গল্প

আমি আবার আসবো

মেসেঞ্জারের আননোন মেসেজটা কবে থেকে জমা হয়ে ছিলো কে জানে। রূপ  সেটা ডিলিট করতে গিয়ে ভ্রূ কোঁচকালো। একটা ছবি, বেশ পুরোনো এবং ঝাপসা। দেখে মনে হচ্ছে সেকালের অটোমেটেড ক্যামেরায় তোলা। চারদিক রাউন্ডকাট করা ছবিটা মনে হয় দীর্ঘদিন সস্তা এ্যালবামে বন্দী ছিলো। কেউ সেটার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। তিনজনকে দেখা যাচ্ছে ছবিতে। তিনটা ছেলে, বয়স গোঁফ ওঠার আগে আগের। একজনের মাথায় হ্যাট। গলায় হাত দিয়ে একে অন্যকে ধরে আছে। একটা পুরোনো দালানের সামনে দাড়ানো তিনজন। ড়ানদিকে একটা তালগাছ তার অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। তিনটা মুখ দেখার জন্য রূপ ছবিটা বড় করলো। দেখলো। দুুজন অপরিচিত। তৃতীয়জনও। কিন্তু তার বুকটা ধ্বক করে উঠলো এজন্য, কারণ তৃতীয় ব্যক্তিটি সে নিজে!
এটা কিভাবে হয়? অবিকল তার মতো দেখতে মুখটা, তাও আবার একটা ছেলে। রূপ টের পেলো তার হাত কাঁপছে। আর কোনো ক্লু আছে কিনা দেখতে সে মেসেজের প্রোফাইল এ্যাড্রেসটা দেখলো। উদাসিন পথিক। বোঝাই যাচ্ছে ফেক আইডি।…  কে হতে পারে?

ছবিটা কোথায় কখন তোলা সে বুজতে পারছে না। এমন কোন ছবি সে তুলেছে বলে মনে পড়ছে না। সবচে বড় কথা ছবির ওই মুখটা একটা ছেলের। কিন্তু অবিকল তারই মতো দেখতে। এমনকি চোখের কাজলও তারই মতো। রূপের মাথা ঝিমঝিম করছে। একটা ফোন নম্বর দেয়া আছে ছবির নিচে। যেটা সে খেয়ালই করেনি এতক্ষণ। কিন্তু নম্বরটা টি এনটির মনে হচ্ছে। এই রাতে কি করা উচিত হবে? করে দেখবে নাকি? ভাবতে ভাবতে রূপ মোবাইল রেখে বাথরুমে ঢুকলো ব্রাশ করতে। আয়নায় নিজেকে দেখলো খুটিয়ে। বয়সের ছাট পড়ে যাচ্ছে কী? চোখের পাশে ক্লান্তির কালো র্ং। হবারই কথা। ওই ছবির মুখটার মতো ছিপছিপে একদিন সে ছিলো। হয়তো এখনো কিছুটা আছে। কিন্তু অমন ছেলেদের শার্টপ্যান্ট পড়ে গলাগলি বেধে ছবি তোলার ঘটনা তার জীবনে ঘটেনি শিওর।

তাহলে কে? আর বেছে বেছে উদাসীন পথিক তাকে এটা পাঠালো কী করে? কোন কূল কিনারা করতে না পেরে সে চিন্তাটা বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। আর তখনই তার যে কথাটা মনে পড়লো, সেটা শরীরের রক্ত জমাট বাধার জন্য যথেষ্ট!

ছবিটা ভাইয়ার। মানে মাঝের ওই পরিচিত মুখটা আসলে সে নয়, তার বড়ভাই আফজালের। মানে মনি র। মনি পড়তো ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা তখনকার কোন শিক্ষা সফরের হবে হয়তো। ছোটবেলায় সে নাকি দেখতে রূপের মতোই ছিলো। মেয়েলি ভাব ছিলো ভাইয়ার। তাকে কারা যেনো মেরে ফেলেছিলো। কিংবা সেটা আত্মহত্যা। পুলিশ যা বলেছে। ভাইয়ার কি জানি সমস্যা ছিলো। রূপ তখন অনেক ছোট। ভাইয়াকে তার মনেও নেই ভালো করে। রেললাইনের ধারে তার লাশ পাওয়া গেছিলো, ক্ষতবিক্ষত। চেহারা চেনা যাচ্ছিলো না। কেডস দেখে শনাক্ত করে পোস্টমর্টেম ছাড়াই কবর দেয়া হয়। রুপ এসব বড় হয়ে জেনেছে।

বিছানায় শুতে গিয়ে সাহস করে সে ওই নম্বরটায় কল দিয়ে ফেললো। তিনবার রিং হবার আগেই কে যেনো ধরলো। তারপর ফোপানির আওয়াজ শুনতে পেলো রূপ। কে কাদছে? কলটা কেটে পি পি করতে লাগলো কিছুক্ষণ। সে রাতে রূপ আর ঘুমোতে পারলো না।

(অসমাপ্ত)

পুুনর্ভব

মৃত্যুর আগে এহেন অবস্থায় আকলিমাকে যখন তার স্বামী তাড়িয়েই দিলো তখন গোটাকয় কাপড় চোপড় আর টুকটাক দু একটা নেয়ার মতো জিনিষের পুটুলি আর সমিতির টাকায় কেনা ডিমপাড়া হোলামুরগীটা সহ আকলিমা এখন মাওয়াঘাটের এককোণে গুড়িসুড়ি হয়ে বসে আছে। মুন্সিগঞ্জের বোতলভাঙ্গা গ্রাম থেকে তার যাত্রা এখন বাপের বাড়ি শরীয়তপুরের ফাতরা গ্রামে। যায়গাটা ডাকাতের আস্তানা বলে বয়স না হতেই তার বাপ কাঠমিস্ত্রি মনিবুরের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো। বিয়ে দিলো যাতে নিজে আর একটা বিয়ে করতে পারে সেই উসিলায়। আকলিমা তের বছর পেরিয়ে এখন উনিশ।

এ কয় বছরে তার বয়সই বেড়েছে কেবল, বুদ্ধি বাড়েনি। ফলে শ্বশুরবাড়িতে সবাই যেমন আশা করেছিলো সে হলো তার বিপরীত। ফলে বৌয়ের খড়ম পা, সাপলেজি চুল আর শামুকভাঙা চোখ ইত্যাদি ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি তার বাপ নাকি কুড়িহাজার টাকা কুবলিয়েছিলো বিয়ের আগে মনিবুরকে দেবে বলে। সেটা না পেলে মনিবুর যে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে না, এমন শর্ত কোথাও লেখা নেই। কাজে কাজেই আকলিমার কোন সন্তান নেই আকলিমা ঘড়ামীর কষ্ট বোঝেনা আকলিমা ভাত পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলে বলে আকলিমাকে নিজেই পুড়ে কয়লা বনে যেতে হবে এমন একটি সর্বজনস্বীকৃত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সে যদি তা হতে না চায়, সে যদি দাঁ হাতে রুখে দাঁঁড়ায়, তাহলে তালাক দেয়ার চেয়ে আরও বেশি শাস্তিদায়ক হলো বাপের বাড়িতে খেদিয়ে দেয়া। নাহ তালাক দেয়ার এখন অনেক ঝামেলা। কোর্টের বারান্দায় ঠায় বসে থাকারও জো নেই, মাঝে মাঝে পুলিশ এসে সিঁড়ি কিলিয়ার করেন! বলে লাঠি হাতে অপমান করে। কালাকোট ম্যানেজ করা, তালাকের কারণ ব্যাখ্যা করা, স্বাক্ষী আনো, এভিডেন্স আনো হাজারটা নখড়া! এনজিওর লোকেরা থাকে তক্কে তক্কে। পারিবারিক আইনে মামলা ঠুকে দেবে। আচ্ছা, এই পারিবারিক আইন পরিবার ছেড়ে কোর্টে চালান হলো কি করে, ভাবে মনিবুর। তারচেয়ে সুবিধাজনক হলো বিনা আয়োজনে খেদিয়ে দেয়া, বা গুম করে দেয়া। তা দ্বিতীয়টা করতে হলে যেরকম কলজের জোড় লাগে মনিবুরের তা নেই। আকলিমা তাই এখন ফেরিঘাটের যেখান থেকে লঞ্চ ছাড়ার কথা সেই ঘাটের পাশটায় বসে আছে। তার এ অবস্থায় বড় সমস্যা হলো ঘাট-টিকিট না দিয়ে লঞ্চে চড়ে বসতে পারা। তার কাছে টাকা নেই তা নয়। কিন্তু বিনাটোলে ঘাটটা পার না হওয়া একধরনের বাজে খরচ আকলিমার কাছে। গতকাল সমিতি থেকে সে আরও একটা কিস্তি নিয়ে এসেছে। আঠেরশ বত্রিশ টাকা সর্বসাকুল্যে। বাপের বাড়ীতে এই টাকা তার অবস্থান পোক্ত করবে অবশ্যই। আর ডিমপাড়া হোলামুরগীটা দেখলে তার বাপের ঘরের নতুন বউটা তাকে একেবারে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে পারবে না।

লঞ্চ একটার পর একটা ছেড়ে যাচ্ছে। লোকজন গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে লঞ্চের তলপেটে। নামে লঞ্চ হলেও এটা আসলে কাঠবডি ইঞ্জিন। চল্টা উঠে যাওয়া সাদা রঙের মাঝে নিল লতাপাতাফুলের পাড় আঁকা শরীরে দোয়া ইউনুস খোদিত খুপড়ি কেবিন আর নীচে গলুয়ের নাকের পাশে লালে লেখা এম ভি হাতেম লঞ্চটা ভরপেট যাত্রী নিয়ে এই হেলানো দুপুরে মনে হচ্ছে পান চিবোচ্ছে আয়েশে। কালো হোৎকা চেহারার টিকিট কালেকটরের খুপড়িতে এখন বেশ ভীড়। এই সুযোগে আকলিমা- বুদ্ধি যতো ভোঁতাই হোক না কেনো- সেঁদিয়ে যাবে; গেলোও। তার যায়গা হলো ইঞ্জিনের পাশে তেলকালিমাখা প্রচÐ উত্তাপ আর বাজখাই শব্দশঙ্কুল এক কুনছিতে। তারপর লোক আরও লোক আর লোক আর মেলা লোকের ভীড়ে লঞ্চের খোলটা যখন দমাস করে ফেটে যাবার অবস্থা তখন সুকানীকে দেখা গেলো কাঠের সিঁড়ির দরজায়। এসেই সে বয়ান দিলো, চাইপা বহেন আর একটু চাইপা বহেন, সবারই যাইতে হইবো এতো ফাঁকা থাকলে চলবো কেমতে, চাপেন না বাই! ওই বানচোদ তোর কোন বাপের কোলে চাইপা বমুরে হৌরের পো বলে প্রতিউত্তর এলে সে তেমন গা না করে ইঞ্জিনের বগলে সেঁদিয়ে যায়। আর তার ঈঙ্গিতে শুঁটকোমত গোঁফ না ওঠা ছেলেটা বেদম ঘোরাতে থাকে শ্যালো মেশিনের চাকাটা। এই লঞ্চটা কারিগরী প্রকৌশলী ব্যবস্থার একটি চমৎকার ফিউশন। জলযান তথা যাবতীয় যানবাহনের কিছু না কিছু পার্টস এখানে সংযোজিত আছে। সেই লঞ্চ যে তাহার ধারণক্ষমতার পাঁচগুণ যাত্রীসাধারণ নিয়ে পদ্মা পাড়ি দেবেই দেবে তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু ষাটনলের মোচড়ে পড়ে হুদাহুদি ডুবে না গেলে পদার্থবিদ্যার সুত্রের সাথে বেজায় বেয়াদপি হয়ে যেতো বলেই এমভি হাতেম অবশেষে ডুবে গেলো। এবং ডুবে একেবারে তলিয়ে গেলো। জনা পাচেক যারা পেরেছে সাঁতারের চেষ্টা করেছিলো অবশ্য কিন্তু চোরা¯্রােত তাদের কোথায় ভাসিয়ে নিলো? অবশেষে আকলিমা খাতুন তার ডিমপাড়া হোলামুরগীটা সহ আটশোযাত্রীর এই ঈদোদযাপন সেযাত্রা পুরো ঈদের ছুটিটাকেই টিভির লাইভ রেসকিউ অপারেশনে বন্দী করে ফেললো। যে সকল বহুজাতিক টয়লেট্রিজ এতো দাম হাঁকিয়ে ঈদের গতরভারী চাঙ্কগুলি কিনেছিলো তারা এখন দেনদরবার করছে লাইভ রেসকিউর ফুটেজ কিনতে। সেনাবাহিনী এই উদ্ধার তৎপরতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুর্যোগমস্ত্রী তার কনন্সটিটিউয়েন্সিতে রয়েছেন একটি কলেজে কম্পিউটর সেকশন উদ্বোধনের কাজে। তিনি একজন দায়িত্বপ্রবণ ব্যক্তি, উদ্বোধনটা শেষ না করে তিনি এ অবস্থায় আসেন কী করে!

