একটি ধারালো গল্প
গাছকাটা দায়ের ধার পরীক্ষা করতে গিয়ে মহামতি জিল্লুরের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা খ্যাঁচ করে কেটে একদম আলাদা হয়ে দুপুরের ফ্যাসলা রোদের উঠোনে তিড়িক মেরে টিকটিকির লেজের মতো তড়পাতে লাগলো!…
ছরবেছর রক্তের ফুসলানিতে লবেজান জিল্লুর তখন ডাকচিক্কুর না খামিশ খেয়ে থাকবে, তা বিষম বুজতে না পেরে ধুলোর ওপর শাদালুঙ্গীর মায়া ত্যাগ করে বসে পড়লো। গলা দিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজে কৌতুহলী তার এইটে পড়া ছেলেসন্তান মোরসালিন ব্যাপার দেখে ভীরমি খাবার জোগাড়। হাতে টাচমোবাইল নিয়ে সে এতো এতো রক্ত দেখে কিংকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে হেঁচকি তুলে ফেললো। কোরবানীর পশুর কণ্ঠনালী ছাড়া এতো রক্তের পিচকারী সে কোথাও দেখেনি আর। মহামতি জিল্লুর মহাবিরক্তি নিয়ে তাকে বললো পানি আনতে। তারপর সেই পানিতে রক্ত ধুয়ে ধূলোর ভেতর নিজেই নিজের থিরথির কাঁপতে থাকা খন্ডিত আঙুলটা কুড়িয়ে এনে কাটা যায়গায় চেপে বসালো। আর এই ঘটনা পুরোটাই বন্দী হয়ে গেলো মোরসালিনের সাড়েতিন মেগাপিক্সেল মোবাইল ক্যামেরায়।
খেজুরগাছ কাটার জন্য স্প্রিংপাতি জুৎমতো পাইন দিয়ে মহার্ঘ দাখানা বানিয়ে দিয়েছিলো ললিত কর্মকার সেই কবে। বালিতে শান দিলে শালী এমন ধারিয়ে ওঠে যে আস্তমানুষও এককোপে দুপিস করা যায়! জিল্লুর তাকে স্ত্রীবাচক মনে করে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনো ঘটনা থেকে থাকবে। কিন্তু ঘটনা হলো, জিল্লুরের সেই কর্তিত আঙুল – যা হোক সময় হলে একটু বাঁকাভাবে জোড়া লেগে গিয়েছিলো; কিন্তু তারচেও বড় খবর হলো, কাঁপা হাতে ভিডিও করা মোরসালিনের সেই ফুটেজ টিকটকে তিনদিনে বারো লক্ষ ভিউড হয়েছে। মোরসালিন রাতারাতি স্টার। সাথে জিল্লুর রহমানও। এখন তাকে এই স্টারার্কি (স্টার+ইয়ার্কি) চালিয়ে যেতে হবে ছাড়া উপায় নেই। তো জিল্লুর এখন কী করবে? নিজের বিশটা আঙুল কি সে নিয়মিত ইন্টারভেলে একে একে কেটে ফেলবে টিকটকবাসীদের প্রভুত বিনুদোন প্রশমনের জন্য? সেটা সম্ভব নয়। জিল্লুর তাই অন্য উপায় খোঁজে। পাবলিকের মনস্তত্ত্ব মেপে সে নানারকম কায়দা কেরিকেচার করে। চ্যানেলে লোক জমাতে সে একটানে ব্রয়লারের মাথা ছিঁড়ে ফেলে, বেড়াল বস্তায় ভরে পিটিয়ে মেরে ফেলে আর ঘুমন্ত পাখির ছানাকে ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়। কিন্তু ভিউয়ার্সের সংখ্যা তাতে ওই হারে বাড়ে না। বেজায় মনোগ্লানি নিয়ে জিল্লুর রহমান আর মোরসালিন তখন ভাবতে থাকে, কী করিলে সোশাল মিডিয়ার ভিউয়ার্স বাড়ানো যায়?
