১.
সামনের রিকসার পেছনে টিনের ব্যাকভিউতে হাতে আঁকা বেঢপ-বুক লাস্যময়ী নারী ভঙ্গীমাটা যে আসলে তারই প্রতিকৃতি আঁকার প্রচÐ প্রয়াশ- তা বুঝতে শাবলীনের বেশ সময় লাগলো। শুটিংয়ে যাবার এই সময়টা ঢাকা শহরের জ্যামে আটকে গত রাতের রাত জাগার ধকল আর অনেকখানি মানসিক চাপকে গোপন করতে করতে সে অনেকটাই হাঁফিয়ে উঠেছিলো বলে মাথাটা তেমন কাজ করছিলো না। সামনে ড্রাইভারের পাশ থেকে মনসুর- তার সেক্রেটারী- বুঝিবা রিক্সাগুলিকেই একটা গালি দিতে তার চমক ভাঙে। আর ভাঙে বলেই কচ্ছপের আচমকা শক্ত খোলসে নিজের কুৎসিৎ মাথা গুটিয়ে নেবার মতো গতরাতের এ্যাংজাইটিগুলি সে চট করে মুছে ফেলে এক ধরনের প্রশান্তির মেকাপে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বোরখায় মধ্যে যদিও কেউ তাকে দেখছে না, তবুও রীতিমতো অভ্যাস করে করে এহেন প্রশান্তি ও ¯িœগ্ধতা মাখা মুখভঙ্গী করতে পারা এখন তার মজ্জাগত। ফিল্ম লাইনের সেই শুরুর দিকেই যা তাকে রপ্ত করতে হয়েছিলো। আর সেটা পরিপূর্ণভাবে পারার কারণেই আাজ সে রূপালী পর্দার এক নন্বর আবেদনময়ী নায়িকায় পরিণত হতে পেরেছে। গোবরচাকার আকলিমা খাতুন এখন দর্শকহৃদয়ের ঘুম কেড়ে নেয়া নায়িকা শাবলিন!
কনি আঙ্কেলের হাতে পড়েই সে পাল্টে ফেলেছে- ফেলতে পেরেছে নিজেকে। আঙ্কেল, মানে বিশিষ্ট পরিচালক সাইদুর রহমান কনি তাকে দেখেই পছন্দ করেছিলেন- শাবলিনের মা তাকে পরে পাঠিয়েছিলো সাইদুরের ফ্ল্যাটে। অনেক অনেক ঘনিষ্ট হবার পর কনি আঙ্কেল ইস্কাটনের ঐ ফ্ল্যাটের সাড়ে পাঁচ সিএফটির ছোট্ট ফ্রিজ খুলে কনিয়াক বের করে দুটো গøাসে ঢালতে ঢালতে কথা দিয়েছিলো তার আগামী ছবিতে সাইড নায়িকার রোল দেবার। সেই প্রথম বারের মতো মদ খাওয়া। ঐ ছবিতে একটি ধর্ষণের দৃশ্যে তাকে উত্তেজক ভাবে এক্সপোজ করার পর প্রযোজক মঈনা পারভীন উৎসাহিত হয়ে পড়েন। লোকটার ভেতরের বিকৃতি শাবলীন বুঝতে পারার আগেই পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে যায়। তার মানে হলো ঐ সময়ের মধ্যে অন্য কোনো পরিচালক-প্রযোজকের ছবিতে সে সাইন করতে পারবে না। তাই শাবলীনকে আটকে থাকতে হয়েছিলো। পাঁচ বছর পর সে যখন সত্যি সত্যি ভালো পরিচালকের হাতে ভালো পারিশ্রমিকে কাজ করার জন্য সাইন করেছে- তখনই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো একটি তৃতীয় শ্রেণীর সিনে ম্যাগাজিনে তার পুরো নগ্ন ছবি ছাপা হয়। গতরাতে প্রথম ফোন করে মঈনা পারভীন। তারপর মনসুরকে পাঠিয়ে পত্রিকার এককাপি কিনে আনার পর নিজের প্রতিই তার রাগ হয়। মনসুর কোনো ঘটনা নয়। তার সব পাপ-অপাপ আর দুষ্কর্মের স্বাক্ষী এই মামাতো ভাইটিকে সে নিজের সেক্রেটারী বানিয়েছে। বয়সে বড় হলেও তাকে সে নাম ধরে ডাকে। সবার সামনেই দুর্ব্যবহার করে। কিন্তু এটাও ঠিক, ওর চরম দুর্দিনেও মনসুর তাকে ছেড়ে যাবে না। প্রেমের বড় বালাই। না হলে তার মতো নষ্টা একটা মেয়েকে কেউ এভাবে ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসবে না। মনসুর কখনো তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। তবু মনসুরের মনের কথা শাবলীন পড়তে পারে। আর পারে বলেই লোকটেেক মেরুদÐহীন মনে হয়। কাপুরুষ! রাগে সে চোয়াল শক্ত করে। নগ্নদেহ চিৎ করে শুইয়ে ওকে চুমু খাওয়া লোকটি যে এই সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেনীর- যারা বাংলা ছবির অশ্লীলতার কারণে হল-এ যাওয়া বন্ধ করে স্যাটারডেতে রেইনবো চ্যানেল খুলে বসা একজন- তা ঐ হিজড়ে পত্রিকাওয়ালারা বেমালুম চেপে গেছে। লোকটির নচ্ছার দাড়ি যা শাবলীনের নরম ফুটফুটে পেলব দেহে সুড়সুড়ি আর বিবমিষা তৈরি করছিলো- সে এখনো তা মনে করতে পারে- সেই মুখটা খুব দায়সাড়াভাবে কালো চিট মেরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মইনা পারভীন ফোনে কন্ট্রাক্ট করেছিলো লোকটার সাথে। শাবলীনকে যেতে হয়েছিলো দু পেগ মেরেই। একটা বিশেষ ক্যামিকেলের কার্গো তার ওষুধ কোম্পানীর জন্য অথরিটির অর্ডার না পেয়ে বাতিল হয়ে পোর্ট থেকে ফিরে যাচ্ছিলো। শাবলীন সেই বাতিল ক্যামিকেলের বাতিল হওয়া অর্ডার বাতিল করেছিলো- দুঘন্টার বিকৃত চাহিদা পূরণ করার পর। করে তার যে খুব অনুশোচনা হয়েছিলো- তা নয়। অনুশোচনা, পাপবোধ ইত্যাদিও স্তরকে অনেক আগেই পার করে এসে সে তখন দেশের এক নম্বর ‘ঘরের ল²ী’ নায়িকা হবার ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। ছবির কাহিনী তাকে ঘিরে বিকশিত হয় না আবার তাকে ছাড়া ছবিও হিট হয় না। ঐ সময়টায় শুরু হয় খুল্লাম খুল্লা যুগ। একদিকে উন্মুক্ত স্যাটেলাইট বিশ্ব- অপরদিকে দর্শকদের হল বিমূখতায় ইন্ডাস্ট্রীকে বাঁচাতে তার মতো অনেকেই বস্ত্র উন্মোচনে নেমেছিলো। কিন্তু শাবলীন ঠিক যেভাবে অল্পখানি দেখিয়েই ইশারা ঈংগিতে দর্শকের মাথার মধ্যে দপদপানি ঘটিয়ে ফেলতে পারতো- সেভাবে আর কেউ ততোটা পারেনি। তাই ছিলো সে ঘরের ল²ী। ইন্ডাস্ট্রীতে তাকে নিয়ে চলছিলো ব্যাপক গুঞ্জন। সিনে পত্রিকার গসিপ ইত্যাদি একজন রূপালি লাস্যময়ী নায়িকা হতে গেলে যা যা লাগে- সবই ঠিক ঠিক সময় মতো ক্লিক করে উঠতে- রাতারাতি সে সুপারস্টার! তার ‘রাতজাগা পাখি’ এতোই হিট করলো যে একটানা দেড়মাস সতেরটি জেলায় হাউজফুল চলেছিলো। গোবরচাকার আকলিমা খাতুন যখন ফ্ল্যাট গাড়ী বাড়ি আর বিভিন্ন মুখরোচক পত্রিকার প্রচ্ছদকন্যা হিসেবে নিজের অবস্থানকে শক্ত আর মঈনা পারভীনের কবল থেকে মুক্ত করে- আর খোলামেলা নয়, এবার সঠিক অভিনয় দক্ষতার দিকে মন দেবো- ভেবে শওকত ভূইয়ার ‘দেখো দুনিয়া’ ছবিতে রাকিবের বিপরীতে সাইন করেছে- তখনই ঐ ছবিটা ছাপা হয়ে গেলো…।
একটি বহুজাতিক সাবান কোম্পানী তাকে নিয়ে দেড়কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত একটি বিজ্ঞাপন চিত্র বর্তমানে এডিটিং টেবিলে আছে। পুনেতে গিয়ে তিনদিনে ঐ কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে শুতে হয়েছিলো তাকে। লোকটার হাতে কি যে এক যাদু, শাবলিন ধীরে ধীরে তপ্ত হয়ে উঠতো। আর তা এমন চরম অবস্থায় তাকে নিয়ে যেতো যে কোনো হিতাহিত জ্ঞান তার থাকতো না। এতো করেও কিন্তু বিজ্ঞাপনটি আগামী সপ্তাহে অন এয়ারে যাওয়ার কথা। তিনটি প্রাইভেট চ্যানেল আর দু দুটো সরকারী প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রথম একমাস নব্বই সেকেন্ডের এ্যাড যাবার কথা। ঈদের চাঙ্কে স্পেশাল স্পন্সরশিপ ছিলো পিটার ব্রাদার্স কোম্পানীর। জনপ্রিয় একজন কাট চলতি নাট্যকার যিনি নাকি মধ্যবিত্তদের ইমোশনকে পুঁজি করে খুব ভালো ভালো আকাশ সাহিত্য রচনা করে মোটা টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন ইদানিং, পিটার ব্রাদার্স তাকেই এবার সওয়ার হয়েছে। আর তাদের নতুন বানানো এ্যাডে আছে শাবলিনের মতো আর এক ললিপপ। কে আর পায় তাদের ? এই শেসনে তারা সত্তর কোটি টাকা মুনাফা করার ধান্দা করেছিলো। কিন্তু ঐ একটি পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়ায় সব বুঝি ভেস্তে গেলো। কিন্তু শাবলিন এতো ভাবছে কেনো ? তার তো এখানে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। আর এমন তো যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারতো। লুকানো ক্যামেরার কথা সে জানতো না। আর তাছাড়া নায়িকাদের নিয়ে এ ধরনের স্ক্যান্ড্রাল তো নতুন নয়। নিশ্চিত ভাবে এসব তার ক্যারিয়ারের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পনেরোটি ছবিতে ইতোমধ্যে সে সাইন করে ফেলেছে। প্রেস জানতে চাইলে সে এই সংখ্যটি দ্বিগুন করে বলে। প্রকৃতপক্ষে শুটিং চলছে অন্তত তিনটি ছবির। তার একটাও হিট করবে বলে মনে হয় না। যদি কাটপিস ঢোকানো হয় তবে অন্য কথা। কিন্তু যারা সাইনিং মানি দিয়ে রেখেছে কেবল, তারা হয়তো তাকে উইথড্র করবে। তাহলে আগামী বছর তার কোনো ছবি রিলিজ হবে না। আগামী বছর সুপারহিট ছবির তালিকায় একটাও না থাকলে পরের বছরও তার ছবির কন্ট্রাক্ট না পাওয়ারই কথা। এবং এভাবেই একজন নায়িকা তার রূপালী পর্দার জীবন থেকে আস্তে আস্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। ভাবতেই শাবলিনের ভেতর এক ধরনের কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। সে পারবে না। কিছুতেই না। যে নষ্ট আর অভাবের জীবন তার ছিলো একসময়- সেই জীবনে আবার যদি তাকে ফিরে যেতে হয় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু বেঁচে থাকার চরমানন্দ যে পেয়েছে, যে পেয়েছে সাফল্যের স্বাদ সে কি এতো সহজে সব নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিতে মনকে বোঝাতে পারে ? সে পারবে না। যে করেই হোক তাকে এই সমস্যা উতড়ে যেতে হবেই। যে কোনো মূল্যে। প্রয়োজনে যদি তাকে আরো দশজন প্রভাবশালী পুরুষের সাথে বিছানায় যেতে হয়- তাও সে যাবে। আর পুরুষ মানুষকে কিভাবে উত্তেজনার চরমে নিয়ে বাজে কাজের সম্মতি আদায় করাতে হয় তাতো শাবলিনের এখন মুখস্ত।
২.
সাংবাদিক সম্মেলনে গিয়ে আজ এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা হলো বখতিয়ারের। শালার দামড়া দামড়া পরিচালকদের কান্না দেখতে দেখতে তার ইচ্ছে করছিলো এদের কান ধরে টেনে এমন লম্বা করে দেয় যাতে গাধার কানকেও হার মেনে যায়। আজীবন বাঈজি নাচের মুদ্রায় যাবতীয় শৃঙ্গারদৃশ্যর নৃত্য দেখিয়ে কাটচলতি ছবি তৈরি করে আজ এমন পরহেজগার সেজেছে যে অশ্লীলতা বন্ধের করো এই স্লোগান তুলে মুখে রক্ত ওঠার পালা। জনৈক পরিচালক যিনি এদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে নতুন মুখ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে প্রবাদ পুরুষ হিসেবে নিজেকে গন্য করেন এবং ছুকড়ি ছুকড়ি নায়িকাপ্রতিম নারীমেশিনগুলি তাকে আবার রঙ্গ করে দাদু নামে সম্বোধন করে থাকে- তিনি একেবারে কেঁদে ফেলেন আরকি। অথচ এই লোকটিকে বখতিয়ার একবার মিনি সাক্ষ্যাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলো- বিশেষত নায়িকারাই কেবল আপনাকে দাদু বলে ডাকে কেনো। ব্যাটা ফিচেল হেসে চরম অশ্নীল ভঙ্গী করে বলেছিলো তারা আমাকে ভালোবাসে, আমি তো ওদের দাদুর বয়সীই তাই… কেনো ডাকে তা ঐসব মেয়েদের জিজ্ঞেস করুন না কাইন্ডলি। অথচ সেই সব নায়িকাদের মধ্যে যারা বছরের পর বছর ঘুরে ঘুরে কোনো ছবিতে কাস্ট না হয়ে কেবল দূর্নাম আর বিকৃত রুচির রাঘব বোয়ালদের রসদে পরিনত হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করেছে ইন্তেখাব দাদু তাদের ঠকিয়েছে। কেউ কেউ যারা এখন এক্সট্রা হিসেবে কাজ করছে তারা আরো স্পষ্ট করে জানিয়েছে তিনি তাদের ভোগ করেছেন বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে।… এই সবই বখতিয়ারের জানা। কিছুটা নিজের অভিজ্ঞতায় কিছুটা সিনে কাম সেক্স পত্রিকা ঘেঁটে । তার এক ভিডিও এডিটর বন্ধুর কাছ থেকেও অনেক তথ্য সে পেয়ে থাকে। কিন্তু এসব আর কাহাতক ভালো লাগে ? সে ঢাকাবাসী হয়েছিলো চারুকলার ছাত্রত্ব নিয়ে। টাকার অভাবে শেষমেষ পড়া হলো না। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে কিন্তু ইউনির্ভাসিটির ক্যাম্পাসকে আঁকড়ে ধরে সে তখন সারাদিন কবিতা আবৃত্তি করে বেড়াতো। তারপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে আজ সে একটি মধ্যম মানের সিনে ম্যাগাজিনের মধ্যম মানের ফিল্ম জার্নালিস্ট হিসেবে মধ্যম অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। তবুও মেজাজ মাঝে মাঝে বিগড়ে যায়। ইচ্ছে করে সব কিছু ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতে।
৩.
সম্ভবত এখন সন্ধ্যা। নমিতা তার অনুভূতি দিয়ে বুঝতে চাইছে। বাইরে কিসের যেনো কোলাহল ভেসে আসছে বলে সে এখন সম্ভাব্য কটা বাজে, ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। জানা যে খুব দরকার তা-ও না। দেখতে না পাওয়া একজন মানুষের কাছে রাত দিন এখন সমান। তবুও মনটা কি এক অস্বস্তিতে ভরে থাকে। দশ বছর আগে জীবনটা তার এমন ছিলো না। এসিড তাকে নিয়ে গেছে অন্য ভূবনে। যেখানে অন্ধকার আর অসহায়তার মাঝে সে বাস করছে। লোকলজ্জা লোকনিন্দা আর অন্যান্য গঞ্জনাকে পাশ কাটিয়ে আজ সে নিভৃতচারী। আজকেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর একটি বহুজাতিক কোম্পানীর যৌথ স্পন্সরশীপের কল্যাণে এসিডদগ্ধ মেয়েদের নিয়ে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নমিতা সে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ কার্ড পেয়েছে কিন্তু সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি মন থেকে। এখন আর এসবের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করে না। আহত হবার প্রথম দিকে খুব ইচ্ছে করতো প্রতিবাদ করতে। তখন সে তার অক্ষমতাকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু এখন সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর এইসব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের ভেতরের অনেক ব্যাপার সে কিছু কিছু জানতে পারার কারণে এখন আর উৎসাহ বোধ করে না। সব কিছুর মধ্যে এক ধরনের অন্তঃসারশূণ্যতা টের পায় বলে নমিতা এখন গা করেনা অনেক কিছুতেই।
পায়ের কাছে পানির ফোটা পড়তে তাকে গা করতে হলো। বৃষ্টি আসছে হয়তো। উঠে জানালাটা বন্ধ করা দরকার। সে যেখানে আছে, এটা একটা ডরমিটরি। একটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রীদের পড়ার স্কুল ও হোস্টেল। এই স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা সবাই দেখতে পায়। কেবল সে ছাড়া। তাকে রাখা হয়েছে সাইন বোর্ড হিসেবে। নমিতা খুব ভালো করেই জানে তাকে কিভাবে মানুষ ব্যবহার করছে। করেছে। কু প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার কারণে তাকে এসিডদগ্ধ হতে হয়েছিলো। লোকটা ছিলো অন্য ধর্মের আর পেশায় ছিলো পুলিশের হাবিলদার। সহ্য হয়নি হিন্দু ঘরের একটি মেয়ে এতো সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাবে। শিক্ষিত হবে। প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব। নমিতাকে। তারপর ব্যর্থ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি পরিবারের কাছে। অতঃপর তাতেও ব্যর্থ হয়ে একদম কুত্তা হয়ে উঠেছিলো লোকটা। তারপর একদিন সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরছিলো বান্ধবীর বাসা থেকে, তখন কুপ্রস্তাব এবং তুলে নিয়ে যাবার হুমকি। নমিতা মাস খানেক বাসা থেকে বেরুতো না। অবশেষে তাকে বেরুতে হয়েছিলো। এস এস সি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। প্রথম কদিন মা বাবা মামা, মেজদির পাহারায় সে স্কুলে গিয়েছে পরীক্ষা দিতে। তারপর একদিন বিকেলে পরীক্ষা ছিলো। মামা সেদিন ফার্মেসীতে। বাবা স্কুলে আগেই চলে গেছেন প্রশ্নপত্র ডিস্ট্রিবিউট করতে। মা মাইগ্রেনের ব্যাথায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। মেজদিকে জামাই বাবুর দিকের কে একজন মারা যাওয়ায় অশৌচ পালন করতে নিয়ে গেছে। ফেরার কথা আগামী কাল। নমিতা একাই সেদিন রওয়ানা দিয়েছিলো হলে। ধর্ম পরীক্ষা ছিলো সেদিন। ভোরবেলা থেকেই তার একটু অন্যরকম লাগছিলো। গতরাতে মা দূর্গার তৃতীয় নয়ন সে স্বপ্নে দেখেছে। ভোররাতে উঠে দেখে শরীর খারাপ শুরু হয়েছে। ইশ্ কী লজ্জা। এখনো সে ব্যাপারটাতে তেমন অভ্যস্ত হতে পারেনি। তার উপরে আজ ধর্ম পরীক্ষা। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে করতে সে ভাত খেলো। মা ঐ শরীর নিয়ে একবার আসতে চেয়েছিলো। নমিতাই তাকে মানা করলো। এই রোদে বেরুলে তার মাথা আরও ধরবে বলে। বাসা থেকে কিছুদূর যেয়েই তার মনে হলো কি যেনো একটা ভুলে আনা হয়নি সাথে। কিন্তু সেটা কি, তা মনে পড়ছে না। আর সূর্যটাও আজ যেনো বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে গনগনে কয়লা কেউ ঢেলে দিচেছ মাথার ওপর। কটা বাজে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলো তাড়াহুড়োয় হাতঘড়িটা আনা হয়নি। স্কুলের কাছে আসতেই সে পরীক্ষা শুরুর ঘন্টা শুনতে পেলো। এইরে,পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে গেছে। বাইরে কোন মানুষজনকে দেখা যাচেছ না। তড়িঘড়ি পা চালিয়ে উত্তাপ আর গরম উপেক্ষা করে সে এগোতে লাগলো। ছ্যাৎ করে তার বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলো যখন দেখলো ঐ বাজে লোকটা তার দিকে হনহন করে এগিয়ে আসছে। এখন তার হাঁটার মধ্যে কোন সংকোচ কাজ করছে না। অথচ এলাকার সালিশে ব্যাটা একদম মেকুর হয়ে ছিলো সেদিন। এতো সব ভাবনাকে গোছানোরও সুযোগ পেলোনা নমিতা। লোকটা তার হাতচারেক সামনে এসে একদম ঠান্ডা গলায় বিষ মিশিয়ে খিস্তি করে বললো- র্ম মালাউনের বাচ্চা ! সূর্যটা ঝট্ করে একদম নিচে নেমে এলো তারপর। আর তার উত্তাপে ঝলসে গেলো নমিতার নাক, মুখ, গলা, হাত… উহ্ মাগো, কুত্তার বাচ্চা আমাকে খুন করে ফেললো মা! তারপর তার আর কিছু মনে নেই। (অসমাপ্ত)