গোলট্যাক্সি

বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটি পরিচালিত মল-অপসারণের গাড়িগুলির কথা বললে একালে কেউ বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ। আফসোস হচ্ছে- অনেক চেষ্টা করেও অমন একটি গাড়ির ছবি আমি জোগাড় করতে পারিনি। স্থানীয় মেথরবাড়ীতে সেগুলো থাকতো। একটা দশাসই ড্রামের পেটের কাছে মুখ-কাটা, আর আড়ভাবে জুড়ে দেয়া গরুর গাড়ীর সাথে। এর সঙ্গে থাকতো অদ্ভুত আকারের একটা বালতি। আজীবন দেখেছি বালতির উপরের অংশটা নীচের অংশের থেকে চওড়া হয়। ওদের বালতিটা ছিলো উল্টো। নীচে অনেক প্রশস্ত আর উপরের মুখের দিকটা সরু। দেখে মনে হতো উল্টানো। ছোটবেলায় ঐ গাড়ী অনেক দেখেছি। ঢিমে তালে অত্যন্ত মুড নিয়ে (মুডতো নেবেই, গাড়ীভর্তি গু নিয়ে তো আর হাসতে হাসতে চলাফেরা করা যায় না!) মেথরপট্টির পেইড-পরিচ্ছন্নকর্মীরা ওই গাড়ী চালিয়ে আসতো। এসে ধন্য করতো। কারণ, যাদের ‘সেপটিক ট্যাঙ্ক’ ভরে গেছে- তারা জানে কী বিপদে পড়েছে! রাস্তা আপসে আপ খালি হয়ে যেতো। কারণ মেইনট্যানেন্সের অভাবে কিংবা বেখেয়ালে- যে কারণেই হোক- অধিকাংশ ড্রামের মুখের ঢাকনা থাকতো না। লোকজন ওই গাড়ী দেখলেই নাকে রুমাল চেপে দৌড় লাগাতো। অতি উৎস্যুক কেউ কেউ চালককে জিজ্ঞেস করতো- ভরা, না খালি? আর এ প্রশ্নের যে উত্তর পেতো তা আর লেখার যোগ্য নয়। ওরা একটু ভিন্ন ভাষায়-ভিন্ন উচ্চারণে- উর্র্দু-হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলতো। সন্ধ্যা হলে ওরা নিজেদের হাতে বানানো মদ গিলে ব্যপক গানবাজনা করতো। লুকিয়ে লুকিয়ে বহুদিন আমরা ঐসব দেখতে গেছি। বড় হয়ে গেছি শুয়োরের ছবি তুলতে। অনেক শুয়োর পালতো ওরা। সে যা-ই হোক, আমাদেরও একটা আদ্দিকালের ল্যাট্রিন ছিল, চুণ-শুরকির ছাদঢালাই দেয়া। এখনো আছে- পরিত্যক্ত। জিনিসটার উপস্থিতি জমির ম্যাপের ভেতরে নির্দেশিত বলে মা ওটা ভাঙতে চান না। আমরা সম্মান করে বলতাম ‘-মন্দির’। বাবা মাঝে মাঝে পৌরসভায় নির্দিষ্ট ফরম পুরণ করে মেথর আসার আবেদন করে আসতেন। ওরা আসতে গড়িমসি করতো। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছালে তবে আসতো। আহ্ কী ভাব তখন তাদের, হাঁকডাক আর হম্বিতম্বি করতো। ঐদিন আমাদের- ছোটদের, গৃহবন্দী থাকতে হতো- কারণ মায়ের ছিলো ভয়ানক শুচিবাই। তারই ফাঁকফোকড়ে ওদের কর্র্মকাণ্ড দেখতাম লুকিয়ে। খুব সাবলীলভাবে ওরা কাজটা করতো। সেফটি ট্যাঙ্কের ওপরের গোল স্ল্যাবটা উঠিয়ে ওদের একজন ঐ আজগুবি বালতি ভরে তুলে আনতো- আর একজন সেই বালতি ঢেলে দিতো গাড়ীর ড্রামে। ওদের নাক ঢাকতে হতো না। কথা বললে ওদের মুখ থেকে বিকট দুর্র্গন্ধ পেতাম- পান্তা পচিয়ে বানানো দেশি মদের। অন্যসব গন্ধ তার কাছে তুচ্ছ! তো, কাজ শেষ হবার পর খানাপ্রধানকে একটা কাগজে সই করে দিতে হতো পরিমানসহ। নিরক্ষর মেথর-সর্র্দার বাবাকে বললেন, “লিখিয়া দেন ইধারসে ম্যেথর আসিয়া দুইগাড়ী গু ল্যইয়া গেসে”। আমাদের নীতিবান বাবা বললেন, “কই, একগাড়ী এনেছ যে?” সর্দার সংশোধন করে বললেন, “তাইলে লিখিয়া দেন ম্যেথর আসিয়া এক্ক গাড়ী গু ল্যইয়া গেসে”। বাবা চটে উঠলেন- “একগাড়ীওতো হয়নি, যা নিলে…”। সর্দার পুনরায় ঠিক করে বললেন, “তাইলে বাবু খিকখেন, ম্যেথর আসিয়া আধাগাড়ী গু লিয়া গ্যেছে…।

এখন ভাবি, দুইগাড়ী লিখলেই বা কী ক্ষতি ছিল? হীরা-জহরত তো আর নেয়নি, কেবল গু-ই তো!

অন্যদের জানিয়ে দিন