ভাবিতে ভাবিতে শীত গড়িয়ে বর্ষা আসে। তারা আশা ছাড়ে না। তাদের গবেষণাও চলতে থাকে। সেধে বোলতার কামড় খেয়ে, গরুর গুঁতায় আহত হয়ে আর গাড়ির নিচে মরতে মরতে চাপা পড়ে সেসব ফুটেজ পাবলিককে খাওয়ানোর কম চেষ্টা করেনি জিল্লুর -মোরসালিন জুটি। কিন্তু কাটা আঙুল জোড়া লাগার মতো টিআরপি আর কিছুতেই আসেনি। আর টিআরপি বা লাইক, যে নামেই ডাকো – জীবনের অর্থ কী, সোশাল মিডিয়া ছাড়া? ভাত খেলাম – তো ছবি দিলাম, বেড়াতে গেলাম – তো ভিডিও দিলাম, গাছে উঠলাম কি দড়ি পাকলাম – লাইভ তো করতেই হবে, নাকি? এর পাশাপাশি আছে বিভিন্ন পারফমেন্স বিষয়ক ব্যারাম। গান গাইলে ছাদে, ছাদবাগানে কুমড়াফুলের ছবি – শেয়ার না দিলে কি মান থাকে? নাচতে জানলে পোয়াবারো, নাচতে না জানলেও সমস্যা নেই, আছে আলোচনা সভা আর সাহিত্য আসর। বাদ যাবে না একটি শিশুও। কিছু না কিছু করে আলোচনার কেন্দ্রে তোমাকে থাকতে হবে। আর সেজন্য যাহাই করা দরকার, করো। টিআরটি পড়তে দিও না। ধরে রাখো, উচ্চ করো শির, হে গম্ভীর, হে গম্ভীর!
তো এহেন টিআরপি সংকটের মাঝে তারা দেখতে পায় বাজ পড়ে ঢ্যাঙ্গা নারকোল গাছটার দফা শেষ। আইডিয়া তখন তড়াক করে মাথায় উঠে আসে। আরে তাইতো, জীবন্ত প্রাণীর ওপর বাজ পড়লে তো দারুণ হবে! এনজিওর ঋণে কেনা ‘লাইভিহুড মিন্স’ যে ব্লাকবেঙ্গলখানা তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী মাস চারেক আগে উপহার পেয়েছে, জিল্লুর রহমান তাকে খোলামাঠের মাঝে টাইট করে বেঁধে রাখে। ধরো এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পেছনেও কিছু পারশিয়ালিটি আছে। একটা অবলা নারকেলগাছ খানখান হয়ে গেলো, অথচ ধুমবৃষ্টিতে একটানা তিনদিন বেঁধে রাখার পরেও ছাগলটার কিছুই হলো না। ম্যঁ ম্যঁ করে ডাকতে ডাকতে ফাজিলটা বজ্রের মন জয় করে নিলো। অথচ এ তল্লাটে অন্তত জনাবিশেক লোক ফিবছর বাজপড়ে ছাই হয়ে যায়। এবং তাদের ডেডবডি গোরস্থানে মাটি হবার আগেই উধাও হয়ে যায়, কখন তা কেউই ঠিক করে বলতে পারে না। তা বাজপড়া ডেডবডি যদি এতোই মূল্যবান হবে মিস্টার, তো তাদের গ্রামের সবার বাড়ি আজ সাততলা দালান ওঠার কথা! আর ওদিকে শালা ছাগলটা তিনদিনের বৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চারদিনের দিন ছেউড় হয়ে মরলো। তার শোকে আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর নাকিকান্না দেখে কে? জিল্লুর যে কী করে এখন! অদিকে টিকটকে তার জনপ্রিয়তার পপুলারিটির যাচ্ছেতাই অবস্থা একেবারে। একে রুখতে না পারলে আর জীবনের অর্থ কী? যে করেই হোক সোশাল মিডিয়াকে তো আর হেলা করা যায় না। বর্তমান যুগ, বিজ্ঞানের যুগ বলে কথা। আর এটাই সায়েন্স! তা সায়েন্স বলো আর বিজ্ঞানই বলো, একটা