ডিম

ডিমের খবরটা এষাই আমাকে প্রথম দেয়। বাথরুমের ঘুলঘুলিতে কিসের যেন একটা ডিম! টিকটিকির নয়তো? এষা উদ্বিগ্ন চোখে জানতে চায়। আমি পেপার থেকে চোখ তুলে কথাটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি। কনসিভ করার পর থেকে এষা দিনের অধিকাংশ সময় বাথরুমেই কাটায়। তলপেটে সর্বক্ষণই একটা চিনচিনে ব্যাথার কথা বলে এষা। তার ধারণা মেটাবলিক সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করলে ব্যাথাটা চলে যাবে। আর এসময় এই ধরনের বাতিক মেয়েদের একটু চড়ে যায় হয়তো। এষা তাই বাথরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা তার আসন্ন মাতৃত্বের পরিচর্যা করে।

প্রথম যেদিন খবরটা সে আমাকে জানালো তখন তার মুখ ছিল অনিশ্চয়তা আর অনিচ্ছায় নীল। সে যেন ভেবেই পাচ্ছিলোনা মাত্র আটমাসের বিবাহিত জীবনে কী করে একটি সন্তান তার পেটে এসে যায়। বিয়ের পর থেকেই সে বলে আসছে একটা চাকরি পেয়ে সংসারটা একটু গুছিয়ে তারপর সন্তান নেবে। কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রি-কশন্ কিছুই সে ঠিক করেনি। নারী পুরুষের দেহগত জটিল বিষয়গুলিতে সে খুবই অনভিজ্ঞ। একটি মেয়ের জন্মগতভাবে এ বিষয়ে যেটুকু জ্ঞান থাকা উচিত, এষার তাও নেই। আমি অনেক সময়ই এ ব্যাপারে খোলাখুলি আলাপ করতে চেয়েছি, কিন্তু পুরো বিষয়টি তার কাছে খুবই নোংরা মনে হয়েছে। ফলাফল যা হবার তাই। এখন সারাক্ষণ গা গুলানো ভাব আর তলপেটে ব্যাথা নিয়ে সে নির্জীব সাপের মত স্তিমিত হয়ে থাকে আর কোঁকায়।

