তুহিন সমদ্দার

আমি আবার আসবো

মেসেঞ্জারের আননোন মেসেজটা কবে থেকে জমা হয়ে ছিলো কে জানে। রূপ  সেটা ডিলিট করতে গিয়ে ভ্রূ কোঁচকালো। একটা ছবি, বেশ পুরোনো এবং ঝাপসা। দেখে মনে হচ্ছে সেকালের অটোমেটেড ক্যামেরায় তোলা। চারদিক রাউন্ডকাট করা ছবিটা মনে হয় দীর্ঘদিন সস্তা এ্যালবামে বন্দী ছিলো। কেউ সেটার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। তিনজনকে দেখা যাচ্ছে ছবিতে। তিনটা ছেলে, বয়স গোঁফ ওঠার আগে আগের। একজনের মাথায় হ্যাট। গলায় হাত দিয়ে একে অন্যকে ধরে আছে। একটা পুরোনো দালানের সামনে দাড়ানো তিনজন। ড়ানদিকে একটা তালগাছ তার অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। তিনটা মুখ দেখার জন্য রূপ ছবিটা বড় করলো। দেখলো। দুুজন অপরিচিত। তৃতীয়জনও। কিন্তু তার বুকটা ধ্বক করে উঠলো এজন্য, কারণ তৃতীয় ব্যক্তিটি সে নিজে!
এটা কিভাবে হয়? অবিকল তার মতো দেখতে মুখটা, তাও আবার একটা ছেলে। রূপ টের পেলো তার হাত কাঁপছে। আর কোনো ক্লু আছে কিনা দেখতে সে মেসেজের প্রোফাইল এ্যাড্রেসটা দেখলো। উদাসিন পথিক। বোঝাই যাচ্ছে ফেক আইডি।…  কে হতে পারে?

ছবিটা কোথায় কখন তোলা সে বুজতে পারছে না। এমন কোন ছবি সে তুলেছে বলে মনে পড়ছে না। সবচে বড় কথা ছবির ওই মুখটা একটা ছেলের। কিন্তু অবিকল তারই মতো দেখতে। এমনকি চোখের কাজলও তারই মতো। রূপের মাথা ঝিমঝিম করছে। একটা ফোন নম্বর দেয়া আছে ছবির নিচে। যেটা সে খেয়ালই করেনি এতক্ষণ। কিন্তু নম্বরটা টি এনটির মনে হচ্ছে। এই রাতে কি করা উচিত হবে? করে দেখবে নাকি? ভাবতে ভাবতে রূপ মোবাইল রেখে বাথরুমে ঢুকলো ব্রাশ করতে। আয়নায় নিজেকে দেখলো খুটিয়ে। বয়সের ছাট পড়ে যাচ্ছে কী? চোখের পাশে ক্লান্তির কালো র্ং। হবারই কথা। ওই ছবির মুখটার মতো ছিপছিপে একদিন সে ছিলো। হয়তো এখনো কিছুটা আছে। কিন্তু অমন ছেলেদের শার্টপ্যান্ট পড়ে গলাগলি বেধে ছবি তোলার ঘটনা তার জীবনে ঘটেনি শিওর।

তাহলে কে? আর বেছে বেছে উদাসীন পথিক তাকে এটা পাঠালো কী করে? কোন কূল কিনারা করতে না পেরে সে চিন্তাটা বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। আর তখনই তার যে কথাটা মনে পড়লো, সেটা শরীরের রক্ত জমাট বাধার জন্য যথেষ্ট!

ছবিটা ভাইয়ার। মানে মাঝের ওই পরিচিত মুখটা আসলে সে নয়, তার বড়ভাই আফজালের। মানে মনি র। মনি পড়তো ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা তখনকার কোন শিক্ষা সফরের হবে হয়তো। ছোটবেলায় সে নাকি দেখতে রূপের মতোই ছিলো। মেয়েলি ভাব ছিলো ভাইয়ার। তাকে কারা যেনো মেরে ফেলেছিলো। কিংবা সেটা আত্মহত্যা। পুলিশ যা বলেছে। ভাইয়ার কি জানি সমস্যা ছিলো। রূপ তখন অনেক ছোট। ভাইয়াকে তার মনেও নেই ভালো করে। রেললাইনের ধারে তার লাশ পাওয়া গেছিলো, ক্ষতবিক্ষত। চেহারা চেনা যাচ্ছিলো না। কেডস দেখে শনাক্ত করে পোস্টমর্টেম ছাড়াই কবর দেয়া হয়। রুপ এসব বড় হয়ে জেনেছে।

বিছানায় শুতে গিয়ে সাহস করে সে ওই নম্বরটায় কল দিয়ে ফেললো। তিনবার রিং হবার আগেই কে যেনো ধরলো। তারপর ফোপানির আওয়াজ শুনতে পেলো রূপ। কে কাদছে? কলটা কেটে পি পি করতে লাগলো কিছুক্ষণ। সে রাতে রূপ আর ঘুমোতে পারলো না।

(অসমাপ্ত)

অবদমন: একটি অশালীন পর্যালোচনা

ক.
খারাপ হবার চান্স পাইনি বলে ভালো…

ঝিকাতলা থেকে বারিধারা যেতে, যেভাবেই যাই- কমসে কম একঘন্টা লাগবেই। তার ওপরে আজ সোয়া আটটা বেজে গেছে! নটার অফিস ধরার জন্য ব্যাকুল আমি রাস্তায় বেড়িয়েই বুঝতে পারলাম আজ খবর আছে। মোড়ের কাছে যেখানে সিএনজি অটোরিক্সা চালকবৃন্দ নেহাৎ খোশগল্প করার জন্য ওৎ পেতে থাকে- আজ তারা আরও বেপরোয়া। বারিধারা কেউ যাবেনা। কোথায় যে যাবে, তা তাদের জন্মদাতারা জানলে নিশ্চয়ই তাদের জন্ম দেয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও মনে জন্ম দিতো না। আমার আশেপাশে আরও অনেকে বিভিন্ন স্থানে যাবার জন্য প্যাশলামী করছে। কিন্তু চালকেরা আমাদের উপদেষ্টা মণ্ডলীর মতোই নীতিতে অনড়! এর ভেতরেই দেবদূতের মতো একটি সিএনজি চ্যারিয়টের ন্যায় আমার সামনে এসে থামলো। কোঁই জ্জাইবেন বাঁই? গ্রিল করা খাঁচার ভেতর থেকে নেহাৎ অবজ্ঞা ভরে মেগাসিটির টোনে জিজ্ঞেস করলো সে। (আমার ধারণা, এই খাঁচা সৃষ্টির পেছনে প্রধান মোটিভ হলো: ভয়। পাবলিকের ওপর নিতান্ত অন্যায়ভাবে তারা যে বাড়তি ভাড়া আদায় করে কিংবা মিটার ছাড়া ‘কন্টাকে যাইমু’ বলে খামি দেয়; তার থেকে নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে সচ্ছন্দ রাখার জন্য এহেন খাঁচার চেয়ে উপযুক্ত আর কী আছে?) তারপর খুব দয়ালু স্বরে উঠতে ইশারা করে শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়র মতো লাজুক হেসে বললো দশটা টাকা বাড়াইয়া দেতে অইবে কইলাম। এবার আমি তার দেশের বাড়ি ঠিক পেলাম। বরিশালের বিল অঞ্চল থেকে এসেছে ব্যাটা। আর এসে একদম অমানুষ হয়ে গেছে। লোকটার কপাল খারাপ, তাই বাঁ দিকের দরজাটা খুললো থুথু ফেলবে বলে। কিন্তু ওর আর থুথু ফেলা হয়ে উঠলো না। কেননা ‘দেতে হইবে’ শুনেই আমার রক্ত চড়ে গেছে মাথায়। খপ করে বাঁ হাতে চুলের মুঠি ধরে ডান পা ভাঁজ করে মাসুদ রানার স্টাইলে হাঁটু দিয়ে সজোড়ে মারলাম ওর মুখে। নাকের হাড় যে এতো নরম তা আগে জানা ছিলো না। ঘট করে শব্দ আর গলগল রক্ত একসাথে বেরোলো। মাথাটা ঠুকে গেলো উপরের রডের সাথে। খানকীর পোলা, তোর দশটাকা আইজ বাইর করতাছি শুয়ারের বাচ্চা, বাইরা চোদনা! …কী হইলো, মারলেন কেলেগা? বলে যে হিতাকাঙ্খী বোকাচোদা ব্যাক্তিটি এগিয়ে এলো সিএনজি চালকের সহমমীর্ হয়ে- তাকে আমি মারলাম না। শুধু বললাম, মাঙ্গের পোলা যেইহান দিয়া আইছো, হেইহানে ভইরা দিম্ যা ফোট্! আমার রক্তচক্ষু আর খুনে চেহারা দেখে জটলা তেমন জমলো না। অদুরে কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণের মতো জনৈক ট্রাফিক সার্জেন্ট অলস দৃষ্টিতে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন। ট্যাক্সিচালক নাক চেপে হতবাক কাঁপছে ভয়ে। আমি চাপা শাসানির স্বরে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম— চালা!! লোকটা টু—শব্দ না করে মিটার এ্যাডজাস্ট করলো আমি উঠে বসার আগেই তারপর ঘরাৎ করে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো। বেশ খুশি খুশি মনে ক্রোধ প্রশমিত আমি সিগারেট ধরালাম… আপনাদের কী ধারণা, ওপরের ঘটনাটা সত্যি সত্যি ঘটিয়েছি আমি? আরে নাহ্ , ও—তো আমার ভেতরের জিঘাংসা! যা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ক্রমাগত হজম করে যাচ্ছি। আসল কাহিনী হলো দশ বাড়তি মেনে নিয়েই আমি সিএনজিতে উঠে বসেছি। তবু যদি অফিসটা পাই আজ… বোকাচোদার বাটখারা আর কাকে বলে! তদুপরি মদনমোহন তর্কালঙ্কার আমাকে মেনে নিতে হয়েছে ওর মিটার টেম্পারিং আর ভাংতি নাইয়ের নখড়া। ফলাফল একশত টাকা!

