তুহিন সমদ্দার

একটি ধারালো গল্প

গাছকাটা দায়ের ধার পরীক্ষা করতে গিয়ে মহামতি জিল্লুরের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা খ্যাঁচ করে কেটে একদম আলাদা হয়ে দুপুরের ফ্যাসলা রোদের উঠোনে তিড়িক মেরে টিকটিকির লেজের মতো তড়পাতে লাগলো!…

ছরবেছর রক্তের ফুসলানিতে লবেজান জিল্লুর তখন ডাকচিক্কুর না খামিশ খেয়ে থাকবে, তা বিষম বুজতে না পেরে ধুলোর ওপর শাদালুঙ্গীর মায়া ত্যাগ করে বসে পড়লো। গলা দিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজে কৌতুহলী তার এইটে পড়া ছেলেসন্তান মোরসালিন ব্যাপার দেখে ভীরমি খাবার জোগাড়। হাতে টাচমোবাইল নিয়ে সে এতো এতো রক্ত দেখে কিংকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে হেঁচকি তুলে ফেললো। কোরবানীর পশুর কণ্ঠনালী ছাড়া এতো রক্তের পিচকারী সে কোথাও দেখেনি আর। মহামতি জিল্লুর মহাবিরক্তি নিয়ে তাকে বললো পানি আনতে। তারপর সেই পানিতে রক্ত ধুয়ে ধূলোর ভেতর নিজেই নিজের থিরথির কাঁপতে থাকা খন্ডিত আঙুলটা কুড়িয়ে এনে কাটা যায়গায় চেপে বসালো। আর এই ঘটনা পুরোটাই বন্দী হয়ে গেলো  মোরসালিনের সাড়েতিন মেগাপিক্সেল মোবাইল ক্যামেরায়। 

খেজুরগাছ কাটার জন্য স্প্রিংপাতি জুৎমতো পাইন দিয়ে মহার্ঘ দাখানা বানিয়ে দিয়েছিলো ললিত কর্মকার সেই কবে। বালিতে শান দিলে শালী এমন ধারিয়ে ওঠে যে আস্তমানুষও এককোপে দুপিস করা যায়! জিল্লুর তাকে স্ত্রীবাচক মনে করে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনো ঘটনা থেকে থাকবে। কিন্তু ঘটনা হলো, জিল্লুরের সেই কর্তিত আঙুল – যা হোক সময় হলে একটু বাঁকাভাবে জোড়া লেগে গিয়েছিলো; কিন্তু তারচেও বড় খবর হলো, কাঁপা হাতে ভিডিও করা মোরসালিনের সেই ফুটেজ টিকটকে তিনদিনে বারো লক্ষ ভিউড হয়েছে। মোরসালিন রাতারাতি স্টার। সাথে জিল্লুর রহমানও। এখন তাকে এই স্টারার্কি (স্টার+ইয়ার্কি) চালিয়ে যেতে হবে ছাড়া উপায় নেই। তো জিল্লুর এখন কী করবে? নিজের বিশটা আঙুল কি সে নিয়মিত ইন্টারভেলে একে একে কেটে ফেলবে টিকটকবাসীদের প্রভুত বিনুদোন প্রশমনের জন্য? সেটা সম্ভব নয়। জিল্লুর তাই অন্য উপায় খোঁজে। পাবলিকের মনস্তত্ত্ব মেপে সে নানারকম কায়দা কেরিকেচার করে। চ্যানেলে লোক জমাতে সে একটানে ব্রয়লারের মাথা ছিঁড়ে ফেলে, বেড়াল বস্তায় ভরে পিটিয়ে মেরে ফেলে আর ঘুমন্ত পাখির ছানাকে ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়। কিন্তু ভিউয়ার্সের সংখ্যা তাতে ওই হারে বাড়ে না। বেজায় মনোগ্লানি নিয়ে জিল্লুর রহমান আর মোরসালিন তখন ভাবতে থাকে, কী করিলে সোশাল মিডিয়ার ভিউয়ার্স বাড়ানো যায়? 

ভাবিতে ভাবিতে শীত গড়িয়ে বর্ষা আসে। তারা আশা ছাড়ে না। তাদের গবেষণাও চলতে থাকে। সেধে বোলতার কামড় খেয়ে, গরুর গুঁতায় আহত হয়ে আর গাড়ির নিচে মরতে মরতে চাপা পড়ে সেসব ফুটেজ পাবলিককে খাওয়ানোর কম চেষ্টা করেনি জিল্লুর -মোরসালিন জুটি। কিন্তু কাটা আঙুল জোড়া লাগার মতো টিআরপি আর কিছুতেই আসেনি। আর টিআরপি বা লাইক, যে নামেই ডাকো – জীবনের অর্থ কী, সোশাল মিডিয়া ছাড়া? ভাত খেলাম – তো ছবি দিলাম, বেড়াতে গেলাম – তো ভিডিও দিলাম, গাছে উঠলাম কি দড়ি পাকলাম – লাইভ তো করতেই হবে, নাকি? এর পাশাপাশি আছে বিভিন্ন পারফমেন্স বিষয়ক ব্যারাম। গান গাইলে ছাদে, ছাদবাগানে কুমড়াফুলের ছবি – শেয়ার না দিলে কি মান থাকে? নাচতে জানলে পোয়াবারো, নাচতে না জানলেও সমস্যা নেই, আছে আলোচনা সভা আর সাহিত্য আসর। বাদ যাবে না একটি শিশুও। কিছু না কিছু করে আলোচনার কেন্দ্রে তোমাকে থাকতে হবে। আর সেজন্য যাহাই করা দরকার, করো। টিআরটি পড়তে দিও না। ধরে রাখো, উচ্চ করো শির, হে গম্ভীর, হে গম্ভীর!

তো এহেন টিআরপি সংকটের মাঝে তারা দেখতে পায় বাজ পড়ে ঢ্যাঙ্গা নারকোল গাছটার দফা শেষ। আইডিয়া তখন তড়াক করে মাথায় উঠে আসে। আরে তাইতো, জীবন্ত প্রাণীর ওপর বাজ পড়লে তো দারুণ হবে! এনজিওর ঋণে কেনা ‘লাইভিহুড মিন্স’ যে ব্লাকবেঙ্গলখানা তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী মাস চারেক আগে উপহার পেয়েছে, জিল্লুর রহমান তাকে খোলামাঠের মাঝে টাইট করে বেঁধে রাখে। ধরো এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পেছনেও কিছু পারশিয়ালিটি আছে। একটা অবলা নারকেলগাছ খানখান হয়ে গেলো, অথচ ধুমবৃষ্টিতে একটানা তিনদিন বেঁধে রাখার পরেও ছাগলটার কিছুই হলো না। ম্যঁ ম্যঁ করে ডাকতে ডাকতে ফাজিলটা বজ্রের মন জয় করে নিলো। অথচ এ তল্লাটে অন্তত জনাবিশেক লোক ফিবছর বাজপড়ে ছাই হয়ে যায়। এবং তাদের ডেডবডি গোরস্থানে মাটি হবার আগেই উধাও হয়ে যায়, কখন তা কেউই ঠিক করে বলতে পারে না। তা বাজপড়া ডেডবডি যদি এতোই মূল্যবান হবে মিস্টার, তো তাদের গ্রামের সবার বাড়ি আজ সাততলা দালান ওঠার কথা! আর ওদিকে শালা ছাগলটা তিনদিনের বৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চারদিনের দিন ছেউড় হয়ে মরলো। তার শোকে আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর নাকিকান্না দেখে কে? জিল্লুর যে কী করে এখন! অদিকে টিকটকে তার জনপ্রিয়তার পপুলারিটির যাচ্ছেতাই অবস্থা একেবারে। একে রুখতে না পারলে আর জীবনের অর্থ কী? যে করেই হোক সোশাল মিডিয়াকে তো আর হেলা করা যায় না। বর্তমান যুগ, বিজ্ঞানের যুগ বলে কথা। আর এটাই সায়েন্স! তা সায়েন্স বলো আর বিজ্ঞানই বলো, একটা পোস্ট দেবার পর যদি বানের পানির মতো লাইকের বন্যা না ছোটে, পরিবর্তে বৃদ্ধ বয়সে বহুমুত্র রোগীর কায়ক্লেশে ফোঁটা ফোঁটা মুত্র বিসর্জনের মতো একটা দুটো রিএ্যাকশন জোট- তো সে জীবন থাকা আর না থাকা সমান কথা নয়কি হে মিস্টার? এদিকে টিকটকে ভিডিও বুস্ট হবার পর তাকে সবাই মহামতি ডাকতে শুরু করেছে। শব্দটা আসলে ভুলবশত তৈরি। তারা তাকে ডাকতে চেয়েছিলো মরারগতি! লোকমুখে জিহ্বার প্রোরচনায় বা আহলাদে সেটাই মহামতি হয়ে গেছে। তো বন্দরের বাজারে বা এলাকার হাটে তাকে লোকজন আস্তে আস্তে বিশেষভাবে চিনে গেলো মহামতি জিল্লুর হিসেবে। তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া অন্তত আরও গোটা পঞ্চাশেক ভিডিও ট্রল নেটদুনিয়ায় চালু। তার স্টিল ছবি দিয়ে প্রাঙ্ক হচ্ছে অহরহ। জিল্লুর এখন নিজেই নিজেকে ভিডিওর শুরুতে মহামতি বলে পরিচয় দেয়। আর বলে, ছলুন ধর্শোক, দেখতে থাকুন আমাদের স্টারার্কি!… তার ঢং নকল করে ভুল বাংলায়, অশুদ্ধ উচ্চারণে আরও কতো রেডিও জকি রাতারাতি সুপারহিট! 

হলে কী হবে? কাটা আঙুল জোড়া লাগার মতো চমক আর কিছুতেই নেই বলে জিল্লুর একদিন পুকুর ঘাটলায় বসে একা একা ভীষণ গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসে। ভেবে ভেবে এই কিনারায় পৌঁছায় যে শরীরের অঙ্গহানি না করিলে এই শালার টিআরপি আর উপরমুই হলো নাহয়। তো কীভাবে হবে সেই অঙ্গহানি? একটা হাত যদি কেটে ফেলা যায়… ধুৎ, বাঁহাত কতো কাজে লাগে!… সবকিছু বাদ দাও, ল্যাট্রিনে বাঁহাত রাজা, তো সেটা তুমি কেটে ফেলতে চাও কোন্ আক্কেলে মিস্টার? তারচে একটা চোখ যদি…! হ্যাঁ ইয়েস, বাকী চোখে দুনিয়া দেখা চলে! কতো ভালো ভালো শিকখিৎ লোকইতো একচোখে দুনিয়া দেখছে, দুনিয়া মাপছে! কৈ, তাদেরতো কোনো সমস্যা হচ্ছে না? এমনকি দুনিয়াটাও একচোখা দুনিয়াতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বেশ! …তা দেবে নাকি খেজুরকাটা দিয়ে নিজের একটা চোখের দফারফা করে? কোন্ চোখ? ডানটা না বামটা? দুনিয়া এখন ডানবাম কোন্ চোখের নেতৃত্বে যে চলছে, তা মহামতি জিল্লুরের পক্ষে বোঝা কঠিন! এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের খেলার মাঝে জিল্লুরের হুট করে আরও একটা অপশনের কথা এক ঝলকে মনে পড়লো! আর তারপর সেটা তার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোতের পরশ বুলিয়ে সাঁৎ করে নেমে গেলো নিচে! কী সর্বনাশ! জিল্লুর ওটা পুরোপুরি কেটে ফেলার কথা ভাবে কী করে? স্ত্রী যদিও অন্তঃসত্ত্বা তবুও কতো কাম বাকী আছে এখনো!! ছিছিছির দোলাচালে খাবি খেতে খেতে তৎসময়ের জন্য তার এই গা জোয়ারী ভাবনাটা মুলতুবী রাখে, রাখতে বাধ্য হয়। ইসব কথা চিন্তাতে আসাও উচিত লা হোইসে মিষ্ঠার!