বাথরুমের প্যানের উঁচু ফ্লোরের উপর দাঁড়িয়ে অনেকটা ঘাড় উঁচু করে ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে ডিমটা খুঁজে পেলাম। কিছুই না। শুধু একটা ডিম। প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত আমার ডানহাত সেদিকে এগিয়ে যায়। ডিমটা ধরে। না। টিকটিকির সবচেয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজাতিটির পক্ষেও সম্ভব নয় এতোবড় ডিম পাড়া। তবে নিশ্চয়ই কোন পাখীর ডিম হয়ে থাকবে। ঘুলঘুলির স্লাইডিং কপাটটি আধখোলা থাকে নির্মল বাতাসের প্রত্যাশায়। সেই ফাঁকা দিয়েই সম্ভবত ডিমের গর্ভধারিনীর আগমন ঘটেছিল। ঘুলঘুলিটি খালি নেই। একটা অর্ধেক খালি হওয়া হারপিকের বোতল, এককৌটো গুড়ো সাবান, দুটি পরিত্যক্ত টুথব্রাশ আর গোটা দুয়েক কাঠিসহ একটা নকল মোরগমার্কা ম্যাচবাক্স সেখানে সহাবস্থান করছে। বাথরুমে আগুনের কী ব্যবহার, এটা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে – আগে যখন আমার প্রচণ্ড সিগারেটের অভ্যাস ছিল, তখন ইমার্জেন্সী হিসেবে এখানে একটা ম্যাচ রেখে দিয়েছিলাম। বিয়ের পরপর কোন এক নাজুক মুহূর্তে আমি সম্মত হয়েছিলাম সিগারেট ছেড়ে দিতে। কিন্তু তা ছিল শুধু কথার কথা। পরে এ নিয়ে ঝগড়া হয়েছে, এষা আমার সিগারেট ভেঙেছে, টাকা আটকে রেখেছে, দিব্যি দিয়েছে; তবু আমি ছাড়িনি। সে কূটগন্ধ পছন্দ করেনা বলে আমি পরবর্তীকালে বাথরুমে ঢুকে খেতাম। কনসিভ করার পর থেকে অবশ্য সিগারেট নিজেই বন্ধ করে দিয়েছি। ডিমটা পেড়েছে সেই ম্যাচবাক্সের পাশেই। আমার হাসি পেয়ে যায় এই ভেবে যে এ তল্লাটে – যদি সত্যিই পাখী হয়ে থাকে – তবে সে আমার এই ছোট বাসার সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য জায়গাটিই পছন্দ করে নিতে পেরেছে। এষা বাড়ীর সব জায়গায়ই পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে। কিন্তু শুধু বাথরুম পরিষ্কারের ব্যাপারে তার এলার্জি আছে।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ওর সাথে আমার প্রেম হয়। তখন আমরা হলের সামনের মাঠে বসে প্রতি সন্ধ্যায় প্রেম করতাম। এই এষাকে তখন মনে হয়েছিল দুর্দান্ত স্মার্ট একটি মেয়ে! হয়তো ওরও আমাকে। কিন্তু বিয়ের পর আমরা দুজনেই অন্যভাবে নিজেদের আবিষ্কার করি। যুক্তিবাদী হিসেবে কলেজ জীবনে নিজের একটি পাকাপাকি পরিচিতি ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি একটু আধটু ভাগ্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। এরপর গোমেদে ব্যবসা, মুক্তায় যশ, নীলায় শান্তি, ইত্যাদি বিষয়গুলি আমাকে অনেকটাই অধিগ্রহণ করে ফেলে। ওদিকে এষা একটা চাকরি, একটা চাকরি বলে কীযে করেনা! আমার মনে হয় পৃথিবীতে মেয়েরা সবসময় একটা খোলস চায়। যে খোলসে তারা নিজেদের ডিমের মতো আটকে রাখবে। ঝগড়াঝাটির উত্তপ্ত মুহূর্তে আমরা নিজেদের ভাগ্যকে শাপশাপান্তকরি। তবু তার মাঝে, তার মাঝেই – একদিন সে তার গেস্টেশনের কথা জানায়। আমি উথাল-পাথাল স্বপ্নসাগরে নিজেকে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখে দায়িত্বপ্রবণ স্বামীর মতো তাড়াতাড়ি তাকে গাইনোকলোজিস্টের কাছে নিয়ে যাই। মনের মধ্যে একটা চিনচিনে আনন্দ, একটা কষ্ট কিংবা একটা দুরাশা নিয়ে আমি চেম্বারের বাইরে অপেক্ষাঘরে বসে থাকি।

চিকিৎসার সাথে একুরিয়ামের কী সম্পর্ক সেটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। প্রতিটি ডাক্তারখানাতেই এ জিনিষটি দেখা যায়। কিম্ভুত কদাকার অচেনা মাছগুলো পান চিবোচ্ছে। তেনারা সকলেই অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ও জাগতিক বিষয়ে উদাসীন বলে আমার মনে হলো। এখন একটা গজালমাছ বা ব্যারাকুডা এর মধ্যে ছেড়ে দিলে কাণ্ডটা দেখা যেত! আচ্ছা, মানুষ এ্যাকুরিয়ামে চ্যাং মাছ পোষে না কেনো? সেগুলোতো অনেক সুন্দর এগুলোর চেয়ে। ঐযে পেট ফুলিয়ে বেশ রঙচঙ ধারণ করে যে মাছটা ঢং করে সাঁতরাচ্ছে, ও শালাকে দেখলেই ঘুষখোর অফিসারের কথা মনে হয়। এটাকে একমাত্র মানায় ইনকাম ট্যাক্স অফিসে। এমন যদি হতো – স্থান অনুযায়ী মাছ রাখা হবে, তাহলে? যেমন সচিবালয়ের একুরিয়ামে থাকবে রাঘব বোয়াল টাইপের মাছ, বিমান অফিসে থাকবে ফ্লাইং ফিস, পুলিশ অফিসে দাঁড়কানা মাছ, আর আর… আমি ভাবনার খেই খুঁজি… সরকারী অফিসে… নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় এমন কোন মাছ আছে কী? ধাত্রীবিদ মহিলা চিকিৎসক এষার প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছিলেন- ‘ট্রাই টু কনটিনিউ দ্য প্রেগনেন্সী’! কিভাবে তিনি বুঝতে পারলেন-এষা মা হতে চায়না? তিনি আমাকেও ভেতরে ডেকে পাঠান। তিনজন প্যারামেডিক বা ঐ জাতীয় আধা-চিকিৎসক মহিলার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এষা প্রধান ডাক্তারের সামনে অনেকটা জুবুথুবু হয়ে বসে ছিল। আমি ডাক্তারনী ভদ্রমহিলার দিকে তাকাই। এককালে তিনি যে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন তা বোঝা যায়। প্রথমেই ভদ্রমহিলা একটা সহজকঠিন প্রশ্ন করেন।

–  বাচ্চাটা রাখতে চাচ্ছেন না কেন?