দর্শকশ্রোতা , আমার অবদমনের এই উদাহরণ আপনাদের জীবনে সত্যি সত্যি হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসুক এই কামনা নিয়ে শুরু করছি। আশাকরি সবাই খারাপ আছে, অবদমিত আছেন এবং সেই খারাপ থাকাকে যথাসম্ভব দমিত করে ভালো থাকার বেহুদা এ্যাক্টিং করতে করতে রীতিমতো হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। সাবাস!

তো আগেভাগেই বলে রাখি: গদ্যে তত্ত্বের তালাশ করেন যারা, তাদের জন্য দুঃখিত, কোন আশার বাণী শোনাতে পারছি না। এবং যারা অবদমন বলতে যৌন—অবদমন শব্দবন্ধের মোড়কে ফ্রয়েড—ফ্রাই খেতে চান তাদেরকেও অন্য রাস্তা দেখতে হবে। বস্তুত, যৌনদণ্ড বা তদ্বিষয়ক কোন চুলচেরা (বালছেড়া) ব্যাখ্যা এখানে বালখিল্য! প্যাট্রিয়ার্কির ইয়ার্কি করতে করতে এমন ন্যারো ফিল্ড অব ভিশন তৈরি হয়ে গেছে আমাদের যে অবদমন শব্দটি তার প্রকৃত আবেদন হারিয়ে বসে আছে। শুনলেই যৌনগন্ধের ভিয়েনের স্বাদ পাওয়া যায় যেন। অথচ বসের ঝাড়ি খেয়ে, চারপাশে কতো কতো সফলতার হাইরাইজ প্রত্যক্ষ করে আর বন্ধু বা কলিগের স্ত্রীর আটসাঁট শরীরের সাথে নিজের প্রাপ্তির ব্যালেন্সসিটে ঘাপলা তৈরি হলে যে সো—কল্ড অনেস্টির মখমলে নিজেকে জড়িয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়ায় আর ‘এই গরীব দেশে জন্ম না নিলে হু হু আমিও দেখিয়ে দিতাম…’ আচরণকে আপনি কী বলবেন, শুধু ব্যর্থতা? নাকি আরও কোন ফ্যাক্টর কাজ করছে এখানে? প্রকৃতপক্ষে, এক অমোঘ অচীন অবধারিত অবদমন আমাদের চলমান জীবনে ক্রমশ বহমান। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে শ্রোতা—ভাই—বন্ধু আপনাকে দিয়ে কিছু শর্তসন্ধি সাইন করিয়ে নিতে চাই। তাতে আমাদের দুপক্ষেরই কথা বলতে সুবিধা। কেননা অঙ্ক করতে হলে কিছু সমীকরণতো আপনাকে মানতে হবেই, না কি? তো এক্ষণে আমার প্রধান দুটি অনুসিদ্ধান্ত— যা আমি বোধ করছি— আপনি একমত হবেন:
এক: আমরা একটি বদ্ধ সমাজে বসবাস করছি। এবং
দুই: আমরা একটি সা¤প্রদায়িক বদ্ধ সমাজ—রাষ্ট্রে বাস করছি।

খ.
আগামী শতাব্দীতে বালুচরী শাড়ি
বালিহাঁসের মতোই মাংসাশীদের খপ্পরে পড়বে…

অতিসা¤প্রতিক বিষয়—বিশ্লেষ করার কিছু বিপদ আছে কারণ কাহিনী যেহেতু তখনও চলমান তাই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলা মুশকিল। যাদুঘর থেকে প্রত্ন—পাচারের বিষয়টি সম্বন্ধে আপনারও নিশ্চয়ই নিজস্ব বীক্ষণ আছে। তথাপি যদি জিজ্ঞেস করা হয় সরকার বা সরকারে বসা লোকগুলো কি শুধুমাত্র তাদের মাথামোটা চিন্তার ফলেই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাহলে আপনি তার সাথে যোগ করবেন উদাসীন পথিকের মনের কথা, লোভ, ওভারসীজ টুরের মূলো, ডোনারদের প্রেসার, দেশপ্রেমের অভাব আর কর্তব্যে গাফিলতি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ভাবুনতো, যারা বামিয়ান পর্বতে বুদ্ধের প্রাচীন মূর্তিদুটি গোলার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছিল, সেখানেতো আন্তর্জাতিক চাপ ছিল, নিন্দা উঠেছিল। তবুও রক্ষা পায়নি শেষ পর্যন্ত। আমরা তো তবু প্রতিবাদ করেছি (ভাবতে শান্তি পাই! আসলে কি প্রতিবাদ হয়েছিল, তেমন করে?)। আর এসবের পেছনে আমাদের প্রত্যেকের অবদান সমপরিমাণ। শৈশব থেকে অবদমনের চুড়োয় আরোহন করে বসে আছি আমরা। এবং একথা আশ্চর্যরকম সত্যি যে, যতো ধরনের দমননীতি রয়েছে তার মধ্যে সাংস্কৃতিক অবদমন শিরচুড়ামনি! রাষ্ট্র তাতে মদদ দেয়। বলে: দেশে ভয়ানক সৌভাত্তৃত্তো বিরাজ করিতেছে। ওদিকে যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাব—গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে নানাপ্রকার অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়। রাস্টোপতি ও বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেত্রীবর্গ তাতে বাঁণী দেন। বলেন, আমাদের হাজার বছরের সাফল্যমণ্ডিত ইতিহাস রয়েছে। দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আমরা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অবস্থান করতে যাচ্ছি বলে জনগনের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কচুশাকের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে চালের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় দুই টাকা কমে এখন মাত্র বিয়াল্লিশ টাকায় বিকোচ্ছে। অদিকে ঘোষিত পুরাকীর্তির নিদর্শন—মন্দিরগুলোর খোয়া যাওয়া মূর্তির বেদিতে ছাগলের লাদি আর সদ্য চূণকাম করা শ্যাতলা পড়া মোটা দেয়ালে অনভ্যস্ত বাংলালিপিতে খোদিত: তোরে চু—! শ্রোতাবন্ধু আপনি যদি বিষয়গুলিকে কো—র্রিলেট করতে পারেন তাহলে ল্যাঠা চুকে গেলো। আর তা না হলে আমাকে সেই শুরু থেকে শুরু করতে হবে, যখন আমাদের শেখানো হয় জল নয় পানি, মাংস নয় গোশ্, খোদা হাফেজ নয় আল্লাহ হাফেজ। তো আমাদের সাংস্কৃতিক অফিসাররা যদি বজ্রসত্ত্ব বা বিষ্ণুমুর্তির মাজেজা না বুঝে থাকেন তবে তা তো তুশ্চু। অবদমনের বাই প্রডাক্ট হয়ে আমরা দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছি আর ছড়িয়ে দিচ্ছি আহা রাশি রাশি অন্ধকার। কে আমাদের ভরসা দেবে কে দেখাবে আশার বাউন্ডারিÑ তাতে কোন্ চঁ্য্য্য্য্য্য্য্যাট এলোগেলো? আর আমার বিদেশিনী কলিগ কিছুতেই বুঝে পায়না, ফ্রান্সের মতো একটি কালচাড়ালি ডেব্লাপ কান্ট্রিতে আমাদের আর্টিফ্যাক্টসগুলি পাঠানোতে আমার আপত্তি কেনো, যেখানে আমার সরকারই সাইন কোরেছে। তার মতে এ—ও একধরনের কালচারাল রিপ্রেশন। এবং ফ্রয়েড সাহেব যথার্থই বলেছেন (?), অবদমনের ফল হয় মারাত্বকÑ সুদুরপ্রসারী এবং বহুদিগবিস্তৃত! জেনে রাখুন, নিজের বৌকে নাভির ওপর শাড়ি পড়তে বলে অন্য মেয়ের নাভির দিকে তাকাবেন না।

গ.
হালায় আইজকা নেশা করছি বহুত…

ঢাকা শহরের যতোগুলো ঘোষিত ও অঘোষিত বার বা মদবিপণনকেন্দ্র রয়েছে তারা সকলেই শুক্রবার বন্ধ থাকে। একমাত্র বোকাচোদা কান্ট্রিতেই এহেন ফাজলামি চলতে পারে। এর মানে হচ্ছে আপনি ইচ্ছে হোক বা অনিচ্ছায় সাপ্তাহিক ঐ ছুটির দিনটিতে অন্তত সাত্ত্বিক থেকে নিরীহ সাদাসিদা সহি জীবন যাপন করতে বাধ্য হবেন। বাকি ছয়দিন ধর্ষণ ও অপরাপর অন্যায় আচরণ করলেও আপনার নাম সিলেবাসে নেই। আমাদের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী সম্ভবত এ কারণেই বাড়িতে মদ রাখতেন। আর কেউ সম্ভবত রাখে—টাখে না। আহা বেচারা।

ঘ.
ডেকো—হেক্টা—কিল—মারিয়া—দেশি—সেন্টি—মিলি!