কিন্তু খোসপাঁচড়ার চুলকানির মতো একটু পরেই আবার ভাবনাটা তার মাথায় উঠে কুটকুট করতে থাকে। আর এসবের মধ্যেই মহীসোপানের মতো একটা দানবীয় অসুরিক আইডিয়া তার মূর্খ মাথাটিকে একদম আয়ত্ব করে ফেলে! ভাবনার আগাপাশতলা কিছুই সে মাপতে না পারলেও এটুকু বুজতে পারে যে, ওই আইডিয়াটা সফল হলে তার টিকটক পোস্ট দুনিয়ার তাবৎ লাইকের সীমাসংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে! আর মহামতি জিল্লুরের জন্য আপাতত সেটুকু আকর্ষণই যথেষ্ট! নয়কি? ভাবনাকে পাকার সুযোগ না দিয়ে জায়মান চিন্তাটা নিয়ে সে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। বিকেলের রোদ পড়িপড়ি করছে। এই সময়টায় লাইভ করতে পারলে খুবই ভালো হবে। লোকজন দুপুরের ভাতঘুম সেরে কেবল মোবাইলটা হাতে নিয়েছে। এখন জিল্লুরের ছলবলানি দেখতে তাদের ভালো না লাগার কথা নয়। সে গাছকাটা দাখানা জুৎমতো ধার দিয়ে রেখেছিলো আগেই। সেটা হাতে নিয়ে আজ আর ধার পরীক্ষার চেষ্টা করলো না। কেবল মোরসালিনকে টাচমোবাইলটা নিয়ে পুকুর পাড়ের কলাগাছের ঝাড়ের দিকে আসতে বললো। আর ছেলেটাও হয়েছে সৎবাপের ন্যাওটা। কথা একটা মুখ থেকে বলেছ কি, মোরসালিন হাজির। প্রথমে সে একটা মাঝারি সাইজের কলাগাছকে এককোপে নামিয়ে দিলো! বাহ্, শালী তো দারুণ ধারিয়ে আছে! কিন্তু একহাতে দা নিয়ে অন্য হাতে লাইভ করা মুশকিল। সে মোরসালিনকে সেলফিমুডে ক্যামেরার সামনে আসতে বললো। এতোদিনে ছেলেটাও বেশ চৌকশ হয়ে উঠেছে। হালকা গোঁফের রেখার সাথে হালকা সাহসও বেড়েছে। সৎবাপের নির্দেশ মোতাবেক সে টিকটকে লাইভ অপশন চালু করে দিলো। ফ্রেমের এককোণে সে নিজেকে রেখে মূল ফোকাসে আনলো দা হাতে জিল্লুরকে। তারপর ইশারা পেয়ে গড়গড় করে বলতে লাগলো: হামার বাপো, হাজ আপোনাদের দেখাবেনজ্বে, কিয়ের পান্হে চোখোৎ ওরচু ঝরে, কেনু হাপন মানুশ পর হঅয়ে যাছে, ছামাইন্নো ছার্থের খারনে হাপন লোকের গলাৎ ছুরি চাল্হাই দিতে কুনো হায়াশরমের তোয়াক্কা না লিছে, বন্দুগণ রেডি থাকিয়েন জ্বে!… শেষের অংশটা একটা ট্যাগলাইন, হাত নেড়েনেড়ে, কায়দা করে মোরসালিন তার সৎবাপের স্টাইলকে আর একটু মেলোড্রামায় সাজিয়ে দিতে, তার আগের বাপের এলাকার ডায়ালেক্টের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক কিম্ভুত ভাষাসংস্থান ফুটিয়ে তোলে! পাবলিক সেটা দারুণভাবে এনজয়ও করে এসেছে এতোকাল। তো ছলুন ধর্শোক, দেখতে থাকুন বলে জিল্লুর তার স্বভাবসুলভ জাদুকরী ভঙ্গীর বদলে আজ দু কদম সামনে বেড়ে ক্যামেরার সামনে ধারালো দাটা নিয়ে এসে পরখ করালো যেনো। আর তারপরই কোনো এক অসুরিক শক্তিতে আবিষ্ট হয়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো দাখানা সে সাঁৎ করে নামিয়ে আনলো মোরসালিনের অপুষ্ট ঘাড়ে! বিদ্ঘুটে একটা ভোঁতা আওয়াজ উঠলো শুধু।

ছরবেছর রক্তের ধারায় যতোক্ষণ মোবাইলটা ধরা ছিলো,  লাখ লাখ ধর্শোকরা দেখেছেন ধারালো গল্পটা তিড়িক মেরে ধুলোকাদায় লাল টিআরপিতে দিগ্বিদিক ভেসে যাচ্ছে! 

আগস্ট ২০২১, সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা।

 

চোরকাঁটা

আমার কিন্তু ছিলোনা কেউ, কোনোখানে
ওঁৎ পাতিনি, জানো?
আমার সাথে দেখা হয়নি কারো।
কিংবা দেখা হতেও পারে, মুখ মনে নেই
কার ইশারায়, উপেক্ষাতে
হুহু জ্বরে তপ্ত হলাম
সিঁড়ির 'পড়ে বসে রইলাম সর্বহারা
মানো বা না মানো-
আমি একাই ছিলাম, আছি আগাগোড়া
মাঝেমধ্যে দু' একটা হাইফেন-
দুজন মানুষ  জোড়ার ছলে দ্বন্দ্ব সাজালেন! 

সেসব বহু পুরোনো সুর। ওই সুরে কি 
গান করা যায়? গানও
খুঁজে বেড়ায় নিত্যনতুন ছন্দ-ভাষা
মগ্ন এলোচুল-
শাড়ীর পাড়ে বিঁধে থাকুক চোরকাঁটা তীর 
কাঞ্জিপুরম হাসিতে মশগুল।
২৮ আগস্ট, ২০২১
সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা।

আগস্ট ‘৭৫

তারপর নেকড়ের দল
দেয়াল টপকে ঢুকে গেলো
সাদা বাড়িটার
মনোহর চাতালে। যেখানে সবুজ ঘাস, 
মাধবীলতার আশকারায় 
টুনটুনি সংসার পেতেছে। 
কিছু বুঝে ওঠার আগেই 
ওরা ঝাঝরা করে দিলো 
নিস্তব্ধতা। প্রতিবাদের ব্যুহ 
তৈরি হবার আগেই 
বেয়াড়া বুটের আস্ফালনে 
সারিসারি চন্দ্রমল্লিকা 
নুয়ে পড়লো। 

জান্তব আনন্দে ভারী ভারী বুলডোজার 
পিচরাস্তায় গাঢ় দাগ ফেলে 
ফিরে যাবার পরও
একটি পাখি পড়ে ছিলো 
            সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে 
                        অনেকক্ষণ, 
                               রক্তাক্ত, 
                                     একা! 



১২ আগস্ট ২০২১

দুর্ঘটনা

কি ঘটেছিলো এই বাসায়? খুন বা ধর্ষণ কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে কেউ আত্মহত্যা করেছিলো? স্ত্রীকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলেছিলো? কিংবা আচমকা দরজা ভেঙে ঢুকে কেউ পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলিতে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলো লোকটিকে?

দেবব্রত অবশেষে বাসা খুঁজে পেলো। বাসা খোঁজার উপরে কোনো ডিপ্লোমার ব্যবস্থা থাকলে তা তার প্রাপ্য। স্ত্রী অরুন্ধতি নতুন সংসার পাতার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পুরো ঘর, মানে দুই রুম আর একফালি বারান্দা আর মানানসই কিচেন বাথরুম একপাক ঘুরে এসে তৃপ্তির আমেজ মাখা মমতা নিয়ে বলে “বেশ কিন্তু বাসাটা, তাইনাগো?’ দেবব্রত বোঝে সুখ মানে এই এক টুকরো কথার মধ্যে ঠাসবুনোট দেয়া আবেগ। এবং এভাবেই তারা সুখী হবার জন্য প্রথমত তাদের প্রথম সংসার শুরু করে দিলো। কিন্তু প্রথম থেকেই জামার নীচে যেখানে হৃদপিণ্ডটা ক্রমাগত ধুকপুক করছে, ভয়টা সেখানে খামচি মেরে ধরার পর থেকে সেই সুখ অস্থায়ী ভাড়াটের মতো আচরণ শুরু করে দেয়। কিন্তু এমন এক অদৃশ্য কার্যকারণহীন সেই ভয়- যাকে ভয় করা তো হয়ই না, উপরন্তু দেবব্রত এবং পরিশেষে অরুন্ধতিও ক্রমাগত আবিষ্ট হতে শুরু করে। তাদের সুখ অসুখ মিলিয়ে বাসাটাও একটা সত্ত্বা হয়ে বিচরণ করে যেনো। কান পাতলে সেই সত্ত্বার সাথে কথোপকথোন কিংবা তার নিঃশ্বাসের স্বরও শুনতে পাওয়া যেতো!

বাড়িওলা সজ্জন। ছুটির দিন বলে তিনি সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। নিজ হাতে খুলে দেখালেন দুইরুম ফ্ল্যাটটি। ছিমছাম। নতুন ডিস্টেম্পারে চকচকে হাইজিনিক ওয়াশ মাখা দেয়াল দেবব্রতকে ডাকে। সে মোহে পড়ে। নিজের ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার দ্রুত হিসেব করে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়- এখানে হবে। হতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই অবশ্য। আজ মাসের ১৪ তারিখ। এরপর আর কেনো টু লেট ঝুলবে না আসেপাশে। তার অফিসেও মোটামুটি অল্প ভাড়াতেই পৌঁছে যাওয়া যাবে এখান থেকে। কিন্তু এই লোকটাকে তা বুঝতে দেয়া যাবে না- সে মনে মনে ভাবে। উপরে নির্লিপ্তি অথচ ভিতরে দ্রুত যোগবিয়োগপূরণভাগ একদম ব্যস্ত রাখে মাথাটাকে। ফলে বাড়িওলার বাড়ি বিষয়ক সেল্ফ প্রোপাগাণ্ডা তার চেতনা স্পর্শ করে না। কিন্তু ওর চোখের ভাষা, পোড় খাওয়া বর্ষীয়ান ব্যক্তিটি অনায়াশে আনকোড করে ফেলতে পারেন। ঈষৎ হেসে বলেন “দেখুন, এর চেয়ে ভালো বাসা হয়তো পাবেন, কিন্তু এমন ভালোবাসা আর পাবেন না।’ বলেই নিজের রসিকতায় হোহো করে হাসেন। লোকটার এতো গরজ কিসের ? এই এরিয়ায় বাসা পাওয়া বেশ কঠিন। অফিসপাড়া থেকে কাছে হয় বলে খালি পাওয়া যায় না একদমই। চিন্তিত হয়ে ভাবে দেবব্রত। কিন্তু নিজেকে আর নেগেটিভলি উসকে দেবে না বলে শাসায় মনে মনে – আর কয়েকটা স্টিল পিকচারের মতো ভাসে অরুন্ধতি চান করে ভিজে চুলে টাওয়েল জড়িয়ে বেরুচ্ছে বাথরুম থেকে, কিচেনে রান্না করছে, অফিস থেকে ফিরতে চাবি ছুঁড়ে দিচ্ছে নিচে গেট খুলতে… দৃশ্যগুলি এমনই জমজমাট যে চিনির সিরায় ডুবে যাওয়া মাছির মতো আবেশে সে জুবড়ে যায় একেবারে।