–  আপনি নিশ্চিত ও কনসিভ করেছে?

–  না নিশ্চিত নই। তবে সত্যিকারেই যদি বাচ্চা এসে থাকে, তবে তা রাখতে হবে। এটা প্রথম ইস্যু। একে কোনভাবেই নষ্ট করা যাবেনা। যদি এবরশান করাতে গিয়ে টিউবে ইনফেক্শন হয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে আর সন্তান না-ও হতে পারে!

এষা এ সময় তার আসন্ন বিসিএস পরীক্ষার কথা বলে। ডাক্তার বলেন- আপনার মত হাজার হাজার মেয়ে এ অবস্থায় পরীক্ষা দিচ্ছেন। ভদ্রমহিলাকে তখন খুব স্নেহময়ী মনে হয়। কখনো কখনো মানুষের অভিভাবকের প্রয়োজন হয়। এষাকে অনেক অনুনয় করেও আমি যে যুক্তি দেখাতে পারিনি, সেই এষা ভদ্রমহিলার এই কথায় একদম মিইয়ে যায়। আমার ভেতরে একধরণের নিশ্চিন্তির ভাব খেলা করে। তিনি কয়েকটা টেস্ট ও অষুধের নাম লিখে দেন। এরপর থেকে এষা কেবলই বাথরুমে আর বাথরুমে অসংখ্যবার জলের ঝাপটা আর ঈষৎ বমি বমি ভাব নিয়ে পাতার পর পাতা ফলিক এসিড আর আয়রণ ট্যাবলেট গিলে ফেলতে থাকে।

অজানা ডিমটা হাতে নিয়ে আমি প্রথমে নেড়েচেড়ে সন্তর্পনে দেখি। এরপর নিশ্চিত হবার জন্য আলোর সামনে একচোখ বন্ধ করে ভেতরে কোন ভ্রূণ আছে কিনা খুঁজি। আমার বন্ধ চোখের ভেতরে কালো অন্ধকার গিসগিস করে, আর খোলা চোখের সামনে ডিমের সাদাটে একঘেয়ে শূন্যতা কোন সূত্রই দাঁড় করাতে পারেনা। এষাকে ভরসা দেবার জন্য তাচ্ছিল্য নিয়ে জানাই – এটা কোন পাখীর ডিম হবে।

–  কোন্ পাখী?

–  পায়রাই হবে।

–  তুমি পায়রার ডিম চেনো? তা কি এতো ছোট হয়?

আমি অসহায় অস্থিরতার সাথে ভাবতে থাকি পাখীর ডিম বিষয়ক তথ্যমূলক কোন বই আছে কিনা। কিন্তু স্মৃতিতে টান পড়ে। সলিম আলী পাখীর ডিম নিয়ে কি কোন রিসার্চ করেছেন? সম্ভবত না। কিন্তু তাই বলে ডিমটাতো আর ফেলে দেয়া যায়না। কিন্তু ডিমটা নিয়ে এখন আমরা কী করবো? একধরণের অচলতা, অমীমাংসা নিয়ে আমি আদালত মুলতুবী করার মত বিচারকের কণ্ঠে – কাল সকালে দেখা যাবে এই সিদ্ধান্ত দিয়ে ডিমটাকে পুনরায় তার আঁতুরঘরে রেখে দেই। হ্যাঁ, ভালো শব্দ পাওয়া গেছে ‘আঁতুরঘর’।

