মশলা বাটতে বাটতে শিলপাটার ধার একসময় নষ্ট হয়ে যায়- একধরনের পেশাজীবী রয়েছেন, যারা এই পাটা খোটানোর বা ধার করার কাজটা করেন। একটা ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে খুটখুট করে সারা পাটার উপরে নকশার আকারে সুন্দর করে তারা খোদাই করেন। কাজটা দেখতে দারুন লাগতো। কিন্তু খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না- পাথরের শ্র্যাপনেল ছিটকে এসে চোখে লাগতে পারে। ক্লাশ থ্রি তে থাকতে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলি- বড় হয়ে পাটা খোটানোর কাজটাকে পেশা হিসেবে নিতে হবে। পরবর্তী জীবনে অবশ্য এই লক্ষ্য অনেকবার পরিবতন করতে বাধ্য হয়েছি। রাজমিস্ত্রি হতে পারিনি বলে আমার দুঃখ এখনো কিছুটা আছে! আর মুদি দোকানদার না হতে পারাটা জীবনের এক বিরাট লস- বিশেষত, গুঁড়োদুধ যেসকল দোকানে বিক্রি হয়- আমার অবাক লাগতো ভেবে- তারা কিভাবে সবটুকু দুধ খালি খালি খেয়ে নিজেরাই শেষ করে না! ছোটবেলায় শপথ নিয়েছিলাম- চাকরি পেলে পুরো একটা গুঁড়োদুধের টিন কিনে একা একা খাবো। বলতে দ্বিধা নেই- সত্যি সত্যি কিনেছিলামও; কিন্তু ছোটবেলার ঐ স্বাদ আর পাইনি।
আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর নাম পিযুষ। কতো বয়স হবে আমাদের, পাঁচ কিংবা ছয়। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো- ওদের বাড়িতে গুঁড়োদুধের টিন থাকতো-পিযুষ হাতভর্তি দুধ নিয়ে আমার সাথে খেলতে আসতো। বড়দের একটা ম্যানিয়া ছিলো- ছোট বাচ্চাদের ইন্টেলিজেন্স টেস্ট করার জন্য ছড়া বলতে বলতো। আমার খুব লজ্জা লাগতো হুটহাট মুখস্ত ছড়া আবৃত্তি করতে। পিযুষকে জিজ্ঞেস করলে সে চটপট শুরু করে দিতো- কাঠবেড়ালী কাঠবেড়ালী পেয়ারা তুমি খাও, গুড়মুড়ি খাও…তারপরই স্বরচিত পাঞ্চলাইন: …খাবেনা খাবেনা, মাইর দেবো!!!
বরিশাল সদর হাসপাতালে প্রায় দিন পনের ভুগলো পিযুষ। শেষদিকে মায়ের সাথে আমিও একদিন দেখতে গিয়েছিলাম পিযুষকে। ঐ প্রথম আয়োডিনের গন্ধভরা পুরাতন বিল্ডিংকে মৃত্যুপূরী মনে হয়েছিলো আমার। পিযুষ শুয়েছিলো ময়লা অফহোয়াইট চাদর বিছানো লোহার খাটে। কোন কথা বলতে পারেনি আমার সাথে- ওর কালো শরীরটা শুকিয়ে গিয়েছিলো নিউমনিয়ায়। তার ২/১ দিন পরে সবাই বলাবলি করছিলো, পিযুষ মরে গেছে। …এতো বছর পর সম্প্রতি পাঁজরের হাড় ভেঙে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে পিযুষের কথা খুব মনে পড়ছিলো!