ঝড়ের দিনে প্রতিবারই একটা দুটো ডাল ভেঙে পড়া রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ঢ্যাঙ্গা, ভঙ্গুর গাছটির এহেন আচরণ রীতিবিরুদ্ধ বলেই অনেকে গাছটিকে প্রেত বসবাসের সম্ভাবনা বলে ঠাওড়াতো। সন্ধ্যার পর ঐ গাছের নিচ দিয়ে যে শর্টকাট মাটির রাস্তাটি- যেটি শুধুমাত্র শীতকাল ব্যতিরেকে কেবল তৃণভোজীদের চলাচলসাধ্য- পারতে-সাধ্যে কেউ সেটা খুব একটা ব্যবহার করতো না।
ঘরের বাইরে, এমনকি ঘরের ভেতর থেকেও তার গলার স্বর শোনা গেছে- এমন দাবী এলাকাবাসীর কেউ কখনো করতে পারেনি লোকটা সম্পর্কে। স্বাধীনতার পর শহর ছেড়ে ঝুনাহারের খাল পেরিয়ে বড় শালার বাড়িতে আত্মগোপন করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকটা, লুট করা সোনাদানা সব সেখানেই নিয়ে গিয়েছিলো- এমন কথা চালু আছে এলাকায়। কিন্তু বাহাত্তরের পর যখন পাতিল একটু একটু করে ঠাণ্ডা হচ্ছে, তখন আবার ফিরে আসে সে। ফিরে আসে যেন তার প্রেত। নিঃশব্দে চলে। কথা প্রায় বলেই না। আর রাস্তাঘাটে একদম মাটির দিকে মুখ করে হাঁটে। দ্রুত, জড়তামুক্ত, কিন্তু অপরাধক্লিষ্ট লোকটি সেই থেকেই এলাকাবাসীর কাছে একটা বিশেষ কিছুতে পরিণত হয়ে আছে। তাকে কেউ ডাকে না। সেও কারো সাথে তেমন মেশে না। কেবল কাঁচাবাজারে তাকে হাসিমুখে আহবান করে মাছওয়ালা, সব্জিবিক্রেতা। পৌরসভায় কী একটা চাকরি যেনো সে করতো। আর প্রতিদিন ভোরে তার একহাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে কুমড়ো, লাউ কিংবা তরমুজ- হিন্দু মেয়েরা যেমন করে পূজা-উপাচার একহাতের তালুতে নেয়- সেভাবে নিয়ে,হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখা যেতো। এই দৃশ্য প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো সবার কাছে। রিকশা বা কোনো যানবাহনের তোয়াক্কা সে করতো না। ফাজিল ছেলে ছোকড়ারা তাকে দেখে সিটি দিতো। দূর থেকে নাম ধরে ডেকে উঠতো- তা-আ-রা-আ-মি-য়া! লোকটা ফিরেও তাকাতো না। যেনো সে একাধারে দৃষ্টিশ্রবণ প্রতিবন্ধী।
তার সাথের একজন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢোকার পর বস্তার মধ্যে ভরে এলাকায় নিয়ে আসে। খুব কষ্ট দিয়ে মারা হয় তাকে। প্রতিটি নিরীহ মানুষকে আর্মিদের হাতে ধরিয়ে দেবার অপরাধে একটি করে আঙুল হাতুড়ি দিয়ে ছেঁচে গুঁড়ো করা হয়। শোনা যায় এসবের পর নাকি মোটে সবমিলিয়ে তিনটা আঙুল তার অবশিষ্ট ছিলো। রাইফেলের বাঁট দিয়ে সামনের সবকটি দাঁত ভেঙে দিয়ে অবশেষে বেয়নেট চার্জ করা হয়। সবশেষে গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেবার আগে যে গুলিটা করা হয়েছিলো- সেটা মাইলখানেক দূরের এক লাইটপোস্ট ফুটো করে ভিতরে আটকে থাকে। মহল্লায় যুদ্ধের স্থায়ী স্মৃতি শুধু এটুকুই। মাঝবয়সী