তো এহেন ডামাডোলের ভেতর উদ্ধারকাজ অসমাপ্ত রাখতে হলো তীব্র ¯্রােতের দাপটে টিকতে না পেরে। উদ্ধারকারী জাহাজ বখতিয়ার এখনো পথে। সেটা এলে পুুনরায় আবার শুরু হবে বলে ল্ইাভে জানানো হয়েছে কিন্তু তারপরও পাবলিক অকুস্থল ভীড় করে আছে। অন্তত সাড়ে পাঁচশো যাত্রী (সংখ্যা কখনো মেলেনা এ জগতে। কমবেশি তো হতেই পারে! আর তাছাড়া যাহা বাহান্ন তাহা বিরানব্বইও বটে!) নিয়ে- যার অধিকাংশই নিম্মবিত্তের- লঞ্চটা এখনো নিখোঁজ রয়েছে। যেখানে ডুবেছে সেখানে তার টিকিটিই নেই। পদ্মার ওই অংশে গভীর খাত। চোরা¯্রােত গুমড়ে উঠছে খালি। ডুবুড়িদের ডুব দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আটচল্লিশ ঘন্টা পর বখতিয়ার এলো। সাথে এলো বিআইডবিøউটিসির টো বোট, হার্নেস ঝোলানো আকাশচুম্বী ক্রেনসহ। কভারওল পড়া একদল চৌকশ ডুবুরীদল প্রথমেই ডিজিটাল লোকেটর দিয়ে লঞ্চটার ডিজিটাল সাবমারসিবল ইমেজিং করতে লেগে গেলো। কাজটা সহজ, কিন্তু এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সেটা যথেষ্ট ঝামেলাই তৈরী করলো। কারণ নদীর ওই একই স্থানে একটি ইমারতের অস্তিত্ব টেকনিশিয়ানরা খুঁজে পেলেন। সেটি নাকি সুলতানী আমলের। ভাবো?

(চলবে)

শ্বেতবামন

১.

পোলার বিয়ারের অন্তর্ধানের সাথে সাথে পোলার আইসক্যাপও যে শুন্যে মিলিয়ে যাবে, তা থিংকট্যাঙ্করা জানতো সেই কোভিদ যুগের সীমানা থেকেই। এখন সেখানে খাঁখাঁ অন্ধকারের মতো জমাট বাষ্প খেলা করে, আর ঘনগভীর গিরিখাতের অন্তিম অভিঘাতে শিরশিরে প্রস্রবণের ঋঋ ছন্দ তোলে! আলোচ্য গল্পের সেখানেই শুরু।

আজ মানুষ তার অস্তিত্ত্বকে সহজসাধ্য করতে অবশেষে পরিবেশের অপার্থিব মূল্য বুঝতে শিখেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে পানির ট্যাঙ্কের পাশাপাশি আইসস্লট রয়েছে। ঘাবড়াবেন না, আইসস্লট এমন হাতিঘোড়া কিছুই না। পোলার আইস শুকিয়ে যাবার পর সেন্ট্রাল ডিফেন্স স্টক থেকে এক সিও (সেন্ট্রাল অর্ডার) জারি করা হয়েছে, যাতে নির্ধারিত আকারে প্রতিটি বাড়ির মাচায় একটি করে বরফ-ছাদ তৈরি থাকে।

এটা এখন বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রযুক্তি আজ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে তাতে উষ্ণ-শীতল প্রকৃতি নির্বিশেষ এই আইসস্লট স্থাপন তেমন কঠিন কিছু নয়। যখন বা যেদিন যেদিন সূর্য ওঠে, তার উত্তাপেও এই বরফ গলে পড়ে না। ফলত, মেরুতুষারের বিকল্প হিসেবে এটা পৃথিবীকে পার্থিব উষ্ণায়ন থেকে বিরত রাখছে। তাছাড়া বরফের ওমন সুন্দর একটা স্ল্যাব থাকায় ইমারতগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখনসই হয়েছে। আপনাদের মধ্যে কারো কারো অরিয়েন্টাল স্থাপত্যকলার প্রতি অনুরাগ থাকতেই পারে, কিন্তু একথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, আমরা একটি ন্যানোউৎকর্ষময় শহুরেসভ্যতায় প্রবেশ করেছি। তৎকালীন হলিউডি বলিউডি তামিল তারাজু এমন কোনো উৎপটাং কল্পনা নেই, যা বর্তমানে অপ্রতুল! বুজতে পারছি, এসব শুনে আপনার মনে একবিংশ শতকের মানুষের বাচ্চার মতো এন্তার কথাপ্রশ্ন খাবি খাচ্ছে, তাইতো?…. আরে বাবা উৎকর্ষের কোন্ স্তরে বাস করছি আমরা, ভাবতে পারেন? একে বলে প্লাস্টিক-শেসন! যার বাঙলা করলে দাঁড়ায় প্রাচ্য-গলিত-পশু-শাসন! বুজলেন এবার? মানেটা একটু খটোমটো হলেও এর কোন্ কোন্ অবদানকে অতঃপর তোমরা অস্বীকার করবে? চুলো জ্বালার বালাই নেই, ঘুমানোর জন্য আলাদা বালিশ-বিছানা-সময় কোনোটাই লাগেনা, কাজ করতে করতে, চোখ খোলা রেখেই যখন তখন মানুষ ঘন্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারে। এহেন বাইপোলার শক্তিসঞ্চয়ের জন্য পোলার বিয়ার ত্যাগ করা তো মামুলী ব্যাপার। সেকালে এসব আদিখ্যেতাকে ‘সোশালভ্যালু’ নামে ডাকা হতো। প্রকৃতি তখন ছিলো নগরজীবন বহির্ভুত ছিনাল স্বভাবের। যখন ইচ্ছা কালবৈশাখী, যখন ইচ্ছা মৃদুমন্দ, যখন ইচ্ছা টিনের চালে রিমঝিম– এসব এখন চলবে না চাঁদু!

অরণ্যশঙ্কুল জনগোষ্ঠীকে কেনো কে জানে তখন ‘আদি’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু অধুনা এই প্রাচ্য-গলিত শাসন ব্যবস্থায় বৃক্ষ একটি অতি ঘনিষ্ট উপকরণ হিসেবে সাব্যস্ত। প্রতিটি যৌথযাপনের (=পরিবারের) জন্য বৃক্ষপালন বাধ্যতামূলক। বলতে পারেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি আহরণের এর চেয়ে সমীচীন পথ আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, বৃক্ষভেদে অম্লজানের তীব্রতা, গভীরতা বিভিন্ন হয়। ফলে, তার ভেদবিদ্যা যেমন সমাদৃত, তেমনি অবশিষ্ট প্রতিটি বৃক্ষ এখন গৃহদেবতার সম্পদ। পাতলা, কিন্তু অভঙ্গুর কাঁচের এ্যাকুরিয়াম-সদৃশ্য বিশাল বিশাল জারে আচ্ছাদিত প্রতিটি বৃক্ষ এখন দ্বারে দ্বারে সুশোভিত। চাইলেই বেলীফুলের সুবাস এখন সুলভ্য নয়। ওই কাঁচের জারের ভেতরে যে অম্লজান বিশ্লিষ্ট হয়- প্রতিটি যৌথযাপন তা দিয়ে প্রতিদিনকার নিঃশ্বাস নেয়ার পরেও বাড়তি অম্লজান পাঠিয়ে দেয় আমাজনে! আরে না না, ওই আমাজন নয়- যেটা পুড়ে ফসিল হয়ে গেছে! এ হলো একবিংশ শতকে উদ্ভাবিত সেই অনলাইন শপিং ব্যবস্থা, যা আজও টিকে আছে। ঘর সাজাবার রাবুত থেকে শুরু করে লেটেস্ট ডিজাইনের ইরাকুস, সবই এখানে বিকোয়। তবে ঘনীকৃত অম্লজানের চাহিদার যে ডিমান্ড, তা পুরো মকরক্রান্তি জুড়েই প্রবল। তাই আমাজান সুযোগটা লুফে নিয়েছে। তাই শুনে জ্যাকবাবা অবশ্য ঘোষণা দিয়েছেন, শীঘ্রই তিনি সুপ্ত-সূর্যালোক বা স্লিপিং-সানলাইট বাজারে আনছেন!

আমাদের গোত্রের পিকো আঙ্কেল অবশ্য জ্যাকবাবার এইসব ছেঁদো কথায় খুব একটা আস্থা রাখেন না, কারণ এর আগেও তিনি এক রেঙ্গুন-রূপসীর সাথে যৌথযাপনের প্রাক্কালে প্যাকেটজাত চাঁদের আলো বাজারজাতের বারফট্টাই করেছিলেন। কিন্তু চাঁদের আলো তো দূরের কথা, একথোকা মরিচবাতিও তিনি বাজারে আনতে পারেন নি। কামারশালার এককোণে যে এলসিডি ডিসপ্লে- যা পিকো আঙ্কেল তথাকথিত ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনে চালু করেছেন – ছাতারে পাখীর ডাক নকলের উদ্দেশ্যে- সেটায় সেন্ট্রাল বুলেটিন দেখানো শুরু হতেই পিকো আঙ্কেলের মেজাজ চড়ে যায়। জ্যাকবাবার উদ্দেশ্যে সেই পুরাতন মুখখিস্তি করা অশ্রাব্য গালিটির পুনরাবৃত্তি করে পিকো আঙ্কেল তার সর্বক্ষণ কোমড়ে গোঁজা ত্যানানো মুড়ি চিবোতে চিবোতে গান ধরেন।

২.

কামারশালাকে যারা রাজনৈতিক আলোচনার আখড়া বলে মনে করেন, পিকো আংকেলের কাছে ম্যাড়ম্যাড়ে সন্ধ্যাগুলিতে তারা ভীড় করেন। গনগনে আগুন, হাপড়ের হা, নেহাইয়ে উপর্যুপরি হাতুড়ির ফুলকিতোলা ঢঢক্কার, আর জ্বলন্ত কাঠকয়লার ভেতর গলা ডুবিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা আধা আকৃতি নেয়া আদিম আয়ুধসমূহ– এসব তাদের কতোটা আন্দোলিত করে, তা বলা মুশকিল। আগুনের কাঁপা আলো কামারশালার আস্তরহীন দেয়ালে কিম্ভূত আবছায়া হয়ে দুলতে থাকে – মনে হয় গুহাচিত্রের চলমান ছায়াছবি! প্রত্যেকের শরীরে সংযোজিত কিছু না কিছু প্লাস্টিক প্রত্যঙ্গের কারণে ভীড়েরা আগুনের খুব বেশি কাছে ভীড়তে পারেনা। বহুভাষাবিদ ডঃ রিবেন দাশুড়া প্রমুখ এই সমাজব্যবস্থাকে “প্লাস্টিসিয়ান” বলে অভিহিত করেছেন। সেই মত অবশ্য পলিকার্বনেশিয়ানরা বাতিল করে দিয়েছেন। সে যা-ই হোক, একটা কথা সকলেই সম্মত হয়েছেন, “কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো প্রতিরোধ!” বলে বলে ফাঁকতালে এই জেনারেশনের কেউ গোলা খালি করতে পারবে না! এর পেছনে মনোসামাজিক দুর্বৃত্তায়ণকেই অনেকে ইন্ধন মনে করছেন। অবশ্য সম্পত্তি বেহাত বা চুরি হবার কনসেপ্টটাই এই প্রজন্মের কাছে বাহুল্য। এককালে পুরো দ্রাঘিমাজুড়ে যে তস্কর-বেষ্টনী তৈরি হয়েছিলো, আজ তা শুন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। এটা সম্ভব হয়েছে আধ্যাত্ব থেকে সত্ত্বার মুক্তির কারণে। দিনে দুবার ‘তাফালিং’ বেজে উঠলে সর্বসাধারণ তাদের পাথরের চোখ, হীরের নকল দাঁত আর ক্ষয়ে যাওয়া করোটি প্লাটিনাম হেলমেটের মতো খুলে রেখে নিষ্কাম সত্ত্বার পরাকাষ্ঠা হিসেবে নিয়মিত গড় করতেন। পিকো আঙ্কেল সেসব মনে করে ত্যানানো মুড়ি চিবোতে চিবোতে হাসেন। এককালে গোত্রে কোনো বৃক্ষের মৃত্যু হলে তারা শোকরাষ্ট্র করতেন। এর মানে হলো- পতিত বৃক্ষের পাশে পুঞ্জীভূত হয়ে নিরব অশ্রুমোচন। এমনকি বৃক্ষালিঙ্গন তাদের প্রধান উৎসব বলে সেসময়ে বিবেচিত হতো। আর আজ এই স্মার্ট কস্টিক-সভ্যতায়– পিকো আঙ্কেলের বিভিন্ন অসাংস্কৃতিক উপায়ে উপার্জনের পাশাপাশি রয়েছে বিস্তর আলিজালি বিষয়ে কৌতুহল ও পাণ্ডিত্য! অবশ্য খিস্তিখেউড়কে যদি তুমি পাণ্ডিত্য বলে স্বীকার করো, তবেই! তো প্রতিদিনকার রুটিনবিহীন এজেন্ডা হিসেবে তিনি অতঃপর উপস্থিত কামিনাহারামিদের উদ্দেশ্যে ভাগাড় থেকে উদ্ধারিত তার সাইলেজ ফটোট্যাবের মেমরিব্যাঙ্ক ওপেনকরতঃ বিংশ শতকের একখানি পয়ার চয়ন করেন! কে বা কাহারা কোন্ উদ্দেশ্যে এহেন অমার্জিত স্লোক রচন করতে পারেন, তা সেন্ট্রাল ডিফেন্স স্টক আজো সুরাহা করে উঠতে পারেনি। আঙ্কেল তার হাড়গিলে উদোম শরীরে ঢেউ তুলে স্বভাবচরিত ভঙ্গীতে ক্যাজন বাজিয়ে পাটের আঁশ সদৃশ্য রুক্ষুচুলগুলি নাড়াতে নাড়াতে সুর করে পড়েন:

হুক্কু হুক্কু শেয়াল ডাকে, গরু ওঠে গাছে!

যা বলার তা বলে দিছি, আরো বলার আছে –

গাছের পাতা নড়েচড়ে, নিচে ঝরে না (ভয়ে)!

পাবলিক পণ করিচ্চে রাস্তায় ময়লা ফেলবে না!

ময়নার বডি বাকশোবন্দী ময়নারতো নাই সেন্স

সৌদি থেকে আসছে দেশে পেট্রো-রেমিটেন্স! হুক্কু…

যাই নাই, তবে যাইয়া দেখলাম –দেখার কিছুই নাই–

ডেঙ্গুর ভয়ে দরজা বন্ধ, দরজার কপাট নাই!

সূধীবৃন্দের মাঝে এ থেকে যে পাঠ প্রতিক্রিয়া হয়, তা অভাবিত! তারা ময়নার বডির চেয়েও চিন্তায় পড়ে যায় বাকশোটা নিয়ে। ওটা কোন্ ম্যাটেরিয়ালে তৈরি? কাঠের না প্লাস্টিকের? প্লাস্টিক হবার কথা নয়, কারণ ওই আমলে এতোটা মরণঘনিষ্ট প্লাস্টিকের উৎকর্ষ ছিলো না। কিন্তু বাকশোটি কাঠের হলে… হায় হায় কাঠের হলে… প্রকৃতিকে রীতিমতো আঘাত করা হয়েছে, হায় হায় আঘাত করা হয়েছে… বলতে বলতে সর্বসাধারণের ভাবসমাধি হয়। তারা কাঠের ডোমিনোর মতো একে অন্যের গায়ে নিমেষেই আছড়ে পড়ে, পড়তেই থাকে।

সেন্ট্রাল ডিফেন্স স্টক এযাত্রায় পিকো আঙ্কেলকে আর রেহাই দেবেনা একথা সবাই বলাবলি করছিলো। ততক্ষণে ব্লু কভারওল আর সোনালি ফেটিগ পরিহিত ‘সেন্ট্রাল হারমোনি’-র চৌকশ একটি দল কামারশালার চারদিকে পজিশন নিয়ে ঘিরে ফেলে। তারা পিকো আঙ্কেলের যাবতীয় অস্থাবর সম্পদ যথা, প্রাচীন পুঁথি ও তার সুর, নেহাইয়ের উত্তাপ আর হাতুড়ির ঢঢক্কার, ছাতারে পাখীর বিস্তৃত কূজন এবং গনগনে কয়লার ধিকিধিকি বাজেয়াপ্ত করার অভীরুচী ব্যক্ত করে। পিকো আঙ্কেল হাসেন। তার অস্পষ্ট ছায়া আস্তরহীন দেয়ালের গায়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এবং সেই হাসি অতিদ্রুত লোকালয়ে ভাইরাল হয়ে যায়। অন্তর্যামীর মতো তিনি সকলের ডিভাইসে আবির্ভুত হন। শুরু হয় গন-উন্মোচন। কী এক অলীক ইশারায় সর্বসাধারণেরা একে একে কলের পুতুলের মতো ডোমিনোদশা থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। জোড়াতালি লাগানো লবেজান কলকব্জার মতো তাদের গা থেকে পচা শ্যাওলার আস্তর খসে খসে পড়তে থাকে- স্পার্ক করে যেনো বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ বারুদের মতো! আর গনগনে হলুদ কাঠকয়লায় গলা ডুবিয়ে থাকা উন্মুক্ত আদিম উপশিরা শিরা সহস্র শস্ত্রের মতো কিলবিল করতে থাকে!

অবিকল বিংশ শতকের মানুষের বাচ্চার মতো জোম্বীভূত সর্বসাধারণ তাফালিংয়ের তীক্ষ্ণ সাইরেন উপেক্ষা করেও কামারশালাটির চারপাশে প্রতিরোধ গড়ে তোলে– যেভাবে বৃক্ষকে তারা আলিঙ্গন করতো! তারা পরস্পরের হাত ধরে এবং একজোট হয়। বৃত্তটা ছোটো হয়ে আসে! ক্লাইমেক্সের চূড়ান্তে তখন দ্রুতলয়ে ক্যাজন বাজতে থাকে। ড্রোনশটে পুরো অঞ্চলের এরিয়েল ভিউ প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের ঘটনা বুঝতে সহায়ক হয়ে ওঠে। অতঃপর কাহিনীর অনাবৃত অংশে বর্ষা আসে। বর্ষা মেয়েটি সুশ্রী ও নৃত্যপটিয়সী। ছবি হিট হবার জন্য যা যা দরকার, সবই তার ভেতরে আপনি পাবেন। জুমলেন্সে তার সাদাভেজাশাড়ী আলোচনার কেন্দ্র হয়েছে বহুবার! হুমহুম হামিংয়ের মহরতে সেই  অবিরাম বৃষ্টির পর রাস্তায় জমে থাকা জল অপসৃত হলে নিরেট সত্যের মতো অবশিষ্ট ফোঁটা ফোঁটা জল গাছের পাতা থেকে, টিনের চালা থেকে আর ভিজে যাওয়া আস্তিন আর চুলের ডগা থেকে ঝরে পড়তে থাকে। সে জলজটে সৃষ্ট কুয়াশায় সেন্ট্রাল হারমোনির ওয়াটারপ্রুফ কাভারঅলগুলো গলে গলে কখন নেই হয়ে যায়! সবাই বলাবলি করে পিকো আঙ্কেল বৃক্ষ হয়ে গেছেন, অথবা বৃষ্টির জল! কিংবা কে জানে হয়তো একটা আস্ত দানব-নক্ষত্র যেমন শ্বেতবামন হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের গর্ভে খেলা শেষে ঢুকে পড়ে, তেমনই হয়তো…!

বিংশশতকের পয়ারমন্ত্রের কী যাদু, দেখলেন তো?

অনিবার্য কারণবশত

পুঁটকী ফাটা গরম পইড়েচে এবার! আর এই গরমে সুস্থির হইয়ে বইস্তে চালি কোতায় যাতি হবে ঢাহা শহরের মদ্দি কও দিনি? পার্কগুলোনরে তো তোমরা হাপিশ কইরে ফেইলেচো। আর আর যে সকল বিনোদনের ব্যবস্থা বানায়ে রাখিছো, তাতে তো আমার মতন ঢ্যামনারা মোততেও বসে না। তালি বাকি থাইকলো কী কতি পারো? বাকী থাইকলোতো শুদু সংসদ ভবন। বিশ্ব বিখ্যাত একটা বিল্ডিং, নাকি যে বিল্ডিংটার নকশা কইরেচিলো সে বিশ্ববিখ্যাত? আর কতো কী বিশ্ববিখ্যাত আছে আমাদের কলজের ভিতরে? লিস্টি দিতি গেলি তো রোদ ম্যালা পইড়ে যাবেনে। তবু যাই কও বাপু, এমন দরজা ছাড়া বিল্ডিং নজরুল ইসলাম আর দেখেনি। অবশ্য দরজা একদম যে নেই তাই-ই বা বলে কী করে? বাইওে থেকে দেকা যায় না ঠিকই। প্লাজা ঘুরে নিচের সুরঙ-রাস্তায় সেঁদিয়ে গেলে হোলের তলায় এন্ট্রেস আছে। তবে ঐসব রাস্তা তার মতো ক্লাশছাড়া লোকজনদের জন্য তো নয়ই, এমনকি তার নাম নিয়ে জাতীয় কবি নিজে এসেও যদি এস্ট্যান্ডআপ হয়ে থাকেন তাহলেও খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না। বলবীর- বললিই এখন আর বীরের অবাব হবিনানে। কাটারাইপেল নে হাজির হবেনে সোনার, হীরে আর চাঁদের টুকরো সব সোনামনিরা। তখন তোমার মতো ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলায়ে আর কাজ হবিনানে বাপ। আগে এন্তার জবাবদিহি কত্তি হবে যে, সে এখানে এইয়েছিলো অবশ্যই নয় একটি নতুন বিদ্রোহী কবিতা লেখার জন্যি!

নাম: নজরুল ইসলাম
বয়স: ৪৮
সাকিন: সাতক্ষীরা জেলার অমুক উপজেলার দোন-ধোয়া খালের পাড়ে
পেশা: বান্দর খেলা (দেখানো)
উচ্চতা: ৩ ফুট সাড়ে ইঞ্চি

এই উচ্চতাটাই তাকে গাড্ডায় ফেলে দিয়েছে। বেশি লম্বা লোক যা হোক তবুও একটু কোলকুঁজো হয়ে বা নুয়ে বাঁকিয়ে হেঁটে নিজের দুই এক ইঞ্চি কমাতে পারে। কিন্তু তার মতো বাঁটকুলুদের সামনে কোন অপশনই রাখেননি পরওয়ারদেগার। তাই এখন আর এই বয়সে লম্বা হবার কোন আশা না করে বরং মাথা উঁচু করেই সে হাঁটে। কিন্তু হাঁটলে কি হবে? তার মাথা অন্যের কোমর পর্যন্ত যায়। ফলে খুবই হাস্যকর লাগে দেখতে। তাকে মিলিটারী মেজাজে গম্ভীর মুখে হাঁটতে দেখলেও প্রথমত বাচ্চা পোলাপান আর পুলিশেরা শুরু করে যন্ত্রণা। টোকাইদের যন্ত্রণা তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু পুলিশগুলোর মুখ না জানি খাটা পায়খানা। নাম ধাম কিচ্ছু না, ওকে দেখলেই ডাক পারে- ওই মাদারচোদ, এদিক আয় হাউয়ার নাতি! আর তাকে দেখলেই শালাদের কোন না কোন কাজ মনে পড়ে যাবে। একবার এক শালার রাজা কনডম পর্যন্ত কিনে এনে দিতে হয়েছিলো। কেনরে শালা? গাড় মারাবি তুই, আর ন্যাকড়া নে আমারি ঠায় দাঁড়ায়ে থাকতি হবি কি জন্যি? নজরুল ইসলামের মেজাজ যে কী পরিমাণ গরম, তা বোঝা যাবে শুধু তার কাঁচাপাকা জুলপি বেয়ে ঘামের স্রোতের বহর দেখে। এই গরমে কার না মেজাজ তাতে? আর ঢাহা শহরের বাড়িওলাদের তেল কী রকম বাড়িছে দিন দিন খেয়াল করিচো? দেখলে হাগা বন্ধ হয়ে যায়। উরিব্বাপ! তিনতলার ফাউন্ডেশনে আঠের তলা তুলতেও শালাদের কোন বিকার নেই। বাপদাদার নাম নাই ট্যামগোপালের নাতি! খেয়াল করো, এই গরমের মদ্দে ইটা বালি সুঁড়কি সিমেন্ট সিফটিন বাটালি হাতুড়ি ক্রাশার…তো এই গরমে নজরুল ইসলাম জাতীয় প্রাণীদের বাঁচার- আর জীবন ধারণের (বাঁচে যারা সবাই তারা জীবনধারণ করে না, আর যারা জীবনধারণ করে আছে… থাক থাক বাপ, তোমাকে আর এই ধূলার দুপুরে দার্শনিকতা করি নাম কামাতে হবে না!) একমাত্র পথ হলো জাতীয় সংসদ ভবন! আর তাই নজরুল ইসলাম সন্দে হলেই রাইতের বেলায় বান্দর খেলা দেখায় সংসদ ভবনে। তার সাথে একটা হাড় জিরজিরে সিড়িঙ্গে গোছের বান্দর। আরেবাহ্, বান্দরতো মাস্ট। নাকি তোমরা চাও নজরুল ইসলাম নিজেই বান্দর হয়ে খেলা দেখিয়ে সবাইকে বিনুদোন করুক? তা বাবা সেইসব দিন কি আর আছে? সংস্কৃতি নাকি এখন আকাশের দখলে। কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে সব চলে যাচ্ছে চ্যানেলে চ্যানেলে। কোনোকিছু চাপায়ে রাখার জো নেই। তা কোনো মদনকে তো দ্যাকলাম না নজরুল ইসলামের মতো একজন প্রোতীভাধড়, স্বোপার্জিত বান্দর খেলোয়াড়কে নিয়ে স্টোরি করতি। অন্তত কোনো না কোনো টকশোতে তো কমপক্ষে এটলিস্ট বান্দরের একটা ইন্টারভিউ নেয়া যেতো! যা চলছে আজকাল! বান্দর অন্তত তার চেয়েও খারাপ কিছু বলতো না। তবে একটা সমস্যা হতো এক্ষেত্রে। এক চ্যনেলে এক ধারায় কথা বলে ফির আর এক চ্যানেলে অন্য কথা বলতে পারতো না এই বান্দর। যদিও দেখলেই বোঝা যায়, শালা শয়তানের সাত নম্বর দাদাভাই! কিন্তু ব্যাটা চলে পাতায় পাতায়- নজরুল ইসলাম কে তুষিয়ে। এ যাবৎ সতের বার নজরুল ইসলাম এই কুজাতটাকে বাড়িছাড়া করেছে। প্রতিবছরে একবার করে। কিন্তু হারামিটা যায় না, আবার ফিরে আসে। খামশি খেয়ে পড়ে থাকে। মাঝে দু একবার অতিষ্ট হয়ে নজরুল ইসলাম নিজেই বান্দরকে ফাঁকি দিতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। শয়তানের দাদাভাই ঠিক ঠিক গন্ধে গন্ধে হাজির হয়ে ধরে ফেলেছে তাকে। ধরি ফেলিচো? ও আমার নাঙ চোদানী তোমার জন্য আমার জীবন চলি গেলো শালী, তবু তোর হাত দে নিস্তার নেইকো ঢংমারানি। ওরে আমার কুলাঙ্গারের শনির আখড়া…! এই জন্নিই তোরে আমি পেটে ধরিনি। তোর মতোন বান্দর জর্ম দিতি পাল্লি আজ কি আমার বাটকুলু হইয়ে থাকতি হতো? কেবল আফসোস করে নজরুল ইসলাম। এই শালীর বান্দরের জন্যি তার কিছুই করা হলো না। আর এখন একমাত্র উপার্জনের পথ এই বান্দর। শালী সেটা বোঝে, কিন্তু তারপরও ওর জন্যে মায়া মহব্বতে কম নাকাল হতে হয়নি। এবং ভবিষ্যতে আরো কতো নাকানি চোবানি কপালে আছে কে জানে? অপ্রচলিত হলেও কথাটা সত্যি যে নজরুলের জিবনেও পেরেম এইসেচিলো। তা তার হবু প্রেমিকা প্রথমেই শর্ত জুইড়ে দিলো: ওই বান্দররে বন্দরে ফেলাইয়া তারপর আহো বেপারি। দুইজন মিল্লা রোজগার করমু, তুমি খদ্দের ডাইক্কা আনবা আর আমি… বান্দর রাখোন যাইবো না কইলাম। রান্দর দেকলে আমার শইল কাঁপে ডরে! বাইরের আপামর ভদ্রসমাজ এসব ঘটনার কিছুই জানে না। বান্দরের ইতিহাস নিয়ে নজরুলের ঝুলিতে কিছু ভালোমানুষ টাইপের নির্দোষ উত্তর আছে। যেমন কেউ যখন জিজ্ঞেস করে:
– এই বান্দর পাইছো কই? উত্তর: আল্লায় দিচে। সাত দিন আগে অগেরে আমি কিনিচি হাটেরত্থে…
– কত দামে? উত্তর: বারোশো টাহা দরে
– কয়টা খেলা পারে বান্দর? উত্তর: সতেরটা খেলা দেহাতি পারে
– কে শিখাইছে এই খেলাগুলান? যার কাছ থিকা কিনছো, সে? উত্তর: না। সেই মুনিব শিখায়েচিলো তিনচাইরডে, বাকীগুলোন আমার হাতে পইড়ে শিখেচে বাবা। আসলি, কদিন গেলি ও আরো বেশি খেলা শিকতি পারবি। (কচু! সতের বছর থেকে এই বান্দরকে ৪/৫টার বেশি খেলা শেখাতে পারেনি নজরুল ইসলাম। বরং তার নিজের আচরণের মধ্যে বান্দরের কিছু ’ফরমুলা’ ঢুকে গেছে। কিন্তু এমুন এমুন বললি মানুষের সিমপ্যাথি বাড়ে, জানে সে।)
– ও, তাইলে তুমিওতো কম বান্দর না! নাম কি বান্দরের? উত্তর: টাইগার! নজরুল ইসলাম এমন হুড়ুম মেরে নামটা বলে যেন সে নিজেই হুালুম করে এখনি কারো ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েেত জানে কিন্তু নেহাত করুণাবশত পড়ছে না।
– তা দেখাও দেখি তোমার বান্দর কী খেলা পারে দেখি…
নজরুল ইসলাম তখন হাতের লাঠিটা দিয়ে মাটিতে জোরে শব্দ করে আঘাত করে। মুখ দিয়ে কুৎকুত আওয়াজও তোলে একসাথে। এই শব্দে বান্দর কিছুটা বশে থাকে। শালা শয়তানের দাদাভাই ঠিক বোঝে এখন রোজগারের সময় বাতেলা করলে চলবে না। মেজাজ বুঝে নজরুল ইসলাম যেমন বলে, তাই করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাবলিকের আনন্দ পাওয়ার বা গ্রহণ করার আগ্রহ সীমাহীন। কিসে যে সে আনন্দিত হবে তা একমাত্র সে-ই জানে। কখনো বান্দর পেটানো দেখে মজা পায়। আবার কখনোবা মানুষকে বান্দরে পেটাচ্ছে- সেটা দেখেও তার আমোদ। আর এই সব আমোদ প্রমোদের ক্যটালিস্ট হিসেবে টাইগার যখন তার কাঙ্খিত আচরণ করতে ব্যর্থ হয়, পাবলিক তখন হই হই সোরগোল করে ওঠে। তখন দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নজরুল ইসলাম তার সাড়ে তিনফুঠি শরীরটা নিয়ে জাম্বুবানের মতো লাফিয়ে পড়ে বান্দরের পিঠে এলোপাতারি লাঠির ঘা বসিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে পিঠ কেটে রক্তও বের হয় তাতে। হায়, নজরুল ইসলামের যদি পাভলভের এনিমেল সাইকোলজি পড়া থাকতো!

তবে এ ধরনের ঘটনা খুব বেশি একটা ঘটে না। কেননা বান্দর খেলা দেখার লোক কৈ? সব শালাই তো বান্দরের মত দৌঁড়োচ্ছে। ঢাকাশহর কখন জিরোয় বলতি পারো? তারপরও এই সংসদ ভবনে দুপুরের পর থেকেই কিছু লোকজন হাওয়া খেতে আসে। তখন অবশ্য চড়া রোদ। সবচেয়ে ভীড় হয় আসেপাশের অঞ্চলে লোডশেডিং হলে। পয়েন্ট টু বি নোটেড- কিছু শখের ডাকে সাড়া দেবার জন্যি মেয়েমানুষদের আনাগোনা – যদি চোখ থাকে তো দেখতে পাবে। আবার বাজার গরমে, রাজনীতির গরমে আর ঘামের আরামে অতিষ্ট যারা, তারাও আসে তাতানো মেজাজ ঠান্ডার আশায়। মানুষগুলো তখন ছায়া ছায়া। সেই ছায়া মানুষগুলো তখন কী করতো যাদি না নজরুল ইসলামের মতো শখ-প্রশমনকারী না থাকতো। কেউ কেউ গায়ের জামাটা আধখোলা করে শরীরটা ঠান্ডা করার অছিলায় ঠ্যাং ছড়িয়ে কংক্রিটের মেঝেতে বসে। কেউবা ঘাসে বসে ঘাসের বারোটা বাজায়। (এই ঘাস লাগানোর টেন্ডার কেমন করে হয়, তা কি তারা জানে?) কিন্তু সিঁড়িতে কেউ বসে না। বসতে গেলেই আনছার ভাইয়েরা সিটি বাজায়। সিকিউরিটি ম্যাটার বলে এখানে সর্বসাধারণের বসা নিষেধ। তা বাবা নজরুল ইসলাম তো সর্ব-অসাধারণ। তাকে বসতি দিতি চাও না কিজৈন্যে? তোমরা আসোলি নজরুল ইসলামের মর্ম বুঝতি পাল্লি না। এই দ্যাহো, আমার টাইগার কী কী দেহাতি পারে। হা, তা দেখাও তো আমার রাজা বাপধন, সাদ্দামের সৈন্ন কী করি বুশের পেলেন ধংশো কইরলো? (বান্দর তখন ক্ষেপণাস্ত্র মারা ভঙ্গী করে!) সাব্বাস, তা পুঁইশাকের ডাঁটা নিয়ি নাতিজামাই বাড়ি যাতি হবি ছাইকেল চড়ি, দেখাও তো বাপা। ও বাপ, ছাইকেলে আমাকেও নিতি হবি (নজরুলের গলায় আহ্লাদ গলে গলে পড়ে)। ও মা রাগ হইয়েচে! ছাইকেলে সে নেপে না কাউরি, একা যাবি। (বলতেই বান্দর শালা লাঠিটাকে নিজের পেটের তলে সোজা করে নিয়ে পা দিয়ে প্যাডেল মারার ভঙ্গী করে)। তারপর ছাইকেলে চড়ি মাঝরাস্তায় একসিডেন হয়ি পড়ি গেলা তুমি! (বান্দর এখন তিনদিনের বাসি মড়ার মতো স্পিকটি নট্) ও বাপা, কী হইয়েচে তোমার? এড়ি গেচো? (নজরুলের গলায় কান্নার সর্দি জমে)। আহারে আমার রাজা বাপধন, ওঠো ওঠো, এম্বুলেন্সে খপর দিতি হবিনানে? (বান্দর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এম্বুলেন্সে খবর দিতে যায়)। হা, ছিরিকিশনো কী করি ননীচুরি কইরলো দেখাও তো বাপ। – হইয়েচে। এবার দেকপেন আট তারিখে জনগনের শোতরু এরশাদ সিকদার কী কইরে ফাঁসিতে ঝুইলচে। বলে বান্দরের গলায় বাঁধা দড়ি ধরে নজরুল ইসলাম হ্যাঁচকা টানে উপর দিকে টেনে তোলে। যেনো এভাবেই সে একদিন এই কুজাতটাকে একদম শেষ খেলা দেখিয়ে ছাড়বে। কিন্তু বান্দর চালাক আছে। বড়শীর মত আঙুলগুলো দিয়ে ঝট করে সে ঝুলন্ত দড়িটা দুহাতে ধরে ফেলে। পাবলিক হই হই করে ওঠে। ওই মিয়া, মইরা যাইবো তো বান্দরে। শালা কষাই। ওই মাদারচোদ তোর মায়েরে বাপ। এরশাদ সিকদাররে লইয়া কী কইতাচোস। চারদিকে যে আরো কতো খুনী আছে দেহস না? দেন ভাই, যে যা পারেন দেনÑ খেলা দেখাইয়া রোজগার করে ভাই, চুরি চামারিতো করে না। দেখছেন তো ভাই সাইজ। বান্দরের লাহান। ও এইটা না করলে কে দেখাইবো বান্দরের খেলা? জনৈক প্রশ্ন করে- তুমি কি মিয়া শুদু এই সংসদ ভবন চত্তরেই বান্দর খেলা দেখাও। হ। যায়গা একটা বাইছা লইছো ভালোই। এইখানেই জমে ভালো! আরো একদিন দেখছি তোমারে, নাচন কোন্দন চালাইতাছো…. কিন্তু তোমার চাইতে অনেক ভালো নাচন কোন্দন জানে – যারা ভিতরে থাকে- বলে আলগোছে বিখ্যাত বিল্ডিংটাকে সই করে কিনা, আবছা আলোয় তা ঠাহর হয় না। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়, অযাচিত, অপরিপক্ক কথার ভেতরেই তারা উদয় হয়। জনা তিনেক সংসদ পুলিশ। এরা চত্তরের নিরাপত্তা ও সিকিউরিটি কনসার্ন। পদাধিকার বলে সংসদের দেহরক্ষী কাম গার্জেন। এসেই তারা প্রথম সবক দেয়। ওই মাদারচোদ, কতো ইনকাম করলি আইজ হাউয়ার নাতি? নজরুল ইসলাম এই ভয়টাই করছিলো। এদের হাতে পড়লি আর ইনকাম নে বাড়িতে যাতি হবিনানে। সে ফিকির চিন্তা করে। ভং ধরে তিনটাকা এগিয়ে দেয় ওদের দিকে। রিএ্যাকশন হয় মারাত্মক। তারা কোন সুযোগ না দিয়ে নজরুল ইসলামের হাতের বান্দর-পেটানো লাঠিটা কেড়ে নিয়ে বান্দরের সাইজে ঠায়-ঠাস গোটাকয় বারি বসিয়ে দেয়। নজরুল ইসলাম ইরিব্বাপ বলে এমন একটা লাফ দেয় যেন সে কোনরকম জেটফুয়েল ছাড়াই আকাশে উড়ে যাবে। চোখের নিমেষে লম্বা কালসিটে পড়ে যায় তার পিঠে। যা ঢাকা থাকে ঢাকাশহরের অসংখ্য অসফলতার মতো কংক্রিট কফিনে। নজরুল ইসলামের এখন শীত লাগছে। আরে, অসময়ে মাঘ মাস ফলে উঠলো নাকি? হাইবাপ কী হলো কওদিনি? কী করিচি আমি, ছার?
– বান্দর নিয়া পার্লামেন্টে ঢোকা নিষেধ। তার উপরে রাইতের বেলা, হারামজাদা, তোর আইজকা খবর আছে। বাইরকর তোর সারাদিনের ইনকাম। বড় ছার আইজ এমনিতেই খেইপা আছে। এমপি হোস্টেলের পিছ্নের জানলা দিয়া নৌকায় পাড় হইতে গিয়া এক মক্ষিরানী পানিতে পইড়া গেছে। আইজ তোর বারোটা বাজামু হাউয়ার নাতি।

আরে কি মুশকিল, এইসবের মধ্যে নজরুল ইসলাম কেমনে ঢুকে গেলো? সে তো বান্দর নিয়া ঘোরে: মাগীর দালালিতো করে না। কিন্তু তাতে কি, জোরপূর্বক হলেও তাকে এই ঘটনার মধ্যে ঢোকানো হবে। এবং ঢোকানোর পর কাহিনীর কী দশা হয় তা আপনারা দেখতে পাবেন। আগামিকালের পত্রিকাগুলোতে একবার চোখ বুলালে কিংবা লেটনাইট টিভি কভারেজে দেখতে পাবেন সোম্বাদিক ভায়েরা যে নিউজ এনালাইসিস করে কিংবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোনো টক-মিষ্টি-শো র টপিক হিসেবে এক বান্দর কাহিনী ঢুকে পড়াটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে আপনাদের এহেন লোডশেডিংয়ের ভেতরে, অকার্যকর সংসদীয় চত্তরে বেমালুম ফেলে রেখে আমি তো ডুগ্গি দিতে পারি না। কাহিনীকে তো অন্তত একটা সম্পৃক্ততার যায়গায় নিয়ে যেতে হবে। তো গেহেরি বাত ইয়ে হ্যায় জনাব, নজরুল ইসলামকে ওইভাবে আগাপাশতলা মার খেতে দেখে সতের বছরের সহচর বান্দর আচমকা লাফিয়ে পড়ে সিকিউরিটি স্টাফদের কাঁধের ওপর উপর্যুপরি হিসি করতে থাকে।

বাপরে বাপ! বান্দরের মুত বলে কথা। কতদিন এর গন্ধ বয়ে বেড়াতে হবে বলা মুশকিল!

নারীঘটিত ব্যাপার স্যাপার

কাঁকড়াজীবন

watercolour, watercolor, paint

বিশ্বাস, আস্থা, শরীর, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ... এর বাইরেও আরও একটা জিনিস আছে মানুষ আর মানুষীর ভেতরে। কী সেটা, তা এই সময়ের মানুষেরা এখনো জানে না। তবে কেউ কেউ জানে মনে হয়। সেটার কোনো নাম নেই এখন। ভবিষ্যত পৃথিবী তাকে কোনো একটা নাম দেবে হয়তো। সে এক অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হবে তখন!

 

এক.

সৈকতের উথাল পাথাল পানি আর বালির নৃত্য আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কিনারায় এগিয়ে গিয়ে দীপান্বিতা সমুদ্রকে হুকুমের স্বরে বললো, “আয়, পা ধুয়ে দিয়ে যা!” আর পোষা এ্যালসেশিয়ানের মতো বালি শুঁকতে শুঁকতে সমুদ্র এসে হামলে পড়ে তার হুকুম তামিল করলো! একটু দূরে দাঁড়িয়া দৃশ্যটা দেখে হেসে ফেললো হৃদকমল। নিভে যাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বললো|

– দেখো সবাই সুন্দরের কীরকম তোয়াজ করে, দেখলে তো! অথচ আমার জ্বলন্ত সিগারেটটা এইমাত্র আক্রোশে নিভিয়ে দিলো নোনা বাতাস!

– তোয়াজ নয়, মুগ্ধতা!… আমি যেমন করে আদরমেখে সমুদ্রকে ডেকেছি, তুমি কি কখনো সেভাবে ডাকো? তোমার তো কেবল হম্বিতম্বি। মনে হয় যেনো সবাই তোমার কর্পোরেট কর্মচারি!

হৃদকমল অসহায় বোধ করলো। কী বলা যায় এখন? যে রোমান্টিক চিন্তাটা এতক্ষণ মাথায় গুনগুনাচ্ছিলো, ধুন্ধুমার কথা শুনে চিন্তারা সব এক নিমেষে হাওয়া! কিছু না বলে সে চুপ করে রইলো। তারপর অনেকক্ষণ ধরে শুধু ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। আর কোন শব্দ নেই, কথা নেই।

জলের দিকে এগিয়ে গেলো দীপান্বিতা, একা। ভেজাবালিতে শরীর শিরশির করে উঠলো তার। নীল জর্জেট শাড়ীর নিচের দিকের পাড় ভিজে আরো গাঢ় নীল দেখাচ্ছে। সরু ফিতের হালকা স্যান্ডেলটা জলসীমা থেকে নিরাপদ দূরত্বে শুকনো বালিতে অযুজ পায়ের ছাপের এবড়ো খেবড়ো অবয়বের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে। দূর থেকে মনে হয় দুটো প্রেমোন্মত্ত কাঁকড়া!

একটু আগে যে এ্যালসেশিয়ান কুকুরগুলো তার পা ধুয়ে দিয়েছিলো, তারা এখন ফিরে যাচ্ছে হেরে যাওয়া অনুর্ধ-সতের কিশোর ক্রিকেট দলের মতো। যেতে যেতে দূর থেকে ঘাড় ফিরিয়ে যেনো দেখছে দীপান্বিতাকে। তার মনে হলো, আরো, আরো দূরে, ঢেউয়ের ভেতরে কী এক রহস্যলাগা ইশারায় তরুণ ঢেউয়ের দল তাকে সামিল হতে ডাকছে। পরক্ষণেই একদল যুবকের উদ্বেলিত মিছিলের মতো অন্য আর এক স্তরের উন্মাতাল ঢেউ কিশোরদলকে মাড়িয়ে দিয়ে মারমুখি তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখতে পেয়ে দীপান্বিতা পিছু হটলো। পিছনে কারো গায়ে ধাক্কা লাগতে ফিরে তাকিয়ে দেখলো হৃদকমল তাকে দুহাতে পতন ঠেকিয়েছে।- ভিজে যাবে!
সংক্ষিপ্ত শব্দদুটো – যা অনেক অনেক অর্থময়তা তৈরিতে সক্ষম – সেটা উচ্চারণের সাথে সাথে সে দীপান্বিতাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে লাগলো। যেদিকে কাঁকড়াদুটো প্রেম করছে, তার উল্টোদিকে!

দুই.

টহলপুলিশের মতো এক একটা ঝাউগাছ যেখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে, তার সামনেই সামাজিক দূরত্ব রেখে অলস বিচকেদারাগুলো লম্বা লাইনে আধশোয়া – যেনো কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে বুকডন দিচ্ছে! দীপান্বিতা তার একটাতে সওয়ার হয়ে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিয়েছে। আর তার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে ছয়-সাত বছরের পুষ্টিহীন এক কন্যাশিশু লাগাতার কথা বলে যাচ্ছে। তার দুটো হাতও সমানে চলছে দীপান্বিতার ঘন চুলের ভেতর। এই পেশার উৎপত্তি বিচে খুব বেশিদিন নয়। সে একবার মেয়েটাকে কাজে লাগাবে কিনা ভাবছিলো, এথিক্সের যায়গা থেকে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, তার কাছ থেকে মেয়েটা যদি সহায়তা নাও পায়, তবুও ওর কাজ বন্ধ থাকবে না। মেয়েটা খুব দক্ষ হাতে কেবল যে তার চুলের গোড়া টেনে দিচ্ছে তাই নয়, সরুসরু আঙুল দিয়ে ওর কপালে এমন ফুলঝুড়ি কাটছে যে চোখ আরামে বুজে আসার মতো। কিন্তু দীপান্বিতা পূর্ণ সজাগ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা কী বলছে। ভাষাটা খুবই দুরূহ আর অস্পষ্ট! তারপরেও সে বুজতে পারছে, চুলটানার শুরুতে সে জিজ্ঞেস করেছিলো, স্কুলে যাসনা কেন্? সেই প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে এখন গত বিশ মিনিট ধরে ননস্টপ! ওটাই মেইনস্টোরি: হঠাৎ করে তাদের এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর নারকেল গাছ থেকে তার বাপের পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পাবার কারণে তাদের আট সদস্যর সংসারটা যে অচল, সেটাতো আছেই, তারসাথে সাইডস্টোরি হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে ওস্তাদের মারধরও ঠাঁই পেয়েছে!

বেশ কিছুটা সময় পার হবার পরেও দীপান্বিতার যখন চেয়ার ছেড়ে ওঠার নামগন্ধ নেই, বরং এখন – দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে হৃদকমল দেখতে পাচ্ছে – চোখ বন্ধ রেখেই মুখে খৈ ফুটছে তার! কী আজব, এরা কেউ কারো ভাষা বোঝেনা, অথচ কি সুন্দরভাবে নিজেদের মধ্যে ভাব করে নিয়েছে। যেনো কতোকালের পুরোনো জান পহেচান! হৃদকমলের ভীষণ হিংসা হলো দৃশ্যটা দেখে। হুহ্, রাজরানীর মতো শুয়ে আছে! তার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওই মানুষীকে জাগায়, এলোমেলো করে দেয়। কিন্তু তা সে কখনোই করবে না। করতে পারবে না। এক অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে যেনো, দুজনের মাঝে। কেউ কাউকে ঘাঁটাবে না। বিয়ের আগে লিখেছিলো একবার –

তুমি বললে যে কোনদিন ঈদ,
তুমি বললে সঙ্গে সঙ্গে ছুটি।
তুমি বললে সোম শুক্কুর বুধ,
অপেক্ষাতে কেবল মাথা কুটি!

উত্তরে মুখ টিপে দীপান্বিতা বলেছিলো, “মিথ্যুক!” আর এখন পুরো সম্পর্কটাই কেমন যেনো আঁশহীন, আশাহীন। দুজনেই দুজনের থেকে প্রাইভেসি চায়, একাকীত্ব খোঁজে। এক অসম্ভবের রাজ্যে তারা প্রেতের প্রেম নিয়ে পরস্পর সহাবস্থান করছে। সেই সহাবস্থানের নিরেট পাঁচিলে আচমকা চিড় ধরালো ওই প্রোমোশনাল প্যাকেজটা। বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রী লাক্সারি ট্রিপ…!

বিচের ডাব কখনো সোজাসাপ্টা নিয়মে কাটা হয়না। আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকবেই। এই প্রবণতা সে বিদেশের বহু বিচেও লক্ষ করেছে। এরা ডাব কাটে পেটের দিকটায়। তারপর একটা বাড়তি “ক্যানেলও” কেটে দেয় পান করা সহজ করতে। হয়তো এটাই ওদের কাছে সোজাসাপ্টা! আসলে মানুষ যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে যায়, সেটাকেই স্বভাবিক মনে করে। ওদের দুজনের সম্পর্কটা যেমন এখন সবার চোখে।

দুহাতে দুটো দশাশই কাটা ডাব নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটা বেশ কষ্টকর। বালির ওপর কাজটা অসম্ভবই বলা চলে। হৃদকমল ধীর গতিতে এলোমেলো পায়ে, দীপান্বিতা যেদিকে শুয়ে আছে তার মাথার দিক দিয়ে ঝাউবনের আবডালে হেঁটে এগোচ্ছে। তার একটু সংকোচও হচ্ছে, একটু আগে তেজ দেখিয়ে সে তাকে ফেলে হাওয়া হয়ে গেছিলো এটা দেখতে যে, তাকে ছাড়া মেয়েটা কী করে! কিন্তু যা ভেবেছিলো সেসব কিছু না করে, ছোট্ট পার্সটা, সেই পার্সের ভেতর রুমের কার্ড আর তার “পেগু-ইয়োমা” সেলফোন নিয়ে দিব্বি বিচকেদারায় হাওয়া খাচ্ছে মহিলা! অগত্যা ডাবের ছুঁতোয় ফিরে না গিয়ে উপায় কী?

ভোরবেলা যখন তারা বিচে এসেছে তখন কাঁকড়ার ছানাপোনারা সব লাইন দিয়ে গড়গড় করে জলে নামছে। মহাব্যস্ত এক একজন। ভাবেসাবে মনে হয়, পৃথিবীতে ওরাই একমাত্র কাজকর্মের বিষয়ে সিনসিয়ার। প্রায় ঘন্টাদুয়েক কাঁকড়ার দলবল ও তাদের গর্ত নিয়ে গবেষণা করে হৃদকমল অবশেষে এটা আবিষ্কার করতে পারলো যে, কাঁকড়ার গর্তে শুধুমাত্র কাঁকড়াই থাকে! আপনমনেই হাসলো সে। কাঁকড়ার ভঙ্গী নকল করে, পা টিপে টিপে যতোটা সম্ভব আওয়াজ না করে সে পৌঁছে গেলো বিচকেদারায় উপবিষ্টা মহারানীর কাছাকাছি। যেনো কিছুই হয়নি তেমন স্বরে, চোখ বন্ধ রেখেই দীপান্বিতা এক হাত তার দিকে বাড়িয়ে বললো, “দাও মহাদেব!”

তিন.

– মৃত্যু ঘটে যাবার পরে দুটো মানুষের জীবন কেমন কাটে?
– জানিনা!
– আমাদের যেমন কাটছে এখন…
– “আমাদের”? তুমি আর আমি মিলে?
– হা!
– তুমি আমার কে ছিলে, সেটা কি কোনোদিন হৃদয় দিয়ে বুঝতে চেয়েছ? বিশ্বাস, আস্থা, শরীর, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ… এর বাইরেও আরও একটা জিনিস আছে মানুষ আর মানুষীর ভেতরে। কী সেটা, তা এই সময়ের মানুষেরা এখনো জানে না। তবে কেউ কেউ জানে মনে হয়। সেটার কোনো নাম নেই এখন। ভবিষ্যত পৃথিবী তাকে কোনো একটা নাম দেবে হয়তো। সে এক অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হবে তখন! নিদারূণ স্বপ্নসাহসিক প্রকৃতির ফুলফলের মতো ঐশ্বর্যের মাধুরী হবে সেটা!! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে!!!! মানুষে মানুষীতে এতো সুদূরতম রহস্য লুকানো আছে এই গ্রহের জাঁহাবাজ জলহাওয়ায়? তাহলে মানুষ কেনো মরে যায়? কেনো সেই সঞ্জীবনী – যা মৃতের বুকেও ব্যাথা হয়ে বাজে – তার আবেশস্পর্শ্বে কালের কফিন থেকে মোহোগ্রস্তে ঘুম ভেঙে উঠে বসে না কেনো? অন্তরাত্মায় প্রবল ঝাঁকুনি দেয়ার মতো সেই সুখানুভূতি নিয়ে সুখী হতে পারেনা কেনো? মাঝে মাঝে নিজেকেই বলে এসব হৃদকমল। একজনকেইতো ভালোবেসেছিলাম, বড় দেরি করে, জিবনে…. সব হারানোর পরে, সব পাওয়ার মতো! এবং পেয়েছিও। তবু কেনো অধরা মনে হয়? কে যেনো বলে ওঠে, “আমাদের সম্পর্কের ভেতরে আঁশ তৈরি হয়নি।…মাঝখানটা ফাঁকা যে! একটা ছোট্ট কচিমুখ বড় দরকার আঁশ তৈরি করতে!”… কে কথা বলছে? দীপান্বিতা শুয়ে আছে ওইযে খাটের ওপর সাদা বালিশে তার চুলের গোছা পরিপাটি এলিয়ে রয়েছে। আর এখানে, এই ব্যালকনিতে সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়া খালি প্যাকেটের ভেতর থেকে রাংতা বের করে তার ওপর নখ দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে হৃদকমল!

– তোমার জন্য আমি একটা নাম ঠিক করেছি জানো?
– কি?

– লোকটা।
– বাহ দারুন তো!…কিন্তু আমি না তোমার মহাদেব? আবার ‘লোকটা’ কখন হলাম?
– এইমাত্র।…তোমাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকতে চাই!
– তাহলে আমিও তোমার আর একটা নাম দেবো।
– কি ডাকবে?
– ভুতি!
– ইশ্, কী বিচ্ছিরি নাম! আমি মরেই যাবো শুনলে।
– কেনো, নামটা খারাপ কোথায়? অনেক স্মার্ট। এই ভুতি!
– এই ডাব ছুঁড়ে মারবো তোমার কপালে!’ বলে সত্যি ছুঁড়ে মারলো ডাবটা নিজের মাথার ওপর দিয়ে পেছন দিকে, ঝাউবনের প্রহরা লক্ষ করে।

এসব দুপুরের ঘটনা। নাকি সকালের? হৃদকমল ঠিক মনে করতে পারে না। দৃশ্যগুলো ধারাবাহিকতা মানছে না। সব কেমন এলোমেলো। সে পৌঁছাতেই পিচ্চি মেয়েটা টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। হৃদকমল খুব হকচকিয়ে গেছে চোখবন্ধ দীপান্বিতা তার বুজরুকি ধরে ফেলেছে বলে। চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে সে অপ্রস্তুত, গম্ভীর হতে চেষ্টা করে। কিন্তু সামনে বসা সুন্দরী নারীপ্রতীমাটি ঠোঁট টিপে হাসছে। তার এই টিপিক্যাল হাসির অর্থ সে জানে। এর মানে হলো, কী, পারলে নাতো কর্পোরেট বুদ্ধিতে! আসলেও তাই, সে কখনোই দীপান্বিতাকে ইমপ্রেস করতে পারে না। চেষ্টা করতে গিয়ে বরং নাকাল হয়েছে! এবারও তাই হলো।

– তুমি দেখলে কী করে, আমি আসছি? মাথার পেছনেও চোখ নাকি আরশোলার মতো?
– হিহ্, কী বুদ্ধি!.. আমার দেখতে হবে কেনো?
– তবে কি পায়ের শব্দে?
– আরে নাহ্, আমার স্যাটেলাইট আছে না? বলে বাচ্চামেয়েদের মতো খিলখিল হেসে উঠলো দীপান্বিতা।
– মানে?
– আরে ওই পিচ্চিটা, চুল টেনে দিচ্ছিলো যেটা! তুমি রাগ করে চলে গেছো, ও খেয়াল করেছে দূর থেকে আগেই। আমাকে একা দেখে পটিয়ে ফেললো…পটরপটর করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিলো একদম!
– আমি তো দেখলাম, তুমিই পটর পটর করছিলে ওর সাথে!
মুখ মচকালো দীপান্বিতা। গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপর সাইক্লোনের ঠিক আগমুহুর্তে আবহাওয়া শান্ত হবার মতো স্বরে বললো, “আমার আর কী কী তোমার অপছন্দ? গিয়েছিলেতো শান্তাহার, পাত্তা পাওনি!”
শান্তাকে সে শান্তাহার ডাকে। সেসব সেই কবেকার কথা, ভার্সিটির যুগের। শান্তা এখন তিন বাচ্চার মা। ওজন একশত সত্তর পাউন্ড। কিন্তু দীপান্বিতা কিছুই ভোলেনি!

ব্যাঙ ডাকছে নিচে কোথাও। হৃদকমলের শীতশীত করছে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে ঠকঠক করে কাঁপলো। এসি চিল্ করে ঘুমোচ্ছে দীপান্বিতা। কম্বলটা ঠিক করে দিলো সে। দেখলো ঘুমন্ত মুখটাকে। চট্ করে একটা কচিমুখ ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেলো!
– আমি ওই পিচ্চিটাকে নিয়ে যাবো! পালবো ওকে মেয়ের মতো।
– কাকে?
– ওই যে চুলটানা-!
– কীসব বলোনা তুমি!
– কেনো, ময়লা জামাকাপড় আর দেখতে কালো বলে তোমার স্টাটাসে মিলবে না?
– দীপা!
– “চিৎকার করছো কেনো?” টলমল চোখে, মনে হচ্ছে এখুনি মরে যাবে।
– আরে, আমি কি তাই বললাম? ওর বাবামা কি দেবে নাকি ওকে?
– দেবে। আমি জানি, আমি চাইলেই দিয়ে দেবে।
– আচ্ছা! তাই নাকি?
– হ্যাঁ।
– জিজ্ঞেস করেছিলে?…তুমি তো ওর ভাষাই বোঝোনা। বলে হাসলো হৃদকমল, জিতে যাওয়ার হাসি। মুখটা পাথর করে ফেললো দীপান্বিতা। তারপর ঠিক ওই মেয়েটির স্বরভঙ্গী নকল করে ওই ভাষাতেই বলে উঠলো, “বুইজ্জিম ন খ্যান? বেগ্গুন বুস্তামফারি!” একটা বিট্ মিস করলো হৃদকমল। আর একটু হলেই তার হৃদপিন্ডের কমল ঝরে যাচ্ছিলো আরকি!
– মাইগড, তুমি ওদের ভাষা শিখে ফেলেছো?
– মহাদেব, তুমি সব ভুলে যাও, লোকটা! …ফাদার এ অঞ্চলে সাত বছর বদলি ছিলো আমি তখন তের, বলিনি তোমাকে?
– ও হো! ভুলে গেছিলাম!
– ইশ্ কর্পোরেট লোকটা! সব গুগলমামা জানে!হৃদকমল ভাবছিলো, সত্যিই দীপান্বিতাকে পুরোপুরি জানা তার এই জিবনে শেষ হবে না। ঘুমন্ত সুন্দর অবয়ব যা ই বলুক, সে তাকে কখনোই ছুঁতে পারে না। এমনকি তার শরীরের ভেতরমহল পর্যন্ত পৌঁছানোর পরেও মনে হয়, এই নারীসত্তাকে জয় করা হলোনা। কেনো এমন মনে হয়? আর সেই মনে হওয়াই তাকে দীপার কাছে সহজ হতে দেয় না। কম্বলের ভেতরে ডিম তা দেয়ার মতো ওম। তার ভেতরে রাতপোষাকে ভুতির উষ্ণ শরীর তাকে আরও চমকে দেয় যখন দুটো কোমল হাত তাকে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পরক্ষণে টের পায়, ঘুমের মধ্যে কেবল আশ্রয় খুঁজছে দীপান্বিতা, আর কিছু নয়! গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে আর একবার হৃদকমল ভাবে, সত্যিই কি তাদের সম্পর্কে কোন আঁশ নেই? এ্যাই ভুতি, ভুতি! সে ঘুমের ভেতর বিরবির করে!

চার. 

লোকটার কথা একবর্ণও বুজতে পারলো না হৃদকমল। তবে দীপান্বিতার ক্রমাগত মাথা নেড়ে সায় দেয়া দেখে বুজলো ঠিক যায়গাতেই এসেছে। ঝুপড়ি ঘরের ভেতর আলোর স্বল্পতা আছে, তবু তার মাঝে বিছানায় শোয়া লোকটা যে হাড্ডিসার তা বোঝা যাচ্ছে। হাপড়ের মতো ফ্যাশফ্যাশ্ শব্দ করছে শ্বাস টানতে। কোমরে চোট পেয়ে বছরখানেক ধরে শয্যাশায়ী। গাছ থেকে নাকি পড়ে গেছে। তবে হৃদকমলের মনে হলো লোকটা এখনো দুবেলা নেশা করে। চোখদুটো সে কথাই বলে।এ অঞ্চলটা মাদকের স্বর্গ বলে পরিচিত!

নাকে হলুদ শিকনি নিয়ে একটা ছোট বাচ্চা মেঝেতে ট্যা ট্যা করে কাঁদছে। তার মা বস্তীর সামনের সরু রাস্তায় শুঁটকি শুকানোর ব্যবস্থা করছে। একটা আঁশটে গন্ধ পুরো এলাকা জুড়ে। বেগমবাড়ি বস্তী এটা। সেই ভোরবেলা ব্রেকফাস্ট সেরেই দীপান্বিতার চাপাচাপিতে তাকে বের হতে হয়েছে! বিচ মার্কেট থেকে কেনা স্যান্ডেলটা ভালোমতো ফিট করেনি। তার ওপরে ভেতরে বালি ঢুকে যাচ্ছেতাই অবস্থা! হাঁটাই দায় হয়ে গেছে। একে তাকে ধরে, নাম জিজ্ঞেস করে দীপান্বিতাই ঠিকানা বের করে আনলো মেয়েটার। তারপর টমটম, রিকসা এসবে ভাঙাচোড়া রাস্তাটা জোড়া দিয়ে দিয়ে তারা এসে পৌঁছালো নানিয়ার টেকের এই বস্তীতে। হৃদকমল গোম্ দিয়ে ছিলো সারাটা পথ। কোনো মানে হয়, একটা পুঁচকে মেয়েকে নিয়ে এসব বাড়াবাড়ির? কিন্তু সেটা এখন এই ভদ্রমহিলাকে বলতে যাওয়া, আর সেধে মাথায় বজ্রপাতকে দাওয়াত দেয়া একই কথা। ওড়নাটা দিয়ে মাথামুখ ঢেকে সানগ্লাসটা দিয়ে সূর্যদেবের কোপ থেকে নিজেকে ঠেকাতেই ব্যস্ত দীপান্বিতা। তার পোড়লফুলের মতো ত্বকে যেনো কোন দাগ না লাগে, সেটাই এখন একমাত্র প্রায়োরিটি। আর কোনো টেনশন নেই। খুশি খুশি ভাব। আশ্চর্য! তারা যে একটা ক্রাইমজোনে ঢুকে গেছে, লোকজন যে বিশেষভাবে নজর করছে তাদের, সেটা যেনো কোনো বিষয়ই না। তার আপ্তবাক্য হলো, মানুষের সাথে তুমি ভালো ব্যবহার করো, প্রতিদানে তুমিও সেটা ফেরত পাবে! হিক্! এইসব ফিলোসফি আজকাল চলে? পথেঘাটে সম্ভ্রান্ত মেয়েরাও আজকাল কীভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে, এতো দেখে, তারপরও যদি একটু শিক্ষা হয়।

বিছানার লোকটা, মানে ‘চুলটানা’র পিতৃদেব এখন উঠে বসার চেষ্টা করছেন। তারপর ওদেরকে অবাক করে দিয়ে তেলচিটে বালিশের নিচ দিয়ে দীপান্বিতার নেকলেসটা বের করে বাড়িয়ে ধরলো তার দিকে। হৃদকমল এতো অবাক হলো যে তার চোয়াল ঝুলে পড়লো!

এই অরিজিন্যাল ন্যাচারাল পার্লের মালাটা সে এনেছে ফিলিপাইনের দাভাও আইল্যান্ড থেকে, যেখানে চাষ নয়, প্রাকৃতিকভাবে মুক্তো আহরণ করা হয়। অফিসের রিট্রিট ছিলো। শো রুমের আটসাঁটো
পোশাকের মেয়েটা চ্যাপ্টা একখানা হাসি দিয়ে বলেছিলো, স্যর, ইয়োর ওয়াইফ মাস্ত্ বি বেরি লাকি। উই কালেক্তেদ দিস পার্র নেকলেস লাস্ত নাইত! সেই জিনিস ওই লোকটার বালিশের নিচে গেলো কী করে? ভাবার আগেই হৃদকমল বিষয়টা আন্দাজ করে ফেললো। কখনো কখনো মাথা খুব দ্রুত কাজ করে। সে চোয়াল শক্ত করলো আর দীপান্বিতা চট করে তার হাত ধরে ঝুপড়ির বাইরে টেনে নিয়ে এলো।

– পিচ্চিটা কৈ? তোমার গলা থেকে খুলে নিলো টের পাওনি?
– পাবোনা কেনো? পেয়েছিতো।
– মানে?…. দেখো সবকিছুর একটা…!
– আহ্ আস্তে কথা বলো, সুলতানা শুনে ফেলবে।
– সুলতানা কে?
– ওই মেয়েটা, তুমি যাকে আদর করে চুলটানা ডাকো!… কিছু বোলোনা এখানে প্লিজ।… এই নাও তোমার মূল্যবান সম্পদ! বলে নেকলেশটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে, শুঁটকি শুকানো মহিলার সাথে কথা বলতে শুরু করলো।
হৃদকমলের এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে কেনো কে জানে? নিজের বৌকে কথা শোনাতে না পারায় যে যন্ত্রণা, তা কে বুজবে?

পাঁচ.

বিকেলে পুরো দু’ঘণ্টা নিজেকে সাজালো আজ দীপান্বিতা। সাজের ব্যাপারে মেয়েদের এই সহজাত প্রবণতা নিয়ে বহুবার ভেবেছে হৃদকমল কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারেনি। পারবে কি করে, সাজগোজ নিয়ে কোনকিছু বলতে গেলে দীপান্বিতার সাথে মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এতো এতো উপকরণ একটার পর একটা ব্যবহার করে শেষমেষ যখন সে সামনে এসে দাঁড়ায়, হৃদকমল তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পায়না। মনে মনে বলে, আগেই তো ভালো দেখাচ্ছিলো! কেবল নতুন শাড়ি, পারফিউম, বডিস্পে আর চুলের কস্তুরীঘ্রাণ হৃদকমলের মাথায় সম্মিলিত নীল মেঘের বারুদ তৈরি করে! সেই বারুদ কখনো জ্বলে ওঠার সুযোগ পায়না দীপান্বিতার মুখ ঝামটার কারণে। হ্যাংলার মতো তাকানো সে একদম পছন্দ করে না। তবুও আড়চোখে তাকালে মনে হয় কিছুই সে মাখেনি। দীপান্বিতাকে সেটা বলতেই সে হিহি করে হেসে ওঠে; তারপর রহস্যমাখা চোখের ঝিলিক তুলে আরো বেশি রহস্য সৃষ্টি করে সে চুপ হয়ে যায়। হৃদকমলকে কিছুই বুঝতে দেয়না। পুরুষমানুষকে সব বুঝতে হবে কেন? মেয়েরা তাদের জাদুময়তা আড়াল করেই তো রাখবে।বুঝে ফেললে আর রহস্য রইল কই? একজন জাদুকরের পেছনের কারিকুরি যদি আমরা জেনেই যাই, তাহলে সে জাদু কি আর দেখতে ভালো লাগে?

আজ অবশ্য তেমন বেশি সাজে নি সে, তবে অনেক আগ্রহ নিয়ে, অনেক সময় নিয়ে গুনগুনিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। মনটা ভালো লাগছে আজ। বিয়ের পরপর যেমন লাগতো। মাঝখানে একটা যুগ চলে গেছে, তা যেন হিসেবই নেই। মনের ভেতর কেমন একটা তোলপাড় করা সুখ। নিজেকে এখন ভাগ্যবতীও মনে হচ্ছে হৃদকমলের মত স্বামী পেয়েছে বলে। লোকটা খুবই নিরীহ আসলে। একটু ভীতু হলেও মন পরিষ্কার। দীপান্বিতাকে সমঝে চলার চেষ্টা করে। এতোদিনেও যে তাকে একটা সন্তান দিতে পারেনি এ নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। বরং এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে গেলে হৃদকমল নিজেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলে, যাতে দীপান্বিতা কোন হীনমন্যতায় না ভোগে। অনেকবারই সে তাকে বলতে চেয়েছে, চলো একটা সন্তান দত্তক নেই। কিন্তু বলতে গিয়ে নিজেই কেমন নিজের কাছে আটকে গিয়েছে। বলা আর হয়ে ওঠেনি। আসলে কিছু কথা আছে, যা বলা এত সহজ নয়। যুদ্ধটা দীপান্বিতার নিজের সাথে নিজের। ফার্টিলিটি সেন্টারের ডঃ রামেশ্বরম অবাক হয়ে বলেছেন, বোথ অফ ইউ সিমস এ্যাবসল্যুটলী এলিজিবল। আই ডোন্ট ফাইন্ড এনি প্রবলেম মিসেস কমল। হিজ স্পার্ম কাউন্ট এন্ড ইওর মেচুরেশন অব এগ্স, অল আর প্রীটি নরমাল। দীপান্বিতা তখন তার ওভারিয়ান সিস্ট এর কথা বলে। ডক্টর হাসেন। এটা কোন বিষয়ই না। একটা বয়সের পর সব মেয়েদেরই কমবেশি জরায়ুতে সিস্ট থাকে, কিন্তু সেজন্য গর্ভধারণে সমস্যা হবার কথা না। সায়েন্স হ্যাভ বিন ডেভেলপ্ড এ লট্, বাট স্টিল, দেয়ার মাস্ট বি সামথিং রিমেইন বিটুইন হেভেন এন্ড আর্থ; হুইচ উই, দ্যা ব্লাডি মেডিকেল ডক্টরস্ কেন্নট রিভিল! তিনি দার্শনিকের মতো বলেন। আজকের দিনে, যখন সে মনস্থির করে ফেলেছে সুলতানাকে নিয়ে যাবে, তখন এসব সে মনে করতে চায়না। গত বারো বছরে বহুবহু বার সে আশা করেছে আর প্রতিবার অনেক উঁচু থেকে পাথরের মেঝেতে আছড়ে পড়ার মতো, ভীষণ জোড়ে লেগেছে সে পতন! দীপান্বিতা জোর করে সুখের কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে চাইলো।

আজ নানিয়ার টেক থেকে ফিরতে দুপুর হেলে গিয়েছিলো। দূরত্ব কম নয়। কিন্তু শান্তনা হলো হৃদকমলকে ম্যানেজ করা গেছে। ম্যানেজ হয়েছে সুলতানার মা-ও। হবারই কথা। মেয়েটাকে ঢাকা নিয়ে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু তার আগে ওর রুক্ষু চুলের জট আর তার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা উকুনের বংশ শেষ করতে হবে। কী শুকনো আর কাঠির মতো হাত পা। আহা, কতোদিন ভালোকরে খায়নি ওরা। ওর মার হাতে দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলো সে এমনিতেই। মহিলা যে কারণ বললেন তা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো! নেশার জন্য স্বামী এই টাকা দুদিনেই শেষ করে ফেলবে। তারচে ওরা যদি সুলতানাকে নিয়ে যায়, তাহলে সেটাই বড় উপকার হবে। কথা বলতে বলতে দীপান্বিতার চোখ খুঁজছিলো সুলতানাকে। কোথাও নেই সে। থাকার কথাও নয়। নেকলেসটা চুরি করার লজ্জায় সে কাছে আসবে না। কিন্তু দীপান্বিতা জানে, সুলতানা আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। লুকিয়ে দেখছে ওদের। ওর মা বেশ কবার ওকে ডাকলো ওদের সামনে, তারপর জানালো, মেয়ে গত রাতেই তাকে ওদের কথা বলেছে। নেশার জন্য সন্তানদের চুরি করতে বলে ওদের বাবা। না করলে মারে তাদের মাকে। এ অবস্থায় বাচ্চাগুলোর চুরি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে র্দীঘশ্বাস গোপন করলো দীপান্বিতা। ফিরতি রিকসায় উঠে হৃদকমলের মান ভাঙানোর স্বরে বললো,

– লোকটা, তোমার দেয়া নেকলেস কি আমি হারাতে পারি?

– এতো নাটকের কী দরকার ছিলো বলোতো?

– কী বলছো, নাটক কেনো হবে?

– পুলিশকে বললেই তো…

– ছিঃ ওইটুকু বাচ্চা। ও কি বুঝে এসব করে? চকচকে জিনিস দেখে ভালো লেগেছে, খুলে নিয়েছে। শুনলে না, ওর মা কী বললো… ও হো, তুমি তো বোঝোনি। ওর বাবা নেশা করার জন্য বাচ্চাগুলিকে দিয়ে চুরি করায়!

– জানি!

– কিভাবে জানলে?

– লোকটার চোখ দেখে।… তুমি আমাকে যতো বোকা মনে করো, আমি ততোটা নই দীপা। জানি আমি তোমার পছন্দের পুরুষ হতে পারিনি। কিন্তু…

– বাব্বাহ। এতো অভিমান? তা চালাক মশাই, আপনার বুদ্ধির একটা প্রমাণ দিন তো। কী করে পিচ্চিটার ভয় ভাঙাতে পারি বুদ্ধি দিন না।

– বুদ্ধি দেয়ার কিছু নেই। সে আমাদের সাথেই আছে!

– মানে?

– পিছনে তাকিয়ে দেখো, রিকসার পেছনে বাদুড়ঝোলা হয়ে সে আমাদের সাথে সাথেই যাচ্ছে!

দীপান্বিতা চট করে পেছনে তাকাতেই পিচ্চিটা চলন্ত রিকসা থেকে লাফিয়ে নেমে গেলো। রিকসা থামিয়ে তাকে পাকড়াও করলো ওরা । কেন্নোর মতো সিঁটিয়ে গেছে লজ্জায়। আবার বুজতে পারছে, এই পরিস্থিতি থেকে ওরাই তাকে উদ্ধার করতে পারে। মেয়েটার হাতে একটা সস্তা ঝিনুকের মালা। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। দীপান্বিতা ওর পাশে বসে পড়ে সুলতানার চিবুক ধরে উঁচু করলো। কচি কালো মুখে ধূলো আর ঘাম। তার ভেতর দিয়ে চোখের জলের ধারা নেমে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট। হৃদকমলের বুকটা ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠলো কেনো কে জানে! পরক্ষণে যে দৃশ্য দেখলো তা দেখতে ভাগ্য লাগে নিশ্চয়ই। সুলতানা দু হাতে তার ঝিনুকের মালাটা দীপান্বিতাকে পড়িয়ে দিলো। তারপর ফিক করে হাসলো লাখটাকা দামের হাসি। মুক্তোর মতো একসারি দাঁত। কী স্নিগ্ধ লাগছে বাচ্চাটাকে! মেয়েটা যাতে ওকে জড়িয়ে ধরতে না পারে, তার আগেই ওর শীর্ণ হাতদুটো ধরে ফেললো দীপান্বিতা। এতো মায়া সে সামলাতে পারবে না। রাগী চোখ তুলে বললো, এই তুই আমাকে মা ডাকবি? উত্তরে সুলতানা বললো,

– আঁই তোয়ার পোয়ারে যাইয়াম! আমি তোমার সাথে যাবো। আর একই কথা বারবার বলতে লাগলো। হৃদকমল ভেবে পেলোনা, কতোটা মনের জোরে দীপান্বিতা পুরো বিষয়টা সামলালো। মনে মনে শ্রদ্ধা এসে গেলো তার ওর প্রতি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিলো, সুলতানা যাবে ওদের সাথে!

ছয়.

রেডি হয়ে হ্যান্ডব্যাগে কনুই গলিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে উল্টো তাড়া দিলে হৃদকমলকে, “কই চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে!” গাঢ় সবুজ জমিনের শাড়িটা অনেক কায়দা করে পড়া হয়েছে। কায়দাটা কি, সেটা বোঝা হৃদকমলের মতো আনাড়ী মানুষের পক্ষে বস্তুত সম্ভব নয়, কারণ কায়দাটা আসলে শাড়িতে নয়, ব্লাউজে! ময়ুরকন্ঠী নীলের সাথে সোনালী জর্জেটের সরু স্টেইট লাইনিং লাগানো থ্রি কোয়াটার স্লিভের ব্লাউজটি কাটার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাস্টারের বিলক্ষণ অসতর্কতা ছিলো বোঝা যায়! মাগোহ! মনে হচ্ছে জয়সলমীরের কেল্লা থেকে এইমাত্র ডাউনলোড হয়েছেন স্বয়ং রানীসা! ক্কী মারদাঙ্গা লাগছে দীপান্বিতাকে! বাপরে বাপরে বাপরে বাপ!… অন্যসময় হলে নির্ঘাৎ মুখঝাপটা বরাদ্দ ছিলো, কিন্তু আজ ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো সে নিজেই। হৃদকমলের পুরুষচোখের সামনে জড়তা নিয়ে আঁচল ঘুরিয়ে নিজেকে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। শাড়ী: একটি বিপদ-আহ্বানী পোশাক, ভাবলো সে। যা যা তুমি আড়াল রাখতে চাইছো, ঠিক সেসবই মানুষের সামনে আরও প্রকট হয়ে উঠবে। তবু সে শাড়ী পড়তে ভীষণ পছন্দ করে। হৃদকমলের আড়ে আড়ে তাকানোর ভঙ্গীতে সে আরও বেপরোয়া বোধ করলো। মুখের ভাব কোমল করে স্বামীর দিকে তাকালো সে। আরে, কফি রঙের চোখের মনিদুটোতে এতো মায়া! আগে তো কখনো খেয়াল হয়নি এমন করে? আর বাবু কী পড়েছেন আজ? দীপান্তিতা ইঞ্চি বাই ইঞ্চি হাজবেন্ডকে মাপতে লাগলো। ব্যাস্ পুরোদস্তুর ইভনিং এ্যাটায়ারে তৈরি তিনি। কালো স্যুটের সাথে রূপালি রেশমি রুমাল তিনকোনা উঁকি দিচ্ছে। সাথে গাঢ় নীল শার্টের সাথে স্লিম টাই। কর্পোরেট আদমি তো, এসব পার্টি ওরা ভালোই বোঝে, ভাবলো দীপান্বিতা। চোখে ভালোবাসার আলো ছড়িয়ে সে স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরলো।

– কুপনটা নিয়েছ? দেখোতো কী লেখা আছে।

– কী আর থাকবে; আগডুম বাগডুম সব। লিখেছে ডিনার এ্যাট সাম্পান। ড্রেসকোড পর্যন্ত বলা আছে। আর আছে র‌্যাফেল ড্র, ফর হানিমুন কাপল। মানে আমরা!

এক নিশ্বাসে সে বলে গেলো রসগোল্লার মতো চোখ করে। হানিমুন কাপল শুনে ওর বাহুতে আলতো ঘুষি মারলো দীপান্বিতা।

– ইশ্ কী কাপলের ছিরি! …আচ্ছা, সাম্পান লিখেছে কেনো?

– আগে চলো তো, গেলেই বোঝা যাবে। …হয়তো ওদের রুফটপ রেস্টুরেন্টের নামই সাম্পান। নতুন রিসোর্ট, প্রমোশনাল কতো কিছুই তো করবে।

কিন্তু গিয়ে ওদের ভুল ভাঙলো। রুফটপ নয়, জলজ্যান্ত সাম্পানেই ব্যবস্থা রয়েছে। রিসোর্টের প্রাইভেট বিচে নোঙর করে রাখা হয়েছে, যাতে জোয়ারের জলে ভেসে না যায়। কাঠের প্রশস্ত পাটাতনের ওপর সিলেক্টিভ গেস্টদের জন্য সুন্দর বসার ব্যবস্থা। একপাশে ইন্সট্রমেন্টসহ লাইভ মিউজিকের বন্দোবস্ত। আর আছেন, স্টান্ডিং কমেডিয়ান রাফি আব্দুল্লাহ। যিনি ইতোমধ্যে নিজেকে আবদাল্লা ঘোষণা করে মর্জিনার খোঁজ করছেন। বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকালো দীপান্বিতা। এই ভাঁড়টাকে দেখলে গা জ্বলে। কেনো যে সবাই ওকে সেলিব্রিটি বলে কে জানে? তার বিরক্তিভাব বুঝে গেলো হৃদকমল। কোত্থেকে একটা জুসের গ্লাস ধরিয়ে দিলো ওর হাতে। দীপান্বিতা এটুকুতেই কৃতজ্ঞতা বোধ করলো। তারপর আস্তে আস্তে হালকা গিটারের টুংটাং আর জলের শব্দ তার মনকে তরল করে ফেললো। খাবার পরিবেশনের আগে র‌্যাফেল ড্রতে হানিমুল কাপল হিসেবে তারা সত্যি সত্যি পেয়ে গেলো পুরষ্কারটা। কী আজব ব্যাপার। অনেক সুন্দরী আর হ্যান্ডসামের ভিড়ে তারা কী করে নজরে পড়লো? তখন আকাশের নীল অন্ধকার চিরে হাউই উড়ে গেলো হুস করে। আতশবাজীর বহুবর্ণি ল আলোকছটায় সারা সাগর আর আকাশ যেনো হাজারফুলে ভরে উঠলো। হৃদকমলের একহাতের বেষ্টনীর ভেতর সে দেখলো সবাই ওদের সুখীমুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর করতালি দিচ্ছে। সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ, পুরো পার্টিতে কেউ নিজের প্রতিভা দেখাতে গান গেয়ে ওঠেনি। স্যাক্সোফোন আর এ্যাকর্ডিয়ানের যুগলে বাজছিলো জ্যাজ। দীপান্বিতার মনে হচ্ছিলো এসব সত্যি নয়, হয়তো কোনো নিষ্ঠুর সুন্দর স্বপ্ন এটা, যা যেকোন সময় ভেঙে যাবে। হৃদকমল তার পাশেই আছে, কিন্তু কেনো যেনো তাকাতেও সঙ্কোচ হচ্ছে এখন। বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। অস্ফুটে চলে যাবার কথা বলতেই হৃদকমল বাধ্যপুরুষের মতো সায় দিলো। ঘোর লেগে আছে তার চোখেও।

কীকরে তারা রুমে ফিরেছে জানে না। তবে হৃদকমল যে তাকে পুরোটা সময় একহাতে জাপ্টে ধরে ছিলো, সেটা মনে আছে। রুম বন্ধ হবার আগে, লিফটেই তাদের দুজনের ঠোঁট লেগে গেলো। দীপান্বিতার মুখ দিয়ে ফোঁপানির মতো কান্না বা কান্নার মতো ফোঁপানির শব্দেও হৃদকমলের সম্বিত ফিরলো না। তারা নিজেদের বিছানার ওমের ভেতর আবিষ্কার করলো। দীপান্বিতার পিঠ কেবল ডাঙায় ওঠা শুশুকের মতো খাবি খাচ্ছে আর মিশরের রাণীর মাথায় ফণাতোলা সাপের মতো তার চকচকে অনাবৃত বাহুদুটো কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরছে হৃদকমলের মাথার দুপাশের চুল। কেঁপে কেঁপে ওঠা দুটো স্যাক্সোফোন আর এ্যাকর্ডিয়ান একটু পর একই তালে বাজতে লাগলো দ্রুতলয়ে, ক্রমাগত। শরীরের আগ্রহ এতোদিন তাদের কাছে এক যান্ত্রিক যোজনা ছিলো। একটা কচিমুখের প্রত্যাশায় যা সমর্পিত হতো। প্রকৃত শরীর তাদের ছেড়ে গেছে বহুদিন। আজ সাম্পানের ঢেউয়ের তালে সে সৈকতে আবার জোয়ার এসেছে। ভাসিয়ে নিচ্ছে দুজন অর্ন্তমুখি মানুষের জমে থাকা বরফের চাঁই! বরফযুগের শেষ প্রান্তে দীপান্তিতা শুনতে পেলো কোন গভীর অতল পাতালের নিচ থেকে হৃদকমল ডাকছে তাকে, ভূতি, এই ভূতি! কিন্তু সে ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বুজলো সে বহু আগেই নিস্তেজ ঘুমে তলিয়ে গেছে!

বেলা করে ঘুম ভাঙার কথা ছিলো। ভাঙলোও। কিন্তু সেটা লোকাল থানার ফোন পেয়ে। ডিউটি অফিসার নয়, ওসি সাহিদুর রহমান তাদেরকে মর্গে যেতে বললেন। মেয়েটার হাতে নাকি আঁকড়ে ধরা ছিলো হৃদকমলের কার্ড। আর এমন ঘটনাগুলো যেভাবে মোড় নেয়, এটাও সেভাবে সেভাবেই মোড় নিলো। প্রথমে ছোট নিউজ, তারপর সোশাল মিডিয়া, তারপর টিভির ব্রেকিং নিউজ এবং অপরাপর সবকিছুই ঘটলো খুব নিয়মতান্ত্রিক ভাবে। হৃদকমল পুরো সময়টা দীপান্বিতাকে চেয়ে চেয়ে দেখলো। বার বার শক্ত পাথরে আছাড় খেতে খেতে ওর কোন বিকার নেই যেনো। গ্রানাইট পাথরের মতো খোদাই করা মুখ নিয়ে সে হাসপাতালের মর্গে সুলতানার লাশ হয়ে যাওয়া শরীরটা দেখলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মরে গেছে বাচ্চাটা। অপুষ্ট হাতদুটো কাঁকড়ার মতো আকাশ ধরতে শক্ত হয়ে আছে। সারা শরীরে আঁচড় কামড়ের দাগ যেনো একশো শ্বাপদ তার শীর্ণ শরীরটাকে নিয়ে উল্লাসে লোফালুফি খেলেছে। টহলপুলিশের মতো সেই গুন্ডাগুন্ডা ঝাউবনের ভেতর পাওয়া গেছে ওর নিথর দেহটা।

থানা থেকে সকল ফর্মালিটি শেষ করে, এমনকি সুলতানার নেশাখোর বাপকে এ্যারেস্ট করে একপ্রস্থ ধোলাই দেয়া হয়েছে, এই সবকিছু শোনার পরেও দীপান্বিতার মুখাবয়বে কোন শূণ্যতা খেলা করলো না। সে যেনো পণ করেছে, জীবনের কোন ঘটনাতেই ভেঙে পড়বে না, চমকাবে না। থানার গেট থেকে বের হয়ে ওরা রিকশা নিলো। সাহিদুর রহমান গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। দীপান্বিতা নিষেধ করেছে। রিকসায় কিছুদূর যেতে যেতে, যেনো খুবই স্বাভাবিক কোন প্রশ্নের মতো সে হৃদকমলের হাতটা ধরে নাড়া দিয়ে বললো, দেখোতো, রিকসার পেছনে কেউ ঝুলছে কিনা!

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো হৃদকমল। আঁই তোয়াঁর পোয়ারে যাইয়ুম! কচিকণ্ঠটা কানে কানে বলছে! (সমাপ্ত)