১.
পোলার বিয়ারের অন্তর্ধানের সাথে সাথে পোলার আইসক্যাপও যে শুন্যে মিলিয়ে যাবে, তা থিংকট্যাঙ্করা জানতো সেই কোভিদ যুগের সীমানা থেকেই। এখন সেখানে খাঁখাঁ অন্ধকারের মতো জমাট বাষ্প খেলা করে, আর ঘনগভীর গিরিখাতের অন্তিম অভিঘাতে শিরশিরে প্রস্রবণের ঋঋ ছন্দ তোলে! আলোচ্য গল্পের সেখানেই শুরু।
আজ মানুষ তার অস্তিত্ত্বকে সহজসাধ্য করতে অবশেষে পরিবেশের অপার্থিব মূল্য বুঝতে শিখেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে পানির ট্যাঙ্কের পাশাপাশি আইসস্লট রয়েছে। ঘাবড়াবেন না, আইসস্লট এমন হাতিঘোড়া কিছুই না। পোলার আইস শুকিয়ে যাবার পর সেন্ট্রাল ডিফেন্স স্টক থেকে এক সিও (সেন্ট্রাল অর্ডার) জারি করা হয়েছে, যাতে নির্ধারিত আকারে প্রতিটি বাড়ির মাচায় একটি করে বরফ-ছাদ তৈরি থাকে।
এটা এখন বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রযুক্তি আজ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে তাতে উষ্ণ-শীতল প্রকৃতি নির্বিশেষ এই আইসস্লট স্থাপন তেমন কঠিন কিছু নয়। যখন বা যেদিন যেদিন সূর্য ওঠে, তার উত্তাপেও এই বরফ গলে পড়ে না। ফলত, মেরুতুষারের বিকল্প হিসেবে এটা পৃথিবীকে পার্থিব উষ্ণায়ন থেকে বিরত রাখছে। তাছাড়া বরফের ওমন সুন্দর একটা স্ল্যাব থাকায় ইমারতগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখনসই হয়েছে। আপনাদের মধ্যে কারো কারো অরিয়েন্টাল স্থাপত্যকলার প্রতি অনুরাগ থাকতেই পারে, কিন্তু একথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, আমরা একটি ন্যানোউৎকর্ষময় শহুরেসভ্যতায় প্রবেশ করেছি। তৎকালীন হলিউডি বলিউডি তামিল তারাজু এমন কোনো উৎপটাং কল্পনা নেই, যা বর্তমানে অপ্রতুল! বুজতে পারছি, এসব শুনে আপনার মনে একবিংশ শতকের মানুষের বাচ্চার মতো এন্তার কথাপ্রশ্ন খাবি খাচ্ছে, তাইতো?…. আরে বাবা উৎকর্ষের কোন্ স্তরে বাস করছি আমরা, ভাবতে পারেন? একে বলে প্লাস্টিক-শেসন! যার বাঙলা করলে দাঁড়ায় প্রাচ্য-গলিত-পশু-শাসন! বুজলেন এবার? মানেটা একটু খটোমটো হলেও এর কোন্ কোন্ অবদানকে অতঃপর তোমরা অস্বীকার করবে? চুলো জ্বালার বালাই নেই, ঘুমানোর জন্য আলাদা বালিশ-বিছানা-সময় কোনোটাই লাগেনা, কাজ করতে করতে, চোখ খোলা রেখেই যখন তখন মানুষ ঘন্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারে। এহেন বাইপোলার শক্তিসঞ্চয়ের জন্য পোলার বিয়ার ত্যাগ করা তো মামুলী ব্যাপার। সেকালে এসব আদিখ্যেতাকে ‘সোশালভ্যালু’ নামে ডাকা হতো। প্রকৃতি তখন ছিলো নগরজীবন বহির্ভুত ছিনাল স্বভাবের। যখন ইচ্ছা কালবৈশাখী, যখন ইচ্ছা মৃদুমন্দ, যখন ইচ্ছা টিনের চালে রিমঝিম– এসব এখন চলবে না চাঁদু!