অবশেষে তারা একটা রফায় আসতে দেরি করে না। বাড়িওলা ওদের ডেকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসিয়ে ফিরনি জাতীয় একটা কিছুতে আপ্যায়নের সাথে সাথে জানান, কয়েকটা জানালায় কাঁচ ভাঙা আছে, তিনি লাগিয়ে দেবেন। পর্দা টাঙানোর রানারেও কিছু সমস্যার কথা নিজ থেকেই তিনি বলেন। লোকটাকে এতো সরল মনে হয় না। তবুও সে সজ্জনের মতোই জিজ্ঞেস করে দেবব্রতর চাকরিটা কোন্ ধাঁচের। বিদেশি এনজিও শুনে তিনি হাঁফ ছাড়েন। এমনকি বরিশাল বা গফরগাঁওয়ের লোকদের তিনি পছন্দ করতেন না কারণ গফরগাঁও তার নিজ শ্বশুরবাড়ি আর দেবব্রত বরিশালের শুনে তিনি এভাবে কথাটার নিষ্পত্তি করেন যে – একটা এলাকার সব লোক খারাপ হয় না হেঃ হেঃ। দেবব্রত লোকটার ভেতরে এই সময় ঘাপটি মেরে থাকা সচিবালয়ের মিড লেভেল অফিসারসুলভ চামচা অভিব্যক্তি খুঁজে পায়। কিন্তু তারপরও বাড়িওলার সাথে তেমন আশনাই হবে না- ওরা নিজেদের মতোন থাকবে- এই আকাঙ্খা নিয়ে সে এডভান্সের টাকাটা তুলে দেয়। অরু অন্তত বুঝুক সেও বাসা নিতে জানা পুরুষ! অর্থাৎ ‘পুরুষমানুষ’!

এই ঘটনার পর আরও বহু বহুবারের মতো এবারও সে নিজের সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাসাটার একটাই সমস্যা। তা হলো রোদ পড়ে না। কিন্তু ট্যানারি এলাকা বলে মশা মাছি তেমন নেই। অভিজ্ঞ ভাড়াটে বন্ধুদের সাথে সে বাসা খোঁজা ও বাসা পাওয়া নিয়ে অঢেল গুলতানি করে। কেউ বলে ঐ এলাকায় ভাড়াতো কম হবেই- তিনমাসে ধাতব যন্ত্রপাতি সব আলগা ঝুরঝুরা হয়ে যায়। আরে ভাই আমার একখান সাইকেল আছিলো। একদম লজ্ঝর হয়ে গেছে- ট্যানারি ক্যামিকেলের কী ঝাঁঝ! আর একজন তার অল্পবয়সে টাক পড়ে যাওয়ার জন্য ঐখানের সাপ্লাইয়ের পানিকে দোষী করে।… কিন্তু দেবব্রতর ভেতরে তখন অরুন্ধতিকে নিয়ে টানা মিছিল চলছে। মানতে হবে মেনে নাও, দিতে হবে দিয়ে দাও-র মতো বৈবাহিক চাহিদাগুলি আস্ফালন করছে একাদিক্রমে। বিয়ের পরের দুই বছর তারা দুই ভূবনে দুই বাসিন্দা হয়ে আছে। আর কাঁহাতক সহ্য হয়? এবার থাক না বেতন কেটে ডিপিএস চালানোর হিসেব। না হয় মাসের সবটাই শেষ হয়ে যাক। আর ঢাকায় এসে অরুন্ধতিও নিশ্চয়ই একটা কিছু জুটিয়ে নিতে পারবে- এই আশাও তাকে বাসা নিতে সাহস জোগায়- অতএব নতুন বাসায় তারা শীগগীর উঠে গেলো। প্রথম সংসার যেভাবে শুরু হয় – একটা পুরোদস্তর খাট, কিছু বইটই, বিয়েতে পাওয়া কিছু অপ্রয়োজনীয় উপহার সামগ্রী আর অরুন্ধতির কিছু গহনাপত্র ও কাপড় চোপড়ের স্যুটকেস এক ঠ্যালাগাড়িতেও উপচে পড়ে না। প্রথম দিনের মেনু আলুসেদ্ধ- ডিমভাজা আর বাড়িওলার স্ত্রীর পাঠানো ফিরনী অমৃত মনে হয়। ভদ্রমহিলা সম্ভবত ঐ একটা রান্নাই পারেন।
কিন্তু বাসা অর্জন করা যতো কঠিন, তাকে টিকিয়ে রাখাও তারচে কম কঠিন নয়। প্রথম সাতদিনে ধোয়ামোছা পরিপাটি আর এন্তার কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। জুতোর আলমারি কেনাও যে কী ঝকমারি তা ওরা উপলব্ধি করে। আর এরই ফাঁকে ভয়টা চিনচিন করে বাড়তে থাকে। ওদের পাশের বিল্ডিংটায় কনস্ট্রাকশন চলছে। সারাদিনে গর্ত খোঁড়ার মেশিন চলছে একদিকে আর সারা রাতভর ট্র্যাকে করে ইট বালু সুড়কির পরিবহনে ঘুমের বারোটা বেজে যেতে বসেছে। সেন্টারিংয়ের জন্য মিস্ত্রিরা সারারাত কাঠ পেটায়। আচ্ছা দেবব্রত যখন অফিসে থাকে – বিশাল ঐ বিল্ডিংটা থেকে লেবাররা যদি কোনো কুমতলবে এই বিল্ডিংয়ে চলে আসে? ওদের বেডরুমে এখনো পর্দা লাগানো হয়নি। অর্ডার দেবার পরও ঘোরাচ্ছে। অরুন্ধতি একা আছে বুঝে কেউ যদি কোনো ভেক ধরে দরজায় নক করে? আজকাল ডিশের লোক, টেলিফোনের লোক বলে কতো কিছুইতো ঘটছে পেপারে দেখা যায়। অরুন্ধতিকে এসব ভয়ের কথা বলতে দেবব্রতর বাঁধো বাঁধো ঠেকে। কিন্তু অফিসে বসেও এক ধরনের অস্বস্তিতে সে চিড়বিড় করতে থাকে। কি করা যায় মনে মনে ভাবে। বাথরুমের একটা কল থেকে পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়েই চলেছে। বাড়িওলাকে বলবে ভাবছিলো। এখন মনে হয় সেই সাথে দরজায় আর একটা দশাসই ছিটকিনি লাগানোর কথাটাও তুলতে হবে। কিন্তু বাসায় ফিরে সে তাজ্জব হয়ে যায়। অরু জানায়, আজ বাড়িওলা অয়েল্ডিং ফ্যাক্টরির লোকসহ এসে প্রতিটা জানালার মাপ নিয়ে গেছে। একটা গ্রিল থাকা সত্ত্বেও ভেতর দিকে অন্য একটা ঘন তারের গ্রীল তিনি সেট করে দিতে চান সিকিউরিটির জন্য। না না এজন্য দেবব্রতকে কোনো পে করতে হবে না। তোমরা নতুন সংসার পেতেছ- আহলাদে আটখানা হয়ে তিনি অরুন্ধতিকে তুমি সম্বোধন করে বসেন- খোদা না চান যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় এজন্য আগাম ব্যবস্থা… সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু ঐ দুর্ঘটনা শব্দটা দেবব্রতর মাথার ঠিক পেছন দিকের যে চিন্তাশয় – সেখানে হাতুড়ির বাড়ি মারে। দুর্ঘটনা মানে কি? কিসের দুর্ঘটনা? কাদের দুর্ঘটনা? গ্রীল আর দুর্ঘটনা। গ্রীলের ঘন তারের খাঁচা আর দুর্ঘটনা… ওর মাথা বিনবিন করে ওঠে। ”কি হলো তোমার, অসুস্থ লাগছে নাকি?” অরুন্ধতি বলতে বলতে থেমে গিয়ে তীক্ষ্ম চোখে তাকায়। খুবই দূরপরিচিতা মহিলার মতো ফর্মাল শোনায় ওর কণ্ঠস্বর। দেবব্রতর মনে হয় ওর পাশে এই শহরে কেউ যেনো চেনাজানা নেই। সবাই খুব দূরের অনাত্মীয়। আর এই ঘটনার পর থেকেই তার ঘুম পাতলা হতে শুরু করে।

কিছুদিনের মধ্যেই মোড়ের সিগ্রেটওলা আর মুদির দোকানদারের কাছে ওর মুখটা পরিচিত হয়ে ওঠে। তারা সাপ্তাহিক বাজারের ফর্দ মিলিয়ে সওদার প্যাকেট বাঁধতে বাঁধতে চা আনায়। সে শুনেছে এরকম নাকি হয়। নতুন ভাড়াটেদের সাথে এভাবে খাতির জমিয়ে দুদিন পড়েই তার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা ধার চায় এরা। তারপর স্বমূর্তি ধারণ করে। দেব এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক হলেও চা তো আর ফিরিয়ে দেয়া চলে না। গম্ভীর হয়ে সে চুমুক দেয় কাপে। গলির মাথার যে পানের দোকান থেকে সিগারেট কেনে রোজ – সেদিন রাতে লোকটা তার দিকে বেশ মারফতি ঢঙে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে! পাঁচশো টাকার নোটের ভাঙতি সে আঁতিপাতি মিলিয়ে জোগার করে। আর তার ফাঁকে কথোপকথনের টুকরো টাকরা ভাসে-

– ভাইজান কি ঐ বেগুনি রংগের বাড়িতে উঠছেন?

– হ্যাঁ।

– এসপি সাবের বাড়ির পি্ছনে?

– তাতো বলতে পারবো না ভাই…

– হয় হয় ঠিকোই কইছি, যেই বাড়িতে কিছুদিন আগে একটা দুর্ঘটনা হইছিলো…বলেই লোকটা কাছিমের খোলে গলা ঢোকানোর মতো কথার বাকি অংশ গুটিয়ে ফেলে।

– কি দুর্ঘটনা? দেবব্রতর কল্জেটা দুম করে একটা লাফ মারে!