অফিসে আমার প্রজেক্টের অবস্থা অনেকটা অনিশ্চয়তার। নতুন ফান্ড আসবে কি আসবে না এ ব্যাপারে কেউই কিছু ঠিক করে বলতে পারছেনা। দাতাসংস্থা শুধুমাত্র হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ও রিসোর্স বাবদ আগামী তিনবছর পর্যন্ত ফান্ড করতে রাজি। কিন্তু স্টাফ স্যালারী কিভাবে আসবে? এ বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনা। মাঝারি মাপের চাকুরী করি বলে উপরমহল বা একদম নীচের মহল, কোন দিকেই আমার তেমন পাত্তা নেই। এটা একধরণের অক্ষমতা। অনেকে খুব সুন্দরভাবে অফিসের সবাইকে ম্যানেজ করে। ড্রাইভার থেকে ডিরেক্টর পর্যন্ত সবার সাথেই থাকে তাদের সহজ সম্পর্ক। যেমন আমাদের অফিসের এখলাস সাহেব। তিনি না চাইতেই অধঃস্তন কর্মীদের কাছ থেকে সালাম টালাম ও বিভিন্ন সুবিধাদি পেয়ে যান। আবার উপরের সকলেই তাকে বেশ পছন্দ করে। অথচ ভদ্রলোক কাজ করার চেয়ে যে জিনিসটায় আগ্রহী তা হচ্ছে টেলিফোন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অন্যের সাথে আলাপ। আবার তিনিই অফিসের ভেতরের সবচেয়ে আপটুডেট খবরটি রাখেন। আমাদের রুমে এসে রসিয়ে রসিয়ে তা মাঝে মাঝে বয়ান করেন। আমরা যখনই এসব তথ্যের যথার্থতা খুঁজতে তার সোর্স জিজ্ঞেস করি তখনই তিনি একদম ঠাণ্ডা মেরে যান। তারপরে এখলাস সাহেবকে আবার অনেকদিনের জন্য খুঁজে পাওয়া যায়না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের খবরও তিনি হয়তো আমাদের চেয়ে বেশী রাখেন। এটা ভাবলেই একধরণের ঈর্ষা আমাকে জেঁকে ধরে। আমাকে কি সবাই অবিশ্বাস করে? তাহলে কেন কিছু জানায় না? একটা খোলসের মধ্যে যেন আটকে রাখা হয়েছে সবকিছু। একটা খোলস; আমি ভাবতে শিখেছি, একটা খোলস। প্রতিটি মানুষ নিজেকে ডিমের ভেতর গুটিয়ে রাখে!

পরদিন তাড়াহুড়োয় বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ঝট্পটি শব্দে আমি দেখতে পাই ঘুলঘুলিতে একটি খেচর-সদৃশ্য প্রাণীর দ্রুত পলায়ন। পাখীটিকে আমি শনাক্ত করতে পারিনা। তড়িঘড়ি সকালের স্নান সেরে অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই লেট হচ্ছে আজকাল। কোন কোনদিন তাই চা না খেয়ে শুধু বিস্কিট, আবার কখনো হয়তো প্যান্টের বেল্ট লাগাতে লাগাতে আমি হিসেব করি আজিমপুর থেকে শংকর পর্যন্ত রিকসায় সর্বনিম্ম কতো মিনিটে পৌঁছানো সম্ভব! ভোরবেলাটায় তাই তাড়া থাকে। সেই ব্যস্ততার মাঝেও ডিমটার প্রতি কেমন করে জানি আকর্ষণ চলে আসে। সেটা তেমনই আছে। একটু কি স্থান পরিবর্তন করেছে? আমি দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের মাঝে শাওয়ার ছাড়ি। অবিরত পানির ফোয়ারায় নিজেকে অবগাহন করে ডিমটার দিকে তাকিয়ে থাকি। ঈষৎ লালচে একটা বড়সড় মার্বেলের আকারের ডিমাকৃতি ডিমটির পাশে একটি দুটি গাছের শুকনো চিকন ডালপালা হয়তো তার গর্ভধারিণী পাখীটিই এনে রেখেছে। পরক্ষণে মনে হয়, পক্ষীকূলে নারী পুরুষের সমঅংশীদারিত্ব বিদ্যমান। তাদের একজন ডিম পাড়ে, তো অন্যজন বাসা বানায়; একজন তা দেয়, তো অন্যজন খাবার খুঁটে আনে। এখানে নিশ্চয়ই তেমন ভারসাম্যমূলক বোঝাপড়া রয়েছে। অফিসে দুএকজন কলিগকে ডিমের বিষয়টি আরও মনোগ্রাহী করতে রং টং চড়িয়ে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু কেউ তেমন আগ্রহ বোধ করেনা। বাথরুমের জানালায় একটা কবুতর ডিম পেড়েছে এটা ওদের কাছে কোন ঘটনাই না। একজনতো বলেই বসে- তা ডিমটা খেয়েছেন না আছে? আমি নিজের মেরুদণ্ডে একটা ঠাণ্ডা স্রোত টের পাই। বলে কী?

