“বি আই আর ডি বার্ড পাখি!’
ঝিঁঝিপোকা ধরার কিছু টেকনিক আছে! চিকন লম্বা বাঁশের কঞ্চির মাথায় নারকেল পাতার শলা কেটে হাত দেড়েক লম্বা ডাঁট অনেকখানি ঢুকিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতাম আমরা। এবার এই শলার মাথায় লাগাতে হবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ আঁঠা- কাউফ্লার কষ! এলাকায় ২/৩ টা নামকরা গাছ ছিলো, সেই গাছের গায়ে কোপ দিলে কিছুক্ষণের ভেতর দুধের মতো আঠালো কষ বের হয়। কিন্তু শুকিয়ে গিয়ে কয়েকঘন্টা পর তা স্বচ্ছ আঠায় পরিনত হয়। এই আঠা ঘুড়ি বানাতে, বইয়ে মলাট দিতে কিংবা ফড়িং ধরতে আমরা ব্যবহার করতাম।
ঝিঁঝি কোথায় ডাকে, কখন তাকে বাগে পাওয়া যাবে, তাকে পাকড়াও করতে কিভাবে চুপিচুপি কাছে যেতে হবে, এইসব জানা থাকলে জঙ্গলের ভেতর ডাক শুনে ঝিঁঝি খুঁজে বের করে দূর থেকে বাঁশের মাথায় লাগানো শলাকা নিপুনভাবে ঝিঁঝির গায়ে ঠেসে ধরতে পারলেই বেচারা আর যায় কোথায়! পাখায় জড়িয়ে যাওয়া আঠা নিয়ে ঝিঁঝিপোকা ট্যাঁ ট্যাঁ করতে থাকে। তাকে নিয়ে তখন ব্যপক গবেষণা করার সুযোগ মেলে! পুরুষপোকাগুলোই কেবল ডাকে, মেয়েগুলো বোবা, ইত্যাদি। সে সবই আমার গোপালদার কাছ থেকে শেখা। সৈয়দ মুজতবা আলীর বই থেকে উঠে আসা গোপালদা আমাদের অনেক বড় হলেও, যাবতীয় গর্হিত কর্মকান্ডের হাতেখড়ি ওর হাতেই। গুরুমশাইয়ের নিষ্ঠা ও মনীষায় সে আমাদের শিখিয়েছে কী করে চুপিচুপি বিড়ালের মতো নিঃশব্দে জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হয়, কুকুরের লেজে লক্ষ্মীপূজার রাতে তারাবাতি বেঁধে দিলে যে ধুন্ধুমার কাণ্ডটি ঘটে, গোপালদা ছিলো তাতে সিদ্ধহস্ত! অশ্লীলশব্দের এক বিশাল শব্দভান্ডার ছিলো ওর, আমার জানার পরিধি বিস্তার করায় ওর ভূমিকা ব্যাপক! বেড়ালকে কি করে আদর করে চোখ চেপে ধরে (যেন বেড়াল টের না পায়) কোলে করে নিয়ে গিয়ে মাঝপুকুরে ছুড়ে ফেলতে হবে, আর ছুড়ে ফেলার পর বেড়াল যে কী হুলুস্থুলভাবে সাঁতরে ডাঙায় ওঠে – এটা ছিলো আমাদের আনন্দের এক বিপুল খোড়াক। জীবনের প্রথম সিগারেট খাই কাশীপুর ইছাকাঠি গার্ডেনের পেছনের বাগানে ঘুরতে গিয়ে। গোপালদার সাথে সাইকেলে গেছি,একা ফিরতেও পারবো না। জোর করে ক্যাপেস্টান সিগারেটে টান দিতে হলো। সম্ভবত আমি তখন ফোরে পড়ি। বহুদিন লেগেছে ওই অপরাধবোধ কাটাতে। অনেক আপাত নোংরা বিষয় গোপালদার কাছে জানার সুযোগ ছিলো। একটু বড় হবার পর নারীপুরুষের জটিল বিষয়গুলো ওর ব্যাখ্যায় পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
পড়াশোনায় বেজায় খারাপ হলেও বিভিন্ন দক্ষতা তার সেই ঘাটতি পুরণ করে দিয়েছিলো। ‘বি আই আর ডি র্বাড, পাখি’ বলে গুলতি ছুঁড়ে সে আজব নিশানায় ভেঙে ফেলতে পারতো শালিখের ডানা! লাইটপোস্টের লাইট ইট মেরে ভাঙার বাজীতে তাকে কে হারায়? গাছের গায়ে লেপ্টে থেকে সড়াৎ করে গা ঢাকা দিতে পারতো, সাঁইসাই করে মগডালে উঠে সবার আগে বাকাট্টা ঘুড়ি ধরে ফেলায় তার জুড়ি কে ছিলো? এলাকায় কারো কোন অনিষ্ঠ হলে সবার সন্দেহ আগে গিয়ে পড়তো গোপালের ওপর। কার বাড়ির ডাব, কার গাছের খেজুরের রস, কার গাছের পাকা বড়ই কিংবা কার পোষা হাঁসের পা ইট মেরে কে ভাঙলো তো গোপালই ঘটিয়েছে এসব! ইংরেজি নটোরিয়াস বিশেষণটির এমন জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আর কোথায় মেলে? ছোটদের মহলে সে ছিলো এক মহাত্রাস। তাদের খেলার ভেতরে একটা ঘাপলা না বাঁধালে ওর শান্তি নেই। ভূক্তভোগীরা শাপশাপান্ত করতো, গোপাল কবে যে দূর হবে?…একদিন ভোরবেলা উঠে শুনি গোপালদারা সবাই ইন্ডিয়া চলে গেছে! ওদের বাসাবাড়ী সব বিক্রি করে দিয়েছে! গোপাল নাকি যেতে চায়নি। অনেক কান্নাকাটি করেছিলো, থাকতে চেয়েছিলো এই দেশে। তবু তাকে জোড় করে নিয়ে যাওয়া হয়। কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে গোপালরা হাওয়া হয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে বি আই আর ডি বার্ড পাখির এলোমেলো কিছু পালক!
আমার ছোটবেলা
সেল্ফ প্রপাগান্ডা বা ধান ভানতে শীবের গীত
…তারপর আমরা এসএসসি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলে সবার টনক নড়ে, যে শুধুমাত্র খেলাধুলা বা দুষ্টুমি নয়, মাঝেমধ্যে পড়ালেখাও আমরা করতাম! স্যাররা, এলাকাবাসী আর পরিবারের অন্যান্যদের মুখ রক্ষা করে আমরা, অর্থাৎ আমি ও আমার বন্ধুরা সবাই তাড়াহুড়া করে “বড়” হয়ে কলেজে উঠে যাই! আমাদের সাথে সাথে বন্ধুদের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া টাইটেলগুলোও বড় হতে থাকে
যাক সে কথা, আমি (সানগ্লাস পরিহিত ব্যক্তিটি) ক্লাস থ্রি থেকে টেন পর্যন্ত বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন বিদ্যালয়, মানে বিএম স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তার আগে যতদূর জানা যায়, আমি নাকি “সিস্টারস্ ডে” নামে আর একটি প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়েও বছরখানেক পড়ালেখা করেছিলাম! কিন্তু ইন বিটুইন কী করিয়া আমি তিনক্লাশে পদার্পন করি, তাহার ইতিহাস কোন মহাফেজখানায় লিপিবদ্ধ থাকলেও থাকতে পারে!
তো তারপর কীর্তনখোলার বহু চর ভাঙাগড়ার পর ঢাকা নামক একটি স্থানের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হইতে এমএ পাশ করি। বিষয় ছিলো বাঙলা সাহিত্য! তা খানকতক পুস্তক প্রকাশ না করিলে নিজের আকাদেমির প্রতি সুবিচার হয়না বিধায় আমাকেও ওই পথ অল্পবিস্তর মাড়াইতে হইয়াছে। গানবাজনা, আঁকাআঁকি, সাংবাদিকতা, অপরাপর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, ইত্যাদির কোনটাই পেশা হিসেবে মনে না ধরায় আমি এখন একটি আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্যদাতা সংস্থায় করে খাচ্ছি। কর্মসূত্রে দেশের ৬২টি জেলাতেই যেতে হয়েছে । গভীর-গভীরতরভাবে (এক্সটেনসিভলি) কাজ করার সুযোগ হয়েছে ঢাকার বস্তীতে , তিন পার্বত্য জেলায় , সুন্দরবনে , বরেন্দ্র এলাকায় , মেঘনার চরাঞ্চলে ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে । বরিশাল শহরের পিতৃপ্রদত্ত ভাঙাচোড়া বাড়িটি টিকে থাকলেও বর্তমানে কর্মসূত্রে ঢাকাকেই করিয়াছি জিবনেরই ধ্রুবতারা। নির্দিষ্ট কোন শখ নেই। ঘুড়ে বেড়াতে পছন্দ করি, আবার ঘরকুনো হয়ে থাকতেও বেশ লাগে!
…এর বেশি জানতে হলে আপনাকে যোগাযোগের পাতায় যেতে হবে 🙂