– না মাইনি, কই আরকি, বিল্ডিং উঠতাছে, কতো বিপদ আপদইতো মান্ষের হয়…

লোকটা যে চেপে যাচ্ছে তা বোঝা যায় বেশ। এর পেট থেকে এখন আর কিছু বের করা যাবে না মনে হচ্ছে। দেব বাসায় ফিরেও গুম হয়ে থাকে। শিকেয় ওঠে অরুন্ধতির সাথে নিষিদ্ধ দুষ্টুমির ইচ্ছেগুলি। শুক্রবারের সকালবেলা যখন আমেজ মাখা, দুধের সরের মতোন ঘুম জমে চোখের পাতায় – যাবতীয় ফেরিওলা আর সব্জি বিক্রেতারা যেনো কাকভোরে তরকারি বেচতে এসে নিজেদের ঘুম হারামের আক্রোশ মেটায় চিৎকারে পাল্লা দিয়ে। এই মাছ, এই মাছ ডাকতে ডাকতে একজন চলে গেলো তো আর একজন পেপে পুঁইশাক লেমু থানকুনিপাতা জানান দিতে দিতে এগিয়ে আসে। তার ফাঁকে খুচরো মিউজিক হিসেবে বাজে তালা সাড়ানোর ঝনৎকার আর আল্লাহুমা সাল্লে­য়ালা… আচ্ছা এতো ভোরে চোর ছাড়া ভালো কোনো মানুষের প্রয়োজন হয় তালার চাবি কাটানোর? শব্জিওয়ালা ইতোমধ্যে বাঁক নিয়েছে। হয়তো অন্য কাউকে ফ্লোর দিচ্ছে আর অরুন্ধতির আলুথালু শাড়ির আঁচলের নিচে নিজের কব্জি পর্যন্ত চালান করে দিয়ে জলভরা বেলুনের মতো তুলতুলে জিনিস দুটোতে আলতো করে পরশ নিতে থাকার রসভঙ্গ করতে ডেকে ওঠে কয়েকটি কাক। আর অরুন্ধতি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে – হেই ডাকোতো ।

– কি হলো ? ঘুমজড়ানো চোখের অভিনয়ে পূর্ণ সজাগ দেবব্রতর অনুযোগ।

– পুঁইশাক পুঁইশাক। ইশ্ কদ্দিন খাই না। গুঁড়ো মাছ দিয়ে চচ্চরি, ধুশ ওঠোতো। সে হাতের ধাক্কায় তাড়া লাগায় স্বামীকে।

– কতো করে কেজি? উত্তর না দিয়ে ছোকড়া চেঁচায়- ছার হাজিডা এট্টু ধরেন…

– আরে তোর শাকের দাম আগে বলবিতো-

– ওস্তাদী ঢংয়ে ছেলেটা বলে, দাম লাগতোনা। আহ্মে দিয়েন আগের সাবেরা যেই রহম দিতো।

– আগের সাব মানে?

– ওই যে আছিলো, পরে চইলা গেলো দুঃখ পাইয়া।

– অরুন্ধতিও এসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় বলে দুঃখটা আর শোনা হয় না। তবে দিনের প্রথম ধরানো সিগারেট টানতে টানতে তাকে কড়া নজর রাখতে হয় সব্জির মাপের দিকে। টাকা গুনে ভাংতি দিতে দিতে ছোকড়া বলে-

– আগের সাবে খুব ভালা আল্হে। কোনোদিন মাপ-উপ্ দেহেনাই। ভাবীসাবরে আমি ডেলি সব্জি দিয়া যাইতাম। দুর্ঘটনা ঘইট্টা গিয়া সব বরবাদ হইয়া গেলো!

– কি হয়েছিলো? দেবব্রত নিজেই চমকে যায় নিজের গলার স্বরে। কী এক নির্ঘুম নেশার ঘোর তার রাতপার করা সকালের মুখমণ্ডলে। ছোকড়া একটু ভয় পেয়েই তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে। 

সারাদিন এরপর আর কোনো কিছুতেই মন বসে না। কি হয়েছিলো এ বাড়িতে? এ ফ্লাটে আগে এমন কিছু ঘটেছিলো, যা সবার মনে দাগ কেটে আছে। কি সেই দুর্ঘটনা ? কোনো খুন কিংবা আত্মহত্যা? এখনো অন্যান্য ফ্লাটের ভাড়াটেদের সাথে ওদের আলাপ পরিচয় হয়নি। কিন্তু আলাপ হলেই যে তারা তাকে সব বলবে এমন আশা করা উচিত নয়। বাড়িওলার মনে হলো সব ভাড়াটেদের প্রতিই দারুণ আস্থা। সকলেই নাকি বহু বছর ধরে আছে। অতএব তারাও বাড়িওলার অনুগত হবেন – এটাই ভেবে নেয়া যায়। তাহলে কিভাবে এই রহস্য ভেদ করা যাবে? ভাবতে ভাবতে দেবব্রত খুবই অসহায় বোধ করে। অরুকে এসব বললে – যা ভিতু মেয়ে, নির্ঘাৎ বাড়ি ছেড়ে পালাবে। এখন এই সবেমাত্র একটি বাসায় উঠেই আবার চেঞ্জ করা আর এক ঝক্কি। এক কথায় অসম্ভবই বলা চলে। এতো সাবধানতার পরও এই বাড়িতে মালপত্র উঠতে গিয়ে ওর সাধের পাইরেক্স মগের একটা ভেঙেছে। সুটকেসের চাবি নতুন করে কাটাতে হয়েছে। বাসা বদলের ঝক্কি অনেক। একা মানুষ কতোইবা পারে সে? দেবব্রত ভাবতে ভাবতে অসহায় বোধ করে। বাসা নেয়ার থ্রিল আর আনন্দ সেই বোধের ভেতরে মিইয়ে যায় একেবারে।

এরপর তার ভেতরে কাজ করে বিদঘুটে সব চিন্তা। কিছু যদি ঘটেই থাকে তবে নিশ্চয়ই তার ছাপ পাওয়া যাবে। কোনো ক্লু কি নেই বাসার ভেতরে? কী সেই ক্লু? মুহূর্তে তার মাথায় কলেজ লাইফ পর্যন্ত পড়া ফেলুদা থেকে মাসুদ রানারা একে একে বাসার প্রতিটি ইঞ্চিতে নজর বোলায়। বাথরুমে স্নান করতে করতে সে আয়নার ডানদিকে একটি স্খলিতবসনা নায়িকার ছোট্ট ছবি দেখতে পায়। সম্ভবত কোনো ম্যাগাজিন কেটে লাগানো হয়েছে। কে লাগিয়েছে এটা? অরুকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ওর আবার এসব খুবই পছন্দ। কোনো ভালো রান্নার রেসিপি, কোনো সেলাইয়ের ডিজাইন কিংবা কোনো নায়িকা বা মডেলের সুন্দর সাজপোষাকের ছবি পেলে সে ম্যাগাজিনের ভবিষ্যত তোয়াক্কা না করে ধ্যাড়ধ্যাড় করে কেটে ফেলে। এসব জমিয়ে কি আনন্দ পায় কে জানে? হয়তো তারই কোনো নিদর্শন ওই টু পিস বিকিনি পরিহিতা। ফেটে পড়া স্তনের লোভাতুর আহবান ছড়িয়ে সে লজ্জানত সৈকতে এলোমেলো হয়ে আছে। কিন্তু তবুও দেবব্রত ভেতর থেকে কোনো সাড়া পায় না। কি হতে পারে ঘটনাটা? কি ঘটেছিলো এই বাসায়? খুন বা ধর্ষণ কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে কেউ আত্মহত্যা করেছিলো? স্ত্রীকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলেছিলো? কিংবা আচমকা দরজা ভেঙে ঢুকে কেউ পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলিতে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলো লোকটিকে? কতো কিছুইতো ঘটা সম্ভব। সে অনুমান করতে পারে ওদেরই মতো এক কাপল থাকতো এই ফ্ল্যাটে। পার্থক্য শুধু তাদের দুজনই ছিলো চাকুরিজীবী। তাদের কি ওদের মতো প্রথম সংসার ছিলো এখানে? হ্যাঁ ছিলো। প্রমাণ? প্রমাণ সারা দেয়ালের এখানে ওখানে অসংখ্য পেরেক পোঁতা আর ড্রিল মেশিনের কারুকাজ। নতুন সংসারি যারা, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই দেয়াল ফুটো করতে শুরু করে। অবশ্য অনেকের আবার এটা হ্যাবিটও। দেবব্রত এটা খুব অপছন্দ করে। তাছাড়া নতুন করে পেরেক গাঁথার কোনো প্রয়োজন এখনো তাদের হয়নি।

গোছানো জিনিস আবার গোছানোর বাতিক আছে অরুর। ছুটির দিন পেয়ে দেবও সেদিন হাত লাগিয়েছে তার সাথে। মালপত্রের বোঝা সব একাকার হয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। তার মধ্যে কাঁচের জিনিস গুরুত্বপূর্ণ আসবাব বা নতুন বার্নিশ করা ফার্নিচারে যেনো কোনো দাগ না পড়ে সে জন্য সতর্কভাবে কাজ করছিলো তারা। তাদের নিজেদের বাসা নিজেদের সংসার ইত্যাকার আনন্দে দেবব্রত তখন ডিম পাড়া মোরগের মতো ফুলছিলো! তার পাশে ছেনাল মুরগীর মতো অরুন্ধতিও বাক বাকুম করে এমন চুড়িহাট্টা জাগিয়ে তুলেছিলো যে স্থানকালপাত্র ভুলে দেবব্রত কী করলো অরুন্ধতিকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে সাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দুজনে ভিজতে লাগলো। তার কতোদিনের ইচ্ছা একত্রে বৃষ্টিতে ভিজবে! আজ, আজি সেই শুভক্ষণে আষাঢ় গগনে… মসৃণ শরীরের এখানে ওখানে বেয়াড়া আঙুলের না-বাড়ন তাদের আরও তপ্ত করে ফেলে। এ অবস্থায় ভাবনাটা এখন কেবল একটি আকাঙ্খায় এসে ঠেকে। অরুন্ধতি ফিসফিস ভাঙা কন্ঠস্বর ক্রমাগত কঁকানিতে রূপ নিলে দেবব্রতর কানে আর এক রিরংসা জন্ম লাভ করে। পরক্ষণেই বোঝে এ চিৎকারের অন্য মানে আছে। চট করে সে সামনের আয়নায় নিজের মাথার পেছনে – যেদিকে তাকিয়ে অরুন্ধতি গোঙাচ্ছে – সেদিকে লক্ষ করে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একটা বিজাতিয় আরশোলার মতো বড় পোকা কোত্থেকে এসে তাদের দিকে নির্লজ্জের মতো সবকিছু দেখছে। সে দেখায় না আছে কোনো লজ্জা, না আছে ভদ্রতার কোনো অনুশোচনা। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো পোকাটি ওদের ক্রিয়াকাণ্ড দেখে দেখে যেনো বিকৃত সুখ চেটে নিচ্ছিলো। জরাগ্রস্থ যযাতির মতো তার মাথার ওপর সার্চলাইটের মতো চোখদুটিতে এক ধরনের অক্ষমতার আগুন ঠিকড়ে বেরুচ্ছে। অরুন্ধতিকে চট করে কাছে টেনে নিয়ে দেব ফিরে তাকায় পোকাটার মুখোমুখি। আকারে প্রায় তেলাপোকার দ্বিগুন। মেটে-সবুজ রঙের পাখার কারণে মনে হয় যেনো কোনো গর্ত থেকে শীতনিদ্রা শেষে উঠে এসেছে সে। অরুন্ধতি নিজেকে সামলে নিতে নিতে বাথরুম থেকে বেরোয়। দেবব্রত ইতোমধ্যে একটা ঝাড়ু দিয়ে পোকাটার সর্বনাশ করে ছাড়ছে। থেতলানো মৃতদেহটা প্যানের মধ্যে উগড়ে দিয়ে সে বীরদর্পে বেড়িয়ে আসে। এসে দেখে অরুন্ধতী বেসিনে উপুর হয়ে বমিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে যা খেয়েছে সব। সে ক্রমাগত হাঁফাতে থাকে। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। কে এলো? কে আসতে পারে এখানে? কেউতো তাদের এই নতুন ঠিকানা জানেনা এখনো। প্রথমে কী হোলে চোখ রেখে দেব দেখে একটা অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে। 

– স্লামালেকুম। আম্মা আপনাদের আজ দুুপুরে আমাদের বাসায় দাওয়াত দিয়েছেন। 

– কি কারণ? 