যৌন—অবদমন ওয়াইডলি ে¯প্রড হবার পেছনে বড় কারণ পাশ্চাত্যের প্রপাগান্ডা বলে আমি মনে করি যদিও তাবৎ রিপ্রেসনের ভেতরে উহা অতি সামান্য অংশ। বলতে গেলে হিমশৈলচূড়া। কোথায় নেই তার অস্তিত্ব বলতে পারেন? ভালো মানুষের সংজ্ঞার খোলসে আর খারাপ মানুষের তকমার কাঠামোয় বারুদের মতো ঠাসা আছে বিস্ফোরণোম্মুখ অবদমনের এমুনিশন। তবে আপাত—দৃশ্যমান অংশ বলেই হয়তো যৌন—অবদমনভিত্তিক কালচার আর কূটকচালি অন্যান্যগুলির চেয়ে বেশি। একে ফিগার—আউট করা অপেক্ষাকৃত সহজ সেই অর্থে। নিষিদ্ধ ভোগ চরিতার্থ না করতে পারার রিরংসা পরিমাপণের মাধ্যমে অনায়াসে তাকে লেবেল মারা সম্ভব। এবং তার পরিত্রাণে পাশ্চাত্যের প্রেসক্রিপশ পাওয়াও তেমন কঠিন নয়। অথচ প্রাচীন—প্রাচ্য কখনোই যৌন—অবদমনের পীড়ন অনুভব করেনি। তার নিজস্ব একটি স্যাক্সুয়াল—ফিলসফি ছিল, আছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের তাতে মন ভরে না। তারা বরাবরের মতো তাদের আগ্রাসী বোধ থেকে আমাদেরকে জ্ঞান দেয়। আমরা যেন তা গ্রহণ করি। তারা বলে, তোমরা এখনও সোসাল—এনিমেল হয়ে উঠতে পারোনি। দেখো আমরা এভাবে এভাবে সেক্স করি, একে বলে উদ্দামতা, একে বলে অর্গাজম আর এইভাবে নারী শরীরকে ছুঁলে তাতে সম—অধিকার বিঘ্নিত হয় না। এর ফলাফল ধরে উঠে আসে আর এক ডব্লিউ ডব্লিউ এফ চ্যাম্পিয়ন— জেন্ডার ইস্যু। কিন্তু তাদের বেধে দেয়া বেঞ্চমার্কে আমাদেরকে উৎরাতে হবে কেনো? আর এইসব, সকল বঞ্চনার পেছনে যে অর্থনৈতিক অসাযুজ্য; তার কথা তুললেই ওরা তখন একারবে বলতে থাকেন রাজনৈতিক অব্যবস্থা ও অদূরদর্শীতার কথা। ফলত গুড গভর্নেন্স আমাদের পথ দেখাবে এই মনে করে কতো কতো বাকোয়াজের পাখোয়াজইনা আমাদের কানের কাছে বাজানো হচ্ছে।

কেমন করে এমন একটি ভিশাস—সার্কেলে যুক্ত হলাম আমরা তা খুঁজতে গেলে দেখা যাবে সমাজের স্তরে স্তরে সুপার শপের মতো সাজিয়ে রাখা আছে দমন—অবদমন আর ভোগের নামে আসক্তির যাবতীয় অনুপান যা একটি বৈষম্যময় বিজাতীয় সমাজসূচনার জন্য কেবল উপযুক্তই নয় অনিবার্য উপকরণও বটে। এবং চোখ থাকলে দেখা যাবে চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের মতো যতোগুলি রাষ্ট্রীয় সংস্থা ক্রিয়াশীল তারা ঐ চরকায় রীতিমতো তেল দিয়ে যাচ্ছেন এবং নিয়মমাফিক দেখভাল করছেন যাতে তা ক্রমাগত আরও শক্তিসঞ্চয় করে গর্দানে—গতরে দেখনসই হতে পারে। এবং এভাবেই ভোগ—বঞ্চনার বিপরীতমূখী দুই স্রোতে আমাদের নিজস্বতা ভেসে যাচ্ছে আর ভিজুয়ান একুইটির ভেতরে কাঠের পুতুলের মতো খাড়া করা হচ্ছে কিছু চিহ্নিত শক্রমণ্ডলী। যারা প্রতিরোধ পেলে ছায়াবাজির মতোই মিলিয়ে যেতে সক্ষম। কিন্তু আসল গডফাদার ধরাছেঁায়ার বাইরেই থেকে যায়। এভাবে ধাঁধায় ফেলে দেয়া বহু প্রাচীন একটি স্ট্যান্ট, যা বর্তমানে আমাদের নিজেদেরকেই হাত পা বেঁধে কুয়োয় ফেলে দেবার অবস্থা করেছে। আর আমরা তলিয়ে যাচ্ছি নিচে আর যেতে যেতে ভাবছি আমার সমাজে আমার কালচারের এই এই দিকগুলি সেকেলে হলেও তা আমার মেনে চলা উচিত কেননা তা এইভাবে নিজস্ব কৃষ্টি ধরে রাখতে সহায়তা দেবে। এবং পাশ্চাত্যের এই এই ভালো ভালো বিষয়গুলি আমার সংস্কৃতিতে অবশ্যই অবশ্যই আনতে হবে কেননা তা রপ্ত করতে পারলে সবাই আমাদের আধুনিক জাতি হিসেবে মেনে নেবে…

আমার কিছু দার্শনিক—কাম—বন্ধু রয়েছে যাদের কাছে মাঝে মাঝে তত্ত্বে টান পড়লে আমি তালাশ করি। তাঁদের মতেÑ
— অবদমন এক প্রকার ক্ষুধা, যার চরম প্রশমন অবাস্তব বলে সতত চলমান। এই তৃতীয়বিশ্বের দেশে বসে অবদমনের অবদান নিয়ে বাক্যব্যায় করাটাই এক সেন্সে লোকসান। কারণ ঢাকায় বসে পাত্তায়া বা বালির বীচের বিকিনির আস্ফালন নির্ঘাৎ ব্যাকফায়ার ঘটাবে চলমান জীবনে। মন আর মাথার কৈবল্য (বৈকল্য?) ঘটে যাবে। তবে এ কথাও ঠিক যে হিউম্যান ব্রেইন এমনভাবে প্রোগ্রামড্, যার কারণে চরম অপ্রাপ্তিকেও সে কোন না কোনভাবে ম্যানেজ করে নেয়। আর করে নেয় বলেই আমরা ক্রমাগত সংখ্যাটা বাড়িয়ে চলেছি: এই সেদিন শুনছিলাম বারো কোটি; তারপর সাড়ে তের কোটি, চৌদ্দ কোটি, এখন শুনছি পনের কোটির কিছু বেশি, সঠিক সংখ্যাটা চালের দামের মতো ব্যস্তানুপাতিক নয়তো!

ঙ.
এ্যায়সি আসানি নেহী হ্যায়রে মাগী…

আমার কৌতুহল ছিল একালের নিউ জেনারেশন অবদমনকে কিভাবে দেখে, কী ভাবে অবদমন বিষয়েÑ তারা তো নেটিজেন। প্রত্যেকেরই হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইস আর ফেসবুক আছে। বেলবটমের সহোদর কাটিংয়ের রাস্তা—ঝাড়–—দেয়া জিন্স আর যেনতেনপ্রকারেণ শট—ঢোলা টি—শার্ট চড়ানো মায়াময় দুটো চোখ আর চিবুকের কাছে এক চিলতে দাড়ির বাহানায় তাদেরকে নগর বাউল বলেই মনে হয়। গোড়ালি ছুঁই ছঁু্ই যে ল্যাগব্যাগ আনইম্প্রেসিভ ঝোলাটা সবসময় ওদের কাঁধে ঝুলে থাকে আমার রহস্য লাগে দেখতে ওর ভেতরে কী রাখে ওরা, কোন স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ায় নিয়ত! তো এদের কিছু স্যাম্পলের সাথে বাতচিত করে বোঝা গেলো, মুক্তিযুদ্ধকে তারা ৯০ এর পর থেকে বিবেচনা করতে চায়। তাদের কাছে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীরা ঘৃণিত কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের বিচার তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। এ এক উদ্ভট উটপাখী জেনারেশন। যাদের নিয়ে আমি না আশাহত না উচ্চাশী হতে পারি। অন্যদের নকল করে তার কাতারে পেঁৗছাতে উৎরাতে তারা নিয়তই ব্যস্ত। এবং কী ভীষণ পরিমাণে তারা ব্যস্ত সবকিছু ডাউনলোড করতে! ব্যতিক্রম হয়তো আছে। তবে তা সংখ্যায় সামান্য। অথচ কী বিপুল প্রাণশক্তি, তাকে যদি আত্মঅন্বেষণের দিকে প্রবাহিত করা যেতো…

চ.
শটগান দিয়ে তুমি চাঁদ পেড়ে ফেলো নার্সিসাস…

মাঝে মাঝে আমি ওভারব্রিজের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখি। মানুষের চরম অসহযোগের ভেতর যুক্ত হবার প্রচেষ্টা দেখি। এবং দেখি ম্যানিকিন মেয়েরা সাজুগুজু করে গুটি গুটি পায়ে ভীষণ অর্থবহ ইশারায় নিষ্পাপ—সরলতার পরাকাষ্ঠা হয়ে ত্রস্ত হেঁটে যায়। যেন আতঙ্কিত; না জানি কার ভয়ে ক্রমাগত তারা কেবল পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ছুটে যাচ্ছে জীবনে যা ঘটে চলেছে তার থেকে মুখ সরিয়ে হয়তো বাস্তবকে অস্বীকার করে অবাস্তব পিওরিটির দিকে। মনে হয় কে যেনো তাদের কাছে মন্ত্রণা দিয়েছেÑ তুমি ভেবো না, তুমি দেখো না, তুমি জেনো না যে, তুমি আরও বেশি কিছু জানতে দেখতে ভাবতে পারতে। বরং এই ভণ্ড নিষ্পাপের, সৌন্দর্যের শিরোপা তোমায় দিলাম। তুমি তাতে আপাদমস্তক ঢেকে চলো ভালো মেয়ে! সবকিছু এমন করে ঢাকো যেন বোঝা না যায় তোমার ভেতরে নারীত্ব উঠেছে।
— আসলে কাকে বলে ভালো মেয়ে?

