সমারসেট মমের অলিখিত গল্প
১৯৬০ সালের দিকে দক্ষিণ ফ্রান্সের সাগরপারের এক ছোট্ট শহরে সমারসেট মমের সাথে সাক্ষাতের এক সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এই গল্প আমার সেই অনুভূতি- যা আমার জীবনের এক অভাবিত কথপোকথোনে রূপ নিয়েছিলো। - লেখক।
ইউরি নাগিবিন
অনুবাদ : তুহিন সমদ্দার
যখন তাঁর সাথে আমার দেখা হয় ইতোমধ্যে তিনি তখন কলম গুটিয়ে নিয়েছেন। পঁচিশ বছর আগেকার সেই দিনে যখন তিনি এহেন সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছিলেন যে, আর কখনো লেখালেখি করবেন না; যদিও নিঃসন্দেহে তাঁর লেখনী দীর্ঘদিন অনুগত ছিলো এবং বার্ধক্যে এসে তিনি দূর্বল কাঁধ আর অপ্রশস্ত বুকে বিভিন্ন অসুস্থতায় মগ্ন হবার পর সারাজীবন বইপত্তরের মাঝে কাটিয়ে দেয়ার কোন মানেই খুঁজে পাননি।
এ কথা বলার সময়- অনুভব করছিলাম- তাঁর চোখ তারুণ্যে আর নির্ভাবনায় চকচক করছে। জলভরা চোখে আমি দেখছিলাম বহু চমক আর বিস্ময়ের জন্মদাতা এই ব্যক্তিটিকে। তাঁর পরিধেয় নীল সামার জ্যাকেট, হালকা রঙের ক্রশ বেল্ট লাগানো ট্রাউজার আর ডিপ রঙের ঘড়ির বকলেস, যা তাঁর শীর্ণ কব্জিতে বাঁধা- সব মিলিয়ে এক দারুণ আভিজাত্য খেলা করছিলো।
তিনি রিভিয়েরা ছেড়ে তেমন কোথাও একটা যেতেন না। মেডিটারেনিয়ান সূর্যতাপে তিনি তাঁর বাদামী চামড়াকে আরও উষ্ণ করতেই পছন্দ করতেন আর বছরে একবার শুধু লন্ডনে যেতেন ওয়ার্ডরোবের জন্য নতুন কিছু সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। সবচে দামী টেইলার্সে স্যূট, ব্রান্ড জুতোর দোকান থেকে জুতো এবং বিশেষভাবে নজর দিতেন টাই আর রুমালের প্রতি। নব্বুই বছরের বুড়োর এহেন সাজসজ্জাকে খেলো মনে হতো না বরং তাঁর গল্পের চরিত্রগুলি- বিশেষত নায়িকাদের বেশভূষা নির্বাচনে তা অনেক সহায়তা করতো। এক্ষেত্রে শুধু বালজ্বাক আর প্রুস্তের সাথেই তাঁর তুলনা চলে।
মমের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো না যে সে অনেক দিনের প্রাচীন কোন ব্যক্তি বরং এরকম প্রাণবন্ত ভাবে বাঁচার কাজটি তিনি করছিলেন বেশ মেধার সাথেই। মনে হচ্ছিলো তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি তাঁর সমগ্র জীবনটি বেশ সক্ষমতার সাথেই পার করে গেলেন। যাহোক, তিনি নিজে হয়তো তাঁর সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে থাকবেন।
“আমার জীবনে’ মম শুরু করলেন- “এবং অনেকেই একে বেশ দীর্ঘ জীবন বলে শনাক্ত করে থাকেন (যদিও সেক্ষেত্রে তারা বেশ ভুল করেন বলে আমার বিশ্বাস) আমি প্রায় কিছুই শিখতে পারিনি। ভেবো না বিনয় করছি। যা আমি সেই শুরুর দিকে করতে পারতাম তা আজও আমার সাথেই রয়ে গেছে। আমার নতুন উপন্যাসটি কি ‘দ্যা মুন এন্ড সিক্স পেন্স‘ থেকে কোনোদিক থেকে উন্নত লেখা বলে মনে হয় ? তখনও আমি অর্থহীন, দূর্বল ভাষায় নিজের অনুভূতিগুলি একজন লেখক হিসেবে প্রকাশ করতে চাইতাম; কিন্তু সাহিত্যের সৃজনশীলতার প্রশ্নে তা সাম্প্রতিক লেখার চেয়েও জঘন্য! আর কেউ কি কখনো দেখেছে যে লেখকেরা বছরভর শুধু উৎকর্ষই লাভ করছে ? আমার মতে লেখকদের সৃষ্টিশীলতার বিষয়টি প্রাকৃতিক যে চলমানতা, তার বিনিময়ে লাভ করতে হয়। ডিকেন্স, হামসান, ফাল্লাদার শেষদিকের লেখা কি তাঁদের প্রথম দিকের লেখার চেয়ে উৎকর্ষপূর্ণ? আবার কেউ এর বিপরীত উদাহরণও খুঁজে পাবেন। তুর্গেনিভ এবং হেমিংওয়ে তাঁদের মধ্যে মাত্র দুটো উদাহরণ। কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রমী। নিয়ম হচ্ছে : একজন লেখক একদা কখনো জন্মান এবং চিরদিনের জন্য।’
“তাহলে কোন যুক্তিতে আপনি লেখালেখি বন্ধ করে কেবল স্মৃতিচারণের দিকেই বেশি জোর দিচ্ছেন ?’ “শোনো, লেখা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কলমের ডগায় চলে আসে তখন তাকে লিখতে পারা এক অভূতপূর্ব আনন্দ বৈকি! এবং এও সত্য যে এটা এক অভুতপূর্ব নিরানন্দও, যখন লেখা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হাতে আসছে না কিন্তু তাকে লিখতে চেষ্টা করা। তখন জীবনটা লেখকের জন্য সত্যি সত্যি নিরানন্দের হয়ে ওঠে। এই যে চারপাশে এতো এতো অপন্যাস আর দূর্বল গদ্যপদ্যের ছড়াছড়ি এটা কি হঠাৎ করে আমাদের ভেতরে জন্ম নেয় ভেবেছে ? যখন তুমি কোন গল্প লিখবে, হয় তুমি তখন চোখ বন্ধ করে এই চারপাশের বিস্তির্ণ জগতকে ভুলে থাকতে চাইবে কারণ এটা তোমার বিষয় থেকে আলাদা অথবা এই জগতের মধ্যে তুমি তোমার দৃষ্টিকে আরও বেশি আকীর্ণ করে রাখবে যাতে তার ভেতর থেকে তোমার যা প্রয়োজনীয় সেটুকু সংগ্রহ করতে পারো। এক্ষেত্রে তোমাকে খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস খেয়ালে রাখতে হবে, তাকে স্বচ্ছভাবে দেখার মতো ক্ষমতা তোমাকে অর্জন করতে হবে অনেকটা নোংরা আবর্জনার স্তুপের মধ্যে কাক যেমন করে কোন রূপোর চামচ, যেমন করে কোন সূবর্ণ গোলক, যেমন করে চকচকে তামার পয়সা খুঁজে ফেরে, অনেকটা তেমন। এই জগতটাকে তোমাকে একেবারে ভুলে গেলে চলবে না, তোমাকে এটা থেকে পাশ কাটাতে হবে অনেকটা পরজীবীর মতো। এবং একবার যখন হাত পাকা হয়ে যাবে তখন সবকিছুতেই আনন্দ আর বিস্ময় তুমি খুঁজে পাবে। তাজা ঘাসের উচ্ছলতা, গাছের ডালে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়া, পাখি কিংবা পাকাজামের ঘ্রাণ আর প্রকৃতির বিচিত্র সব রং … সবকিছুই জীবনে অপার আনন্দের উৎস হয়ে দেখা দেয়!
সৃজনশীলতার ভালো দিক হলো তা লেখককে এমন এক মায়ার ভেতরে আচ্ছন্ন রাখে যা তাকে নিজের আরো কাছে যেতে শেখায়। তুমি কি জানো যখন আমি নতুন কোনকিছু লিখতে বসি তখন কোন্ বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা জোগায় ? আমি তখন একটি মুখোশে নিজেকে ব্যপৃত রাখতে চেষ্টা করি। আমার সমালোচকেরা আমার লেখায় বর্ণনা বা চরিত্র বিশ্লেষণের যে ভুল বরাবর ধরে থাকেন যে- আমি যা লিখি, যাদের নিয়ে লিখি তা আদৌ আমার অভিজ্ঞতা প্রসূত নয়, এই বলে। কিন্তু আবার যখনই আমি স্বনামে গল্পে আবির্ভূত হই তখন তাঁরাই আবার বলেন এটা আমার ভীমরতিপ্রাপ্ত জোকারপনার একটা লেজুরগল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবিক এর কোনটাই অবশ্য সত্যি নয়। কেউ কাউকে ভেতর থেকে পুরোপুরি চিনতে পারে না। কিন্তু একজন অন্য কারো সম্পর্কে তখনই জানতে পারে যখন নাকি সে অন্যজনের কাছাকাছি যায় ঘনিষ্ট হবার কিংবা তার সাথে জুঝবার জন্য। জীবনভর আমি নিঃসঙ্গ একাকীত্বের মধ্যে কাটিয়েছি বলে যারা আমার ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি থাকার কারণে কিছুটা হলেও প্রভাবিত বা পরিবাহিত হয়েছেন এমন লোকজন বা বন্ধুবান্ধবদের চোখ দিয়ে আমি নিজেকে অনুধাবন বা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। মানুষকে কারো না কারোর ভেতরে নিজেকে প্রতিফলিত করে দেখতে হয়। কেবল তাতেই সে নিজের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারে। আমার গল্পের চরিত্রগুলি আসলে এক ধরনের প্রতিফলকের মতোই আবর্তিত- যেখানে, যাদের ভেতরে আমি খুঁজে ফিরেছি আমার আসল চেহারাকে।’
“কিন্তু কেনো কেউ শুধুমাত্র একটি অস্তিত্ত্ব হিসেবেই থাকছে না ?‘- আমি জানতে চাইলাম।
“তার আগে বলো এই ‘কেউ’ বলতে আমরা ঠিক কাকে মীন করছি ?‘ -এই বলে বুড়ো মৃদৃ হাসলেন। তার গমরঙা জ্যাকেটে সাগরের নীল খেলা করছিলো। “এটা সত্যিই রীতিমতো আবিষ্কার করার মতো একটা বিষয়। কোন গল্পের ন্যারেটর আমার কাছে যেকোন চরিত্র থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। যদি আমি গল্পে নিজের ভাব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকতে পারি কিংবা যদি এমন হয় দেখি যে আমি ঠিক ঠিক গল্পকে এগিয়ে নিতে পারবো, তাহলে কখনো আমি উত্তম পুরুষে লিখি না।’
“কিন্তু আপনিতো সবসময় উত্তম পুরুষে লেখেননি। মাঝে মধ্যে আপনি অবজেক্টিভ ফর্মে লিখেছেন।’
“হ্যাঁ, কিন্তু তাতে সবসময় আমি তৃপ্ত হতে পারিনি। শুধুমাত্র একবার থিয়েটারের ক্ষেত্রে আমি সফলভাবে এই ফর্মের প্রয়োগ করতে পেরেছিলাম। আমাকে অনেকে তখন বার্নাড শ‘র সাথে তুলনা করতেন। কিন্তু থিয়েটারে আমার পোষাচ্ছিলো না। কেননা আমি মনে করি একজন লেখকের দর্শকের সামনে নিজেকে হাজির করার কোনো প্রয়োজন নেই। শ’ তাই-ই করেছিলেন এটা সত্য, কিন্তু তা শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত আধুনিকতাকে উপলব্ধি করার জন্য, আÍ-আবিষ্কারের জন্য মোটেই নয়। ক্রিটিকরা নাট্যকার মমের হঠাৎ করে অন্তর্ধানকে তখনও ভুলতে পারছিলেন না, ততদিনে আমি ফিকশন ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি আÍজীবনীতে- যে ফর্ম আমার উদ্দেশ্যর সাথে মানানসই বলে আমি ভেবেছি, তাতে মগ্ন হয়ে গেছি।’
“আমি যতদূর জানি আপনি শুধু আপনার আÍজীবনীর একটি ক্ষুদ্রাংশ প্রকাশ করেছেন। এবং আপনার যাবতীয় চিঠিপত্তর সহ যাকিছু আপনার রহস্যময় ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে ফেলতে পারে তার সব ধ্বংস করে ফেলেছেন।’
“হ্যাঁ কারণ আমি কখনো বলিনি যে আমার সবকিছু আমি পাঠকদের কাছে প্রকাশ কিংবা ব্যাখ্যা করবো। আমি বলতে চাচ্ছি আমার আÍ-জ্ঞানের কথা। এই দুটো বিষয় একেবারেই ভিন্ন। কেনো কেউ শুধু তার নিজের জন্য কিছু সৃষ্টি করতে পারবে না- যেমন আমার কল্পিত গাউগুইন পেরেছে ? আজও আমি রোমাঞ্চিত হই, যখন মনে করি যে গাউগুইন তার সমস্ত চিত্রকর্ম সহ নিজের কুড়েঘরটি পুড়িয়ে ফেলতে পেরেছিলো! এটা খুবই পরিপক্ক মেধার কাজ। সৃজনশীলতার রাজ্যে এমনটি করতে পারার মতো হিম্মত থাকা চাই। আমি সবসময়ই আমার কিছু না কিছু কাগজ, নোটপত্র বা ড্রাফট পুড়িয়ে ফেলছি। কিন্তু পুরোপুরি কমপ্লিট হয়ে গেছে এমন কোন পাণ্ডুলিপি আমি নষ্ট করিনি, শুধু একটি ছাড়া, যেটা খুব একটা মানসম্মত হয়নি বলে আমি মনে করেছিলাম। আমি এমনকি ‘দ্যা ম্যাজিশিয়ান‘ নভেলটিও পুড়িয়ে ফেলিনি তখন আমার খুব টাকার প্রয়োজন ছিলো বলে। দূর্ভাগ্যবশত আধিকাংশ লেখকেরই টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়! কোটিপতির ঘরে লেখক খুব কমই জন্ম নেয়! মার্সেল প্রুস্ত তাঁদের মধ্যে একজন, আর কেউ কি আছেন ? কিন্তু এটা শুধু টাকা পয়সা রোজগারেরই বিষয় নয়। লিটারেচারের সাথে লেটারের বেশ ভালো একটা সাযুজ্য আছে। আর লেটার সবসময়ই কাউকে না কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখিত হয়। কিন্তু কেনো নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করেই সব লেখালেখি চালাতে হবে ? আবার ভবিষ্যতের নিরীখে আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন এক একটি সত্ত্বা। লেখকের মৃত্যুর পরে তার রাশি রাশি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে এমন নজির বিরল নয়। কিন্তু আমরা জানিনা ঐ লেখকের কতো কতো পাণ্ডুলিপি তিনি নিজেই পুড়িয়ে ফেলেছেন। সাহিত্য বলতে আমরা সেটুকুকেই নির্দেশ করি যা এখনো পুড়িয়ে ফেলা হয়নি কিংবা আবিষ্কৃত হয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে তা হয়তো অল্প নয়, কিন্তু প্রকৃত বিচারে এর কি কোন মানে আছে ? আরও বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা করলে বলা যায় যে, বিশ্বের লাখ লাখ গ্রন্থ যুদ্ধ, ধ্বংস, হত্যা, ভায়োলেন্স, মারামারি, মানবিকতা বিরোধী সকল কর্মকাণ্ড রোধ করতে পারেনি। তাই বলে কি সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে ? কিন্তু কেউ হলফ করে বলতে পারেন না পৃথিবী থেকে সকল সাহিত্যের অপসরণ হলে কোন্ অপশক্তির উত্থান ঘটবে। এজন্য কেউ কি সাহিত্যের এমন কোনো ক্রাইটেরিয়া বেঁধে দিতে পারেন যার মাধ্যমে কোন্টা প্রয়োজন আর কোন্টা প্রয়োজন নয় তা নির্ধারিত হবে ? এর মানে হলো কোনো লেখক তাঁর কোনো লেখার পাণ্ডুলিপি ইচ্ছে করলেই পুড়িয়ে ফেলতে পারেন না। হয়তো তার ঐ লেখায় কোন দৃশ্য বা কোনো ঘটনার এমন বর্ণনা আছে যেটা অন্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এবং এটা সমগ্র জীবনেরই একটি অংশ। হয়তো তা আমাদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় ঝরে পড়া পাতা বা ঘাস। সম্ভবত আমি আমার আÍজীবনীরও বেশ বড় একটি অংশ ধ্বংস করে ফেলবো। যদিও তা আমার ‘পোড়াবার নীতি’ ভঙ্গ করে নয়। আমার আন্দাজ, অনুমান, সন্দেহ, আমার ভয়, দ্বিধা ইত্যাদি সবকিছু আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বারোভূতে তাতে ভাগ বসাবে, সেটা আমি হতে দিতে চাই না। যখন আমি সব কিছুর উর্ধ্বে চলে যাবো, তার আগেই আমি সবকিছু পরিষ্কার করে রেখে যাবো!’