বাসায় ফিরতেই এষা নতুন খবর জানায়- হারামজাদা পাখীটা তার বাথরুমের সুখ কেড়ে নিয়েছে। রাজ্যের ডালপালা এনে জড়ো করছে ঘুলঘুলিতে বাসা বানাবে বলে! সেসব ডালপালা জানালার খোপ থেকে নিচে পড়ে প্যানে ও তার আসেপাশে নোংরা করে রেখেছে। এষার আবার পরিষ্কারের বাতিক। ডাক্তার বলেছেন- ভারী জিনিস তুলবেন না, রেস্টে থাকুন। সেই শরীর নিয়ে সে অন্তত দশ বালতি পানি ঢেলেছে সারাদিনে। বাড়ীওলা দুবারের বেশী পানি ছাড়েনা। ফলাফল- রাতের পানি আসার আগে হাতমুখ ধোয়া বন্ধ। আমি ঔৎসূক্য নিয়ে বাথরুমে যাই। একফোঁটা পানি নেই। এন্তার ডালপালা কোত্থেকে এলো এতো? ডিমটা আগের মতোই আছে। এখন যদি ঘুলঘুলির কবাটটা আমি আটকে দেই, তবেই ওদের এই ফ্লাট তৈরীতে বাঁধা পড়ে যাবে। পাখী দম্পতিটি কি তবে বিদ্রোহ করে অন্য পাখীদের ডেকে আনবে? হিচ্ককের ছবির সেই পাখীদের মত আমার বাড়ী বা এ তল্লাটের সবার ঘরবাড়ী ধ্বংস করে দেবে হাজার হাজার পাখী? আমি মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডাস্রোত নিয়ে ডিমটাকে আবার হাতে তুলে নেই। আগের মতোই আছে। কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। সেটা আগের স্থানে রাখার পর মনে পড়ে- এষা তার পেটের অনাগত সন্তানকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। বাচ্চা এলে তার কেরিয়ার ধ্বংস হবে। সে চাকরী করতে পারবেনা। চাকুরী না হলে মেয়েরা মানুষের মত মর্যাদায় বাঁচতে পারেনা ইত্যাদি কথাগুলো এখনো মাঝে মাঝে শোনায়। মনে হয় যেন এখন কনসিভ না করলেই ভালো হতো। আমিই তার অমীত সম্ভাবনার পথে কুড়াল দিলাম। খাওয়া-দাওয়া, সবকিছু এ কারণে তাকে বারবার সেধে করাতে হয়। শুধু নিয়মিত অষুধগুলো খাচ্ছে। এরমধ্যে একদিন খুব যখন আদর আদর ভালোবাসা- তখন বলছিল:

–  ওর হাত পা হয়েছে এখন?

–  নাহ্ , কিযে বলো, সবে তো তিনমাস।

–  তাহলে কি কেবল মাথা হয়েছে?

আমি হাহা করে একথায় হেসে উঠি একটা বাজে গল্প মনে পড়েছে বলে। এষা অপ্রতিভ হয়ে উঠলে বলি:

–  সবই হয়েছে তবে এখনও খুবই ছোট আর অসম্পূর্ণ।

–  উহ্ যন্ত্রণা আর সহ্য হয়না।

–  একটু সহ্য করো সোনা, আরতো মাত্র কটা দিন-

এমনি সব ফালতু কথার ট্রাডিশনাল বুলি দিয়ে তাকে ভুলিয়ে দিতে চাই গা ব্যাথা, মাথাধরা, শরীর গুলানো ভাব। কিন্তু তাতে সমস্যা যায়না। মাঝে মাঝে খুব যখন কষ্ট হয়, তখন সে বাচ্চাটাকে গালি দেয়। গভীর রাতে ক্ষিদের চোটে ঘুম ভেঙে গেলে সে হরলিক্স বানাতে বানাতে শাসায়- ‘রাক্ষসটা খাবে আমাকে। ওর খাই চেপেছে।’

পরদিন বাড়ী থেকে ওর প্রেগনেন্সীর খবর শুনে আমার শ্বাশুড়ী আসেন বেড়াতে। এষা জলের সংকট, বাড়ীভাড়া, শব্দদূষণ, ঢাকার আবহাওয়া, চাকুরীর বাজার ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পরপরই চলে আসে ডিম প্রসঙ্গে। নাস্তার টেবিলে শ্বাশুড়ি আমাকে ধরেন-

– বাবা একটা কথা বলি, ক্ষণগণ এখন একটু মেনে চলবা।’ তার ভাষা প্রয়োগে দক্ষিণাঞ্চলীয় টান উঠে আসে। বড় আপন মনে হয় আমার!

– কেনো মা, তা বলছেন কেনো?

– শুনলাম তোমাদের বাথরুমে কিসে নাকি ডিম পাড়ছে?

– হ্যাঁ, ওইতো পায়রাগুলো ভীষণ জ্বালাচ্ছে আজকাল। ও কিছু না, নেক্সট শুক্রবার আমি সব পরিষ্কার করবো।

– না না বাবা, এটা করতে যাইও না। এসব ভালোমন্দ দেখে হয়। তিনি জামাইয়ের সাথে শুদ্ধ বলার চেষ্টা করেন। বেনুর এখন তিনমাস চলছে। এ অবস্থায় অন্যের ডিম তোমরা ভাঙবা না।

এষা চোখ গোল করে আমাদের দিকে তাকায়। সে দৃষ্টিতে ভয় আর জিজ্ঞাসার মিশ্রণ। ঘাড় বাঁকিয়ে অবুঝ বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞেস করে-

– কেনো,তাহলে কি হবে মা?

– তুই বুঝবিনা এসব। মায়ের মনে দুকখো দিবিনা। ডিম ভাঙলে মায়ের মনে দুকখো পাইবে। এরপর থেকে এষার পাখী ও তার ডিমের প্রতি যত্ন বেড়ে যায়। পারলে সে ডিমটার জন্য একটা জাজিম বানিয়ে দেয়! পাখীটাকে সাবান দিয়ে গোসলও করিয়ে দিতো, যদি ধরতে পারতো। প্রশ্রয় পেয়ে পাখীটাও বেশ জাঁকিয়ে বসেছে তার ডালপালার ভেতরে। এষা প্রতিদিন আমাকে ফলোআপ নিউজ দেয়।

– জানো, আজ না পাখীটা দুঘন্টা তা দিয়েছিল, আজ না পাখীটার একটা পালক পড়ে গেছে। আচ্ছা বাবু হলে আমারও কি ওইরকম চুল উঠে যাবে?

শুনে আমি ক্যাবলার মতো হাসি। রাতে শয়নপূর্ব আলাপচারিতার অনেকটা জুড়ে ডিমটা বিরাজ করে। আমার তখন নিজেকে সুখী সুখী মনে হয়। এখন এমনকি এষার অসুস্থতাও আমার কাছে মহৎ শিল্পের মতো লাগে। ওর মাতৃত্ব একটু একটু করে প্রকাশিত হতে থাকে। বাথরুমে এখন এষা গুনগুন করে গান গায়। বোধহয় ডিমটাকে শোনায়। একদিন জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা বলোতো পায়রার কতোদিনে ডিম ফোটে? আমি পাখী বিশেষজ্ঞের মত বলি- একুশ দিনে। এষা দিন গোনে। ক্যালেন্ডারে তার সম্ভাব্য প্রস্ফুটনের তারিখে কাউন্ট ডাউন করার মতো দাগ কেটে চলে। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন পাখীটা আর আসেনা। এষা হু হু করে কাঁদে। এই না আসার কারণের ব্যাখ্যা করতে পুরাতন যুক্তিবাদী সত্ত্বাটি আমার মধ্যে নড়েচড়ে ওঠে। পাখীরা খুবই স্পর্শ্বকাতর। ডিমটি ধরার কারণে ওটার গায়ে নিশ্চয়ই আমাদের হাতের ঘ্রাণ লেগেছিল। তারপর থেকে মা পাখী এটার প্রতি তার আগ্রহ হারিয়েছে। আমি যুক্তি খাড়া করতে চাই। এমনই হয়। পাখীটি তার ডিমকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেছে বলে বাসা বানাতে আর উৎসাহী নয়। অসমাপ্ত ডালপালার মধ্যে ডিমটি পড়ে আছে। আমিও আর ওটাকে ফেলে দিতে বা জিনিষটাকে হাতে নিয়ে দেখতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি।