– কিছু না এমনি। 

– না না এসবের দরকার কী… 

কিন্তু মেয়েটি সেসব শোনার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। ফিরে এসে দেখে অরু এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বার বার জিজ্ঞেস করছে কে এসেছিলো। তারপর ধাতস্থ হয়ে দেবব্রতর দিকে চোখ রেখে বলে পোকাটা কী নির্লজ্জের মতো দেখছিলো আমাদের। ওটা কোনো অশরীরী আত্মা নয়তো? রুমে এখনো ফ্যান লাগানো হয়নি। অবশ্য তাড়া নেই। জাঁকিয়ে শীত পড়বে কদিন পরেই। টিউবও লাগাতে হবে। ইত্যাকার অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। বাড়িওলা প্রতিদিনকার কোটনা কুটা সব নিয়ে যাবার লোকটাকে ঠিক করে দিয়েছে। দেব অফিসে গেলে সেদিনের পর থেকে অরুন্ধতি ভেতর থেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে থাকে। গতকাল বিকেলে ডিশের লোক ডিশের লোক বলে অনেকক্ষণ চিল্লি­য়ে গেছে গুন্ডামতো এক লোক। অরু ভয়ে দরজা খোলেনি। দেব আসার পর অনেক সময় নিয়ে সে গল্পটা বলেছে। বাড়িওলাকে যে লোকটা দুধ দেয় সে এসেও নাকি জিজ্ঞেস করেছিলো দুধরোজ করবে কিনা। এদিকে বলা নেই কওয়া নেই গতকাল ভোরবেলা দেখা যায় দরজার নিচ থেকে একটা পেপার উঁকি দিচ্ছে। আরে, সবকিছু এতো অটোম্যাটিক হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? অরু যেহেতু একা থাকে তাই বাইরের কোনো লোকের সাথে এখনই কোনো ধরনের লেনদেন না করাই মঙ্গল। এটা অবশ্য দেবব্রতর অতি সতর্কতা কিংবা স্ত্রী শাসন। কিন্তু সত্যিকারার্থে নতুন যায়গায় এখনই খুব বেশি লোকের আনাগোনা সে ভয় পায়। কিছুদিন গেলে তারপর এসব নিয়ে ভাবা যাবে। অরু সেদিনের তেলাপোকা দেখার পর থেকে বেশ সিঁটিয়ে আছে। তার উপরে সেদিন হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করেছে দেয়ালের কোথায় নাকি গোটা অক্ষরে পেন্সিল দিয়ে কে লিখে রেখেছে ‘শোধ নেবো’। কে লিখতে পারে এই কথা দেয়ালে ? দেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। বাড়িউলি- যখন সে থাকে না- তখন মাঝে মাঝে এসে ওর সাথে গল্প করে যায়। মহিলা আসলে তার বাড়িটা ওরা কিভাবে ব্যবহার করছে সে ব্যাপারে স্পাইগিরি করতে আসেন। তাকে মুখ ফুটে ভয়ের কথা বলতে অরুর সংকোচ লাগে। অবশ্য তার সাথে আলাপচারিতায় বোঝা গেছে আগের ভাড়াটেদের প্রতি তাদের মিশ্র অনুভূতি রয়েছে। সে সম্পর্কে খুলে কিছুই তিনি বলেন না। আবার মাঝে মাঝেই ওদের সাথে পূর্বতন দম্পতির তুলনা করতে গিয়ে কেমন যেনো চুপসে যান। সব মিলিয়ে বিষয়টি এমন এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করে দেব আর অরুর মনে যে নতুন বাসায় সুখের মাঝেও বিষের কাঁটা খচ্খচ্ করে। সবচেয়ে যন্ত্রণা হয় অফিসে। একা একা অরুন্ধতির কোনো বিপদ হয় কিনা- এটা ভেবে কিছুতেই সে কাজে মন লাগাতে পারে না। মাঝে মাঝে নিজেকে সে অটো-সাজেশন দেয়: এসব শ্রেফ নতুন বিবাহিত দম্পতির প্রথম সংসার পাতার ফালতু টেনশন ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর আশংকার ছোটো ছোটো কিউ তাদের অনাস্থা বাড়িয়ে তোলে। এমনি করে একটি মাস নিরানন্দ আর দ্বন্দ্বের দোলাচালে কেটে যাওয়ার আগেই তাদের কাছে অনর্থক অপয়া হয়ে পড়ে বাসাটি। নির্ধারিত তারিখের আগেই ভাড়া দিতে বাড়িওলার ফ্ল্যাটে নক করে দেবব্রত।

– আরে এসো এসো, কেমন চলছে তোমাদের নতুন সংসার? ইত্যাদি আন্তরিক সংলাপ দেবব্রতর ভেতর কোনো আনন্দকে উসকে দিতে পারে না। সে ধপ করে সোফায় বসে প্রথমে কোনো ভূমিকা ছাড়াই ভাড়ার টাকাটা নিঃশব্দে এগিয়ে দেয়। প্রবীণ ব্যক্তিটি ওর দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক তাকান।

– কোনো সমস্যা?

– জ্বি

– কি হয়েছে ?

– আমাদের আগে এ বাসায় যারা থাকতো তাদের কী হয়েছিলো?

ভদ্রলোক তাকিয়েই থাকেন দেবব্রতর দিকে। তারপর একটা চোরা দীর্ঘশ্বাসকে গোপন না করেই পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়েন- 

– তুমি কি ভাগ্য বিশ্বাস করো?

– না, কোনো?

– তাহলে যা-ই ঘটে থাকুক, এজন্য তোমাদের আপসেট হওয়া ঠিক নয়।

– আমি জানতে চাচ্ছি, এ্যাকচুয়াল ইন্সিডেন্টটা কী ঘটেছিলো?

বাড়িওলা হাসেন। বহু বেদনায় দীর্ণ সে হাসি। ভাড়াটে হারানোর চেয়ে বেশি কিছু অর্থময়। এই সময়টুকুর মধ্যেই দেব ঘামতে থাকে। কী শুনতে হবে তাকে? কী ঘটেছিলো? লোকটা যেনো প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিংবা গুছিয়ে নিচ্ছে – ঠিক কতটুকু বলবে, বলা উচিত হবে- এইসব। দেবব্রতর ইচ্ছা করছে লোকটাকে চেপে ধরে খুনে গলায় চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করতে – কী ঘটেছিলো? তার চোখ সরু আর শ্বাস প্রশ্বাস চরম কিছুর জন্য নিষ্পলক হয়ে আছে। বাড়িওলা নিস্তব্ধতা ভাঙ্গেন-

– আমার এই বাসাতেই ওদের বাসর হয়েছিলো। ইউনিভার্সিটিতে পড়তো দুজন। ছেলেটা বিসিএস পাশ করে দুজন বিয়ে করে। কাজী অফিস থেকেই বাসা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। মেয়েটাও জবে ঢুকেছিলো মাস তিনেক পর একটা মার্কেট রিসার্চ কোম্পানিতে কিন্তু…

ক্কি হয়েছিলো? দেব এতো জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে যে, ভেতরঘর থেকে বাড়িওলার পর্দানশীন স্ত্রী পর্যন্ত পর্দা সরিয়ে তাকায়।

– কি হবে বলো?

– কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিলো?

– হ্যাঁ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করেন ভদ্রলোক। এরপর দেবব্রতর মুখে আর প্রশ্ন আসতে চায় না। তাহলে তারা যা সন্দেহ করেছিলো তাই-ই? একটা অপয়া বাড়িতে অরুন্ধতিকে নিয়ে উঠেছে সে! উহ ! এতোদিনে তাদেরও ভাগ্যে কিছু একটা ঘটে যেতে পারতো, উহ্ ভগবান! ঠেকায় পড়ে ভেতর থেকে ঈশ্বরকে মনে পড়লো তার। বাড়িওলা কাশলেন- 

– বছর না ঘুরতেই বাড়ি ছেড়ে দিলো ওরা।

– কারা? আপনি না বললেন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো? তারা কি বেঁচে ছিলো তারপরও?

বাঁচবে না কেনো? দুজনই ভিন্ন ভিন্ন বাসায় গিয়ে উঠেছে শেষে…

মানে? আক্রমণের শেষ চুঁড়োয় যেনো এক বলে একরান নিতে হবে এমন মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করলো দেব। বাড়িওলা নিস্তেজ ম্লান কণ্ঠে বললেন-

– ওরা ডিভোর্স নিয়েছিলো। সেপারেশন হয়ে গিয়েছিলো ওদের !

 

 

রচনাকাল: ৮ নভেম্বর ২০০২

কবিসভা

ট্রামের ক্যাচারে মিলুদার স্থুল শরীরটা 
আধাআধি সেঁদিয়ে যাবার পর
সূক্ষ্ম বিধাতা হেসে উঠলেন!
জাতি তখন বিকেলের সিয়েস্তা সেরে 
কেবল উঠেছে! ঘুম ঘুম মদালসায়
জর্জরিত ল্যান্সডাউনে শেষ বিকেলের রোদ
কর্পোরেশনের তারে তারে 
অনিত্যতায় তখনো ঝুলছে। 
সূক্ষ্ম বিধাতা বুঝলেন-
এ জাতির কপালে খারাবি আছে;
তাই তিনি অচীরেই মিলুদাকে মুক্তি দিলেন।
চরম বিব্রত এক নির্ভেজাল জীবন-
যা দোয়েলের ফড়িংয়ের স্বাদ পেতে চেয়েছিলো
কার্তিকের কুয়াশার মতো
শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের 
লোহার বিছানা থেকে মুক্ত হলো! 

সূক্ষ্ম বিধাতা চিতায় আমকাঠ চড়াতে চড়াতে 
উদ্বাস্তু পেঁচানীকে বললেন- হে প্রগাঢ় পিতামহী, আরও একশো বছর তোমাকে এই শোক সইতে হবে; আরও একশো বছর শালা সব কবির ভাত মেরে নিজেই একটা কবিসভা হয়ে উঠবেন!
১৯ জুলাই ২০২১, রাত ৪টা

জাতিস্মর

ধরো বুঁচি, তোমার আমার এখনো বিয়েশাদী হয়নি
কিন্তু হবো হবো করছে- রিকশায় হুড তুলে আমরা দুজন ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক সেদিক পার্কে কিংবা রেস্টুরেন্টে- জনগনের চোখের সামনে বরবউয়ের মতো একজন আরএকজনের মুখে তুলে দিচ্ছি আধিখ্যেতার গ্রাস। চুড়ি কিনতে হাত মুঠোয় নিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি হাতে- বুঁচি, আমার মনে হয় আমাদের এই জিবন ভালো। এই জিবন জিবনের চেয়ে মরনোত্তর! তুমি কী বলো বুঁচি, আমরা কি আবার জন্মাবো?

১৭ মার্চ ২০২১ সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা

ট্রোপোসীমার ৭ছন্দ

১.

ট্রোপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে একা স্বপ্ন দেখে নদী

কোদণ্ড সন্তাপের শেষে টাটকিনা মাছ নাচে

গভীর রাতে বুকের মাঝে তেজকটালের চাপ

কোথায় যেনো বাজছে ব্যকুল

স্যাক্সোফোনের স্বর।

                     নিরক্ষীয় সন্ধ্যা বসে

                     জনযুবতীর চুলে –

আগুন নিয়ে করছে খেলা অবাধ্য সব ভূত!

 

২.

বর্ষাবিহীন ক্লান্তিমাখা পত্রপতন গাছে

একাত্তরের সঙ্গী যখন 

বেশ্যা-কবি-ভাঁড়;

ডায়ামিটার বাড়িয়ে দিলাম গণতন্ত্রের মুখে –

যা বলে যান, বলুন; 

এখন

সবাই সর্বভূক।

 

৩.