“লেভ তলস্তয় এমনটি করেননি।’
“লেভ তলস্তয় !… উনি কোন লেখকই নন, উনি আর সবার মতো নন, কিন্তু একজন মৌলিক শক্তি বলে আমি মনে করি। তাঁকে বিচার করা এতো সহজ কাজ নয়। তাঁকে কোন আইন কানুনের মধ্যে পুরে ফেলা সম্ভব নয়। তিনি স্বয়ং এক আইনের প্রতিভূ!’ এই বলে মম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। কিন্তু ঠোঁটদুটো কামড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ করে তন্ময় ভেঙে শিশুদের মতোন উচ্ছলতায় বলে উঠলেন “এমনকি তিনিও ভবিষ্যতবাণীতে আশাহত হয়েছিলেন। মনে করো, জিরাউদক্স বলেছিলেন ট্রয় ধ্বংস হয়েছিলো কেবলমাত্র দৈববাণীর কারণে। তাহলে আমি কোনো এখন তা বলবো না ? এ প্রসঙ্গে অনেক চিন্তা আমার মাথায় আসছে, কিন্তু তাকে লিখিত রূপ দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’
এসময় আমি মমকে জানালাম তাঁর কথার অর্থ আমি ঠিকভাবে বুঝতে পারছি না।
“কিন্তু এসব খুবই সহজ বিষয়! দেখো আনা কারনিনায় শুরুর উক্তিটি স্মরণ করো। সেই অভূতপূর্ব, গীতিময় শব্দগুলি- যা যে কোন অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের স্মৃতিতে আজীবন রয়ে যাবে: ‘সকল সুখী পরিবারের চেহারা একই ধাঁচের, কিন্তু সকল অসুখী পরিবার স্বতন্ত্র ধরনেই অসুখী।‘ কিন্তু যদি এই উক্তির প্রথমাংশ সত্য হয় তবে অসুখী পরিবারের অসুখীত্বও একই ধাঁচের হওয়ার কথা। অর্থাৎ প্রতিটি সুখী পরিবার তার নিজস্ব স্বতন্ত্রতায় সুখী; যেমন প্রতিটি অসুখী পরিবার অসুখী তার স্বতন্ত্র সমস্যা নিয়ে। এই বিষয় নিয়ে একটা গল্প লেখার পর্যাপ্ত সময় আমার নেই। এটা বস্তুত একটা সত্য ঘটনা। তুমি কি গল্পের এই প্লটটা আমার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেতে চাও ?’
আমি ঠিক ঠিক মমের ভাষায় গল্পটি পুনরায় বলতে অক্ষম। তবু আমি চেষ্টা করবো যতোটা সম্ভব তাঁর ভঙ্গী ও টোন অবিকৃত রাখতে। তারপরেও আমার মনে হয় আমি হয়তো তা ভালোভাবে পারবো না। কারণ মাঝখানে অনেক সময় চলে গেছে, তাঁর কণ্ঠস্বরের সেই দ্যোতনা আমার স্মৃতিতে নিঃস্প্রভ হয়ে গেছে অনেকটাই। মমের সাথে সাক্ষ্যাতের সময় যে নোট টুকে রেখেছিলাম তাও ছিলো দূর্ভাগ্যবশত সংক্ষিপ্ত।
প্রথমেই মম আমাকে তাঁর গল্পের নায়কের বর্ণনা দেন। এক্ষেত্রে তিনি ইচ্ছে করেই কিছুটা অস্পষ্টতা আরোপ করেন। গল্প বলার সময় মম তাকে ক্যাপ্টেন নামে ডাকতেন। তিনি এমনভাবে তার বর্ণনা দিতেন যাতে মনে হতো ঘটনাগুলি সম্পর্কে তিনি খুব একটা নিশ্চিত নন। হয় তিনি ক্যাপ্টেনের পেছনের ইতিহাস ভালোভাবে জানতেন না কিংবা হয়তো তিনি কিছু কিছু ভুলে গিয়ে থাকবেন কিন্তু তার পরিবর্তে নিজে কিছু সংযোজন তিনি করতে চাননি। ক্যাপ্টেন তার যুবক বয়সে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে এক জেটির সাথে জাহাজের ধাক্কা লাগিয়ে নিজের ক্যারিয়ারটাই ধ্বংস করে ফেলে। এই ঘটনার পরে তাকে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার মই আবার নতুন করে উৎরাতে হচ্ছিলো ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। এতে তার চরিত্রের কোন উন্নতি ঘটেনি। বরং সে আরও বেশি খিটখিটে আর অসামাজিক হয়ে পড়েছিলো।
এক অভিযানে গিয়ে ক্যাপ্টেনের জাহাজ ডুবে গিয়ে দীর্ঘদিন হেব্রিডিজের দ্বীপে আটকা পড়ে থাকতে হয়। কোন উদ্ধারকারী জাহাজের নজরে না পড়ার কারণে এ ছাড়া আর কোন উপায় তার ছিলো না। একা একা নিঃসঙ্গতায় প্রায় উন্মাদ হয়ে যাবার অবস্থাতেও সে সস্তা রং পেন্সিলে সাগরের দুরঙা বেশ কিছু স্কেচ এঁকে ফেলে। এরপর থেকে ক্যাপ্টেন তার পরবর্তী অন্যান্য অভিযানেও সময় কাটানোর জন্য একবাক্স অয়েল পেইন্ট সঙ্গে রাখতো। সে অবশ্য ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি কিন্তু ফিরে আসার পর স্কেচ প্যাডগুলি সে ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে তার সংগ্রহেই রেখে দিয়েছিলো। পোর্টের দক্ষিণে তার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ছিলো। একজন ছন্নছাড়া বন্ধনহীন ব্যাচেলরের মতো সে সকল পিছুটান- যা তাকে বেঁধে রাখতে পারে- ছেড়ে একা একা সময় কাটাতো। সে ভাবতো তার জীবনটা সে খুব ঈর্ষণীয় একাকীত্ব আর স্বাধীনতার মধ্যে কাটাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কোনরকম দায়িত্ববোধকে ভয় পেতো।
রমনীমোহন হিসেবে সে কখনোই কারো মনে দাগ কাটতে পারেনি। বলতে কি, হুইস্কি তার কাছে নারীসঙ্গের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিলো। সে একা একা পান করতে করতে বোতলের সাথে কথপোকথন চালাতে ভালোবাসতো। এবং এমনই গাড়ল যে, সবাই যখন তাকে ঘিরে আনন্দ করছে কিংবা আড্ডায় মত্ত তখনও সে সততার সাথেই নিজের গর্ধবপনার স্বাক্ষর রাখতো।
ক্যাপ্টেনের চোখে জগতের সকলেই বিরক্তিকর, বিশেষত তার বাবামা, যারা তাকে এই পৃথিবীর বুকে এহেন কুৎসিত শ্রীহীন চেহারায় জন্ম দিয়েছিলেন! তাদের ভাগ্য ভালো যে ক্যাপ্টেন শুধু শ্রীহীনই নন, তার উপরে বেঁটে, হাড্ডিসার আর বুড়োশকুনের মতো হাড়গিলে। তার স্মিত হাসিটি ছাড়া আর কিছুই তার পুঁজি ছিলো না যা দিয়ে কাউকে আকর্ষণ করা কোনক্রমে সম্ভব। তাও সেই হাসি কদাচিৎ হঠাৎ করেই তার চাঁদমুখে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যেতো। ক্যাপ্টেনকে এই হাসি ফোটানোর জন্য রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হতো। সে জানতো যে যখন তার ধারালো সাদা দাঁত পাতলা ঠোটের ফাঁক থেকে দেখা দিয়ে থ্যাবড়া নাকের দুপাশে দুটো ভাঁজ ফেলে মুখমণ্ডলে ভিন্ন এক ইপ্রেশন তৈরি করে তখন সেটাই মানুষ হাসি হিসেবে ধরে নেয়। যদিও এটি খুব বিরল তবু শুধু সেই সময়ই তাকে একজন মানুষ হিসেবে গোনা যেতে পারে।
শরীফ মেজাজে থাকা অবস্থায় ক্যাপ্টেন নিজের সম্পর্কে, নিজের শিল্পকর্ম সম্পর্কে বেশ উচ্চ ধারণা পোষণ করতো। নিজেকে তার প্রচণ্ড ট্যালেন্টেড বলে গালি দিতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আর সবকিছুর মতো আঁকাআঁকিতেও সে খুবই লাগামছাড়া আর সেটা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শেখার বয়সও তার তখন ফুরিয়ে গেছে…
এভাবে আস্তে আস্তে এমন হলো যে সে খাঁটি নিরানন্দের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একধরনের অর্থহীন অলীক সুখে নিজেকে ব্যপৃত করে রাখতে শুরু করলো। সাগর তাকে তেমন টানতো না; শুধু যদি লেগুনের নীল পানিতে সেইলিং করতে পারাই কোন বুড়ো জাহাজের জীবনে রোমান্টিক কোন কল্পনা না হয়ে থাকে, তবেই। মজার ব্যাপার হলো ক্যাপ্টেনেরও টাকার প্রয়োজন হতো বিশেষত বোতল আর রং কেনার জন্য! অন্ধকারে নিমজ্জিত হৃদয় নিয়ে কোন ব্যক্তি যদি নিজেকে নেলসন বা কুকের সাথে নিজের তুলনা করে ভাবে যে, একদিন সেও ইংলন্ডের বেলাভূমিতে তার জাহাজ ভেড়াতে সক্ষম হবে- তো তা অনেকটা শুকনো মাটিতে নৌকো চালানোর মতোই। ক্যাপ্টেন তার স্বপ্নের সেই শ্বেত শুভ্র জাহাজ- যা তাকে ক্রমে ক্রমে হত্যা কিংবা আÍহত্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো- তা ভেড়ানোর এই কাহিনী কাউকে, এমনকি নিজেকেও কোনদিন নির্ভয়ে শোনাতে চায়নি। গলা টিপে সে তার স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে কেবল হত্যা করে গেছে। তার তুলিতে কখনো যদি সেই স্বপ্নের কোন ছায়াও ভেসে উঠতো তবে সাথে সাথেই সে তা কালো ব্রাশের পোচ দিয়ে ঢেকে ফেলতো।
সে শুধু তার সামনে যা কিছু বাস্তবে দেখতো তাই-ই ক্যনভাসে ফুটিয়ে তুলতো। বালিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভাসিয়ে আনা জঞ্জাল, মোটর লঞ্চ, বার্জ, কার্গো শিপ, পানিতে ভাসমান তেল মবিলের পর্দার উপরে উরন্ত গাঙচিল, সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় কিংবা কখনো দু একটা শুকনো মানুষ যারা ল্যান্ডক্যাপের অংশ হিসেবে কখনো কখনো তার ছবিতে ধরা দিতো কখনো কখনো। সে কখনো পোট্রেট কিংবা স্টিল-লাইভ আঁকতো না। তার ছবিগুলি ছিলো একটু ভিন্ন ধাঁচের যেখানে ছবির সাবজেক্ট সবসময় সে নিজেও কিছু ঠিকভাবে নিশ্চিত করতে পারতো না। তার ব্রাশ আর তুলি তাদের আপন গতিতে চলতে চাইতো। সবকিছুই সেখানে এক অনিশ্চয়তা, অস্পষ্টতা আর উদ্দেশ্যহীন রেখায় জড়ানো থাকতো। কখনো কখনো বিপরীতক্রমেও সে সাবজেক্টকে উপস্থাপন করতো। ব্যকগ্রাউন্ডের কোন উপাদান হয়তো দেখা যেতো কাছের কোন উপাদানের চেয়ে আকারে বড়। পারসপেকটিভের এই অসামঞ্জস্য দিয়ে, ধুসর কালচে রঙের আধিক্য দিয়ে সে এক ভিন্ন জগতকে দৃশ্যমান করে তুলতো। অন্ধকার যেখানে সূর্যের প্রতিকল্প! অন্ধকারের হৃদয় নিয়ে ক্যাপ্টেন উজ্জ্বল বর্ণগুলিকে যেনো নিঃপ্রভ করে রাখতো। শিল্পের নান্দনিকতার দিক থেকে ক্যাপ্টেন ছিলো পুরোপুরি অপ্রাতিষ্ঠানিক। সে কখনো কোন যাদুঘর বা চিত্রশালায় ঢোকেনি এবং বিভিন্ন আর্ট স্কুলের ভিন্ন ভিন্ন অংকনরীতির সাথেও তার কোন পরিচয় ছিলো না। কিন্তু ক্যানভাসে অতিরিক্ত রঙের প্রলেপ দিয়ে তাতে আরো আরো মাত্রা বিন্যাসে নিজের মতো করেই সে আঁকতে চাইতো। এ ছাড়া অবশ্য অন্য কোন পথও খোলা ছিলো না। অন্যের আঁকা ছিলো তার দু চোখের বিষ। সে কেবল নিজের আঁকা ছবিই পছন্দ করতো, এবং তা শুধু তখনই- যখন সে শরীফ মেজাজে থাকতো। কিন্তু যখন সে প্রচুর গিলে একদম টাল হয়ে যেতো তখন নিজের প্রতিভার প্রতি সকল বিশ্বাস সাগরপারের অগভীর ঘোলা জলে ডুবে যেতো…
ক্যাপ্টেনের আঁকা ছবির বর্ণনা করার মতো তেমন কিছু নেই যদিও সে কালে কালে একটি সময়ে বেশ নাম করে ফেলে। একটা সময় এমন হলো যখন সে একজন সেলিব্রিটির মর্যাদাও পেতে শুরু করলো। তার জীবনাচরণ ও চিন্তাভাবনা- বিশেষত যুবশ্রেণীর ফ্যাশনে পরিণত হলো।
এরপর সে পার্শ্ববর্তী অন্য এক শহরে আনাগোনা শুরু করলো। ছোট্ট ঐ শহরের লোকজন অতি সামান্য বিষয় নিয়েও বেশ মাথা ঘামাতো। তারা ক্যাপ্টেনের বিষয়টাকে আড্ডার প্রধান বিষয় বলে লুফে নিলো। শহরের লোকগুলি পরচর্চায় পটু হলেও কার্যকারণহীন ভাবে তাদের মনটাও বেশ নরম ছিলো। তারা এই নাবিক-শিল্পীর ছবিগুলি নিয়ে কফির কাপে ঝড় তুলে ফেললো। নাবিক জীবনের নিঃসঙ্গতা আর অসুখীত্ব, ব্যক্তি ক্যাপ্টেনের আধ্যাত্বিক প্রসারতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে পড়লো।
ঐ শহরে (মম ইচ্ছে করেই শহরের নামটি গোপন করে গেছেন) আরো ছিলো একজন বিশ্বখ্যাত আর্কিওলজিস্ট যিনি তার পেশাগত জীবনের অধিকাংশ সময় আফ্রিকাতে কাটিয়েছেন। তিনি বেশ তরুণ বয়সে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং শীঘ্র শীঘ্র রয়েল সোসাইটির সদস্যপদও লাভ করে ফেলেন। তারপর ধাপে ধাপে আর্কিওলজি সোসাইটির সভাপতি এবং আদি ইউরোপীয়ান একাডেমীর অনারারি মেম্বারশীপ লাভ করেন। তিনি বহু স্বর্ণপদক পেয়েছেন এবং মোটা মোটা বহু গবেষণাধর্মী পুস্তক রচনা করেছেন। দেখে শুনে মনে হয় যেনো এ এক ভিন্ন জগত, যা প্রাত্যহিক সাদামাটা কিংবা একঘেঁয়ে জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জোনস তার আবছায়া সামাজিক অবস্থিতির জন্য মোটেই ভাবিত ছিলো না। সে বিজ্ঞান ভালোবাসে- এটাই ছিলো তার সব। সে যখন ভূত্বকের অভ্যন্তর থেকে আহরিত হাজার হাজার বছরের প্রাচীন হাড়গোর কিংবা একখণ্ড ভাঙা তৈজসের টুকরো গভীর মনোনিবেশের সাথে পর্যবেক্ষণ করতো, তখন ঐ বিষয়গুলির প্রতি তার ভালোবাসা আর অনুরাগ ছিলো তার স্ত্রী, পুত্র কিংবা চিত্রকর্মের প্রতি ঠিক ততোটাই। এবং এহেন সিরিয়াস মানুষটির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো এই যে, সে টেনিসে রীতিমতো একজন তুখোড় খেলোয়ার ছিলেন। শক্তপোক্ত, চওড়া হাড়ের জোয়ান শরীরে তাকে মানাতোও বেশ। শারিরীক সুস্থতা তার এ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ অভিযানের ক্ষেত্রে বেশ সাহায্য করতো বলে সে নিজেকে ফিট রাখার জন্য নিয়মিত যত্ন নিতো।
অন্যান্য সৌভাগ্যর পাশাপাশি প্রকৃতিদেবী তাকে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর অভিব্যক্তি দান করেছেন। জোনসের অল্পবয়সে মাথায় টাক পড়ে যায়। কিন্তু এই টেকো মাথার কারণেই তার মাথার বড় খুলিটি আর প্রশস্ত ললাট স্পষ্টভাবে দেখা যেতো। মসৃণ আর সঠিক আকারের বাদামী চামড়ায় মোড়ানো মাথার পেছনদিকটা চকচকে পরিপাটি করে আচঁড়ানো চুল আর তার নিচেই মানানসই ঘাড়- সবমিলিয়ে তার চেহারায় এক বুদ্ধিদীপ্তি ছড়িয়ে রাখে। এর পাশাপাশি প্রশস্ত ঈষৎ ঢালু কাঁধ আর বলিষ্ঠ বাহু তাতে আর একটি মাত্রা যোগ করেছে।
এই অসাধারণ দৈহিক গঠন জোনস পেয়েছে তার এ্যাংলো-স্যাক্সন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে। ফর্সা, দীর্ঘ আর একহারা- যেনো প্যাঁচানো স্প্রিংয়ের ক্ষিপ্রতা! কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই একই গঠন তার একমাত্র পুত্রের শরীরে নেই যাকে সে তার প্রত্নতত্ত্বের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ছেলে পেয়েছে তার মায়ের ধাঁচ। ফর্সা কিন্তু গোলগাল, কালো পাপড়ির নিচে নীল চোখ আর লালচে সোনালী চুল। অপ্রশস্ত কাঁধ আর সমতল বুকের খানিকটা মেয়েলি ধাঁচের সন্তানকে নিয়ে জোনসের দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। সে নিজে ঐ বয়সে ছিলো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আর খেলাধুলায় পটু। ছেলের মুখে যখন বালকসুলভ লাজুকতা সে দেখতে পায় তখন মনে মনে এর ভবিষ্যত নিয়ে জোনসের বুক ধ্বক ধ্বক করে ওঠে। এই হাসি দেখে কারো অসহায়ত্ব আর সরলতা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। তার মায়ের এমনই হাসির কারণে সে নিশ্চিত জানে স্বামীকে আজীবন ভালোবেসে যাওয়া ছাড়া মেরীর আর কিছু করা সম্ভব নয়। যা অনেক সময়ই তাকে একঘেঁয়েমির স্বাদ নিতে বাধ্য করে। জীবনে যদি কোন এডভেঞ্চারই না থাকে তবে তা কিসের জীবন? জোনস এমন করেই ভাবে, কেননা ম্যাদামারা নিস্তরঙ্গতা তার দু চোখের বিষ!