শেষ সংকেত
যা লেখা প্রয়োজন ছিলো অথচ লেখার পরে নিজেই ভেতর থেকে বেছে বেছে শব্দগুলো পাল্টে দিলাম, পুরো লাইন প্যারা অব্দি ডিলিট করে দিলাম যেটুকু পড়তে বা পড়াতে সাহসে কুলোবে না ভেবে, আসলে হয়তো তাই—ই অবদমন।

========

টীকা:

  1. এই লেখাটি মক্সো করি গত ডিসেম্বরে, সেই সময়কার কতিপয় এডভাইজর ছারদের কথা কল্পনায় রেখেই!
  2. দর্শকশ্রোতা, আমি দশ বলছি, সংখ্যাটা বিশ, ত্রিশ যা খুশি আপনি বসিয়ে নিতে পারেন, সময় বিশেষে
  3. এই স্যাট্—টেক্—সাইবার—ইনফোর ভিজুয়াল দুনিয়ায় সঙ্গীতও যেহেতু দর্শিত হয় এবং ভিজিবিলিটিই একমাত্র মোক্ষ বলে ধরেই নিচ্ছি আপনি পাঠ করছেন না- দেখছেন!
  4. এখানে এসেই আপনার চোখ আড়চোখে এই প্রবন্ধ রচয়িতার নামের উপর চলে গেলো। যাবেই। আর আপনি যা গেস করেছেন ঠিক তাই: লেখক মনেহয় অযথা খুঁচিয়ে দেশে বিরাজমান স¤প্রতিতে চিড় ধরাচ্ছে। শালা মালু! …বস্তুত এই শব্দটি জ্ঞান হবার পর কিংবা তার আগে থেকেই এতো শুনেছি এবং এতোভাবে কু—ব্যবহৃত (এ্যাবিউজড?) হয়েছি এই শব্দটির পীড়নে যে মা ডাকের চেয়েও বড় আপন মনে হয় মাঝেমাঝে। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করুন একাত্তরে সর্বস্ব লুট হয়ে যাবার পর এগারো দিন পায়ে হেঁটে শরণার্থী শিবিরে নয়মাস কাটিয়ে কিসের আহ্বানে আমার পিতামাতাকূল নতুন একটি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে ফিরে এলো? আর কিসের কারণে আমিইবা গভীর রাতে ভলভো বাসের শেষ যাত্রীর মতো সংখ্যালঘু হয়ে এখনো সিট কামড়ে পড়ে আছি? …খেয়াল করেছেন, ‘লঘু’ অক্ষরগুলি পুরো ইস্যুটাকেই কেমন লঘু করে রেখেছে?
  5. চালের দাম হয়তো আরো বাড়বে ভবিষ্যতে। সেই সময়ে এই লেখাটি পড়তে বসে আমাকে আবার ‘সেকেলে’ বলে গালি দেবেন না যেন!
  6. বলেন তো, শূণ্যস্থানে কোন্ অক্ষরটি মোক্ষম?
  7. শব্দটিকে সাম্প্রতিক অনুষঙ্গের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না প্লিজ!
  8. দেখেছেন, পকেটে পাত্তির জোরে ওরা কেমন পৃথিবীটাকেই গ্রেড করে পৃথক করে ভিন্নভাবে আলাদা করে ফেলেছে?
  9. মাঝ বরাবর চাড় দিয়ে শব্দটি দুই খণ্ড করে ফেললে দেখবেন কি কুৎসিত নঞার্থক শব্দধাতু রয়েছে ভেতরে।

পুুনর্ভব

মৃত্যুর আগে এহেন অবস্থায় আকলিমাকে যখন তার স্বামী তাড়িয়েই দিলো তখন গোটাকয় কাপড় চোপড় আর টুকটাক দু একটা নেয়ার মতো জিনিষের পুটুলি আর সমিতির টাকায় কেনা ডিমপাড়া হোলামুরগীটা সহ আকলিমা এখন মাওয়াঘাটের এককোণে গুড়িসুড়ি হয়ে বসে আছে। মুন্সিগঞ্জের বোতলভাঙ্গা গ্রাম থেকে তার যাত্রা এখন বাপের বাড়ি শরীয়তপুরের ফাতরা গ্রামে। যায়গাটা ডাকাতের আস্তানা বলে বয়স না হতেই তার বাপ কাঠমিস্ত্রি মনিবুরের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো। বিয়ে দিলো যাতে নিজে আর একটা বিয়ে করতে পারে সেই উসিলায়। আকলিমা তের বছর পেরিয়ে এখন উনিশ।

এ কয় বছরে তার বয়সই বেড়েছে কেবল, বুদ্ধি বাড়েনি। ফলে শ্বশুরবাড়িতে সবাই যেমন আশা করেছিলো সে হলো তার বিপরীত। ফলে বৌয়ের খড়ম পা, সাপলেজি চুল আর শামুকভাঙা চোখ ইত্যাদি ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি তার বাপ নাকি কুড়িহাজার টাকা কুবলিয়েছিলো বিয়ের আগে মনিবুরকে দেবে বলে। সেটা না পেলে মনিবুর যে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে না, এমন শর্ত কোথাও লেখা নেই। কাজে কাজেই আকলিমার কোন সন্তান নেই আকলিমা ঘড়ামীর কষ্ট বোঝেনা আকলিমা ভাত পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলে বলে আকলিমাকে নিজেই পুড়ে কয়লা বনে যেতে হবে এমন একটি সর্বজনস্বীকৃত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সে যদি তা হতে না চায়, সে যদি দাঁ হাতে রুখে দাঁঁড়ায়, তাহলে তালাক দেয়ার চেয়ে আরও বেশি শাস্তিদায়ক হলো বাপের বাড়িতে খেদিয়ে দেয়া। নাহ তালাক দেয়ার এখন অনেক ঝামেলা। কোর্টের বারান্দায় ঠায় বসে থাকারও জো নেই, মাঝে মাঝে পুলিশ এসে সিঁড়ি কিলিয়ার করেন! বলে লাঠি হাতে অপমান করে। কালাকোট ম্যানেজ করা, তালাকের কারণ ব্যাখ্যা করা, স্বাক্ষী আনো, এভিডেন্স আনো হাজারটা নখড়া! এনজিওর লোকেরা থাকে তক্কে তক্কে। পারিবারিক আইনে মামলা ঠুকে দেবে। আচ্ছা, এই পারিবারিক আইন পরিবার ছেড়ে কোর্টে চালান হলো কি করে, ভাবে মনিবুর। তারচেয়ে সুবিধাজনক হলো বিনা আয়োজনে খেদিয়ে দেয়া, বা গুম করে দেয়া। তা দ্বিতীয়টা করতে হলে যেরকম কলজের জোড় লাগে মনিবুরের তা নেই। আকলিমা তাই এখন ফেরিঘাটের যেখান থেকে লঞ্চ ছাড়ার কথা সেই ঘাটের পাশটায় বসে আছে। তার এ অবস্থায় বড় সমস্যা হলো ঘাট-টিকিট না দিয়ে লঞ্চে চড়ে বসতে পারা। তার কাছে টাকা নেই তা নয়। কিন্তু বিনাটোলে ঘাটটা পার না হওয়া একধরনের বাজে খরচ আকলিমার কাছে। গতকাল সমিতি থেকে সে আরও একটা কিস্তি নিয়ে এসেছে। আঠেরশ বত্রিশ টাকা সর্বসাকুল্যে। বাপের বাড়ীতে এই টাকা তার অবস্থান পোক্ত করবে অবশ্যই। আর ডিমপাড়া হোলামুরগীটা দেখলে তার বাপের ঘরের নতুন বউটা তাকে একেবারে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে পারবে না।