ডিমটি সেখানেই আছে। কোন পরিবর্তন ছাড়াই। এদিকে এষা বা বেনুর পেট উঁচু হতে হতে অনেক বড় হয়ে উঠেছে। প্রতিমাসে একবার করে ডাক্তার চেকআপ চলছে। এই ডাক্তারের প্রশংসা শুনি সর্বত্র। এখনও তিনি আল্ট্রাসনো করানোর পক্ষপাতী নন্। এষার মাতৃত্বজনিত উপসর্গগুলি তিনি হেসেই উড়িয়ে দেন। মা হওয়া কি এতোই সোজা? তিনি বক্তৃতার ঢঙে বলেন, কিন্তু এষার সমস্যা কাটে না। ইতোমধ্যে সে বিসিএসের প্রিলিতে অংশ নিয়েছে। যদিও পাশ করতে পারেনি। তবু তার চাকরী দরকার, একটা চাকরী না হলে …।

বিছানায় এখন আর আগের মত এষা হাঁসফাঁস করেনা। কেবল বড় পেট নিয়ে চিৎ হয়ে স্থবির হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে স্খলিত কণ্ঠে হয়তো অনুযোগই করে। দিন ঘনিয়ে আসে। আমি আগেই একটি ক্লিনিকে সবকিছু রেডি করে রেখেছি। ক্লিনিকটি মহিলা ডাক্তারের আশীর্বাদপুষ্ট। নিয়ম মেনে চেক আপ চলছে। এষা এখন আর তেমন চলাফেরা করেনা। ডাক্তার পূর্ণ রেস্টে থাকতে বলেছেন। পাখীটি আর এলোনা। এখন ওদের মিলনের মাস। এক সিজনে পায়রাতো একটি ডিম পাড়েনা। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও ডেড়া বেঁধেছে। অবিভাবকহীন ডিমটি পড়ে আছে সেই থেকে। একদিন শেষ রাতের আধো ঘুম জাগরণে অসুস্থ শরীর নিয়ে এষা আমাকে জাগায়:

– ওর জন্য ওর কোন ক্ষতি হবেনাতো?

– কার কথা বলছো?

– বাবুর কথা।

– কেনো ক্ষতি হবে, কি বলছো তুমি?

– না মানে ডিমটার জন্য ওর যদি কোন অমঙ্গল হয়?

– কেনো হবে, ও তো কিছু করেনি!

– বাবামায়ের অপরাধ নাকি সন্তানের উপর গিয়ে লাগে?

– কি হয়েছে তোমার এষা, এসব বলছো কেনো, আমরা কী দোষ করেছি?

এষা আমতা আমতা করতে থাকে। প্রথমে তো সত্যিই সে চায়নি মা হতে। তাছাড়া পাখীটা হঠাৎ করে না আসার পেছনে সে নিজেদেরই দায়ী করছে। একদিন বলছিল-

– তুমি কি ডিমটা নিয়ে কিছু করেছিলে?

– কই নাতো।

– তা হলে পাখীটাকে কখনো ধাওয়া দিয়েছিলে?

– আমি পাখীটাকে মারতে যাবো কেনো?

– তাহলে ও আসছেনা কেনো, বলো, আসছে না কেনো?

শেষের দিকে এষার স্বর হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে। আমারও বুক দুরদুর করে। সত্যি যদি কোন অমঙ্গল হয়ে থাকে? যদি এজন্য অনাগত সন্তানের কোন ক্ষতি হয়ে যায়? যদি সে আর না আসে?…