এই নরম হৃদয় সুন্দরী রমণী এমন এক পরিমণ্ডলে বাস করে যেখানে তার নিজের জগতটা স্বামী সন্তানের প্রতি ভালোবাসার ভেতরেই আস্পৃষ্ট। আর পিতা-পুত্র উভয়ে তার সাথে এমন আচরণ করে, যেনো মেরি কোন দুঃস্প্রাপ্য চিনামাটির তৈজস -যাকে সবসময় সাবধানে নাড়াচাড়া না করলে হাত থেকে ফসকে পড়ে যেতে পারে। মেরির ইচ্ছা অনিচ্ছা তার ভালোলাগা ইত্যাদি সব যেনো তারা বুঝে বসে আছে, তাকে এক অদৃশ্য বোরখার মধ্যে তারা আটকে রাখতে পারলে বাঁচে! কিন্তু মেরি তা পছন্দ করে না। সে চায় নিজের ব্যক্তি ন্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিতে। যখন তার স্বামী বা ছেলে, কেউ একজন অসুস্থ থাকে তখন মেরি এই ভেবে আনন্দিত হয় যে তারা অন্তত কিছু সময়ের জন্য খবরদারী করতে পারবে না এবং ঐ কটা দিন সে শান্তিতে তাদের অসুস্থতায় নার্সিং করতে পারবে। তা না করতে পারলে মেরির সেবাপ্রবণ মনটা যে শান্ত থাকতে পারে না!
এহেন সেবাঅন্ত-প্রাণ মহিলা এসেছে এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এবং তার জীবনের ইচ্ছা ছিলো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হওয়া যেখানে সে দূর্বল ও অর্বাচীনদের দেখভাল করার যথেষ্ট সুযোগ পাবে। জোনসের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পেছনে আসলে তেমন কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। কেননা জোনস তাকে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যায় এবং প্রপোজ করে। মেরি দেখলো, পাত্র হিসেবে জোনস পছন্দ করার মতো এবং তার চরিত্রের গূঢ় গভীরতা অনুধাবন করার আগেই- আসলে এমন কিছুর অস্তিত্ব বোঝার ক্ষমতাই সে সময় তার ছিলো কিনা ঈশ্বর জানেন- জোনসের পেশাগত খ্যাতি ইত্যাদিতে আবিষ্ট হয়ে মেরি ঐ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। হঠাৎ করেই সামাজিক মর্যাদা উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে প্রথমটায় মেরি বিয়ের পর কিছুদিন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলো কিন্তু অতি দ্রুত তা কাটিয়ে উঠে একজন প্রতিশ্রুতিশীল প্রত্নতত্ববিদের স্ত্রী কিংবা একটি খানদানী বংশের কর্ত্রী হয়ে ওঠে। হাজার হোক একজন গরীব স্কুল শিক্ষিকা হবার তুলনায় এটা ঢের আকর্ষণীয়। তার যুবতী দেহমনের প্রথম স্বপ্ন হয়ে ওঠে লালচে বাদামী রঙের এক ইন্ডিয়ান রক্তের অসাধারণ পুরুষ- যিনি প্রায় ফেনোমেনন হিসেবে সমাজে খ্যাত এবং মেরির কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্খিত, সবচেয়ে প্রেমময় ব্যক্তিটি।
এবার তাহলে মেরির কিছুটা বর্ণনা দেয়া যাক। গাঢ় নীল চোখ, কমনীয় মুখশ্রী আর অসাধারণ দৈহিক বিভঙ্গের কারণে তাকে সবসময় ফ্রেশ দেখায়। অথচ উগ্রতার লেশমাত্র তার মধ্যে নেই, বরং তার বদলে করুণায় আর্দ্র চাহনী সবসময় সংশয়ীদের আশা জোগায়। যেনো তার দয়াময় হৃদয় সবসময় দুঃখিতের নিরব আকুতি অনুধাবনে সক্ষম, যা অন্য কেউ কখনো বুঝবে না। চারপাশের জগতটা যেনো মারী ও দূর্যোগে ছেয়ে আছে। গাছপালা পাখি ফুল সবাই যেনো বাঁচার জন্য আপ্রাণ আশ্রয় প্রার্থনা করছে- মেরি এভাবে ভাবে। জোনস কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করে যে মেরি একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া। সেই অর্থে সেও, কিন্তু মেরির মতো এমন করুণার্দ্র হয়ে আর যা-ই হোক একজন আর্কিওলজিস্টের জীবন চলতে পারে না। সে যে মেরির মতো করে স্বার্থহীনভাবে নিজেকে চালিত করতে পারবে না এটা বুঝে নিয়েই জোনস আর তার সাথে সমান পদক্ষেপে পা ফেলতে চায়নি। আবার মেরিকে তার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতেও সে চায়নি। পাছে মেরি মনে কোন চোট পায়। এই সবকিছু মিলিয়ে মেরির দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্য তার স্বামীকে একই ছাদের নিচে থাকার পরেও দূরবাসী দ্বীপের বাসিন্দাই করে রেখেছে। যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যতোটা না উপর থেকে বন্ধুত্বের, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে ভেতর থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সেবার এক অমৃতসমান ঘ্যাঁট!
মেরি বিমূর্ত শিল্পের নান্দনিকতা তেমন বুঝতে পারে না। জোনস যখন বিভিন্ন চুটকি বলে, যখন সে হেসে হেসে মাথা দোলায় কিংবা দুষ্টুমিপূর্ণ বিভিন্ন গল্প তাকে শোনায় তখন মেরি একনিষ্ঠ শ্রোতার মতো তা শোনে ঠিকই কিন্তু গল্পের সমাপ্তিতে সে বোকা বনে যাওয়া বা হেরে যাওয়া চরিত্রটির জন্য করুণা প্রকাশ করে- তাতে প্রকৃতপক্ষে জোনসের গল্প বলার আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। তার মনে হয় মেরির এই সমস্যা মূলত মিডলক্লাশ সেন্টিমেন্ট ছাড়া আর কিছুই নয় এবং তার একমাত্র সমাধান হতে পারে প্রচুর অর্থসম্পদের মধ্যে তাকে ডুবিয়ে দেয়া। মেরি যা যা করতে চায়- যেমন এতিম বা পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের জন্য যে সব চ্যারিটি, সেসব দিকে তাকে যেতে জোনস উৎসাহ জোগায়। এমনকি সংসারের খরচের একটা বড় অংশ ঐ সব দুঃস্থদের সেবার জন্য ব্যয় করতেও সে পিছপা নয়। এর পেছনে সোসাল ওয়ার্ক করার তৃপ্তি যতোটা, তার চেয়ে বেশি হলো মেরিকে কোন কিছুতে ব্যস্ত রাখা বা চাঙ্গা করা।
এভাবে দেখলে জোনস খুবই দয়াবান ব্যক্তি, বিশেষত তার স্ত্রীর প্রতি; কিন্তু অযথাই। আবার অন্য দিক থেকে দেখলে এ ছাড়া তার কোন উপায়ও নেই। কারণ জোনস-গিন্নি যদি ঠিকভাবে সংসার সামলাতে না পারে, যদি সে প্রতিদিনকার রুটিনমাফিক অঢেল কর্তব্যস্তুপ অতিক্রম করতে না পারে এবং তার পেছনে যদি দায়ী হয় ঐ নচ্ছার সহায়হীন দুঃস্থ মানুষের আর্তচিৎকার তাহলে তা যে জোনসের চলমান জীবনেও গতিরোধ করবে এটুকু জোনস ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। তাই তাকে হেঁসেলের কর্ত্রী, স্বামী সন্তানের প্রতি অনুগত, অতিথি পরায়ণ, এক্সিবিশন, থিয়েটার, কনসার্ট, চ্যারিটি, সোসাইটি, সোসাল ওয়র্ক- যেখানে চর্বির স্তুপ-সর্বস্ব কুঁড়ের বাদশা স্লিভসেল ব্লাউজেরা এন্তার কফি আর এরারুট বিস্কিট ধ্বংস করে- সেদিকেই চালিত করতে হয়েছে। সে চেয়েছে আর একটু স্মার্ট আর একটু ফর্মাল হোক তার বৌ!
এরইমধ্যে একদিন জোনসকে একটি বিপদসংকুল ও লম্বা অভিযানে বেরুতে হলো। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাদের সন্তান কাছেই ছিলো কিন্তু এখন সে কলেজে উঠেছে বলে অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার পর এই প্রথম জোনসের এতোদিন বাইরে থাকা। মেরির সময় যেনো কাটতেই চায় না। আগে তাও ছেলেটাকে নিয়ে সময় কেটে যেতো। মেরি তাই অগত্যা তার সেবাকর্মে বস্তিতে বস্তিতে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়তে চাইলো। কিন্তু মাঝে মাঝে এই সকল কাজের মধ্যে যে অন্তসারশূণ্যতা, তা তাকে বিদ্ধ করতো। মনে হতো অর্থহীন। এভাবে গরীবকে, বিত্তহীনদেরকে উন্নত জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তার মনে হতে থাকে নিজের সংসারেই তার আরও বেশি কিছু করার ছিলো, কর্তব্য ছিলো যা সে ঠিকভাবে পালন করেনি।
নিজের স্বামী সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় সে কাতর হয়ে পড়লো। তারা যাতে নির্বিঘেœ বাড়ি আসে এজন্য সে মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলো কিন্তু যখন তারা সত্যি সত্যি ফিরে এলো তখন সে আদৌ তেমন খুশি হতে পারলো না। তাদের অতি সাবধানী গার্জেনগিরি তাকে জীবনের সত্যিকার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে লাগলো।
এই তিনটি মানুষের একে অপরের প্রতি ভালোবাসাবোধ কারোরই দোষকে সরাসরি চিহ্নিত করে না। তবু এই আপাত-সুখী পরিবারের ভেতরেই ক্যাপ্টেন তার সম্ভাব্য সকল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে অনুপ্রবেশ করে!
যদিও ক্যাপ্টেনের আসলে কোন আকর্ষণীয় ক্ষমতাই ছিলো না। প্রায় সবসময় নেশাগ্রস্থ, বিরক্তিকর, অসামাজিক এবং এমন বেয়াদব যার সামাজের কারো বা কিছুর প্রতিই কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই। কিন্তু মেরির দিক থেকে চিন্তা করলে এহেন চরিত্র তার কাছে লুফে নেবার মতো একটি কেসই বটে। এই পৃথিবীটাকে যদি পীড়নের সমুদ্র ধরি তাহলে ক্যাপ্টেন হলো সেই সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে ওঠা যন্ত্রণারূপএক শুশুক- যে নিয়ত জ্বালা, ক্ষোভ আর একাকীত্বের নিঃশব্দ আকুতি নিয়ে খাবি খাচ্ছে…
জোনসের সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো এক চিত্র প্রদর্শনীতে। সে তার একটা ছবি দেখছিলো এবং মেরিকে বোঝাচিছলো ছবিটার নান্দনিকতা কতটুকু। মেরি যখন ল্যান্ডস্কেপটির অন্তর্নিহিত নিঃসঙ্গতার ক্রন্দন টের পেলো, তখন তার কাছে বিষয়টি বেশ পরিষ্কার হয়ে গেলো। ক্যাপ্টেনের সাথে তখন তাদের পরিচয় হয়- রক্তাভ চোখ, কালচে লাল জেলী রং কোঁচকানো জ্যাকেট, হুইস্কির গন্ধভরা ভারী নিঃশ্বাস, যার সাথে কড়া তামাকের ঘ্রাণ মিলেমিশে এমন দমবন্ধ অবস্থা। জোনস যেনো একটা ধাক্কা খায়। তবু তাকে সামলে নিতে হয়। আর ওদিকে মেরি তার সমস্ত উদারতার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে ক্যাপ্টেনকে নিঃশব্দে কৃপা করে যেতে থাকে। সে অবাক হয়ে আঁকিয়ে এবং ঐ শিল্পকর্মগুলির মাঝে একটা সাজুয্য খুঁজে পায়।
জোনস এই ব্যক্তিটির মধ্যে কোনরকম হুমকির আশঙ্কা না করে তাকে তক্ষুনি একটি রেঁস্তোরায় রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ জানায়। ক্যাপ্টেন উত্তরে শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে। নিমন্ত্রণে ঐ চিত্রশালার মালিক স্মিথ- জোনসের সাথে তার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব- সেও ছিলো। ক্যাপ্টেন রেঁস্তোরায় কারো সাথে একটা কথা বললো না, কিছুই খেলো না, শুধু একমনে মদ খেয়ে যেতে লাগলো।
“আপনি এতো ড্রিঙ্ক করছেন কেনো ?’ মিসেস জোনস তাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে একটু ঝুঁকে লোকটাকে বুঝতে চেষ্টা করে। তার কষ্ট কিংবা সমস্যা যা-ই থাকুক না কেনো মেরি এক হাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের ময়লা হয়ে যাওয়া জ্যাকেটের হাতার কাছটা খামচে ধরে!
“মদ গিলছি তো তাতে আপনার কী ?’ খেঁকিয়ে ওঠে ক্যাপ্টেন। সে খেয়াল করে গোলাপি রঙের চাপাকলির মতো নমনীয় সুন্দর আঙুলগুলি তাকে ছাড়ছে না বরং তা আরও অন্তরঙ্গ হতে চাইছে। “ দুশ্বালা, আমি মনে হয় শীঘ্রি পাগল হয়ে যাচ্ছি’ ক্যাপ্টেন র্বির্বি করে ওঠে। ওদিকে স্মিথ একটানা বকবক করে জোনসের মাথা প্রায় ধরিয়ে দিয়েছে। ক্যাপ্টেন টানছে তার উৎকট ঘ্রাণের পাইপ-সবমিলিয়ে বাজে এক পরিস্থিতির মধ্যে তারা খাওয়া সারলো। বিদায় নেয়ার আগে জোনস যেচে পড়ে ক্যাপ্টেনের স্টুডিও দেখতে যেতে উৎসাহ দেখালো।
“হাহ্ আমার কোন স্টুডিও-ফিস্টুডিয়ো নেই।’
“আপনি কি ছবি বিক্রি করছেন না ?’
“করতে তো চাই, কিন্তু কেউ আমার ছবি কেনে না।‘
“সেকি’ একথায় স্মিথের চমক ভাঙে। যাদুঘর কর্তৃপক্ষ না তোমার দুটো ক্যানভাসের ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করেছে… ?’
’হাহ্ বাদ দাও এসব’। ক্যাপ্টেনের মেজাজ চড়েছে “কেউ আমার ছবির ব্যাপারে আগ্রহ ফাগ্রহ দেখায়নি।“
“ ইয়ে, যদি আপনার উল্টানো নৌকার দৃশ্যের পেইন্টিংটি বিক্রি হয়ে না থাকে তাহলে আমি ওটা কিনতে চাই।’ বিনয়ের সাথে জোনস জানালো।
“ওব্বাবা, আপনিতো দেখছি শি-শিল্প সমঝদার!’ বলতে না বলতেই হঠাৎ করে ক্যাপ্টেন হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে লাগলো।
মেরি চট করে একপা সামনে বাড়িয়ে পেছন থেকে তার পতন ঠেকালো। মেরি অনুভব করলো শুধু হাড্ডি ছাড়া ক্যাপ্টেনের শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ক্যাপ্টেন ধাতস্থ হয়ে রুমাল বের করে সশব্দে নাক ঝাড়লো। ‘ধন্যবাদ” যেনো মেরিকে নয় নিজেকেই শোনাচ্ছে। “এমন একজন ভালো মহিলা হিসেবে আপনার এর চেয়ে বেশি কিছু পাওনা হয়ে গেছে।’
“আমি মোটেই ভালো মেয়ে নই। এ রকম ধারণা আপনি পেলেন কি করে ?’
এর উত্তরে ক্যপ্টেন হেসে উঠলো। এবং হাসলে যে তাকে সুন্দর দেখায় শুধু সে জন্যই তার মুডও অনেকটা ভালো হয়ে গেলো। “আপনি কি ঐ ছবিটি পেজেন্ট হিসেবে নিতে চান ?’
“না।‘ জোনস শান্তভাবে উত্তর দিলো। “আপনি বরং একটি দাম ধরুন। আর ভালো হয় যদি এই প্রদর্শনী শেষ হবার পর ছবিটা আমরা নিতে পারি, তাহলে।’
“তাকে জিজ্ঞেস করুন।’ ক্যাপ্টেন ইশারায় স্মিথকে দেখিয়ে দিলো। “বেচাকেনার বিষয়আশয় আমি কিছু জানি না।’
উত্তরে জোনস তার হাতের গ্লাসটি ক্যাপ্টেনের সম্মানে উঁচু করে ধরলো।
বিকেলটা যতোটা আশা করা হয়েছিলো তার চেয়ে ভালোই কাটলো। স্মিথ জানতে চাইলো কেনো ক্যাপ্টেন বিশাল জলের বিস্তৃতি আঁকতে চায় না ?
“বিশাল জলে বলতে তুমি ঠিক কী বোঝাচ্ছো ?‘
“সমুদ্র। উন্মুক্ত সমুদ্র। তুমি সবসময়ই বেলাভুমির অনুসঙ্গ হিসেবে সাগরকে আঁকো। তুমি হলে সমুদ্র থেকে মুখ ফেরানো, ভীত এক আঁকিয়ে যে কেবল সৈকতের বালি আঁকো।’
“হাহ্ তুমি কখনো সমুদ্রকে আঁকতে পারবে না।’ ক্যাপ্টেন তার স্বভাবসুলভ খেঁকিয়ে ওঠার বদলে অনেকটা শান্তভাবেই উত্তর দিলো। “টার্নার এটা আঁকতে পারেননি এবং অন্যান্য যারা আছেন সকলেই এতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখনো পর্যন্ত কেউই সমুদ্রকে ঠিক ঠিক আঁকতে পারেনি। যারা আজীবন দ্বীপে বাস করে তারা কি জানে সমুদ্র আসলে কী ?’… বলতে বলতে ক্যাপ্টেনের ভেতরে উত্তেজনা বাড়তে লাগলো। ক্রমে তার বাক্য অসংলগ্নতায় পৌঁছালো বলে মেরি তার একটি শব্দও ঠিক করে বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে আজীবন যে রহস্যকে বিশ্বাস করে এসেছে- সেই সমুদ্রের কথা এই উড়নচণ্ডী লোকটা ওহ্ কী চমৎকারইনা বলছে, আর বলছেইবা কতো চমৎকার ভাষা-ভঙ্গীতে! সমুদ্রকে কখনো পুরোপুরি আঁকা যায়না, ওয়ান্ডারফুল! ক্যাপ্টেন এখন চুপ করে আছে। সে তার গ্লাসে বোতলটা উপুর করে শেষের কয়েক ফোঁটা হুইস্কি ঢাললো। সেটুকু খুব সন্তর্পনে চুমুক দিয়ে খেতে খেতে জড়ানো গলায় বলতে লাগলো “একাগ্রতার সপ্ত চুঁড়োয় পৌঁছে গেছি। যথেষ্ট হয়েছে। এবার তাহলে ঘরে ফেরা যাক চাঁদ!’