লঞ্চ একটার পর একটা ছেড়ে যাচ্ছে। লোকজন গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে লঞ্চের তলপেটে। নামে লঞ্চ হলেও এটা আসলে কাঠবডি ইঞ্জিন। চল্টা উঠে যাওয়া সাদা রঙের মাঝে নিল লতাপাতাফুলের পাড় আঁকা শরীরে দোয়া ইউনুস খোদিত খুপড়ি কেবিন আর নীচে গলুয়ের নাকের পাশে লালে লেখা এম ভি হাতেম লঞ্চটা ভরপেট যাত্রী নিয়ে এই হেলানো দুপুরে মনে হচ্ছে পান চিবোচ্ছে আয়েশে। কালো হোৎকা চেহারার টিকিট কালেকটরের খুপড়িতে এখন বেশ ভীড়। এই সুযোগে আকলিমা- বুদ্ধি যতো ভোঁতাই হোক না কেনো- সেঁদিয়ে যাবে; গেলোও। তার যায়গা হলো ইঞ্জিনের পাশে তেলকালিমাখা প্রচÐ উত্তাপ আর বাজখাই শব্দশঙ্কুল এক কুনছিতে। তারপর লোক আরও লোক আর লোক আর মেলা লোকের ভীড়ে লঞ্চের খোলটা যখন দমাস করে ফেটে যাবার অবস্থা তখন সুকানীকে দেখা গেলো কাঠের সিঁড়ির দরজায়। এসেই সে বয়ান দিলো, চাইপা বহেন আর একটু চাইপা বহেন, সবারই যাইতে হইবো এতো ফাঁকা থাকলে চলবো কেমতে, চাপেন না বাই! ওই বানচোদ তোর কোন বাপের কোলে চাইপা বমুরে হৌরের পো বলে প্রতিউত্তর এলে সে তেমন গা না করে ইঞ্জিনের বগলে সেঁদিয়ে যায়। আর তার ঈঙ্গিতে শুঁটকোমত গোঁফ না ওঠা ছেলেটা বেদম ঘোরাতে থাকে শ্যালো মেশিনের চাকাটা। এই লঞ্চটা কারিগরী প্রকৌশলী ব্যবস্থার একটি চমৎকার ফিউশন। জলযান তথা যাবতীয় যানবাহনের কিছু না কিছু পার্টস এখানে সংযোজিত আছে। সেই লঞ্চ যে তাহার ধারণক্ষমতার পাঁচগুণ যাত্রীসাধারণ নিয়ে পদ্মা পাড়ি দেবেই দেবে তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু ষাটনলের মোচড়ে পড়ে হুদাহুদি ডুবে না গেলে পদার্থবিদ্যার সুত্রের সাথে বেজায় বেয়াদপি হয়ে যেতো বলেই এমভি হাতেম অবশেষে ডুবে গেলো। এবং ডুবে একেবারে তলিয়ে গেলো। জনা পাচেক যারা পেরেছে সাঁতারের চেষ্টা করেছিলো অবশ্য কিন্তু চোরা¯্রােত তাদের কোথায় ভাসিয়ে নিলো? অবশেষে আকলিমা খাতুন তার ডিমপাড়া হোলামুরগীটা সহ আটশোযাত্রীর এই ঈদোদযাপন সেযাত্রা পুরো ঈদের ছুটিটাকেই টিভির লাইভ রেসকিউ অপারেশনে বন্দী করে ফেললো। যে সকল বহুজাতিক টয়লেট্রিজ এতো দাম হাঁকিয়ে ঈদের গতরভারী চাঙ্কগুলি কিনেছিলো তারা এখন দেনদরবার করছে লাইভ রেসকিউর ফুটেজ কিনতে। সেনাবাহিনী এই উদ্ধার তৎপরতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুর্যোগমস্ত্রী তার কনন্সটিটিউয়েন্সিতে রয়েছেন একটি কলেজে কম্পিউটর সেকশন উদ্বোধনের কাজে। তিনি একজন দায়িত্বপ্রবণ ব্যক্তি, উদ্বোধনটা শেষ না করে তিনি এ অবস্থায় আসেন কী করে!

তো এহেন ডামাডোলের ভেতর উদ্ধারকাজ অসমাপ্ত রাখতে হলো তীব্র ¯্রােতের দাপটে টিকতে না পেরে। উদ্ধারকারী জাহাজ বখতিয়ার এখনো পথে। সেটা এলে পুুনরায় আবার শুরু হবে বলে ল্ইাভে জানানো হয়েছে কিন্তু তারপরও পাবলিক অকুস্থল ভীড় করে আছে। অন্তত সাড়ে পাঁচশো যাত্রী (সংখ্যা কখনো মেলেনা এ জগতে। কমবেশি তো হতেই পারে! আর তাছাড়া যাহা বাহান্ন তাহা বিরানব্বইও বটে!) নিয়ে- যার অধিকাংশই নিম্মবিত্তের- লঞ্চটা এখনো নিখোঁজ রয়েছে। যেখানে ডুবেছে সেখানে তার টিকিটিই নেই। পদ্মার ওই অংশে গভীর খাত। চোরা¯্রােত গুমড়ে উঠছে খালি। ডুবুড়িদের ডুব দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আটচল্লিশ ঘন্টা পর বখতিয়ার এলো। সাথে এলো বিআইডবিøউটিসির টো বোট, হার্নেস ঝোলানো আকাশচুম্বী ক্রেনসহ। কভারওল পড়া একদল চৌকশ ডুবুরীদল প্রথমেই ডিজিটাল লোকেটর দিয়ে লঞ্চটার ডিজিটাল সাবমারসিবল ইমেজিং করতে লেগে গেলো। কাজটা সহজ, কিন্তু এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সেটা যথেষ্ট ঝামেলাই তৈরী করলো। কারণ নদীর ওই একই স্থানে একটি ইমারতের অস্তিত্ব টেকনিশিয়ানরা খুঁজে পেলেন। সেটি নাকি সুলতানী আমলের। ভাবো?

(চলবে)

ভনলতা বেওয়া

আজার বচ্ছর হামি আস্তা মাপিতেছু বাহে দুনিয়ার আস্তায়,

আলাংফালাং মুই কম না করিচ্চি চ্যাংড়াকালে!
চিরিরবন্দর ছাড়ি দাগনভুইয়া গেলু কোচখালী বেলকুচি রোড-
ভন্লতা নামে এক বিটিচ্ছাওয়া পুছ্ করে

ট্যাঁকে মোর কতো আছে নোট?

… চুল তার ম্যালাদিন তেলসাবান না দেখিচ্চে,

মুখে নাই ছুনো-
পক্খীর বাসার মতো নয়ন মেলিয়া কয়

ফ্লেক্সি দ্যান দশটেয়া, চান যদি মন ও…!!!

জলের উজ্জ্বল শস্য

ইলিশ আমাদের জাতীয় ফল- একথা শুনেই হইহই করে উঠবেন না। ফল মানে শুধু ফ্রুট নয়, উৎপাদনও বোঝায়। তো আমার হিসেবে আগেকার যুগের কোন একটি আইটেমও যদি স্বাদ গন্ধে এখনো অবিকৃত থেকে থাকে, তো সেটা ইলিশ। বৃদ্ধ বয়ষ্করা অবশ্য একথা মানবেন না, বলবেন “আমাদের আমলের সেই ইলিশ কি আর আছে!” কিন্তু নেই নেই করেও এখনো ইলিশের যে সোয়াদ তা সত্যিই মনমাতানো। ইলিশ আহরণ ও বিপণনের পেছনে আছে নানারকম রাজনৈতিক আবেগ আর অর্থনীতি। গ্রেডের ইলিশ দেশে লভ্য নয়- কুবের কালচারে সব বেহাত হয়ে যাচ্ছে! যারা ইলিশ আহরণে জড়িত, তাদের জীবন ইলিশের মতো ততোটা চকচকে নয়। বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে অভিসিক্ত করেছেন ’জলের উজ্জ্বল শস্য’ নামে।সে যা-ই হোক, বছরের এই সময়টায় ইলিশ অনেক পরিপক্ক হয়ে ওঠে। সত্যিকারার্থে, প্রতিটি সিজনে ইলিশের ভিন্নরকম স্বাদ। এর অন্যতম কারণ মাছটি বিভিন্নভাবে রান্না করতে পারা।  ইলিশের বাহারি রান্নার একটা ছোটখাটো লিস্ট দেয়া যাক, তবেই বোঝা যাবে এর ক্ষমতা:

ইলিশ ভাজা, ইলিশের তেলঝোল, ইলিশ ভাঁপে/ভাতে, সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পানিকচুর ঝোল, ইলিশ ডাঁটা, ইলিশ পাতুরি, কালোজিরা ইলিশ, হিং ইলিশ, পোস্তো ইলিশ, দই ইলিশ, ইলিশ মুগডাল, ইলিশ পটল, ইলিশ কাঁচাটমেটোর ঝোল, কাচকলা ইলিশ ঝোল, চালতা ইলিশ, লেবু ইলিশ, আমড়া ইলিশ, ইলিশ আনারস, পঁচা ইলিশ, ইলিশ দিয়ে কচুরলতি, ইলিশ বাটা, ইলিশের লেজভর্তা, ইলিশ আচারি, দম ইলিশ, ইলিশ কোর্মা, ইলিশের ঝুরি/চচ্চরি, ইলিশ দোপেঁয়াজা, ইলিশ কলমি, কচুর শাকে ইলিশ, কচুমুখি ইলিশ, কচুর ছড়া/গাঁটি দিয়ে ইলিশ, ইলিশ কাঁকরোল, চালকুমড়ো ইলিশের পাতলা ঝোল, নতুন আলু ফুলকপি দিয়ে কড়া ইলিশ, ধুন্দল ইলিশ, ইলিশ বরবটি, সীম আলু দিয়ে ইলিশের ঝোল, পেঁপে ইলিশ, বেগুন ইলিশের ঝোল, কাঁচাআমে ইলিশ, শসা ইলিশ, পুঁইশাক মিষ্টিকুমড়ো দিয়ে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, মসুরডাল দিয়ে ইলিশের কালিয়া, লাউপাতায় ইলিশসেদ্ধ, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক, নারকোল ইলিশ ভুনা, ডাব ইলিশ, নোনা ইলিশ, ইলিশ ভুনা, ইলিশ পোলাও, ইলিশ মাছের ঝুরি ভাজা, ইলিশ আচার, সাদা ইলিশ, সরিষা ইলিশ, দই ইলিশ, ইলিশের কোর্মা, ইলিশের পাকৌড়া, নারকেলি ইলিশ, বেগুন আলু দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, আনারস ইলিশ, ভাপা ইলিশ, আচারি ইলিশ, ইলিশের পাতুরি, ইলিশ ভর্তা, ইলিশ শুটকি, ভাঁপা ইলিশ ভর্তা, ইলিশের মুড়িঘন্ট, ইলিশ ভাজা, ইলিশ মাছের ডিম ভুনা, ভিনেগার তেল মিশিয়ে কাটাসিদধ আস্ত ইলিশ, সরষে ইলিশ, ইলিশ পাতোরা, ইলিশ পুইশাক, ইলিশ দোপেয়াজা, ইলিশের ঝোল, তরকারি দিয়ে ইলিশ, ইলিশ খিচুড়ি, ইলিশ কোরমা, ইলিশের বারবিকিউ, ইলিশ  গ্রিল, ইলিশ কাবাব, ইলিশ খোলা, ইলিশ মাছের রেজেলা, চালকুমড়া ইলিশ, কলাপাতায় ইলিশ পাতুরি, লেবু ইলিশ, শাপলা দিয়ে ইলিশ, ইলিশ পোস্ত, তেল ইলিশ, কচুর লতি দিয়ে ইলিশ, ইলিশের দোরমা, ডাঁটা দিয়ে ইলিশের ঝোল, কচু দিয়ে ইলিশের ঝোল, বেগুন দিয়ে ইলিশ, সিম টমেটো আলু দিয়ে ইলিশ, মিষ্টি কুমড়া দিয়ে ইলিশ, পটল আলু দিয়ে পাতলা ঝোল ইলিশের, ইলিশ খিচুড়ি, কচুর মুখি ইলিশ, লাউ ইলিশ, কচুর লতি দিয়ে ইলিশের মাথা, শিম দিয়ে ইলিশ, নারিকেল ইলিশ, ইলিশের হালুয়া, কাঁটা গলানো ইলিশ, ইলিশ ঝিঙ্গের ঝোল, ইলিশ কোপ্তা,  ইলিশের পাতলা ঝোল, ইলিশ দিয়ে কাঠ কচু ভাজা, ইলিশ দিয়ে শাক, ইলিশ কাসুন্দি, ইলিশের কাটলেট, ইলিশ পিঠা, নোনা ইলিশ ভাজি, ইলিশ  দিয়ে  সীমের বীচির ডাল, নারকেল দিয়ে ইলিশ, ইলিশ মাছের লুকা ভুনা, ধুন্দল  বা মিনা দিয়ে ইলিশ, কাঁচকলা দিয়ে ইলিশের ঝোল, নোনা ইলিশের তরকারি, ইলিশ লতি, ইলিশ দিয়ে বরবটি ভর্তা, ইলিশ দিয়ে পটলের খোসা ভর্তা, ইলিশ দিয়ে লাউ খোসার ভর্তা, ইলিশের চচ্চড়ি, ইলিশের মরিচখোলা, ইলিশ কশা, ইলিশ দিয়ে পটল তরকারি,  ইলিশ দিয়ে কচু শাক ভাজি, ইলিশ দিয়ে কচুমুখি, নোনা ইলিশের পাতুরি, নোনা ইলিশ দিয়ে লাউ শাকের তরকারি, ইলিশের লেঞ্জা ভর্তা, ইলিশ চিতৈ, ওলকচু দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, তেঁতুল দিয়ে সর্ষে ইলিশ, ইলিশের মাথা দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল, কচু শাক দিয়ে  ইলিশ, আনারস ইলিশ, কাঁচা আম দিয়ে ইলিশ, ইলিশের রোল, চালতা ইলিশ, ইলিশের মরিচ খোলা, পুঁইশাক দিয়ে ইলিশ, ইলিশের মাথা দিয়ে কালাকচু শাক, করলা দিয়ে ইলিশ, ইলিশের ঘন্টি, মুগ ডালে ইলিশ মাথা, পুই পাতায় ইলিশ পাতুড়ি, কুমড়া ফুলের বড়ায় ইলিশ,  ইলিশ কমলা, পোস্ত বাটায় ইলিশ ঝোল, পানি ইলিশ, মেথি ইলিশ, ইলিশ ভেজে ভুনা, বেগুল আলু দিয়ে ইলিশ, পটল দিয়ে ইলিশ, সিম আলু দিয়ে ইলিশ, ইলিশ এর ডিম ভুনা, ইলিশ এর শুটকি, ডাব ইলিশ, ইলিশের মাথা দিয়ে মাষকলাই ডাল, সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশ ভাপা, ইলিশের মাথা দিয়ে চালকুমড়ার ঘন্ট, লেবু পাতা দিয়ে ইলিশ ঘাটা, ইলিশের মরিচপোড়া ঝোল, ইলিশ কোপ্তাকারি, কচু দিয়ে চুরচুরি, ঝাল ইলিশ, ইলিশ ঝুরি, ইলিশের শুটকি, ইলিশের ডিমের বড়া, ইলিশ-মুগ ডাল, বেকড স্মোক ইলিশ, জিরা বাটা দিয়ে ইলিশ, ইলিশের পোড়া, পটল ইলিশ, আমপোড়া ইলিশ, ইলিশের আস্ত কাবাব, ভাঁপে ইলিশ পোলাও, ইলিশের ডিমের কোর্মা, ইলিশ শুটকি মরিচ/ঝাল, বাদশাহী ইলিশ, ইলিশের ঝাল, সরষে পোস্ত ইলিশ, লেবু পাতায় ইলিশ, নারকেলের দুধে ইলিশ, পোস্তদানা বাটায় ইলিশ,কাটা বেছে বাঁশপাতা শুটকি দিয়ে ইলিশ, ইলিশ শসার ঝোল, কালিজিরার ঝোল, চর্চরী ইলিশের, ইলিশের কালিয়া, লেবু ইলিশ, ইলিশ রেজালা, শাহী ইলিশ কোর্মা, ইলিশ-বিরিয়ানী, কচুশাক দিয়ে ইলিশ, ইলিশের পানিখোলা, ইলিশ মালাইকারি, বেসন দিয়ে ইলিশ ফ্রাই, ilish with tometo sos, ইলিশ দিয়ে কাঁচাপেপের ঝোল, ইলিশ আলু ভুনা, ইলিশের ঝালচচ্চড়ি, জিরা ইলিশ, আলুু ডাটা দিয়ে ইলিশের ঝোল, কচুপাতায় নারিকেল দিয়ে  ইলিশ ভাপা, ইলিশের রোস্ট, লাউ পাতায় মুড়িয়ে ইলিশ ভাজি, ঝাল ঝাল নারিকেল দিয়ে ইলিশ পাতোড়া, ইলিশ মাছের বড়া, তেল ইলিশ, আলু মটরশুঁটি বেগুন দিয়ে ইলিশ, পেঁয়াজী ইলিশ, ইলিশের কাটলেট, ইলিশের টক, সর্ষ লেবু ইলিশ, লাউ ইলিশ, বড়ি ইলিশ, ইলিশ মাছের বিরন, ইলিশের মাথা ভর্তা, কমলালেবু দিয়ে ইলিশ, ইলিশ মাছ দিয়ে কলার খোসার ভর্তা, ইলিশ মাখা, কচুর পাতা দিয়ে ভাপ দিয়ে ইলিশ মাছের ভর্তা, ইলিশ এর কাটা বেছে কোপ্তা, ইলিশ মাছের ফুলের ভর্তা, বাদাম ইলিশ, ফুলুরি আলু বেগুন দিয়ে ইলিশ, সজনে ডাটায় ইলিশ ঝোল, লাউ পাতায় ইলিশ ভর্তা, পানি কচুর ডগা দিয়ে  লাবরা, ইলিশের মালাইকারি, আম কাসুন্দী ইলিশ, Spice onion hilsha, কাঁচা মরিচ পেয়াজ খোলায় ইলিশ, ইলিশ ভূনা, ইলিশ সাতকড়া ভুনা, ইলিশের  লেজ লাউ পাতার ভর্তা, ইলিশভাত, কাঁচা পেঁপের ইলিশ ঝোল, ইলিশের সুপ, ইলিশের মরিচ, ইলিশের গঙ্গা যমুনা, BBQ ইলিশ, ইলিশরসা, কাকরোল ইলিশ, তিল দিয়ে ইলিশের মুড়োঘন্ট, কচি আমড়া দিয়ে ইলিশ, মটরশুঁটি দিয়ে ইলিশ, পোস্ত ইলিশ, ইলিশ স্টু, ইলিশ তান্দুরী, সুপারি গাছের খোলে ইলিশ পাতুরি, রসুন ইলিশ, ইলিশ কাঁচা ভর্তা, আলু গোল গোল চাক করে কেটে ইলিশের কোরমা, ইলিশ দিয়ে কচুর ফুল রান্না, হান্ডি ইলিশ, নোনা ইলিশের ডিম নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না, ফুলকপি সীম নতুন আলু দিয়ে বাচ্চা ইলিশের ঝোল, ইত্যাদি।

