পাঙ্গাসকাকু

গায়ে ঘাম। খেলার মাঠ থেকে ফিরেছি ধুলোবালি একাকার করে। কাদামাখা খালি পা। ঝরের বেগে ঘরে ঢুকেছি, উদ্দেশ্য মাটির কলসের ঠান্ডা জল খাবো। কিন্তু ঘরের ভেতর ন্যাড়াচৌকিতে পা তুলে যে লোকটি বসে আছেন হাফহাতা গেঞ্জি লুঙ্গি পড়ে, হাতপাখায় বাতাস খাচ্ছেন, তাকে দেখে কুন্ঠিত হলাম। মা রাগত স্বরে কিকি যেনো বলছেন, সেসবের তোয়াক্কা না করে লোকটির পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। তিনি হাহা করে উঠে ধরে কাছে টানলেন। পেন্নাম করোন লাগবে না, বাবাজি কোথায় আছেলা? মা এখন তাঁর কাছেই নালিশ জানালেন, দেহো পাঙ্গাস, পড়াশুনার নাম নাই, হারাদিন আঁদাড়েপাদাড়ে…!

হ্যাঁ, পাঙ্গাসকাকু। বাবার আপন ভাই নন। এমনকি তুতোভাইও নন। একই গ্রামে বসবাসকারী, কিন্তু কাকু বলতে তাকেই বুঝতাম আমরা, যেহেতু বাবার কোনো আপন ভাই নেই! এই বিদঘুটে নামের সঠিক কার্যকারণ রয়েছে। পাঙ্গাসকাকু চোখে পড়ার মতন ফরসা ছিলেন, আর ঠোঁটদুটি অস্বাভাবিক পুরু প্রশস্ত আর লাল! হয়তো সেকারনেই এমন নাম। এমনি আরও অনেক কাকুর আনাগোনা লেগেই থাকতো আমাদের বাসায়। মোনাকাকু, ধলুকাকু, মোহনকাকু….সব কাকুদেরই বরিশালে আমাদের বাড়িতে লাগাতার পদার্পন ছিলো বিভিন্ন কারণে। তার ভেতর একটা প্রধান কারণ ছিলো ডাক্তার দেখানো। বড়দা তখন ইন্টার্নি করছে শেবাচিমহা তে। তাতে কী, গ্রামের মানুষের কাছে সেটাই বড়-ডাক্তার! সমস্যা কী কাকু? বড়দা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতো রোগের উপসর্গ। তারা তাতেই অর্ধেক ভালো হয়ে যেতেন। মাকে বলতেন, বৌদি, খোকন যে কয়ডা “ফরমুলা” জিগাইলে, মোগো গেরামের ডাক্তারেতো হেকয়ডা জিগাইলেনা!”

কাকুদের আরও একটা কারণে টাউনে আসতে হতো। কেসের তারিখ পড়লে বা জমি “লাগানোর” টাকা দিতে। কেস মানে জমিসংক্রান্ত মামলা, জানতাম, কিন্তু জমি লাগানোর ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না (এখনো বুঝি না :)।  জমি কি চারাগাছ, যে লাগাতে হবে? তবে এর সাথে টাকাপয়সা জড়িত, সেটা বুজতাম, মায়ের অসন্তুষ্টিতে! বাবাকে প্রেশার দিতেন, “এইবার এতো কম টাকা দেছে কেন্? আমাগো জমিতে ধান কি কম ওডে? কতগুলা গাছ! পুষ্কনির মাছতো সব ওরাই খায়!” বাবা চেপে যেতেন, বাদ দাও, গরীর মানুষ!… তা শুনে মা আরও চটে যেতো!… আমরা কি জমিদার? শ্বশুড়ে জমি করছে হালুডি কইররা। তুমি সব বিলাইতে আছো!”
” আহ্ থামো তো, শুনবে!” বাবা চাপাস্বরে বলতেন। কাকুরা বারান্দার চৌকিতে শুয়ে সবই শুনতেন, না শোনার মত। বাবা কখনো মায়ের প্ররোচনায় তাদের কিছু বলতেন না। একটু বড় হবার পর, বাবার ওপর বেশ রাগ হতো এজন্য। বাবা বছরে একবার বাড়ি যেতেন, চেঁচরি, তেলিখালি, কৈখালি, মইষপুরা, বোত্লা  এইসব নাম শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। যাওয়া হয়নি কখনো। বিভিন্ন অঞ্চলে জমি ছিলো আমাদের। মা মাঝেমাঝে তাল দিতো, এইবার তুকুরে নিয়া যাও, ওর পরীক্ষা শেষ, বাড়ি যাউক তোমার লগে। বাবা রাজি হতেন না। কারণগুলো পরে জেনেছি। দেশে আমাদের বাড়িঘর ছিলো না। অন্যের বাড়িতে নিজে যেভাবে থাকেন, ছেলেকে সেখানে নিতে চাননি। বাবার এই বাবাসুলভ অনুভুতিটার খবর মা কোনদিনই তলিয়ে দেখেননি। অগত্যা ক্যাম্বিসের চামড়ার ব্যাগে দু একটা লুঙ্গি গামছা চশমা, দু ব্যাটারির টর্চলাইট আর ক্ষৌরি করার যন্ত্রপাতি ভরে ছাতাসমেত বাবা একতলা কাঠবডি চরদোয়ানির লঞ্চে চড়ে বসতেন। নামতেন হুলারহাট বা ভান্ডারিয়া। আঠালো কাদায় গদগদে কাঁচা রাস্তায় মাইল দশেক যাবার পর সন্ধ্যাসন্ধ্যি গ্রামে ঢুকলে কাকীরা শঙ্খে ফুঁ বা তুলশীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে বাবাকে দেখে একহাত ঘোমটা টেনে “দাদা, আইছেন?” বলে মাটিতে গড়প্রণাম করতেন!

সপ্তাখানেক পর রুক্ষু চেহারা নিয়ে বাবা ফিরতেন একব্যাগ সুপারি, কলার মোচা, সেরদুয়েক রাই সরিষা, হাতেভাজা মুড়ি, খইয়ের ধান আর কিছু টাকা নিয়ে। মায়ের জেরা শুরু হতো তখন। বাবা দশ কথার একটা হয়তো উত্তর দিতেন। মা গজগজ করেই যেতেন, যে কম টাকায় বন্দোবস্ত নেয়ার কথা বলে গেছেন কাকুরা, দিয়েছেন তারও অর্ধেক। “তুমি কিছু কইতে পারলা না?”

– কি বলবো? বাবা কাঁধ ঝাঁকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে শ্রাগ করতেন। দেশের মানুষের হাতে টাকা নাই তো! মোনার পোলাপানগুলি ইস্কুলে যায়…!

আমার এমন বোকাবাবাকে আমার মা, আমরা কেউই কোনদিন বুঝিনি।

অন্যদের জানিয়ে দিন