বাঘের থাবা বাড়িয়ে আছে অসভ্য স্তন।

চান্দ্রমাসে কন্দকাটা

শিব গিয়েছেন জেলে

                   রসিক, এবার স্যাক্সোফোনে

লাম্বাডা সুর তুলে

গিনেস বুকে অনাহারীর ফর্দ তুলে ধরে!

 

৪.

নি-নেপচুনের চামড়া ছিঁড়ে মিথেন-মদির ধোঁয়া

এইযে আমার কোদাল

আমার কাস্তেরা খঞ্জ না।

 

৫.

তুড়ির শব্দে

তুবড়ি তুলে জ্যান্ত ফুজিয়ামা

জলখাবারের কফির কাপে

মেঘ দ্যাখে সন্তরা।

                      ত্রিশের কবি

                      পঞ্চাশে মেঘ

                      নব্বইয়ে হালভাঙা-

ঊষঢ় দিনেই গজায় ক্ষেতে কন্টিকারীর ছানা।

 

৬.

হামাক্ তু ল্যিয়ে যাবিক্

মারমা গাঁয়ের কাছ্যে

সনঝেরাতের মাদল শুন্যে

চিত্রাহরিণ ডাক্যে!

 

৭.

অবশেষে ক্রান্তি যখন

শিরে ও সন্দ্বীপে-

                          ভাসাও তোমার

                           ক্যান্যু জাহাজ

                           তাহিতি কোন্ দিকে?

ওইখানে সব ওয়াহিন মেয়ে

ওইখানে সব সুখ;

ওইখানে এক মারমা যুবক

                            ণৃতত্ত্ব সন্ধানে-

ট্রোপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে এক

ভিনগ্রহে পৌছাঁবে!

 

প্রকাশ: আমিনুল হাসানের রেখা ও কাব্যে কবিত্রয়, ১৯৯৪

বিশ্বরূপ

 

খড়ের পুতুলের ভেতর থেকে 
সেদিন তোমাকে আমি 
টেনে বার করলাম, আর রাতারাতি 
পৃথিবীটা ভীষণরকম 
নতুন ভাসানে ভরে উঠলো! 

মানুষেরা যার যতো দেনাপাওনা ছিলো
সব শোধ করে 
নতুন মানুষ হয়ে গেলো। গাছপালা
অবশিষ্ট পাতায় বল্কলে
দিব্যি গজিয়ে গেলো নতুন মানুষ!
মোড়ে মোড়ে খুলে গেলো ট্রাফিক জ্যাম।

একবিন্দু বৃষ্টিতে 
বিশ্বরূপ দেখে ফিরলেন অবসন্ন চাকুরিজীবী

যেদিন তুমি প্রথম চুমু পাঠাবে!

৯ জুন ২০২১ সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা

খুন

খুন হয়ে যাবার পর আমি তোমার দিকে 
তাকালাম; পিরামিডের পাশে-
ঝিকিঝিকি আগুনের সূর্যটা ম্লান করে 
তোমার নিঃসঙ্গ সৌষ্ঠব 
অহেতুক আস্ফালনে 
আমাকে বাঘের মতো ফালাফালা 
করে দিলো! 

চেয়ে দেখলাম, পুরোনো পৃথিবীটা 
নগন্য তামার পয়সার মতো নিঃশব্দে 
অস্ত যাচ্ছে তোমার পেছনে!



৯ জুন, ২০২১
সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা

আলোহা

নাহ ! ঠিক এভাবে যে নয়নার সাথে সম্পর্কটার স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এমনটা ভাবেনি উদিতাংশু। সাত বছর পরে এসে তারা যে সমাধানটার কথা ভাবলো, সেটা আগে কেনো ভাবেনি- তাই ভেবে তার নিজেরই একরকম জিদ চেপে গিয়েছিলো। অনেকটা জোর করেই তাই নায়নাকে নিয়ে জমপুর আসা। এমন বিস্তীর্ণ গ্রামে নয়নাকে নিয়ে এই অবস্থায় আসার কোনো মানেই হয়না। তাকে নিয়ে বরং সরকারী কোনো হিসেব সংরক্ষণাগারে হানিমুনে যাওয়া উচিত। যেখানে না থাকবে কোকিল না থাকবে একটা ধানগাছের ছায়া। এই ছায়াঢাকা-পাখীডাকা গ্রাম তার জন্য এখন বিষ। বিষ! উদিতাংশু তাই এক ধরনের বেকুবই ভাবে নিজেকে। তবু, গ্রামের গল্প তার ভেতরে দীর্ঘদিন দানা বেঁধে মিছরি জমে আছে- তাকে না দেখে থাকার কষ্টের চেয়ে এখন দিনরাত্তির নয়নার ঘ্যানঘ্যানানি শোনাও তেমন লোকসানের নয়। হাজার হোক, মেয়েতো একটা! রক্তমাংসের সেক্সডলওতো কতো মানুষ কামনা করে… না,না, উদিতাংশু নিজেকে শাসায়- কেবল খারাপ দিকগুলো ভাবলে চলবে না। নয়নার কিছু ভালো দিকওতো আছে, না-কি?

তবু কেনো যে মেজাজের মুূহূর্তে সেসব মনে আসে না তার? আর নয়নাও তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই একদম সপ্তমে চড়ে বসে। কখনো কখনো চিল চিৎকার আর দাঁত-নখ একত্রে চালায় সে। সাত বছরের বিবাহিত জীবনটা তখন তাকে কলা দেখায়। নাহ্! এভাবে হবে না। হবে না। ভাবতে ভাবতে উদিতাংশু আরও মুষড়ে পড়ে ভেতরে ভেতরে। তার গান কম্পোজ মাথায় ওঠে। এই বাজারে একবার প্রতিষ্ঠার দরজায় পিঠটান দিয়ে কবে আর কে তা ফিরে পেয়েছে ? এ জন্যই তার গান লেখার প্রতি আগ্রহটা চরম ও মরীয়া। গানের নেশা তাকে এক ধরনের ভাবালুতার মধ্যে নিয়ে যায়। তার কেবল ফিরে পেতে ইচ্ছে করে ইউনিভার্সিটির হলের সামনের চত্তরে রাত জেগে বন্ধুদের মাঝে গান গাওয়ার হল্লা। কতো দূর থেকে বন্ধুরা আসতো তার গান শুনতে। নিজের লেখা সুর করা একটার পর একটা চালিয়ে যেতো উদিতাংশু। ওরা তাকে উৎসাহও দিতো প্রচুর। বেশ কিছু স্টেজ প্রোগ্রামও করেছিলো সে। তেমনই এক শো শেষে নয়নার সাথে তার প্রথম পরিচয়! শীতের সন্ধ্যা ছিলো তখন। গাঢ় নীল জিনস্, হলুদ ফিতের স্যান্ডাল আর গ্রেটকোটের মতো ঢোলা কালো সোয়েটারের ভেতর উৎফুল্ল স্তনের অধিকারীণী- চোখে ঝিলিক দিয়ে তার দিকে প্রশ্নাত্বক আকাঙ্খা ছুঁড়ে বলেছিলো- আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন ?….

এদিকের রাস্তা ঘাট এখনো আটশট্টি হাজার গ্রামের মতোই। রিকসায় আসতে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে একত্র হবার দশা। তবু তাদের ভালো লাগছিলো। তার ভালো লাগছিলো। নায়না সূর্যের তেরছা রোদ্দুরের কেরামতি সহ্য না করতে পেরে হ্যান্ডব্যাগটা দিয়ে মাথা ঘাড় ঢেকে- চারপাশের এই এত্তো এত্তো সবুজ-সুষমা না দেখে শুনেই তৃপ্ত ছিলো। যেনো এতে তার কিছুই যায় আসে না। কেবল নলিয়া বাজার আসার পর বলছিলো -জল খাবো। সেই জল জোগাড় করতে গিয়েই তারা প্রথমে শুনলো ’সিন্নি গাছের’ কথা। ডাবওয়ালা নিখুঁত কোপে ডাবটাকে ফালি করতে গিয়ে বলছিলো

-লেওয়া স্যার সিন্নি গাছের ফলের মতোন মিষ্টি!

-কিসের মতো ?

-সিন্নি ফলের মতো। ঐ তো কোপ্তাডাঙ্গায় দেহেন গিয়া…

– কোথায় সেটা ?

– কেন্ আফনেরা জানেন না ? ঢাহা দিয়া আইছেন ?

– হ্যাঁ, কি সেখানে ?

– তাজ্জব এক গাছ আছে এই গ্রামের ঠোডায়। খেজুরের মতোন ফল দেয়, খাইতে দুধের তিন্নাও মিডা লাগে।

উদিতাংশুর মনে হয়েছিলো- এই সেই গাছ, এই সেই গাছ যার কথা সে বিভিন্ন সময় শুনেছে, পড়েছে। পারসীরা তাদের অগ্নীপূজার প্রারম্ভে যে রিকিতের উপাসনা করতো –এটি বুঝি তাদেরই মতোন কোনো দেবাংশী! কিন্তু তার ভাবনাটা- নায়না রোদ্দুরটাকে একটা বিচ্ছিরি গাল দিয়ে রিকসার দিকে এগিয়ে যেতে- আর বাড়তে পারলো না। আশ্চর্য! এমন মোলায়েম পরিবেশের মাঝেও মেজাজ খারাপ করতে পারে কেউ ?

জমপুর রেস্টহাউসটা আহামরি হবে না এ কথা তারা আগেই অনুমান করেছিলো। নামই যার যমপুর… এখানের নামগুলি যেনো কেমন- নলিয়া, কোপ্তাডাঙা, বরিষা, মোস্তফার চর, গুনটিয়া একটার সাথে অন্যটার মিল নেই। নামেরও নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। যেমন জমপুর বা যমপুর যেটাই হোক- তার কোনো ইতিহাস না থেকেই যায় না। ছোট্ট জনপদটির দোকানের সাইনবোর্ডগুলোতে দু ধরনের বানানই সে দেখছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হিন্দু দোকানগুলো লিখেছে ’য’ দিয়ে আর মুসলিম দোকানগুলোয় ’জ’ দিয়ে। যেমন, যমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, নিউ যমপুর লেডিস টেইলার্স, শ্রী মা হেয়ার ড্রেসার এন্ড সেলুন, নীচে ’যমপুর’ লেখা হয়েছে। আর তার ঠিক পাশাপাশি জমপুর ইসলামিয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। হয়তো ’জমজম’ শব্দটির সাথে স্থানের একটি সম্পর্কসূত্র দাঁড় করানোই এর লক্ষ্য। কিন্তু ব্যাপার যা-ই হোক না কেনো, বর্ডার এলাকা দিয়ে এখানে ইদানিং ব্যাপকহারে ফেন্সিডিল আসছে- এটাই এ অঞ্চলের এখন প্রধান অলোচনা। দ্বিতীয় বিষয়টা আর্সেনিক। কেউ কেউ বলছে ফেন্সির বোতলে ভারত থেকে নাকি আর্সেনিক পাচার করছে আবার কেউবা বলছে আর্সেনিক রোগটা বাড়ে ফেন্সিডিল খাবার কারণে। কিন্তু ভজনবালার আশি বছর বয়ষ্ক মোতাহারের মায়ের যখন বিনা কারণে হাত পায়ের তালু ফেটে যেতে লাগলো, তখন এলাকাবাসী আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। তাজ্জব ব্যাপার। প্রথমে জানা ছিলো উঠতি ছ্যামড়ারাই এসব খেয়ে ঝিম মেরে পড়ে থাকে আর দুধ চিনি কড়া চা খেতে শ্যামলের দোকানে ভীড় জমায়। অথচ এখন ?

রাতের বেলা খাবার শেষে আগ্রহটা নায়নাই দেখায় বেশি। উদিতাংশু তখন ভাবছিলো একটা নতুন কম্পোজিশন। আকাশ ভেঙে অত্যুজ্জ্বল আলোকরাশি পৃথিবী ভরিয়ে দেবে- এই মনোভাবাপন্ন একটি গান তার লেখার ইচ্ছে বহুদিনের। এমন গান, যা মানুষকে না প্রেম, না বিপ্লবী, না তত্ত্ব, শুধু গভীর ও উৎফুল্ল আবেশে তরঙ্গায়িত করবে- তাকে জীবন ও জিজ্ঞাসার মুখোমুখি না করে, উত্তরের আকাঙ্খী করবে। এমন গান, এমন গান কি সে লিখতে পারবে না কখনো ? তরুণদের মাঝে সে মোটামুটি পরিচিত একজন গীতিকার। কিন্তু সেই গান কেবলই তাকে অতৃপ্তির মাঝে নিয়ে যায়। সেই অত্যুজ্জ্বল আলোকরাশি- যা সূর্যের চেয়েও মেধাবী, সে কি পারবে না কখনো লিখতে ? …নায়না তার ভাবালুতার মাঝে জট পাকায়।

-কী ভাবছো ?

-উম্ ?

-চলো শুতে চলো।

উদিতাংশু আবছা অন্ধকারেও নায়নার চোখে রতিতপ্ত মানুষীর ঝিলিমিলি দেখতে পায়। সাত বছরতো কম সময় নয়, এতোদিনে সে এই দেহজ ভালোবাসার সবসূত্র জেনে ফেলেছে। চলমান চিত্রের মতো বলে দিতে পারে সে এরপর আস্তে আস্তে নায়না কীভাবে এগুবে। তার প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি পর্ব তার চেনা। উদিতাংশু সেই একান্ত উৎসবে হোমের আয়োজনে নিজেকে ব্রতী করতে, নিজেকে প্রস্তুত করতে মনে মনে প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু নায়না তার ধার দিয়েও যায় না। আজ যেনো সে অন্য নারী। অচেনা। কি যেনো চিবোচ্ছে সে। সম্ভবত মৌরী। এই এক অভ্যাস। যেখানেই যাক, ব্যাগে তার মুখশুদ্ধি কিছু না কিছু থাকবেই। এলাচ দানা, আদাকুচি, গুয়াশুপারি, খোর্মাকুচি, নিদেনপক্ষে দারুচিনি এক টুকরো ওর খাবার পরে চাই-ই চাই। তাকে মানায়ও বেশ। এমনিতে সাজে না। কিন্তু যত্নহীন যত্নের আলগা শ্রী সবসময় ওর গায়ে লেপ্টে থাকে যেনো। মনে হয় এই মেয়েটাকে জয় করি, ভাঙি। তার ভেতরের আমিত্বটুকু পান করে নিঃশেষিত করে দেই। এরই নাম বোধহয় ঘোর। যে ঘোরের কারণে মাত্র সাত দিনের পরিচয়ে, আর একদিনের নিরাপদ নিভৃতির সুযোগে চার চারবার যৌন অংশগ্রহণের পর উদিতাংশু সাবসিডিয়ারী পরীক্ষা না দিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বিয়ে করার। কিন্তু আজ তাদের জীবনে সবটাই যেনো এক ভুল বাসে উঠে পড়ার মতো ভুল। সেটা আদৌ ভুল কিনা- এটুকু; শুধু এটুকু জানার জন্যই উদিতাংশু জমপুর নিয়ে এসেছে নায়নাকে। ‘চলো না কাল আমরা কোপ্তাবাড়ি যাই আজব গাছটা দেখতে!’ নায়নার কথায় চমক ভাঙে তার।

‘তুমি কি কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পেলে ?’ পরদিন দুপুরে ভেজা চুল রৌদ্রে মেলে নায়না প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তার দিকে। বারান্দার টালীর নীচে এ্যাকোস্টিক গিটার নিয়ে উদিতাংশু তখন একটা সুরের নোটেশন দেখছিলো। কোপ্তাবাড়ি থেকে ফেরার পথে আচমকাই একটা সাঁকো পেরুতে পেরুতে তার মনে গুনগুনিয়ে উঠেছিলো লাইনটা। কিন্তু সেটা এখন ঠিক ঠিক দোলা দিচ্ছে না। তৃতীয় তারটিতে এসে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছে সে। নায়নার প্রশ্নটা তাই তার কাছে গুরুত্বহীন মনে হয়। সে কোনো জবাবের চাহিদাও বোধ করে না। মাথা ঝুঁকিয়ে সুরটা খুঁজতে থাকে। নায়না বোধহয় ক্ষেপে যায় এতে। তার নিচু গলা ক্রমে দ্রুতলয়ে বেজে ওঠে। ‘ছোটলোক, আমাকে এই গণ্ডগাঁয়ে নিয়ে এসে হানিমুন শেখাচ্ছে। ছোটলোক, মিনমিনে শয়তান আবার তানসেন হতে চায়’ …উদিতাংশুর সুর কেটে যায়! এই নচ্ছার মেয়েলোকটিকে তার একহাত দেখে নিতে ইচ্ছে করে। গান নিয়ে তাকে কেউ কিছু বললে সে মোটেই সহ্য করতে পারে না। নায়না তা জানে। জেনেই সে বলেছে। অন্ধ রাগে সে টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারে। নায়না উহ্ মাগো বলে পার পাবার আগেই সে এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে এক চড় কষায়…! অথচ একটু আগেই আজ দুপুরে তারা কোপ্তাবাড়ি গিয়ে সেই গাছটা দেখে এসেছিলো। ওদের যিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- সে খুব রোমান্টিক স্টাইলে বর্ণনা করছিলো গাছটির জন্ম ইতিহাস। তাই বলে নায়না অনায়াসে ছেড়ে দেবে না স্বামীকে। মুখ দিয়ে নয়- এবার সে অন্য পন্থা ধরলো। অস্ত্র হিসেবে সেটিও বেশ মোক্ষম। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে জানালো, এমন হবে জানলে সে তাকে বিয়েই করতো না। এরকম তাদের মাঝে মাঝেই হয়। ভালোবাসাবাসির সময় যেমন মাত্রাছাড়া তেমনি ঝগড়ার সময়ও কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না ওদের। এমনও হয়েছে শরীরের টানে তারা সাপের মত শঙ্খলেগে পড়েছিলো সারারাত সারাদিন একটানা একে অপরকে আঁচড়ে-কামড়ে লালা আর লালসায় খুবলে খেয়েছে। আর শরীরের সুখ যখন বিস্বাদ হয়ে গেছে শরীরে- তখন তুচ্ছ কারণে মেতে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ঝগড়ায়। কেউ কাউকে ছাড় দেয়নি। ছাড় পেতেও চায়নি কেউ। ঝগড়া করে জিততে চেয়েছে। অপরের সামান্য ব্যর্থতাও আড়াল থাকেনি তাদের। ফলে দুজনই হেরে গেছে দুজনের কাছে। উভয়েই দেখেছে নিজেদের চরম পরাজয় অন্যের কাছে।

অন্তত আড়াইশো বছরের পুরোনো এই গাছ। কবে কে লাগিয়েছিলো তার কোনো হদিস জানা যায় না। জনশ্র“তি আছে এক কামেল পীরের আগমন ঘটেছিলো জলাভূমি অধিভূক্ত এই অঞ্চলে। তার হাতের আশার লাঠিটি তিনি অনুসারীদের সামনেই মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন, আর, সে থেকেই সিন্নি গাছের উৎপত্তি। কিন্তু পীরসাহেবকে পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তিনি কোনো মাজার- যা পীরদের স্বভাবজাত- স্থাপন করেন নি। হিন্দুরা মনে করে কোনো সাধুপুরুষ নিজেই গাছ হয়ে গিয়েছিলেন ধ্যান করতে করতে। নায়না এসব নোট নেয়। তার একটি সখ আছে, মাঝে মাঝে পত্রিকায় ফিচার লিখে পাঠানো। সে গাছটির ছবি তুলতে গেলে যে লোকটি ওদের গাইডের মতো সঙ্গ দিচ্ছিলো, সে হা হা করে পড়ে।

-ছবি তুইলেন না কোলোম।

-কেনো ?

-ওডবে না।

-এ্যাঁ ?

– ছবি ওডবে না। এর আগে একফির এক সাইবে চেষ্টা হরছেলে ছবি তোলোনের। তিনদিন বাদে রক্তবমি হইয়া মরছে।

একদম বাজে কথা। নায়না দমে যায়। এই জন্য নয় যে, তাদের কথা সে বিশ্বাস করেছে কিন্তু এখানে এর প্রতিবাদ করা ঠিক হবে না সেটা সে বুঝতে পারছে। উদিতাংশু ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আলতো ইশারায় সেও নিষেধ করে নায়নাকে। কী লাভ এদের বিশ্বাসে আঘাত করে। ওরা গাছটিকে দেখে। বেশ বড়সড় একটা বটগাছের আকার নিয়ে গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। চিরিচিরি পাতা খুব ঘন হয়ে আছে। সেই পাতার ফাঁকে ফাকে লালচে ও ঘিয়ে রঙের খেজুরাকৃতি ফল ফলে আছে। অসংখ্য। গাছের কাণ্ডে যারা ইট বেঁধে দিয়ে মানত পূর্ণ করতে এসেছে তারা সযত্নে ফলগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে। মোটা কাণ্ডের গায়ে সিঁদুরও লাগানো কোথাও কোথাও। সব ধর্মের লোকেরাই এটাকে মানে। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই দেখতে আসে। কিন্তু গাছটার মধ্যে ভক্তি করার মতো কোনো গাম্ভীর্য উদিতাংশু খুঁজে পেলো না। এমনকি রিকিতের মীথটিও এখন তার মনে পড়ছে না। সে তাকিয়ে দেখলো গাছের ডালের ফাঁকে বেশ কিছু বাদুর ঝুলে আছে। উদ্ভিদজগতের কোনো বিরল বৈশিষ্ট্যই হবে হয়তো গাছটা। বাদুড়গুলো লাল চোখে নীচের মানুষগুলো দেখছে। একটাও নড়ছে না একটুও। স্থির হয়ে আছে। নায়নার ডাকে সে ফিরে তাকালো। ওরা দেখতে দেখতে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলো। নায়না একটা ফল তার দিকে এগিয়ে দিলো। সে নিজেও চিবুচ্ছে একটা। উদিতাংশু বিরক্তি ও নিঃস্পৃহভাবে কাঁচা ফলটাতে কামড় দিলো। আরে অদ্ভুত তো ! ঘন দুধের মতো স্বাদ আর মিষ্টি। ও একটু ধান্দায় পড়ে গেলো। এতোটা সে ভাবেনি। মনে করেছিলো কইস্টা হবে। নাহ্ এটা সত্যিই বিরল বৃক্ষ ! এরপর নায়নার উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে। সে স্থানীয় লোকজনকে গাছটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে বিভিন্ন কথা। সারা বছরই নাকি গাছটার ফল ধরে। একদিকে ফল পাকে, তো অন্যদিকে নতুন কুঁড়ি ফুটে ওঠে। কিন্তু আশ্চর্য, এই বীজ লাগালে নতুন গাছ হয় না। উদিতাংশুর এসব কিছুই ভালো লাগছে না। তার ভেতরের একটা বোধ কেবলই কেটে কেটে যাচ্ছে। এই নিশ্চুপ গাঁয়ে এসেও যদি সে এতোটা অস্থিরতায় ভোগে তাহলে…। মনে মনে সে নায়নাকে এ প্রসঙ্গে দোষী করে। এই মেয়েটা তার সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে, তাকে স্থির হতে দিচ্ছে না। বিস্বাদ আর অস্বস্তি নিয়ে সে বিরবির করে। পরক্ষণে বুঝতে পারে অজানা কিছু শব্দ সে মনে মনে আওড়াচ্ছে। শব্দগুলো এরপর সঙ্গীতের রূপ নেয়। সে বুঝতে পারে কী যেনো একটা ভাঙাগড়া শুরু হয়ে গেছে ভেতরে

মনে করো এই রোদ তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাত
ছেড়ে যাবে- ঝিম ধরা স্বপ্ন খুঁজেছি একসাথে-
জীবন পাবেনা দেখাÑ মন তাকে বলে অকষ্মাৎ
চাঁদের ছায়ার নীচে চোরাবালি ইশারায় ডাকে!