অরণ্যশঙ্কুল জনগোষ্ঠীকে কেনো কে জানে তখন ‘আদি’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু অধুনা এই প্রাচ্য-গলিত শাসন ব্যবস্থায় বৃক্ষ একটি অতি ঘনিষ্ট উপকরণ হিসেবে সাব্যস্ত। প্রতিটি যৌথযাপনের (=পরিবারের) জন্য বৃক্ষপালন বাধ্যতামূলক। বলতে পারেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি আহরণের এর চেয়ে সমীচীন পথ আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, বৃক্ষভেদে অম্লজানের তীব্রতা, গভীরতা বিভিন্ন হয়। ফলে, তার ভেদবিদ্যা যেমন সমাদৃত, তেমনি অবশিষ্ট প্রতিটি বৃক্ষ এখন গৃহদেবতার সম্পদ। পাতলা, কিন্তু অভঙ্গুর কাঁচের এ্যাকুরিয়াম-সদৃশ্য বিশাল বিশাল জারে আচ্ছাদিত প্রতিটি বৃক্ষ এখন দ্বারে দ্বারে সুশোভিত। চাইলেই বেলীফুলের সুবাস এখন সুলভ্য নয়। ওই কাঁচের জারের ভেতরে যে অম্লজান বিশ্লিষ্ট হয়- প্রতিটি যৌথযাপন তা দিয়ে প্রতিদিনকার নিঃশ্বাস নেয়ার পরেও বাড়তি অম্লজান পাঠিয়ে দেয় আমাজনে! আরে না না, ওই আমাজন নয়- যেটা পুড়ে ফসিল হয়ে গেছে! এ হলো একবিংশ শতকে উদ্ভাবিত সেই অনলাইন শপিং ব্যবস্থা, যা আজও টিকে আছে। ঘর সাজাবার রাবুত থেকে শুরু করে লেটেস্ট ডিজাইনের ইরাকুস, সবই এখানে বিকোয়। তবে ঘনীকৃত অম্লজানের চাহিদার যে ডিমান্ড, তা পুরো মকরক্রান্তি জুড়েই প্রবল। তাই আমাজান সুযোগটা লুফে নিয়েছে। তাই শুনে জ্যাকবাবা অবশ্য ঘোষণা দিয়েছেন, শীঘ্রই তিনি সুপ্ত-সূর্যালোক বা স্লিপিং-সানলাইট বাজারে আনছেন!
আমাদের গোত্রের পিকো আঙ্কেল অবশ্য জ্যাকবাবার এইসব ছেঁদো কথায় খুব একটা আস্থা রাখেন না, কারণ এর আগেও তিনি এক রেঙ্গুন-রূপসীর সাথে যৌথযাপনের প্রাক্কালে প্যাকেটজাত চাঁদের আলো বাজারজাতের বারফট্টাই করেছিলেন। কিন্তু চাঁদের আলো তো দূরের কথা, একথোকা মরিচবাতিও তিনি বাজারে আনতে পারেন নি। কামারশালার এককোণে যে এলসিডি ডিসপ্লে- যা পিকো আঙ্কেল তথাকথিত ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনে চালু করেছেন – ছাতারে পাখীর ডাক নকলের উদ্দেশ্যে- সেটায় সেন্ট্রাল বুলেটিন দেখানো শুরু হতেই পিকো আঙ্কেলের মেজাজ চড়ে যায়। জ্যাকবাবার উদ্দেশ্যে সেই পুরাতন মুখখিস্তি করা অশ্রাব্য গালিটির পুনরাবৃত্তি করে পিকো আঙ্কেল তার সর্বক্ষণ কোমড়ে গোঁজা ত্যানানো মুড়ি চিবোতে চিবোতে গান ধরেন।
২.
কামারশালাকে যারা রাজনৈতিক আলোচনার আখড়া বলে মনে করেন, পিকো আংকেলের কাছে ম্যাড়ম্যাড়ে সন্ধ্যাগুলিতে তারা ভীড় করেন। গনগনে আগুন, হাপড়ের হা, নেহাইয়ে উপর্যুপরি হাতুড়ির ফুলকিতোলা ঢঢক্কার, আর জ্বলন্ত কাঠকয়লার ভেতর গলা ডুবিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা আধা আকৃতি নেয়া আদিম আয়ুধসমূহ– এসব তাদের কতোটা আন্দোলিত করে, তা বলা মুশকিল। আগুনের কাঁপা আলো কামারশালার আস্তরহীন দেয়ালে কিম্ভূত আবছায়া হয়ে দুলতে থাকে – মনে হয় গুহাচিত্রের চলমান ছায়াছবি! প্রত্যেকের শরীরে সংযোজিত কিছু না কিছু প্লাস্টিক প্রত্যঙ্গের কারণে ভীড়েরা আগুনের খুব বেশি কাছে ভীড়তে পারেনা। বহুভাষাবিদ ডঃ রিবেন দাশুড়া প্রমুখ এই সমাজব্যবস্থাকে “প্লাস্টিসিয়ান” বলে অভিহিত করেছেন। সেই মত অবশ্য পলিকার্বনেশিয়ানরা বাতিল করে দিয়েছেন। সে যা-ই হোক, একটা কথা সকলেই সম্মত হয়েছেন, “কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো প্রতিরোধ!” বলে বলে ফাঁকতালে এই জেনারেশনের কেউ গোলা খালি করতে পারবে না! এর পেছনে মনোসামাজিক দুর্বৃত্তায়ণকেই অনেকে ইন্ধন মনে করছেন। অবশ্য সম্পত্তি বেহাত বা চুরি হবার কনসেপ্টটাই এই প্রজন্মের কাছে বাহুল্য। এককালে পুরো দ্রাঘিমাজুড়ে যে তস্কর-বেষ্টনী তৈরি হয়েছিলো, আজ তা শুন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। এটা সম্ভব হয়েছে আধ্যাত্ব থেকে সত্ত্বার মুক্তির কারণে। দিনে দুবার ‘তাফালিং’ বেজে উঠলে সর্বসাধারণ তাদের পাথরের চোখ, হীরের নকল দাঁত আর ক্ষয়ে যাওয়া করোটি প্লাটিনাম হেলমেটের মতো খুলে রেখে নিষ্কাম সত্ত্বার পরাকাষ্ঠা হিসেবে নিয়মিত গড় করতেন। পিকো আঙ্কেল সেসব মনে করে ত্যানানো মুড়ি চিবোতে চিবোতে হাসেন। এককালে গোত্রে কোনো বৃক্ষের মৃত্যু হলে তারা শোকরাষ্ট্র করতেন। এর মানে হলো- পতিত বৃক্ষের পাশে পুঞ্জীভূত হয়ে নিরব অশ্রুমোচন। এমনকি বৃক্ষালিঙ্গন তাদের প্রধান উৎসব বলে সেসময়ে বিবেচিত হতো। আর আজ এই স্মার্ট কস্টিক-সভ্যতায়– পিকো আঙ্কেলের বিভিন্ন অসাংস্কৃতিক উপায়ে উপার্জনের পাশাপাশি রয়েছে বিস্তর আলিজালি বিষয়ে কৌতুহল ও পাণ্ডিত্য! অবশ্য খিস্তিখেউড়কে যদি তুমি পাণ্ডিত্য বলে স্বীকার করো, তবেই! তো প্রতিদিনকার রুটিনবিহীন এজেন্ডা হিসেবে তিনি অতঃপর উপস্থিত কামিনাহারামিদের উদ্দেশ্যে ভাগাড় থেকে উদ্ধারিত তার সাইলেজ ফটোট্যাবের মেমরিব্যাঙ্ক ওপেনকরতঃ বিংশ শতকের একখানি পয়ার চয়ন করেন! কে বা কাহারা কোন্ উদ্দেশ্যে এহেন অমার্জিত স্লোক রচন করতে পারেন, তা সেন্ট্রাল ডিফেন্স স্টক আজো সুরাহা করে উঠতে পারেনি। আঙ্কেল তার হাড়গিলে উদোম শরীরে ঢেউ তুলে স্বভাবচরিত ভঙ্গীতে ক্যাজন বাজিয়ে পাটের আঁশ সদৃশ্য রুক্ষুচুলগুলি নাড়াতে নাড়াতে সুর করে পড়েন:
হুক্কু হুক্কু শেয়াল ডাকে, গরু ওঠে গাছে!
যা বলার তা বলে দিছি, আরো বলার আছে –
গাছের পাতা নড়েচড়ে, নিচে ঝরে না (ভয়ে)!
পাবলিক পণ করিচ্চে রাস্তায় ময়লা ফেলবে না!
ময়নার বডি বাকশোবন্দী ময়নারতো নাই সেন্স
সৌদি থেকে আসছে দেশে পেট্রো-রেমিটেন্স! হুক্কু…
যাই নাই, তবে যাইয়া দেখলাম –দেখার কিছুই নাই–
ডেঙ্গুর ভয়ে দরজা বন্ধ, দরজার কপাট নাই!