একইভাবে ইলিশের ডিম দিয়েও আছে রকমারি রেসিপি। পৃথিবীর আর কোন মাছ দিয়ে এতো ধরণের পদ রান্না করা যায় কিনা আমার জানা নেই। মাছটির নমনীয়তা ও তীব্র ঘ্রাণ তাকে অনন্য করেছে। এককালে গরীবের মাছ ইলিশ খুব সহজে অল্প মশলায় রান্না হতো বলে প্রায় সব সবজি দিয়ে একে খাওয়া হতো। কিন্তু ইলিশ রেসিপি নিয়ে নতুনভাবে তেমন এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। রান্না করতে যারা আনন্দ পান তাদের জন্য আমি কিছু আইডিয়া শেয়ার করতে চাই। নতুন কিছু পদ এক্সপেরিমেন্ট করা যেতে পারে ইলিশ নিয়ে, যেমন- ইলিশ পুদিনা, কাঁচা তেতুল দিয়ে ইলিশ, ইলিশ শাশলিক, সীমের বিচি টমেটো দিয়ে ইলিশের ঝোল, ইলিশ মাশরুম স্যুপ, ইলিশের কোপ্তা, মাসালা ইলিশ, মুগডাল গাটি দিয়ে ইলিশ,  ইলিশের চুইঝাল, সাতকড়া ইলিশ, কষা ইলিশ, বাঙ্গী ইলিশ, ইলিশ কাবাব, ইলিশের বড়া, ইলিশ আলুবোখারার চাটনি, বোরহানী দিয়ে ইলিশ রান্না, ইলিশ বিরিয়ানী।

এইসব ফিউশন এখন যুগের দাবী। আপনাদের খোঁজে আরও কোন ইলিশের পদ থাকলে সেটা এখানে যোগ করতে পারেন। 😀😁

সেলফিকাণ্ড

আসল নামটি মফিজুর বটে এলাকার বিগ নেতা
পেছনে যতোই ডাকোনা মফিজ তার কানে গেলে সেটা
কেটে নেবে কান, জমিন আসমান এক হয়ে যাবে ডড়ে
মফিজুর ছিলো চাল ব্যবসায়ী-  কার আজ মনে পড়ে?

অত্র এলাকা মফিজের হাতে – অবৈধ ঠেক, দোকান
চাঁদা দেয় তাকে, টটস্থ থাকে পাতি নেতা, মাস্তান!
পাড়ার বেড়াল, বেওয়ারিশ যতো কুকুর, ইঁদুর, ছুঁচু
ডাকেনা উচ্চে, চেঁচামেচি করে- তাও স্বর করে নিচু।
মফিজের বানী- শাসন এখানে; জনাদশে বডিগার্ড
ঘিরে রাখে তাকে অষ্টপ্রহর- যেনো জেলভাঙা বার্ড
আনাগোনা করে টেন্ডারবাজ, সমাজবিরোধী, রিচ-
মফিজুর খুব বিজি থাকে রোজ, মোবাইলে আনরিচ।
 
ইদানিং তার ঝামেলা বেড়েছে- রেসপন্সিবিলিটি হাই
রাস্তা, সড়ক, গলি, সাঁকো, ব্রিজ উন্নত করা চাই।
আসছে দেদার বরাদ্দ- তার কাঙ্খিত ঠিকাদার
মফিজেরই শালা- রডের বদলে বাঁশেতে বাঁধে পিলার
সেইসমস্ত নির্মাণকাজে মফিজের শতকরা
বিশ পার্সেন্ট মার্জিন থাকে ভার্জিন আনকোরা….!

সেইসমস্ত নির্মাণকাজ উদ্বোধনের দিন-
কতো যে কান্ড, কেরিকেচার আর কতো নাটকের সিন-
কি আর বলিবো, বলিতে বলিতে শির হয়ে যায় খাড়া
”জনতার নেতা, গরীব-দরদী, জাগো হে সর্বহারা“!
বক্ততাপালা সমাপ্ত হলে পারিষদ সহচরে
মফিজ বের হয় সরেজমিনে পরিবীক্ষণ তরে।

একশোফুটের বিরিজ হয়েছে দেড়শো মানুষ তায়-
মহাসমারোহে দন্তকপাটি মফিজের পিছে ধায়!
সবার সামনে মফিজের শালা রোদচশমায় ঢাকা
পিলিক পিলিক সেলফি টিপিছে কব্জি করিয়া বাঁকা
মফিজ দাঁড়ানো ব্রিজের উপরে,তাকে ঘিরে বডিগার্ড
ফডাশ করিয়া তখন ফাটিলো ঢালাইয়ের কাঁচা বাঁশ
হুড়মুড করে দেড়শো পিপল, জনতা দিগ্বিদিক
কার ঘাড়ে কার পাঁজড় ভাঙছে কিচ্ছুটি নাই ঠিক।


সেই ঘটনার ভিডিওকিলিপ ওইদিনই সন্ধ্যায়
অন্তর্জালে ছড়াইয়া পড়ে- ভাইরাল হয়ে যায়।

শুকনো আপেল

বয়স পাঁচ বছর ছুঁইছুঁই, সম্ভবত চুহাত্তর সালের দিকে – প্রতি সপ্তাহে আমার উছিলায় শুকনো আপেলের প্যাকেট নিয়ে আসতো মা। সঙ্গে অয়েস্টার মিল্ক গুঁড়োদুধের টিন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে রেড ক্রসসহ বিভিন্ন ক্রিস্চিয়ান অর্গানাইজেশন তখন প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য বাড়তি পুষ্টি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলো।

কী যে স্বাদ ছিলো সেই আপেলকুচিতে তা বলে বোঝানো যাবে না। স্বর্গে গেলে যে প্রথমত ওই আপেলকুচি দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে, সে ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ও আছি! ইউরোপের অাবহাওয়ায় পরিপক্ক, দূষণহীন সেইসব আপেল কেমন করে শুকিয়ে তারা আমাদের নিরানন্দ শৈশবকে চমকিত করেছেন তা ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করি। কয়েক টুকরো মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেয়া যেতো। তারপর পানি খেলে ক্ষিদে গায়েব!

অয়েস্টার মিল্কের কৌটো অনেক ওপরের তাকে তুলে রাখা হতো, আমার নাগালের বাইরে! কিন্তু চেয়ার ঠেলে ঠেলে নিয়ে, তার ওপর জলচৌকি বসিয়ে ননীচুরির বিদ্যা কী আমি শিখিনি তদ্দিনে?.. দুয়েকটা অঘটন তো ঘটতোই- পুরো টিন মাঝপথে হাত ফসকে গেলে কিংবা চেয়ারের পায়া যদি বিট্রে করে, তো সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে ঘুমিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বাড়ির পেছনের জঙ্গলে বা স্বপনদাদের বাসায় রাজনৈতিক আশ্রয় না নিয়ে উপায় কী?

সেই আপেলকুচি আর অয়েস্টার মিল্ক শৈশবের সাথে সাথে বাজার থেকেও নেই হয়ে গেছে! বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর পুরো বিদেশী সাহায্যগুলি রাতারাতি তাদের মিশন গুটিয়ে নিয়েছ বা স্ট্রাট্রেজি পাল্টে ফেলেছে। আমার মুখে লেগে থাকা সেই শুকনো আপেলের স্বাদ আমি কখনো ভুলতে পারিনি! ঢাকার বড়বড় সুপারশপে জিজ্ঞেস করলে তারা কিভাবে যেনো তাকায়। তারপর আপেলের জ্যাম নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে এটায় চলবে কিনা!

দেশের বাইরে সবসময় শুকনো আপেল কেনার বাসনা থাকলেও, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে পাইনি। গতমাসে ভিয়েনার চেইন শপ ‘বিল্লা’ তে ঢুকে মনে হলো, এটাই উপযুক্ত স্থান। অত্যন্ত সুদর্শন এক অস্ট্রিয়ান যুবক সেলসবয় হিসেবে তখন মালামাল সাজিয়ে রাখছিলো থরে থরে। জিজ্ঞেস করতে আমাকে নিয়ে গেলো নির্দিষ্ট জায়গায়। দুনিয়ার হেনো ফল নেই, যা তারা চিপসে রূপান্তরিত করেনি! কিন্তু শুকনো আপেল মাত্র দুই প্যাকেট, তাও ছোট ছোট। দেড় ইউরো দাম। আমার আশাহত চোখ দেখে ছোকড়া কী বুজলো কে জানে। আমাকে অপেক্ষায় রেখে বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো বড়বড় আরও দুটো প্যাকেট নিয়ে। চোখে অপরাধ ফুটিয়ে বললো সেগুলির দাম প্রতিটি পাঁচ ইউরোর বেশি, আমার তাতে চলবে কিনা!… চলবে না মানে? পুরো শৈশব প্যাকেট করে তোমরা হাতে তুলে দিচ্ছো, এত্তো সস্তা ইউরোপের বাজার!

