি অতোটা বুঝলাম না। তবে আমার মা যে বিনা চিকিৎসায় মরেছে সেটা বুজলাম। কিন্তু বিয়ের পরেও বাবার খাসলতে কোনো পরিবর্তন এলো না। সেই ছাত্র পড়ানো, সেই সমাজসেবা, সেই রাত করে টর্চহাতে বাড়ি ফেরা। সাথে যোগ হলো নতুনমায়ের চিল চিৎকার। আমি ভয়ে জড়োসরো হয়ে কাঁথায় মুখ ঢেকে থাকতাম।

*****

বিয়ের বছর ঘুরে যাচ্ছে কিন্তু কোনো নতুন সংবাদ না শুনতে পেয়ে এলাকাবাসী আছে বেজায় দুঃশ্চিন্তায়। আমার শ্বাশুড়ি তার ছেলেকে বৌ নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার পরামর্শ দেন। কিন্তু মৃদুলের তখন ব্যবসার ভীষণ চাপ। নতুন একটা প্লাস্টিক ইমালশন বাজারে ছাড়া হয়েছে। অনেকটাকা লগ্নী করা হয়েছে এ্যাডভার্টাইজিং আর প্রোমোশনের জন্য। এ অবস্থায় ছুটি নেয়া অসম্ভব। মৃদুল তার ভেতরেও সময় বের করে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। চারদিকে চা বাগান আর মাঝখানে টিলার ওপর ছোট্টো কটেজে প্রথম দুটো দিন আমাদের আনন্দ নির্জনতা আর অন্তরঙ্গতায় কেটে যায়। খুব বেশী ঘোরাঘুরি হয়না আমাদের। যে উদ্দেশ্যে এসেছি, সেটাতে পূর্ণ মনযোগ দেই। আমাকে ইমপ্রেস করতে মৃদুল যথাসাধ্য চেষ্টা করে। তৃতীয়দিন রাতের খাবার শেষে লাল শাটিনের রাতপোশাকে আমাকে দেখে মৃদুলের চোখে ফের ঘোর লাগে। তাড়া দেয় ঘুমুতে যাবার। আমি জানি, ঘুম নয়, তার প্রত্যাশা অন্যকিছু। আমারও। কিন্তু একটা বিষয় মনের ভেতর খচখচ করছে। মৃদুল আমাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে ঘাড়ে গলায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। অস্ফুটে বলে, আমার লাল কবুতর! আমি একহাতে ওর চুলগুলো খামচে ধরতে গিয়ে টের পাই মৃদুলের হাত আমার নাইটির ভেতরে। দমবন্ধ অবস্থার ভেতরেও আমি নিজেকে ভেসে যাওয়া ঠেকাই। মেয়েটা কে, মী? মৃদুলের হাত থেমে যায়, কোন্ মেয়েটা? আমি একপাক ঘুরে ওর মুখোমুখি হই, মিষ্টি করে হেসে বলি, মী, তুমি জানো কার কথা বলছি। মৃদুল হাসে, ওহ্ সেই পারফিউমওয়ালী! আরে ও তো প্রোডাক্ট বেচতে অফিসে এসেছিলো! আমি না-বুঝ বালিকার মতো হাসি। এতো ঝটপট উত্তর তখনই দেয়া সম্ভব, যখন সেটা আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়। আহ্, মৃদুল যদি আর কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র দেরি করতো উত্তরটা দিতে, কিংবা না বুঝতে পারার অভিনয় করে জানতে চাইতো, আমি কার কথা বলছি! মিথ্যে বলা একটা আর্ট, সবাই পারেনা। মৃদুল কেনো মিথ্যেটা গুছিয়ে বলতে পারলো না, এই দুঃখে আমার মনটা কুঁকড়ে গেলো। মৃদুল আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, কী কাণ্ড বলো, এক ডজন পারফিউম গছিয়ে দিয়ে গেলো মেয়েটা। আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট। লতিফকে বলেছি শোরুমে রাখতে, যদি কেউ কেনায় আগ্রহী হয়! আমি তীর্যক চোখে মৃদুলকে দেখলাম। একদম নিখুঁত। এতোটা কোনো পাকা অভিনেতাও পারবে না। কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, তোমার জামা থেকে ভুরভুর করে ঘ্রাণ আসছিলো তো! মৃদুল মাথা নাড়লো, হ্যা, মেয়েটা বলেছে ধুয়ে ফেলার পরেও নাকি ঘ্রাণ থেকে যায় কাপড়ে। তাই টেস্ট করলাম! এ কথা শুনে বুক থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেলো যেনো! ইশ্ আমার স্বামীটা নেহাৎই ইনোসেন্ট, আর তাকে নিয়ে আমি কিনা সন্দেহ করি! অনুশোচনায় মুহুর্তেই আমার শরীর সাড়া দিয়ে উঠলো! আমার স্বামীর হাতদুটো আবার সচল হলো। আমি দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম ওকে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো আমরা খুলে নিলাম একে অন্যের বসন। আর আদিম মানব মানবীর মতো বিশুদ্ধ শরীরী প্রেমে সিক্ত করলাম দুজন দুজনকে। চরম পুলকের মূর্ছনায় আমাদের বিছানাটা একটা উড়োজাহাজের মতো টেক অফ করলো শেষ মুহূর্তে!