অনেকে এখনো সেই সন্ধ্যায় গুলিটা লাইটপোস্ট ঠং করে ফুটো করার শব্দটির কথা স্মরণ করতে পারে। আর তার অনুভূতি এমন, যে মনে হয় লাইটপোস্ট নয়- গুলিটা নিজের করোটিকে ফুটো করেছে আর সেই থেকে এখনো দশগ্রাম খাঁটি তামায় মোড়া সীসার টুকরোটি মাথার মধ্যে নির্জীব পড়ে আছে; আছে বলেই মাথাটা ভার ভার লাগে! এলাকার লাইট্টা-বান্দর পোলাপানে ঐ লাইটপোস্টের ফুটোটাকে সই করে ইট মারা প্রাকটিস করতো। তারা একে নাম দিয়েছিলো গুল্লি-মারা! লোকটি তার সঙ্গীর এহেন পরিনতিতেই হয়তো কোনো উচ্চবাচ্য থেকে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছিলো। তার ছেলেমেয়েরা কিন্তু তেমন নয়। তারা সবার সাথে মিশতো। অন্তত সমবয়সী অনেকের সাথে। এলাকায় যে যুব-তরুণ-শিশু সংগঠনটি ছিলো- তাতেও তারা নিয়মিত অংশ নিতো। বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধলে একদিন তাদের একজন তারামিয়ার মেজো ছেলেকে গাল দিলো- রাজাকারের বাচ্চা! শান্ত সুবোধ ছেলেটি তখন ক্ষেপে গিয়ে একটা ইট দিয়ে ঐ ছেলেটির মাথা ফাটিয়ে দেয়। এলাকাবাসী থ।
‘দেখছো নাহি কারবার, হালার রাজাকারের বাচ্চায় ঠিক রাজাকারই হইছে। খানকির পোরে কেউন্নাইয়া দাড়া ভাইঙ্গা দেলে হ্যাসে ঠিক অয়।’ এলাকাবাসীর এই রায় অবশ্য কার্যকর হয় না। লোকটা এলাকার মাথা ফ্রিডম ফাইটার তোফাভাইয়ের আব্বার কাছে গিয়ে পা ধরে পড়ে। মিনমিনে খোনা গলায় বলে- ‘ভাইজান, পোলায় আমার জাউর্যার পয়দা, আপনে অরে মাফ হইর্যা দ্যান’। তোফা ভাইয়ের আব্বা, মানে হাজীচাচার দয়ার শরীর। গজগজ করতে করতে তিনি শাসানি আর ভর্ৎসনা করেন ‘পোলাগুলিরে মানুষ র্ক তারা। ওইগুলা জানি তোর রহম বেহাংরা না অয়- আর কিছু কইলাম না- যা।’ এই বাক্যালাপ বিভিন্ন অনুষঙ্গে এলাকায় চাউড় হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে। কেউ বলে, শালা রাজাকার থাকলে কি হইবে, পোলামাইয়ারে শাসন করে খুব। কেউ বলে, তোফাভাইর আব্বার উচিত আছিলো গন্ডোগোলের সোমায়র জিদটা তুইল্লা লওয়া’। কে না জানে, এলাকায় ‘মুক্তি’ আছে কিনা- প্রশ্নের জবাবে তারামিয়া পাক আর্মীদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তোফাভাইয়ের বাসায়। হাজীচাচা ক্রমাগত চোস্ত উর্দূতে বাতচিৎ করতে পারার কারণেই সেদিন ওদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। আর অশিক্ষিত চামচা তারামিয়াকে ওদের মেজর না ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কের এক অফিসার ভারীবুটের এমন এক লাত্থি মেরেছিলো যে- সে আর খাডাল থেকে উঠতে পারেনি। অনেকে বলে তারামিয়ার মাটির দিকে নুয়ে হাঁটার রহস্য নাকি সেই দশাসই বুটের লাথি। কিন্তু কোমরে ব্যথা নিয়ে লোকটা এতো দ্রুত হাঁটে কী করে সেটা আর এক বিস্ময়!