পোস্ট দেবার পর যদি বানের পানির মতো লাইকের বন্যা না ছোটে, পরিবর্তে বৃদ্ধ বয়সে বহুমুত্র রোগীর কায়ক্লেশে ফোঁটা ফোঁটা মুত্র বিসর্জনের মতো একটা দুটো রিএ্যাকশন জোট- তো সে জীবন থাকা আর না থাকা সমান কথা নয়কি হে মিস্টার? এদিকে টিকটকে ভিডিও বুস্ট হবার পর তাকে সবাই মহামতি ডাকতে শুরু করেছে। শব্দটা আসলে ভুলবশত তৈরি। তারা তাকে ডাকতে চেয়েছিলো মরারগতি! লোকমুখে জিহ্বার প্রোরচনায় বা আহলাদে সেটাই মহামতি হয়ে গেছে। তো বন্দরের বাজারে বা এলাকার হাটে তাকে লোকজন আস্তে আস্তে বিশেষভাবে চিনে গেলো মহামতি জিল্লুর হিসেবে। তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া অন্তত আরও গোটা পঞ্চাশেক ভিডিও ট্রল নেটদুনিয়ায় চালু। তার স্টিল ছবি দিয়ে প্রাঙ্ক হচ্ছে অহরহ। জিল্লুর এখন নিজেই নিজেকে ভিডিওর শুরুতে মহামতি বলে পরিচয় দেয়। আর বলে, ছলুন ধর্শোক, দেখতে থাকুন আমাদের স্টারার্কি!… তার ঢং নকল করে ভুল বাংলায়, অশুদ্ধ উচ্চারণে আরও কতো রেডিও জকি রাতারাতি সুপারহিট!
হলে কী হবে? কাটা আঙুল জোড়া লাগার মতো চমক আর কিছুতেই নেই বলে জিল্লুর একদিন পুকুর ঘাটলায় বসে একা একা ভীষণ গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসে। ভেবে ভেবে এই কিনারায় পৌঁছায় যে শরীরের অঙ্গহানি না করিলে এই শালার টিআরপি আর উপরমুই হলো নাহয়। তো কীভাবে হবে সেই অঙ্গহানি? একটা হাত যদি কেটে ফেলা যায়… ধুৎ, বাঁহাত কতো কাজে লাগে!… সবকিছু বাদ দাও, ল্যাট্রিনে বাঁহাত রাজা, তো সেটা তুমি কেটে ফেলতে চাও কোন্ আক্কেলে মিস্টার? তারচে একটা চোখ যদি…! হ্যাঁ ইয়েস, বাকী চোখে দুনিয়া দেখা চলে! কতো ভালো ভালো শিকখিৎ লোকইতো একচোখে দুনিয়া দেখছে, দুনিয়া মাপছে! কৈ, তাদেরতো কোনো সমস্যা হচ্ছে না? এমনকি দুনিয়াটাও একচোখা দুনিয়াতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বেশ! …তা দেবে নাকি খেজুরকাটা দিয়ে নিজের একটা চোখের দফারফা করে? কোন্ চোখ? ডানটা না বামটা? দুনিয়া এখন ডানবাম কোন্ চোখের নেতৃত্বে যে চলছে, তা মহামতি জিল্লুরের পক্ষে বোঝা কঠিন! এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের খেলার মাঝে জিল্লুরের হুট করে আরও একটা অপশনের কথা এক ঝলকে মনে পড়লো! আর তারপর সেটা তার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোতের পরশ বুলিয়ে সাঁৎ করে নেমে গেলো নিচে! কী সর্বনাশ! জিল্লুর ওটা পুরোপুরি কেটে ফেলার কথা ভাবে কী করে? স্ত্রী যদিও অন্তঃসত্ত্বা তবুও কতো কাম বাকী আছে এখনো!! ছিছিছির দোলাচালে খাবি খেতে খেতে তৎসময়ের জন্য তার এই গা জোয়ারী ভাবনাটা মুলতুবী রাখে, রাখতে বাধ্য হয়। ইসব কথা চিন্তাতে আসাও উচিত লা হোইসে মিষ্ঠার!