“কী দারুণ ভাষায় লোকটা বর্ণনা দিচ্ছিলো, তাই না গো ?’ বাড়ি ফিরে মেরি তার স্বামীকে বললো।
জোনস সায় দিলো। “ আমি শুধু দেখছিলাম প্রতিভার প্রচণ্ডতায় লোকটা কী ভীষণ অসুস্থ!’
“তারপরও সে একদমই একস্ট্রা অডিনারি কী বলো ?’…
“আমি জানি না সে মানুষ হিসেবে কি রকম, কিন্তু সে খুবই ইন্টারেস্টিং একজন পেইন্টার। এমন সাধারণত দেখা যায়না।’ জোনস চিন্তিতভাবে বললো। “আমি বুঝি না শিল্প প্রতিভার সাথে নেশা করার কী সম্পর্ক থাকতে পারে ? পাগলাীরই বা কী যোগাযোগ ?’
“তোমার মুখে এসব বলা খুব সোজা।’ জোনস-গিন্নি মনে মনে বললো এবং তার দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এই প্রথম বারের মতো সে স্বামীর প্রতি নির্জলা ক্ষোভ অনুভব করলো। “তুমি সবসময় জীবনের আলোকিত দিকটা নিয়ে বাঁচতে চাও জোনস। ভেবে দেখোতো, বেচারা কতোটা অসুখী ?’ জোনস তার স্ত্রীর দিকে একঝলক তাকিয়ে সেখানে লজ্জার আভাস দেখতে পেলো।
এভাবে ঐ শহরে থেকে থেকে ক্যাপ্টেনের পরিচিতি বাড়তে লাগলো। জোনস তার বাড়ির ড্রইং রুমে কিনে আনা ছবিটি হোগার্থের পেইন্টিং আর ডেরাইনের স্কেচ- এ দুটোর পাশাপাশি ঝুলিয়ে রাখলো। ক্যাপ্টেন তা দেখে মুখে কিছু না বললেও খুশি হলো। সেদিনও ঐ রেঁস্তোরার মতো ক্যাপ্টেন শুধু মদই খেয়ে যেতে লাগলো। টেবিলে খাবার পড়ে রইলো। আর একটার পর একটা পাইপ সে টেনে যেতে লাগলো। টেবিলের উপরে আর চারপাশে ছাই জমতে লাগলো। মাঝে মাঝে সে তার রক্তঝরা চোখদুটো সরু করে ক্রুর হাসি ছুঁড়ে দিয়ে হয়তোবা নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইছিলো। কিন্তু আসলে জোনসের ক্ষেত্রে এর কোন প্রয়োজন ছিলো না। বেচারা নিতান্তই ভালোমানুষ।
অবশ্য ক্যাপ্টেন তাদের ব্যাথা দেবার উদ্দেশ্যে কিছু বললো না। এমন কি তাদের মধ্যে সমুদ্র নিয়ে কোন দ্বিধা তৈরি হোক-বিশেষত মেরি কোন কষ্ট পাক সেটাও সে চাইছিলো না। যদিও সে নিজে এমন এক ক্রনিক আলসারে ভুগছিলো- যার প্রয়োজন অন্যের ভালোবাসা, সহানুভূতি, করুণা আর উদারতা… কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্যাপ্টেনের ক্ষমতা ছিলো না জোনসের সুখের সংসার তছনচ করার জন্য একটা আঙুল পর্যন্ত সে তোলে। কিন্তু সে এমনই এক অসুখীর প্রতিমূর্তি যে মেরির হৃদয়ে তার উদ্দেশ্যে একটি ভালোবাসার বোধ ধীরে ধীরে শেকড় ছড়াতে লাগলো। ক্যাপ্টেনও তাতে সাড়া দিতে লাগলো এবং সে অবাক হয়ে লক্ষ করলো জোনসের প্রতি তার বিরূপ ধারণা বাড়ছে এবং তার সৌাভাগ্যকে সে ক্ষমাহীনভাবে ঈর্ষা করতে শিখেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার প্রতি ভাগ্যদেবীর এই প্রসন্নতার কী কারণ, তা সে বহু খুঁজেও পেলো না। তার খিটখিটে মেজাজ, অহেতুক রাগ, উড়নচণ্ডী জীবনযাপন- কিছুই সে আর ধর্তব্যের মধ্যে আনলো না। সে ভাবতে লাগলো আগে সে বেশ ভালো ছিলো, অবশ্যই জোনসের চেয়ে আকর্ষণীয়, ধণী, আর ইন্টারেস্টিংতো বটেই। জোনসের কী এমন আছে? একটা মাথামোটা, মিনমিনে, মাগী-পুরুষ কোথাকার !
বছর জুড়ে ক্যাপ্টেনের মাথায় নিজের চেহারা সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণার জন্ম নিলো। সে একটা সময় এও ভাবতে লাগলো তার মাবাবা তাকে গড়তে তেমন ভুল করেনি। সিনেমার নায়কদের যেমন ভিন্ন ইমেজ থাকে তার নিজেরও তেমনি একটি নিজস্বতা আছে। ভেবে দেখো তুমি যদি এ্যাপোলো বা এন্টিনিউয়াস নাও হও তবু তুমি এই পৃথিবীর জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, রোমান্টিকতা পরিপূর্ণ এক ভবঘুরে, যার রয়েছে এই সমাজ কাঠামো- যা নিরীহদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে- তার প্রতি অসীম ঘৃণা আর সর্বোপরি তোমার রয়েছে এমন এক বিরল প্রতিভা যাকে মানুষ কদর না করে পারছে না, হাহ্। ক্যাপ্টেন নিজের সাথে মাঝে মাঝে এভাবে কথা বলে।
মেরির সাথে অন্তরঙ্গতা বাড়ার সাথে সাথে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ ক্যাপ্টেনের বেড়ে গেলো। সে মানতেই পারতো না যে জোনস তার চেয়ে উন্নততর কোন পেশায় নিয়োজিত। উত্তপ্ত সূর্যের নীচে মরুভুমিতে হয়তো কখনো ক্ষুধা তেষ্টায় কাতর হয়ে জোনসকে কাজ করতে হয় যেমন তাকেও শুকনো কার্গো শিপের ডেকে রোদের ভেতর কাটাতে হয় বহু বহু দিন। জোনস নিজেকে এ পৃথিবীর বিজ্ঞান কতটুকু এগোলো তার সার্টিফিকেট দেনেওয়ালার মতো ভাব করে অথচ সে নিজে একজন ব্যতিক্রমী আঁকিয়ে যাকে বাঘা বাঘা শিল্প রসিকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মাথা নাড়ে “লোকটার মধ্যে আসলেই ভিন্ন কোন যাদু আছে’। তারপরও জোনস চাইলে তাকে পিঁপড়ের মতো পিষে মারতে পারে আর সবচেয়ে যেটা সারাক্ষণ ক্যাপ্টেনকে খোঁচায়, তা হলো পৌরুষের দিক থেকে সে কখনোই জোনসের সমকক্ষ হতে পারে না বলেই মেরিকেই সক্রিয় হয়ে সবকিছু করে নিতে হয়। সে শুধু নিরব দর্শকের মতো নিচে শুয়ে যৌনদেবীর ক্রিয়াকাণ্ড দেখে যেতে থাকে!
কিন্তু যখন মেজাজ ভালো থাকে তখন ক্যাপ্টেন জানে যে জোনস অন্তত তার চেয়ে সবদিক থেকেই ভালো মানুষ। কিন্তু আউট হয়ে যাবার পর তার কেবল মনে হয় যখন এসব জোনস জানতে পারবে তখন তার মতো নেংটি ইঁদুরকে ধরে শ্রেফ একটা আছাড় মারবে- ভাবতেই তার পেটের ভেতরের সবকিছু পাক খেতে খেতে গলার দিকে উঠে আসে যেনো।
যাহোক দিন যতোই বাড়তে লাগলো মেরি জোনসের ঘরে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষার মাত্রা কমিয়ে দিলো। যখন সে তার অভিযানে বেরুবার আগে সব মালপত্র ঠিক আছে কিনা চেক করতো, সব সরঞ্জাম, খাবার টিনগুলি, জুসের প্যাকেট, মাংশের কৌটো, ভিটামিন আর অন্যান্য অষুধপত্র বাধাছাঁদা করতো মেরি তখন আগের মতোই সহায়তা করতো কিন্তু মন তার পড়ে রইতো ক্যাপ্টেনের কাছে। হয়তো লোকটা এখন এলোমেলো বালিশ বিছানায় কোন সস্তা হোটেলে শুয়ে আছে। খাচ্ছে কম দামী হুইস্কি-যা তার মতো আলসার রোগীর জন্য প্রায় বিষ। তাই জোনস রওনা হবার প্রায় সাথে সাথেই মেরিও ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে বের হয়ে যায় এবং আশ্চর্যজনক ভাবে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেও কেমন করে যেনো সে একবারেই তাকে খুঁজে পায়।
মেরি গিয়ে দেখে যা ভেবেছিলো ঠিক সেভাবেই নোংরা বিছানায় সে শুয়ে আছে। বালিশের উপর পর্যন্ত সিগারেটের ছাই জমে আছে। “এরপর আসার আগে আমাকে জানিয়ে আসবে। আমি একা নাও থাকতে পারতাম।’
“ক্ষমা করো। তোমার জন্য মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠেছিলো।’ বলার পর মেরি অবাক হয়ে লক্ষ করলো ক্যাপ্টেনের আচরণে মনে হচ্ছে সে যে আসবে তা যেনো ও আগেই জানতো।
আচ্ছা মেরি কি নির্বোধ না তাকে ফাঁদে ফেলতে চায় ? ক্যাপ্টেন বিরবির করলো নিজমনে। হয়তো এর দুটোই। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আর সেটা বুঝতে হলে তার সাথে বিছানায় যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ক্যাপ্টেনের জানা নেই।
অবশেষে সকল লজ্জা, সংশয়,ভীতি ইত্যাদি কাটিয়ে এমনকি কোন পাপবোধও মেরিকে স্পর্শ করতে পারলো না। বরং যখন সে ক্যাপ্টেনের ডেরা থেকে ফিরে এসে তার দীর্ঘ দিনের প্রেমময় স্বামী সন্তান আর সামাজিক অবস্থানকে ত্যাগ করার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো। আর এর সবকিছুই ভালোবাসার জন্য। তার করুণা বর্তমানে ক্যাপ্টেনকে ভালোবাসার র্যাঙ্কে নিয়ে গেছে। আর অন্তরঙ্গতার মুহূর্তে মেরি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে যখন দেখেছে ক্যাপ্টেনের কোন আন্ডারওয়ার নেই। ওহ্ বেচারা। মেরি তারপর ভাবতে বসে প্রথমে ছোটখাটো বিষয় দিয়ে শুরু করতে হবে।…
এটা এমন একটা খেলা যেখানে ক্যাপ্টেনের কোন লস নেই। সে মাঝে খুব খুব খারাপ ব্যাবহার করে দেখেছে তাতে মেরি দুঃখিত তো হয়ই না বরং সে আরও বেশিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মুফতে মেয়েমানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারলে মন্দ কী ? আর মেরি সেটাকে ভালোর দৃষ্টিতেই দেখে। আসলে মেরির এখন ভালো মন্দ বিচারের কোন সুযোগ নেই। তার মাথায় পিন আটকে যাবার মতো একটা জিনিসই বাজছে ঘুরে ঘুরে তা হলো, সে যা করছে সেটাই ঠিক। ভাবলেই তার শরীর রোমাঞ্চিত হয়। এমন সুখ আর কখনো পায়নি কোনদিন। তার সবটা জুড়ে পরিতৃপ্তির সুখ।
মেরি তারপর ফোন করে অনুমতি নিয়ে ক্যাপ্টেনকে দেখতে গেলো। সাথে করে নিয়ে গেলো কিছু কাপড় চোপর আর টয়লেট্রিজ। দেখে ক্যাপ্টেন পারলে মারে। “আমাকে নিজের সাথে বাঁধার কোন চেষ্টা কোরো না। তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার ঐ শরীর সচেতন শুচিবাইগ্রস্থ স্বামীর মতো ? আমি এর সবকিছু ঘৃণা করি।’
গাঁইগুই করলেও অবশেষে ক্যাপ্টেনকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতে হয় এবং পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো ভাবে ঘষে ঘষে ধুতে হয়। øান সেরে সে দেখে মেরি নতুন একটা ফ্লানেলের ট্রাউজার আর উলের শার্ট নিয়ে অপেক্ষা করছে। শার্টের বড় বড় বুক পকেট টোবাকে পাইপ রাখার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। আবার সে রাগে ফেটে পড়লো, কিন্তু ভিন্ন কারণে। তা হলো এসবের দাম দেয়ার মতো মনিব্যাগের অবস্থা তার নেই।
“কিন্তু এগুলিতো তোমার জন্য আমি উপহার এনেছি…‘। কি ভেবেছে এই মহিলা ? আমি তার আনন্দদানের উপকরণ ? ক্যাপ্টেন এক ঝটকায় তার চেস্ট অব ড্রয়ার খুলে মনিব্যাগ বের করে মেরি দিকে ছুঁড়ে দিলো।
“থামো। যথেষ্ট হয়েছে।‘
এবার ক্যাপ্টেন সত্যিই থামলো। “ঠিক আছে তাহলে ঐ টাকা আমরা ড্রিঙ্কের পেছনে ব্যায় করতে পারি।‘ সে শান্ত ভাবে বললো। আসলে সে ভয় পাচ্ছিলো যদি টাকায় না কুলোয়। কিন্তু বিল দিলো মেরিই। ক্যাপ্টেনকে কিছুতেই দিতে দিলো না। এবং সবশেষে সে তাকে একটা তামাকের পাইপও উপহার দিলো। প্রথম দিকে যখন সে জোনসকে ঘৃণা করতো, আবার অন্যদিকে তাকে নিয়ে জোকও করতো মনে মনে- যে মানুষটি টাকা দিয়ে সবকিছু জয় করতে চায় হাহ্। কিন্তু যখন সে মেরির মধ্যে তার স্বামীর ব্যাবহার দেখতে পেলো না তখন তার কথা মতো চলতে নিজেকে ফেরাতে যত্নবান হলো। সে হুইস্কির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া শুরু করলো আর পেন্টিং নিয়ে সময় কাটাতে লাগলো। সবকিছু তাকে প্রায় বিবাহিত জীবনের আস্বাদই দিচ্ছিলো। তার ছবি বিক্রির মাধ্যমে কিছু টাকাও রোজগার হচ্ছিলো।
দিনে দিনে কর্মঠ, হাত ভর্তি রঙ লাগা ক্যাপ্টেনকে দেখে মেরি এক অব্যক্ত আনন্দে বুঁদ হয়ে পড়লো। তার প্রভাবেই যে সে এমন পরিবর্তিত হয়েছে ভেবে সে দারুণ সুখ অনুভব করতে লাগলো। কিন্তু ক্যাপ্টেন নীতিগত কিছু বিষয়ে তখনও ক্রমাগত যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। কেননা অন্যের বৌকে নিয়ে ঘর করা সস্তিদায়ক কোন কাজ নয়। আর এর পর থেকেই সে মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে থাকে। ফিরে আসে ফুটো পকেটে আর খরগোশের মতো রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে। তার দূর্বল হাত পা মুখে কাটাকুটি অত্যাচারের চিহ্ন নিয়ে সে যখন মেরির সামনে দাঁড়ায় তখন সে তার ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে অষুধ খাইয়ে চাঙ্গা করে। সেরে যাবার পর সে তাদের দুজনকেই কষ্ট দেয়। রুম ছেড়ে কোথাও বের হতে চায় না আর শুধু চা খেয়ে থাকে। যদিও মেরির পছন্দ কারো সাথে বারে গিয়ে জ্যাজের সাথে পা মিলিয়ে নাচতে কিংবা কোন কোন পার্কের দোলনায় দোল খাওয়া অথবা কোন লেকের ধারের টেবিলে চাইনিজ ল্যান্টার্নের আবছা আলো আঁধারিতে বসে ফেনা ওঠা ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিতে। এর অর্থ হলো ক্যাপ্টেনের কারণে মেরি কিছু ক্ষুদ্র সুখ, ছোট ছোট আনন্দ উপভোগের সুযোগ পাবে বলে ভেবেছিলো, কিন্তু তার ধারণা ভুল হলো। ক্যাপ্টেন এক্ষেত্রে শুধু বিয়ারের বিষয়টি ছাড়া অন্য সবটাতেই অরাজি ছিলো অথচ মেরি কিশোরী বয়স থেকেই ঐসব পছন্দ করতো। বিয়ের পরে জোনসের সংসারে এসে সে তার নিজের স্বপ্নগুলি পূরণ করার কোন সুযোগই পায়নি। মানুষ বলেই সে জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছে কিন্তু কখতো তার অংশ হয়ে ওঠেনি। তাই ক্যাপ্টেনের সাথে সম্পর্কের পর থেকে নিজেকে সে সত্যিকারার্থেই মুক্ত বলে ভাবতে পারছে। লোকটা আর যাই হোক অন্যের ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো।
মাঝে মাঝে সে মেরিকে অহেতুক কোন সন্দেহে কিংবা ভিত্তিহীন কিছু কারণের জন্য দুঃখ দেয় সত্য। মাঝে মাঝে এমনও হয় যখন সারারাত মেরি একা একা কেঁদে কাটিয়ে দেয় কিন্তু তারপরও সে ক্যাপ্টেনকে ক্ষমা করে দেয়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে যখন সে তার শিল্পমনষ্কহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মেরিকে মেধাহীন মেয়েমানুষের মতো তুচ্ছ করে। স্বামীর সাথে বিভিন্ন যাদুঘর বা চিত্রশালায় ঘুরতে যাবার কারণে মেরির চিত্রকলা সম্পর্কে কিছু সাধারণ ধারণা জন্মেছে। সে জেনেছে যে চিত্রকলায় সবকিছুই গ্রহণযোগ্য; চোখের বদলে কেউ তাকে নীল বোতামও ভাবতে পারে, অথবা দুটো চোখ পাশাপাশি না এঁকে কেউ সেগুলি একটার ওপরে আর একটা আঁকতে পারে কিংবা মুখচ্ছবি আঁকতে গিয়ে কেউ ব্যবহার করতে পারে সবুজ বা গোলাপী কিংবা গাঁইয়া হলুদের সাথে কালো মিশিয়ে গোবরমুখো পোট্রেটও কেউ চাইলে আধিকার রাখে। এমন কি চতুষ্কোণ বা মোচকের একত্র সন্নিবেশকে কেউ হয়তো চিন্তার জটিলতা বোঝাতে কিংবা শ্রেফ ধূলোবালির দাগ বোঝাতেও ব্যবহার করতে পারে। আসলে চিত্রকর্ম হলো মানবিক বোধের তাৎক্ষণিক যাদুময় অভিব্যক্তি কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তা প্রকৃতপক্ষে তেমন কোন অর্থবহন করে না। ক্যানভাস জুড়ে তখন শুধু পড়ে থাকে কিছু পাজল্ আর আঁকিবুকি। মেরি এই সব ধাঁধা পছন্দ করে না আর তার সমাধানও করতে পারে না। কিন্তু জোনস এসব খুব পছন্দ করে, মাঝে মাঝে সে কোন ফ্রেমের সামনে নির্বিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ করেই জিভ দিয়ে জিতে গেছি গোছের শব্দ করে। মেরি তখন চমকে তাকিয়ে বুঝতে পারে নিশ্চয়ই ঐ ফ্রেমের ভেতরের ছবিটাতে কোন পাজল্ লুকিয়ে ছিলো!