পর্ব ৫

হানিমুন থেকে ফিরে আসার পর আমার শ্বাশুড়ি আমাকে আশির্বাদস্বরূপ একটা রূপোর টাকা দিলেন। যাকে বলে চাঁদি! পাকিস্তান আমলের।আমি যত্ম করে সেটা সিঁদুরের কৌটায় উঠিয়ে রাখলাম। মৃদুল অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার ব্যবসার কাজে। রাত করে বাড়ি ফেরে, কোনো কোনো দিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। আমার কেমন ভয়ভয় করে। কিন্তু ভয়টা যে কিসের, সেটাই বুঝিনা। ইদানিং তিনতলায় একা একা সময় কাটাই। একদম একা নই অবশ্য, শ খানেক কবুতরের সাথে। ওদের দেখাশোনা করার আলাদা লোক আছে। কবুতরগুলো মহানন্দে ছাদময় ঘুরে বেড়ায়, কট কট করে ভূট্টা খায় আর গুপগুপ করে ডাকে! আমার পায়ের শব্দ পেলে ওদের গুপগুপ বেড়ে যায়। আমি কানখাড়া করে বুঝতে চেষ্টা করি ওরা কী বলছে, কিন্তু ধরতে পারিনা। কিছু একটা যে বলছে, এবং সেটা বলছে যে আমাকেই, এটা আমি বেশ বুঝতে পারি। মৃদুলকে বিষয়টা জানাবো ভাবছিলাম। কিন্তু সে এটা শুনে হাসবে ভেবে আর বলিনা! খাবার টেবিলে আচমকা একদিন প্রসঙ্গটা তুলি। সুজাতার স্বামীর হার্টে পাঁচটা ব্লক ধরা পড়েছে শুনেছ? আমার স্বামী খুব বড় রকমের চমকে যায়। কোন্ সুজাতা? সে খেই ধরতে জানতে চায়। যে তোমাদের বাড়িতে থেকে এইচএসসি দিয়েছিলো। তোমার ফুলপিসির ননদের মেয়ে না জানি কী। ওহ্, তা তুমি কার কাছে শুনলে? ছায়া বলেছে। আমি অকপটে স্বীকার করি। কিন্তু বাকিটা বলিনা। মৃদুল চোখ সরু করে তাকায়। ছায়া বলেছে? আর কী বললো? বলেনি, ওর সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো? হা বলেছে তা ও; তবে আমি সেটা বিশ্বাস করিনি! বললাম ঠিকই, কিন্তু মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো।

