বয়স পাঁচ বছর ছুঁইছুঁই, সম্ভবত চুহাত্তর সালের দিকে – প্রতি সপ্তাহে আমার উছিলায় শুকনো আপেলের প্যাকেট নিয়ে আসতো মা। সঙ্গে অয়েস্টার মিল্ক গুঁড়োদুধের টিন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে রেড ক্রসসহ বিভিন্ন ক্রিস্চিয়ান অর্গানাইজেশন তখন প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য বাড়তি পুষ্টি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলো।
কী যে স্বাদ ছিলো সেই আপেলকুচিতে তা বলে বোঝানো যাবে না। স্বর্গে গেলে যে প্রথমত ওই আপেলকুচি দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে, সে ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ও আছি! ইউরোপের অাবহাওয়ায় পরিপক্ক, দূষণহীন সেইসব আপেল কেমন করে শুকিয়ে তারা আমাদের নিরানন্দ শৈশবকে চমকিত করেছেন তা ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করি। কয়েক টুকরো মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেয়া যেতো। তারপর পানি খেলে ক্ষিদে গায়েব!
অয়েস্টার মিল্কের কৌটো অনেক ওপরের তাকে তুলে রাখা হতো, আমার নাগালের বাইরে! কিন্তু চেয়ার ঠেলে ঠেলে নিয়ে, তার ওপর জলচৌকি বসিয়ে ননীচুরির বিদ্যা কী আমি শিখিনি তদ্দিনে?.. দুয়েকটা অঘটন তো ঘটতোই- পুরো টিন মাঝপথে হাত ফসকে গেলে কিংবা চেয়ারের পায়া যদি বিট্রে করে, তো সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে ঘুমিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বাড়ির পেছনের জঙ্গলে বা স্বপনদাদের বাসায় রাজনৈতিক আশ্রয় না নিয়ে উপায় কী?
সেই আপেলকুচি আর অয়েস্টার মিল্ক শৈশবের সাথে সাথে বাজার থেকেও নেই হয়ে গেছে! বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর পুরো বিদেশী সাহায্যগুলি রাতারাতি তাদের মিশন গুটিয়ে নিয়েছ বা স্ট্রাট্রেজি পাল্টে ফেলেছে। আমার মুখে লেগে থাকা সেই শুকনো আপেলের স্বাদ আমি কখনো ভুলতে পারিনি! ঢাকার বড়বড় সুপারশপে জিজ্ঞেস করলে তারা কিভাবে যেনো তাকায়। তারপর আপেলের জ্যাম নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে এটায় চলবে কিনা!
দেশের বাইরে সবসময় শুকনো আপেল কেনার বাসনা থাকলেও, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে পাইনি। গতমাসে ভিয়েনার চেইন শপ ‘বিল্লা’ তে ঢুকে মনে হলো, এটাই উপযুক্ত স্থান। অত্যন্ত সুদর্শন এক অস্ট্রিয়ান যুবক সেলসবয় হিসেবে তখন মালামাল সাজিয়ে রাখছিলো থরে থরে। জিজ্ঞেস করতে আমাকে নিয়ে গেলো নির্দিষ্ট জায়গায়। দুনিয়ার হেনো ফল নেই, যা তারা চিপসে রূপান্তরিত করেনি! কিন্তু শুকনো আপেল মাত্র দুই প্যাকেট, তাও ছোট ছোট। দেড় ইউরো দাম। আমার আশাহত চোখ দেখে ছোকড়া কী বুজলো কে জানে। আমাকে অপেক্ষায় রেখে বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো বড়বড় আরও দুটো প্যাকেট নিয়ে। চোখে অপরাধ ফুটিয়ে বললো সেগুলির দাম প্রতিটি পাঁচ ইউরোর বেশি, আমার তাতে চলবে কিনা!… চলবে না মানে? পুরো শৈশব প্যাকেট করে তোমরা হাতে তুলে দিচ্ছো, এত্তো সস্তা ইউরোপের বাজার!