আকুল হয়ে কাঁদে নায়না। তার পিঠ ফুলে ফুলে ওঠে। উদিতাংশু বিমূঢ় তাকিয়ে থাকে। বারান্দায় অন্ধকার- জোৎস্না ভেঙে ঘন হয়ে আছে। রাত হয়ে গেছে অনেকটা গাঁও-গ্রামে, এই প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের বিনোদন এখন শুধুই ঘুম। দিনের বেলায় যে কথাগুলো তাকে নাড়াচ্ছিলো প্রবলভাবে এখন মনে হয় যেনো ইচ্ছে করলেই তাকে সুর দিতে পারে সে। নায়নার কান্নার সুরের সাথে কোথায় যেনো একটা মিল আছে সেই সুরের। তার মাথার ভেতর কল্পনার সেই আলোকমালা ঝর্না হয়ে ঝরে! শহর ছেড়ে এই যে তারা এতোদূর চলে এসেছে, তার উদ্দেশ্যটি এখন ভিন্ন মাত্রায় মনে টোকা দিয়ে যায়। নায়নার এই কান্না শুধু তাদের- তার- ভিন্ন জীবন যাপনের সমঝোতা স্মারকের কারণেই নয়- মনে হয় যেনো আর কোনো গূঢ় অর্থ বহনকারী।

– তুমি আর চাওনা আমাকে? নায়না জলভরা চোখ- হয়তো লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে- অন্ধকারে ভাবে উদিতাংশু। তার দিকে মুখ ফিরিয়ে কমনীয় কণ্ঠস্বরে শান্ততায় জিজ্ঞেস করে।

– নাহ। এভাবে দুটো জীবন অযথা জোর করে জোড়া বেধে দুজনই কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে নেই আর।

– কাল ভোরে যাচ্ছি আমরা ? ততোধিক শান্ত স্বরে সিদ্ধান্ত শুনতে চায় নায়না।

– হ্যাঁ।

– আজ কি শোবে একসাথে ?

– হ্যাঁ, কেনো নয়?

কিন্তু শুতে গিয়ে সে টের পায় নায়না গভীর ঘুমে নিহত চড়ুইয়ের মতো মৃদু শ্বাস টানছে ঘুমের ভেতর। ’জীবন পাবেনা দেখা- মন তাকে বলে অকস্মাৎ!’ নায়না কী করে এতো নিঃস্পৃহ থাকে- আশ্চর্য- এতোসব কিছুর পরও? আজ কী তাদের শেষ দিন নয়? শেষ রাত নয় তাদের ? সারাদিন উদিতাংশু ভেবেছে সম্পর্কটির স্থায়ীত্ব নিয়ে। নয়নার মনের মতো হয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হবে না কখনো। নয়নাও সেই স্বপ্ন-কল্পনা থেকে বিচ্যুত হতে পারবে না, যা সে ছোটোবেলা থেকে মনে মনে ভেবে এসেছে হয়তো- ভাবে উদিতাংশু। এখন এই শরীর-মনে দূরের হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে হয়তো ম্যাজিক দেখিয়ে, কিংবা পুরুষের মোহময় আচ্ছন্নতা দিয়ে কিছুদিন বশ করে রাখা সম্ভব- কিন্তু তা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। নায়নার প্রতি যে চোরা আবেগ ও কর্তব্যবোধ ছিলো তার, সেটাকে জোর করে বিদায় করতে হবে হয়তো; কিন্তু তাও ভালো। প্রতিদিন এই অহেতুক ঝগড়া-যন্ত্রণার চেয়ে- মনকে প্রবোধ দেয় সে- দূরে চলে যাওয়া ভালো। ’চাঁদের ছায়ার নীচে চোরাবালি ইশারায় ডাকে’। ভাবতে ভাবতে উদিতাংশু ঘুমের চোরাবালিতে ডুবে যায়।

খুব করে সেজেছে আজ আলোহার মা। মানে নায়না। বিয়ের পর পর যখন রোমান্স তাদের শরীর-মনে রোমাঞ্চের বন্যা ডেকে আনছে। ভেবেছিলো মেয়ে হলো ’আলোহা’ ডাকবে তাকে। কেনো এই নাম ? খুব একটা ভাবেনি তা নিয়ে। কোথাও হয়তো শুনে থাকবে। পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। কখনো সখনো নায়নাকে দুষ্টুমী করে খেপানো যেতো ’আলোহার মা’ বলে। আজ সাত বছর পরে- যখন তারা ভিন্ন জীবন নিয়ে ভাবছে তখন- এই নামের কী-ইবা তাৎপর্য আছে এমন ? কেয়ারটেকার খুব যত্ন নিয়ে ওদের সবকিছু রেডি করে দেয়। নিজের হাতে ব্রেকফাস্টে গরম পরোটা ভেজে দিয়েছিলো ভোরে উঠে। রিকসায় যেতে হবে অনেকটা পথ। গতরাতে একজনকে আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। ভোরবেলা ঠিক ঠিক সে হাজির হয়েছে রিকসা নিয়ে। এখন রোদ চড়ার আগে আগেই বেরুতে পারলে বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই ফিরতে পারবে তারা। তারপর, কোথায় যাবে ওরা ? পুনরায় সেই একই ঠিকানায় ? একই বিছানায় ? অসম্ভব। তাহলে আর কষ্ট করে এতোদূরে আসা কেনো ? তাঁতের একটা পারমুটিট ডিজাইনের শাড়ি- শাড়ি খুব একটা পড়ে না নয়না- প্লিট করে পড়েছে সে। চুল ছেড়ে দেয়ায় সেই ইউনিভার্সিটি হল বলেই মনে হচ্ছে এখন। বয়স বাড়েনি নয়নার। কেবল চাকরি তাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে- এর বেশি কিছু নয়। ‘চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে’ বলে খুব সাধারণ ডাকে নয়না বারান্দায় নামে। কী যেনো বলতে গিয়েও বলা হয়না উদিতাংশুর। সেটা কি, নয়নাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে- শুধু এই উক্তিটুকু? সে মনে মনে গুনগুন করে- ‘মনে করো এই রোদ- তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাত।’ নাহ্ সুরটা ঠিক ঠিক এসে দোল দিচ্ছে না, ছাড়া ছাড়া মনে হচ্ছে। কোথায় যেনো কেটে যাচ্ছে খেই। কথার সাথে প্রবাহিত না হলে সুরের মুক্তি আসেনা বলে তার ধারণা।

নয়না উঠে গেছে রিকসায়। কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটা পরিপাটি হয়ে কোলের উপর রেখেছে। মনে হচ্ছে বাচ্চা কোলে নিয়েছে! গীটারটা নিয়ে বারান্দা ছেড়ে সামনের হেরিংবোন ছড়ানো ইটের উপরে নামলো। খবরটা আসে তখন। রেস্ট হাউসের দাড়োয়ান জানালো ওদের। প্রথমে নয়নাকে। উদিতাংশু শোনে- সিন্নি গাছের নাকি একটা চারা পাওয়া গেছে আধমাইল দূরের এক গ্রামে। গ্রামবাসীরা অবাক বিস্ময়ের ভেতরে হু হু করে ছুটছে সেদিকে। এ একরকম অকল্পনীয় ব্যাপার। কেউ ভাবেনি বুড়োকালে গাছটার এমন ভীমরতি ধরবে। নয়না শোনে, নিঃস্পৃহভাবে। উদিতাংশু নাক গলায় ওদের কথায়- ‘যাবে নাকি দেখতে ? গেলে হয় একবার- আর কী আসা হবে এখানে এভাবে ?’ নয়না সায় দেয়না। ফিরতে চায় এখান থেকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব; পৃথক হয়ে চায় সে। উদিতাংশু অগত্যা রিকসায় উঠে বসে। রিকসা বড় রাস্তায় উঠে এলে দেখা যায়- লোকজন অস্থিরভাবে লাইন ধরে ছুটছে রোদের উচ্ছাসের ভেতর। ‘মনে করো এই রোদ…’ উদিতাংশু গুনগুন করে। ‘কেমন হবে কম্পোজিশনটা বলো দেখি ?’ অনেকদিন পর এই প্রথম সে নায়নার মতামত নেয় সঙ্গীত বিষয়ে। একদিন সে তো তার গানের পাগল ছিলো। নায়না ফিক করে হাসে।

– নতুন লিখলে ?

– হ্যাঁ।

– সুন্দর হয়েছে। খুব।

তারপর আর কিছু নয়। চুপচাপ কেবল নারকোল পাতার ঝিরঝির শব্দ শোনা। অনেকক্ষণ। যেনো সাত বছর কেটে গেলো এরই মধ্যে। সাত বছর ?

– কী অদ্ভুত তাই না ? …এতো বছর পর গাছটা… উদিতাংশু ছাড়া ছাড়া ভাবে বলে।

– নাহ্ , এটাতো অস্বাভাবিক নয়। হতেই পারে।

– হতেই পারে ?

– কেনো নয় ?

– ও। বলে উদিতাংশু ঠোঁট কামড়ায়। -তাই বুঝি দেখতে যেতে চাইলে না ?

– সে জন্য নয়। কী হবে শুধু একটা চারাগাছ দেখে ?

– তা অবশ্য। তবুও ভাবো। -এতোবছর পর…

– আর তাছাড়া… নায়নার কথা শেষ হয়নি। কথায় বাধা পড়ে উদিতাংশুরও। সে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে-

– তাছাড়া কী ?

– ওকে নিয়ে আমি যেতে চাইনা অতদূর।

– ক্কী ?

– ওর কথা বলছি। আলোহা! এসে গেছে ! বলে কোলের ব্যাগটা সামলে অবিচল আস্থা নিয়ে সামনের সবুজের দিকে তাকিয়ে বলে নয়না। তারপর যোগ করে হতচকিত উদিতাংশুর দিকে না তাকিয়েই:

– আমরা কিন্তু আর একসাথে থাকছি না। গতরাতে সিদ্ধান্তের কথা মনে আছে তো তোমার ?

উদিতাংশু ঝিম ধরা মাথার মধ্যে সেই নোটেশনটা এবার স্পষ্ট টের পায়। সুরটা ঠিক ঠিক মিলছে এবার! দ্রুতলয়ে বাজছে ক্রমাগত- ‘মনে করো এই রোদ- মনে করো…!’

রচনাকাল: ২৭/০৩/২০০৪