রাতের আলো নিভিয়ে দেবার পর মৃদুল আমাকে আদর করতে করতে অহেতুক সুজাতার প্রসঙ্গ তুললো। জানো, মেয়েটা চায়নি এখানে বিয়ে হোক, আরও পড়তে চেয়েছিলো। ওর পরিবার জোর করে চাপিয়ে দিলো। কিন্তু কোনো লাভ হলোনা। অল্প বয়সে বিধবা হলো। শুনে আমি বরফ হয়ে যাই। আমি কখনো বলিনি সুজাতার স্বামী মারা গেছে! মৃদুল কি করে জানলো? আমার মাথাটা ঘুরছে। মৃদুলকে সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুতে চাইলাম। কিন্তু যে পর্যায়ে সে আছে, সেটাকে বলে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। ওখান থেকে ফিরে যাওয়া যায়না। অগত্যা নিজের অনিচ্ছায় ওর ভোগের সামগ্রী হিসেবে নিজেকে সঁপে দিতে হলো। সে রাতে মৃদুল খুব জান্তবভাবে আমাকে নিলো। আঁচড় কামড়ের একপর্যায়ে কি সুজাতা বলেও ডাকলো আমাকে? আমি নিশ্চিত নই। হয়তো মনের ভুল, হয়তো নয়। পরদিন সকালে বিধ্বস্ত আমাকে বারবার সরি বললো মৃদুল। জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। আমি ক্ষমা করে দিলাম। মাকে হারানোর পর থেকে আমার মাথার ওপর ছায়া দেবার মতো কেউ ছিলো না। বাবা স্বার্থপরের মতো তাঁর নিজেরটা দেখেছেন। সারাটা জিবন আমার গেলো ছায়া খুঁজতে খুঁজতে। অনেক আশায় আর তীব্র ভালোবাসায় মৃদুলকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ফুলশয্যার রাতে তাকে বলেছিলাম, তুমি শুধু আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে থেকো! কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, আমার সেই ছায়া ক্রমশ সরে যাচ্ছে। কিংবা আমি একটা বড় চক্রান্তের শিকার। কাউকে কিছু বলার নেই, কিছু বোঝাবার নেই। তাহলে এখানে আমি থাকবো কেনো? এ সংসারে আমি কে? সারাদিন বিছানায় শুয়ে মাকে মনে করে কাঁদলাম। সন্ধ্যায় আমার জন্য একটা চমৎকার শাড়ী নিয়ে এলো মৃদুল। পরদিন সেই শাড়ী পড়ে আমি নারকেল ছোবড়ার দড়ি দিয়ে ফাঁস নিলাম!

কিন্তু কী কারণে আমি ফাঁস নিয়েছিলাম, সেটা একদমই মনে পড়ছে না আমার। ছায়া না থাকায় কাকেইবা জিজ্ঞেস করি? আর মৃদুল ওই ঘটনার পর কেমন যেনো চুপসে গেছে। কথা একদম বলেই না। খাওয়া দাওয়াতেও ভীষণ অনিয়ম। আমি কথা বললে চুপ করে মাথা নিচু করে থাকে, উত্তর দেয়না। মনে হয় সে নিজেকে দোষী ভাবছে।আমি দিনের অধিকাংশ সময় তিনতলার চিলেকোঠার সামনের ছাদে বসে কাটাই। দুপুরবেলা সেদিন সিঁড়িতে শব্দ শুনে বুঝলাম কেউ ছাদের দিকে আসছে। আমি একটু আড়ালে চলে গেলাম। মৃদুল মোবাইলে কথা বলতে বলতে উঠে এলো। কবুতরের দানা হাতে নিয়ে ছাদময় ছড়িয়ে দিলো। সব কবুতর কার্নিশ থেকে লাফিয়ে নেমে গুপগুপ করে দানা খাচ্ছে। হঠাৎ সে অবাক হয়ে গেলো, মোবাইলে বললো, একটু হোল্ড করো। তারপর নতুন একটা কবুতরের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাল কবুতর। এটা তার ঝাঁকের কবুতর নয়। কিভাবে এলো? মৃদুল তড়িঘড়ি নিচে নেমে গেলো। আমি ওর কাণ্ড দেখে হাসলাম। নিজের কবুতর চিনতে পারছে না।

মাসখানেক পর আমার শ্বাশুড়ির ঘরে মৃদুলকে কথা বলতে শুনলাম। প্রসঙ্গটা যে কী নিয়ে সেটা বুঝতে পারছি না। তবে মা ছেলের দ্বন্দ্বটা পরিষ্কার। মৃদুল বলছে, হলে এখানেই হবে, না হলে নাই। তার মা বলছে, সে এ বাড়ীর যোগ্য নয়। মৃদুল পাল্টা উত্তর দিলো, একবার তো তোমাদের সম্মানরক্ষা করলাম, লাভ হলো কিছু? কার কথা বলছে বুঝতে পারছি না। তবে আমার শ্বাশুড়িকে এভাবে দ্বিমত করতে দেখিনি কখনো। বিয়ের পর বৌভাতের দিন উনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি এই বংশের সম্মান রেখেছ; আশির্বাদ করি সুখী হও! এখন মনে হচ্ছে ওই কথাটার ভেতরে একটা রহস্য ছিলো, যেটা আমি তখন বুঝিনি। ওই ঘটনার কিছুদিন পর বাড়ীতে একটা সাজসাজ রব পড়ে গেলো। হলুদ দেয়ালে চূনকাম পড়লো। আশপাশে সাফ সুতরো করা হলো, জানালায় লাগলো নতুন পর্দা! মৃদুল অনেকরাত করে বাসায় ফেরে আজকাল, তার গা থেকে ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে নাক ডাকে। আমি ওর বুকের ওপর একটা হাত রেখে সন্তর্পনে শুই, যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখি ওর ঘুমন্ত মুখটা।

একদিন খুব ভোরবেলা মৃদুল উঠে পাঞ্জাবী পড়ে বের হয়ে যায়। অনেক লোকজন নিচতলায় জড়ো হয়েছে। তিনচারটা গাড়ি করে ওরা চলে যায়। আমি তিনতলার চিলেকোঠায় কবুতরদের গুপগুপ দানা খাওয়া দেখি। হঠাৎ একটা কবুতর বলে ওঠে। বরকনে এলো বলে, বরকনে এলো বলে! আমি স্পষ্ট শুনলাম। ওরা এটা কেনো বলছে? একটা কবুতর এসে আমার মাথায় ঠোকর মারলো। আমি ভয় পেয়ে দোতলায় নেমে আসলাম। হঠাৎ দেখি বাড়ীভর্তি অনেক লোকের হইচই। শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে কাদের যেনো ওপরের ঘরে আনা হচ্ছে। এতো লোকের কথার কারণে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ভীড়ের ভেতরে উঁকি দিতে দেখলাম মৃদুল। মাথায় টোপর পড়া, বরবেশ। পাশে কনেবেশে সুজাতাকে চিনলাম। যদিও কখনো দেখিনি, তবু আমি এখন জানি এ সুজাতা। নিশ্চিত জানি। কারণ আমি কবুতরের সব কথা বুঝতে পারি!

বরকনে আমাদের বেডরুমের দিকে যাচ্ছে। আমার আর সহ্য হলো না। তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে এসে ওদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম। মৃদুল, কোথায় যাচ্ছো? তোমার পাশে এ কে? আমাদের বেডরুমে কী চায়? মৃদুল আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ঘরে ঢুকলো। আমি প্রাণপণে পেছন থেকে ওদেরকে আটকাতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। মৃদুল ঘরে ঢুকে সুজাতাকে সহ দেয়ালের দিকে গেলো। আমার হাসিহাসি মুখের বড় একটা ছবি টাঙানো দেয়ালে। কাঁচের ওপর চন্দন দিয়ে সাজানো। একটা শুকনো মালা পড়নো ফটোফ্রেমে। আরে, এ ছবিটা এতোদিন চোখে পড়েনি কেনো? আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার হাতের ছোঁয়ায় সিঁদুরের কৌটাটা পড়ে গিয়ে রূপোর টাকাটা ঝনঝন শব্দ তুললো। সবাই চমকে ফিরে সেদিকে তাকালো। কে একজন এসে আমার ফটোটা খুলে নিচ্ছে। আমি দৌড়ে বারান্দার নেমে এসে আমার শ্বাশুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ঝংকার তুলে বললাম, এসব কী হচ্ছে মা, আপনার ছেলে কাকে নিয়ে এসেছে? আমার শ্বাশুড়ি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ফটোটার দিকে তাকিয়ে কাকে যেনো বললেন ঠাকুরঘরে নিয়ে রাখতে। সবাই চুপ করে আমার কান্না দেখছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিকেলের রোদ আমার গায়ে পড়েছে, কিন্তু কোনো ছায়া পড়েনি মেঝেতে! কে যেনো বললো, এই নতুন লাল কবুতরটাকে তাড়া তো, ঘর নষ্ট করবে! (সমাপ্ত)

অন্যদের জানিয়ে দিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *