ধারাবাহিক

তেড়ুয়া

watercolour, watercolor, paint

ধান নিয়ে বাজারে গিয়ে সে মোটামুটি ভিরমি খেলো। দর যা বলে, সেটা খরচের চেয়ে কম। এই দামে বেচলে আর ধানকৃষি করে কী হবে? মোসাদ্দেক একটা জিনিস বোঝে না, ধানের দাম এতো কম, কিন্তু চালের দাম এতো বেশি কেনো? অবশ্য সে মুর্খ মানুষ। আর মূর্খ মানুষের যা হয়, রাগ থাকে জাহেলের মতো।

পর্ব ১. বাঐতারা

বাঐতারা গ্রামকে যদি গ্রাম বলো তো গ্রাম; আর যদি শহর বলো, তো সেটাও বলতে পারো। বিকাশ এজেন্ট থেকে ভ্রাম্যমান কৃষি পরামর্শক, কী নেই এখানে? সেই খাসসাজবাড়ি থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে যে সড়কটা পুরো গ্রামটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে মর্ডানের মোড়ে গিয়ে খান্ত হয়েছে, তার পুরোটাই পাকা! ইজিবাইকে পঞ্চান্ন মিনিটে এখন উপজেলা সদরে পৌঁছানো যায়। ভাড়া জনপ্রতি ২৮ টাকা। ভাবো! লোকজন বলাবলি করে এই সরকার আর দশটা বচ্ছর ক্ষমতায় থাকলি পরে বাঐতারা হবে মডেল ভিলেজ। তারা ’ভিলেজ’ শব্দটার ওপর জোর দেয়, যেনো সেটা গ্রামের উন্নত কোনো সংস্করণ। গ্রামের পাশদিসটায় যে বাজারটা আছে, ওখানে কিছু মোবাইল ফোন বিক্রির চকচকে স্টল হয়েছে। হরেনের চায়ের দোকানকে টেক্কা দিয়ে তার উল্টোদিকে সিস্টেম ক্যাফেতে এখন স্প্রিংরোল আর চিকেন নাগেটও বিক্রি হয়, কফি সহযোগে। মোবাইলধারী উঠতি ছোলপোলের ভিড় লেগে থাকে ভালোই। প্রোপাইটর সিস্টেম জোয়ার্দার খুবই আশাবাদী; ইলেকট্রিসিটি যেহেতু এখন সারাসময় ২৪/৭ সার্বক্ষণিক নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহিত হচ্ছে- কমার্শিয়াল নয়, বাসাবাড়ির লাইন দেখিয়ে সে আগামি বছরই এসি লাগাবে দোকানে। কিছু খরচাপাতি হবে তাতে, সিস্টেম করতে হবে বিদ্যুত অফিসের স্যারদের। কনডেন্সড মিল্ক দুধ কোম্পানি তাকে একটা এসি দেবে ইএমআইতে, বলেছে।

গ্রামের ওইদিকে কোলাবাড়ির দিকটায় প্লাস্টিক পন্যের বিজ্ঞাপনে প্লিটকরা শাড়িতে জগ হাতে নামকরা টিভি অভিনেত্রীর হাসিহাসি মুখের পেছনে সচ্ছলতার এ্যারাবিয়ান হর্সমার্কা ঢেউটিনের বাড়ির যে ঢাউস বিলবোর্ডটা, তা কোনভাবেই না দেখে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বিশাল কাঠামোর লোহার এ্যাঙ্গেল খুঁটিগুলো কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে পোঁতা হয়েছে ঠিক সাদেক চেয়ারম্যানের পোড়ো জমিটার ডাইনে মোসাদ্দেকের ধানিজমিতে। মোসাদ্দেক চায়নি এটা তার জমিতে হোক -পাশের পোড়ো জমিটায় দিব্বি হতে পারতো- কিন্তু চেয়ারম্যান চৌকিদার ডেকে তাকে পরিষদের সদ্য নির্মিত দোতলা বিল্ডিংয়ের কামরায় তোয়ালে ঢাকা চেয়ারে বসে বোঝালো, সরকার গৃহহীনদের জন্য দুর্যোগ সহনীয় একশো ঘর তুলবে এই ইউনিয়নে। এলাকার অভিভাবক হিসেবে তার তো একটা দায়িত্ব আছে না কী? তাছাড়া মাননীয় সরকারের উন্নয়নের হাতকে শক্তিশালী করতে তাদের মতো ত্যাগী নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে না? না না, এই সুযোগ সে মোসাদ্দেককে দেবেনা। ওটা ধানিজমি, ফসলি জমির ক্ষতি করে পরিবেশ বিপর্যয় নয়। তারচে সে নিজের জমিটাই এ মর্মে সরকারকে দান করবে। পরিবেশবান্ধব এই সরকারের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে উজ্জীবীত রাখতে হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়… সাদেক চেয়ারম্যান গড়গড় করে মুখস্থ বলে যায়- তার লিডার, পাশের আসন ৩ নং পঞ্চসারের মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আখতারুজ্জাম ডালিমের কথা ধার করে!

থ্রি লেয়ার পলিব্যাগে প্যাক করা চারখানা থিন এ্যারারুট ভেজিটেবল বিস্কুটের প্যাকেট বহু কসরত করে ছেঁড়ার পর ভাঙা বিস্কুটের টুকরো চাবাতে চাবাতে আর ফ্রেমেবন্দী সাদেক চেয়ারম্যানের মন্ত্রীর হাত থেকে শ্রেষ্ঠ জনপ্রতিনিধির পুরষ্কার নেবার ছবি দেখতে দেখতে মোসাদ্দেক পুরো বিষয়টার গুরুত্ব উপলব্ধী করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা এতো সহজ নয় যে তার ঢিলা মাথায় চট করে ঢুকবে। সাদেক চেয়ারম্যান শেষ করে এই বলে যে ভিজিডি একটা তাকে বাড়িয়ে দেয়া হবে তবে সেটা এই ‘পিচকেল’ ইয়ারে নয়। আগামিতে। পরিষদের সচিব সাহেব গেছেন শ্রীলংকা, সেখানকার আমচাষে কর্মজীবী নারীদের ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা কার্যক্রমের সফলতা দেখতে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে যে কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট বাই দা ভালনারেবল উমেন্স গ্র‍ুপ সাসটেইনেবল লাইভলিহুড প্রকল্প (সিইভিডব্লিউজিএসএলপি) – তারাই বহন করছে ট্রীপের সব খয়খরচা! তিনি ফিরে এলেই সে যেনো তার সাথে দেখা করে। মোসাদ্দেকের বিস্কুট শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, এবং খালি খোসাটা ফ্যানের বাতাসে উড়ি উড়ি করছে। চা তাকে সাধা হয়নি, তবু চায়ের অপেক্ষা না করে সে পরিষদ থেকে বাড়ি ফিরে এলো।

ওই জমিতে ধান এবার বাম্পার ফলেছে। আগামি সপ্তাহেই দাইতে হবে। কিন্তু মুশকিল হলো, এই ইজিবাইকগুলো হবার পরে গ্রামে যুবকছেলে আর বেকার নেই। আর ধানকাটার মতো কাজকে তারা একটু আড়নজরেই মাপে ইদানিং। আসল কামলা যারা, তারা চলে গেছে হাওড়ের ধান কাটতে। ঠিকাচুক্তিতে। সেখানে নাকি মজুরি অনেক বেশি মেলে। আলফাজকে নিয়ে সে তাই নিজেই কেটে ফেললো ধান। মাত্র এককানী জমির! আরও চারগুণ তার কাটতে হবে। কিন্তু তা হোক, কামলা নিশ্চয়ই জোগাড় হবে তখন। কিন্তু ধান নিয়ে বাজারে গিয়ে সে মোটামুটি ভিরমি খেলো। দর যা বলে, সেটা খরচের চেয়ে কম। এই দামে বেচলে আর ধানকৃষি করে কী হবে? মোসাদ্দেক একটা জিনিস বোঝে না, ধানের দাম এতো কম, কিন্তু চালের দাম এতো বেশি কেনো? অবশ্য সে মুর্খ মানুষ। আর মূর্খ মানুষের যা হয়, রাগ থাকে জাহেলের মতো। মোসাদ্দেক অবশ্য ততো রাগী না। জুয়ানকালে একবার বর্ষায় জোঁকে ধরেছিলো বলে সে পা থেকে জোঁক ছাড়িয়ে সেটা দাঁতে কেটে টুকরো করেছিলো। সেটা রাগে, না অসহায়তায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে এবার মোসাদ্দেকের রাগই হলো হাট থেকে ফিরে!

watercolour, watercolor, paint

জয়নাল ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে ছুটে যায় রাস্তার ধারে, আর ভিডিও তুলতে থাকে আগুনলাগা ক্ষেতের! তেড়ুয়ার জমির পাকাধান জ্বলিচ্চে! সে দুই লাফ দিয়ে রাষ্ট্র করে সিস্টেম ক্যাফেতে!

পর্ব ২: এলামালে

গাঁওগেরামে একই নামে দুজন থাকলি পরে যা হয়, শালার পাবলিক তার পাছাত্ বাড়তি আর একটা নাম যোগ কইরে ছাড়বেই! এই যেমন ধরো মোসাদ্দেককে ডাকে তেড়ুয়া – সেই জোঁক দাঁতে কাটার পর থেকে। আর একই নামে অপর যে জন, সে সাড়ে পাঁচ বছর ওমানে কাটিয়ে এসে এখন কাঁঠালকাঠের হলুদ ভারী কপাটের দরজা লাগানো দোতলা বিল্ডিং আর উপজেলা সদরে কয়েক বিঘা নাইল্লা জমির মালিক হবার পরেও নটির ছাওয়ালরা তার পূর্বপেশা বিস্মৃত হয়নি। তাকে ডাকে প্লাম্বার। বোঝো! আরে শালোর বেটা শালো, ওমান কি তোর বাপদাদার জমিদারী নাকি যে গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে মানচিত্র বরাবর কোনাকুনি আরবসাগর পাড়ি দিলেই তারা তোমাক্ অফিস পিওনের ‘চারকি’ দেবে? পুরা তিনমাসের ট্রেনিং নিয়ে, এধার ওধার ধর্না দিয়ে, স্যান্ডেল ক্ষয় করে তারপর সে যেতে পেরেছে মিডলইস্ট। তখন সৌদী যাওয়া এখনকার মতো অতো সহজ ছিলোনা বাহে। না এনআইডি, না মোবাইল। পাসপোর্ট ভিসা লাগাতেই মনে করো বছর পার। আর এখন শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ আরো কী কী সব হয়ে টাকা মার যাবার চান্স কমেছে। আদম ব্যাপারির ফিচলেমি আইনের গদাম খেয়ে কমেছে। দু দেশের মধ্যে সমঝোতার ‘লেখাপড়া’ হচে। বাসাবাড়িতে আয়ার কাজ নিয়ে বিটিছাওয়াও যাচ্ছে প্রচুর! আবার ফিরেও আসছে কেউকেউ কদিন পর – যাদের কপালে ঠাডা – কফিনের বস্তায়! কী? না, সৌদী মালিক আর তার দুই আজদাহা শেখপুত্র নিয়মিত অইত্যাচার কইরে কইরে বিটিক্ মারি ফেলিচ্চে!

হরেনের এইটে পড়া ছেলে গৌতমের সাথে বাজারের পিছনে যে মরিচপট্টির গুদাম, তার পাকা সেডের নিচে ফাইবারের ফোল্ডিং চেয়ারে বসে লুডু খেলছিলো জয়নাল। চোয়াড়ে গালের অপুষ্ট দাড়ি সেভ করা শুরু করেছে তাও বছরদুই হবে, তবে ক্লাশ ফোরের গণ্ডি পেরিয়ে সে গৌতমকে আর ধরতে পারবে বলে মনে হয় না। এই সেদিনও তার চুলগুলো বেশ বাহারি কায়দায় ছাঁটা ছিলো। ইভ টিজার হিসেবে জয়নাল একবার পুলিশের ঝটিকা অভিযানে ধরা খেয়ে কদিন হাজত খাটার পর এখন কৌড়িখাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। সারাদিন লুডু নিয়ে পড়ে থাকে। লুডুতে এখন আর ছক্কা, গুটি, কোর্টের ঝামেলা নেই। সতের টাকার মিনিপ্যাক টকটাইম রিচার্জের সাথে ফ্রীতে পাওয়া ত্রিশ এমবি দিয়ে একবার গুগল প্লেস্টোরে ঢুকে পছন্দমতো গেম নামিয়ে আনো, ব্যাস রেডি! তোমাকে কেবল আঙুল দিয়ে একবার ছুঁলেই হলো। ছক্কা ঘুরবে, দান পড়বে, তারপর গুটিও চেলে দেবে। সব অটো! অতটুকু স্ক্রিনের ভেতর মেলা কারিকুরি! গুটি চালার সাথে সাথে পিঁপ পিঁপ সাউন্ড মারাচ্চে। আজ গৌতমের সাথে তার বাজি লেগেছে পঞ্চাশে। পাঁচদান খেলা হবে, যে জিতবে সে একশো পাবে, নিজের পঞ্চাশসহ! গৌতম তার বাপের দোকানে বসে মাঝে মাঝে, পঞ্চাশ একশো যা পারে হাতিয়ে নেয়। টাকার লেনদেন তারা করে গোপনে গোপনে, সাংকেতিক শব্দে। মুরুব্বিরা দেখে, ছেলেগুলো নির্দোষ লুডুই খেলছে মনযোগ দিয়ে, নেটে ঢুকে ‘ওইসব’ দেখছে না!

তা ‘প্লাম্বারের’ ভাগ্য অতো খারাপ নয়গো। প্রথমে তার কাজ মেলে এক সিরামিক ‘ফ্যাটকরিতে’। মোসাদ্দেকের কাগজপত্র জাল, তাই তিনমাস যেতে না যেতে ওখান থেকে সে বাধ্য হয় আলখয়ের কন্সট্রাকশন লিমিটেডে যেতে। নামে লিমিটেড, কিন্তু বিশাল কোম্পানি! বন্দী জীবন! শতশত শ্রমিক কাজ করছে বিভিন্ন দেশের। তার মধ্যে ভারত বাংলাদেশ ছাড়াও আলজেরিয়া আর সুদানের ‘এলামালে’ অনেক। কিছু আজারবাইজান আর মরোক্কোর ‘এলামালেও’ আছে- সেফটি গিয়ার পড়ে উঁচু উঁচু গ্লাস টাওয়ারে ঝুলে আই বাপ, দৈনিক ১৮ ঘন্টা কাজ করে। পোদ মারিচ্চে! ওই কোম্পানীতে বালি-কামড়ে সে পড়ে থাকে পাঁচ বছর। ঝোলাঝুলির কাম তার নয়, আল্লাহ মেহেরবার- ল্যাট্রিনের ফিটিংস অনেক পরে, তাই রক্ষা। হুহ্ এখন যে মোসাদ্দেকরে তোমরা পেছনে পায়খানার মিস্ত্রি ডাকো, আর সামনে পড়লে নুরানী দাঁড়ি টুপি আর কপালে সেজদাজনিত কালো কড়া দেখে সালাম দাও, তার পেছনে কম রক্ত পানি হয়নি!

করোগেটেড ফাইবার সিট- যেটা কিনা পরিবেশ বান্ধব- তাই দিয়ে ড্যানিশ প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এলজিএসপি টু প্রকল্পের আওতায় যৌথভাবে উপজেলা পরিষদ এক বছর হলো নির্মাণ করেছে এই গুদাম। সপ্তাহে দুদিন এখানে পাইকারী হাট বসে। আগে খোলামাঠে ছাগলের হাটের পাশেই বসতো, এখন গুদামের সাথে বাহারি শেডের নিচে অনেক শান্তি। সোলারসেটিং পাখা ঘুরছে, একপাশে টিউবয়েলের পানি গাজি ট্যাঙ্ক হয়ে সারিসারি হাতধোয়ার ট্যাপে পৌঁছাচ্ছে। অবশ্য এই গুদাম কাম মার্কেট কম্পেলেক্সের টেন্ডারের বিল এতোদিন ঝুলে ছিলো। ঢাকা থেকে এনকোয়ারি হলো বেশ কবার। পত্রিকাতে লেখালেখিও হয়েছিলো চাতালের কোথাও কোথাও চলটা উঠে যাওয়ায়। কেউ কেউ আবার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে এমন কথাও বলে বেড়ায়। আরেহ্শালা, আগে তোরা কোয়ানে মরিচ শুকাতি চুতিয়া? এই শেড না হলি মুততে যেতি কোয়ানে হারামি? কৃষিতে সিনজেনটা লেখা ডিজিটাল ব্যানারের নিচে আল মদিনা ফার্টিলাইজারের ডিলার আট নং ওয়ার্ডের ইসাকমেম্বারকে স্বাক্ষী রেখে পঞ্চসার সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির সেক্রেটারী দুলাল দাশ এক হাটবারে চিৎকার করে কিছু নির্দোষ কাককে শুনিয়ে কথাগুলো বলে। দুলাল কাজটা তদারকি করলেও টেন্ডারটা পেয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাগ্নে জিন্নাত। জিন্নাত সদরে পলিটিক্স করে। একটা দেড়শো সিসি রাইডার চালায়। এলাকার উন্নয়নের জন্য লিডারকে ধরে সে এই কাজটা এনেছে, এমন দাবী তার পক্ষ থেকে ওয়ার্ড মেম্বাররাই করে। তো তার জনসেবার বিল স্থানীয় সরকারে আটকে থাকবে এটা কেমন কথা? এমপি হোস্টেলে দিনদুয়েক যাতায়াতের পর একটা ডিও লেটার পিআইও অফিসে সরাসরি চলে আসে। সিসিটু ডিস্ট্রিক অথরিটি, বিল প্রসেস হয় জুন ক্লোজিংএর আগে আগে। ইংরেজি শব্দগুলো খুব জোড় দিয়ে দিয়ে কুড়ুলমুখে উচ্চারণ করে দুলাল দাশ মেম্বারকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে। “বুজলা মেম্বার, এরা আয়েচে বাপেরে চোদন শেখাতি! আরেহ চুদির ছাওয়াল, সেনট্রালের পলিটিক্স তোরা কী বুঝিবি কও? সেনট্রালে মুইতে দিলি পাঁড়াগার রাজনীতি কোতায় ভেইসে যায়, সেই খপর কেউ জানে?” এতো বিশদ না করলেও হতো, কিন্তু বিগত সরকারের আমলে এই মেম্বারই তাকে এলাকাছাড়া করেছিলো। মেম্বার তখন ওইদলের রাজনীতি করতো। এলাকা ছেড়ে বারাসাতে বড় ভায়রার বাড়ীতে গিয়ে অনেকদিন থাকতে হয়েছে তখন দুলালকে। চালানচোথা যায়যায় অবস্থা। কলিকাতার জলহাওয়ায় তার একদম পোষাচ্ছিলো না। এদিকে দেশেও তখন অবস্থা খারাপ। বাস পুড়ছে স্কুল পুড়ছে। মৌলালি বাসস্টপে হঠাৎ একদিন তার দেখা হয়ে যায় শ্রীপংকজের সাথে। স্কুলে একসাথে পড়তো দুলাল আর সে। এখন সাদাধুতি, পাঞ্জাবি আর কামানো মাথায় সাদাটুপি পরিহিত শ্রীপংকজকে দেবদূতের মতো শক্তিমান মনে হয়। খদ্দরের একটা ঝোলা কাঁধে থাকার পরও হাতে একখানা চৈতন্যচরিতামৃত (অখন্ড) থাকায় তার গেটআপটা পরিপূর্ণ হয়েছে। হাতে লিখে দেয়া একটুকরো চিঠিসমেত সে দুদিন পরেই দেশে ফিরে দেখা করে অশ্বানানন্দ মহারাজের সাথে। তারপর সব আস্তে আস্তে গুছিয়ে নেয়। সরকার বদল হবার পর এই মেম্বারই দুলালকে এসে হাতেধরে তাদের দলে যোগ দিতে লিডারের সাথে দেনদরবার করিয়ে দেবার জন্য। পুরানো কথা কিছুই দুলাল ভোলেনি যদিও, কিন্তু ইসাকমেম্বারের মতো এক আকাট জাহেল তার সাথে সমীহ করছে এটাই এলাকায় তার ক্ষমতা আরও একটু বাড়িয়ে দেয়। আরও একটা কারণে সে ইসাকমেম্বারের প্রতি অনুরক্ত, তার বাড়ীতে আগুন দেয়ার কারণে। বিরোধীদলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রতি তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের যে জ্বালাও পোড়াও, সেটার সরেজমিন উদাহরণ হলো দুলাল দাশ। তাকে নিয়ে মিডিয়া বেশকিছু ফিচারও করেছিলো তখন। এই সবকিছুই দুলালকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছিলো। মরিচহাটার কাজটাও অতি অনায়াসে পেয়ে গেছে সে। অনেক পুরানো মোকাম এটা। অত্র অঞ্চলের তামাম মরিচচাষী আর ফড়িয়ারা এসে জড়ো হয় সিজনে। হাট বাদে বাকি পাঁচদিন ছাগলের নাদিতে ছেয়ে থাকে চাতাল আর সেড। সন্ধ্যার পর থেকে মেলা রাত অব্দি আড্ডাও হয় এখানে। তা সেসব আড্ডার প্যাঁচাল তোমাক্ কবো কোন্ দুকখে? হামার কি জানের মায়া নাই? বর্ডার ঘুরে যমুনার ওইপার থেকে যে গোলাপি রঙের লাললাল ট্যাবলেটগুলোন আসে, সেটার কতা মুই কওয়ার না পারি বাহে। হামাক খ্যান্ত দেন, অন্য গল্প শোনেন।

সিম্ফনী-১১ টাচমোবাইলে খেলা তখন দারুণ জমে উঠেছে। গৌতম জয়নালের দুটো পাকাগুটি খেয়েছে, কিন্তু পুট আর পড়ছে না জয়নালের। এমন সময় ঢাউস বিলবোর্ডের নিচ দিয়ে চোখ যেতেই সে দেখে পাগাড়ের ওইপাশে ধানক্ষেতে আগুন জ্বলিচ্চে। হারিব্বাপ! ইডা হলো কিসক? কেবা কইরে হলু? ভাবতে না ভাবতেই জয়নাল ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে ছুটে যায় রাস্তার ধারে, আর ভিডিও তুলতে থাকে আগুনলাগা ক্ষেতের! তেড়ুয়ার জমির পাকাধান জ্বলিচ্চে! সে দুই লাফ দিয়ে রাষ্ট্র করে সিস্টেম ক্যাফেতে!

এর একদিন পর নিজস্ব সংবাদদাতার বরাত দিয়ে আঞ্চলিক একটি পত্রিকা খবরটা ছাপে: ধানের দাম না পেয়ে এক প্রান্তিক কৃষক ক্ষেত জ্বালিয়ে দিয়েছে! জয়নালের এগারো মিনিটের জিগজ্যাগ ঝাপসা ভিডিওক্লিপ তাদের সংবাদের সূত্র! এবং তার ঘন্টাদুই পর একটা অনলাইন পোর্টাল আর টিভি চ্যানেল একই সাথে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে সেটা হেডলাইন করে। তাদের ছাপিয়ে গিয়ে ইউটিউবের সেই এগারো মিনিটের ক্লিপ চব্বিশ ঘন্টায় একলাখ ছিয়াশিবার ভিউড্ হয়! ভাইরালের বিষয়টাকে এক টকশো গবেষক পিপলস্ রিপোর্টিং বলে ব্যাখ্যা করেন! জনগনের প্রতিবাদের শক্তি ব্যাআপক, তিনি উপসংহার টানেন!!!

watercolour, watercolor, paint

টার্নওভার আর প্রফিট মার্জিন শব্দদুটো সালাম ভাইরা মাঝে মাঝেই বলে। ওদুটো বাড়লে নাকি তারা ব্রেকইভেনে চলে যাবে, শুনলে মনে হয়, ব্রেকইভেন কোনো স্বর্গীয় মহাকাশযান, যেটা নিয়ে নিমেষে ভিনগ্রহে পৌঁছে যাওয়া যায়!!

পর্ব ৩: নকিরা

ধানে আগুন দিয়ে মোসাদ্দেককে খিদার চোটে আবার সেই ভাতের কাছেই ফিরে যেতে হয়। আর খিদেতো নয়, যেনো নিমতলির এসিডমারা আগুন! হলকা দিয়ে পেটের ভেতর জ্বলছে। মোসাদ্দেকের একটু বেশিই জ্বলে, রাগ হলে। তখন মনে হয়, আশেপাশের গাছপালাশুদ্দ উন্নয়নমুখর পুরো গ্রামটাই গিলে ফেলতে পারে। চেটে চিবিয়ে মাছের কাটা খাবার মতো ধানিজমিতে পোঁতা বিলবোর্ডের লোহার এ্যাঙ্গেলগুলো কুড়মুড় করে ভেঙে মুখ থেকে ফেলতে পারে ফুলজোড় নদীর নোংরা ফেনায়। ত্রাহিরাগে সকল বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে সে গনগনে খিদে নিয়ে বাড়ির পানে ছোটে। কাদামাখা বেঢপ থ্যাবড়া পায়ে হেঁটে আসা ফ্যাকাশে পাঞ্জাবির অবয়বের পেছনে হলুদ আগুন দুপুরের রোদে এক অদ্ভুত মরিচীকা তৈরি করে। মনে হয় যেনো মোসাদ্দেক কাঁপাকাঁপা আগুনের ভেতর থেকে উঠে আসা এক পরাবাস্তব মানুষ, যে প্রত্যাদেশ পেয়ে গেছে!

হাজেরা টাকা গুনছিলো। আজ তাদের সমিতির মাসিক সভা ছিলো। বাঐতারা দুঃস্থ নারী উন্নয়ন সংস্থার সেক্রেটারি সে। ঋণ দেয়ানেয়া, কিস্তি ফেরানো আর আয়বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন উদ্যোগই সমিতির কাজ। সদস্য আছে বত্রিশজন নারী। সাপ্তাহিক কিস্তি ওঠার কথা সাতশো করে বাইশ হাজার চারশো, কিন্তু উঠেছে পাঁচশো কম। কেউ একজন একটা নোট সরিয়েছে। ডানোর কৌটায় গুনে রাখার সময় হিসেবে ঠিকই ছিলো। পরে সভার কার্যবিবরণীতে সবার সাক্ষর নেবার সময় কেউ এটা করে থাকতে পারে। বিকেলে বিরাক থেকে সালাম ভাই আসবে কিস্তি জমা নিতে। আবেদিন স্যার তাদের সমিটির রেজিস্ট্রেশন নিতে বলছে কিছুদিন থেকে, তাহলে নাকি তারা সরকারের নারী উদ্যোক্তার বিশেষ ঋণসুবিধা পাবে। কিন্তু সেজন্য যে ক্যাপিটাল থাকতে হয়, সেটা হতে মেলা দূর আছে। ‘সদস্যো বাড়ায়ে নিতি পাল্লি তোমাগের সোমিতির গুডউইল আরও বাড়লো হয়! কিন্তু শুধু ওতেই হবেনানে হাজেরাবু। ইনকাম জেনারেঠিং কত্তি হবে বুজিচো, বাইছে বাইছে তাগোরে নিতি হবি যারা কিস্তি ফিরাতে পারে। কিস্তি বাকি পইল্লে তোমাগের আর রিণ দেয়া যাবেনানে বুজিচো। তাই হিসেপ কইরে…’ আরও কি কি সব হিসেবের কথা বলে সালামভাই, হাজেরা অতো বোঝেওনা। টার্নওভার আর প্রফিট মার্জিন শব্দদুটো সালাম ভাইরা মাঝে মাঝেই বলে। ওদুটো বাড়লে নাকি তারা ব্রেকইভেনে চলে যাবে, শুনলে মনে হয়, ব্রেকইভেন কোনো স্বর্গীয় মহাকাশযান, যেটা নিয়ে নিমেষে ভিনগ্রহে পৌঁছে যাওয়া যায়!! কিন্তু সেই রাস্তা বহুদূরে এখনো। তাদের সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা জমা হয় সমিতিতে, সেখান থেকে যায় বিরাকে, তারপর তা গিয়ে ঠেকে কর্ম-সহায়ক তহবিলে! দারিদ্র্য বিমোচনের এই লম্বা লাইনের মাথার দিকে আর কারা কারা আছে, কী আছে, সেটা হাজেরা তো হাজেরা, এমনকি সালামভাইদের পর্যন্ত বোধে কুলায় না। মাঝেসাজে সাদাচামড়ার আর আমাদের থেকেও কালোচামড়ার বিদেশি ফরেনার আসে গ্রামে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে রুরাল ভিলেজের ইতিউতি। ছবি তোলে কুমড়ো খেতে ছাগল চড়ানো দড়ি হাতে সীমা আক্তারের, নেপিয়ার ঘাসের আঁটি মাথায় লুঙ্গি কাছা দেয়া বিল্লালের বাপের আর সাতদিন বয়সি পিঁচপিঁচ ঝাঁপিঢাকা হাঁসেরছানাদের শামুক ভেঙে খাওয়ানো হাজেরার। লাভলী, বিউটিফুল, এক্সেলেন্ট, সুপার্ব ইত্যাদি ধনাত্বক বিশেষণের আস্ফালনে বাঐতারার বাতাস কিছুক্ষণের জন্য রোমাঞ্চিত হয়! সেইসব সাদাচামড়ার আর কালোচামড়ার বিদেশিরা পরে ডিপ্লোমেটিক জোনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিশঃব্দ কামরায় অর্গানিক লাল আটায় বানানো ইটালিয়ান কুকিজ সহযোগে ব্লাককফিতে চুমু দিতে দিতে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে নানারকম চার্ট, গ্রাফ, কার্ভ আর ইনফোগ্রাফিকে রানঝানা বাজিয়ে তোলে। কামরার ভেতরে তাতাথৈথৈ করে ওঠে হিউমেন ডেভ ইনডেক্স, সাসটেইনেবল লাইলিহুড আর লো ইনকাম ফ্যামিলির প্রোফাইল!

কাদামাখা পাজোড়া না ধুয়েই দাওয়ায় উঠে আসা মোসাদ্দেককে দেখে হাজেরা বুঝে যায় তেড়ুয়ার পেটের আগুনের খবর। বোঝাটা অস্বাভাবিক নয়। তা দুই ডজন শীতের কম তো নয় সে এই আজদাহা মানুষটার সাথে এককাঁথার নিচে শুয়েছে। জ্বর হলে, অসুখবিসুখে কপালে জলপট্টি আর থুতুর চিলুমচি কে এগিয়ে দেয়, হাজেরা ছাড়া? আর যখন গনগনে রাগ মোসাদ্দেকের কপাল বেয়ে টিকটিকির মতো তিড়িক মেরে মাথায় উঠে যায়, তখন দুনিয়ায় হাজেরা ছাড়া আর কেউ আছে তাকে শান্ত করার? যদিও মোসাদ্দেক তার প্রথম স্বামী নয়, যদিও হাজেরার পেটের আটমাসের নকিরা কালাজ্বরে মরে ফিনিশ হয়েছে বিয়ের বছর না ঘুরতেই, তারপরও মানুষটাকে ’নকিরার বাপ’ ডেকে শান্ত করতে পারে একমাত্র হাজেরাই। আজও সে তেড়ুয়ার ভাবগতিক বুঝে ওলের তরকারি আর বাটামাছের সালুন দিয়ে ভাঁপওঠা আঠাশ চালের ভাত বেড়ে দিলো। একটা কথাও না বলে মোসাদ্দেক গরাশ দিয়ে গিলতে লাগলো ভাত। আগুনটা যতো দ্রুত সম্ভব চাপা দিতে হবে। কিন্তু গিলতে গিয়ে যেই তার আগুনলাগা ক্ষেতের দৃশ্যটা মনে পড়লো, ওমনি গলায় আটকে গেলো ভাত। কাশতে কাশতে খাবি খেতে খেতে হাজেরার বাড়িয়ে দেয়া পানির গ্লাসে মুখ দিতে গিয়ে হুহু কান্নায় চোখনাকমুখ সব বন্ধ হয়ে গেলো মোসাদ্দেকের। কান্নার দমকে আর নিজের কৃতকর্মের আফসোসে মরে গিয়ে তার আর ভাত খাওয়া হলো না। মাজাভাঙা কুকুরের মতো কান্নার কুঁইকুঁই নিয়ে সে অনেকসময় ধরে কাঁদলো। তারপর অসময়ে ঘুমিয়ে গেলো সাঁঝ লাগার আগে আগে। আলফাজের কাছে এরই মধ্যে হাজেরা জেনেছে আগুনের কারবালা। রাতে মোসাদ্দেকের জ্বর এলো। সে স্বপ্ন দেখতে লাগলো দোজখের আগুনে তাকে ধানক্ষেতের ভেতর পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে! আর আটমাসের নকিরা ক্ষেতের পাশ থেকে বলছে বাপজান, আগুন কিসক? হামার পা জ্বলিচ্চে বাপজান!

watercolour, watercolor, paint

এই এখন যেমন জয়নাল অনেকটা পুলিশের কেয়ারঅফে আছে ঠিকই, আবার নেইও। কে বা কাহারা তাকে ধরিয়া অর্থাৎ তুলিয়া আনিয়াছে, তাহা সরকারবাহাদুর এখনো জানে না। তবে জানবে। সেই জানা অব্দি জয়নাল বেঁচে থাকলে হয়।

পর্ব ৪: টাইরোটানেল

– তোক্ কে ভিডিও তোলার কহচে, চোদনাহরি? মারের চোট্ তোর বিলাড গুরুপ চেইঞ্জ না করিচ্চি তো হামার নাম রশিদ অপেরা না!

– ছার, হামি কিছু কবার না পারি ছার, হামাক ছাড়ি দেন!

-চোপ! রশিদ অপেরা মুখ হা করে এমন করে আওয়াজ তোলে যে সেই হাঁয়ের ভেতর বাচ্চাসমেত একটা পুরো গজালমাছের ফ্যামিলি ঢুকে যেতে পারতো! কিন্তু পিছমোড়া করে পুলিশফাঁড়ির টেম্পোরারি মেকশিফটের বাঁকানো খুঁটির সাথে না বসা না দাঁড়ানো উচ্চতায় ইজ্জতের-রশি দিয়ে পোক্ত করে বাঁধা জয়নাল এখন এইসব এপিগ্রামের উর্ধে! তার কানের ভেতর পোঁ পোঁ আওয়াজটা- যেটা রশিদ অপেরার জোড়া-চটকানা খাবার পরে শুরু হয়েছিলো – বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কথাবার্তা সে শুনতে পাচ্ছে ঠিকই, তবে তা সিগন্যাল-না-পাওয়া মোবাইল নেটওয়র্কে কথা বলার মতো পিছলে পিছলে যাচ্ছে। কথাগুলোও যেনো হাতপা ছড়িয়ে চরের কাদামাটিতে আছাড় খাচ্ছে! তাকে ধরা হয়েছে ভোররাতে, কিংবা মধ্যরাতের পরপর। যখন ঘুমের মধ্যে গিসগিস করা স্বপ্নগুলো মাথা ঠোকাঠুকি করে কার আগে কে উদয় হবে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে, তখন। একটা চিকন সরু শুপারিগাছ বেয়ে সে কেবল উপর দিকে উঠছিলো আর উঠছিলো। এতো লম্বা শুপারিগাছে সে আগে ওঠেনি। উঠতে উঠতে সে লক্ষ করে শুপুরিগাছের মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলছে আর তার পাতাগুলো জয়নালের মাথায় আছড়ে পড়ছে। মাথা সরিয়ে সে ছাইসমেত আগুনের আকশি কাটাতে গেলে চুলে টান পড়ে। উঠে দেখে তার সুপুরিপাতার মতো কায়দা করে ছাঁটা চুল মুঠি-মেরে ধরে লোমশ দুটো হাত তাকে দুহাতে সপাটে চড় মারছে! কানের ভেতর পোঁ পোঁ আওয়াজ তখন থেকে শুরু।

মন্ত্রণালয় থেকে ফোন আসার আগে ধবলদী-ধারা চন্ডীপাঠ আসনের এমপি মহোদয় বিষয়টি আমলে আনেন। এই আমলে আনার ব্যাপারটা এমনই যে, যে কোন আমলেই এর প্রচলন মোটামুটিভাবে একইরকম। আয়োজনের প্রথমধাপ শুরু হয়, আক্ষেপ দিয়ে। “তোমাগের জোন্নো হামি কী না করিচ্চি!” তিনি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড মোনাজাতউদ্দিন পাটোয়ারীকে হোয়াটস্যাপে বলেন। ভিন্ন দল থেকে নমিনেশন পেয়ে ফাঁকতালে জিতে যাওয়া দুধভাত এমপি হবার পর নিজ দলে তার কদর যতোটা বেড়েছে, মূলধারায় বিরুদ্ধবাদী উপজোটের সাথে তার দূরত্ব ততোটাই ঢালু। পঞ্চসার আসনের আখতারুজ্জামান ডালিমের সাথে তার এমনিতে কোন মিস্টার নাই, তবে গেলো নির্বাচনের হিসেব নিকেশে এই দুই আসনের নেতাকর্মীদের আধিপত্যর ভাগবাটোয়ারায় না চাইলেও কিছু টরেটক্কা তৈরি হয়েই যায়। এমপি মহোদয়কে তাই প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হয়। আজকাল ফোনকলে আড়িপাতার যে রেওয়াজ শুরু হয়েছে, তাতে মোবাইলে কল করা রিস্কি। তিনি ভিন্ন আইডি দিয়ে সাংগঠনিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। নেহাত ভিন্ন দল বলে নেতা হবার সর্বজনবিদিত কালো কোট থেকে বঞ্চিত বলে এমপি মহোদয়ের আরও একবার পুনর্জন্ম নিতে ইচ্ছা করে! তার যা বয়স তাতে আবার পুনর্জন্ম নিয়ে ব্যারিস্টারি শেষ করে ছোট দলের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হওয়া সম্ভব! একবার ভেবেছিলো, দল ভিন্ন তাতে কি? আদর্শিক পরাকাষ্ঠা হিসেবে কালোকোট তো সে পড়তেই পারে। কিন্তু পরক্ষণে তার মনে পরে, সংসদে বিরোধীদল হিসেবে বিষয়টা বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে হয়তো। তাছাড়া তার নিজের দলের ভেতরে অন্তত সতেরটা উপমত রয়েছে। কে যে কোথায় সুতো ধরে টানবে তার ঠিক নেই। এমপি সাহেবের ইদানিং ঘুমাতে গেলেই টেনশন লাগে এই ভেবে যে, কোন একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হয়তো শুনবে তার দলটারই হয়তো অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, আর সাথে তার এম্পিত্বটাও। অবশ্য এমনিতেও তার দলেও খুব স্বকীয় অস্তিত্ব যে আছে সেটা পানির ভেতরের এক অনু হাইড্রজেনে দুই অনু অক্সিজেন প্রমাণ করার মতোই ঘটনা-সাপেক্ষ বটে! এ কারণে এম্পি হবার পরেও তার ওজন ভারছে না। অথচ মোনাজাত উকিল এমপি না হয়েও অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। তবে বয়সে বড় হয়েও মোনাজাত তাকে কাছকাছারিতে পেলে ছাছা ডাকে। আর সবার সামনে ডাকে ‘মানোনীও ছংছদ ছদোছ্যো’। এতেই সে আটখান। তবে পেছনের হিসেবটা হলো মোনাজাতের ভায়রাভাই ব্রিজটেক কর্পোরেশন- তার এলাকার মেগা প্রজেক্ট হিসেবে টাইরোটানেলের কাজটা পাচ্ছে। সাড়ে সাতশো কোটির কাজ পুনর্বিবেচিত প্রাক্কলিত ব্যায়ে টেকনেকে পাশ হয়েছে ষোলশো উনষাঠ কোটিতে। এই এলাকার দুটি আসনের এম্পিরাও এই বিশাল কাজের বেনিফিশিয়ারি যে হবেন সেটা মোটামুটিভাবে পাক্কা। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন এখন সমগ্র জাতির জন্য একদিকে যেমন অহংকার অন্যদিকে তা প্রেস্টিজ ইসু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা নরওয়ের একটি ভূতত্ত্ব জরীপ জার্নালে জানানো হয়েছিলো ডাউকি ফল্টের এতো কাছে প্লেট টেকটোনিক এ্যাকশনের কারণে টাইরোটানেল নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ। ওই গবেষণাকে হটকারি বলে রায় দিয়েছেন ‘গফরগাঁও সমাজ ও নৈতিকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের’ একদল শিক্ষানুরাগী! কাজে কাজেই মোনাজাতউদ্দিনের নিজ এলাকায় ধানে আগুন লাগার ভিডিও ভাইরালের বিষয়টি ফোন করে শহর তাঁতী কমিটির প্রচার সম্পাদক সমুদ্র বিশ্বাসকে জানান। সমুদ্র থেকে তথ্যটি আরও দুটি কান ঘুরে চলে যায় বাঐতারা বাজার ব্যবসায়ি ডিজিটাল সমবায় সমিতির সভাপতি রশিদ অপেরার কাছে। যৌবনে অতিরিক্ত যাত্রাআসক্তি তাকে এহেন টাইটেল নিতে বাধ্য করেছে! তাতে তিনি যথেষ্টই হৃষ্ট। তবে তার আপত্তি ওই যৌবনকালের ইসু নিয়ে। “কেন বাহে? হামার কি জোয়ানকি নাই বলিচ্চ তোমরা?” তা সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ বলে কেউই চ্যালেঞ্জ করেনা কারণ আর কিছু থাকুক না থাকুক, রশিদ অপেরার জোড়া-চটকানা যে একবার খেয়েছে…!

পুলিশের খাতায় নাম আছে বলে বারবার পুলিশই যে তোমাকে ধরবে এমন কথা নেই। এই এখন যেমন জয়নাল অনেকটা পুলিশের কেয়ারঅফে আছে ঠিকই, আবার নেইও। কে বা কাহারা তাকে ধরিয়া অর্থাৎ তুলিয়া আনিয়াছে, তাহা সরকারবাহাদুর এখনো জানে না। তবে জানবে। সেই জানা অব্দি জয়নাল এখন বেঁচে থাকলে হয়। হাবে ভাবে মনে হচ্ছে জয়নালের এবার চান্স ফিফটি ফিফটি। কারণ, জনাদুয়েক কনস্টেবল বুকে মেডেল ঝুলিয়ে আনস্টাবল অবস্থায় তার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। কাহিনীর মূলদৃশ্য এখনো শুরু হয়নি বলে তারা ফ্লোর নিতে পারছে না। নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে মতবিনিময় করছে। দু একটা শব্দ শুনলে বোঝা যায় তারা জয়নালের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। শালা জারুয়া ছিলো, মাদারচোদ মেয়েদের ইভটিজিং করতো- তারা বাক্যগঠনে পুরঘটিত অতীত কালীন শব্দ ব্যবহার করে! তাদের নেমট্যাগে কারো নাম ইলিয়াস, কারো আঃ রব কারো বা মনতোষ! কিন্তু তারা নিস্পৃহভাবে মার খাওয়া দেখে। এই অর্থবছরে মডেলফাঁড়ির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে বলে ফাঁড়ি এখন অস্থায়ী কুঁড়েঘরে স্থানান্তর করা হয়েছে। পাশেই চটমোড়ানো বড় বড় কংক্রিট থাম আর থামের মাথায় চোখা রড আকাশমুখি হয়ে আছে। নতুন ভবনের বিশেষত্ব হলো এটাতে টর্চারসেল বলে আলাদা কোন স্পেস নেই। আধুনিক পুলিশিং হচ্ছে জনবান্ধব। সেই সত্যকে মাথায় রেখেই উনত্রিশ কোটি চুয়ান্ন লক্ষ টাকার এই মডেল ফাঁড়ি কাম পুলিশ কোয়াটার্স নির্মিত হচ্ছে। জয়নালের এখন শীত করছে। নাকের রক্ত শুকিয়ে ঝুলছে নাকের সাথেই। তার মনে হচ্ছে রাতের স্বপ্নগুলো বুঝি এখনো ঘুরে ঘুরে চলছে। একটা থামলেই আর একটা, অনেকটা ইউটিউবের অটোপ্লে অপশনের মতো। মাঝে মাঝে বাফারিংয়ের জন্য দৃশ্য থেমে যাচ্ছে। তখন একটা ডায়লগই বারবার প্লে হচ্ছে, বল্, তোক্ কে ভিডিও তোলার কহচে? বল্!

watercolour, watercolor, paint

মোসাদ্দেক হেঁটে হেঁটে উঁচু আলের পাড়ে গিয়ে বাকহারা হয়ে যায়। সারা ক্ষেতের এমাথা ওমাথা বেগুনি রঙে ছেয়ে গেছে। এতো পাখী এলো কী করে, কোথা থেকেইবা এলো? তাদের কলকাকলিতে লোকজন চারদিকে উৎসাহ নিয়ে দেখছে! তেড়ুয়াকে চিনতে পেরে কে যেনো তাকে সামনে ঠেলে দেয়। মোসাদ্দেক ক্ষেতে নেমে বুজতে পারে, পাখী নয় বেগুনি রঙের দেবদূত নেমে এসেছে তার মাঠে। কৌড়িখাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের একঝাঁক ছাত্রী তার ক্ষেতের ধান কাটছে!

পর্ব ৫: কমেন-কোঁজোড়

মিডিয়া চাইলে কী না হয়, কও? ডেনাইট উল্টায়ে ফেলা কুনো ঘটনাই না। একটা লাঠিরে তরমুজ বানানো ধরো সিডা যাদুকরের জন্য মেলা প্রাকটিসের বিপার, কিন্তু আজকালগের এই ওপেনসোর্সের জগতে এক ক্লিকই যথেষ্ট। দৈনিক গোধড়া বুলেটিনের অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাব এডিটর স্বপন কৌশিক তার না ঘুমানো চোখজোড়া স্ক্রিনে রেখে সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে আলোচনার সমাপনী বক্তব্য দেন। স্বপন কৌশিক তার আসল নাম নয়। এ বি এম আশরাফুর রহমান লেবুর আরও দুটো নাম আছে। নিউজে শর্ট পড়লে তারা পুনর্জীবীত হন। সহকর্মী বলতে দুজন প্রদায়ক, যাদের চাকরি পার্মানেন্ট হবার কথা বলে নয়মাস ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। পার্মানেন্টের তোয়াক্কা অবশ্য তারা করেনা। তাদের চাই প্রেসকার্ড। সেটা পাওয়ার প্রক্রিয়াটা একটু জটিল, তাই আপাতত একটা টেম্পোরারী কার্ড ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে লেখা মোঃ ইসতিয়াক হোসেন, কন্ট্রিবিউটর। বাকীজনকে বলে কয়ে রাজি করানো হয়েছে। কার্ডও দেয়া হয়েছে। তিনি গোধড়া প্রাইমারি স্কুলের বিদ্যোৎসাহী ম্যালেট অঞ্জলি বিশ্বাস। কিন্তু গোধড়া বুলেটিনের প্রতি তার বিশ্বাস ও আস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। তা না ওঠার কারণও আছে। নির্জন দুপুরে যখন অফিস থাকে ফাঁকা, তখন তাকে আসতে বলেছিলো স্বপন কৌশিক। কেনো? তাকে লেখার টেকনিক হাতেকলমে শেখাতে। ম্যালেট অঞ্জলী মিষ্টি করে হেসে বলেছিলেন আসবো লেবু ভাই। আসেনি। আসেনি তাতে দুঃখ নাই। বাকি সবাই তাকে স্বপনভাই ডাকে, অঞ্জলি লেবু ডেকে তার মুখোশটাতে টোকা মারলো যেনো! মফঃস্বলের সাংবাদিক হিসেবে লেবুর দাপট সেই লেটার প্রেসের যুগ থেকে। যখন একটার পাশে একটা সীসার টাইপ সেট করে দিনরাতের পরিশ্রমে মাসিক আটশত টাকায় কম্পোজিটররা কাজ করতো। ধাক্কাস ধাক্কাস শব্দে ট্র্যাডেল মেশিনে ছাপা হতো ট্যাবলয়েড। দৈনিক গোধড়া বুলেটিন সেই আমলের। অধুনা এর মালিক চেঞ্জ হয়েছে। পুরোনো প্রেস বিক্রি করে তিনি হাইস্পিড ফোর কালার অফসেট প্রেস বসিয়েছেন। পাশাপাশি লেবু নিয়ে এসেছে অনলাইন নিউজ পোর্টালের আইডিয়া। মালিক চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানশাটে তার সুবিশাল আমবাগান ও সেই বাগানের ভেতরের আলিশান প্রাসাদ সামলায়, আর লেবু সামলায় তার প্রেস। কিন্তু শুধু স্থানীয় সাংবাদিক হলে তো জাতে ওঠা কঠিন। কলমের ধার বোঝাতে হলে রাজধানী ও রাজনীতিতেও যোগাযোগ থাকতে হয়। লেবুর দুটোই আছে। ফাইনান্সিয়াল ট্রিবিউন আর দোতারা টিভি, দুটোরই সে আঞ্চলিক করস্পন্ডেন্ট। সারাদিন তাকে একটা ফিফটি সিসির মোটরবাইকে দেখা গেলেও সন্ধ্যার পরে কিছুসময়ের জন্য লেবুকে কেউ খুঁজেও পাবেনা। ওই সময়টায় সে কী করে কোথায় যায়, সেটা জানে হয়তো দুয়েকজন। বিড়ি সিগারেটের নেশা না থাকলে কী হবে, লেবুর দুর্বলতা অন্য যায়গায়। অঞ্জলির দিক থেকে সাড়া না পেলেও সে হাল ছাড়েনি। লেগে আছে। এসব ব্যাপারে তার ধৈর্য সীমাহীন। চান্সে আছে মহিলার কিছু ছবি কালেকশনের। সেসব হাতে পেলে স্বপন কৌশিক ম্যালেটের নামে ফেসবুকে একটা ক্লোন আইডি খুলবে, তারই ছবি ব্যবহার করে। তারপর হালকার ওপর ঝাপসা কিছু বিতর্কিত পোস্ট দিলেই ম্যালেট তার কাছে সুড়সুড় করে এসে পড়বে। কিন্তু মহিলার একাউন্ট লক থাকে আর অপরিচিত কাউকে এ্যাডই করতে চায়না। আশ্চর্য, সোশাল মিডিয়ায় এতো আনসোশাল হলি চলে? তাছাড়া অঞ্জলির ছেলে পড়ে সিলেট শাহজালালে। এখানে থাকে সে একা। বয়স বোঝা যায়না অঞ্জলির। তা বাপু রাতবিরাতে মানুষতো অসুস্থও হয়, নাকি? সেসবকালে সাহায্য করার জন্য লেবুর চেয়ে পরোপকারী আর কে আছে?

ইসতিয়াকের সাথে ধানে আগুনের নিউজটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো লেবুর। ট্রিটমেন্টটা পছন্দ হয়নি তার। ন্যায্য দাম না পেয়ে এক কৃষক তার ক্ষেতে আগুন লাগাতে যাবে কেনো? ঘটনা অন্য। তুমি আর একটু ডিপসার্চ করো ইসতিয়াক। আন্ডারলায়িং স্টোরি খোঁজো। ইসতিয়াক যখন বলে আর কোনো স্টোরি নাই পেছনে, তখন রাগ লাগে লেবুর। আরে বাবা, দুনিয়ার সকল নারী নির্যাতনের পেছনের স্টোরি কি? নারী নিজেরে পুরুষের সমান মনে করে, সেইজন্যইতো? তাহলে, গরীব মানুষের দুর্ভাগ্যের কারণ কী? অতিলোভ। এই সামান্য বিষয়টা ইসতির মাথায় কেনো ঢোকে না, বোঝেনা সে। এটাতো পরিষ্কার যে ধান কাটার জন্য এখন খরচ আগের চেয়ে বেশি। ফলন যতোই বাড়ুক, লেবার ক্রাইসিসের কারণে সময়মতো ধান ওঠানো এখন একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। এখন তুমি যোদি সেই খরচের ওপোর আরো লাভ কোরতে চাও, সেটাতো বাস্তোবোতাকে অগ্রাজ্ঝো করা। গ্লোবালি চালের উৎপাদোন খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশেও যে বাড়বে তাতো জানা কথা। সে কারণে কেউ যদি নিজের ক্ষেতে আগুন দেয়, তো ঘটোনার একটা মোটিভ পাওয়া যায়। দেখা গেলো এ মর্মে সরকার তখন একটা ভোর্তুকির ব্যবস্থা করলেও করতে পারে। ওয়েলফেয়ার রিপোর্টিংয়ের এ বিষয়টা ইসতিয়াকের মাথায় একদমই ঢোকেনা। লেবু নিজেই পুরো নিউজটা রিরাইট করে গায়েব হবার আগে সন্ধ্যাসন্ধি নেটে আপলোড করে

মন্ত্রণালয় থেকে কল আসার পর ধানের বিষয়টা নড়েচড়ে বসে। যারা নড়াচড়া করে তারা কেউই অবশ্য ধান উৎপাদনের সাথে জড়িত নয়। কিন্তু তারা নীতি নির্ধারণী। বিভিন্ন ইত্যাদি মহল থেকে ধানে আগুন, ধান কাটা, ধানের দাম তথা ধানোৎপাদন নিয়ে এমন চুড়িহাট্টা শুরু হয়ে যায় যে স্থানীয় শাসনযন্ত্রের গা না করে উপায় থাকে না। ইন্টেলিজেন্স রিপোট বিভাগীয় পর্যায়ে এমনভাবে পরিবেশিত হয়, মনে হয় যেনো সেটা বিশাল রাজনৈতিক ক্ষতি হিসেবে অবমুক্ত হতে যাবে। স্থানীয় পর্যায়ে ঘটনার হলকা এসে লাগে সাদের চিয়ারম্যানের দপ্তরেও। একে তো সচিব সাহেব দেশের বাহিরে, তার ওপর এলজিএসপির অডিট শুরু হয়ে গেছে। এমন সময়ে এহেন একটা ভাবমূর্তির গায়ে গোবর ছেটানো সংবাদটা তাকে বিহ্বল করে তোলে। প্রথমেই তার মনে হয় এর পেছনে বিরোধীপক্ষীয়- যারা গতবছর তার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে প্যানেল চেয়ারম্যানি চেয়েছিলো- তাদের হাত আছে কিনা! কিন্তু কান্ডটা করেছে মোসাদ্দেক, যাকে সে মাত্র কদিন আগে বুঝিয়ে বাজিয়ে সাইজ করে দিয়েছিলো বলে তার ধারণা। আর সে কারণেই পুরো ঘটনাটায় সে তৃতীয় শক্তির আনাগোনা টের পায়। পুরোনো দল ত্যাগ করে ক্ষমতাসীন দলে আসার বর্ষপূর্তী হবার আগেই এমন একটি সংবাদ তাকে বিষম চিন্তায় ফেলে। ওই রাতেই ডাকাতি হয় প্লাম্বার মোসাদ্দেকের বাড়িতে। তার ২২০ ঘোড়াশক্তির জেনারেটর তুলে নিয়ে যায় ডাকাতদল। যাবার কালে ডেইরিফার্মের তিনটা অস্ট্রেলিয়ান গরু গায়ে ছুরির পোঁচ দিয়ে রেখে যায়। প্লাম্বারের আহাজারি দেখে কে? আহাহা বোবা জীবগুলা। সবাই জিভে চুকচুক করে। অনাহুত ব্যক্তিবর্গ সর্বৈব ডাকাত না চোর না ধড়িবাজ না কসাই, সে নিয়ে উপস্থিত দর্শকশ্রেণীতে ব্যাপক মতদ্বৈততা দেখা দেয়। দিনদুয়েকের মধ্যে বাঐতারা আর তার পার্শ্ববর্তী কয়েকটা গ্রামে পুলিশের আনাগোনা বেড়ে যায়। সাদা পোশাকের ছোটকরে ছাঁটা কিছু অপরিচিত মানুষজন খুঁজতে থাকে গৌতমকে। সিস্টেম রেস্টুরেন্ট দুদিন যাবৎ বন্ধ আছে। একটা ফোনকল এসেছিলো সিস্টেমের নম্বরে।