অশ্রুভাই

আলী আশরাফ অশ্রু! নামের ভেতরে যার কান্না লুকানো- সেই লোকটি কিন্তু ছিলেন ভীষণ হাসিখুশি। আমাদের চেয়ে ২/৩ বছরের বড় হবে বড়জোড়- কিন্তু চান্স পেলেই আমাদের মতো পিচ্চিদের কাছে যথেষ্ট মুরুব্বীআনা করতেন তিনি। অত্যন্ত সুশ্রী, গৌরবর্র্ণ, উন্নতনাসার অশ্রুভাইকে দেখলে হিংসা হতো! অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পরেও তিনি ছিলেন আমাদের সম্পত্তি- মুক্ত বিহঙ্গ খেলাঘর আসরের। নাটক-শরীরচর্চা-বিজ্ঞান ক্লাব আর মারামারি- সবকিছুতেই তার দক্ষতা মানোত্তীর্র্ণ ছিলো। তাঁর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেন। অনেকদিন বাদে অশ্রুভাইকে আবিষ্কার করতাম- তারুণ্যের নতুন কোন ডাইমেনশন নিয়ে ‘দিগ্বিজয়’ করে ফিরেছেন হয়তো। অত্যন্ত পরিপাটি একটি পরিবারের তিনি বড় ছেলে- কিন্তু সে অনুযায়ী দায়িত্বের বোঝা তাকে কখনো বিচলিত করেছে বলে মনে হতো না। কী এক খেয়াল চাপলো- অশ্রুভাই তখন খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের একনিষ্ঠ কর্র্মী- হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলে পরে জানা গেলো তিনি পশ্চিমবঙ্গে গেছেন নাটক নিয়ে পড়তে। বছর দুতিনেক পরে অশ্রুভাই আবার নতুন খোলসে ফিরে এলেন- এবার আর মুরুব্বীআনা নয়- আমাদের সাথে বয়সের পার্র্থক্য ঘুচিয়ে দিব্বি সিগারেট অফার করছেন- আর রাজ্যের হাসি-তামাশায়-মধ্যমনি হয়ে উঠেছেন। নাটকে অভিনয় আর নির্দেশনা- দুটোতেই অশ্রুভাই আমাদের দিল জিতে নিলেন অল্পতেই। তারপর আবার হঠাৎ করে অশ্রুভাই নেই হয়ে গেলেন…ভেবেছিলাম তিনি আবার যথারীতি তার অন্তর্র্ধানের নিয়মানুযায়ী পুনরায় ফিরে আসবেন। কিন্তু অশ্রুভাই ফিরলেন না। কোনদিনই না। শুনেছি কোলকাতার একটি নামকরা নাট্য-সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। তারপর কারা জানি তাকে মেরে ফেলেছে- কোন এক বড়লোকের কন্যার সাথে (অন্য ধর্মের হয়েও) হৃদয়জ সম্পর্কে জড়ানোর অপরাধে। …এ সবই শোনা শোনা কথা। সত্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তাঁর পরিবার থেকে অনেক চেষ্টা করেও অশ্রুভাইয়ের এমনকি লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানি না অশ্রুভাইয়ের কথা মনে করে আজও সেই নাম না জানা মেয়েটির চোখে অশ্রু ঝরে কিনা!

পিযুষ

মশলা বাটতে বাটতে শিলপাটার ধার একসময় নষ্ট হয়ে যায়- একধরনের পেশাজীবী রয়েছেন, যারা এই পাটা খোটানোর বা ধার করার কাজটা করেন। একটা ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে খুটখুট করে সারা পাটার উপরে নকশার আকারে সুন্দর করে তারা খোদাই করেন। কাজটা দেখতে দারুন লাগতো। কিন্তু খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না- পাথরের শ্র্যাপনেল ছিটকে এসে চোখে লাগতে পারে। ক্লাশ থ্রি তে থাকতে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলি- বড় হয়ে পাটা খোটানোর কাজটাকে পেশা হিসেবে নিতে হবে। পরবর্তী জীবনে অবশ্য এই লক্ষ্য অনেকবার পরিবতন করতে বাধ্য হয়েছি। রাজমিস্ত্রি হতে পারিনি বলে আমার দুঃখ এখনো কিছুটা আছে! আর মুদি দোকানদার না হতে পারাটা জীবনের এক বিরাট লস- বিশেষত, গুঁড়োদুধ যেসকল দোকানে বিক্রি হয়- আমার অবাক লাগতো ভেবে- তারা কিভাবে সবটুকু দুধ খালি খালি খেয়ে নিজেরাই শেষ করে না! ছোটবেলায় শপথ নিয়েছিলাম- চাকরি পেলে পুরো একটা গুঁড়োদুধের টিন কিনে একা একা খাবো। বলতে দ্বিধা নেই- সত্যি সত্যি কিনেছিলামও; কিন্তু ছোটবেলার ঐ স্বাদ আর পাইনি।

আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর নাম পিযুষ। কতো বয়স হবে আমাদের, পাঁচ কিংবা ছয়। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো- ওদের বাড়িতে গুঁড়োদুধের টিন থাকতো-পিযুষ হাতভর্তি দুধ নিয়ে আমার সাথে খেলতে আসতো। বড়দের একটা ম্যানিয়া ছিলো- ছোট বাচ্চাদের ইন্টেলিজেন্স টেস্ট করার জন্য ছড়া বলতে বলতো। আমার খুব লজ্জা লাগতো হুটহাট মুখস্ত ছড়া আবৃত্তি করতে। পিযুষকে জিজ্ঞেস করলে সে চটপট শুরু করে দিতো- কাঠবেড়ালী কাঠবেড়ালী পেয়ারা তুমি খাও, গুড়মুড়ি খাও…তারপরই স্বরচিত পাঞ্চলাইন: …খাবেনা খাবেনা, মাইর দেবো!!!

বরিশাল সদর হাসপাতালে প্রায় দিন পনের ভুগলো পিযুষ। শেষদিকে মায়ের সাথে আমিও একদিন দেখতে গিয়েছিলাম পিযুষকে। ঐ প্রথম আয়োডিনের গন্ধভরা পুরাতন বিল্ডিংকে মৃত্যুপূরী মনে হয়েছিলো আমার। পিযুষ শুয়েছিলো ময়লা অফহোয়াইট চাদর বিছানো লোহার খাটে। কোন কথা বলতে পারেনি আমার সাথে- ওর কালো শরীরটা শুকিয়ে গিয়েছিলো নিউমনিয়ায়। তার ২/১ দিন পরে সবাই বলাবলি করছিলো, পিযুষ মরে গেছে। …এতো বছর পর সম্প্রতি পাঁজরের হাড় ভেঙে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে পিযুষের কথা খুব মনে পড়ছিলো!

বন্ধুত্ব

দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখানে পনের ফুট রাস্তার ব্যবধান- কিন্তু তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তাদের বন্ধুত্বে। একজন সাড়ে ছয় অন্যজন পাঁচ। খেলার সিস্টেম হলো দুজন দুজনকে একটা করে খেলনা বেলকনি থেকে অন্যজনকে দেখায়। তাতেই তাদের আনন্দ। বছর তিনেক ধরে চলছে এসব। দুটি পরিবারের মধ্যে সখ্য না থাকলেও তাদের আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি নেই। তারা এমনকি একে অন্যের নাম পর্র্যন্ত জানে না। জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি কখনো। উভয়ে ‘আপু’ বলে সম্বোধনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। স্কুল থেকে ফিরেই- যে আগে ফেরে- সে অ্ন্যজনকে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে –আ-পু! অপরদিক থেকে আপুর আবির্র্ভাব হলে চলে সারাদিনের ফিরিস্তি- কে কী দেখেছে, করেছে খেয়েছে ইত্যদি। আপু, আমি না আজ বর্র্ণমেলায় গিয়েছিলাম, আপু আমি না ‘ব্যস্ত’ ছিলাম কাল। এরপর শুরু হয় খেলা বিষয়ক নির্দেশনা: আপু তুমি ডাল রান্না করো, আমি ভাত। মাঝে মাঝে চৌকশ হিন্দিতেও বাতচিত চলে। মুঝে ভুখ নেহী হ্যায়, ও মর জাওয়া ইত্যদি। লেটেস্ট ছবির গানগুলো তাদের কাছ থেকেই শোনা হয় আমার। বাসায় থাকলে আমি অতি সন্তর্র্পনে লক্ষ করি তাদের গতিবিধি। উল্লাসে চিৎকারে দুপুরের ঘুমের বারোটা বাজে, কিন্তু বিরক্ত হই না। খেলার মাঠ, সঙ্গীসাথী নেই, তো এ ছাড়া এই পিচ্চিদুটো করবেই বা কী? এভাবে যে বন্ধুত্ব হয়, খেলা করা যায়- এই ব্যপারটা ওদের না দেখলে আমার মাথায়ই আসতো না!


ইদানিং একটু ভয়ে ভয়ে থাকি। কারণ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে কিছুটা বৈচিত্র্য এসেছে। পারিবারিক বিষয়, বাবা মা ইত্যাদি নিয়েও তারা একে অন্যের সাথে গভীর মতবিনিময় করে। মুশকিল হচ্ছে, ঘরের সিক্রেসি আউট হয়ে যাচ্ছে। বাসায় কী রান্না হচ্ছে- তা আমার চেয়ে এলাকাবাসী আগে জেনে যাচ্ছে- আরও কী কী বলা শুরু করবে- তাই নিয়ে একটু চিন্তিত আছি!… 🙂