ওর খাওয়া দাওয়া আগের চেয়ে কমে গেছে। যা খায় তাইই বমি হয়ে যায়। এটাই নাকি হয় এ সময়। তিনগুন খাওয়া উচিত, অথচ…। এষার হীনমন্যতা আমাতেও সঞ্চারিত হয়। সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা বিষয় খচখচ করে। আমরা কি কোন পাপ করেছি? ডিমটার অ-প্রস্ফুটনে আমার কি কোন ভূমিকা আছে? ওরাতো খুবই সেনসিটিভ, হয়তো আমাদের কোন ব্যবহার ওদের পছন্দ হয়নি। পাখীদের প্রজনন বিষয়ক বেশ কয়েকটা বই ঘেঁটে দেখেছি। কোন কোন পাখী ডিম পেড়েই খালাস। এক ধরনের ফ্লাইক্যাচার আছে, যারা একটি প্রজনন ঋতুতে একধিক পুরুষসঙ্গীর সাথে মিলিত হয় এবং তাদের প্রত্যেকের ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন বাসায় ডিম পাড়ে। হয়তো দ্বিতীয় বার আর সেসব বাসায় যায়ও না। অবশ্য হলুদগলা-ফিঞ্জদের কথা আলাদা। তারা জীবনে একবারই পুরুষসঙ্গী নির্বাচন করে আর তার সাথেই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেয়। ঠিক আমি আর এষা যেমন। আমার ভাবতে ভালো লাগে। বাইরে থেকে ফিরে যখন ওকে পিচ্চিপিচ্চি কাঁথা সেলাই করতে দেখি আমার তখন নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। আমার মা, যাকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে আর দেখিনি, তিনিও কি এভাবে  আমাকে পেটে নিয়ে কাঁথা বুনতেন?

এমনি করে দিন ঘনিয়ে আসে। এষাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার ওকে ড্রিপ দিচ্ছেন। তাতেও না হলে হয়তো সিজার করবেন। দোকান থেকে ফলমূল কিনে কেবিনটাকে একদম বাড়ী বানিয়ে ফেলেছি আমি। আমার শ্বাশুড়ী রাতে থাকেন ওর সাথে। আমি বাসায় ঘুমাই। ইদানিং ঘুম বেড়েছে আমার। সত্যিকারার্থে এষার হাঁসফাঁসের কারণে ঘুমে ব্যাঘাত হতো। এখন স্থির অনুভূতিহীন গাঢ় আচ্ছন্নতা। গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি স্বপ্নের ঘোরে। একটা ডিমের মধ্যে যেন আমি আটকা পড়ে গেছি। চারদিকে নিঃস্প্রাণ সাদা শক্ত খোলস। বাথরুমে গিয়ে নাকে মুখে পানি দেই। ফ্রিজ খুলে পানি খাই। ঘরে একটা বাচ্চার ছবি টাঙিয়েছিলাম। ওটায় মাকড়সা জাল বুনতে শুরু করেছে। এষা থাকলে এসব গুছিয়ে রাখতো। এই সময় ফোনটা বেজে ওঠে। হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো বাজে। ফোনটা মুমূর্ষু রোগীর মত কঁকিয়ে চলেছে। এতো রাতে কে ফোন করেলো। আমি যন্ত্রচালিতের মত রিসিভার তুলতে যাই। কে ফোন করলো? কে? কোত্থেকে? ক্লিনিক থেকে নয়তো? রিসিভার তুলতে ওপাশ থেকে কোন শব্দ আসেনা!

পরদিন ঘুম থেকে জেগে পুরোটাই স্বপ্ন মনে হয়। নিয়ম মত ক্লিনিকে যাই। আজ এষার ডেলিভারী হবে। ওকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যাওয়ার আগে সে রোজকার মত জিজ্ঞেস করেছিলো – পাখীটা এসেছে কিনা। আমি হ্যাঁ বলেছি। আসলে পাখীটা আসেনি। আসেনি এষাও। অনন্তঅনন্তকালের অপেক্ষার পর নার্স কাপড়ের পুটুলীতে পেঁচিয়ে একটা জ্যান্তডিমের মত মানবশিশু আমার কাছে হাজির করে। আমি সেই শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনের-বিশ্বাসের-বাস্তবের বর্ণহীন বিবমিষা প্রত্যক্ষ করি। আর চারদিকে অসংখ্য পাখীর পালকে যেন ছেয়ে যায়। অসংখ্য পালক।  করিডোরে রাস্তায়, যত্রতত্র ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো। শুধু পাখীহীন পাখীর পালক আর তার ডিম! পাখীটি আর কখনো আসবেনা।

রচনাকাল: ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০০০

অন্যদের জানিয়ে দিন