ওদিকে তিনরাত একটানা স্বপ্নের ভেতর দোজখি আগুনে ভাজাভাজা হয়ে চাররাতের ভোরে তেড়ুয়া মোসাদ্দেকের ঘুম ভাঙে। হাজেরা এই তামামটা সময় ওজিফা পড়েছে তার শিথানের পাশে বসে। মানুষটা কেবল কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। আর বিরবির করে নকীরাকে ডাকছিলো। কিন্তু ভোরে চোখ মেলে উঠে স্বাভাবিক স্বরে সে হাজেরার কাছে ভাত চায়। গরুর কালাভুনা দিয়ে গপাগপ পানিভাত গেলে সে রাক্ষসের মতন। তারপর চা খায় এক ডেকচি। দু দুটো হানিফবিড়িও খায় পরপর। আলফাজ সে সময় হন্তদন্ত খবরটা নিয়ে আসে। ‘দুলাভাই, তোমার জমিত কী চিত্তির হচে সন্ধান করেন বাহে। মেলা কাউর বাদিচ্চে এ্যানা…’। জমির কথা শুনে আলফাজ সম্বিত ফিরে পায়। তাইতো, তার জমিতে তো এখনো অনেক ধান পড়ে আছে কাটার অপেক্ষায়। সে দ্রুত এগোয় ক্ষেতের দিকে। তেরচা করে রোদ ঘনিয়েছে চারদিকে। পথের ধারে জংলায় এলোকেশির থোড় বেড়িয়েছে বাহারি ভঙ্গীতে। কদিন গেলেই মেটেহলুদ ফুলের গাঁটি ছাড়বে। ঘ্রাণে মৈ মৈ করবে তখন ভিটিবারান্দা। মোসাদ্দেক হেঁটে হেঁটে উঁচু আলের পাড়ে গিয়ে বাকহারা হয়ে যায়। সারা ক্ষেতের এমাথা ওমাথা বেগুনি রঙে ছেয়ে গেছে। এতো পাখী এলো কী করে, কোথা থেকেইবা এলো? তাদের কলকাকলিতে লোকজন চারদিকে উৎসাহ নিয়ে দেখছে! তেড়ুয়াকে চিনতে পেরে কে যেনো তাকে সামনে ঠেলে দেয়। মোসাদ্দেক ক্ষেতে নেমে বুজতে পারে, পাখী নয় বেগুনি রঙের দেবদূত নেমে এসেছে তার মাঠে। কৌড়িখাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের একঝাঁক ছাত্রী তার ক্ষেতের ধান কাটছে! তাদের আনন্দ আর উচ্ছাসে পুরো গ্রাম জেগে উঠেছে যেনো। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া নিউজটা তারা অনেকেই শেয়ার করেছে। উঁচুক্লাশের মেয়েগুলি হাতে কাস্তে নিয়ে সেই ভোরবেলায় জড়ো হয়েছে এখানে। আজ তারা ক্লাশ বাদ দিয়ে এসেছে মোসাদ্দেকের ধান কেটে দিতে! কীয়েক্টাবস্থা! মোসাদ্দেকের বিড়বিড়ানি চলছেই। সেটা থেমে যায় যখন ওদের ভেতর থেকে একদল অতিবেগুনি দলনেত্রী তার দিকে এগিয়ে আসে। প্রাণপ্রাচুর্যের উষ্ণতা নিয়ে মেয়েগুলো তার সামনে এসে কে কার আগে কথা বলবে এটা ভেবে হাফায়। তারপর নিজেদের একজন নেতৃত্ব নিয়ে বলে, চাচাজান আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা আপনার সব ধান ঠিকমতো কেটে দেবো। মোবাইলে আপনার খবরটা দেখে আমরা সবাই চলে এসেছি। আমাদের কোনো মজুরী দিতে হবে না। বলে একযোগে হাসির কোরাস তোলে। তারপর আবার হইহই করে কাজে লেগে পড়ে। তেড়ুয়া যে তেড়ুয়া সে কোন্ ছাড়, হার্মাদের দিলও এমন কথায় গলে কাদা হয়ে যাবে। যদিও উপযুক্ত কিষাণপাট না পাওয়াই তার ধানে আগুন দেয়ার প্রকৃত কারণ নয়, এমনকি ধান কাটার মজুরি বেড়ে যাওয়াও তার জন্য অতোটা সমস্যা ছিলো না। আলফাজকে নিয়ে বরাবরের মতো এবারও সে কোনোমতে কেটে ফেলতে পারতো অবশিষ্ট ধান। কিন্তু কেনো সে আগুন দিলো তার নিজের হাতে বোনা ক্ষেতে? গত চারদিনের ঘুমতন্দ্রার মাঝে মোসাদ্দেক নিজেও খুঁজে পায়নি তার প্রকৃত কারণ। তার শুধু মনে আছে টিকটিকির মতো তার মাথায় বিষম রাগ তিড়িক মেরে উঠে গিয়েছিলো। এখন এই সরস ধানের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে সে মনেই করতে পারলো না কি কারণে সে এমনটা করতে পেরেছিলো। পাকা ধানের হলদে সবুজের মাঝে বেগুনি সাদা ইউনিফর্ম পড়া মেয়েগুলিকে ধান কাটতে দেখে পানিভর্তি চোখে অভিভূত তেড়ুয়া ভাবতে থাকে বেহেস্তের মাঠ কি এমন সুন্দর? সেখানে কি নকিরারা এভাবে খেলা করে?

watercolour, watercolor, paint

পন্ডিত হরিহরণের সম্বর্ধনায় তাঁর হাতে শুভেচ্ছা স্মারক ‍তুলে দিতে গিয়ে সে জনসমখ্যে বিনয় প্রকাশ করতে পেরেছিলো। অবশ্য অনুষ্ঠান শেষে রাতে রেডিসন ব্লর স্যুইটে বসে জনৈক দূতাবাস কর্মকর্তার সাথে তারা তিনজন যখন অন্য আলাপ করেছিলো – বিনয়বাবু তখন ছিলেন না, এমনকি মিডিয়াবাবুও তার কিচ্ছুটি টের পাননি।

পর্ব ৬: হত্তেলঘুঘু

সচিবালয় থেকে বের হয়ে দক্ষিণ মৈষুন্ডীর লালমোহন সাহা স্ট্রীটে আসা অব্দি কেউ যদি কবীর আল হুমায়ূনকে ফলো করতো, তবে বড়ো আশাহতই হতো। চোখে পড়ার মতো এমন কিছুই নেই যা অন্যের মনযোগ আকর্ষণে কাজে লাগতে পারে। না চেহারা, না বেশভূষা। এমন কি তার নামটা পর্যন্ত গড়পড়তা। র্সাচ দিলে এ মুহূর্তে সারা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ কবীর আল হুমায়ূন বের হয়ে আসবে। জমির দালাল থেকে শুরু করে শুঁটকি ব্যবসায়ী পর্যন্ত। এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তাদের প্রত্যেকের সাথে তার চরিত্রগত সাযুজ্য রয়েছে। কিন্তু একটা ছাড়া। সেই এক্স ফ্যাক্টরের গুণেই কবীর আল হুমায়ূন, কৃষ্ণ-কবীর নামে চেনা মহলে পরিচিত। কিন্তু পুরোপুরি চেনা মহল তাকে বলা যায় না। কেননা, তাদের জগতে চেনা বলে আদতে কিছুই নেই। যে যতো অচেনা, টিকে থাকার সম্ভাবনা ততো বেশি। বস্তুত, অচেনা মানেই সে ততোই ওপরের মানুষ। হা, কৃষ্ণ-কবীর নামধারী এই ব্যক্তিটি আসলেই কতোটা ওপরের তা সে নিজেও জানে না। কনস্যূলেট অফিসগুলো হয়তো জেনে থাকতে পারে। কে জানে ভবিষ্যতে উইকিলিকসের মতো কোন গোপন নথি প্রকাশ হলে হয়তো দেখা যাবে, সেখানে কৃষ্ণ-কবীর লীলা করছেন! সে হাসলো মনে মনে। স্বামী অশ্বানানন্দের ব্যক্তিগত খাসলত মনে করে।

লালমোহন সাহা স্ট্রিটের এই চিপা গলিতে তার একটা ‍দু রুমের গোডাউন আছে। সেখানে জিন্নাত এসে মাঝে মাঝে থাকে। রাত কাটায়। চায়না থেকে মোটরবাইকের পার্টস আমদানী করে গোডাউন চালায় জিন্নাত। কাগজপত্র সব ওরই নামে। কিন্তু এটা আসলে কৃষ্ণর সেফ হাউজ। কেউ এখানে তাকে চেনে না। এরকম অন্তুত আরও চারটা অফিস আছে ঢাকা শহরে তার। কিন্তু কোনটাতেই সে খুব একটা যায়না। এমন কি অফিসগুলোও একে অন্যকে চেনেনা। তার আসল ব্যবসার সাথে এই অফিসগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কাজ করতে টেবিল চেয়ারে পেপারওয়েট মার্কা অফিসের দরকার পড়ে না। ব্যাবসায় সবাই যা দশ বছর পরে ভাববে, কৃষ্ণ কবীর তা আজ ভাবে। পানির দরে বললেও কম বলা হয় এমন দশ হাজার বিটকয়েন সে কিনেছিলো বছর আটেক আগে, শ্রেফ কৌতুহল বশে। আজ তার দাম কয়েকশো কোটি টাকা! টেকনোলজি তাকে টানে। দেশে ব্যক্তিগতভাবে স্যাটেলাইট ফোন প্রথম আনে সে। ড্রোন ক্যামেরাও। তারও আগে ভিওয়াইপির ভালোমন্দ যখন তেমন করে আমলে আনেনি কেউ, কবীর আর হুমায়ুন মোটা টাকা বানিয়ে নিয়েছে তা দিয়ে। তারও আগে- যখন ইন্টারনেট চলতো ডায়ালআপ লাইনে- সে তখন ফাইবার অপটিকস্ পরিচিত করেছে দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন দেশে। সবই অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন নামে। এক ব্যবসা খুব বেশিদিন করে না সে। বস্তুত ব্যবসা সে করতে খুব একটা পছন্দও করে না। সে মারে দাঁও, এটা তার খুবই পছন্দের। লাগলে লাগলো, না লাগলে অভিজ্ঞতা – এই হলো তার দর্শন। ভিড়ের রাস্তায় হাঁটতে তার ভালো লাগে, অনেককিছু চিন্তা করতে পারে তখন। হেঁটে হেঁটেই অফিসগুলোয় ঢুঁ মারে সে। আসলে তার গাড়ী নেই। সবার চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য থাকার এই দুর্ণিবার প্রবণতা তাকে তরতর করে উপরে উঠতে সাহায্য করেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে তার না-মানুষ মনে হয়। সিনেমায় নাচের দৃশ্যে বা নায়কের এন্ট্রিতে রহস্য তৈরিতে যেমন ধোঁয়া তৈরি করা হয়, তার চারপাশে তেমন এক ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখে সে সারাক্ষণ। কথা বলে মেপে মেপে- লোক বেছে বেছে- সবার সাথে বলেনা। কাজও করে বেছে। তা কাজ বললেই কাজ। যদি জনসংযোগকে তুমি কাজ বলো, তবেই। অথচ সেজন্য তাকে ছেঁচড়াদের মতো সারাক্ষণ কানে মোবাইল ঠেকিয়ে রাখতে হয় না। বস্তুত কবীরের নিজের নামে কোনো সিমও নেই, হ্যান্ডসেট তো নেই-ই। সন্তানরা কানাডা থেকে হাই হ্যালো যা করার সব তাদের মায়ের সাথেই করে। স্ত্রীর কাছ থেকেই কবীর জেনে নেয় ওদের কিছু জানতে বা জানাতে হলে।

মৌলিকভাবে কবীর বিনয়ী। সেই বিনয় লোকসমাজে দেখানোর সুযোগ খুব একটা হয় না। পন্ডিত হরিহরণের সম্বর্ধনায় তাঁর হাতে একবার শুভেচ্ছা স্মারক ‍তুলে দিতে গিয়ে সে জনসমখ্যে বিনয় প্রকাশ করতে পেরেছিলো। অবশ্য অনুষ্ঠান শেষে রাতে রেডিসন ব্লর স্যুইটে বসে জনৈক দূতাবাস কর্মকর্তার সাথে তারা তিনজন যখন অন্য আলাপ করেছিলো – বিনয়বাবু তখন ছিলেন না, এমনকি মিডিয়াবাবুও তার কিচ্ছুটি টের পাননি। বাইরের দুনিয়ায় সে এক মাঝারি মানের ব্যবসায়ী- যার একটি গ্লাস ফ্যাক্টরী আছে। সলিসিটরস ইন্ এর স্বত্তাধিকারি এফ রহমান তাকে ফ্যাক্টরি করার বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন। বর্ষীয়ান এফ রহমান তার চেয়ে বছর দশেক ছোট কৃষ্ণ-কবীরকে ডাকতন মুরুব্বী বলে। আসলে তাকে ডাকতে গিয়ে সে নিজেই যে ওর মুরুব্বী সেটা মনে করিয়ে দিতেন প্রচ্ছনভাবে। এফ রহমানের এই ডোমিনেটিং কিন্তু ডিপ্লোমেটিক আচরণ তার কাছে বেশ লাগতো। পৃথিবীতে ভদ্দরলোক বিষয়টা তো উঠেই গেছে একরকম। পাছা মারার সময়ও যদি গোলাপফুল ধরে না থাকো, তো তুমি কেমন ভদ্দরলোক বটে? সারা দুনিয়া চলছে কিসের ওপর? এই হাসতে হাসতে খুন করা আর খুন হতে হতে হাসতে পারার গপ্পেইতো? কিছু আদুজাতের মানুষ সেটা বোঝেনা। ঝামেলা করে বসে অহেতুক প্রশ্ন, অহেতুক কৌতুহল দেখিয়ে। যেখানে যা না বললেও বাল-ফালানি যায় না, সেটা তাদের বলা চাই-ই চাই। এফ রহমান লোকটা জান্নাতবাসী হোক, এই কামনা এখন করে কবীর। দেশের ব্যাংক ঋণখেলাফিদের বড়বড় মামলা সলিসিটরস ইন্ রফা করতো। প্রতি শুনানীতে লাখ লাখ টাকা জমা হতো এফ রহমানের একাউন্টে। তা তাতে খেলাফিদের কিই বা কাটে? একশো কোটির ঋণ পেলে এককোটি কার গায়ে লাগে? হাসতে হাসতে চেম্বারে বসে উনি একদিন বলেছিলেন, ’একটা ফ্যাক্টরী খোলেন মুরুব্বী। অপ্রদর্শিত আয় চেপে রেখে এভাবে আর কতোদিন? মিডিয়া ছুঁলে ছত্রিশ ঘাঁ, আর সোশাল মিডিয়া ছুঁলে একশো ছত্রিশ ঘাঁ। ব্যাপারটা বোঝেন মুরুব্বী। ঋণখেলাফি হলে আপনাকে সেফ করতে পারতাম, কিন্তু যে পথে আপনি হাঁটেন, সেটা আরও মারাত্মক!’ কথাটা মনে ধরেছিলো তার। রাতারাতি কালিয়াকৈরে দশ একর যায়গা কিনে না বিশাল না বড়ো একটা মাঝারিমানের পিএমপি গ্লাস ফ্যাক্টরি খুলেছে সে। নব্য বড়লোকদের ঘোড়ারোগের অন্ত নেই। যেই শুনলো তাপশোষণকারী কাঁচ, অমনি হামলে পড়লো। ইহ্, এক একজন পাঁড়-পরিবেশবাদী এক্কেবারে। অবশ্য এর ক্রেডিট অনেকটাই দিতে হয় বিজ্ঞাপন-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে। সাধারণ কাঁচের তিনগুণ দামী পিএমপি গ্লাসের ওরা মার্কেট ধরিয়ে দিলো। পাবলিক কি বুজলো তা তারাই জানে। ব্যবসা খারাপ হলো না। স্টাটিংয়ের তৃতীয় বছরে সে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে পুরষ্কৃত হলো। আর তার ঠিক তের দিনের মাথায় এফ রহমান তার শয়নকক্ষের এসি বার্স্ট করে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আরও তের দিন মিডিয়ার স্ক্রলে থেকে থেকে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে শেষে একদিন শোকবার্তা হয়ে গেলেন। সবাই এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবেই জানে। এখন অবশ্য কৃষ্ণ-কবীরের কাছেও ব্যাপারটা তেমনই মনে হয়। অন্যের বিষয়ে খুব বেশীমাত্রায় জেনে ফেলাটা একরকম দুর্ঘটনাই বটে!