কিন্তু আরও এক বিস্ময় সামনে অপেক্ষা করছিলো হয়তো। কেননা তারামিয়া যখন পথের দিকে নুয়ে হাঁটা বাদ না দিলেও, লুঙ্গি ছেড়ে পাজামা পাঞ্জাবী পড়তে শুরু করে, শুক্রবার শুক্রবারে জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতো- তখন কালচারাল দু একটি ফ্যামিলি বাদে অনেকেই তাকে একটু একটু সমীহ করা শুরু করে। কেউ কেউ এমনও বলে যে গণ্ডগোলের সময় লোকটার মতিগতি একটু ঘূণে ধরেছিলো হয়তো… আর তাছাড়া তখন যে সব ফ্যামিলি এফেক্টেড হয়েছিলো- তারা তো এখন আর এলাকায় নেই- বাড়ি টারি বিক্রি করে রাতের আঁধারে কবেই ইন্ডিয়া চলে গেছে- আর লোকটাতো কোনো হিন্দুদের বাড়িও দখল করেনি কিংবা শত্রু-সম্পত্তি হিসেবে রিকুইজিশনড বাড়িও মামলা চালিয়ে ভোগ করছে না, অতএব… তাদের এই ক্ষমাপূর্ণ উদারনীতির বদৌলতে লোকটার কোমর সোজা হয় না বটে, কিন্তু বেশভূষা আর দেহভঙ্গীতে, ব্যক্তিত্বে এক ধরনের জেল্লা ধরে। এক কোরবানীর সময় হালকা পাতলা মানুষটি বিশাল এক ষাঁড় কিনে এনে ফকির-মিশকিনদের প্রচুর গোস্ত বিলিয়ে আর চামড়াটি স্থানীয় মসজিদে দান করলে এলাকাবাসী কেউ কেউ এতোদিন তারাভাইয়ের উপর অবিচার করা হয়েছে- একটি সামান্য ভুলের এমন শাস্তির কেনো মানেই হয় না- এমন কথা বলতেও সঙ্কোচ করে না। কেউ কেউ তখন যুদ্ধ-পরবতীঁ তারামিয়ার দোসরের শাস্তি ও মৃত্যু বিষয়ক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় অনুযোগ না ক্ষোভ না অনাস্থা না অবিচার- কী সূচিত করতে চায়, ঠিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। দেখা যায় কেউ কেউ এমন বক্তব্যের সাথে একপ্রকার মিনমিনে সমর্থন বা একাত্মতাও ঘোষণা করে যেনো। অবশেষে তারামিয়াকে স্থানীয় যুব-কিশোর-শিশু সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদটি দেবার আহবান জানানো হলেও একগুঁয়ে লোকটি মিনমিন করে তার অনিচ্ছা প্রকাশ করে। যে ছেলেরা এই প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলো তারা যেনো বেশ খুশি মনেই ফিরে আসে। এমন আচরণই তারা তারামিয়ার কাছ থেকে আশা করেছিলো হয়তো। ফলত, তারামিয়া সেই নিন্মমুখী, দ্রুতগমনশীল, প্রাত্যহিক বাজারকারী- দৃশ্যটি থেকে তেমন খুব একটা পৃথক হয়ে ধরা পড়ে না। কেবল তার কপালে অত্যাধিক সেজদাজনিত একটি লালচে-কালো কড়া ফুটে ওঠে। আর তার বদৌলতে চট করে তারামিয়ার মুখশ্রীতে কেমন একটি সৌম্য সৌম্য ভাব ফোটে। সরকার আসে সরকার যায়- তারামিয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারাতেও কেউ কোনো আলোড়ন দেখতে পায় না। খুবই হৃদয়বান কেউ কেউ এমনও বলে যে একাত্তরে অনেকেই তো অনেক কিছু করছে- আরে কতো দ্যাখলাম, মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়া হিন্দুগো মাইয়ারে জোর কইর্যা মোছলমান বানাইতে, আর তারমিয়া যা-ই হউক মাইয়া মাইনসের অপমান করছে এমোন কতা কেউ কইতে পারবে না।
এহেন অনুসন্ধানী রিপোর্ট সমগ্র এলাকায় তারামিয়ার সম্মান ও প্রতিপত্তিকে স্থায়ী করে তুলেছিলো। আর তার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যখন পড়ালেখায় স্কুল ডিঙিয়ে কলেজের সীমায় ঢুকে পড়ে- তখন তারামিয়াকে আর পায় কে? দেখতে দেখতে তার বাড়ির টিনের চাল উঠে গিয়ে দালান হলো- তারপর সেই দালান একতলা দোতলা হয়ে শেষে বৃদ্ধ কড়ই গাছের মাথা ডিঙিয়ে অনেক দূর থেকে কাঁচকলা দেখায়। কড়ই গাছটি তার বাড়ির সীমানাতেই। ঝড়ের দিনে প্রতিবারই একটা দুটো ডাল ভেঙে পড়া রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ঢ্যাঙ্গা, ভঙ্গুর গাছটির এহেন আচরণ রীতিবিরুদ্ধ বলেই অনেকে গাছটিকে প্রেত বসবাসের সম্ভাবনা বলে ঠাওড়াতো। সন্ধ্যার পর ঐ গাছের নিচ দিয়ে যে শর্টকাট মাটির রাস্তাটি- যেটি শুধুমাত্র শীতকাল ব্যতিরেকে কেবল তৃণভোজীদের চলাচলসাধ্য- পারতে-সাধ্যে কেউ সেটা খুব একটা ব্যবহার করতো না। এই রাস্তাটি থানা কাউন্সিলের আওতায়, কিন্তু এর লিংক রোড দুটি পৌরসভার নিয়ন্ত্রনে বলে বহু বছর ধরে টেন্ডার হলেও থানা কাউন্সিল রাস্তাটিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না করায় এর সংস্কার হয়নি। কবে কারা এককালে সুরকি ফেলেছিলো। এখন প্যাঁচপেঁচে কাদা, কড়ই গাছের পাকনা বীজ আর পাকা পাতায় থকথকে পথটি চলাচলের অযোগ্য। কিন্তু একদিন ভোরে গাছ কাটার শব্দে সবাই চমকে তাকিয়ে দেখলো বিরল পত্রের ঢ্যাঙ্গা কড়ই গাছটির মগডালে কালো কালো পেটানো শরীরের কয়েকটা লোক দড়িদড়া আর হাত-করাত, কুড়োল নিয়ে গাছটিকে খণ্ড খণ্ড করে ভূপাতিত করছে। ‘তারার গাছ তারা কাডে, কার বাপের বাড়া চাডে?’ ছ্যাড়ারা ছড়া বানায়। কেউ বিষয়টাকে তেমন করে পাত্তাও দেয় না। কিন্তু তাদের এই অনুৎসাহ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ব্যাপার হলো, তারামিয়ার বাড়ির পাশের ঐ পথ বা রাস্তাটি থানা কাউন্সিল অবশেষে পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করেছে। তারামিয়া পৌরসভায় চাকরি করতো বলে আগেভাগে খবর পেয়ে গাছটি প্রথমে কেটে ফেলে। কারণ ওটা তার সীমানার মাঝামাঝি। এককালে তার জমিতে গাছটির শেকড় পুরোটাই থাকলেও প্রতি বর্ষার সিজনে বাঙালির সীমানা বাড়ানোর আবহমান রীতি অনুসরণ করে তারামিয়া সেটাকে ঠেলে দিয়েছিলো এতিম রাস্তাটির দিকে। এখন মাপজোখ শুরু হলে সেটাই যাতে বুমেরাং না হয়ে ওঠে এজন্য এহেন পূর্ব প্রস্তুতিতে সে অনেকের নৈব্যক্ত বাহবা কুড়োয়। কিন্তু গাছ কেটে ফেলার পরদিনই যখন রাজমিস্ত্রিরা তারামিয়ার সীমানা বরাবর দশইঞ্চি দেয়াল গাঁথতে শুরু করে- তখন কারো কারো টনক নড়ে। ‘মাজাভাঙ্গার পোয় শুরুডা হরলে কি? রাস্তাডা পাকা হইবে হেয়া সৈজ্জো অয়না এ্যাঁ?’ ইত্যাকার বাক্য তারামিয়ার কানতক পৌঁছায় কিনা সন্দেহ। এলাকার যুবক ছেলেরা একজোট হয়। মুরুব্বীরা জোহরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফেরার পথে জিজ্ঞেস করেথ- ‘ও মেয়া, এইডা হল্লেন কি? রাস্তাডা হওনের পর ওয়াল দেতে পারতেন না?’
