বিশ্বাস, আস্থা, শরীর, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ... এর বাইরেও আরও একটা জিনিস আছে মানুষ আর মানুষীর ভেতরে। কী সেটা, তা এই সময়ের মানুষেরা এখনো জানে না। তবে কেউ কেউ জানে মনে হয়। সেটার কোনো নাম নেই এখন। ভবিষ্যত পৃথিবী তাকে কোনো একটা নাম দেবে হয়তো। সে এক অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হবে তখন!
এক.
সৈকতের উথাল পাথাল পানি আর বালির নৃত্য আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কিনারায় এগিয়ে গিয়ে দীপান্বিতা সমুদ্রকে হুকুমের স্বরে বললো, “আয়, পা ধুয়ে দিয়ে যা!” আর পোষা এ্যালসেশিয়ানের মতো বালি শুঁকতে শুঁকতে সমুদ্র এসে হামলে পড়ে তার হুকুম তামিল করলো! একটু দূরে দাঁড়িয়া দৃশ্যটা দেখে হেসে ফেললো হৃদকমল। নিভে যাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বললো|
– দেখো সবাই সুন্দরের কীরকম তোয়াজ করে, দেখলে তো! অথচ আমার জ্বলন্ত সিগারেটটা এইমাত্র আক্রোশে নিভিয়ে দিলো নোনা বাতাস!
– তোয়াজ নয়, মুগ্ধতা!… আমি যেমন করে আদরমেখে সমুদ্রকে ডেকেছি, তুমি কি কখনো সেভাবে ডাকো? তোমার তো কেবল হম্বিতম্বি। মনে হয় যেনো সবাই তোমার কর্পোরেট কর্মচারি!
হৃদকমল অসহায় বোধ করলো। কী বলা যায় এখন? যে রোমান্টিক চিন্তাটা এতক্ষণ মাথায় গুনগুনাচ্ছিলো, ধুন্ধুমার কথা শুনে চিন্তারা সব এক নিমেষে হাওয়া! কিছু না বলে সে চুপ করে রইলো। তারপর অনেকক্ষণ ধরে শুধু ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। আর কোন শব্দ নেই, কথা নেই।
জলের দিকে এগিয়ে গেলো দীপান্বিতা, একা। ভেজাবালিতে শরীর শিরশির করে উঠলো তার। নীল জর্জেট শাড়ীর নিচের দিকের পাড় ভিজে আরো গাঢ় নীল দেখাচ্ছে। সরু ফিতের হালকা স্যান্ডেলটা জলসীমা থেকে নিরাপদ দূরত্বে শুকনো বালিতে অযুজ পায়ের ছাপের এবড়ো খেবড়ো অবয়বের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে। দূর থেকে মনে হয় দুটো প্রেমোন্মত্ত কাঁকড়া!
একটু আগে যে এ্যালসেশিয়ান কুকুরগুলো তার পা ধুয়ে দিয়েছিলো, তারা এখন ফিরে যাচ্ছে হেরে যাওয়া অনুর্ধ-সতের কিশোর ক্রিকেট দলের মতো। যেতে যেতে দূর থেকে ঘাড় ফিরিয়ে যেনো দেখছে দীপান্বিতাকে। তার মনে হলো, আরো, আরো দূরে, ঢেউয়ের ভেতরে কী এক রহস্যলাগা ইশারায় তরুণ ঢেউয়ের দল তাকে সামিল হতে ডাকছে। পরক্ষণেই একদল যুবকের উদ্বেলিত মিছিলের মতো অন্য আর এক স্তরের উন্মাতাল ঢেউ কিশোরদলকে মাড়িয়ে দিয়ে মারমুখি তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখতে পেয়ে দীপান্বিতা পিছু হটলো। পিছনে কারো গায়ে ধাক্কা লাগতে ফিরে তাকিয়ে দেখলো হৃদকমল তাকে দুহাতে পতন ঠেকিয়েছে।- ভিজে যাবে!
সংক্ষিপ্ত শব্দদুটো – যা অনেক অনেক অর্থময়তা তৈরিতে সক্ষম – সেটা উচ্চারণের সাথে সাথে সে দীপান্বিতাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে লাগলো। যেদিকে কাঁকড়াদুটো প্রেম করছে, তার উল্টোদিকে!
দুই.
টহলপুলিশের মতো এক একটা ঝাউগাছ যেখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে, তার সামনেই সামাজিক দূরত্ব রেখে অলস বিচকেদারাগুলো লম্বা লাইনে আধশোয়া – যেনো কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে বুকডন দিচ্ছে! দীপান্বিতা তার একটাতে সওয়ার হয়ে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিয়েছে। আর তার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে ছয়-সাত বছরের পুষ্টিহীন এক কন্যাশিশু লাগাতার কথা বলে যাচ্ছে। তার দুটো হাতও সমানে চলছে দীপান্বিতার ঘন চুলের ভেতর। এই পেশার উৎপত্তি বিচে খুব বেশিদিন নয়। সে একবার মেয়েটাকে কাজে লাগাবে কিনা ভাবছিলো, এথিক্সের যায়গা থেকে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, তার কাছ থেকে মেয়েটা যদি সহায়তা নাও পায়, তবুও ওর কাজ বন্ধ থাকবে না। মেয়েটা খুব দক্ষ হাতে কেবল যে তার চুলের গোড়া টেনে দিচ্ছে তাই নয়, সরুসরু আঙুল দিয়ে ওর কপালে এমন ফুলঝুড়ি কাটছে যে চোখ আরামে বুজে আসার মতো। কিন্তু দীপান্বিতা পূর্ণ সজাগ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা কী বলছে। ভাষাটা খুবই দুরূহ আর অস্পষ্ট! তারপরেও সে বুজতে পারছে, চুলটানার শুরুতে সে জিজ্ঞেস করেছিলো, স্কুলে যাসনা কেন্? সেই প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে এখন গত বিশ মিনিট ধরে ননস্টপ! ওটাই মেইনস্টোরি: হঠাৎ করে তাদের এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর নারকেল গাছ থেকে তার বাপের পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পাবার কারণে তাদের আট সদস্যর সংসারটা যে অচল, সেটাতো আছেই, তারসাথে সাইডস্টোরি হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে ওস্তাদের মারধরও ঠাঁই পেয়েছে!
বেশ কিছুটা সময় পার হবার পরেও দীপান্বিতার যখন চেয়ার ছেড়ে ওঠার নামগন্ধ নেই, বরং এখন – দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে হৃদকমল দেখতে পাচ্ছে – চোখ বন্ধ রেখেই মুখে খৈ ফুটছে তার! কী আজব, এরা কেউ কারো ভাষা বোঝেনা, অথচ কি সুন্দরভাবে নিজেদের মধ্যে ভাব করে নিয়েছে। যেনো কতোকালের পুরোনো জান পহেচান! হৃদকমলের ভীষণ হিংসা হলো দৃশ্যটা দেখে। হুহ্, রাজরানীর মতো শুয়ে আছে! তার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওই মানুষীকে জাগায়, এলোমেলো করে দেয়। কিন্তু তা সে কখনোই করবে না। করতে পারবে না। এক অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে যেনো, দুজনের মাঝে। কেউ কাউকে ঘাঁটাবে না। বিয়ের আগে লিখেছিলো একবার –
তুমি বললে যে কোনদিন ঈদ,
তুমি বললে সঙ্গে সঙ্গে ছুটি।
তুমি বললে সোম শুক্কুর বুধ,
অপেক্ষাতে কেবল মাথা কুটি!
উত্তরে মুখ টিপে দীপান্বিতা বলেছিলো, “মিথ্যুক!” আর এখন পুরো সম্পর্কটাই কেমন যেনো আঁশহীন, আশাহীন। দুজনেই দুজনের থেকে প্রাইভেসি চায়, একাকীত্ব খোঁজে। এক অসম্ভবের রাজ্যে তারা প্রেতের প্রেম নিয়ে পরস্পর সহাবস্থান করছে। সেই সহাবস্থানের নিরেট পাঁচিলে আচমকা চিড় ধরালো ওই প্রোমোশনাল প্যাকেজটা। বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রী লাক্সারি ট্রিপ…!
বিচের ডাব কখনো সোজাসাপ্টা নিয়মে কাটা হয়না। আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকবেই। এই প্রবণতা সে বিদেশের বহু বিচেও লক্ষ করেছে। এরা ডাব কাটে পেটের দিকটায়। তারপর একটা বাড়তি “ক্যানেলও” কেটে দেয় পান করা সহজ করতে। হয়তো এটাই ওদের কাছে সোজাসাপ্টা! আসলে মানুষ যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে যায়, সেটাকেই স্বভাবিক মনে করে। ওদের দুজনের সম্পর্কটা যেমন এখন সবার চোখে।
দুহাতে দুটো দশাশই কাটা ডাব নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটা বেশ কষ্টকর। বালির ওপর কাজটা অসম্ভবই বলা চলে। হৃদকমল ধীর গতিতে এলোমেলো পায়ে, দীপান্বিতা যেদিকে শুয়ে আছে তার মাথার দিক দিয়ে ঝাউবনের আবডালে হেঁটে এগোচ্ছে। তার একটু সংকোচও হচ্ছে, একটু আগে তেজ দেখিয়ে সে তাকে ফেলে হাওয়া হয়ে গেছিলো এটা দেখতে যে, তাকে ছাড়া মেয়েটা কী করে! কিন্তু যা ভেবেছিলো সেসব কিছু না করে, ছোট্ট পার্সটা, সেই পার্সের ভেতর রুমের কার্ড আর তার “পেগু-ইয়োমা” সেলফোন নিয়ে দিব্বি বিচকেদারায় হাওয়া খাচ্ছে মহিলা! অগত্যা ডাবের ছুঁতোয় ফিরে না গিয়ে উপায় কী?
ভোরবেলা যখন তারা বিচে এসেছে তখন কাঁকড়ার ছানাপোনারা সব লাইন দিয়ে গড়গড় করে জলে নামছে। মহাব্যস্ত এক একজন। ভাবেসাবে মনে হয়, পৃথিবীতে ওরাই একমাত্র কাজকর্মের বিষয়ে সিনসিয়ার। প্রায় ঘন্টাদুয়েক কাঁকড়ার দলবল ও তাদের গর্ত নিয়ে গবেষণা করে হৃদকমল অবশেষে এটা আবিষ্কার করতে পারলো যে, কাঁকড়ার গর্তে শুধুমাত্র কাঁকড়াই থাকে! আপনমনেই হাসলো সে। কাঁকড়ার ভঙ্গী নকল করে, পা টিপে টিপে যতোটা সম্ভব আওয়াজ না করে সে পৌঁছে গেলো বিচকেদারায় উপবিষ্টা মহারানীর কাছাকাছি। যেনো কিছুই হয়নি তেমন স্বরে, চোখ বন্ধ রেখেই দীপান্বিতা এক হাত তার দিকে বাড়িয়ে বললো, “দাও মহাদেব!”
তিন.
– মৃত্যু ঘটে যাবার পরে দুটো মানুষের জীবন কেমন কাটে?
– জানিনা!
– আমাদের যেমন কাটছে এখন…
– “আমাদের”? তুমি আর আমি মিলে?
– হা!
– তুমি আমার কে ছিলে, সেটা কি কোনোদিন হৃদয় দিয়ে বুঝতে চেয়েছ? বিশ্বাস, আস্থা, শরীর, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ… এর বাইরেও আরও একটা জিনিস আছে মানুষ আর মানুষীর ভেতরে। কী সেটা, তা এই সময়ের মানুষেরা এখনো জানে না। তবে কেউ কেউ জানে মনে হয়। সেটার কোনো নাম নেই এখন। ভবিষ্যত পৃথিবী তাকে কোনো একটা নাম দেবে হয়তো। সে এক অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হবে তখন! নিদারূণ স্বপ্নসাহসিক প্রকৃতির ফুলফলের মতো ঐশ্বর্যের মাধুরী হবে সেটা!! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে!!!! মানুষে মানুষীতে এতো সুদূরতম রহস্য লুকানো আছে এই গ্রহের জাঁহাবাজ জলহাওয়ায়? তাহলে মানুষ কেনো মরে যায়? কেনো সেই সঞ্জীবনী – যা মৃতের বুকেও ব্যাথা হয়ে বাজে – তার আবেশস্পর্শ্বে কালের কফিন থেকে মোহোগ্রস্তে ঘুম ভেঙে উঠে বসে না কেনো? অন্তরাত্মায় প্রবল ঝাঁকুনি দেয়ার মতো সেই সুখানুভূতি নিয়ে সুখী হতে পারেনা কেনো? মাঝে মাঝে নিজেকেই বলে এসব হৃদকমল। একজনকেইতো ভালোবেসেছিলাম, বড় দেরি করে, জিবনে…. সব হারানোর পরে, সব পাওয়ার মতো! এবং পেয়েছিও। তবু কেনো অধরা মনে হয়? কে যেনো বলে ওঠে, “আমাদের সম্পর্কের ভেতরে আঁশ তৈরি হয়নি।…মাঝখানটা ফাঁকা যে! একটা ছোট্ট কচিমুখ বড় দরকার আঁশ তৈরি করতে!”… কে কথা বলছে? দীপান্বিতা শুয়ে আছে ওইযে খাটের ওপর সাদা বালিশে তার চুলের গোছা পরিপাটি এলিয়ে রয়েছে। আর এখানে, এই ব্যালকনিতে সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়া খালি প্যাকেটের ভেতর থেকে রাংতা বের করে তার ওপর নখ দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে হৃদকমল!
– তোমার জন্য আমি একটা নাম ঠিক করেছি জানো?
– কি?
– লোকটা।
– বাহ দারুন তো!…কিন্তু আমি না তোমার মহাদেব? আবার ‘লোকটা’ কখন হলাম?
– এইমাত্র।…তোমাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকতে চাই!
– তাহলে আমিও তোমার আর একটা নাম দেবো।
– কি ডাকবে?
– ভুতি!
– ইশ্, কী বিচ্ছিরি নাম! আমি মরেই যাবো শুনলে।
– কেনো, নামটা খারাপ কোথায়? অনেক স্মার্ট। এই ভুতি!
– এই ডাব ছুঁড়ে মারবো তোমার কপালে!’ বলে সত্যি ছুঁড়ে মারলো ডাবটা নিজের মাথার ওপর দিয়ে পেছন দিকে, ঝাউবনের প্রহরা লক্ষ করে।
এসব দুপুরের ঘটনা। নাকি সকালের? হৃদকমল ঠিক মনে করতে পারে না। দৃশ্যগুলো ধারাবাহিকতা মানছে না। সব কেমন এলোমেলো। সে পৌঁছাতেই পিচ্চি মেয়েটা টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। হৃদকমল খুব হকচকিয়ে গেছে চোখবন্ধ দীপান্বিতা তার বুজরুকি ধরে ফেলেছে বলে। চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে সে অপ্রস্তুত, গম্ভীর হতে চেষ্টা করে। কিন্তু সামনে বসা সুন্দরী নারীপ্রতীমাটি ঠোঁট টিপে হাসছে। তার এই টিপিক্যাল হাসির অর্থ সে জানে। এর মানে হলো, কী, পারলে নাতো কর্পোরেট বুদ্ধিতে! আসলেও তাই, সে কখনোই দীপান্বিতাকে ইমপ্রেস করতে পারে না। চেষ্টা করতে গিয়ে বরং নাকাল হয়েছে! এবারও তাই হলো।
– তুমি দেখলে কী করে, আমি আসছি? মাথার পেছনেও চোখ নাকি আরশোলার মতো?
– হিহ্, কী বুদ্ধি!.. আমার দেখতে হবে কেনো?
– তবে কি পায়ের শব্দে?
– আরে নাহ্, আমার স্যাটেলাইট আছে না? বলে বাচ্চামেয়েদের মতো খিলখিল হেসে উঠলো দীপান্বিতা।
– মানে?
– আরে ওই পিচ্চিটা, চুল টেনে দিচ্ছিলো যেটা! তুমি রাগ করে চলে গেছো, ও খেয়াল করেছে দূর থেকে আগেই। আমাকে একা দেখে পটিয়ে ফেললো…পটরপটর করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিলো একদম!
– আমি তো দেখলাম, তুমিই পটর পটর করছিলে ওর সাথে!
মুখ মচকালো দীপান্বিতা। গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপর সাইক্লোনের ঠিক আগমুহুর্তে আবহাওয়া শান্ত হবার মতো স্বরে বললো, “আমার আর কী কী তোমার অপছন্দ? গিয়েছিলেতো শান্তাহার, পাত্তা পাওনি!”
শান্তাকে সে শান্তাহার ডাকে। সেসব সেই কবেকার কথা, ভার্সিটির যুগের। শান্তা এখন তিন বাচ্চার মা। ওজন একশত সত্তর পাউন্ড। কিন্তু দীপান্বিতা কিছুই ভোলেনি!
ব্যাঙ ডাকছে নিচে কোথাও। হৃদকমলের শীতশীত করছে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে ঠকঠক করে কাঁপলো। এসি চিল্ করে ঘুমোচ্ছে দীপান্বিতা। কম্বলটা ঠিক করে দিলো সে। দেখলো ঘুমন্ত মুখটাকে। চট্ করে একটা কচিমুখ ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেলো!
– আমি ওই পিচ্চিটাকে নিয়ে যাবো! পালবো ওকে মেয়ের মতো।
– কাকে?
– ওই যে চুলটানা-!
– কীসব বলোনা তুমি!
– কেনো, ময়লা জামাকাপড় আর দেখতে কালো বলে তোমার স্টাটাসে মিলবে না?
– দীপা!
– “চিৎকার করছো কেনো?” টলমল চোখে, মনে হচ্ছে এখুনি মরে যাবে।
– আরে, আমি কি তাই বললাম? ওর বাবামা কি দেবে নাকি ওকে?
– দেবে। আমি জানি, আমি চাইলেই দিয়ে দেবে।
– আচ্ছা! তাই নাকি?
– হ্যাঁ।
– জিজ্ঞেস করেছিলে?…তুমি তো ওর ভাষাই বোঝোনা। বলে হাসলো হৃদকমল, জিতে যাওয়ার হাসি। মুখটা পাথর করে ফেললো দীপান্বিতা। তারপর ঠিক ওই মেয়েটির স্বরভঙ্গী নকল করে ওই ভাষাতেই বলে উঠলো, “বুইজ্জিম ন খ্যান? বেগ্গুন বুস্তামফারি!” একটা বিট্ মিস করলো হৃদকমল। আর একটু হলেই তার হৃদপিন্ডের কমল ঝরে যাচ্ছিলো আরকি!
– মাইগড, তুমি ওদের ভাষা শিখে ফেলেছো?
– মহাদেব, তুমি সব ভুলে যাও, লোকটা! …ফাদার এ অঞ্চলে সাত বছর বদলি ছিলো আমি তখন তের, বলিনি তোমাকে?
– ও হো! ভুলে গেছিলাম!
– ইশ্ কর্পোরেট লোকটা! সব গুগলমামা জানে!হৃদকমল ভাবছিলো, সত্যিই দীপান্বিতাকে পুরোপুরি জানা তার এই জিবনে শেষ হবে না। ঘুমন্ত সুন্দর অবয়ব যা ই বলুক, সে তাকে কখনোই ছুঁতে পারে না। এমনকি তার শরীরের ভেতরমহল পর্যন্ত পৌঁছানোর পরেও মনে হয়, এই নারীসত্তাকে জয় করা হলোনা। কেনো এমন মনে হয়? আর সেই মনে হওয়াই তাকে দীপার কাছে সহজ হতে দেয় না। কম্বলের ভেতরে ডিম তা দেয়ার মতো ওম। তার ভেতরে রাতপোষাকে ভুতির উষ্ণ শরীর তাকে আরও চমকে দেয় যখন দুটো কোমল হাত তাকে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পরক্ষণে টের পায়, ঘুমের মধ্যে কেবল আশ্রয় খুঁজছে দীপান্বিতা, আর কিছু নয়! গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে আর একবার হৃদকমল ভাবে, সত্যিই কি তাদের সম্পর্কে কোন আঁশ নেই? এ্যাই ভুতি, ভুতি! সে ঘুমের ভেতর বিরবির করে!
চার.
লোকটার কথা একবর্ণও বুজতে পারলো না হৃদকমল। তবে দীপান্বিতার ক্রমাগত মাথা নেড়ে সায় দেয়া দেখে বুজলো ঠিক যায়গাতেই এসেছে। ঝুপড়ি ঘরের ভেতর আলোর স্বল্পতা আছে, তবু তার মাঝে বিছানায় শোয়া লোকটা যে হাড্ডিসার তা বোঝা যাচ্ছে। হাপড়ের মতো ফ্যাশফ্যাশ্ শব্দ করছে শ্বাস টানতে। কোমরে চোট পেয়ে বছরখানেক ধরে শয্যাশায়ী। গাছ থেকে নাকি পড়ে গেছে। তবে হৃদকমলের মনে হলো লোকটা এখনো দুবেলা নেশা করে। চোখদুটো সে কথাই বলে।এ অঞ্চলটা মাদকের স্বর্গ বলে পরিচিত!
নাকে হলুদ শিকনি নিয়ে একটা ছোট বাচ্চা মেঝেতে ট্যা ট্যা করে কাঁদছে। তার মা বস্তীর সামনের সরু রাস্তায় শুঁটকি শুকানোর ব্যবস্থা করছে। একটা আঁশটে গন্ধ পুরো এলাকা জুড়ে। বেগমবাড়ি বস্তী এটা। সেই ভোরবেলা ব্রেকফাস্ট সেরেই দীপান্বিতার চাপাচাপিতে তাকে বের হতে হয়েছে! বিচ মার্কেট থেকে কেনা স্যান্ডেলটা ভালোমতো ফিট করেনি। তার ওপরে ভেতরে বালি ঢুকে যাচ্ছেতাই অবস্থা! হাঁটাই দায় হয়ে গেছে। একে তাকে ধরে, নাম জিজ্ঞেস করে দীপান্বিতাই ঠিকানা বের করে আনলো মেয়েটার। তারপর টমটম, রিকসা এসবে ভাঙাচোড়া রাস্তাটা জোড়া দিয়ে দিয়ে তারা এসে পৌঁছালো নানিয়ার টেকের এই বস্তীতে। হৃদকমল গোম্ দিয়ে ছিলো সারাটা পথ। কোনো মানে হয়, একটা পুঁচকে মেয়েকে নিয়ে এসব বাড়াবাড়ির? কিন্তু সেটা এখন এই ভদ্রমহিলাকে বলতে যাওয়া, আর সেধে মাথায় বজ্রপাতকে দাওয়াত দেয়া একই কথা। ওড়নাটা দিয়ে মাথামুখ ঢেকে সানগ্লাসটা দিয়ে সূর্যদেবের কোপ থেকে নিজেকে ঠেকাতেই ব্যস্ত দীপান্বিতা। তার পোড়লফুলের মতো ত্বকে যেনো কোন দাগ না লাগে, সেটাই এখন একমাত্র প্রায়োরিটি। আর কোনো টেনশন নেই। খুশি খুশি ভাব। আশ্চর্য! তারা যে একটা ক্রাইমজোনে ঢুকে গেছে, লোকজন যে বিশেষভাবে নজর করছে তাদের, সেটা যেনো কোনো বিষয়ই না। তার আপ্তবাক্য হলো, মানুষের সাথে তুমি ভালো ব্যবহার করো, প্রতিদানে তুমিও সেটা ফেরত পাবে! হিক্! এইসব ফিলোসফি আজকাল চলে? পথেঘাটে সম্ভ্রান্ত মেয়েরাও আজকাল কীভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে, এতো দেখে, তারপরও যদি একটু শিক্ষা হয়।
বিছানার লোকটা, মানে ‘চুলটানা’র পিতৃদেব এখন উঠে বসার চেষ্টা করছেন। তারপর ওদেরকে অবাক করে দিয়ে তেলচিটে বালিশের নিচ দিয়ে দীপান্বিতার নেকলেসটা বের করে বাড়িয়ে ধরলো তার দিকে। হৃদকমল এতো অবাক হলো যে তার চোয়াল ঝুলে পড়লো!
এই অরিজিন্যাল ন্যাচারাল পার্লের মালাটা সে এনেছে ফিলিপাইনের দাভাও আইল্যান্ড থেকে, যেখানে চাষ নয়, প্রাকৃতিকভাবে মুক্তো আহরণ করা হয়। অফিসের রিট্রিট ছিলো। শো রুমের আটসাঁটো
পোশাকের মেয়েটা চ্যাপ্টা একখানা হাসি দিয়ে বলেছিলো, স্যর, ইয়োর ওয়াইফ মাস্ত্ বি বেরি লাকি। উই কালেক্তেদ দিস পার্র নেকলেস লাস্ত নাইত! সেই জিনিস ওই লোকটার বালিশের নিচে গেলো কী করে? ভাবার আগেই হৃদকমল বিষয়টা আন্দাজ করে ফেললো। কখনো কখনো মাথা খুব দ্রুত কাজ করে। সে চোয়াল শক্ত করলো আর দীপান্বিতা চট করে তার হাত ধরে ঝুপড়ির বাইরে টেনে নিয়ে এলো।
– পিচ্চিটা কৈ? তোমার গলা থেকে খুলে নিলো টের পাওনি?
– পাবোনা কেনো? পেয়েছিতো।
– মানে?…. দেখো সবকিছুর একটা…!
– আহ্ আস্তে কথা বলো, সুলতানা শুনে ফেলবে।
– সুলতানা কে?
– ওই মেয়েটা, তুমি যাকে আদর করে চুলটানা ডাকো!… কিছু বোলোনা এখানে প্লিজ।… এই নাও তোমার মূল্যবান সম্পদ! বলে নেকলেশটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে, শুঁটকি শুকানো মহিলার সাথে কথা বলতে শুরু করলো।
হৃদকমলের এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে কেনো কে জানে? নিজের বৌকে কথা শোনাতে না পারায় যে যন্ত্রণা, তা কে বুজবে?
পাঁচ.
বিকেলে পুরো দু’ঘণ্টা নিজেকে সাজালো আজ দীপান্বিতা। সাজের ব্যাপারে মেয়েদের এই সহজাত প্রবণতা নিয়ে বহুবার ভেবেছে হৃদকমল কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারেনি। পারবে কি করে, সাজগোজ নিয়ে কোনকিছু বলতে গেলে দীপান্বিতার সাথে মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এতো এতো উপকরণ একটার পর একটা ব্যবহার করে শেষমেষ যখন সে সামনে এসে দাঁড়ায়, হৃদকমল তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পায়না। মনে মনে বলে, আগেই তো ভালো দেখাচ্ছিলো! কেবল নতুন শাড়ি, পারফিউম, বডিস্পে আর চুলের কস্তুরীঘ্রাণ হৃদকমলের মাথায় সম্মিলিত নীল মেঘের বারুদ তৈরি করে! সেই বারুদ কখনো জ্বলে ওঠার সুযোগ পায়না দীপান্বিতার মুখ ঝামটার কারণে। হ্যাংলার মতো তাকানো সে একদম পছন্দ করে না। তবুও আড়চোখে তাকালে মনে হয় কিছুই সে মাখেনি। দীপান্বিতাকে সেটা বলতেই সে হিহি করে হেসে ওঠে; তারপর রহস্যমাখা চোখের ঝিলিক তুলে আরো বেশি রহস্য সৃষ্টি করে সে চুপ হয়ে যায়। হৃদকমলকে কিছুই বুঝতে দেয়না। পুরুষমানুষকে সব বুঝতে হবে কেন? মেয়েরা তাদের জাদুময়তা আড়াল করেই তো রাখবে।বুঝে ফেললে আর রহস্য রইল কই? একজন জাদুকরের পেছনের কারিকুরি যদি আমরা জেনেই যাই, তাহলে সে জাদু কি আর দেখতে ভালো লাগে?
আজ অবশ্য তেমন বেশি সাজে নি সে, তবে অনেক আগ্রহ নিয়ে, অনেক সময় নিয়ে গুনগুনিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। মনটা ভালো লাগছে আজ। বিয়ের পরপর যেমন লাগতো। মাঝখানে একটা যুগ চলে গেছে, তা যেন হিসেবই নেই। মনের ভেতর কেমন একটা তোলপাড় করা সুখ। নিজেকে এখন ভাগ্যবতীও মনে হচ্ছে হৃদকমলের মত স্বামী পেয়েছে বলে। লোকটা খুবই নিরীহ আসলে। একটু ভীতু হলেও মন পরিষ্কার। দীপান্বিতাকে সমঝে চলার চেষ্টা করে। এতোদিনেও যে তাকে একটা সন্তান দিতে পারেনি এ নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। বরং এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে গেলে হৃদকমল নিজেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলে, যাতে দীপান্বিতা কোন হীনমন্যতায় না ভোগে। অনেকবারই সে তাকে বলতে চেয়েছে, চলো একটা সন্তান দত্তক নেই। কিন্তু বলতে গিয়ে নিজেই কেমন নিজের কাছে আটকে গিয়েছে। বলা আর হয়ে ওঠেনি। আসলে কিছু কথা আছে, যা বলা এত সহজ নয়। যুদ্ধটা দীপান্বিতার নিজের সাথে নিজের। ফার্টিলিটি সেন্টারের ডঃ রামেশ্বরম অবাক হয়ে বলেছেন, বোথ অফ ইউ সিমস এ্যাবসল্যুটলী এলিজিবল। আই ডোন্ট ফাইন্ড এনি প্রবলেম মিসেস কমল। হিজ স্পার্ম কাউন্ট এন্ড ইওর মেচুরেশন অব এগ্স, অল আর প্রীটি নরমাল। দীপান্বিতা তখন তার ওভারিয়ান সিস্ট এর কথা বলে। ডক্টর হাসেন। এটা কোন বিষয়ই না। একটা বয়সের পর সব মেয়েদেরই কমবেশি জরায়ুতে সিস্ট থাকে, কিন্তু সেজন্য গর্ভধারণে সমস্যা হবার কথা না। সায়েন্স হ্যাভ বিন ডেভেলপ্ড এ লট্, বাট স্টিল, দেয়ার মাস্ট বি সামথিং রিমেইন বিটুইন হেভেন এন্ড আর্থ; হুইচ উই, দ্যা ব্লাডি মেডিকেল ডক্টরস্ কেন্নট রিভিল! তিনি দার্শনিকের মতো বলেন। আজকের দিনে, যখন সে মনস্থির করে ফেলেছে সুলতানাকে নিয়ে যাবে, তখন এসব সে মনে করতে চায়না। গত বারো বছরে বহুবহু বার সে আশা করেছে আর প্রতিবার অনেক উঁচু থেকে পাথরের মেঝেতে আছড়ে পড়ার মতো, ভীষণ জোড়ে লেগেছে সে পতন! দীপান্বিতা জোর করে সুখের কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে চাইলো।
আজ নানিয়ার টেক থেকে ফিরতে দুপুর হেলে গিয়েছিলো। দূরত্ব কম নয়। কিন্তু শান্তনা হলো হৃদকমলকে ম্যানেজ করা গেছে। ম্যানেজ হয়েছে সুলতানার মা-ও। হবারই কথা। মেয়েটাকে ঢাকা নিয়ে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু তার আগে ওর রুক্ষু চুলের জট আর তার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা উকুনের বংশ শেষ করতে হবে। কী শুকনো আর কাঠির মতো হাত পা। আহা, কতোদিন ভালোকরে খায়নি ওরা। ওর মার হাতে দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলো সে এমনিতেই। মহিলা যে কারণ বললেন তা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো! নেশার জন্য স্বামী এই টাকা দুদিনেই শেষ করে ফেলবে। তারচে ওরা যদি সুলতানাকে নিয়ে যায়, তাহলে সেটাই বড় উপকার হবে। কথা বলতে বলতে দীপান্বিতার চোখ খুঁজছিলো সুলতানাকে। কোথাও নেই সে। থাকার কথাও নয়। নেকলেসটা চুরি করার লজ্জায় সে কাছে আসবে না। কিন্তু দীপান্বিতা জানে, সুলতানা আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। লুকিয়ে দেখছে ওদের। ওর মা বেশ কবার ওকে ডাকলো ওদের সামনে, তারপর জানালো, মেয়ে গত রাতেই তাকে ওদের কথা বলেছে। নেশার জন্য সন্তানদের চুরি করতে বলে ওদের বাবা। না করলে মারে তাদের মাকে। এ অবস্থায় বাচ্চাগুলোর চুরি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে র্দীঘশ্বাস গোপন করলো দীপান্বিতা। ফিরতি রিকসায় উঠে হৃদকমলের মান ভাঙানোর স্বরে বললো,
– লোকটা, তোমার দেয়া নেকলেস কি আমি হারাতে পারি?
– এতো নাটকের কী দরকার ছিলো বলোতো?
– কী বলছো, নাটক কেনো হবে?
– পুলিশকে বললেই তো…
– ছিঃ ওইটুকু বাচ্চা। ও কি বুঝে এসব করে? চকচকে জিনিস দেখে ভালো লেগেছে, খুলে নিয়েছে। শুনলে না, ওর মা কী বললো… ও হো, তুমি তো বোঝোনি। ওর বাবা নেশা করার জন্য বাচ্চাগুলিকে দিয়ে চুরি করায়!
– জানি!
– কিভাবে জানলে?
– লোকটার চোখ দেখে।… তুমি আমাকে যতো বোকা মনে করো, আমি ততোটা নই দীপা। জানি আমি তোমার পছন্দের পুরুষ হতে পারিনি। কিন্তু…
– বাব্বাহ। এতো অভিমান? তা চালাক মশাই, আপনার বুদ্ধির একটা প্রমাণ দিন তো। কী করে পিচ্চিটার ভয় ভাঙাতে পারি বুদ্ধি দিন না।
– বুদ্ধি দেয়ার কিছু নেই। সে আমাদের সাথেই আছে!
– মানে?
– পিছনে তাকিয়ে দেখো, রিকসার পেছনে বাদুড়ঝোলা হয়ে সে আমাদের সাথে সাথেই যাচ্ছে!
দীপান্বিতা চট করে পেছনে তাকাতেই পিচ্চিটা চলন্ত রিকসা থেকে লাফিয়ে নেমে গেলো। রিকসা থামিয়ে তাকে পাকড়াও করলো ওরা । কেন্নোর মতো সিঁটিয়ে গেছে লজ্জায়। আবার বুজতে পারছে, এই পরিস্থিতি থেকে ওরাই তাকে উদ্ধার করতে পারে। মেয়েটার হাতে একটা সস্তা ঝিনুকের মালা। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। দীপান্বিতা ওর পাশে বসে পড়ে সুলতানার চিবুক ধরে উঁচু করলো। কচি কালো মুখে ধূলো আর ঘাম। তার ভেতর দিয়ে চোখের জলের ধারা নেমে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট। হৃদকমলের বুকটা ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠলো কেনো কে জানে! পরক্ষণে যে দৃশ্য দেখলো তা দেখতে ভাগ্য লাগে নিশ্চয়ই। সুলতানা দু হাতে তার ঝিনুকের মালাটা দীপান্বিতাকে পড়িয়ে দিলো। তারপর ফিক করে হাসলো লাখটাকা দামের হাসি। মুক্তোর মতো একসারি দাঁত। কী স্নিগ্ধ লাগছে বাচ্চাটাকে! মেয়েটা যাতে ওকে জড়িয়ে ধরতে না পারে, তার আগেই ওর শীর্ণ হাতদুটো ধরে ফেললো দীপান্বিতা। এতো মায়া সে সামলাতে পারবে না। রাগী চোখ তুলে বললো, এই তুই আমাকে মা ডাকবি? উত্তরে সুলতানা বললো,
– আঁই তোয়ার পোয়ারে যাইয়াম! আমি তোমার সাথে যাবো। আর একই কথা বারবার বলতে লাগলো। হৃদকমল ভেবে পেলোনা, কতোটা মনের জোরে দীপান্বিতা পুরো বিষয়টা সামলালো। মনে মনে শ্রদ্ধা এসে গেলো তার ওর প্রতি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিলো, সুলতানা যাবে ওদের সাথে!