কিন্তু ক্যাপ্টেনের ছবিতে এজাতীয় কোনো ভনিতা নেই। কোনো চালাকি কিংবা বিপরীত এঙ্গেল, পাজল্ অথবা সন্ত্রাসী আঁচড় তার ব্রাশে দাগ কাটে না। যখন সে ‘তার মেয়েমানুষ’ পোট্রেটটি আঁকছিলো তখন সত্যিকারার্থেই একটি রিয়ালিস্টক পোট্রেট করার চিন্তা নিয়েই কাজ করছিলো। নাবিক শিল্পী যখন তার কাজের মগ্নতায় নিজের অস্তিত্ত্বকে ছড়িয়ে যাওয়ার মতো বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলো শুধু নিজের প্রেমের খাতিরে তা লক্ষ করে মেরির হৃদয়টা একেবারে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তার গলা দিয়ে আর্তচিৎকার বেড়িয়ে এসেছিলো যখন সে দেখতে পেলো যে ছবির মুখাবয়বে নিরানন্দ, প্রাণহীন একটি মানুষের প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মেরির এই অনুভূতি ক্যাপ্টেনের নিরাশ মনের ক্যানভাসে কোনোরকম প্রভাব ফেললো না। সে তো আর দেবতা নয়, ঈশ্বর জানেন, সে অনেক ক্লান্ত এবং যতোবড় প্রতিভাবানই হোক না কেনো মানুষ যখন ক্রমাগত জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে, আশাহীনতায় আর আশাভঙ্গের মাঝে বসবাস করতে থাকে তখন তার ধ্বংস ঠেকানো খুবই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ক্যানভাসে কোনো কিছু যদি সঠিক ভাবে না ফুটে ওঠে তবে তার জন্য মেরি নিজেকে দায়ী ভাবতেও প্রস্তুত। কেননা কিভাবে প্রেরণা যোগাতে হয় তা সে বোঝে না। তার মাথার ভেতরে কেবল নির্বোধ কিছু ভাব জমে উঠেই আবার অতলে হারিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতিরও শিল্পবোদ্ধা হিসেবে তাকে তৈরী করা উচিত ছিলো নাকি ? ক্যাপ্টেনকে সে কথা বলতেই সে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় “এসব তুমি কৈ পেলে ?’ মেরি বলে সে কোনো এক বইতে এসব পড়ে থাকবে। কিন্তু তাতে সে বিশ্বাস করে না। এই নিয়ে পীড়াপীড়ির এক পর্যায়ে সে তার ব্রাশ, ইজেল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বোতল নিয়ে বসে। দিনভর সে কর্ন হুইস্কির বোতল থেকে নির্জলা সেবা করতে করতে ঝিমাতে থাকে। দেখে ভয়ে মেরি মৃদু কোন প্রতিবাদও করার সাহস পায় না। মেরি বুঝতে পারে এই চরম স্পর্শকাতর ব্যক্তিটি এমন এক ভয় বা ক্ষত নিজের ভেতরে সারাক্ষণ সে পুষছে যাকে সাধারণভাবে সে তার শিল্পবোধের ক্রাইসিস দিয়ে ঢেকে রাখলেও কখনো কখনো তার চেহারার মধ্যে ঝলকে ওঠে। মেরি বুঝতে পারে সেই ভয়টা আসলে কিসের।
সব মিলিয়ে মেরির জীবনটা আগের মতোই অসহ্য। সোনার খাঁচায় সোনার পালঙ্কে সোনার শিকল এড়িয়ে সে এখন হতচ্ছাড়া শ্রীহীন দূর্বিসহ জীবনের অনুগামী। এ তার কেমন সুখান্বেষণ? এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন যখন সমুদ্র অভিযানে যাবার কথা বলে তখন তার দুচোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরতে থাকে। তা দেখে ক্যাপ্টেনের মনটা নরম হয়ে এলেও অন্যদিকে তা বিব্রতও করে। মাঝে মাঝে সে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। “চুপ মাগি, ভুলে গেছিস তোর গুবরে পোকা ভাতার ফিরতে বেশি দেরি নেই ?’
“হ্যাঁ গেছি!’ চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দেয় সে।
“ওহ্ এই বলদ মাতারিকে নিয়ে এখন আমি কী করি!’ রেগে গেলে ক্যাপ্টেনের মুখে সহজে ভালো কথা আসে না। সে বুঝতে পারে না তার মধ্যে কী দেখেছে মেরি। বেচারাকে দুটো ভালো কথা বলে মন ভালো করতে ইচ্ছা করে কিন্তু যে গাম্ভীর্য আর ঝোড়ো কাকের চেহারায় সে নিজেকে বন্দি করে ফেলেছে, তা বাঁধ সাধে। কিন্তু আর সে এভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় না। এই প্রথমবারের মতো সে মেরিকে নতুন ভাবে মূল্যায়ন করতে চাইলো। এখন সে বিশ্বাস করে তার প্রতি মেরির ফিলিংস শুধু অঢেল সম্পদ আর প্রাপ্তির একঘেঁয়েমি কাটাতে কোনো বিলাসী নারীর পরিবর্তন প্রত্যাশা কিংবা নয় স্বামীর সাথে যৌনজীবনে অতৃপ্ত কোনো ডাইনির ক্লেদাক্ত কামনা যা স্বামীর উপস্থিতিতে নিশ্চুপ থাকলেও তার অবর্তমানে চাগিয়ে ওঠে। বরং এক ভিন্ন অনুভূতি তাকে কেমন যেনো আবছায়া আাঁধারে একাকার করে ফেলে। ক্যাপ্টেনের আগে এমন কখনো হয়নি। একেই হয়তো সবাই বলে প্রেম।
কিন্তু এই অভাবিত উপহার নিয়ে সে কি করবে ? মেরি কি তাকে চিরদিনের জন্য বাঁধতে চায় ? তাহলে সেটা তার মুক্ত-পুরুষ জীবনটা নস্যাৎ করে ছাড়বে। তাকে হাত পা বেধে অথৈ সাগরে ফেলে দেয়ার সাথে এর কোন পার্থক্য আছে কি ? এটা ভাবতেই তার বিব্রতবোধ আতঙ্কে রূপ নেয়। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার চিন্তার জট পাকানো মাথাটাকে খাটানোর পর বুঝতে পারে যে মিঃ জোনস এবং মিঃ জোনস জুনিয়র এবং তাদের পুরো খানদানের শেকল তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করে। এতোসব পেরিয়ে মেরির তাকে সাদী করা হবে না কখনো। তাহলে কিসের এতো চিন্তা ? পরম পুলকে তার চোখ বুঁজে আসতে চায়। কে সে ? এক হতচ্ছাড়া বাউণ্ডুলে, এক আটকপালে খালাসী, গরীব এক আঁকিয়ে কোন রকম আÍীয়-স্বজন না হয়েও কেমন অনায়াসে জোনস খানদানের দূর্নিবার সম্মান বহু প্রজন্মের ত্যাগের ফলে সৃষ্টি হয়েছে- তা ভেদ করলো। ব্রাভো! চালিয়ে যাও গুরু!
ক্যাপ্টেনের চিন্তা চেতনা সম্পর্কে মেরির কোন স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। প্রথমত সে বিশ্বাস করতো যে ক্যাপ্টেনেরও তাকে খুব প্রয়োজন; তাহলে সে তাকে তার সাথে থাকার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে না কেনো ? তাতে তো মেরি এককাপড়ে সাগরের দক্ষিণ পারের ঐ ড়েরায় চলে আসতে ইচ্ছুক। এমন কি তার জিনিসপত্র বা জোনসের ফিরে আসার জন্যও সে অপেক্ষা করবে না- অন্যান্য নাবিকের বৌরা যেমন করে থাকে। কিন্তু তার শুষ্ক, শীতে ফাটা ঠোঁট কিছুই বলে না। কেমন করে সে এমন চণ্ডালে রাগ নিয়ে নির্বিকার ভাবতে পারে যে জোনসের ঘরে সে আবার ফিরে যাবে ? উচিত শিক্ষা হয় যদি সে এখন আÍহত্যা করে। শুধু ক্যাপ্টেনেরই না জোনসেরও তাহলে ঠিক হয়। কেনো ঐ আঁকিয়ে লোকটা তাকে মেরে ফেলে না ? কিন্তু কী নিবিষ্ট মনে সে তার সামান্য কিছু জিনিসপত্র অভিযানে বেরুবার আগে বেঁধেছেদে নিচ্ছে। কোন শব্দ উচ্চারণ পর্যন্ত করছে না। এমন কি মেরি যখন বিদায়ের বেলায় তাকে নিজের শরীর আর প্রতিভার যত্ন নিতে এবং প্রতিদিন অন্তত একবার তার মেরিকে মনে করতে বললো তখনও কিরকম কাঠ কাঠ। যোগাযোগের কথা মেরি ইচ্ছে করেই আর তুললো না কারণ ক্যাপ্টেন আগেই জানিয়েছে কোন রকম পত্র লেখা সে একদম পছন্দ করে না।
একা একা বাড়ি ফেরার পথে মেরি পুরোটা সময় কাঁদলো। রাতেও তার মন হালকা হলো না। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার মনে পড়লো নাবিক শিল্পীর জাহাজ যখন টার্মিনাল ছাড়বে তখন অন্য একটি জাহাজ এসে ভিড়বে- যাতে বাড়ি ফিরছে তার স্বামী! ভেবে বিশেষ কোন প্রত্যয় হলো না তার। সে খুশিও হলো না, অখুশিও না। এখন তাকে কিছু কর্তব্য করতে হবে। যেমন তার প্রিয় আইটেমের খাবার অর্ডার দেয়া। এতোদিন শুকনো আর টিনের খাবার খেয়ে খেয়ে ওর মুখ অরুচি হয়ে গেছে বলে মেরি সুস্বাদু কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করলো। এই ধরনের রুটিন কাজগুলি এক আলাদা তৃপ্তি দেয় তাকে। কাউকে তৃপ্তিমতো খাইয়ে যে সুখ পায় সুগৃহিনীরা তা আর কিসে পাওয়া যায় ? আর মেরি ভেতরের শূণ্যতাকে ঢাকবার জন্য কাজে ব্যস্ত থাকাই শ্রেয় বলে মনে করলো। বরাবরের মতো এবারও সে ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে রাখলো এবং তখন মনে পড়লো যে তার ছেলে আগামিকাল ছুটিতে বাড়ি আসছে। সে তার জন্যও ভাবতে লাগলো। এবং একসময় সহজ হতে পারলো।
ট্যাক্সি থেকে জোনস যখন নামলো তখন তাকে দেখে মনে হলো প্রত্নাভিযানের পরিবর্তে সে যেনো বাকিংহাম প্যালেস থেকে এসেছে। মেরির ভাবতে খুবই অবাক লাগলো যে কিছুই বদলায়নি, সব আগের মতোই আছে এবং মাঝখানের ঐ কটা মাসের পাগলামি ভুলে গেলে তার কিছুই হারিয়ে যায়নি।
তারা কখনোই প্রথাগত স্বামী-স্ত্রীর মতো দূর থেকে একে অন্যের দুহাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কিংবা চোখ মুছতে মুছতে দীর্ঘ বিরহের অবসানকে সেলিব্রেট করে না। এবারও করলো না। জোনস মুচকি হাসির সাথে স্ত্রীর হাত দুটো ধরলো কেবল। তারপর আলতো চুমু দিলো মেরির কপালে। এরপর ঘরে ঢুকে সোজা বাথরুমের দিকে যেতে লাগলো। ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে সে দেখলো টেবিলে খাবার সাজানো হয়ে গেছে। একটা বরফ কুচি দেয়া ঝুড়িতে ঠাণ্ডা স্যাম্পেনও রাখা আছে। তারা রাতের খাবার খেতে বসলো।…
তার অভিযানের কিছু টুকরো-টাকরা, অবশ্যই তাতে হাসির নানা উপকরণ ছড়ানো থাকবে। শুনে মেরি মুখ চেপে ম্লান হাসলো। কখনো ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা শুনে শঙ্কিতও হলো। সবকিছুই ঠিক আগের নিয়মেই ঘটছিলো। জোনস জিজ্ঞাসা করলো তার অনুপস্থিতিতে মেরি কী করে সময় কটিয়েছিলো ? এটাও একটা ট্রাডিশনাল প্রশ্ন এবং এর কোন বিস্তারিত উত্তর যে সে চায়না তা তার বলার ভঙ্গী দেখেই মেরি আঁচ করতে পারতো। কিন্তু এবারে এই প্রশ্ন শুনে মেরির মনে হলো জোনসের এই কেয়ার না করা বলার ভঙ্গীর মধ্যে শুধু ফর্মালিটি নয়, আরও কিছু লুকিয়ে আছে যেনো। কিন্তু তাকে নিয়ে যে কানকথা এখন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তা ঐ দূর্গম মরুভূমিতেও পৌঁছে গেছে এটা ভাবা খুব কঠিন। কিন্তু ভাবনাটা আর বাড়তে না দিয়ে মেরি সাথে সাথে-অন্যান্য বারের তুলনায় একটু তাড়াতাড়িই হয়তো উত্তর দিলো। “ পোড়া কপাল আমার! সোসাল ওয়র্ক, কফি, এরারুট বিস্কিট আর আমার এক প্রিয় বেচারাকে নিয়েইতো সময় কেটে গেলো’… নিখুঁত অভিনয়! একটু কি অতি অভিনয় হয়ে গেলো ? যাকগে…। কিন্তু মেরি এটা কি করলো ? একদম পরকীয়া-দক্ষ নষ্টা মেয়েদের মতো জোনসকে ল্যাং মারলো ? বেচারা। এতো কষ্ট করে এতোদিন পর বাড়ি ফিরলো। নিশ্চয়ই খুব একটা সুখে কাটেনি তার। আর তার পেশাটাই এমন যে প্রতিবারেই কিছু না কিছু আশাহত তাকে হতেই হয়। এ অবস্থায় প্রথম তার প্রয়োজন বিশ্রাম ও ঘুম। আর মেরি কিনা পরিশ্রান্ত মানুষটাকে সুযোগ পেয়ে যা না তাই বলে যাচ্ছে। নীতিগতভাবে, ভেবে দেখো, যখন কেউ নিচে পড়ে যায় তখন তাকে হিট করা উচিত নয়। আর ক্যাপ্টেনওতো তাকে নিষেধ করেনি কোন কিছু জোনসকে জানাতে। তাহলে কেনো সে সব গোপন করছে ? মেরি সব খুলে বলবে। যা হয় হোক। ও যা ভাবে ভাবুক। কি ভাববে, নষ্টা ? নষ্টাইতো। তাতে কী। তবু এভাবে সে জোনসকে ঠকাতে পারবে না। বিশেষত আইনগতভাবে যেহেতু সে এখনো তার স্বামী, মেরির উচিত তার সম্মতি বা মতামত নেয়া। অন্তত জানানো। মেরি সত্য জানাতে ভীত নয়। কিন্তু… তার স্বামী কিংবা ক্যাপ্টেনেরই তা জানার প্রয়োজন বা আগ্রহ আছে কী… কিংবা যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- তার, মেরির নিজের ? ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেড়িয়ে এলো। সে বলতে পারবে না। নাহ্ এ জীবনটা আর নিজের মতো করে গড়া হলো না…।
স্ত্রীর হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া আর দীর্ঘশ্বাস শুনে জোনস তাদের ছেলের প্রসঙ্গ ওঠালো। সে একদম তাকে লেখে না। শুধু তার শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছে আর ভালোই হেসেখেলে সময় পার করছে মেরি স্বামীকে জানালো।
“তাহলে তোমার ছেলে একরকম ভালোই আছে কি বলো ?’ বলে হাসলো জোনস। “এই বয়সটাই হলো গিয়ে নিজেকে আবিষ্কারের সময়। মাটির যতো ভেতরে যাওয়া যায় ততোই প্রাচীন আর দুঃস্প্রাপ্য প্রত্ন খুঁজে পাওয়া যায়।’ বলে সুখী বাবার মতো হাসলো সে। “ বাবামা হিসেবে আমাদের উচিত এখন তাকে আটকে না রাখতে চেয়ে বরং ছেড়ে দেয়া। আর তার মনটা বুঝে নিয়ে সহায়তা দেয়া। কোনোকিছু তার উপরে জোর করে চাপিয়ে দিয়ো না, উপদেশও দিয়ো না। সে না জানলেও আমরাতো জানি বয়ঃসন্ধির জ্বালা কী ?”
“কিন্তু কতোদিন এই জ্বালা চলবে বলতে পারো ?”
“দু তিন বছর তো বটেই।’
ছোট বেলায় মেরি টিনের তলোয়ারওয়ালা সৈন্যদের গল্প খুব পছন্দ করতো। ঐ রাতে সে তার জীবনের দুঃসাহসী কাজটা করলো। তা হলো জোনসের সাথে এক বিছানায় শুতে যাওয়া। এর পর প্রায় হপ্তাখানেক লাগলো জোনসের ঘুমের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে। বাড়ির আসেপাশে তারা পায়চারী করে বেড়ালো। হাতে হাত ধরে ঘুরলো। হাজার হোক মানুষতো!
ছেলে বাড়ি ফিরলে মেরির জীবনে নতুন আর এক অধ্যায় জন্ম নেয়। সে আবার অক্সফোর্ডে ফিরেও যায়। জোনসও পুনরায় আর এক দূর্গম অভিযানে বেড়িয়ে পড়ে। মেরি যে কে সেই। তার কিছুদিন পরেই আমাদের ক্যাপ্টেন ফিরে আসে! শহরে তাই নিয়ে আবার কানাঘুষা শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আসলে তেমন কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। মেরি এখনো জোনসের স্ত্রী আর ক্যাপ্টেনের পরকীয় প্রেমিকা হিসেবেই আছে। আর বৃথাই তার দিক থেকে কোন প্রস্তাব আসার অপেক্ষায় কাল কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার আÍহত্যার কথাই বেশি মনে হয়। কিন্তু তাও কি এতো সহজ ? অথচ সংসারের প্রতি তার যে পিছুটান তার শেষ সূতোটাও ছিঁড়ে গেলো, যখন ছেলে মার চিঠির জবাব দেয়া বন্ধ করে দিলো। সন্দেহ নেই ছেলে বাপের আগেই সব টের পেয়ে গেছে!
মেরি অবাক হয়ে দেখলো ক্যাপ্টেন তাকে দুই পুরুষের মাঝে ভাগাভাগি করে ভোগ করতে তেমন কুণ্ঠিত নয়। এটা তার কাছে বেশ্যাপনারই নামান্তর। জোনসের কাছে স্বভাবতই তার নিজেকে ন্যস্ত করতে হয়। কিন্তু সে জানতো না যে প্রেমিকেরা সাধারণত তাদের স্বামীর ব্যাপারে ঈর্ষাপ্রবণ হয় না। ক্যাপ্টেনের ইতোমধ্যে আয় রোজগার বেড়ে যাওয়ায় মাথায় যেনো শিং গজিয়েছে। এখন মেরির একমাত্র ভরসা জোনস সব জেনে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিক; তাহলে যদি ক্যাপ্টেন তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। কিন্তু বিষয়টা জোনসের কানে যায়নি, তা হতেই পারে না। অথচ তার নিঃস্পৃহতা মেরিকে বাকহারা করে ফেলেছে। এখন আর সে বা ক্যাপ্টেন কোন কিছু লুকোছাপা কোরে করে না। বারে, রে¯েঁ—ারায়, বক্সিং ক্লাবে কিংবা ক্যাফে, প্রদর্শনীতে তারা নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ায় যাতে জোনসের পরিচিত কোন বন্ধুবান্ধব তা দেখে কথাটা ওর কানে তোলে। মেরি মনে মনে অপেক্ষায় থাকে এমন দিনের- যেদিন কোন চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে চিত্রকরের বাহুলগ্না অবস্থায় তার স্বামী এসে ঐখান থেকে ছবি কিনে নিয়ে যাবে!
কিন্তু তা হতে পারলো না। জোনসের নিঃস্পৃহতা আর না জানার ভান, প্রতিটা মিথ্যে বানানো কথা, ভঙ্গি, হাসি, খাবারের বিস্বাদ, ফুলের ঘ্রাণহীনতার মতো এই জীবন, সন্তানের দূরে সরে যাওয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে মেরি আর সইতে পারলো না। চরমভাবে ভেঙে পড়ে একদিন সে সব কিছু অকপটে জোনসের কাছে স্বীকার করে বসলো!
সব শুনে জোনস যেনো বিব্রত, লজ্জা আর অসহায়বোধে ভুগতে লাগলো- দেখে মেরির মনে হলো অভিনয়। কিন্তু তাহলে তাকে প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা হিসেবে অস্কার দিতে হয়। কিন্তু তা সে নয়, এটা জানে মেরি। সবচে ভয় বা আশ্চর্য লাগলো যখন সে উত্তরে একটা শব্দ পর্যন্ত খরচ করলো না। মেরি ভেবে কূল পেলো না। সে ঠিক করে রেখেছিলো জোনসের উত্তরে সে বলবে “আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম’ কিন্তু তা বলার মতো কোন পরিবেশই সৃষ্টি হতে দিলো না তার স্বামী। কিন্তু আÍ মর্যাদা থাকলে মেরির নিজেরই বের হয়ে যাওয়া উচিত নয় কি ? দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর মেরিই নিরবতা ভাঙলো : “কিছু অন্তত বলো।’ নিজের ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলার স্বরে নিজেই চমকে উঠলো সে।
“দেখলে তো সাদা চামড়ার মানুষগুলো কি রকম কুটিল। তাদের পাতলা ঠোঁট, খাড়া নাক আর মুখণ্ডলের ভাঁজ আর চোখের বুনো দৃষ্টিতে সারক্ষণ কী যেনো চল্লাশী চালায়। সাদা চামড়ার মানুষেরা সবসময় কিছু না কিছুর সাথে লেগে থাকে। কিছু খোঁজে। এ বিষয়ে তারা ক্লান্তিহীন, অসীম ধৈর্য তাদের। যা আছে তাতে তারা কখনোই তুষ্ট নয় বরং যা তাদের নেই তা তাদের চাই-ই চাই। আমি একজন ইন্ডিয়ান, আর তুমি বেছে নিলে এক সাদা চামড়াকে!’
“তুমি কি কারো উক্তি বলছো ? ’ মেরি ঠিক না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাস করলো। তার এ মুহূর্তে মনে হলো পাগল হয়ে গেছে।
“কার্ল জং সম্ভবত…হ্যাঁ এটা তার এক ভ্রমন কাহিনীর বর্ণনা থেকে বললাম।’
“আর এ সময় তোমার মনে নিজের বলার মতো কিছু নেই। যা ঘটার তা ঘটতোই।”
“নিজের পরের বলে কথা নয়। এই শব্দগুলির পেছনে কি সত্য লুকিয়ে সেটাই ইম্পর্টেন্ট।’
সবকিছু বলে ফেলার পর মেরির নিজের জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। তাই মাথা ঠিকভাবে কাজ করছিলো না। মানুষ সাধারণত- যাদের শিল্পজ্ঞান নেই তারা খুব জটিল হয়। অযথাই তারা অন্যের উক্তি, প্রবাদ প্রবচন, উদ্ধৃতি ও মতামত দিয়ে, চালাকি দিয়ে আর আচ্ছন্নতা দিয়ে সাধারণকে অসাধারণ বা অস্বাভাবিকতায় রূপ দিতে পারে। মেরি এতো ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। সন্দেহ নেই, জোনস এই পৃথিবীর সেরা একজন পুরুষ, তবুও তার পুরো অস্তিত্বটাই একটা পাজল্। নাহলে কেনো সে সোজাসাপ্টা নিজের কথায় না এসে মিষ্টি মিষ্টি কথার জাল ছড়াচ্ছে ? মেরিতো সব কিছুতেই রাজি। শুধু একটা বিষয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তা হলো ছেলের ব্যাপারে সে কি সিদ্ধান্ত নেবে ? সে বুঝতে পারছে তার ব্যাপারে আর বেশিদিন এমন কোন দায়িত্ব থাকবে না যা জোনস পালন করতে পারবে না। ছেলে নিজেই তার মার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। এখন তার আর তেমন কিছু করার নেই। এসবের নিস্পত্তি সে আগেই করে ফেলেছে। এখন সব কিছু তাড়াতাড়ি চুকে গেলেই হয়। কিন্তু জোনসের মধ্যে দাগ টানার কোন তাড়াই দেখা যাচ্ছে না, শুধু নিস্তব্ধতা তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। হঠাৎ করেই ভিন্ন এক অনুভূতির টান সে ভেতর থেকে টের পেলো যার ফলে নিজের আকাঙ্খার কথা ঐ মুহূর্তের জন্য তাকে ভুলে গিয়ে কেবল জোনসের জন্য দুঃখ বাড়তে লাগলো। তার স্টাইলিস্ট টুইড জ্যাকেট আর সেকেলে উদারতা, তার সুন্দর ভাঁজভাঙা ট্রাউজার এবং মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা শার্ট আর নরম চামড়ার মোকাসিন আর উত্তর না জোগানো বিব্রত মুখ- কোন কিছুই তার নিরানন্দ করুণ শ্রীকে ঢাকতে অক্ষম এখন।
কতো পুরোনো অভ্যাসে জড়িয়ে আছে দুজন। এখন এই চির বিচ্ছেদের সময় কেউই সঠিক আচরণ করতে পারছে না। আবার দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে অন্তরঙ্গতার সেই এন্টিক বিছানায় তারা দুজনই একই কক্ষে একই সাথে শয়ন করছে। যার যার পাশে সে সে। জোনসের প্রতি করুণাবোধ মেরিকে ছেড়ে যায়নি। তাই ঘুমের মাঝেও সে অভ্যাসবশত জোনসের বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দিলো। স্বামীও আগের মতোই তাকে কাছে টেনে নিলো। পরদিন মেরি দেখলো অনেকদিন পর গতরাতে সে পুরোটা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। এতোদিনের নির্ঘুম ক্লান্তির যেনো অবসান হলো।
সে আর বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাইছে না। যা হবার তা প্রকৃতির নিয়মেই হবে। শীঘ্রই সে নতুন কিছু দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেলো। জোনস ভালোভাবে অভিযান থেকে ফিরে এলে তাকে সম্বর্ধনা দেবার একটা রীতি ছিলো। যেখানে সে-ই প্রধান ভূমিকা রাখতো। রিসেপশনটা দারুন হলো এবার। মেরি দেখলো তার বন্ধুরা তাকে কমই পছন্দ করছে। সে ফোন রিসিভ করা আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করা কমিয়ে দিলো। কী হবে চ্যারিটি করে ? তার বরং এই ক্ষত এখনই সারিয়ে ফেলা দরকার। ক্যাপ্টেন সমুদ্রে থাকাকালীন অবস্থায় সে জোর করে নিজেকে বন্ধুবান্ধবদের সাথে সোসাল ওয়ার্কে ব্যস্ত রাখতো। এর মাঝে সে ভুলেই গেলো তার ভেতরের দ্বিধাটাকে। জোনস এমন আচরণ করতো যে সে কিছুই শোনেনি যেনো। তার এই সুন্দর ভাবে মানিয়ে নেয়া আর অনবদ্য ব্যবহার মেরিকে যারপর নাই সুখী হতে দিলো।
কিছু দিনের ভেতরে সে ছেলের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলো যাতে সে জানিয়েছে যে এবারের ছুটিতে সে বাড়ি আসছে না কারণ তারা সবাই মিলে উত্তর স্কটল্যান্ডে সফরে যাচ্ছে। এটা পরিষ্কার যে মাকে সে আর আগের মতো ভালোবাসে না। তবু তারপরও নিজের ছেলেতো। আর এর পেছনে নিশ্চয়ই জোনসের হাত রয়েছে। কিভাবে সে এমন বেয়ারা ছেলেকে তার মায়ের দিকে চালিত করলো সেটা একটা বিস্ময়। কিভাবে নিজেকে প্রবোধ দিলো, সেটাও।
স্বামীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা ক্রমেই বাড়তে লাগলো, যদিও তা ক্যপ্টেনের অনুপাতে নয়- যে কোনকিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে লন্ডনে চলে গেছে। আসলে ক্যাপ্টেনের চরিত্রে হঠাৎ বলে কিছু নেই। হয়তো সে ঠিক করা তারিখেই ফিরে এসেছিলো কিন্তু এদিকে মেরি তার আনন্দের মাঝে সব ভুলে বসে আছে। তার স্বামীকে রাজপ্রাসাদ থেকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে ?
এর মাঝে মেরি একদিন তার বন্ধুর এক এন্টিক সপে গেলো ব্যারনের জন্য একটা উপহার কেনার জন্য। তার বন্ধুটি একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের; সে জোনসের সামনেই ক্যপ্টেনের প্রসঙ্গ তুললো। মেরি চট করে একবার জোনসের মুখটা দেখে নিলো। কিভাবে নেবে সে ব্যাপারটা ? সে ওর জন্য আঠের শতকের একটা ব্লটিং প্যাড নিলো আর ক্যাপ্টেনের জন্য স্যাক্সোফোনের মতো দেখতে একটি মিরশিউম পাইপ কিনলো। এককালে জলদস্যুরা এ ধরনের পাইপ ব্যবহার করতো। সে ভাবছিলো এটা তার প্রেমিকের কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় নেবে না। কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে এখন আরও একব্যক্তি অবস্থান করছে যার পরনে টুইড জ্যাকেট, ফ্লানেল ট্রাউজার আর নরম মোকাসিনের জুতো। যাকে সহজে অবহেলা বা এড়ানো সম্ভব নয়। কেমন করে ভুলবে মেরি যে লোকটি তার নিজের ছেলেকে তার কাছে ফিরিয়ে এনেছে ? লালচে মুখ, বাদামী নীল চোখ আর শক্ত সমর্থ রোদেপোড়া দুটি হাত তার জন্য পৃথিবীতে নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মেরি ক্যাপ্টেনের জীবনে একজন অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে চায়, যেমন জোনস তার সমগ্র জীবনের অভিভাবক। ছন্নছাড়া জীবনের অভ্যস্থতায় ক্যাপ্টেন তাকে নিয়ে একবারও ভাবতে পারেনি- একথা ভাবতেই মেরির ধিক্কার এসে গেলো।
জোনসের দিক থেকে সাহায্য আগের মতোই অটুট ছিলো। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ স্বাভাবিক নরম স্বরে সে মেরিকে জানালো “আমি শুনেছি ক্যাপ্টেন ফিরে এসেছে, তুমি কি তাকে দেখতে যেতে চাও ?’
স্বামীর কাছ থেকে এধরনের প্রস্তাব পাওয়া খুব একটা স্বাভাবিক নয়। যা সে বলছে এটা সাধারণ কারো পক্ষে বলা খুবই অসম্ভব।
“তোমার কি তাতে হিংসা হবে না ?’ মেরি চমকে জিজ্ঞেস করলো।
“তার মানে তুমি চাও আমি হিংসা করি ? শোনো, যে কোনো প্রকার হিংসাই প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসার ঘাটতি নির্দেশ করে।’
মেরির মনে হলো জোনসের এই কথাটাও কোন মহাপুরুষের বাণী থেকে ধার করা। নিজের মনের ভেতরে আসলে কি আছে সেটা কখনোই প্রকাশ করছে না। এটাও তার একধরনের ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতারই নামান্তর, যেখানে সে তার দূর্বলতা এভাবে ঢেকে রাখছে।
“আমি কেমন কোরে তোমাকে সম্মান করবো যদি তোমার অনুভূতিগুলিকে সম্মান না জানাতে পারি ?’ জোনস বলে যাচ্ছিলো। “আমি অন্য নাইটদের মতো সংকীর্ণ মানসিকতার নই বলেই বংশগৌরবে অতোটা বিশ্বাসী নই। তুমি ক্রমাগত মিথ্যে বলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এটা কখনো আমার কাম্য নয়।’
শুনে মেরির মনে হলো জোনস যেনো তার কাছ থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে। কি সেটা ? ক্যাপ্টেনকে সে এতো সহজে ছেড়ে দেবে এটা তার মনেই হলো না। সে বেচারার জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করলো। আর ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করার প্রস্তাব দিয়ে জোনস তাকে যেনো আর এক বাঁধনে আটকে দিলো। কিন্তু এতো ঝামেলার মধ্যে সে কেনো যাচ্ছে ? যদি কখনো মেরির কাছে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তাহলে সে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে সোজা ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে উঠবে এবং তারপর জোনস যদি তার চতুর কোন দাবী বা অধিকার খাটাতে আসে তাহলে সে হাস্যকর প্রাণী হয়ে উঠবে। এটা এখন মেরির কাছে পরিষ্কার যে জোনস তাকে কোনমতেই হারাতে চাচ্ছে না। কিন্তু সে থাকবে ততোদিনই, যতোদিন না ক্যাপ্টেন তার গম্ভীর, ম্রিয়মান অথচ আকর্ষণী স্বরে তাকে বলছে “চলে এসো’।
“ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে আমার কোন ক্ষোভ নেই। তার পরকীয়া সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাও নেই। ঘৃণা যদি কাউকে করতে হয়, সে তোমাকে। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। অতএব এই আনন্দের জীবনটাকে মাটি করার কোনো মানেই আমি দেখি না।” এক নিশ্বাসে বললো জোনস। “যা তোমাকে আগেও বলেছি, তুমি খুব মিথ্যা বলো তা আমি একদম চাই না। আমাকে না জানিয়ে তোমার গোপন চিন্তাগুলি বাড়তে থাকুক তাও চাই না। সহজ হও এবং নিজের মর্যাদা রেখে চলো এটাই আমি তোমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। তুমি আমাকে যা-ই ভাবো না কেনো, কেউ তোমাকে অভিযোগ দিচ্ছে না। তুমি যে আমার কাছে সত্য কথা বলেছো এতেই আমি খুশি। তাকে বোলো আমাকে এড়িয়ে চলার কোনো দরকার নেই। আগামি গ্রীষ্মে ছেলে বাড়ি আসবে এবং কিছুদিন আমরা একসাথে কাটাবো। এরপর আমি আবার নতুন এক অভিযানে বেরুবো।’
জোনসের কথাগুলি যুক্তি ও করুণার মিশেল দেয়া, যা মেরিকে ছুঁয়ে গেলো। কিন্তু তার ভেতরে কেমন এক অস্বস্তি কাজ করছিলো যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। জোনস পরিস্থিতি এমন করেছে যাতে তাদের দুজনের একে অপরকে দেখে মাথা নিচু করে রাখতে না হয়। তাহলে সমস্যা কোথায় ?