জিন্নাতের গায়ে স্পোর্টম্যানদের মতো চটকদার ট্রাকস্যুট। ভুরু কোঁচকালেন কবীর। এতো খুশির কী আছে? কুন্ঠিতভাবে সালাম দিলো জিন্নাত। মিয়াভাই, সাহা সুইটসের মিষ্টি নিয়া আসলাম, কচুরীভোগ সন্দেস, আপনার জৈন্ন।’

– পেয়েছেন?

একটি শব্দেই জিন্নাত বুঝে গেলো, কী পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সে মাথা নেড়ে বিনীতভাবে ছোট্ট করে হ্যাঁ বললো। টাইরোটানেলের এপ্রোচওয়ের আগে যে দশ কিলোমিটার এক্সপ্রেস হাইওয়ে হবে বামনহাটি থেকে সতীদাহ পর্যন্ত, সেটা করবে বাংলাদেশি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু টেকনিক্যাল এসিসস্ট্যান্স দেবে নরওয়েরে নোরাক্স দ্যু-অর কোম্পানি। অর্থাৎ কিনা ষাট ভাগ যাবে ওদের পেটে। তা সেসব যেয়েসেয়েও দেশি কোম্পানির ইতর-বিশেষ কিছু হবে না। টাকা ধরা আছে মেলা। বাজেট যাচাই কমিটি পুনর্বিবেচনা করে কাজ শুরুর ছয় মাসের মাথায় প্রাক্কলিত ব্যায়ের নুন্যাধিক বিশ শতাংশ ব্যায় বাড়াতে পারবে বলে সমঝোতা স্মারকে একটি ধারা যোগ করা আছে। জিন্নাত ভেবে রেখেছে, কাজটা পেলে সে একবার স্পেনের লা লিগা দেখতে যাবে। উহ্ তার কতোদিনের শখ গ্যালারিতে বসে… আর কৃষ্ণ-কবীর আগেভাগেই কল্পনায় জিন্নাতের লাশটা ফুলজোড় খালের কাদায় আধা-ডোবা উপুর হয়ে ভাসতে দেখলো। কিন্তু এসব ঘটনার সাথে তার কোন যোগাযোগ কেউ কখনো যদি করতে পারতো, তাহলে কবীর আল হুমায়ূন আর কৃষ্ণ-কবীরের সাথে পার্থক্য রইলো কোথায়? জিন্নাতের যে বেপরোয়া বাইক চালানোর বাতিক আছে, তা বাঐতারার কে না জানে? তা রাত দুটোয় রাস্তা ফাঁকা পেয়ে ফুলজোড়ের পাড় দিয়ে ওভাবে ড্রাইভ করলে দুর্ঘটনা তো ঘটবেই। তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে তার শরীরে ধারালো অস্ত্রের ক্ষত রয়েছে- এমন একটা এফ আই আর প্রথমে রপ্ত হলেও- চার্জশিটে তার চিহ্ণও থাকবে না। মোনাজাত উকিলের ভায়রাভাই এ নিয়ে বেশ কিছুদিন পানি ঘোলা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভদ্রলোক মাগীবাজ হলেও, ওয়ার্ড পর্যায়ের এক কর্মীর সাথে অপ্রীতিকর অবস্থায় ৪০ সেকেন্ডের ক্লিপ ভাইরাল হবার পর সব কেমন ঠান্ডা মেরে যাবে। ‘একহাত বল্লার বারোহাত শিং, উড়ে যায় বল্লা ধা তিংতিং!’ সেই কবে স্কুলের পাঠ্যে এই লাইনটির ব্যাখ্যা লিখতে হতো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে এখন কৃষ্ণ-কবীর পংক্তিটির সঠিক মানে জানে! কিন্তু জানা আর মেনে চলা এক জিনিস না। সে জিন্নাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। – দেখা হয়েছে?

– জ্বী।

জিন্নাতের এই গুণটা মারাত্বক। খুব দ্রুত বুঝে ফেলে সবকিছু। কাজ করিয়ে আরাম ওকে নিয়ে। কিন্তু কি আর করা? তাদের লাইনে এটাই নিয়ম। সবাই সবকিছু খাবে না। যে সবকিছু খাবার লোভ করবে- তাকে সবাই খেয়ে নেবে। এও এ্রকধরনের অনার কিলিং। তুমি আমার লেজে পারা দেবার আগেই আমি তোমার মুড়ো ধরে ধড় ফেলে দেবো। যেনো এক অদৃশ্য টেরিটরি ভাগ করা আছে বনের পশুদের মতো। সেই ম্যাজিনো রেখা যদি কেউ অতিক্রম করে। সেজন্য দায় তাকেই পোহাতে হবে কড়ায় গন্ডায়। জিন্নাত সেটাই করেছে। ওর গলার ডানদিকে কল্পিত বুলেটের ছেঁদাটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কবীর, বিশ্বরূপ দেখার মতো। সাধে কি আর তাকে সবাই কৃষ্ণ ডাকে?

– স্বামীজী কথা বলতে চেয়েছিলেন… ধরে দেবো মিয়াভাই? বলে নিজের আল্ট্রাথিন মোবাইল বের করলো জিন্নাত।

– নাহ। এখন না। আমি যাবো ওঁর ওখানে…

জিন্নাত চুপ হয়ে গেলো। কোনো উৎসাহ দেখালো না। সে কবীরের ধাঁত জানে। তার চেয়েও বড় কথা, কবীরের কারণেই আজ তার যা যতোটা হয়েছে। লোকটির হাত কতটুকু লম্বা সেটা এখনো সে জানে না। তবে না জেনেও ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছে জিন্নাত। মোনাজাত উকিলের ভায়রাভাইয়ের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিল্ডিংব্লক সাপ্লাইয়ের কাজটা আগ বাড়িয়ে প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নিয়েছে। নোরাক্স দ্যু-অর কোম্পানির ত্রিশ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার দুবাইভিত্তিক আর একটি প্রতিষ্ঠান, যারা দেশে দেশে স্বর্ণের আকরিক খুঁজে বেড়ায়। শেয়ারের দাম বাড়াতে হলে কোম্পানির বাৎসরিক আয়ব্যয়ের হিসেবে নতুন নতুন অর্থলগ্নি আর কাজের বাস্তব ফিরিস্তি থাকতে হয়। দেখাতে হয়, কোম্পানি ন্যায্য ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠছে। স্বর্ণের খনি খোঁজা ওই কোম্পানিটি অধুনা কিছু হাইলি ক্লাসিফায়েড জিনিসপত্র সাপ্লাই দিচ্ছে বাংলাদেশে- যার স্লিপিং পার্টনার কবীর নিজে। কিন্তু জিনিসগুলোর কন্টেনার ভর্তি জাহাজ পতেঙ্গায় বসে আছে। অথচ খালাশের অনুমোদন আটকে দিয়েছেন মোনাজাত উকিলের ভায়রাভাই। এক ঢিলে তিন পাখি মারার জন্য কৃষ্ণ-করীর এখন এক অদ্ভুত নীলনকশা তৈরি করেছে! একহাত বল্লার বারোহাত শিং-এর মতোই। সে খুব ভালো করেই জানে, তার এই নকশা মোতাবেক কাজ হবে। আজ পর্যন্ত তার কোন পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়নি। বেশ কয়েক বছর পর, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক সুদর্শন গোয়েন্দা কর্মকর্তা যখন কৃষ্ণ-কবীরকে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে হালকা-জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক আলো-ঝলমল বিকেলে সদর দপ্তরে ডেকে পাঠাবেন তখন সে কল্পনায় দেখতে পাবে এই চৌকশ অফিসারটির পেছনে এক ভয়ার্ত বৃদ্ধার মুখ! কৃষ্ণ-কবীর জেনে যাবেন – বৃদ্ধাটির কোনোই অস্তিত্ব নেই তখন আর, তবু চৌকশ অফিসারটির ব্যাজহীন নিপাট ইউনিফর্মে বিকেলের রাঙারোদ ঠিকড়ে পড়া দেখে নিদারুণ পরিতাপ অনুভব করবেন। যা বিশ্বরূপ দেখার চেয়েও মারাত্মক।

ভবিষ্যতে জিজ্ঞাসাবাদকারী সেই পোড় খাওয়া সুদর্শন অফিসারটির সামনেই এখন তেড়ুয়া মোসাদ্দেক বসে আছে। ইতোমধ্যে কাহিনী অনেক বেড়াছেড়া হয়ে গেছে। তাকে বাসা থেকে তুলে আনা হয়েছে। এবং এখন তাকে এই মর্মে মুচলেকা দিতে হবে যে স্বয়ংকৃতচিত্তে জনমনে সংশয়সৃষ্টিকরতঃ পুরোবাসীর অহম আলোড়ন-উদ্দেশ্যে অমুক অমুকের প্ররোচনায় মোসাদ্দেক স্বীয় ধান্যক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগ করেছিলো!… বাড়ীর পেছনের জামরুল গাছের লাগোয়া ডোবাটার শীতশীত পানির নিচে গলা ডুবিয়ে বসে থাকতে মন চায় এখন মোসাদ্দেকের। তার খুবই জলতেষ্টা পায়। স্যার, হামার কিছুৎ উদ্দেশ্য নাছিলো বাহে। তোমরা দেখেন গিয়া হামার ক্ষেতোত্… সে বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কথা বললেই কি শোনার জন্য কানেরা প্রস্তুত থাকে?

* (এই পর্বের শিরোনাম জীবনানন্দ দাশের লেখা থেকে ধার করা)

watercolour, watercolor, paint

হিউম্যান রাইটস ওয়াচডগ নামে একটি বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সৌজন্য সাক্ষ্যাৎ করেছেন। তারা মোসাদ্দেকের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কাজে কাজেই মোসাদ্দেকের ষোলকলা আর পাকতে পারলো না।

পর্ব ৭: ওমভাঙা

এ বি এম আশরাফুজ্জামান লেবু তার ফিফটি সিসি ভ্যাসপা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা একটা দেখার দৃশ্যই বটে। বাইকের সিটে বসে সে ক্রনিক পাইলসের রোগীর মতো কোমর বেঁকিয়ে। মনে হয় যেনো ঝুলে আছে। শরীরের তুলনায় হাতদুটো একটু লম্বা হবার কারনে বাইক চালানোর সময় ওদুটো কনুইয়ের কাছে কিছুটা ভেতরের দিকে বাঁকা হয়ে থাকে। তার ওপরে মাশাল্লা তার বাইকের আওয়াজ নামকরা। দ্রুত ছুটতে পারুক না পারুক ফটফট শব্দে এলাকায় জানান দিয়ে যায়। পাশ দিয়ে গেলে কানে আঙুল চাপতে হয় প্রায়। সবমিলিয়ে লেবু একটা দেখার জিনিস! কিন্তু এখন তাকে দেখার মতো কেউ নেই। হাইওয়েতে লেবু একা চালাচ্ছে। রাস্তার দুধারে চাষের জমি সবুজ আর সবুজ। ধইঞ্চা আর কোষ্টা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেহাতি তরুনীর মতো। নীলফামারি পঞ্চগড় মহাসড়ক হয়ে তাকে আরো মাইল তিনেক যেয়ে আল্কির হাঁটে থামতে হবে। সেখানে দৈনিক গোধড়া বুলেটিনের স্থানীয় সংবাদদাতা কণক পাটোয়ারী অপেক্ষা করবে। কণকই তাকে নিয়ে যাবে শমসের আলীর বাড়ীতে। আবর মানুষ। কামলা খাটতো পরের বাড়ী। হঠাৎ কী হলো, পাটের আঁশ দিয়ে শমসের উদ্ভাবন করে ফেললো সিলিংফ্যান। সে কলের পাখায় বিদ্যুত খরচ নাকি প্রচলিতর চেয়ে দশভাগের একভাগ, বাতাসও নাকি তুলনামূলক বেশি ঠান্ডা। আহা। কতো দরদ দিয়ে রঙচঙ করে নিউজটা আজকে ধরাবে সে। পড়তে পড়তে পাঠক যেনো চাতকপাখির মতো ওই ফ্যানের বাতাসের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে, তাহলেই না নিউজের সার্থকতা! লেবু ঠিক করেছে, নিউজটাতে ইমোশনের লোশন লাগিয়ে দেবে। নিউজের ট্রিটমেন্টটাই মূল। স্থানীয় উদ্যোক্তা শব্দটি উল্লেখ করতে হবে নিউজে। পরিবেশ-বান্ধব কথাটাও থাকতে হবে। নবায়নযোগ্য কিংবা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী- এই কথাটাও অবশ্যই জোড় দিতে হবে। তার ওপরে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি শব্দবন্ধটি যদি টেনেটুনে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে আর কথা নেই। ডেভ ফিচারের সবগুলি বৈশিষ্ট্যই তাতে পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু সিলিং ফ্যানের সাথে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি কি করে মেলাবে সেটা নিয়ে লেবু বেশ একটু খটকায়ই পড়লো। চিন্তা করলে একটা উপায় নিশ্চয়ই বের হবে আশা করা যায়। কিন্তু চিন্তার হেলিকপ্টারটা টেকঅফ করার আগেই তাকে ব্রেক করতে হলো। মোবাইল বাজছে। বাইক সাইড করে ফোন বের করতে করতে কল কেটে গেলো। অচেনা নম্বর। কণক হয়তো দেরি দেখে রিং দিয়েছে। বাইকের ফটফটানি বন্ধ হওয়ায় শুনসান নিরবতা আর তার ফাঁকে ধইঞ্চার মগডালে ফিঙের পোকা ধরার কট্কট্ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কল ব্যাক করার সময় লেবু দেখলো টিএনটি নম্বর, ঢাকার। তার সারাশরীর নিমেষে শক্ত হয়ে গেলো। চট করে ফাঁকা রাস্তাতেও চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে সাবধানী দৃষ্টিতে। তারপর দুই মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড কথা বললো। আসলে শুনলো কেবল ওপাশের কণ্ঠস্বরের নির্দেশ। মাঝে মাঝে হুঁ দিলো। সন্ধ্যায় আপডেট জানাবে বলে ফোন রাখলো। মোবাইলসহ হাতের তালু ঘামছে এখন তার। যা শুনেছে তাতে তালু ঘামা খুবই মামুলি প্রতিক্রিয়া। অন্য কেউ শুনলে হাপুড় দিয়ে উঠতো হয়তো। লেবুর এখন আর ভেসপা চালানোর মতো অবস্থা নেই। সে কণক পাটোয়ারীকে রিং দিয়ে এসাইনমেন্টটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফিরতি পথে বাইক ঘোরালো। অনুভূতিকে তীব্রভাবে আহত করা স্পর্শকাতর একটি ছবি এখন তাকে সুপার ইম্পোজ করতে হবে। ফটোশপে বসে কাজটা করবে সে নিজেই। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ সোশাল মিডিয়ার নিউজফিডে আপলোড করবে কোনো একটি বিশেষ নামের ফেক আইডি ব্যবহার করে!

হাজেরা শামুক কাটছে। তার ষোলোটা ডিমের বারোটা ফুটিয়ে মুরগিটা হাঁসের ছানা পয়দা করেছে। উঠোনের এক কোণে একটা ছোট ডোবা কেটে তাতে ছানাগুলো ছাড়া হয়েছে। ওদের সৎমা কক্ কক্ করে ডোবার চারপাশে পায়চারী করছে! আহারে বেচারা। সিস্টেমে পড়ে বেকায়দায় আছে, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। এই মাতৃত্বর মহড়া তাকে চালিয়ে যেতে হবে ছানারা বড় হওয়া অব্দি। যতোদিন নিজেরা ধানক্ষেতে সাঁতরে ডুবে খাবার খুঁটে না খেতে পারে ততোদিন হাজেরাকেও এইভাবে শামুক কেটে ফালি করে দিতে হবে মায়ের আদরেই। মোসাদ্দেককে গতকাল সন্ধ্যায় ছেড়েছে। তার আগে একটানা সাতদিন তাকে বিভিন্ন স্থানে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছিলো। হয়তো তার চিহ্নও থাকতো না কোথাও। কিন্তু সোশাল মিডিয়া তাকে মূলধারা মিডিয়া থেকে বিস্মৃত হতে দেয়নি। কৌডিখাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা একটা ফেসবুক গ্রুপ খুলেছিলো ’আমরা সবাই মোসাদ্দেক- জাস্টিস ফর পুওর ফার্মার’ এই নামে। সেটায় আবার নাকি দেড়লাখ মেম্বার সারা দুনিয়া থেকে এ্যাড হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচডগ নামে একটি বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সৌজন্য সাক্ষ্যাৎ করেছেন। তারা মোসাদ্দেকের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কাজে কাজেই মোসাদ্দেকের ষোলকলা আর পাকতে পারলো না। কিন্তু মানুষটা বাসায় ফেরা অবধি গোম মেরে আছে। তা মোসাদ্দেককে কবেই বা লোকে হাসতে দেখেছে? সে তো এমনধারাই। আখাম্বা, জাঁহাবাজ, গোঁয়াড় যাকে বলে। কিন্তু কেমন যেন মিইয়ে গেছে। কথায় কথায় মাথা গরম করার তেজ এখন আর তার নেই। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে ঢিম ধরে বসে থাকে। নড়ে না। হাজেরা চিন্তায় পড়ে গেলো। লোকটাকে নাড়ানো দরকার। এই কদিন কোথায় ছিলো, কি খেয়েছে, মারধর করেছে কিনা কিছুই সে জানায়নি এখনো। জিজ্ঞেস করলে বিরবির করে, কিছু বোঝা যায় না। সকালে সালামভাই এসে জানিয়ে গেছে তাকে বিরাকের ’সুখতারা’ প্রকল্পের আওতায় হাজেরার নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর আওতায় দুই বান টিন, একটি গাইগরু এ্যাসেট ট্রান্সফার হবে প্রত্যেকের নামে। গরু কিনতে পারবে উপকারভোগী নিজে। হাজেরা ঠিক করেছে তেড়ুয়াকে সে সালামভাইয়ের সাথে পাঠাবে গরু কেনার সময়। কাজে থাকুক। একটা কিছুতে ব্যস্ত থাকলে হয়তো সে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারবে।…

হঠাৎ চিৎকার শুনে হাজেরা চমকে গেলো। হাঁসের একটা ছানা কাকে ছোঁ দিচ্ছিলো প্রায়, কিন্তু সৎমার জন্য পারেনি। গলার কাছে পালক ফুলিয়ে রণরঙ্গীনী মূর্তি ধরে কাকের দিকে ছুটছে ওমভাঙা মুরগিটা! 

(চলবে)

রূপালি পর্দা

১.
সামনের রিকসার পেছনে টিনের ব্যাকভিউতে হাতে আঁকা বেঢপ-বুক লাস্যময়ী নারী ভঙ্গীমাটা যে আসলে তারই প্রতিকৃতি আঁকার প্রচÐ প্রয়াশ- তা বুঝতে শাবলীনের বেশ সময় লাগলো। শুটিংয়ে যাবার এই সময়টা ঢাকা শহরের জ্যামে আটকে গত রাতের রাত জাগার ধকল আর অনেকখানি মানসিক চাপকে গোপন করতে করতে সে অনেকটাই হাঁফিয়ে উঠেছিলো বলে মাথাটা তেমন কাজ করছিলো না। সামনে ড্রাইভারের পাশ থেকে মনসুর- তার সেক্রেটারী- বুঝিবা রিক্সাগুলিকেই একটা গালি দিতে তার চমক ভাঙে। আর ভাঙে বলেই কচ্ছপের আচমকা শক্ত খোলসে নিজের কুৎসিৎ মাথা গুটিয়ে নেবার মতো গতরাতের এ্যাংজাইটিগুলি সে চট করে মুছে ফেলে এক ধরনের প্রশান্তির মেকাপে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বোরখায় মধ্যে যদিও কেউ তাকে দেখছে না, তবুও রীতিমতো অভ্যাস করে করে এহেন প্রশান্তি ও ¯িœগ্ধতা মাখা মুখভঙ্গী করতে পারা এখন তার মজ্জাগত। ফিল্ম লাইনের সেই শুরুর দিকেই যা তাকে রপ্ত করতে হয়েছিলো। আর সেটা পরিপূর্ণভাবে পারার কারণেই আাজ সে রূপালী পর্দার এক নন্বর আবেদনময়ী নায়িকায় পরিণত হতে পেরেছে। গোবরচাকার আকলিমা খাতুন এখন দর্শকহৃদয়ের ঘুম কেড়ে নেয়া নায়িকা শাবলিন!
কনি আঙ্কেলের হাতে পড়েই সে পাল্টে ফেলেছে- ফেলতে পেরেছে নিজেকে। আঙ্কেল, মানে বিশিষ্ট পরিচালক সাইদুর রহমান কনি তাকে দেখেই পছন্দ করেছিলেন- শাবলিনের মা তাকে পরে পাঠিয়েছিলো সাইদুরের ফ্ল্যাটে। অনেক অনেক ঘনিষ্ট হবার পর কনি আঙ্কেল ইস্কাটনের ঐ ফ্ল্যাটের সাড়ে পাঁচ সিএফটির ছোট্ট ফ্রিজ খুলে কনিয়াক বের করে দুটো গøাসে ঢালতে ঢালতে কথা দিয়েছিলো তার আগামী ছবিতে সাইড নায়িকার রোল দেবার। সেই প্রথম বারের মতো মদ খাওয়া। ঐ ছবিতে একটি ধর্ষণের দৃশ্যে তাকে উত্তেজক ভাবে এক্সপোজ করার পর প্রযোজক মঈনা পারভীন উৎসাহিত হয়ে পড়েন। লোকটার ভেতরের বিকৃতি শাবলীন বুঝতে পারার আগেই পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে যায়। তার মানে হলো ঐ সময়ের মধ্যে অন্য কোনো পরিচালক-প্রযোজকের ছবিতে সে সাইন করতে পারবে না। তাই শাবলীনকে আটকে থাকতে হয়েছিলো। পাঁচ বছর পর সে যখন সত্যি সত্যি ভালো পরিচালকের হাতে ভালো পারিশ্রমিকে কাজ করার জন্য সাইন করেছে- তখনই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো একটি তৃতীয় শ্রেণীর সিনে ম্যাগাজিনে তার পুরো নগ্ন ছবি ছাপা হয়। গতরাতে প্রথম ফোন করে মঈনা পারভীন। তারপর মনসুরকে পাঠিয়ে পত্রিকার এককাপি কিনে আনার পর নিজের প্রতিই তার রাগ হয়। মনসুর কোনো ঘটনা নয়। তার সব পাপ-অপাপ আর দুষ্কর্মের স্বাক্ষী এই মামাতো ভাইটিকে সে নিজের সেক্রেটারী বানিয়েছে। বয়সে বড় হলেও তাকে সে নাম ধরে ডাকে। সবার সামনেই দুর্ব্যবহার করে। কিন্তু এটাও ঠিক, ওর চরম দুর্দিনেও মনসুর তাকে ছেড়ে যাবে না। প্রেমের বড় বালাই। না হলে তার মতো নষ্টা একটা মেয়েকে কেউ এভাবে ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসবে না। মনসুর কখনো তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। তবু মনসুরের মনের কথা শাবলীন পড়তে পারে। আর পারে বলেই লোকটেেক মেরুদÐহীন মনে হয়। কাপুরুষ! রাগে সে চোয়াল শক্ত করে। নগ্নদেহ চিৎ করে শুইয়ে ওকে চুমু খাওয়া লোকটি যে এই সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেনীর- যারা বাংলা ছবির অশ্লীলতার কারণে হল-এ যাওয়া বন্ধ করে স্যাটারডেতে রেইনবো চ্যানেল খুলে বসা একজন- তা ঐ হিজড়ে পত্রিকাওয়ালারা বেমালুম চেপে গেছে। লোকটির নচ্ছার দাড়ি যা শাবলীনের নরম ফুটফুটে পেলব দেহে সুড়সুড়ি আর বিবমিষা তৈরি করছিলো- সে এখনো তা মনে করতে পারে- সেই মুখটা খুব দায়সাড়াভাবে কালো চিট মেরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মইনা পারভীন ফোনে কন্ট্রাক্ট করেছিলো লোকটার সাথে। শাবলীনকে যেতে হয়েছিলো দু পেগ মেরেই। একটা বিশেষ ক্যামিকেলের কার্গো তার ওষুধ কোম্পানীর জন্য অথরিটির অর্ডার না পেয়ে বাতিল হয়ে পোর্ট থেকে ফিরে যাচ্ছিলো। শাবলীন সেই বাতিল ক্যামিকেলের বাতিল হওয়া অর্ডার বাতিল করেছিলো- দুঘন্টার বিকৃত চাহিদা পূরণ করার পর। করে তার যে খুব অনুশোচনা হয়েছিলো- তা নয়। অনুশোচনা, পাপবোধ ইত্যাদিও স্তরকে অনেক আগেই পার করে এসে সে তখন দেশের এক নম্বর ‘ঘরের ল²ী’ নায়িকা হবার ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। ছবির কাহিনী তাকে ঘিরে বিকশিত হয় না আবার তাকে ছাড়া ছবিও হিট হয় না। ঐ সময়টায় শুরু হয় খুল্লাম খুল্লা যুগ। একদিকে উন্মুক্ত স্যাটেলাইট বিশ্ব- অপরদিকে দর্শকদের হল বিমূখতায় ইন্ডাস্ট্রীকে বাঁচাতে তার মতো অনেকেই বস্ত্র উন্মোচনে নেমেছিলো। কিন্তু শাবলীন ঠিক যেভাবে অল্পখানি দেখিয়েই ইশারা ঈংগিতে দর্শকের মাথার মধ্যে দপদপানি ঘটিয়ে ফেলতে পারতো- সেভাবে আর কেউ ততোটা পারেনি। তাই ছিলো সে ঘরের ল²ী। ইন্ডাস্ট্রীতে তাকে নিয়ে চলছিলো ব্যাপক গুঞ্জন। সিনে পত্রিকার গসিপ ইত্যাদি একজন রূপালি লাস্যময়ী নায়িকা হতে গেলে যা যা লাগে- সবই ঠিক ঠিক সময় মতো ক্লিক করে উঠতে- রাতারাতি সে সুপারস্টার! তার ‘রাতজাগা পাখি’ এতোই হিট করলো যে একটানা দেড়মাস সতেরটি জেলায় হাউজফুল চলেছিলো। গোবরচাকার আকলিমা খাতুন যখন ফ্ল্যাট গাড়ী বাড়ি আর বিভিন্ন মুখরোচক পত্রিকার প্রচ্ছদকন্যা হিসেবে নিজের অবস্থানকে শক্ত আর মঈনা পারভীনের কবল থেকে মুক্ত করে- আর খোলামেলা নয়, এবার সঠিক অভিনয় দক্ষতার দিকে মন দেবো- ভেবে শওকত ভূইয়ার ‘দেখো দুনিয়া’ ছবিতে রাকিবের বিপরীতে সাইন করেছে- তখনই ঐ ছবিটা ছাপা হয়ে গেলো…।
একটি বহুজাতিক সাবান কোম্পানী তাকে নিয়ে দেড়কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত একটি বিজ্ঞাপন চিত্র বর্তমানে এডিটিং টেবিলে আছে। পুনেতে গিয়ে তিনদিনে ঐ কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে শুতে হয়েছিলো তাকে। লোকটার হাতে কি যে এক যাদু, শাবলিন ধীরে ধীরে তপ্ত হয়ে উঠতো। আর তা এমন চরম অবস্থায় তাকে নিয়ে যেতো যে কোনো হিতাহিত জ্ঞান তার থাকতো না। এতো করেও কিন্তু বিজ্ঞাপনটি আগামী সপ্তাহে অন এয়ারে যাওয়ার কথা। তিনটি প্রাইভেট চ্যানেল আর দু দুটো সরকারী প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রথম একমাস নব্বই সেকেন্ডের এ্যাড যাবার কথা। ঈদের চাঙ্কে স্পেশাল স্পন্সরশিপ ছিলো পিটার ব্রাদার্স কোম্পানীর। জনপ্রিয় একজন কাট চলতি নাট্যকার যিনি নাকি মধ্যবিত্তদের ইমোশনকে পুঁজি করে খুব ভালো ভালো আকাশ সাহিত্য রচনা করে মোটা টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন ইদানিং, পিটার ব্রাদার্স তাকেই এবার সওয়ার হয়েছে। আর তাদের নতুন বানানো এ্যাডে আছে শাবলিনের মতো আর এক ললিপপ। কে আর পায় তাদের ? এই শেসনে তারা সত্তর কোটি টাকা মুনাফা করার ধান্দা করেছিলো। কিন্তু ঐ একটি পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়ায় সব বুঝি ভেস্তে গেলো। কিন্তু শাবলিন এতো ভাবছে কেনো ? তার তো এখানে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। আর এমন তো যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারতো। লুকানো ক্যামেরার কথা সে জানতো না। আর তাছাড়া নায়িকাদের নিয়ে এ ধরনের স্ক্যান্ড্রাল তো নতুন নয়। নিশ্চিত ভাবে এসব তার ক্যারিয়ারের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পনেরোটি ছবিতে ইতোমধ্যে সে সাইন করে ফেলেছে। প্রেস জানতে চাইলে সে এই সংখ্যটি দ্বিগুন করে বলে। প্রকৃতপক্ষে শুটিং চলছে অন্তত তিনটি ছবির। তার একটাও হিট করবে বলে মনে হয় না। যদি কাটপিস ঢোকানো হয় তবে অন্য কথা। কিন্তু যারা সাইনিং মানি দিয়ে রেখেছে কেবল, তারা হয়তো তাকে উইথড্র করবে। তাহলে আগামী বছর তার কোনো ছবি রিলিজ হবে না। আগামী বছর সুপারহিট ছবির তালিকায় একটাও না থাকলে পরের বছরও তার ছবির কন্ট্রাক্ট না পাওয়ারই কথা। এবং এভাবেই একজন নায়িকা তার রূপালী পর্দার জীবন থেকে আস্তে আস্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। ভাবতেই শাবলিনের ভেতর এক ধরনের কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। সে পারবে না। কিছুতেই না। যে নষ্ট আর অভাবের জীবন তার ছিলো একসময়- সেই জীবনে আবার যদি তাকে ফিরে যেতে হয় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু বেঁচে থাকার চরমানন্দ যে পেয়েছে, যে পেয়েছে সাফল্যের স্বাদ সে কি এতো সহজে সব নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিতে মনকে বোঝাতে পারে ? সে পারবে না। যে করেই হোক তাকে এই সমস্যা উতড়ে যেতে হবেই। যে কোনো মূল্যে। প্রয়োজনে যদি তাকে আরো দশজন প্রভাবশালী পুরুষের সাথে বিছানায় যেতে হয়- তাও সে যাবে। আর পুরুষ মানুষকে কিভাবে উত্তেজনার চরমে নিয়ে বাজে কাজের সম্মতি আদায় করাতে হয় তাতো শাবলিনের এখন মুখস্ত।

২.
সাংবাদিক সম্মেলনে গিয়ে আজ এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা হলো বখতিয়ারের। শালার দামড়া দামড়া পরিচালকদের কান্না দেখতে দেখতে তার ইচ্ছে করছিলো এদের কান ধরে টেনে এমন লম্বা করে দেয় যাতে গাধার কানকেও হার মেনে যায়। আজীবন বাঈজি নাচের মুদ্রায় যাবতীয় শৃঙ্গারদৃশ্যর নৃত্য দেখিয়ে কাটচলতি ছবি তৈরি করে আজ এমন পরহেজগার সেজেছে যে অশ্লীলতা বন্ধের করো এই স্লোগান তুলে মুখে রক্ত ওঠার পালা। জনৈক পরিচালক যিনি এদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে নতুন মুখ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে প্রবাদ পুরুষ হিসেবে নিজেকে গন্য করেন এবং ছুকড়ি ছুকড়ি নায়িকাপ্রতিম নারীমেশিনগুলি তাকে আবার রঙ্গ করে দাদু নামে সম্বোধন করে থাকে- তিনি একেবারে কেঁদে ফেলেন আরকি। অথচ এই লোকটিকে বখতিয়ার একবার মিনি সাক্ষ্যাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলো- বিশেষত নায়িকারাই কেবল আপনাকে দাদু বলে ডাকে কেনো। ব্যাটা ফিচেল হেসে চরম অশ্নীল ভঙ্গী করে বলেছিলো তারা আমাকে ভালোবাসে, আমি তো ওদের দাদুর বয়সীই তাই… কেনো ডাকে তা ঐসব মেয়েদের জিজ্ঞেস করুন না কাইন্ডলি। অথচ সেই সব নায়িকাদের মধ্যে যারা বছরের পর বছর ঘুরে ঘুরে কোনো ছবিতে কাস্ট না হয়ে কেবল দূর্নাম আর বিকৃত রুচির রাঘব বোয়ালদের রসদে পরিনত হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করেছে ইন্তেখাব দাদু তাদের ঠকিয়েছে। কেউ কেউ যারা এখন এক্সট্রা হিসেবে কাজ করছে তারা আরো স্পষ্ট করে জানিয়েছে তিনি তাদের ভোগ করেছেন বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে।… এই সবই বখতিয়ারের জানা। কিছুটা নিজের অভিজ্ঞতায় কিছুটা সিনে কাম সেক্স পত্রিকা ঘেঁটে । তার এক ভিডিও এডিটর বন্ধুর কাছ থেকেও অনেক তথ্য সে পেয়ে থাকে। কিন্তু এসব আর কাহাতক ভালো লাগে ? সে ঢাকাবাসী হয়েছিলো চারুকলার ছাত্রত্ব নিয়ে। টাকার অভাবে শেষমেষ পড়া হলো না। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে কিন্তু ইউনির্ভাসিটির ক্যাম্পাসকে আঁকড়ে ধরে সে তখন সারাদিন কবিতা আবৃত্তি করে বেড়াতো। তারপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে আজ সে একটি মধ্যম মানের সিনে ম্যাগাজিনের মধ্যম মানের ফিল্ম জার্নালিস্ট হিসেবে মধ্যম অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। তবুও মেজাজ মাঝে মাঝে বিগড়ে যায়। ইচ্ছে করে সব কিছু ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতে।

৩.
সম্ভবত এখন সন্ধ্যা। নমিতা তার অনুভূতি দিয়ে বুঝতে চাইছে। বাইরে কিসের যেনো কোলাহল ভেসে আসছে বলে সে এখন সম্ভাব্য কটা বাজে, ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। জানা যে খুব দরকার তা-ও না। দেখতে না পাওয়া একজন মানুষের কাছে রাত দিন এখন সমান। তবুও মনটা কি এক অস্বস্তিতে ভরে থাকে। দশ বছর আগে জীবনটা তার এমন ছিলো না। এসিড তাকে নিয়ে গেছে অন্য ভূবনে। যেখানে অন্ধকার আর অসহায়তার মাঝে সে বাস করছে। লোকলজ্জা লোকনিন্দা আর অন্যান্য গঞ্জনাকে পাশ কাটিয়ে আজ সে নিভৃতচারী। আজকেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর একটি বহুজাতিক কোম্পানীর যৌথ স্পন্সরশীপের কল্যাণে এসিডদগ্ধ মেয়েদের নিয়ে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নমিতা সে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ কার্ড পেয়েছে কিন্তু সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি মন থেকে। এখন আর এসবের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করে না। আহত হবার প্রথম দিকে খুব ইচ্ছে করতো প্রতিবাদ করতে। তখন সে তার অক্ষমতাকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু এখন সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর এইসব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের ভেতরের অনেক ব্যাপার সে কিছু কিছু জানতে পারার কারণে এখন আর উৎসাহ বোধ করে না। সব কিছুর মধ্যে এক ধরনের অন্তঃসারশূণ্যতা টের পায় বলে নমিতা এখন গা করেনা অনেক কিছুতেই।
পায়ের কাছে পানির ফোটা পড়তে তাকে গা করতে হলো। বৃষ্টি আসছে হয়তো। উঠে জানালাটা বন্ধ করা দরকার। সে যেখানে আছে, এটা একটা ডরমিটরি। একটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রীদের পড়ার স্কুল ও হোস্টেল। এই স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা সবাই দেখতে পায়। কেবল সে ছাড়া। তাকে রাখা হয়েছে সাইন বোর্ড হিসেবে। নমিতা খুব ভালো করেই জানে তাকে কিভাবে মানুষ ব্যবহার করছে। করেছে। কু প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার কারণে তাকে এসিডদগ্ধ হতে হয়েছিলো। লোকটা ছিলো অন্য ধর্মের আর পেশায় ছিলো পুলিশের হাবিলদার। সহ্য হয়নি হিন্দু ঘরের একটি মেয়ে এতো সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাবে। শিক্ষিত হবে। প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব। নমিতাকে। তারপর ব্যর্থ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি পরিবারের কাছে। অতঃপর তাতেও ব্যর্থ হয়ে একদম কুত্তা হয়ে উঠেছিলো লোকটা। তারপর একদিন সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরছিলো বান্ধবীর বাসা থেকে, তখন কুপ্রস্তাব এবং তুলে নিয়ে যাবার হুমকি। নমিতা মাস খানেক বাসা থেকে বেরুতো না। অবশেষে তাকে বেরুতে হয়েছিলো। এস এস সি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। প্রথম কদিন মা বাবা মামা, মেজদির পাহারায় সে স্কুলে গিয়েছে পরীক্ষা দিতে। তারপর একদিন বিকেলে পরীক্ষা ছিলো। মামা সেদিন ফার্মেসীতে। বাবা স্কুলে আগেই চলে গেছেন প্রশ্নপত্র ডিস্ট্রিবিউট করতে। মা মাইগ্রেনের ব্যাথায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। মেজদিকে জামাই বাবুর দিকের কে একজন মারা যাওয়ায় অশৌচ পালন করতে নিয়ে গেছে। ফেরার কথা আগামী কাল। নমিতা একাই সেদিন রওয়ানা দিয়েছিলো হলে। ধর্ম পরীক্ষা ছিলো সেদিন। ভোরবেলা থেকেই তার একটু অন্যরকম লাগছিলো। গতরাতে মা দূর্গার তৃতীয় নয়ন সে স্বপ্নে দেখেছে। ভোররাতে উঠে দেখে শরীর খারাপ শুরু হয়েছে। ইশ্ কী লজ্জা। এখনো সে ব্যাপারটাতে তেমন অভ্যস্ত হতে পারেনি। তার উপরে আজ ধর্ম পরীক্ষা। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে করতে সে ভাত খেলো। মা ঐ শরীর নিয়ে একবার আসতে চেয়েছিলো। নমিতাই তাকে মানা করলো। এই রোদে বেরুলে তার মাথা আরও ধরবে বলে। বাসা থেকে কিছুদূর যেয়েই তার মনে হলো কি যেনো একটা ভুলে আনা হয়নি সাথে। কিন্তু সেটা কি, তা মনে পড়ছে না। আর সূর্যটাও আজ যেনো বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে গনগনে কয়লা কেউ ঢেলে দিচেছ মাথার ওপর। কটা বাজে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলো তাড়াহুড়োয় হাতঘড়িটা আনা হয়নি। স্কুলের কাছে আসতেই সে পরীক্ষা শুরুর ঘন্টা শুনতে পেলো। এইরে,পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে গেছে। বাইরে কোন মানুষজনকে দেখা যাচেছ না। তড়িঘড়ি পা চালিয়ে উত্তাপ আর গরম উপেক্ষা করে সে এগোতে লাগলো। ছ্যাৎ করে তার বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলো যখন দেখলো ঐ বাজে লোকটা তার দিকে হনহন করে এগিয়ে আসছে। এখন তার হাঁটার মধ্যে কোন সংকোচ কাজ করছে না। অথচ এলাকার সালিশে ব্যাটা একদম মেকুর হয়ে ছিলো সেদিন। এতো সব ভাবনাকে গোছানোরও সুযোগ পেলোনা নমিতা। লোকটা তার হাতচারেক সামনে এসে একদম ঠান্ডা গলায় বিষ মিশিয়ে খিস্তি করে বললো- র্ম মালাউনের বাচ্চা ! সূর্যটা ঝট্ করে একদম নিচে নেমে এলো তারপর। আর তার উত্তাপে ঝলসে গেলো নমিতার নাক, মুখ, গলা, হাত… উহ্ মাগো, কুত্তার বাচ্চা আমাকে খুন করে ফেললো মা! তারপর তার আর কিছু মনে নেই। (অসমাপ্ত)

নমিতা হালদারকে ১৯৯৯ সালে যেমন দেখেছিলাম!