ছয়.
রেডি হয়ে হ্যান্ডব্যাগে কনুই গলিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে উল্টো তাড়া দিলে হৃদকমলকে, “কই চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে!” গাঢ় সবুজ জমিনের শাড়িটা অনেক কায়দা করে পড়া হয়েছে। কায়দাটা কি, সেটা বোঝা হৃদকমলের মতো আনাড়ী মানুষের পক্ষে বস্তুত সম্ভব নয়, কারণ কায়দাটা আসলে শাড়িতে নয়, ব্লাউজে! ময়ুরকন্ঠী নীলের সাথে সোনালী জর্জেটের সরু স্টেইট লাইনিং লাগানো থ্রি কোয়াটার স্লিভের ব্লাউজটি কাটার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাস্টারের বিলক্ষণ অসতর্কতা ছিলো বোঝা যায়! মাগোহ! মনে হচ্ছে জয়সলমীরের কেল্লা থেকে এইমাত্র ডাউনলোড হয়েছেন স্বয়ং রানীসা! ক্কী মারদাঙ্গা লাগছে দীপান্বিতাকে! বাপরে বাপরে বাপরে বাপ!… অন্যসময় হলে নির্ঘাৎ মুখঝাপটা বরাদ্দ ছিলো, কিন্তু আজ ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো সে নিজেই। হৃদকমলের পুরুষচোখের সামনে জড়তা নিয়ে আঁচল ঘুরিয়ে নিজেকে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। শাড়ী: একটি বিপদ-আহ্বানী পোশাক, ভাবলো সে। যা যা তুমি আড়াল রাখতে চাইছো, ঠিক সেসবই মানুষের সামনে আরও প্রকট হয়ে উঠবে। তবু সে শাড়ী পড়তে ভীষণ পছন্দ করে। হৃদকমলের আড়ে আড়ে তাকানোর ভঙ্গীতে সে আরও বেপরোয়া বোধ করলো। মুখের ভাব কোমল করে স্বামীর দিকে তাকালো সে। আরে, কফি রঙের চোখের মনিদুটোতে এতো মায়া! আগে তো কখনো খেয়াল হয়নি এমন করে? আর বাবু কী পড়েছেন আজ? দীপান্তিতা ইঞ্চি বাই ইঞ্চি হাজবেন্ডকে মাপতে লাগলো। ব্যাস্ পুরোদস্তুর ইভনিং এ্যাটায়ারে তৈরি তিনি। কালো স্যুটের সাথে রূপালি রেশমি রুমাল তিনকোনা উঁকি দিচ্ছে। সাথে গাঢ় নীল শার্টের সাথে স্লিম টাই। কর্পোরেট আদমি তো, এসব পার্টি ওরা ভালোই বোঝে, ভাবলো দীপান্বিতা। চোখে ভালোবাসার আলো ছড়িয়ে সে স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরলো।
– কুপনটা নিয়েছ? দেখোতো কী লেখা আছে।
– কী আর থাকবে; আগডুম বাগডুম সব। লিখেছে ডিনার এ্যাট সাম্পান। ড্রেসকোড পর্যন্ত বলা আছে। আর আছে র্যাফেল ড্র, ফর হানিমুন কাপল। মানে আমরা!
এক নিশ্বাসে সে বলে গেলো রসগোল্লার মতো চোখ করে। হানিমুন কাপল শুনে ওর বাহুতে আলতো ঘুষি মারলো দীপান্বিতা।
– ইশ্ কী কাপলের ছিরি! …আচ্ছা, সাম্পান লিখেছে কেনো?
– আগে চলো তো, গেলেই বোঝা যাবে। …হয়তো ওদের রুফটপ রেস্টুরেন্টের নামই সাম্পান। নতুন রিসোর্ট, প্রমোশনাল কতো কিছুই তো করবে।
কিন্তু গিয়ে ওদের ভুল ভাঙলো। রুফটপ নয়, জলজ্যান্ত সাম্পানেই ব্যবস্থা রয়েছে। রিসোর্টের প্রাইভেট বিচে নোঙর করে রাখা হয়েছে, যাতে জোয়ারের জলে ভেসে না যায়। কাঠের প্রশস্ত পাটাতনের ওপর সিলেক্টিভ গেস্টদের জন্য সুন্দর বসার ব্যবস্থা। একপাশে ইন্সট্রমেন্টসহ লাইভ মিউজিকের বন্দোবস্ত। আর আছেন, স্টান্ডিং কমেডিয়ান রাফি আব্দুল্লাহ। যিনি ইতোমধ্যে নিজেকে আবদাল্লা ঘোষণা করে মর্জিনার খোঁজ করছেন। বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকালো দীপান্বিতা। এই ভাঁড়টাকে দেখলে গা জ্বলে। কেনো যে সবাই ওকে সেলিব্রিটি বলে কে জানে? তার বিরক্তিভাব বুঝে গেলো হৃদকমল। কোত্থেকে একটা জুসের গ্লাস ধরিয়ে দিলো ওর হাতে। দীপান্বিতা এটুকুতেই কৃতজ্ঞতা বোধ করলো। তারপর আস্তে আস্তে হালকা গিটারের টুংটাং আর জলের শব্দ তার মনকে তরল করে ফেললো। খাবার পরিবেশনের আগে র্যাফেল ড্রতে হানিমুল কাপল হিসেবে তারা সত্যি সত্যি পেয়ে গেলো পুরষ্কারটা। কী আজব ব্যাপার। অনেক সুন্দরী আর হ্যান্ডসামের ভিড়ে তারা কী করে নজরে পড়লো? তখন আকাশের নীল অন্ধকার চিরে হাউই উড়ে গেলো হুস করে। আতশবাজীর বহুবর্ণি ল আলোকছটায় সারা সাগর আর আকাশ যেনো হাজারফুলে ভরে উঠলো। হৃদকমলের একহাতের বেষ্টনীর ভেতর সে দেখলো সবাই ওদের সুখীমুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর করতালি দিচ্ছে। সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ, পুরো পার্টিতে কেউ নিজের প্রতিভা দেখাতে গান গেয়ে ওঠেনি। স্যাক্সোফোন আর এ্যাকর্ডিয়ানের যুগলে বাজছিলো জ্যাজ। দীপান্বিতার মনে হচ্ছিলো এসব সত্যি নয়, হয়তো কোনো নিষ্ঠুর সুন্দর স্বপ্ন এটা, যা যেকোন সময় ভেঙে যাবে। হৃদকমল তার পাশেই আছে, কিন্তু কেনো যেনো তাকাতেও সঙ্কোচ হচ্ছে এখন। বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। অস্ফুটে চলে যাবার কথা বলতেই হৃদকমল বাধ্যপুরুষের মতো সায় দিলো। ঘোর লেগে আছে তার চোখেও।
কীকরে তারা রুমে ফিরেছে জানে না। তবে হৃদকমল যে তাকে পুরোটা সময় একহাতে জাপ্টে ধরে ছিলো, সেটা মনে আছে। রুম বন্ধ হবার আগে, লিফটেই তাদের দুজনের ঠোঁট লেগে গেলো। দীপান্বিতার মুখ দিয়ে ফোঁপানির মতো কান্না বা কান্নার মতো ফোঁপানির শব্দেও হৃদকমলের সম্বিত ফিরলো না। তারা নিজেদের বিছানার ওমের ভেতর আবিষ্কার করলো। দীপান্বিতার পিঠ কেবল ডাঙায় ওঠা শুশুকের মতো খাবি খাচ্ছে আর মিশরের রাণীর মাথায় ফণাতোলা সাপের মতো তার চকচকে অনাবৃত বাহুদুটো কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরছে হৃদকমলের মাথার দুপাশের চুল। কেঁপে কেঁপে ওঠা দুটো স্যাক্সোফোন আর এ্যাকর্ডিয়ান একটু পর একই তালে বাজতে লাগলো দ্রুতলয়ে, ক্রমাগত। শরীরের আগ্রহ এতোদিন তাদের কাছে এক যান্ত্রিক যোজনা ছিলো। একটা কচিমুখের প্রত্যাশায় যা সমর্পিত হতো। প্রকৃত শরীর তাদের ছেড়ে গেছে বহুদিন। আজ সাম্পানের ঢেউয়ের তালে সে সৈকতে আবার জোয়ার এসেছে। ভাসিয়ে নিচ্ছে দুজন অর্ন্তমুখি মানুষের জমে থাকা বরফের চাঁই! বরফযুগের শেষ প্রান্তে দীপান্তিতা শুনতে পেলো কোন গভীর অতল পাতালের নিচ থেকে হৃদকমল ডাকছে তাকে, ভূতি, এই ভূতি! কিন্তু সে ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বুজলো সে বহু আগেই নিস্তেজ ঘুমে তলিয়ে গেছে!
বেলা করে ঘুম ভাঙার কথা ছিলো। ভাঙলোও। কিন্তু সেটা লোকাল থানার ফোন পেয়ে। ডিউটি অফিসার নয়, ওসি সাহিদুর রহমান তাদেরকে মর্গে যেতে বললেন। মেয়েটার হাতে নাকি আঁকড়ে ধরা ছিলো হৃদকমলের কার্ড। আর এমন ঘটনাগুলো যেভাবে মোড় নেয়, এটাও সেভাবে সেভাবেই মোড় নিলো। প্রথমে ছোট নিউজ, তারপর সোশাল মিডিয়া, তারপর টিভির ব্রেকিং নিউজ এবং অপরাপর সবকিছুই ঘটলো খুব নিয়মতান্ত্রিক ভাবে। হৃদকমল পুরো সময়টা দীপান্বিতাকে চেয়ে চেয়ে দেখলো। বার বার শক্ত পাথরে আছাড় খেতে খেতে ওর কোন বিকার নেই যেনো। গ্রানাইট পাথরের মতো খোদাই করা মুখ নিয়ে সে হাসপাতালের মর্গে সুলতানার লাশ হয়ে যাওয়া শরীরটা দেখলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মরে গেছে বাচ্চাটা। অপুষ্ট হাতদুটো কাঁকড়ার মতো আকাশ ধরতে শক্ত হয়ে আছে। সারা শরীরে আঁচড় কামড়ের দাগ যেনো একশো শ্বাপদ তার শীর্ণ শরীরটাকে নিয়ে উল্লাসে লোফালুফি খেলেছে। টহলপুলিশের মতো সেই গুন্ডাগুন্ডা ঝাউবনের ভেতর পাওয়া গেছে ওর নিথর দেহটা।
থানা থেকে সকল ফর্মালিটি শেষ করে, এমনকি সুলতানার নেশাখোর বাপকে এ্যারেস্ট করে একপ্রস্থ ধোলাই দেয়া হয়েছে, এই সবকিছু শোনার পরেও দীপান্বিতার মুখাবয়বে কোন শূণ্যতা খেলা করলো না। সে যেনো পণ করেছে, জীবনের কোন ঘটনাতেই ভেঙে পড়বে না, চমকাবে না। থানার গেট থেকে বের হয়ে ওরা রিকশা নিলো। সাহিদুর রহমান গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। দীপান্বিতা নিষেধ করেছে। রিকসায় কিছুদূর যেতে যেতে, যেনো খুবই স্বাভাবিক কোন প্রশ্নের মতো সে হৃদকমলের হাতটা ধরে নাড়া দিয়ে বললো, দেখোতো, রিকসার পেছনে কেউ ঝুলছে কিনা!
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো হৃদকমল। আঁই তোয়াঁর পোয়ারে যাইয়ুম! কচিকণ্ঠটা কানে কানে বলছে! (সমাপ্ত)