ক্যাপ্টেনের সাথে দীর্ঘদিন পর সাক্ষ্যাৎ বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। প্রথমে সে এতো দেরী করে কেনো দেখা করতে এলো এজন্য অভিযোগ করলো। সবমিলিয়ে তাদের দিনটা কেটেছে ভালোই। ক্যাপ্টেন কোন জারিজুড়ি ছাড়াই তার দেয়া পাইপটা গ্রহণ করেছে। তারপর যখন শুনলো যে জোনস নিজেই এই দেখা করার জন্য মেরিকে উৎসাহ দিয়েছে তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। প্রচণ্ড রাগও করলো সে। জোনসের ইচ্ছা অনিচ্ছায় তাকে চাল দিতে হবে নাকি ? মেরি যদি তার স্বামীর প্রতি এতোটাই নির্ভরশীল হয়ে থাকে তাহলে তাদের দুজনের দেখা না হওয়াটাই ভালো। মেরি যেনো এরপর থেকে তাদের দুজনের সম্পর্কের এক বর্ণও তার স্বামীকে না বলে। আগে জোনসকে তার বোকা মনে হতো, কিন্তু এসব শুনে মনে হচ্ছে ব্যাটা একটা রামছাগল।
“কিন্তু আমি তাকে কোনো মিথ্যা বলিনি। সবই অকপটে স্বীকার করেছি।’
“সঅব?’
“হ্যাঁ। আমাদের অন্তরঙ্গতা পর্যন্ত!’ মেরির কণ্ঠস্বর যেনো দূর সমুদ্রের অপার থেকে ভেসে এলো।
“এ্যাঁ। কি বলবে ? …তারমানে তুমি তার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়েছো, এ্যাঁ ? যাক ভালোই করেছো তাহলে। এবার দেখা যাবে তার শিং দুটো কেমন তিরিং তিরিং করে বাড়তে থাকে। ব্যাটা ব্যারনের বাচ্চা ব্যারন!… আমি স্পোর্টসম্যানশীপে বিশ্বাসী। তাকে আমি ভয় পাই ভেবেছো ? শুধু আমার ব্যাপারে একবার নাক গলিয়ে দেখুক না।… তুমি সত্যি তাকে বলেছো। সেই সব ফষ্টিনষ্টির কথাও এ্যাঁ ? কি… কি বলেছে ব্যাটা শুনে, কেমন লেগেছে তার ?’
“এটা তার কাছে খুবই অস্বস্তির ব্যাপার ছিলো…’ মেরি বিরবির করলো।
“ হ্যাঁ তা যা বলেছো। আমরা ভালো একটা কিছু সৃষ্টি করতে যাচ্ছি কি বলো …’
মেরির এখন ক্যাপ্টেনের কথায় মন নেই। তার কেবল মনে পড়ছে জোনসের বিব্রত মুখ। ক্যাপ্টেন এরপর তার সমুদ্রবিলাসের কাহিনী বললো। নতুন আঁকা পেন্টিংগুলি দেখালো। এগুলি তার পূর্বের কাজগুলির থেকে তেমন ভিন্ন নয়। এরপর তারা একটা রে¯েঁ—ারায় গিয়ে কিছুক্ষণ পান করলো এবং সবশেষে ক্যাপ্টেনের ডেড়ায় গিয়ে উঠলো। মেরি চাচ্ছিলো রাতটা এখানে কাটাতে কিন্তু ক্যাপ্টেন তা শুনলো না। কারো সাথে এক বিছানায় ঘুমোনোর কথা সে ভাবতেই পারে না। মেরির জানা আছে ওর মতের বিরুদ্ধে গেলে রেগে যাবে, তাই অল্পস্বল্প আদর সোহাগের পর ক্যাপ্টেন তাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলো বাড়ি ফেরার জন্য।
তো পৃথিবীর সবকিছুই তার আপন গতিতে চলে, কিছুই পরিবর্তিত হয় না।- আনাতোলে ফ্রঁসের এই উক্তি এই তিনটি ব্যক্তি চরিত্রের ক্ষেত্রে ভীষণরকম সত্য এখন। তিনজনই যথেষ্ট সময় পেয়েছে নিজের লাভ-ক্ষতি বুঝে নেবার এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবার। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব অবস্থানে দাঁড়িয়ে মোটেই সুস্থির নয়। এমন কি ক্যাপ্টেন, যে মনে করতো শয়তান তার যত্ন নেবে, সেও না। কারোরই সাহস হয়নি প্রথম পদক্ষেপটি ফেলার। জোনস তার সাহায্যকারী বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার থেকে বিচ্যুত হয়নি যাতে কোনক্রমে স্ত্রীকে হারাতে হয়। মেরি ক্যাপ্টেনের আহবানের অপেক্ষায় থেকেছে কিন্তু কখনো নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু করে বসার ঝুঁকি বা সাহস দেখায়নি। আর ক্যাপ্টেন বরাবরে মতো সংশয় নিয়ে বসে থেকেছে এই ভেবে যে, শেষ মুহূর্তে হয়তো মেরি পিঠটান দেবে, তাহলে যেচে কে আর বোঝা কাঁধে তুলে নিতে চায় ?
কিন্তু এর মাঝেও অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। ক্যাপ্টেন বাধ্য হয় জোনসের সাথে দেখা করতে। একদিন জোনসই তাতে রাতে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে। মেরি প্রথমটায় শংকিত ছিলো। কিন্তু অবাক হতে হয়, নাকিব-শিল্পী খুব আভিজাত্য নিয়ে তাদের সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসে। জোনস বুঝতে পারে যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী খুব দ্রুত এক খেলায় মেতেছে। সব গুটি এখন তার পক্ষে রায় দিচ্ছে। আর এখানে সমস্যা যেটুকু তা শুধু মেরির ভেতরে, অতএব এই খেলায় অংশ নেয়ার কোনো মানেই হয় না। সে দ্রুত খাবার দিতে বললো। খাওয়ার পর এক বন্ধুর সাথে দেখা করার ছুতো দিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে সে ডাইনিং রুম ত্যাগ করলো। আসলে সে তাদের একান্ত আলাপে বাধা হতে চাচ্ছিলো না।
“মন্দ নয়, তোমার… ’ ক্যাপ্টেন বলতে লাগলো “আমি ভেবেছিলাম সে বুঝি খুবই নির্বোধ। এখন দেখছি সে তার অবস্থান কোথায় এবং কি হওয়া উচিত তা ভালোই বোঝে।’
মেরির তখন বেচারা জোনসের জন্য দারুন দুঃখ হচ্ছিলো। কিন্তু জোনস সম্পর্কে সে আর কতোটাইবা জানে ? তার পেশাগত জীবনে কোন অভিযানের সফলতা ব্যর্থতাকে হিসেব নিকেশ করে লাভ-ক্ষতির পরিমান আগেই ধর্তব্যে আনতে পারাই হচ্ছে দক্ষতা। কিন্তু এও ঠিক যে একজন তার জীবনের সবকিছু আগেই ধারণা করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে না। কিন্তু কাউকে অন্তত জেতার চেষ্টা তো করতে হবে। জোনস তাই-ই করছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে সে লন্ডনের বহুশ্রুত এক হোটেলে এই প্রথমবারের মতো একটি কলগার্ল চেয়ে পাঠালো। হোটেল ম্যানেজার তাকে একটা এ্যালবাম ধরিয়ে দিলো যেখানে বিভিন্ন মেয়েদের পছন্দ করে ভাড়া করা যায়। এদের মধ্যে অনেকেরই রেট বেশ উঁচু। জোনস সবচেয়ে বেশি রেটের সুন্দরী একটি মেয়েকে পছন্দ করলো। ঠিক ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে মেয়েটি তার স্যুইটে নক করলো। লম্বা চওড়া, সুস্বাস্থ্য আর যৌবন ফেটে পড়া মেয়েটি পেশাদার হাসি হাসলো। তার সুন্দর সুগঠিত পা জোড়া আড়াআড়ি ভাবে নিয়ে আর্মচেয়ারে বসে পড়ে আকর্ষণ আর রহস্যকে আরো ঘন করে তুললো। জোনস খেয়াল করলো মেয়েটির সাথে একটি আফগান হাউন্ড কুকুর। সে ভ্রƒ কুঁচকে তাকালো। মেয়েটা তাই দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো।
“ভয় পাবেন না। এটা আমার একধরনের ফ্যাশন। যখন কোন ক্লায়েন্ট এটা দেখে তখন তার আর মনে হয় না যে সে আমার জন্য বেশি খরচ করে। পাশাপাশি রয় আমাকে নিরাপত্তাও দেয়। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কী বিচিত্র ধরনের ক্লায়েন্ট আমাকে ডিল করতে হয়।’ সে জোনসের দিকে তাকালো। “আপনি অবশ্য তেমন ভয়ংকর কেউ নন। তবে বেশ কঠিন আর জটিল ব্যক্তি।’
“কোন্ দৃষ্টিতে ?’
শুনে আপনি কেঁদে ফেলবেন নাতো ?
বিবাহিত, বয়স হয়ে যাওয়া লোকজন কখন কাঁদে জানেন ? যখন তারা হেরে যায়। যেমন কোন নান যখন ধর্ষিত হয় তখন তার মনের অবস্থা যেমন হয়, তেমন।’
“তুমি কী বলছো? ও হ্যাঁ তোমাকে তুমি করে বলছি। যেহেতু বয়সে অনেক ছোট হবে।
মেয়েটি সম্মতির মাথা নাড়লো। “আপনার এই বয়সে এসে স্ত্রীর প্রতি অনুগত না থাকা অল্পবয়সে জোর করে নিজের কৌমার্য হারানোর চেয়ে বেশি কষ্টকর! কিন্তু সেজন্য ভাববেন না। আমাদের মধ্য থেকে কোন ইনফরমেশন বাইরে যায় না।’
জোনসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু এতো উঁচু যার রেট তার সাথে ঝগড়া করা অর্থহীন। সে চুপ করে রইলো। “আমার সম্পর্কে তুমি কতোটা জানো ?’
“আপনি বিবাহিত।’ জোনসের বিয়ের আংটিটার দিকে চোখ রেখে বলে যাচ্ছে সে। “আপনি সমাজের একজন উঁচুস্তরের সম্মানিত মানুষ। টাকা দিয়ে এভাবে প্রেম কেনার অভিজ্ঞতা আপনার আগে কখনো হয়নি। অর্থাৎ লাইনে নতুন। কিন্তু একজন ধনী ব্যক্তির পক্ষে তার বিচরণের জগতের ভেতর থেকেই সুন্দরী কাউকে পছন্দ করে পরকীয়া চালানো কিংবা একজন রক্ষিতা রেখে নেয়া কঠিন কোন কাজ নয়। আর সেটা তার জন্য সম্মানজনক ও আর্থিক দিক দিয়েও কম খরচের, কিন্তু আপনি তা করেন নি।’
“আমি তোমার শেষ কথাটার সাথে একমত।’
“আমরা হচ্ছি অঢেল টাকার মালিক সেই সব আমেরিকান কোটিপতিদের জন্য- যারা মনে করে ইউরোপ হচ্ছে সেক্সের স্বর্গ, কিংবা বুড়ো হাবড়া কিন্তু লুচ্চা- যাদের ওটা আর দাঁড়ায় না। অথবা তাদের জন্য- যারা অল্পবয়সী ছোকড়া- যারা বাপের পকেট খালি করে এসেছে তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখে নিতে… বলতে বলতে সে জোনসের প্রসঙ্গে এলো- এই সকল ক্যাটাগরির মধ্যে আপনাকে ফেলা যায় না। তাহলে এর একটাই মানে হতে পারে আর তা হলো: কোন দূর্যোগ! মনে হচ্ছে সংসারের চাকা ঠিকভাবে ঘুরছে না।’
“তুমি এতো গন্ধ শুঁকে দেখছো কেনো ?’ জোনস খেয়াল করলো এই দুনম্বর মেয়েটার সাথে কথা বলে তার ক্ষত থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। যদিও ক্ষত এখনো শুকায় নি। তবু তাই-ই বা কম কিসে ?
“ কি ভাবছেন ওল্ড চ্যাপ ?’
“তোমার নিয়ে ভাবছি।’ জোনস সত্যিটাই বললো।
“ওহ কী আপন করে বলো তুমি। সরি, আপনি।… তার মানে আপনার এখন কারো সাথে কথা বলতে পারা দরকার, তাইতো ?’
“না। কুকুরটাকে কি ওঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে ?
“আপনার কি কুকুরে এলার্জি আছে ? ঠিক আছে। রয়-’ বলে ডাকতেই কুকুরটা তার বাদামী চোখে করুণ করে একবার তাকিয়ে বাধ্য কুকুরের মতোই হলঘরে চলে গেলো। খাবার খেতে খেতে ভাড়া খাটা মেয়েটি বকবক করে চললো : “দেখে মনে হচ্ছে আপনি বেশ কড়া দাগা খেয়েছেন। সমস্যাটি কি ? আমি কি কোন অনুমান করতে পারি ? আপনার স্ত্রী আপনার প্রতি বিশস্ত নয়। ঠিক না ?’
“ধরতে পারো অনেকটা সেরকমই।’ জোনস অবাক হয়ে গেলো; কী করে সে এই বেশ্যা মেয়েটির সাথে তার দাম্পত্য জীবনের সংকট নিয়ে আলাপ করছে ভেবে।
“আপনি তাকে হারাতে চান না তাই না ?’
জোনস মাথা নাড়লো।
“সন্তান, একটা বাড়ি, একটা স্থায়ী আবাস… কেউ সহজে নষ্ট করতে চায় না।… ভালোবাসা, সত্যবাদিতা, স্বর্গীয় প্রেম ফুঃ সব বোগাস।… এটা খুবই দূর্লভ। কখনো হয়তো বাস্তবে ঘটে।… তাহলে সে, মানে আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছে না কেনো ?’ বলে নিজেই যেনো উত্তর খুঁজে পেলো। “ও আবার সেই সন্তান, একটা বাড়ি, স্থায়ী আবাস, সামাজিক অবস্থান… আচ্ছা বলুনতো তার প্রেমিক কি চায় না যে তিনি আপনাকে ছেড়ে তার কাছে গিয়ে উঠুক ?’
“হয়তো সে চায় কিন্তু সে এটা তাকে কখনো বলেনি।’
“প্রেমিক কি খুব গরীব?’
“সে আসলে ভাসমান। শেকড়হীন।’
“বোঝা গেলো। এভাবে সম্পর্ক টেকানো তাহলে তার জন্য অনেক সহজ। আচ্ছা বলুনতো আপনার বৌ কি আমার মতো খানকি ?’
“খবরদার! আর ভুলেও ওসব উচ্চারণ করবে না। সে খুবই ভালো আর খুবই দয়াবতী…’
“কিন্তু একটু বোকা আছে। গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে।’
“কী যাতা বলছো। সে খুবই মায়াবতী, আর মিষ্টি…’
“-এবং নির্ভরশীল। স্বামীদের দেখলেই আমি তাদের স্ত্রীর চেহারা চরিত্র সম্পর্কে বলে দিতে পারি। মন ঠাণ্ডা করুণ, দুশ্চিন্তার কিছু নেই, আপনার বৌ আপনাকে রেখে ভাগবে না।’
“তুমি কি ভবিষ্যত দ্রষ্টা ?’
“না তা নই। তবে এটা খুবই সহজ বোঝা যে, আপনার মেরির আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবার যায়গা নেই।’
“তুমি তার নাম জানলে কি করে?’
“আপনি দুদুবার আমাকে ভুল করে মেরি বলে ডেকেছেন।…যাক সে কথা, সবকিছুরই শেষ আছে। এখন প্রয়োজন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। যদি এর মাঝে সবকিছু অসহ্য ঠেকে তাহলে আপনার কাছে আমার ফোন নম্বর রইলো, কেমন ? এখন কি আপনি বুঝতে পারছেন কেনো আমি অন্যসব কলগার্লদের চেয়ে এক্সপেনসিভ ?’
“হ্যাঁ পারছি।’ জলভরা চোখ নিয়ে জোনস হাসলো।
ওদিকে ক্যাপ্টেন আর মেরি চুটিয়ে মজা করছিলো। শেষমেস সে মেরিদের বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। বিশেষত জোনসের লাইব্রেরীর কালেকশন দেখে সে খুবই চমকে গেলো। দুষ্প্রাপ্য আর মূল্যবান পুস্তক থরে থরে সাজানো। নিজের প্রথম জীবনের আঁকা সেই উল্টানো নৌকোর পেন্টিংটা দেখে সে মাথা নাড়লো।
“এটা তো সেই কবেকার আঁকা। জোনস নিশ্চয় ব্যাথা পাবে না যদি এখনকার আমার কোন পেন্টিং এখানে দেখা যায় ?’
মেরির মনে হলো ক্যাপ্টেন হয়তো রসিকতা করছে। কিন্তু সে আসলে সিরিয়াস। “দেখো আমি জলদস্যু হতে পারি কিন্তু কোন পকেটমার নই মনে রেখো।’
ক্যাপ্টেনের মধ্যে মেরির সাহচর্যে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন সে পোশাক আশাকের ব্যাপারেও সচেতন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকেও। আগের মতো খিটখিটে ভাব অতোটা নেই। অশ্লীল শব্দ ব্যবহার প্রবণতাও কমে গেছে। একসময় সে শিল্পী হিসেবে উদীয়মান ছিলো। এরপর সমাজ তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। কালে কালে এই জলদস্যূ-আঁকিয়ে- যে নাকি আবার একজন সদ্য ব্যারনের স্ত্রীর অবৈধ প্রেমিক- তার পেন্টিং কেনা একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকটা স্বীকৃতি তারা দিয়ে দেয় এই প্রতিভায় অসুস্থ আর রোমান্টিক পাইরেটকে।
অপরদিকে তার ব্যক্তিত্ব বাড়ার সাথে সাথে প্রশাসনিক দিক থেকেও আস্থাভাজন নাবিক হিসেবে তাকে গোনা হয়। তার নতুন মালিক তাকে একজন সমর্থ, অভিজ্ঞ মানুষ হিসেবেই জানেন, যার হাতে জাহাজ ছেড়ে দিলেও নিশ্চিতভাবে তা ভালোয় ভালোয় জেটিতে ফিরে আসবে। ক্যাপ্টেনের প্রমোশন হতে লাগলো। সমুদ্র এখন তার জন্য উন্মুক্ত। এবং এমন একদিন এলো যখন সে অভিযানে গেলো কোনো ফার্স্ট মেট হিসেবে নয় একেবারে সত্যিকার জাহাজের কাপ্তান হিসেবে একটি গবেষণা দলের জাহাজ নিয়ে। মেরির কাছে সে তার এই নতুন অভিযানের গল্প আর নাম না জানা অসংখ্য স্থানের উল্লেখ করতো। মেরি সেসবের নাম শোনেনি বলে ক্যাপ্টেনের আফশোসের শেষ নেই। এমন নির্বেধ মেয়ে মানুষের সাথে কেউ মিশতে পারে ?
শুনে মেরি হুহু করে কেঁদে ফেলে। কতো বছর ধরে সে পথ চেয়ে আছে কখন ক্যাপ্টেন তাকে তার সঙ্গে একত্রে থাকার আহবান জানাবে। কতো দিন ধরে সে স্বপ্ন দেখছে তার কাছে এসে স্বাধীনভাবে জীবন কাটাবার। একজন অবিস্বস্ত স্ত্রী, একজন খারাপ মা হয়ে একজন সামাজিক বিধি নিষেধ ভাঙা মহিলা হয়ে এই জীবন চালাতে চালাতে সে এখন রীতিমতো অসুস্থ বোধ করছে। সে কি কোনদিন শান্তির মুখ দেখবে না? তার ভালোবাসা, ধৈর্য, সততার কি কোনো দাম নেই ?
ক্যাপ্টেন পুনরায় তার সমুদ্রে চলে গেলো। আর জোনস ফিরে এলো তার প্রত্ন সন্ধান থেকে। শরীরে একফোঁটা চর্বিও অবশিষ্ট নেই। দেখতে আরো রোগা লাগছে। বয়সও যেনো তার সাথে কমে গেছে। সুইডিশ রয়েল সোসাইটি তাকে সোনার মেডেল দিয়ে সম্বর্ধনা দেবে জানালো জোনস।
“ আমি দু দুজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে সঙ্গ দিচ্ছি!’ মেরি নিজেকে নিজেই বলে। এক নতুন অনুকম্পা সে বোধ করে। “সম্ভবত আমি ওদের দুজনেরই সৌভাগ্য বয়ে আনছি, কেবল নিজের কপালটাই যা পোড়া।’
এটা সত্যি যে সে এমন করেই উভয় সংকটে কিংবা দু নৌকায় পা দেয়ার মতো তার জীবনের ফলবান সময়গুলি পার করে দিলো এবং একদিন বসন্ত তার জীবনের দাঁড়প্রান্তে এসে কড়া নাড়লো। সে এখনো সুন্দরী। কিন্তু যৌবন তার থেকে পিছিয়ে গেছে। সে এখন ঠাকুমা হয়েছে। তার ছেলের ঘরে সুন্দর একটি শিশুর তদারকি করে তার সময় কাটে। এই ছোট্ট রক্তের দলার মতো শিশুটির তার প্রতি যেনো দাবী সবচেয়ে বেশি। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে জোনস যখন তাই দেখে মেরি তখন লজ্জা নিয়ে তার দিকে তাকায়। এই দৃষ্টিতে মিশে আছে সুখী মানুষের ছায়া।
এই নতুন দায়িত্বে পড়ার কারণে ক্যাপ্টেনের ফেরার কথা মেরি ভুলে গেলো । মেরিকে জেটিতে থাকার দিন উল্লেখ কোরে সে যে চিঠিটি দিয়েছিলো দূর্ভাগ্যবশত তা অনেক পরে এসে পৌঁছায় বলে আর দেখা হয় না। এরপর তার কাছ থেকে আরও একটি অভাবিত চিঠি পায় সে। তাতে ক্যাপ্টেন জানিয়েছে তাদের দুজনের সম্পর্ক দীর্ঘদিন থেকে ঘোলা জলে খাবি খাচ্ছে। জোনসের দিক চেয়ে এতোদিন সে বিষয়টা তুচ্ছ করে নিজেকে বঞ্চিত করেছে, কিন্তু আর নয়; এবার তাদের গাঁটছড়া বাধার সময় এসেছে।… এটা সেই সব শব্দ, সেই আহবান যার প্রত্যাশায় মেরি এতোদিন ছিলো। কতোটা বছর! আর সেই সুযোগ দোড়গোড়ায় আসার পরও সে কেনো যেনো অতোটা খুশি হতে পারলো না। অনেক অনেক দেরী হয়ে গেছে। একঝলক তার নাতিটির মুখ মনে পড়লো। কিন্তু সে তো ক্যাপ্টেনের কাছে কথা দিয়ে রেখেছে, তাকে তো যেতেই হবে। কি করবে মেরি ?
বাইরে থেকে ফিরে এসে জোনস দেখলো মেরি বিছানায় উপুর হয়ে কাঁদছে। দমকে তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। এই পিঠের যিনি অধিকারী তাকে এখন আর যুবতি বলা যায় না। জোনসের বুকটা কষ্টে মোচর দিয়ে উঠলো। সে আলতো করে মেরি মাথায় হাত রাখলো। মেরি কোন কথা না বলে চিঠিটা স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিলো। চিঠি শেষ করে জোনস বললো “আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না।’
“কী করবো আমি বলে দাও। ’
“আমি জানি না। তোমার এক নাতি আছে। যাকে তোমার বড় করতে হবে।’
“সে কি সত্যিই আমাকে তার জীবনের জন্য ভাবছে ?’
“আমি জানি না। আমি তোমাকে ছাড়তে রাজি নই।’
কিন্তু ক্যাপ্টেন তার চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী কথা রাখতে এলো না। এর কিছু দিন পর মেরি জানতে পারলো ক্যাপ্টেন হার্ট এটাক হয়ে হাসপাতালে ছিলো এখন একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
মেরি তাকে দেখতে যাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। জোনস তাকে নিরস্ত করতে চাইলো না। শুধু গাড়িতে ওঠার আগ মুহূর্তেও বললো “তোমাকে আমি ছাড়তে পারবো না।’ ক্যাপ্টেনের বাসার বাইরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে মেরির বুক ঢিপঢিপ করে উঠলো। আগে যতোবার এসেছে দরজা সবসময় খোলাই থাকতো। সে বারান্দা পেরিয়ে পেছনের স্টুডিও- যেখানে বসে ক্যাপ্টেন ছবি আঁকতো সেখানে এলো। বাঁশের চাটাই দিয়ে পর্দা ঘেরা স্টুডিওর কাছে এসে সে ভেতরে নারী কণ্ঠের কলকল টের পেয়ে চোখ রাখলো। পরক্ষণেই তাকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হলো। একটি আধন্যাংটো মেয়ে ক্যাপ্টেনের কোলে বসে তার ঠোঁটে হুইস্কির গ্লাস ঠেলে ধরছে। গ্লাসে চুমুক দেবার এই সুযোগে ক্যাপ্টেন উদোম মেয়েটির একটা স্তন আচ্ছা করে টিপে দিচ্ছে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর হলো এই মডেল কাম কলগার্ল মেয়েটি পড়ে আছে মেরির একটি নীল পাজামা! মাথায় আগুন ধরে গেলো তার। সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেলো তার কাছে। এই তাহলে ব্যাপার।
“কুত্তি মাগি, তোর এতোবড় সাহস’ বলে দৌড়ে গিয়ে ওর পাছায় একটা লাথি কষালো মেরি। লিজি নামের ঐ কলগার্ল মেয়েটি পরিমরি করে দৌড়ে পালালো ঐ অবস্থাতেই। পেছন পেছন ক্যাপ্টেন। কিন্তু লিজি আর ফিরলো না। রাগে গরগর করতে করতে ফিরলো ক্যাপ্টেন। “তোমার এতোবড় সাহস আমার গেস্টকে অপমান করলে ?’
মেরি নেশাগ্রস্থ ক্যাপ্টেনের শরীর থেকে মদ,তামাক, ঘাম, আর সস্তা পারফিউমের গন্ধ পেলো। সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো লিজি এর আগেও এখানে বহুবার এসেছে। “তুমি যে এতো শয়তান তা আমার ধারণায় ছিলো না। ছিঃ’
“এঃ খুব এসে লেকচার দিচ্ছেন এখন। এদিকে আমি মরি মরি। এই লিজি না থাকলে আমি শেষ হয়ে যেতাম, তা জানো ?’ মেরি জানে ক্যাপ্টেন মিথ্যা বলছে। এর নাম যত্ন নেয়া ? এই বেশ্যাটাকে নিয়ে কতো কি করেছে ক্যাপ্টেন ? তার মাথায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। কোন্ সাহসে মাগি তার পায়জামা পড়লো ? হঠাৎ করে টেবিলের ওপর আধ খাওয়া হুইস্কির গ্লাস দেখে তার মনে হলো ক্যাপ্টেনের জন্য এ্যালকোহল বিষ এখন। “তুমি এখন মদ খেতে পারবে না। একফোঁটাও না।’
“এঃ ভারী আমার মাস্টারনি এসেছেন একজন। তোর কথায় ? আমার খুশি আমি খাবো।’
“না। তোমাকে আমি আর একটুও খেতে দেবো না।’ বলে মেরি তার ব্যাগ থেকে ক্যাপ্টেনের জন্য কিনে আনা জুসের ক্যান, খাবারের প্যাকেট ইত্যাদি বের করতে লাগলো। ক্যাপ্টেন ঢুলতে ঢুলতে এসে এক থাবা দিয়ে সব মেঝেতে ফেলতে গেলো। মেরি তাকে বাধা দিতে গেলে তার লম্বা নখ ক্যাপ্টেনের গালে গিয়ে লাগলো। চিকন ধারায় রক্ত বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। ক্যাপ্টেন প্রথমে থমকে গেলো। তারপর একহাত দিয়ে নিজের গালে আঙুল ছুঁইয়ে এনে দেখলো রক্ত পড়ছে। “ তুমি আমার রক্ত বের করে ছাড়লে ?’ খুবই শান্ত ভাবে বললো সে। মেরি এগিয়ে গেলো মুছিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু প্রচণ্ড জোড়ে ক্যাপ্টেনের এলোপাতারি চড় থাপড়ে সে মেঝেতে পড়ে গেলো। তার একটা চোখে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর মেরির হুশ ফিরলো। সে অন্ধ চোখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে। চোখটায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। তার মধ্যেও সে আস্তে একটা চেয়ারের পায়া ধরে নিজেকে সোজা করলো। “সে আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে।’ কোন তাড়াহুড়া না করে মেরি ভাবতে লাগলো। তার মাথাটা একদম ফাঁকা এখন। কিন্তু একটা স্বর অন্তরের ভেতর থেকে তাকে যেনো নির্দেশ দিয়ে গেলো। এখন তার নিজের কোণে ফিরে যাবার পালা।
ফেরার পথে ট্রেনে অনেকেই তার ফোলা কালসিটে পড়া চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলো। সেদিকে মেরির কোন মনযোগ নেই। দেখতে পাওয়া না পাওয়ায় এখন আর কিছু যায় আসে না।
জোনস একটা কথাও জিজ্ঞেস করলো না। কেবল মেরির রক্তাক্ত চোখ পরীক্ষা করার জন্য একজন চোখের ডাক্তারকে ফোন করে আসতে বললো। তারপর বাথরুমে নিয়ে গেলো তাকে ধুয়ে দেবার জন্য। অষুধপত্র আর চিকিৎসার পর মেরি ঠিকই দেখতে পাচ্ছে এখন।
ক্যাপ্টেনের মদ গেলার মাত্রার সাথে সাথে আবারও সে অসুস্থ হয়ে পড়লো। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে খুব শীঘ্রই আবার সুস্থও হলো। ফেরার পথে সে এক ভাসমান পতিতাকে তার ওখানে তুলে নিয়ে এলো। কিন্তু কামবোধ তাকে তেমন তাড়িত করছে না দেখে সে তাকে ভাগিয়ে দিলো। ছবি আঁকার ইচ্ছাও তেমন তাড়িত করে না এখন। সমুদ্রাভিযানের সেই রোমাঞ্চ এখন তাকে উদ্বেলিত করে না। অবশেষে সে বুঝতে পারলো যে মেরির শূণ্যতা সে টের পাচ্ছে। এতোদিনের অভ্যাস কি সহজে ভোলা যায় ? মেয়েটা আসলে ভালোই ছিলো। সে নিজের স্বাধীনতাবোধকে এতো বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়েই সব খুইয়েছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন ছাড়বে না। এর শেষ দেখে ছাড়বে। আসলে ওকে ওভাবে আঘাত দেয়া উচিত হয়নি সেদিন। কিন্তু ভেবে দেখো, আমাকেও তো সে চড় মেরে রক্ত বের করে দিয়েছিলো। আর এর পেছনে কারণ হলো তার দেয়া নীল পাজামা। যত্তোসব হিংসুটে। বড়লোকদের ভাবনা সবসময় মালিকানা নিয়ে। শালা।… কিন্তু তাকে তো ফিরে আসতেই হবে ক্যাপ্টেনের কাছে। এ ছাড়া তো তার আর কিছু করার নেই।
কিন্তু মেরি ফিরে এলো না। ক্যাপ্টেন প্রথমটায় বিরক্ত, তারপর খুবই আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেলো। তার শেষ দিকের কয়েক বছরের সাফল্য তার কাছে ফালতু বলে মনে হলো। এই পৃথিবীতে কোন বিচার নেই। সবাই যখন নতুন নতুন শিপ নিয়ে আর্কটিক, টেরা ডেল ফুয়েগায় অভিযানে যায় সে তখন একটা পুরাতন ভাঙা বাথটাবের মতো জাহাজ নিয়ে অভিযান থেকে ফেরে হাহ্। তার মনটা একটু হালকা করা দরকার। কিন্তু মন খুলে কথা বলার একটা লোক নেই। ঐ খানকি মাগি লিজি তো শীত নেই বর্ষা নেই কাপড় খুলে পড়ে থাকে আর তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করো এখন কোন্ সিজন ? ও তো একটা গোলাপি মাল! এখন তার দরকার এমন একজন যে তাকে বোঝে। মেরি বুঝতো- মেরি চলে গেছে। গেছে যাক। অনেক সময় চলে গেছে আর ফেরানো যাবে না। ভাবতে ভাবতে ক্যাপ্টেন অপ্রকৃতিস্থের মতো নিজমনে মাথা নাড়তে লাগলো।
এতো কিছু ঘটার পরও ক্যাপ্টেনের মেরির হৃদয়কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা নিয়ে অতিরিক্ত বিশ্বাস ছিলো। ভাবতো হয়তো এখনো সে ডাকলেই মেরি চলে আসবে। হ্যাঁ তাকে সে চড় মেরেছে, ঘুষি মেরেছে, কিন্তু এসব করতে সে-ই তাকে বাধ্য করেছে। হাসপাতালের বেডে গনোরিয়া আক্রান্ত কুকুরের মতো শুয়ে থাকতে থাকতে সে মেরির অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু কেউই তাকে দেখতে এলো না। মেরি তখন তার নাতির ডায়াপার বদলাতে ব্যস্ত। একটি শিশু, এক মিরাকল! মেরি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। যে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে, তারচেয়ে যে ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছে- তার প্রতি মায়া বেশি বোধ করছে মেরি। এ হলো সেই মেরি, যে কিনা ছোটবেলায় স্কুল শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলো। যে সবসময়ই অসহায় আর দূর্বল আর সরলদের প্রতি ছিলো সহানুভ’তিশীল।
কিন্তু কোনরকম যুক্তি তর্ক কার্যকারণ ছাড়াই মেরিকে চাই ক্যাপ্টেনের। আর কোন কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে কি বোঝে না যে তাদের জন্ম হয়েছে একে অপরের জন্য ? এতোসবের পর একদিন ক্যাপ্টেন ভাবতে বসে অনেক তো হলো। এবার জাহাজ ফেরানো যাক। একজীবনে কাউকে একবার আছাড় দেয়াই যথেষ্ট! সে একটা কঠিন চিঠি লিখলো জোনসকে। “ আপনি কি নিজেকে মানুষ বলে ভাবেন? কতো বছর ধরে আমি আপনার বৌকে নিজের রক্ষিতা বানিয়ে মজা করলাম, আর আপনার তাতে কোন শীত-গ্রীষ্ম নেই ? আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে। এবার আপনার সম্পত্তি আপনি অবিলম্বে বুঝে নিন।’
উত্তর পেতেও তাকে তেমন দেরি করতে হলো না। “প্রিয় ক্যাপ্টেন, আপনি একটু ভুল করেছেন। আমি আপনার রক্ষিতাকে নিয়ে বহু বছর ধরে ঘর করে আসছি এবং এটা আমার ভালোভাবে অভ্যাস হয়ে গেছে। আমরা দুজনই খুব সুখী মানুষ। শুভেচ্ছাসহ, জোনস।’
—————————————————
ইউরি নাগিবিন ১৯৪০ সালে যখন মস্কোর ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফির ছাত্র, তখন তার প্রথম ছোটগল্পের বই প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি ‘তুর্দ’ নামক সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে সরাসরি যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হন। নাগিবিনের লেখার ব্যপ্তি বহুবিস্তৃত। শিকার কাহিনী থেকে শুরু করে শিশুতোষ, যুদ্ধ থেকে নাটকের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় কিংবা জনজীবনের সুখদুঃখ থেকে প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্যময়তা সবদিকেই তিনি তার কলম চালিয়েছেন। তার অসংখ্য বই পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তিনি ফিল্ম স্ক্রিপ্টও লিখতেন। বিশ্বখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোশাওয়া তাঁর দারশু উজালা ছবিটি তৈরী করেছেন নাগিবিনের চিত্রনাট্য থেকেই। এই গল্পটি তার ‘এ্যান আনরিটেন স্টোরি বাই সমারসেট মম’ সংকলনের নামগল্পের অনুবাদ।