কিন্তু খোসপাঁচড়ার চুলকানির মতো একটু পরেই আবার ভাবনাটা তার মাথায় উঠে কুটকুট করতে থাকে। আর এসবের মধ্যেই মহীসোপানের মতো একটা দানবীয় অসুরিক আইডিয়া তার মূর্খ মাথাটিকে একদম আয়ত্ব করে ফেলে! ভাবনার আগাপাশতলা কিছুই সে মাপতে না পারলেও এটুকু বুজতে পারে যে, ওই আইডিয়াটা সফল হলে তার টিকটক পোস্ট দুনিয়ার তাবৎ লাইকের সীমাসংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে! আর মহামতি জিল্লুরের জন্য আপাতত সেটুকু আকর্ষণই যথেষ্ট! নয়কি? ভাবনাকে পাকার সুযোগ না দিয়ে জায়মান চিন্তাটা নিয়ে সে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। বিকেলের রোদ পড়িপড়ি করছে। এই সময়টায় লাইভ করতে পারলে খুবই ভালো হবে। লোকজন দুপুরের ভাতঘুম সেরে কেবল মোবাইলটা হাতে নিয়েছে। এখন জিল্লুরের ছলবলানি দেখতে তাদের ভালো না লাগার কথা নয়। সে গাছকাটা দাখানা জুৎমতো ধার দিয়ে রেখেছিলো আগেই। সেটা হাতে নিয়ে আজ আর ধার পরীক্ষার চেষ্টা করলো না। কেবল মোরসালিনকে টাচমোবাইলটা নিয়ে পুকুর পাড়ের কলাগাছের ঝাড়ের দিকে আসতে বললো। আর ছেলেটাও হয়েছে সৎবাপের ন্যাওটা। কথা একটা মুখ থেকে বলেছ কি, মোরসালিন হাজির। প্রথমে সে একটা মাঝারি সাইজের কলাগাছকে এককোপে নামিয়ে দিলো! বাহ্, শালী তো দারুণ ধারিয়ে আছে! কিন্তু একহাতে দা নিয়ে অন্য হাতে লাইভ করা মুশকিল। সে মোরসালিনকে সেলফিমুডে ক্যামেরার সামনে আসতে বললো। এতোদিনে ছেলেটাও বেশ চৌকশ হয়ে উঠেছে। হালকা গোঁফের রেখার সাথে হালকা সাহসও বেড়েছে। সৎবাপের নির্দেশ মোতাবেক সে টিকটকে লাইভ অপশন চালু করে দিলো। ফ্রেমের এককোণে সে নিজেকে রেখে মূল ফোকাসে আনলো দা হাতে জিল্লুরকে। তারপর ইশারা পেয়ে গড়গড় করে বলতে লাগলো: হামার বাপো, হাজ আপোনাদের দেখাবেনজ্বে, কিয়ের পান্হে চোখোৎ ওরচু ঝরে, কেনু হাপন মানুশ পর হঅয়ে যাছে, ছামাইন্নো ছার্থের খারনে হাপন লোকের গলাৎ ছুরি চাল্হাই দিতে কুনো হায়াশরমের তোয়াক্কা না লিছে, বন্দুগণ রেডি থাকিয়েন জ্বে!… শেষের অংশটা একটা ট্যাগলাইন, হাত নেড়েনেড়ে, কায়দা করে মোরসালিন তার সৎবাপের স্টাইলকে আর একটু মেলোড্রামায় সাজিয়ে দিতে, তার আগের বাপের এলাকার ডায়ালেক্টের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক কিম্ভুত ভাষাসংস্থান ফুটিয়ে তোলে! পাবলিক সেটা দারুণভাবে এনজয়ও করে এসেছে এতোকাল। তো ছলুন ধর্শোক, দেখতে থাকুন বলে জিল্লুর তার স্বভাবসুলভ জাদুকরী ভঙ্গীর বদলে আজ দু কদম সামনে বেড়ে ক্যামেরার সামনে ধারালো দাটা নিয়ে এসে পরখ করালো যেনো। আর তারপরই কোনো এক অসুরিক শক্তিতে আবিষ্ট হয়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো দাখানা সে সাঁৎ করে নামিয়ে আনলো মোরসালিনের অপুষ্ট ঘাড়ে! বিদ্ঘুটে একটা ভোঁতা আওয়াজ উঠলো শুধু।
ছরবেছর রক্তের ধারায় যতোক্ষণ মোবাইলটা ধরা ছিলো, লাখ লাখ ধর্শোকরা দেখেছেন ধারালো গল্পটা তিড়িক মেরে ধুলোকাদায় লাল টিআরপিতে দিগ্বিদিক ভেসে যাচ্ছে!
আগস্ট ২০২১, সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা।