কুমীরের মাথার ভেতর হাত ঢোকানোর যে কী শিহরণ- তা শৈশবেই টের পেয়েছিলাম! এই বক্তব্য কিছুটা প্রক্ষিপ্ত- কারণ আদতে তা ছিলো কুমীরের মাথার কঙ্কাল বা খুলি। এবং শহরবাসী হয়েও আমাদের এমন সুযোগ পাবার কথা নয়। কেননা, আমাদের জন্মের বহু আগেই কীর্তনখোলা নদীর কুমীর লোপাট হয়ে গেছে- ছিলো কতগুলো শুশুক। মামাবাড়ী যাবার সময় নৌকার গলুইয়ে বসে ওদের হুশ করে ভেসে উঠে মিলিয়ে যাওয়া দেখে দেখে গুনতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু কোনদিনই গুনে মেলাতে পারতাম না, কারণ সংখ্যায় ওরা ছিলো প্রচুর। একসাথে তিনচারটা কালো তেলতেলে শরীর নিয়ে লাফিয়ে উঠেই মিলিয়ে যেত। নৌকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে ওরা আসতো। মায়ের যন্ত্রণায় শান্তিমতো উপভোগ করার জো ছিলো না। তিনি নদীর পাড়ের মেয়ে হয়েও নিজে সাঁতার জানতেন না বলে নদীতে ডুবে যাবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে নৌকার ভেতর বসে থাকতেন। আমাদেরকেও আটকে রাখতেন। এহেন নিয়ন্ত্রিত শৈশবে একটি কুমীরের মাথা নিয়ে ‘গবেষণা’ করতে পারার সুযোগ নেহাত কম নয়। খেলাঘরের প্রদর্শনীতে এটা রাখা হয়েছিলো- আর আমার উপর সেটা ডেমনেস্ট্রেট করার ভার পরেছিলো। আমার শৈশব-কৈশোরকালের প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে খেলাঘর!শিশুদের ভেতরে সাংস্কৃতিক বিকাশের সাথে সাথে নিয়ম, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্ব তৈরি করতে এমন সংগঠনের বিপুল ভূমিকা ছিলো। নিয়মিত প্যারেড-পিটি, খেলাধুলা, গানবাজনার পাশাপাশি বছরান্তে একটি সম্মেলনের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। দুই বা তিনদিনব্যাপী লাগাতার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ‘ভাইবোনদের’ হাতের কাজের প্রদর্শনী করা হতো পাবলিক স্কুলের ঘরগুলো পুরোটা ব্যবহার করে। চেষ্টা করা হতো প্রতি বছরেই নতুন কিছু উপকরণ তৈরির। সম্ভবত আশি সালের কথা- সম্মেলনের আগের দিন শেখর দা কোত্থেকে যেন ঐ কুমীরের মাথাটা নিয়ে হাজির। স্থানীয় জালিয়াবাড়ীতে তাঁর বাড়ীর পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে খাল- যেখানে চারপাঁচটা পোষা উদ্বিড়াল সারাক্ষণ ডুবোডুবিতে ব্যস্ত থাকতো! শেখরদা নাকি খালে স্নান করতে নেমে ঐ কঙ্কালটা পেয়েছিলেন। এখন বুঝি, ওটা ছিলো একটা এলিগেটর বা মেছো কুমীর- নাকের ডগাটা অনেক লম্বা। কঙ্কালের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আমরা ওর অবশিষ্ট নড়বড়ে কয়েকটা দাঁত নিয়ে মজা করতাম। ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো ঐ কুমীরের মাথাটা। লোকজন ওটার পাশে ভিড় করে বিভিন্ন সম্ভাবনা ব্যক্ত করতেন। তৎকালীন নারীনেত্রী শ্রদ্ধেয়া মনোরমা বসু মাসীমা তাঁর বক্তৃতার শেষে এজন্য শেখরদাকে একশত টাকা বকশিস দিয়েছিলেন, এটা মনে আছে। কিন্তু এরপর কুমীরের মাথাটা নিয়ে কী করা হয়েছিলো তা আর জানতে পারিনি। খেলাঘরটিও কয়েকবছর পরে আস্তে আস্তে অকার্যকর সংগঠনে পরিনত হয়ে অবশেষে নেই হয়ে যায়। শত খুঁজেও আমরা এখন আর একটা কুমীরের মাথা জোগাড় করতে পারবো না…!