সুরুজ মিয়া ভাবতেই পারেনি, উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট সাত সকালে এসে তার বাড়িতে হাজির হবে। বাড়ি না বলে এটাকে অবশ্য ডেঁরা বলাই সমীচীন। ভেঙে পড়োপড়ো একটা এক কামরার চালাবেড়ার আস্তানা! তাহার নিচে ডাঁই করে রাখা তার মহামূল্যবান সম্পদ। এর ভেতরে কোনক্রমে সে মাথা গুঁজিয়া ঘুমায় আরকি। সাইরেন বাজাইয়া, দলবল নিয়া, এলাকা তটস্থ করিয়া নয়- প্রেসিডেন্ট সাহেব এসেছেন রিকশাভ্যানে পা দুলিয়ে হালকা শিস্ দিতে দিতে- কালচারাল এ্যাটাশেকে বগলদাবা করে!
এ কেমন আসারে বাবা? এভাবে কোনো প্রেসিডেন্ট আসে নাকি- ছাতা হাতে ছাপোষা উটকো প্রতিবেশীর মতো? কিন্তু কথা এ-ও ঠিক, সুরুজ মিয়াকে বুঝতে হলে- বলা ভালো, ‘সুরুজ মিয়া’ বিষয়টাকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে এভাবেই আসা দরকার। বিচক্ষণ প্রেসিডেন্ট সাহেব তাই করেছেন! না এসে উপায়ইবা কী? পাথর পোষে এমন লোক দুনিয়াতে আছেইবা কটা? তাও যদি একটা দুটো হতো, না হয় মানা যেতো। গুনে গুনে একুশ হাজার দুইশত উনচল্লিশটা পাথরের খামার! খামার বলার কারণ আছে, সুরুজমিয়ার পাথরগুলো সব জীবন্ত। তাদের তদারকিতেই দিন যায় তার। বাইরের লোক ভাববে, কী আর এমন তদারকী? পাথরইতো? খানাখাদ্য, হাগামোতার ব্যাপার তো নাই। থম্ ধরে এক যায়গায় পড়ে থাকা! সুরুজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করো, রাজ্যের কাজের ফিরিস্তি দেবে। পাথরকে নাকি নিয়মিত রোদ খাওয়াতে হয়। অসুখ বিসুখে মাথায় জলপট্টি পর্যন্ত! তা মাথার ইসক্রুপ ঢিলা থাকলে কতো কিছুইনা মানুষ করতে পারে! সেসব কাজের লিস্টি শোনার সময় দধিমঙ্গল গ্রামের লোকদের আছে নাকি? এখন পেঁয়াজ বোনার সময়। শীর্ণকায় পেঁয়াজের অপুষ্ট চারাগুলো মিহিধুল মাটিতে বিঘতখানেক কেবল পুঁতে দিলেই হবে না। তাদের রোদ খাওয়াও রে, ছায়া দাও রে, সেচ দাও রে, আগাছা মারো রে! যেনো ল্যাদাবাচ্চার ঘনঘন কাঁথা পাল্টানোর অবস্থা! মুনিশজন ক্ষেতের সেইসব তত্ত্বতালাফি করতে করতেই সুরুজ মিয়ার খবরাখবর নিজেদের মধ্যে চালাচালি করে। খবরাখবর আর কী, প্যাঁচালের চৌদ্দ আনাই গিবত।
– চুদির বেটার রোয়াবি দেখিছিস? পাথর পুষে কেমন দুনিয়া লয় করে ফেললো গো!
– অক লিয়ে আরও কতো কেচ্ছা হয় দেখে লিস খবিরুল! তোক্ বুইলে দিলাম, ওই পাথরই ওর মহা সব্বোনাশটা করবে!
লোকটা কোনো কাজকর্ম করে না, পাথর ঘষে জীবন পার করে দিলো, খায় দায় মহা ফূর্তিতে আছে, এসব সহ্য করার দায় আছে কারও? কিন্তু সুরুজমিয়াকে আজ পর্যন্ত কেউ কিছু খেতে দেখেনি। চুলো জ্বালার তো প্রশ্নই আসে না। চুলো থাকলে তো জ্বলবে। কারো কারো বিশ্বাস, এই পাথরগুলোর ভেতরে জান আছে। তারা নাকি মিহিসুরে কথা কয়। ভাঙা চালাবেড়ার আড়ে পাতন দিয়ে কেউ কেউ শুনেছে, সুরুজ মিয়া রাতবিরাতে পাথরের সাথে আলিঝালি কথা কয়। তাদেরকে ধমকায়, আদর সোহাগ করে। এসব কিসের আলামত? জ্বিনের নয়তো? আর সেটা ভালো না মন্দ, গ্রামবাসী সেটা ঠিক ঠিক গুছ করতে পারে না। শুরুর দিকে এসব সুরুজের পাগলামীই মনে করে গায়ে পড়ে তার অনিষ্ট করতে গেছিলো, কিন্তু ফল পেয়েছে উল্টো। সুরুজ মিয়ার পাথরে হাত দিয়েছ কি, তোমার কিছু একটা ক্ষতি হবেই। সুইধন বেওয়ার নাতি, যেটা বইছামা হাইস্কুলে আট ক্লাশে পড়তো, সাইকেলে ব্রেকফেল করে ডোবায় পড়ে কী মারাত্মক দুর্ঘটনাই না ঘটালো। তার আগের দিন সে চুরি করেছিলো সুরুজ মিয়ার সবচে প্রিয় পাথর কালাচানকে। পাথরের আবার নাম হয়? আরে বাবা, তোমাদের ওসব নামটাম না হলেও চলে। কিন্তু পাথর যে পোষে, তার কাছে নাম একটা ফ্যাক্টর। কেনো বাপু, তোমরা তো শুনেছি সাইক্লোনেরও নাম দাও। তা সুরুজ মিয়া পাথরে নাম দিলে অসুবিধা কী?
নাতির ওই মরোমরো অবস্থা দেখে সুইধন বেওয়া নিজে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফেরত দিয়ে আসে কালাচানকে। তাকে ফিরে পেয়ে পোষা বেড়ালের মতো কোলে তুলে আদর করতে করতে মিহিস্বরে সুরুজ মিয়া পাথরটাকে শান্তনার সুরে বলে, ভাইঙে দ্যায়েছিছ? মামুর বেটাক একদম খায়ে দিবার পারলু না? এই কথা রাষ্ট্র হবার পর, তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে এমন সাহসী লোক দধিমঙ্গল গ্রামে কটা আছে? অবশ্য একজন আছে, যার সাহসের তুলনা সে নিজে। মীরের হাটের পাতা বিশ্বাস।
তুলারাশির জাতক বলে পাতাখেলার বাজিতে তাকে চাইই চাই। মেসবাউল নামটা তার চাপা পড়ে গেছে পাতা খেলার মূল কারিগরির তলায়। ধান ভুট্টা উঠে যাবার পর লোকজনের বিনুদন ধরো কিছুটা নারীসঙ্গমে আর চায়ের দোকানে পলিটিক্সের আলাপসালাপ মারাতে খরচা হয়। সেটাতো গেলো শরীরের উপর দিয়ে। কিন্তু পকেটে যে বাড়তি টাকা এসেছে, দাদন শোধ করার পরেও বাকিটার সদ্গতি করতে পাতা খেলার আয়োজন করা ছাড়া উপায় কী? খেলা আয়োজনের পারমিশন নিতে হয় উপজেলা পরিষদ থেকে; লিখিত। শাল্টিবাজারের পাশের বিশাল পাগাড়ে লোকজন গায়ে গা ঘেঁষে জড়ো হয়। দূরদূরান্ত থেকে দল ভাড়া করে নিয়ে আসে লোকে। পাতার বাজি জেতার উত্তেজনায় রক্ত টগবগ করে সবার। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে পাতাকে আবিষ্ট করে নিজেদের কোর্টে টানতে পারলেই সেই দল জিতবে। মন্ত্রতন্ত্রের তুকতাক আর কেরিকেচার সাধ্যমত সব দলই করে, কিন্তু পাতা বিশ্বাসকে বশ করা কি এতোই সোজা? একসাথে যে তিন নারীতে উপগত হতে পারে, তাকে ঠান্ডা করার ফিকির কজনইবা জানে? মীরের হাটের নিষিদ্ধ পাড়ার মেয়ে বসিলা, মীনুরানী আর নবিতুন সাক্ষ্য দেয়, পাতা বিশ্বাস আসলেই একটা চিজ! চিকনা মানুষটার গায়ে মোষের শক্তি কিভাবে আসে, যে তিন তিনটা যুবতী মেয়েমানুষকে বিছানায় কব্জা করে ফেলে? কেউ কেউ বলে পাতা বিশ্বাস পাহাড়ি লতাপাতা খেয়ে এহেন যৌনশক্তি সংগ্রহ করেছে। তবে অধিকাংশর ভিন্নমত হলো সুুরুজমিয়ার পাথরের সাথে এর কোনো সংযোগ থেকে থাকতে পারে। বলাটা অমুলক নয়। সুরুজের সাথে একমাত্র পাতারই সামাজিক সম্পর্ক আছে। সাহস করে সে-ই রাত বিরাতে সুরুজের ডেঁড়ায় হানা দেয়। বলে ছাচা, আইজ মীরের হাটের বাজারেত কী হএচে শুইনচেইন? ইয়াব্বড় এক বাঘাইড় মাছ উইটলো, তো কাস্টমার নাই। শেষে হামি ওইঠা কিনা নিলাম হাপনার পাথরের জৈন্ন! এরপর সারারাত তারা চাচাভাতিজা কী করে, কেউ জানে না। তবে সুরুজ মিয়ার ডেঁরা থেকে দুপুররাতে বাঘাড় মাছের সম্ভার দেয়ার সুঘ্রাণে দধিমঙ্গলের বাতাস মইমই করে!
প্রেসিডেন্টের লটবহর এসে পৌঁছালো ঘন্টা খানেক পরে। পোড়ামাটি রঙের লিমুজিনে। মোট আটজন, চারজন সাদা পোশাক আর চারজন কালোয় মোড়া। সাদাদের চারজনের একজন দোভাষী বেশ কায়দা করে স্থানীয়ভাষা প্রেসিডেন্টের জন্য তর্জমা করছেন। তার সোনালী চুল মেয়েদের মতো ঝুঁটি করে পেছনে বাঁধা। প্যাকাটির মতো, শুকনো পাছা দেখলে বোঝা যায় দিনের খুব কম সময়ই ওটা কেদারার স্পর্শ পায়। বকের মতো তুলে তুলে কদম ফেলে সে সবার আগে ঘরে ঢুকলো। রক কাল্টিভেটর সুরুজ মিয়ার ইন্টারভিউ শুরু হলো তারপর। কথা যা বলার দোভাষীই বলছেন। প্রেসিডেন্ট কেবল মিটিমিটি হাসছেন, সম্মতির হাসি। ডিভিক্যামের সামনে অপ্রস্তুত সুরুজ মিয়াকে জেঁকে ধরলো ওরা।
– আপুনি কেমুন কড়িয়া পাতর পালন শিক্কা করিলেন, আমাদিগকে বলুন!
তারপর নিজেই সেটা স্বভাষায় মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অনুবাদ করলেন: Comment as-tu appris à conserver les pierres, raconte-nous! সুরুজ মিয়া যে কী বলে, সেটা সুরুজের নিজের কানেই ঠিকঠাক পৌঁছায় না। পুরো দধিমঙ্গল আজ ভেঙে পড়েছে তার ঘরে। প্রেসিডেন্টের অভিলাষে পুলিশ প্রহরা শিথিল থাকায় কাউকেই ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিরবির করে সুরুজ যা বলে সেটাই বহুগুণ তর্জমা হয়ে ফিরে যায় প্রেসিডেন্টের কাছে। সুরুজ দেখলো, প্রেসিডেন্ট সাহেব তার অতিপ্রিয় সোনাভানকে আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। সে এগিয়ে গেলো। পিছে পিছে দোভাষী। সুরুজমিয়া কুণ্ঠিত হয়ে বল্লে, এই আমার সোনাভান, ও পাঁচমাসের পোয়াতী! শুনিয়া দোভাষীর চোয়াল ঝুলিয়া পড়িলো।
– পাথর পোয়াতী হয়?
– হয়না আবার? কদিন আগে ও ভেগে গিয়েছিলো বসন্ত রক্ষিতের সাথে! দিন দশেক কাটিয়ে এই হাল নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।
– আর বসন্ত রক্ষিত, তাহার কী হইলো?
– ওকে আমি মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলেছি!
– হাসিহাসি মুখ করে প্রেসিডেন্ট তর্জমা শুনলেন। তারপর উচ্ছসিত হয়ে বললেন, J’ai atteint le niveau de fou? এ হামি কোন্ প্রকারের পাগলের পাল্লায় আসিয়া পড়িলাম?
– উপস্থিত দর্শকমন্ডলীর তাহা বোঝার কথা নহে। তাহারা ততোধিক উচ্ছসিত হইলো। রা রা রবে বাতাস প্রকম্পিত করিয়া তারা শুনিয়া যাইতে লাগিলো, সুরুজমিয়া বলিতেছে,
– মানুষ মরিয়া গেলে কেহ হয় ধূলা; কেহ যায় মাটি হয়ে, কেউ হয় শিলা!
– খাঁটি কথা বলিয়াছেন মসিঁউ সুরাজ, অতি খাঁটি কথা!
ওদিকে সুরুজমিয়ার দেহতত্ত্ব বর্ণনা চলছেই: পাথরেরও জান আছে। তারা ভালোমন্দ সৎঅসৎ বোঝে! ওদের হামি সন্তানের মতো পালন করিনু। এই দুনিয়ায় মায়া কাটানো মানুষের জন্য অতি মুশকিল। যারা সেই মায়ায় আটকায় তাদের দিল পাথর হয়ে পড়ে থাকে!
এ কথা শোনার পর প্রেসিডেন্ট সাহেব শোকে মূহ্যমান হয়ে জানতে চাইলেন, তার আটানব্বই বয়সী মায়া কাটানো দাদীআম্মার আত্মা পাথর হয়েছে কিনা। সুরুজ মিয়া তখন নজর তিরচি করে চোখ উল্টে কিছুক্ষণ ভাবলেন। হ্যাঁ, উরুগুয়ের কিছু আত্মার পাথর তার নিকট আছে বটে, তবে খুঁজতে হবে। এই বলে সে তার পাথরের গাদায় হাত ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ বাছাবাছি করার পর ঈষৎ কালচে রঙের চ্যাপ্টা একখানি পাথর টানিয়া আনিয়া প্রেসিডেন্ট সাহেবের সামনে উপস্থিত করিলো। তা দেখিয়া তিনি শোকাকুল হইলেন। আরে, এটা তো সত্যিই দেখিতে তাঁর দাদীআম্মার মতোন! পারিষদবৃন্দও এ কথায় একমত হইলেন, হুবহু দাদীআম্মা! Exactement grand-mère ! বিশেষত গায়ের রঙটা। শুনিয়া প্রেসিডেন্ট কুওইল দিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তার দেখাদেখি পারিষদবৃন্দও যার যার অশ্রু মোচন করিলেন। তাহাদের কান্না হেঁসকি সহযোগে এতোই প্রবল পরাক্রমে চলিতেছিলো, যাহা দেখিলে ইবনে মিজান সাহেব পর্যন্ত বলিতেন, নাটক বেশী হয়ে যাচ্ছে লেদু, কাট্ কর্! অবশেষে সেই প্রস্তরীভূত দাদীআম্মার আত্মাকে বগলদাবা করিয়া প্রেসিডেন্ট সাহেব সত্তর দধিমঙ্গল ত্যাগ করিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রিবিউন আর পোঁ-দেঁ এক্সপ্রেসে এই সংবাদ বেশ ফলাও করিয়া সুরুজ মিয়ার ছবিসহ ছাপা হইলো: Des imbéciles dans la maison des imbéciles!
তার কিছুদিন বাদে পাতা বিশ্বাস নিখোঁজ হইলো। কেহ বলে সে দূরদেশে যাইয়া আর একটি নিকাহ্ করিয়াছে, কিন্তু গ্রামবাসীর অনেকেরই সেটা বিশ্বাস হয় না। বিশেষত বসিলা, মীনুরাণী আর নবীতুনের কাছে এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল সুরুজ মিয়া মাঝরাতে চিৎকার করে শাসায়, আহ্ পাতা, জ্বালাতন করিছ না তো, এ্যানা রাত্তিরে তোর জৈন্ন হামি বাঘাইড় মাছ পাবো কোটে?
তার পাথরশালায় সম্প্রতি সবুজ রঙের নতুন একটা পাথর যুক্ত হয়েছে!