তারামিয়া সেই মিনমিনে কণ্ঠে কি যেনো বলে। তার চোখ, তার গলার স্বর আগের মতোই অনিচ্ছা আর বিরক্তিতে কাঁপে। যেনো সে কোনো কৈফিয়ত দিতে প্রস্তুত নয়। দিনকাল খারাপ। মুরুব্বীরা তেমন কোনো সদুত্তর না পেয়ে অপমানেই সরে পড়ে। তার পরদিন যুবকরা যখন অনেকে মিলে দেয়াল তুলতে নিষেধ করার আর্জি নিয়ে তার কাছে যায় তখনও সে তাদের দিকে ভালোকরে তাকায় না পর্যন্ত। কেবল সদ্য কেটে ফেলা কড়ই গাছের এন্তার ডালপালার স্তুপের ভেতর থেকে একটি কালচে-সবুজ আরজিনা সড়াৎ করে বেড়িয়ে এসে লকলকে জিভ বের করে নির্ণীমেষ তাকিয়ে চকিতে উধাও হয়ে গেলে তাদের মধ্যে সদ্য-যুবা কেউ কেউ ভয় পেয়ে নিজের বুকে থুৎকুড়ি ছিটায়। এর দুদিন পর পৌরসভা থেকে লোকজন এসে রাস্তার জন্য জমি মাপ দিয়ে দেখে দুপাশে ড্রেনের জন্য এলাকাবাসীর প্রত্যেকের আড়াই ফিট করে যে জমি সরকারের হুকুমদখলের কথা ছিলো, তা তো নেই-ই, উপরন্তু তারামিয়ার গাইডওয়ালের ভেতরে হাতখানেক রাস্তা গায়েব হয়ে গেছে। ফলে ঐ অংশটা সরু হয়ে গেছে। অপরদিকে আবিয়াতো মেয়েমানুষের অবৈধ পেট ওঠার মতো তারামিয়ার গাইডওয়ালটি ঐখানে বিচ্ছিরিরকম ভাবে ফুলে আছে।
পৌর কর্তৃপক্ষ এলাকার গন্যমান্যদের জানায়। তারামিয়াকে জমি ছেড়ে দিতে বলে। এমনকি এর জায়ে সরকারী কিছু টাকা পাইয়ে দেয়ার আহবানও জানানো হয়। কিন্তু তারামিয়া মিনমিনে খোনা গলায় তার দেয়াল ভাঙতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং তার দেয়ালে সাদা চূণকাম লাগার পর নানা অশ্লীল অক্ষর ও আঁকিবুকিতে ভরে ওঠে। তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য শব্দবন্ধটি হলো- ‘তারারে চুদি’। এই সাদাসিদে আকাঙ্খার কথাটি কে দেয়ালে লিখতে পারে, এ নিয়ে এলাকায় তারামিয়ার ছেলেরা- যারা এখন বেশ নামিদামি মাস্তান- খুঁজে বের করতে গিয়ে দু দফায় তিনজনকে মারধর করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সবাই যখন একজোট হয়ে দেয়াল ভাঙার উদ্যোগ নেয়, তখন এলাকায় স্থায়ী-বেকার ফ্রিডম ফাইটার তোফা ভাই এতে নেতৃত্ব দেন। দলটি দেয়ালের দিকে অগ্রসর হয় এবং শাবলের আঘাতে তার একাংশের কিছু ইট দমাদম খসিয়ে ফেলে। তারার মেজো ছেলে তখন ঘরের ভেতর দিয়ে সড়াৎ করে পিস্তল হাতে বেড়িয়ে এসে তোফাভাইকে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলি করে। তিনি মাথায় গুলি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়। তারামিয়ার দু দুটি পাতানো কেস-এ পুলিশ এলাকার বাড়িঘর চষে ফেলে, সকল যুবক ছেলেদেরই থানায় ধরে নিয়ে যায়। যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়… এমনিভাবে… এমনিভাবে ঘটনার পর ঘটনা ঘটতে থাকলে পুরো ঘটনাটাই একটা নিছক ঘটনায় পরিণত হয়। রাস্তাটাও একদিন পৌরসভা টেন্ডার দিয়ে পাকা করে ফেলে। বলা বাহুল্য, ঐ একহাত জমি ছাড়াই। আর তার পরের কয়েক বছরে তারামিয়ার বিল্ডিং আরও কয়েক তলা উঁচু হয়। ভাড়াটের সংখ্যা বাড়ে। তার বাজার করে বাসায় ফেরার প্রাত্যহিক ভঙ্গীমায় কোনো পরিবর্তন আসে না। দূর থেকে আগে যেখানে দেবাংশী কড়ই গাছটির মাথা নজরে পড়তো- সেখানে এখন তারামিয়ার টু-ইউনিট ফ্ল্যাটবাড়ির নীলপর্দা বাতাসে ওড়ে!
১৫ জুন ২০০১