সূধীবৃন্দের মাঝে এ থেকে যে পাঠ প্রতিক্রিয়া হয়, তা অভাবিত! তারা ময়নার বডির চেয়েও চিন্তায় পড়ে যায় বাকশোটা নিয়ে। ওটা কোন্ ম্যাটেরিয়ালে তৈরি? কাঠের না প্লাস্টিকের? প্লাস্টিক হবার কথা নয়, কারণ ওই আমলে এতোটা মরণঘনিষ্ট প্লাস্টিকের উৎকর্ষ ছিলো না। কিন্তু বাকশোটি কাঠের হলে… হায় হায় কাঠের হলে… প্রকৃতিকে রীতিমতো আঘাত করা হয়েছে, হায় হায় আঘাত করা হয়েছে… বলতে বলতে সর্বসাধারণের ভাবসমাধি হয়। তারা কাঠের ডোমিনোর মতো একে অন্যের গায়ে নিমেষেই আছড়ে পড়ে, পড়তেই থাকে।
সেন্ট্রাল ডিফেন্স স্টক এযাত্রায় পিকো আঙ্কেলকে আর রেহাই দেবেনা একথা সবাই বলাবলি করছিলো। ততক্ষণে ব্লু কভারওল আর সোনালি ফেটিগ পরিহিত ‘সেন্ট্রাল হারমোনি’-র চৌকশ একটি দল কামারশালার চারদিকে পজিশন নিয়ে ঘিরে ফেলে। তারা পিকো আঙ্কেলের যাবতীয় অস্থাবর সম্পদ যথা, প্রাচীন পুঁথি ও তার সুর, নেহাইয়ের উত্তাপ আর হাতুড়ির ঢঢক্কার, ছাতারে পাখীর বিস্তৃত কূজন এবং গনগনে কয়লার ধিকিধিকি বাজেয়াপ্ত করার অভীরুচী ব্যক্ত করে। পিকো আঙ্কেল হাসেন। তার অস্পষ্ট ছায়া আস্তরহীন দেয়ালের গায়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এবং সেই হাসি অতিদ্রুত লোকালয়ে ভাইরাল হয়ে যায়। অন্তর্যামীর মতো তিনি সকলের ডিভাইসে আবির্ভুত হন। শুরু হয় গন-উন্মোচন। কী এক অলীক ইশারায় সর্বসাধারণেরা একে একে কলের পুতুলের মতো ডোমিনোদশা থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। জোড়াতালি লাগানো লবেজান কলকব্জার মতো তাদের গা থেকে পচা শ্যাওলার আস্তর খসে খসে পড়তে থাকে- স্পার্ক করে যেনো বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ বারুদের মতো! আর গনগনে হলুদ কাঠকয়লায় গলা ডুবিয়ে থাকা উন্মুক্ত আদিম উপশিরা শিরা সহস্র শস্ত্রের মতো কিলবিল করতে থাকে!
অবিকল বিংশ শতকের মানুষের বাচ্চার মতো জোম্বীভূত সর্বসাধারণ তাফালিংয়ের তীক্ষ্ণ সাইরেন উপেক্ষা করেও কামারশালাটির চারপাশে প্রতিরোধ গড়ে তোলে– যেভাবে বৃক্ষকে তারা আলিঙ্গন করতো! তারা পরস্পরের হাত ধরে এবং একজোট হয়। বৃত্তটা ছোটো হয়ে আসে! ক্লাইমেক্সের চূড়ান্তে তখন দ্রুতলয়ে ক্যাজন বাজতে থাকে। ড্রোনশটে পুরো অঞ্চলের এরিয়েল ভিউ প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের ঘটনা বুঝতে সহায়ক হয়ে ওঠে। অতঃপর কাহিনীর অনাবৃত অংশে বর্ষা আসে। বর্ষা মেয়েটি সুশ্রী ও নৃত্যপটিয়সী। ছবি হিট হবার জন্য যা যা দরকার, সবই তার ভেতরে আপনি পাবেন। জুমলেন্সে তার সাদাভেজাশাড়ী আলোচনার কেন্দ্র হয়েছে বহুবার! হুমহুম হামিংয়ের মহরতে সেই অবিরাম বৃষ্টির পর রাস্তায় জমে থাকা জল অপসৃত হলে নিরেট সত্যের মতো অবশিষ্ট ফোঁটা ফোঁটা জল গাছের পাতা থেকে, টিনের চালা থেকে আর ভিজে যাওয়া আস্তিন আর চুলের ডগা থেকে ঝরে পড়তে থাকে। সে জলজটে সৃষ্ট কুয়াশায় সেন্ট্রাল হারমোনির ওয়াটারপ্রুফ কাভারঅলগুলো গলে গলে কখন নেই হয়ে যায়! সবাই বলাবলি করে পিকো আঙ্কেল বৃক্ষ হয়ে গেছেন, অথবা বৃষ্টির জল! কিংবা কে জানে হয়তো একটা আস্ত দানব-নক্ষত্র যেমন শ্বেতবামন হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের গর্ভে খেলা শেষে ঢুকে পড়ে, তেমনই হয়তো…!
বিংশশতকের পয়ারমন্ত্রের কী যাদু, দেখলেন তো?